তোমার মাঝে(২),পর্ব_১০,১১

0
2555

তোমার মাঝে(২),পর্ব_১০,১১
সারিফা তাহরিম
পর্ব-১০

—”আফা আমনেরে মেহেরাব ভাইজান ডাহে।”

আমি আর নিশাত কথা বলছিলাম তখনই ভার্সিটির এক কর্মচারি রহিমা আপা এসে আমায় কথাটি বললেন।

রহিমা আপার কথা শুনে বিরক্তিতে আমার কপাল কুচকে গেল। মেহরাব কি আমাকে কখনো শান্তিতে থাকতে দিবে না। ব্রেক টাইমের পরে একটা ক্লাস হয়েছিল। এরপরের দুটো ক্লাস অফ। একেবারে লাস্ট ক্লাস আছে। ক্লাসটি শেষ হওয়ার পরে নিশাত ওয়াশরুমে যাবে বলেছিল। আমি যেতে না চাইলেও আমাকে জোর করে নিয়ে যায়। একটু মুখে পানি দিয়ে বিষন্ন ভাবটা কিছুটা কাটিয়ে তুলে একটু হাসলাম। তারপর আমি আর নিশাত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ক্লাসের দিকে যেতে লাগলাম। কয়েকটা ক্লাসরুম পেরিয়ে সিড়ির কাছে আসতেই সেখানে মেহরাবকে দেখতে পাই। মেহরাব আমার সাথে কথা বলার জন্য আমার সামনে আসার আগেই আমি দ্রুত নিশাতকে নিয়ে ক্লাসে চলে আসলাম। এখন আবার রহিমা আপাকে দিয়ে ডাকিয়েছে। কিন্তু আমি তো যাব না।
যতো যাই হয়ে যাক আমি আর কখনো মেহরাবের সামনে যাব না। তাই রহিমা আপাকে বললাম,,

—”আচ্ছা ঠিক আছে আপা। এখন আপনি যেতে পারেন।”

—”আইচ্ছা।”

রহিমা আপা যাওয়ার পরে নিশাত কৌতুহলী চোখে আমার দিকে তাকিয়ে খানিকটা অবাক কন্ঠে বলল,,

—”ভার্সিটির টপার বয় মেহরাব না? উনি তোকে ডেকেছেন? কিন্তু কেন?”

—”তা কি উনি এসে আমার কানে কানে বলে গেছিলেন যে উনি আমায় কেন ডেকেছেন? যত্তসব ফাউল। আরে ভাই আমি কিভাবে জানব যে উনি আমাকে কেন ডেকেছেন। “(চরম বিরক্তির সাথে কথাগুলো বললাম আমি)

—” তা না জানলে ভ্যাবলার মতো এখানে বসে আছিস কেন? যা গিয়ে দেখে আয় কি জন্য ডেকেছেন।”

—”উফফ নিশু বন্ধ করবি তোর এই পকর পকর। ভালো লাগছে না আমার। তোর এইসব জ্ঞান শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা আমার নেই। আমি কোত্থাও যাব না এখানেই বসে থাকব। তোর যদি ভালো লাগে তাহলে থাক আর নাহলে আল্লাহর ওয়াস্তে আমার সামনে থেকে যা। তারপরও ওখানে যাওয়ার কথা আমাকে বলিস না প্লিজ।” (খানিকটা চিল্লিয়ে কথাগুলো বললাম আমি)

—”ওকে ওকে। শান্ত হ তুই। আর বলবো না এখানেই বসে থাক। মেজাজ ঠান্ডা কর আর একটু পানি খা। ”

নিশাত আমাকে পানির বোতল এগিয়ে দিতেই আমি তা নিয়ে অল্প পরিমাণ পানি খেলাম। বেশ কিছুক্ষণ ওভাবেই চুপচাপ বসে ছিলাম। এর মধ্যেই রহিমা আপা আরও দুবার ডেকে গেছেন। কিন্তু আমি যাই নি। একটু পরে ২য় বর্ষের এক ভাইয়া ক্লাসে ঢুকে বললেন,,

—”তোমাদের মধ্যে তিতলি কে? তাকে বক্কর স্যার ডাকছেন।”

কথাটি বলেই ভাইয়াটি সেখান থেকে বের হয়ে গেল। নিশাত আমাকে বলল,,

—” এবার আলুর বস্তা ডেকেছে। এবারও কি না গিয়ে এভাবে বসে থাকবি নাকি?”

