#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (১৯)
#রোকসানা-রাহমান
ইশাদ বাড়ি ছেড়ে হসপিটালের দিকে ছুটছে। পারবেনা সে আর তার তিহিপাখিকে ছাড়া থাকতে,পারবেনা সে আর তিহিকে দুঃখের সাগরে ভেসে যেতে দিতে। তার তিহিকে চাই,বুকের মধ্যিখানে,যেখানে রয়েছে তার ভালোবাসার অনুভূতিরা। অনুভূতির সাগরে ডুবিয়ে রাখবে,খুব করে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখবে। তিহিপাখি,আমি আর তোমার চোখের পানি ঝড়তে দিবোনা,দরকার হলে তোমাকে নিয়ে অন্য এক জগতে পাড়ি দিবো,যেখানে থাকবে শুধু তিহিপাখি আর ইশাদের বুকের বিশাল আকাশ!
ইশাদ দ্রুতপদে তিহির কেবিনে ছুটছে,মনে হচ্ছে আর একটা সেকেন্ডও সে তিহিকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। কেবিনের কাছটাতে এসে ইশাদ থমকে গিয়েছে,পাদুটো জমে যাচ্ছে। আর এগুতে পারছেনা,অন্তরআত্মা চিৎকার করে তিহিকে ডাকলেও ঠোঁটদুটো নড়ছেনা,চোখদুটো চেয়ে আছে সামনের দিকে। যেখানে তিহিকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে আছে তাজ!
ইশাদ তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে চেয়ে আছে দুটো আলিঙ্গিত মানুষগুলোর দিকে। তিহিকে পেছন থেকে জড়িয়ে আছে তাজ। ইশাদের নোনাজলে ডুবে থাকা চোখদুটোর কার্নিশ অনেকটাই শুকিয়ে আসছে,বুকের ভেতরে যে এক ধরনের আকুতি চলছিলো তিহিকে নিজের করে পাওয়ার সেটাও অনেকটা মিয়িয়ে আসছে,নিশ্বাসটা থেমে থাকলেও সেটা ক্ষনিকের জন্যই ছিলো,এখন অনেকটাই নিশ্বাসের গতি ধীর হয়ে আসছে। থমথমে জমে যাওয়া পাদুটোও নড়েচড়ে উঠছে। তবে তিহির কাছে যাওয়ার জন্য নয়,নিজের তৈরী করা এক অনুভূতিহীন জগতে। যেটা সে নিজের ইচ্ছায়,নিজ হাতে নিজের গলা টিপে তৈরী করেছিলো!
ইশাদ ঠোঁটের কোনে ঝরা হাঁসি নিয়ে ঘুরে দাড়ায়। তিহিপাখি,তুমি কেমন আছো আমি জানিনা। কখনো জানতে চায়নি আর জানতেও চাইবোনা৷ তবে আমার প্রার্থনার পুরোটাতে আমি চাইবো তুমি সুখে থাকো। তোমার উপর আমার যতটুকু অধিকার ছিলো তা নিঃশেষ করে তোমাকে অন্যের বুকে গুজে দিয়েছিলাম। তাহলে আজ আবার কোন অধিকার নিয়ে তোমার সামনে দাড়াবো?? স্বার্থপরের মতো আমার সবটা ইচ্ছে তোমার উপর চাপিয়ে দিয়েছিলাম,তুমি মুখ বুজে চুপচাপ চেপেও গেছো,তাহলে এখন আর কোন স্বার্থপরের মতো তোমাকে নিজের করে চাইবো?? নিয়তির খেলায় দুজন যখন মাঠে নেমেই পড়েছি তাহলে চলুকনা সেই খেলা। দেখি এর শেষটা কি হয়। শুরুটাতে তুমি, আমার থাকলেও শেষটা কি আমার হবে?? নাকি খালি হাতে মাথা নিচু করেই আমায় মাটির নিচে ঘুমুতে হবে??? তোমাকে অন্যের রাজ্যে লেপ্টে থাকতে দেখে আমার রাজ্য শূন্য হয়ে যাচ্ছে। তাতে কি,তুমি তো তোমার কথা রেখেছো। আমার পছন্দের তৃতীয়মানুষটার সংসার পরিপুর্নতা এনে দিয়েছো। আমি আজ খুশি,খুব খুশি,আমার তিহিপাখি তার ভালোবাসার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ!
~~
শিরিন বেগমের ডাকে তাজের নেশারঘুমটা কিছুটা হালকা হয়ে এসেছিলো। মুখের মধ্যে পানির ঝাপটা দিয়ে টেনে দাড় করিয়ে নতুন অতিথীর আগমনীর বার্তা জানায়।
বাবুর মুখ না দেখেই সোজা তিহির কাছে ছুটে গিয়েছিলো তাজ। নেশা তখনো পুরোপুরি কাটেনি,এলোমেলোভাবে হাটছিলো,চোখ বুঝে বুঝে আসছিলো। তাতেও চেহারায় ফুটে উঠেছিলো এক স্পষ্ট প্রাপ্তি সুখের ছায়া।
তাজকে দেখে তিহি ডানকাত হয়ে মুখ গুড়িয়ে নিলে ও সোজা সাদা কাপড়ে মোড়ানো বেডটাতে উঠে পড়ে। লম্বা লম্বা হয়ে শুয়ে তিহিকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। হাতের বাধন আরেকটু শক্ত করে তিহির কানের কাছের গলার ভাজটাতে একটা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে বললো,,
“” নেশাবউ,আমার নেশা কাটাতে তোমার নেশা প্রয়োজন। দিবে তো আমায় তোমার নেশায় ডুবতে?? একটু একটু করে তোমার নেশায় ডুববো,আর মদের নেশা ভুলবো। তিহি, আমি সাধারন জীবন চাই। আমার আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছে অন্য সবার মতো বউ বাচ্চা নিয়ে সুখের সংসার করতে। সারাদিন অফিস শেষে ক্লান্তশরীরে বউয়ের হাতের রান্না খেতে। বাবুকে ঘুম পাড়িয়ে মাঝরাতে বউয়ের শরীরের উত্তাপে নিজেকে ঘামিয়ে তুলতে। কোনো এক ছুটির দিনে দুজনে ঝকঝক রোদের আলোয় ঘুরতে যেতে,রাতের নির্জন ল্যাম্পোস্টের আলোর দিকে তাকিয়ে মধুর আলাপে মত্ত হতে।
আমি অন্যায় করেছি,খুব বড় পাপ করেছি। তোমার মতো এমন নিষ্পাপ মেয়েকে নিজের প্রতিশোদের আগুনে জ্বালাতে চেয়েছি। কিন্তু আমি এতোটাও হৃদয়বান নই যে তোমাকে তোমার জগতে ফিরিয়ে দিয়ে আসবো। ফিরিয়ে দিলেও কি সব ঠিক হবে??? তোমার কি মনে হয়না এতোদিনে তোমার সাজানো জগৎটা কোনোএক কালবৈশাখী ঝড়ে সবকিছু ভেঙে গুড়িয়ে গেছে?? তার থেকে ভালো নয় কি আমরা নতুন করে শুরু করি?? আমি আমার ভুল শুধরিয়ে তোমাকে নিয়ে বাঁচতে চাই,নেশাবউ! নতুনভাবে,নতুন সাজে,নতুন স্বপ্ন নিয়ে””
তিহি চোখের সামনে সাদা রঙে আবৃত দেয়ালটার দিকে চেয়ে আছে,চোখের দৃষ্টি ওখানেই আটকে আছে। চোখটা নোনাপানিতে টয়টুম্বর,যেমনটা বর্ষায় শুকনো নদী, বৃষ্টির পানিতে টইটুম্বুর হয়ে যায়। কিন্তু তার চোখের এই থমকে যাওয়া বৃষ্টির কারন কি?? তাজের নতুন করে শুরুর আহ্বান নাকি ইশাদের থেকে দুরে চলে যাওয়ার বহমান???