আমার মুখে এক রাশ বিরক্তি জায়গা করে নিল। আজ সকালে আমি কার মুখ দেখে উঠেছিলাম আল্লাহ জানে। সারাটা দিনই ফালতু যাচ্ছে। একেকবার একেকজন ডাকছে। উফ আজকে কি ডাকাডাকি দিবস না কি? না তাহলে তো সবাইকেই ডাকা হতো। কিন্তু আজ তো শুধু আমাকেই ডাকা হচ্ছে। এখন আবার এই আলুর বস্তা ডাকছে। কপালে কি লিখা আছে তা আল্লাহ ছাড়া কেউই জানে না। আচ্ছা গিয়েই দেখে আসি কি হয়েছে।

আমি বক্কর স্যারের চ্যাম্বারের সামনে গিয়ে দেখতে পেলাম বক্কর স্যারের মুখোমুখি আমার জমরাজ স্বয়ং মেহরাব রায়ান চৌধুরী বসে আছে। আমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে এইসব মেহরাবেরই কৃতকর্ম। উনাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে উনি বেশ রেগে আছেন। আমার সাথে নিশ্চিত কিছু একটা ঘটতে চলেছে,, ভাবতেই কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। কিন্তু নিজেকে স্ট্রং করে স্যারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললাম,,

—”স্যার আসতে পারি।”

—”হ্যাঁ। ভিতরে আসো।”

অনুমতি পেতেই আমি ভেতরে ঢুকলাম। তবে এমন ভান করলাম যে মেহরাব এখানে বসে আছে তা আমি সম্পূর্ণ ইগনোর করছি।

—”আসসালামু আলাইকুম স্যার। ”

—”ওয়ালাইকুম আসসালাম। বসো।কেমন আছো? ”

স্যারের এমন মধুর কথা শুনে আমি খানিকটা অবাক হলাম। তবুও স্বাভাবিকভাবেই বললাম,,

— ” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি স্যার। আপনি কেমন আছেন? ”

—”এইতো আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তা গতকাল আসো নি কেন?”

—”স্যার খুব মাথা ব্যাথা ছিল তো তাই।”(এই প্রশ্নগুলো করার পিছে যে মেহরাব আছে তা আমার খুব ভালো করেই জানা আছে।)

—”ওহ। আচ্ছা শুনো তোমাকে যেই জন্য ডেকেছি… মেহরাবের একটা প্রজেক্টের কাজ আছে আর ওখানে একজন কম আছে। তাই ও চাইছে তোমাকে সেই কাজ দেওয়ার জন্য। আর আমারও মনে হয় কাজটা করলে তোমারও অভিজ্ঞতা বাড়বে।”

—”(যা ভেবেছিলাম তাই হচ্ছে। এগুলো প্রজেক্ট না সব মেহরাবের কারসাজি। তবে আমার এই জালে ফেসে গেলে হবে না) জি স্যার কাজটা করতে পারলে আমারও ভালো লাগত। কিন্তু স্যার আমার বাসায় আজ কিছু কাজ আছে বড় মা কে নিয়ে ডক্টর এর কাছে যেতে হবে তাই আজ তারাতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। তাই আমি কাজটা করতে পারছি না। আমি খুবই দুঃখিত।

—”ওহ তাহলে কি আর করার। তুমি নাহলে মেহরাবের সাথেই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে দেখ। অন্য কোন সময় ফ্রি থাক কি না দেখ আর তোমরা আলোচনা করো।”

—”জি স্যার আমি পরে কথা বলব। স্যার আজ তারাতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। তাই আজ আমি উঠি।”

—”আচ্ছা ঠিক আছে যাও।”

—”আসসালামু আলাইকুম স্যার। ”

আমি স্যারকে সালাম দিয়ে মেহরাবকে ইগনোর করে বাহিরে বের হয়ে এলাম। কিছু দূর যেতেই হাতে টান অনুভব করলাম। পিছে ফিরে দেখি মেহরাব মুখ শক্ত করে আমার হাত ধরে দাড়িয়ে আছে। তার মুখে রাগ স্পষ্ট। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললাম,,

—”হাত ছাড়ুন।”

—”আগে বলো কি হয়েছে? গতকাল ভার্সিটিতে আসো নি। আজ সকালে দেখেও না দেখার ভান করে চলে গেছ। এতবার ডেকেছি তবুও আসো নি। আমাকে ইগনোর করছো। কেন? কিসের জন্য তোমার এই ইগনোরেন্স?”

—” আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে হাত ছাড়ুন।”

—” আগে বলো কেন এতো কষ্ট দিচ্ছ? কেন এতো পোড়াচ্ছ? কেন আমায় ইগনোর করছো? বলো। আমি তোমার ইগনোরেন্স মেনে নিতে পারছি না।”

—”বলেছি তো আমার তাড়া আছে, যেতে হবে। হাত ছাড়ুন।”

কথাটি বলার সাথে সাথেই মেহরাব আমাকে হেঁচকা টানে তার একদম কাছে নিয়ে আসে। আমাদের মাঝখানে দূরত্ব খুবই কম। তার এহেন কান্ডে আমি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম তার চোখে মুখে কেমন এক কষ্টের ছাপ। এটি দেখেই আমার বুক ধক করে উঠল। এই মানুষটার এতো কিসের কষ্ট? কার জন্য এতো কষ্ট পাচ্ছেন উনি? কার জন্য এতোটা কাতরাচ্ছেন? আমার জন্য! না না আমার জন্য কেন হতে যাবে উনি তো উনার ভালোবাসার মানুষটির জন্য কাতর হবে। আমি তো উনার কিছুই না। উফফ উনার সামনে ভেঙে পড়লে চলবে না আমার এখান থেকে যেতে হবে। এই ভেবে আমি ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে শুরু করলাম। আর উনি আমাকে আরও শক্ত করে চেপে ধরে ধরা গলায় বললেন,,

—” এমন কেন করছ তিতলি? আমার কষ্ট হচ্ছে খুব। আর কষ্ট দিও না প্লিজ। কি হয়েছে বলো। আমি ঠিক করে দিব সত্যি। আমি কি কোন ভুল করেছি? আমি ভুল করে থাকলে সরি। তুমি আমাকে শাস্তি দাও। তবুও এমন করো না প্লিজ। খুব কষ্ট হয়।”

আমি এবার নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। উনাকে সজোরে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম। আমার সব কান্না বাঁধ ভেঙে উপচে আসছে। আমি কান্না করতে করতে বললাম,,

—”হ্যাঁ আপনার দোষ। আপনি ভুল করেছেন। আপনি অন্য কাউকে ভালোবেসেও আমার কাছে এসেছেন। আমার প্রতি কেয়ারিং হয়েছেন,, অধিকার খাটিয়েছেন। আমার মনে জায়গা করেছেন। নিজের প্রতি আমার মনে অনুভূতি জাগিয়েছেন। আপনি অন্য কাউকে ভালোবেসেও আমার জন্য অস্থির হওয়ার অভিনয় করেছেন।আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন মিস্টার। আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন।”

আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম। মেহরাব আমার দিকে এগিয়ে এসে বলতে লাগল,,

—”তিতলি তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি…..”