তিহির দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে তাজ তিহিকে নিজের আবদ্ধে টেনে নিয়ে আবার বললো,,,
“” তুমি চাইলে আমি আজ থেকেই শুরু করবো। আমি আজি কোনো ভালো রিহ্যাবে চলে যাবো। মানুষ মন থেকে চাইলে অসম্ভব জিনিসটাকেও সম্ভবে রুপান্তর করতে পারে,শুধু তার ইচ্ছে শক্তি আর প্রাপ্তির উৎসের প্রয়োজন। এই মুহুর্তে আমার ইচ্ছেশক্তি খুব প্রখর আর আমার প্রাপ্তির উৎস হিসেবে আছো তুমি আর তোমার কোল আলো করা আলোকরশ্মি। আমার আর কি চাই বলো?? আমি না চাইতেও বিধাতা আমায় এতোকিছু দিয়েছে,সেগুলোকে অসম্মান করলে যে আমার পাপ হবে। আমি আর কোনো পাপের ভাগিদার হতে চাইনা। আমাদের পবিত্র বন্ধনটাকে পবিত্রতায় আরো শক্ত বন্ধনে রুপান্তর করতে চাই। শুধু ইহকালে নয় আমি যে পরকালেও তোমার সান্নিধ্যে থাকতে চাই।””
তাজ হাতের বাধনটা খুলে মাথা উচু করে তিহির দিকে তাকিয়ে আছে। তিহির দৃষ্টি তখনোও ঐ দেয়ালেই আটকে। তিহির গালটায় আলতো করে ছুয়ে সোজা করে নিলো। কপালে পড়ে থাকা এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে নিচ্ছে। তিহি তাজের চোখের দিকে তাকাতে পারছেনা। এদিকওদিক তাকানোর চেষ্টা করছে। মনোযোগটাও স্থির করতে পারছেনা। কার দিকে তাকাবে সে,কোন আশায় তাকাবে? যে আশার বুলি বুলাচ্ছে সেখান থেকে কি আদৌ আশার ক্ষীন আলোটা সে পাবে??
“” নেশাবউ!””
তাজের ডাকটাকে আর উপেক্ষা করতে পারছেনা তিহি। এমন বউ ডাক শোনার জন্য সে কত প্রহর গুনেছে তার কি হিসেব আছে?? আজ সেই বউ তো সে সেজেছে,স্বামীর মুখে বউ বলে ডাকটাও তার বুকে বিধছে,কিন্তু সে তীরটা যে অন্য কারো ছুরার কথা ছিলো!
“”এই প্রথম হারানোর ভয় হচ্ছে আমার,তোমাকে হারানোর ভয়,ভয়ে আমি কুকড়ে যাচ্ছি। আমি তোমার কাছ থেকে দুরে চলে গেলে কি তুমি আমাকে ভুলে যাবে?? আমার রুমটা শুন্য করে দিবে?? পারবেনা একটু ভালেবাসায় আমাকে তোমার সময়গুলোতে জড়িয়ে নিতে? বেধে নিতে তোমার অপেক্ষার ডোরের সাথে?? তোমাকে ছাড়া আমি অনেক রাত কাটিয়েছি,মদের নেশায়। তবুও আমার ভয় হয়নি, তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে এরকম চিন্তা মাথাতে আসেওনি। কিন্তু আজ যখন আমি মদকে ছাড়াতে চাচ্ছি তখনি ভয়েরা জায়গা করে নিচ্ছে। মনে হচ্ছে তোমাকে একদন্ডের জন্য একলা ছাড়লেই তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে। সত্যি চলে যাবে?? একটু অপেক্ষা করতে পারবেনা???””
তাজের নির্লিপ্ত চাহনিতে তিহি চেয়ে আছে। চোখের ভাষা সে পড়তে পারছেনা। প্রশ্ন করছে নাকি অনুরাগ দেখাচ্ছে??