উনাকে আর বলতে না দিয়ে আমি বললাম,,

—”আমার ভুল হয়েছিল আমি আপনার মতো মানুষকে বিশ্বাস করেছি। মনে করেছি আপনি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু না আপনি একজন ধোকাবাজ। আমি এখন সব বুঝতে পারছি। আমি এখন আপনাকে একদমই সহ্য করতে পারি না। প্লিজ আমার সামনে থেকে চলে যান। আর কখনো আমার সামনে আসবেন না। প্লিজ।”

শেষের কথাগুলো আমি বেশ জোরেই বললাম। মেহরাব আমার কথা শুনে দুই পা পিছিয়ে বলল,,

—” তুমি একটাবার ও বুঝার চেষ্টা করলে না। থাক তোমার যা ঠিক মনে হয় তুমি তাই বুঝো। আমি আর কখনোই তোমার সামনে আসব না। ”

—” আমিও আপনাকে আর কক্ষণো দেখতে চাই না। কক্ষণো না।”

বলেই আমি দৌড়ে সেখান থেকে চলে এলাম।

চলবে…….

তোমার মাঝে(২)
পর্ব_১১
সারিফা তাহরিম

দুই দিন পর ?

সেদিন মেহরাবের সাথে কথা বলেই আমি দৌড়ে সেখান থেকে বের হয়ে যাই আর ভার্সিটি থেকে বাসায় চলে আসি। সেই থেকে আমার সব কিছু উলোট পালোট হয়ে গেছে। তখন থেকে নিজেকে ঘর বন্দি করে ফেলেছি। একবারের জন্যও বাহিরে যাই নি, কারো সাথে কথা বলি নি। দিয়াপু টাইমে টাইমে এসে জোর করে খাইয়ে দিয়ে গেছে। আপু কিছু জিজ্ঞেস করলে আমি কিছুই বলতে পারি নি শুধু আপুকে জরিয়ে ধরে কান্না করেছি। আমার বারবার মেহরাবের কথা মনে পড়ছে আর বুক চিড়ে হাহাকার বের হয়ে আসছে। কেন এমন হলো আমার সাথে? মেহরাব আমাকে ভালোবাসলে কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত? আমি কি ওর ভালোবাসার যোগ্য ছিলাম না?

—”তিতলি মা, তোর ফুফুরা আর আরাফরা এসে পড়েছে। এবার তো দরজা খোল। তোর ফুফু তোর সাথে দেখা করতে চাইছে।”

মায়ের কথায় আমার ভাবনায় ছেদ ঘটে। এতক্ষণ ধরে আমি বারান্দার ফ্লোরে বসে ছিলাম। চোখ থেকে অঝর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে। সম্পূর্ণ এলোমেলো অবস্থা হয়ে আছে আমার। মা দরজায় কড়া নেড়ে কথাটি বলতেই আমি দৃষ্টি একই জায়গায় স্থির রেখেই জোর গলায় বললাম,,

—”মা তুমি যাও। আমি কারো সাথে দেখা করতে চাই না। আমার ভালো লাগছে না তাই দয়া করে ডিস্টার্ব করো না। ”

—”আচ্ছা। দিয়া খাবার নিয়ে এলে খেয়ে নিস মা।আমি গেলাম।”

বলেই মা চলে গেল। আমার বুক চিড়ে এক দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। আজ ফুফুরা আর আরাফ ভাইয়ারা সবাই আমাদের বাসায় আসছে। কিন্তু কেন আসছে তা আমার জানা নেই। আমিই জানতে চাই নি। দিয়াপু শুধু বলেছিল আজ তারা আসবে। আর আমি বললাম আমি কারো ব্যাপারে কিছু শুনতে চাই না। তাই আপুও আর কিছু বলে নি। আমারও আর কিছুই ভালো লাগছে না তাই এই বিষয়ে আমার জানার কোন আগ্রহ নেই।

~~~~~~~~~~~~~~~

—”কি ব্যাপার মামু আজ বাড়িতে এতো মানুষ জন কেন? না মানে আমার জানা মতে আজ তো শুধু আমাদেরই আসার কথা ছিল। কিন্তু এখন দেখছি আরাফ ভাইয়া এসেছে। কোন অনুষ্ঠান আছে নাকি?”

লিভিং রুমে সোফায় বসতে বসতে তিতলির বাবার উদ্দেশ্যে কথাটি বলল নাফিজ।

—”হুম আজ একটি বড় সড় অনুষ্ঠান আছে। ”

ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটি বলল মেহরাব। মেহরাবকে দেখে নাফিজের চেহারার ভঙ্গিতে এক পরিবর্তন দেখা দিল। নাফিজ কেমন ভঙ্গিতে মেহরাবের দিকে তাকিয়ে বলল,,
—”তুমি এখানে?”

মেহরাব এসে নাফিজের পাশে বসে তার কাধে হাত রেখে বলল,,

—”কি নাফিজ ভাই,, চমকালেন নাকি? আপনি এখানে থাকতে পারেন আর আমি পারেন আর আমি পারি না?”

—”ননা আআমি তেমনটা বলি নি। ”

মেহরাব নাফিজের কলার ধরে হালকা ঠিক করছিল। নাফিজের কথা শুনে বাকা হেসে বলল,,

—”আরে আরে এতো ঘাবড়ে যাচ্ছেন কেন? আমি এখনো তো কিছুই করি নি। এই অল্পতেই এতো ভয় পেয়ে যাচ্ছেন মাফিয়া মি. নাফিফ খান।জাস্ট নস্ট হয়ে যাওয়া শার্টের কলার ঠিক করেছি আর এতেই এতো ভয় পয়ে গেলেন। যখন আপনার নষ্ট হয়ে যাওয়া মন মানসিকতা, চিন্তা ভাবনা, কাজকর্ম আর সেই সাথে আপনাকেও ঠিক করব তখন কি অবস্থা হবে?”

—”মমমানে ককি বলছ এসব? মামু তোমাদের সামনে এই মেহরাব কিসব বলছে আর তোমরা শুনেই যাচ্ছ। মা তুমি ও?”

লিভিং রুমে বড়রা সকলেই উপস্থিত ছিল। নাফিজ তার মামুদের অর্থাৎ তিতলির বাবা আর বড় বাবার উদ্দেশ্যে বলল আর সেই সাথে তার মাকেও বলল। নাফিজের মা নিজের ছেলেকে এসব বলতে দেখে গর্জে উঠলো। আর তাঁর ভাইয়েরাও চুপচাপ বসে আছে দেখে তাদের বলল,,

—”তোরা কি আমাকে এখানে অপমান করতে এনেছিস? আমরা একমাত্র ছেলেকে ওই ছেলে যা নয় তাই বলছে আর তোরা চুপচাপ শুনছিস?”

—”আহা আপা তোমার আদরে বাদর করা ছেলে সম্পর্কে যা সত্যি তা ই তো বলছে। এতে আমরা আর কি বলবো। বরং আমাদের তো লজ্জা লাগছে যে নাফিজ আমাদের বোনের ছেলে।” (তিতলির বড় বাবা)

—”কিসব বলছিস তুই। আমার ছেলে খারাপ হতে যাবে কেন? আমি অনেক দেখে শুনে, ভালো শিক্ষা দিয়ে বড় করেছি। সে কখনো কোন খারাপ কাজ করতে পারে না। ”

—”আন্টি, কোন মা ই চায় না তার সন্তান খারাপ হোক। প্রত্যেক মা ই তার সন্তানকে ভালো শিক্ষা দিয়ে বড় করার চেষ্টা করে। কিছু সন্তান সেই শিক্ষা গ্রহণ করে আর কিছু সন্তান সেই শিক্ষা গ্রহণ করে না। আপনার ছেলেও ঠিক তেমন। আপনি তাকে ভালো শিক্ষা দিলেও সে তা গ্রহণ করে নি বরং অন্যায় পথে পা বাড়িয়েছে।”