“” আমার সুস্থ হতে যদি অনেকটা সময় লেগে যায়। এই ধরো একমাস,দুৃমাস,ছ মাস কিংবা মাস ফুরিয়ে ১ বছর, ২ বছর, ৫ বছর,তখন কি ফিরে এসে আমি আমার বউকে আমার নীড়ে পাবো?? আমার ফিরে আসায় তার অপেক্ষারত চোখূুটোতে কান্নার অশ্রু দেখতে পাবো?? কি হলো বলোনা তিহি? থাকবেতো তুমি আমার হয়ে?? নাকি একাকিত্বের কাছে হেরে যাবে। আমার অনুপস্থিতে কি তুমি ছুটে চলে যাবে তোমার প্রিয়র কাছে,তোমার ইশাদের কাছে??””
ইশাদ নামটা শুনতেই তিহির স্থির চোখদুটো আবার অস্থির হয়ে উঠেছে। তাজের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছেনা। তাজের নিশ্বাসের মধ্যে ভাবসা গরমে বেশ বিরক্ত লাগছে। ভালো লাগছেনা তার,কিছু ভালো লাগছেনা। আজ এতোটা দিন বাদে ইশাদকে দেখেছে,তার ক্ষুধার্ত চোখ দিয়ে গিলে খেতে চেয়েছিলো ইশাদকে। কিন্তু সময় হয়ে উঠেনি নাকি সুযোগ হয়ে উঠেনি। হয়তো নিয়তির লেখনে অন্যকিছু ছিলো বলেই দেখা হয়নি। বুকের ভেতরে কষ্টের দাবানলে জ্বলে উঠা আগুনটাকে নিভানোর জন্য হলেও ইশাদের বুকে একটু ঠাঁই নিতে ইচ্ছে করছে। যে বুকটাই তার বন্দী হওয়ার কথা ছিলো,সে বুকটা যে এখন শূন্য হয়ে পড়ে আছে। এই শূন্যতা ইশাদ কি দিয়ে ভরবে???
তাজ এতক্ষণ তিহির চোখের দিকে চেয়ে থাকলেও এবার চোখদুটো ঠেকেছে তিহির ঠোঁটে,গোলাপি আভার ঠোঁটদুটো নির্জীব,শুকনো, ধেরধেরা হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে শুকনো ঠোঁটদুটো ভিজিয়ে নিতে। তাজ হাতের তর্জনী দিয়ে ঠোঁটছুতেই তিহি কিছুটা নড়ে উঠে। তাজের দিকে চাইতে ও বললো,,,
“” আমি তোমাকে খারাপভাবে ছুয়েছি,খুব বেশিই খারাপভাবে। আমি তোমায় আবার ছুতে চাই,ভালোবেসে,স্বামী হিসেবে। ছুতে দিবে তো আমায়?””
তিহির মুখে এখনো কোনো শব্দ নেই। তাজের করা এতো এতো প্রশ্নের উত্তরগুলো তিহির জানা নাই। জানা থাকলেও আজ তার উত্তর দিতে ইচ্ছে করছেনা। সবগুলোর উত্তর যে একটাই!
তাজ তিহির ঠোঁটে হাত ছুয়ে নিতে নিতে বললো,,,
“” আমি তোমার সব জায়গায় ছুলেও এখানে কেন ছুইনি জানো??””