—”কিসব আজেবাজে বকছো মেহরাব? আমি তোমার কি ক্ষতি করেছি যে তুমি আমার নামে এইসব ফালতু কথা বলছো? আর মা, মামু তোমরা কেউ ওর কথা বিশ্বাস করো না। ও সব মিথ্যে কথা বলছে। বানিয়ে বানিয়ে বলছে। আমি কোন খারাপ কাজ করি নি। আর আমি কোন মাফিয়াও না।” (নাফিজ)

মেহরাব জোরে জোরে হেসে দিল। তারপর বলল,,

—” ও তাই নাকি? আপনি মাফিয়া না? আপনার খুন খারাবি, কালোবাজারি, এত্তো বড় চুরির মালের ফ্যাক্টরির সাথে কোন সম্পর্ক নেই? আচ্ছা সেইসব নাহয় পরে, আগে বলুন সেদিন আপনি তিতলিকে কিডন্যাপ করান নি?”

—”কককি যযা তততা ববলছছো? আ আমি কককেন তততিতলিকে কিকিডন্যাপ করাতে যযাব। আ আমি এএসব ককিছুই করি নি। মমিথ্যে ববলছো তুমি।” (নাফিজ)

—” বাবা মেহরাব, আমরা জানি যে নাফিজ কিছুটা বেপরোয়া স্বভাবের। আর তাই তোমার কথাতেই সবাইকে এখানে এনেছি তুমি তিতলির বিষয়টি সমাধান করবে বলে। কিন্তু এতো বড় একটি কথা তো এমনিই মেনে নেওয়া যায় না। নাফিজ যে তিতলিকে কিডন্যাপ করেছে সেই সম্পর্কে তুমি কিভাবে জেনেছ? আর নাফিজ কাজটি করেছে তার প্রমাণই বা কি?(তিতলির বড় বাবা)

—”আঙ্কেল, তিতলি যখন কিডন্যাপ হয় তার একটু পরেই বিষয়টি জানতে পেরে আমি সেই গাড়িটির পিছু নিয়েছিলাম। তারপর সেখানে এক জঙ্গলে গিয়ে তারা তিতলিকে নিয়ে যায় আর বেধে রাখে। তারা অনেকেই কিছুটা দূরত্ব রেখে দাড়িয়েছিল। আর আমি তাদের মুখ চেপে আঘাত করে বেশ কয়েকজনকে অজ্ঞান করি। আর তিতলিকে নিয়ে আসতে যাই তখন আরেকজন আমাকে আঘাত করে আমি তা সামলে তাকেও অজ্ঞান করে ফেলি। তারপরে তিতলিকে নিয়ে চলে আসি।

আমার একটা গ্যাং আছে যা অন্যায়ের বিরুদ্ধে থাকা মানুষদের শাস্তি দেওয়া হয়। আমি আমার সেই লোকগুলোকে সেই জায়গার ঠিকানা দিই আর তারা সেই অজ্ঞান ছেলেগুলোকে আমাদের আস্তানায় নিয়ে আসে। এরপরে আমি সেই দুইদিন তাদের বেশ মারি যাতে তারা তাদের লিডারের নাম বলে। কিন্তু তারা কেউই বলে নি। পরেরদিন আমি ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে গিয়ে দেখলাম ছেলেগুলোর লাশ পড়ে আছে। আমার এসিস্ট্যান্ট জানায় যে তাদের অন্য কেউ এসে আমাদের লোকগুলোকে অজ্ঞান করে এদের মেরে চলে গেছে। আর সেই লোকেরও সেইম ট্যাটু আছে যা ওই ছেলেগুলোর ছিল। তারপরে সেই ট্যাটু এবং সেই রাস্তাগুলোর সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হয়। কারণ প্রতিটি জায়গায় আমাদের গ্যাঙের গুপ্ত ক্যামেরা থাকে। আর তাদের সেই ট্যাটুটা বেস্ট আর্টিস্ট দিয়ে করানো হয়েছে আর এই ডিজাইন সম্পূর্ণ ভিন্ন।

আমি পরশু সাদাফের মাধ্যমে সেই ট্যাটু আর্টিস্ট এর সাথে ভিডিও কলে কথা বলি আর সেই ট্যাটুর ছবি দেখিয়ে জানতে পারি যে এইটা বেশ অনেকদিন আগে এক মাফিয়া গ্রুপ করিয়েছিল। উনার কাছে যারা ট্যাটু করে তাদের ছবি উনার কাছে থাকে। কিন্তু উনি তৎক্ষণাৎ আমাকে সেই ছবিটি খুজে দিতে পারেন নি তাই পরে দিবে বলেছেন।