তিহি প্রশ্নক্ষুব্ধে চেয়ে থাকে তাজের দিকে। তাজ ঠোঁটের কোনে হাঁসি নিয়ে বললো,,,
“” আমার কাছে মনে হয়,দুটো ভালেবাসার মানুষের আত্মিক ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে দুজোড়া ঠোঁটের মিলনে। কারোরটা পবিত্র,কারোরটা অপবিত্র!আমার মধ্যে তোমার জন্য ভালেবাসা ছিলোনা,তোমারও আমার জন্য ভালোবাসা ছিলোনা,তাই আমি ইচ্ছে করেই তোমার ঠোঁটে ছুইনি,শুধু ঠোঁট কেন তোমার পুরো মুখটাতেও আমি আমার হিংস্র আচরের ছোয়া লাগাইনি। তবে এখন ছুতে ইচ্ছে করছে,কিন্তু মদের গন্ধ মেশানো নিশ্বাসে নয়,ভালোবাসার নিশ্বাসে। তার জন্য আমি অপেক্ষা করতে রাজি,যতদিননা আমি পুরোপুরি নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছি,একটা সাধারন,পবিত্র জীবনে ফিরতে পারছি ততদিন অপেক্ষা করবো। তার আগে তোমাকে আমি চোখের দেখাও দেখতে চাইনা। তাহলে আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারবোনা বন্দী দশাতে! তোমার আড়ালে চলে যাবো,অনেকটা দুরে, তোমার ঘৃন্ন চাহনিকে ভালোবাসায় রুপান্তর করতে। তার জন্য আমার একটু ভরসা,একটু বিশ্বাস,একটু আশার আলো চাই। দিবেতো আমায় আশার আলো???””
তিহি আর চুপ করে থাকতে পারছেনা। কিছু একটা বলতে চেয়ে ঠোঁট নাড়িয়ে উঠতেই ওর ঠোঁটে নিজের আঙুল ঠেকালো তাজ।
“” কিছু বলোনা,প্লিজ! তোমার উত্তর যদি না হয় তাহলে আমি আজ এখানেই মরে যাবো। কিন্তু আমি এখনি মরতে চাইনা। আমার রাজকন্যার মুখে বাবা ডাক শুনতে চাই। কতটা বছর এই ডাকটা শোনার জন্য ছুটেছি বলোতো! এক মেয়ে ডাকেনি তো কি হয়েছে? আল্লাহ আমায় আরেক মেয়ে দিয়েছে। আমি তার জন্যই এবার শুধরে যাবো। যে ভুলের জন্য নিজের বুক খালি হয়ে গেছে আমি আবারও সে একি ভুল করতে চাইনা তিহি। আমার এবার বাবা ডাক চাই। খুব করে চাই! সাথে আমার এই নেশাবউয়ের নেশাটাও চাই। যাতে প্রতি নিয়ত আমি নেশায় ডুবতে পারি,আমার তিহি আমার বউয়ের নেশায়!!””
তিহি ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে তাজের দিকে। এমন মধুর,আবদারী,আবেগী কন্ঠ তিহি আগেও শুনেছে,তবে সেটাই ছিলো মাদকের ছোয়া,নেশায় ডুবে থাকা তাজের। কিন্তু আজ! আজ ও কি সে নেশা থেকেই এগুলো বলছে?? নিশ্বাসের সাথে নেশার কিছুটা গন্ধ এখনো তিহির নাকে বাড়ি খাচ্ছে,তবে সেটা খুবই নগন্য! তাহলে কি এবার সবকিছু ঠিক হতে চলেছে?? কিন্তু এই ঠিক হওয়াতে কেন মন সায় দিতে চাইছেনা?? মন কেন চাইছে সবকিছু বেঠিক,বিচ্ছিন্নভাবেই চলুক? ইশাদকে ছাড়া সে যে কিছুই গুছাতে চায়না,কিছুই সাজাতে চায়না!!
“” এই বউ,কি ভাবছো এতো? আমি সজ্ঞানেই এগুলো বলছি,আমার নেশা কেটে গেছে। সত্যি!””
“” বাবু কোথায়? একটু আমার কাছে এনে দিবেন?””
তাজ তিহিকে ছেড়ে উঠে পড়ে। তাজের সঙ্গ কাটিয়ে উঠতে তিহির অস্থির লাগছিলো,ভেতরটা কেমন ছ্যাতছ্যাত করছিলো। ঘেমে উঠেছে সে,কপালে জমে উঠছে সুক্ষ জল কনারা! তার বিষাক্ত ছোয়াতেও এমন অস্থিরতা কাজ করেনি,কিন্তু সুস্থ চোখের চাহনিতেও তিহি শিউরে উঠছে।
~~
তিহি কোলে বাবু নিয়ে ল্যাপটপের দিকে চেয়ে আছে। ওর শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি ভিডিও কলে আছে। এতোদিন পর এই মানুষদুটোকে দেখে তিহি বেশ অসস্থিতে ভুগছে,মুখের কোনে কোনো কথা খুজে পাচ্ছেনা। অপরিচিত হলেও সম্পর্কেতো কাছের। কি বলবে না বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা। চোখের দৃষ্টিও স্থির করতে পারছেনা। একবার উনাদের দিকে তো আরেকবার বাবুর দিকে তাকাচ্ছে,মাঝে মাঝে আড়চোখে তাজকেও দেখার চেষ্টা করছে।
তাজ তিহির দিকেই চেয়ে আছে,তার আড়চোখে তাকানোর প্রয়োজন নেই,অন্য মেয়ের দিকে তো নয়,নিজের বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছে,তাতে ভয় পাওয়ার কি আছে আর আড়ষ্ট হওয়ারই বা কি আছে?? তিহির অবস্থা দেখে বেশ মায়া হচ্ছে তাজের, মিটিমিটি হাঁসিও দিচ্ছে। এমন ছোট্ট শিশু কোলে কোনো মাকেই হয়তো এতো সুন্দর লাগেনি। ওর মনে হচ্ছে যদি কোনো ফটোপ্রেমী এই মা-মেয়ের ছবি তুলে কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নেয় তাহলে নির্ঘাত ফার্স্ট প্রাইজটা সেই পাবে। পাবেনা কেন?? তার নেশাবউ যে এই পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর বউ আর সুন্দর মা!
তাজ তিহির জড়োতা কাটাতেই ওর পাশে গিয়ে বসে। আম্মু-আব্বুর সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা বলে কল কেটে দিয়েছে। তিহিকে রেস্ট নিতে বলে নিজেও কেবিন থেকে বের হচ্ছিলো। তখনি ইরফাদের আগমন ঘটে।
দুজন দুজনার দিকে চেয়ে আছে,কত বছর পর আজ তারা এতোটা কাছে। এর মধ্যে কত কিই না হয়ে গেছে। ভাবতেই শিউরে উঠে তাজ। সাথে ইরফাদও!
তিহির কথা জানতে পেরেই ওর সাথে দেখা করতে এসেছিলো ইরফাদ। কিন্তু এখানে তাজকে দেখে বেশ চমকিত!
তাজ নিজে থেকেই বললো,,
“” কেমন আছিস?””
ইরফাদ ছোট করে উত্তর দিলো,,
“” ভালো।””
“” রেগে আছিস?””
“” না।””
ইরফাদকে অবাক করে দিয়ে ওকে ঝাপটে ধরে তাজ। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,,
“” আল্লাহ যা করেন, কল্যানের জন্য! তাই হয়ত আমার বউ সাজে সানজিদা নয় তিহিকে পাঠিয়েছেন। হয়তো কপালে তাই ছিলো। আমি ধৈর্য্যচ্যুত হয়েছিলাম তাই অনেক অপরাধ করেছি। ক্ষমা করে দিস আমায়। দ্বিতীয়বার দেখা হলে যদি আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরিস তাহলে আমি বুঝবো আমি ক্ষমা পেয়েছি। তোর জড়িয়ে ধরে বন্ধু ডাকের অপেক্ষায় থাকলাম।””
ইরফাদকে ছেড়ে দিতে গিয়েও আবার জড়িয়ে নিয়ে বললো,,
“” আল্লাহ হয়তো তোর জন্যও কিছু রেখেছে রে। তার জন্য অপেক্ষায় থাকিস। আর আমি সিউর একদিন তুই ও আমাকে এভাবে জড়িয়ে নিয়ে বলবি,আল্লাহ যা করেন, কল্যানের জন্য!””