আর এদিকে সকল সিসিটিভি ফুটেজ কালেক্ট করে দেখা গেছে যে লোকটা ওই ছেলেগুলোকে মেরেছিল সে এক নির্জন জায়গায় থাকা গোডাউনে গেছে। আমরা সেই জায়গার খোঁজ লাগাই। আর জানতে পারি সেটি এক মাফিয়ার আস্তানা। আজ সকালে তাদের বেশ কয়েকজনকে আমরা ধরে এনে পরিবারের লোকদের জীবনের ভয় দেখিয়ে জানতে পারি যে সেই মাফিয়া আর কেউ নয় মি. নাফিজ খান। আর এটাও স্বিকার করে যে তিতলিকে নাফিজই কিডন্যাপ করিয়েছিল। আর সেই খুনি লোকটি জানায় যে কিডন্যাপ করার জন্য তাদের মধ্যের কয়েকজনকে নাফিজ পাঠিয়েছিল। আর তারা যেহেতু নাফিজের কথা বলতে না পারে তাই নাফিজ তাকে সেই ছেলেগুলোকে মেরে ফেলতে পাঠায়। আর সেইখানে তার নিজের ভাইও ছিল যাকে নিজের প্রাণের ভয়ে সে নিজ হাতে হত্যা করেছে।

তারা সবাই-ই এখন আমাদের কাছে আছে। আর বিকেলেই সেই আর্টিস্ট আমাকে ছবিটি পাঠায় যেখানে নাফিজ আর তার গ্যাং এর প্রত্যেককে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। এই ছিল সম্পূর্ণ কাহিনি আর এই রইল তার প্রমাণ। ”

এক সাথে সব কথা বলে মেহরাব থামল আর সিসিটিভি ফুটেজ, ছবি, আর্টিস্টের সাথে কথা বলার কল রেকর্ড সব প্রমাণ এগিয়ে দিল। তারপর নাফিজের সাথে কিছুটা ধস্তাধস্তি করে, জোর করে মেহরাব তার শার্টের হাতা বাহুর উপরে উঠিয়ে সেই ট্যাটু দেখায়। সবাই থমকে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। এগুলো দেখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে নাফিজই এই সবের সাথে জড়িত।

মেহরাব আবার বলল,,

—”ওহ সবচেয়ে বড় প্রমাণ তো দেখানোই হয়নি। ”

এই বলে মেহরাব রাকিবকে ফোন করে। তার কিছুক্ষণ পরে রাকিবরা নাফিজের গ্যাঙের কয়েকজনকে বেধে আনে। সকলেই তাদের চেহারা ছবিতে দেখার কারণে চিনতে পারে। তারপর তারাও সকলে বলে যে নাফিজ তিতলিকে কিডন্যাপ করিয়েছিল আর বিভিন্ন খারাপ কাজে লিপ্ত। তাদের স্বিকারোক্তির পরে আবার নিয়ে যাওয়া হয়। এতোক্ষণ ধরে তিতলির বাবা চুপচাপ দেখছিল। কিন্তু এখন তিনি আর বসে থাকতে পারলেন না। উঠে নাফিজকে কয়েকটা জোরে থাপ্পড় দিয়ে চিল্লিয়ে বলল,,

—”কেন করেছিস এমন? বল তুই। আমার মেয়ে তোর কি ক্ষতি করেছিল যে তুই তাকে কিডন্যাপ করলি? আমার একমাত্র মেয়ের দিকে তুই হাত বাড়ালি। কেন? ”

আরাফ আর সাদাফ গিয়ে তিতলির বাবাকে ধরে ছাড়িয়ে আনে। হার্টের রোগী হওয়ার কারণে বেশি উত্তেজিত হয়ে পড়লে সমস্যা। মেহরাব বলল,,

—”আঙ্কেল আপনি উত্তেজিত হবেন না। এর ব্যাপারটা তো আমি দেখছি।”

বলেই নাফিজের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল মেহরাব।

চলবে…….

(ভুল ত্রুটিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ধন্যবাদ ?)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here