~~
হসপিটাল থেকে ছুটি পেয়েই তিহি নিজের বাবুটাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেদিনের পর ইশাদের সাথে তার আর দেখা হয়নি,দেখা যেহেতু হয়নি কথাও হয়নি। তবে সে প্রত্যেকটা মুহুর্তই দরজার পানে চেয়েছিলো,বারবার মনেপ্রাণে আকুতি করছিলো,আর একটাবার মানুষটার মুখ দেখার আশায়। কিন্তু তার আকুতি হয়তো আল্লাহ কবুল করেননি। নিজের অতৃপ্ত আর ক্ষুধার্ত চোখ নিয়েই তাকে ফিরতে হয়েছিলো।
বাসায় আসার পর তাজ উধাও। হুট করে সেও একদিন, দুদিন কেটে যায় বাসায় আসার নাম নেই। এমন হুট করে উধাও হওয়াতে কিছুটা চিন্তিত হয়েছিলো তিহি আর শিরিন বেগম। কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়ে গিয়েছিলো হসপিটালে বেডে থাকা অবস্থায় তাজের বলা কথাগুলো। তবে কি সে পবিত্র হয়ে ফিরার উদ্দেশ্যেই বেড়িয়েছে?? কিন্তু এভাবে না বলে চলে গেলো কেন? তার কি মনে হয়না তাকে নিয়ে কারো চিন্তা হতে পারে?? ফুপিমার কথাটা তো ভাবতে পারতো?? তিহি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বিড়বিড় করে বললো,যার এতো চাওয়া পুরন করে এলি,তার সাথে কি তোর আর দেখা হবে?? আমি জানতাম আমার কন্যা সন্তানই হবে। কেউ একজন যে খুব করে চাইতো আমার তিন কন্যা হোক। তার চাওয়ার প্রথম কন্যা তুই,বুঝলি??
~~
ছ’মাস পর,,
মিহি ক্লাসে ডুকতেই রাদিব এক টুকরো কাগজ এগিয়ে দিলো ওর দিকে। বেশ বিরক্ত আর ঝাঝ নিয়েই বললো,,
“” তোকে কতবার বলেছি,আমাকে এসব দিবিনা। আমি অন্য কাউকে ভালোবাসি। তুই কি আমার কথা বুঝিসনা রাদিব??””
“” কাগজটা খুলেতো দেখ।””
“” দরকার নেই। আমার সামনে থেকে সর!””
মিহি পাশ কেটে চলে যেতে নিলে রাদিব আবার বললো,,
“” কাগজটা ইরফাদ স্যার দিয়েছিলো। বলেছিলো তুই এলে তোকে যেন দেই। ঠিক আছে তুই যখন নিবিইনা তাহলে আমি বরং স্যারকেই…””
রাদিবের টানা কথা শেষ হওয়ার আগেই ওর হাত থেকে কাগজটা কেড়ে নেয় মিহি। দ্রুততার সাথে খুলতেই চোখদুটো ছানা বড়,,,
**টিফিন শেষে ফার্স্ট পিরিয়ডে লাইব্রেরিতে এসো। কথা আছে। আমি অপেক্ষায় থাকবো। অবশ্যই একা আসবে!
ইরফাদ
রাদিব উকি দেওয়ার বাহানায় বললো,,
“” কি লিখা আছে রে? প্রেমপত্র নাকি?””
মিহি চট করে কাগজটা মুঠোয় পুরে একটু ভাব নিয়ে বললো,,
“” তোকে কেন বলবো? এটা আমাদের পারসোনাল ব্যাপার!””
টিফিন টাইম ১২ঃ১৫ তে। তার আগে তিনটে ক্লাস। এতোগুলো ক্লাসে মিহির কি মন বসবে?? যে মানুষটাকে একপলক দেখবে বলে ঝড়,বৃষ্টি,ঘুম উপেক্ষা করে মিহি কলেজে ছুটে আসে সেই মানুষটা আজ তার সাথে দেখা করতে চাইছে। তাও কি রোমান্টিকভাবে। ভাবতেই মিহির শরীরজুরে বয়ে যাচ্ছে উত্তেজনার শীতল ছোয়া।
এতোগুলো দিন পেরিয়ে গেলেও মিহি তার মনের কথা জানাতে পারেনি ইরফাদকে। দিন যত গড়াচ্ছিলো ইরফাদের সাথে ওর সম্পর্ক ততই নুয়ে পড়ছিলো। হঠাৎ দুএকবার ক্লাসে লেকচার দিতে আসলেও মিহির আজগুবি কান্ডে বিরক্ত হতো ইরফাদ। যার ফলে মিহির ঐ একদুটো ক্লাসটাও করা হতোনা। কখনো বাইরে দাড়িয়ে কান ধরে উঠবোস করতো,কখনো ক্লাসের মধ্যে হাই বেঞ্চের উপর কান ধরিয়ে রাখতো,কখনো বা বেঞ্চের নিচে মাথা ঢুকিয়ে বসিয়ে রাখতো। প্রেমে পড়লে যে কত কাঠ,খড় পুরাতে হয় মিহি এই কদিনেই টের পেয়ে গেছে। তবে এতকিছুর মধ্যেও ইরফাদের কাছে মনের গহীনে পড়ে থাকা ভালোবাসার অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশ করতে পারেনি। কিভাবে করতে হয় তা হয়তো মিহি জানেওনা। ও শুধু জানে এই মানুষতাকে ওর ভালেবাসতে ভালো লাগে!
টিফিন শেষ হতে সকলে ক্লাসরুমে ঢুকলেও মিহির তেমন তাড়া নেই। থাকবে কিভাবে? তারতো মন পড়ে পড়ে আছে অন্যকোথাও। দ্রুত নিজের ব্যাগটা কাধে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লো লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে!
লাইব্রেরির কাছটাতে আসতেই মিহির বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে,লজ্জাগুলো এমনভাবে আচ্ছাদন করছে যে পাদুটো কদম ফেলে ভেতরে ঢুকতে পারছেনা। সাথে মনের ভেতর চলছে হাজার ভাবান্তর প্রশ্ন। কি এমন কথা বলবেন যে এভাবে একা ডেকেছেন? তাও ক্লাস পিরিয়ডে?? স্পেশাল কিছু কি? উনি কি কোনোভাবে ধরতে পেরেছেন আমি উনাকে পছন্দ করি?? ধরতে না পারার তো কোনো কারন নেই,কলেজের সবাই জানে এই কলেজের কমার্সের এক পিচ্ছি মেয়ে বুড়ো স্যারের প্রেমে হাডুবুডু খাচ্ছে!
মিহি ভয়ে ভয়ে লাইব্রেরির ভেতরে ডুকে পড়ে। কয়েককদম এগিয়ে যেতেই পেছন থেকে দরজা লাগানোর শব্দ! মিহি তড়িঘড়ি করে পেছনে ঘুরে দেখলো রাদিব।
মিহি বিক্ষিপ্তসুরে বললো,,
“” তুই এখানে?””
রাদিব সাফল্যভঙ্গিতে শার্টের কলার টেনে বললো,,
“” আমার চিঠিতে এলি,আর আমি থাকবোনা?? এটা কি করে হয় মিহিসোনা?””
“” তারমানে ঐ চিঠিটা তুই…””
মিহি আর কিছু ভাবতে পারছেনা। নিচে ইরফাদের নাম দেখে সে এতোটাই আবেগপ্রবন হয়ে গিয়েছিলো যে হাতের লেখাটাও খেয়াল করেনি। আর স্যার কেন ওর কাছে চিঠি লিখে দিবে,তাও এরকম টাইপের! উফ! আমি এতো বড় ভুল কি করে করললাম??
মিহির কাধ থেকে ব্যাগটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছে। মিহি অসহায়ভাবে চেয়ে আছে রাদিবের দিকে,,
“” আমি ক্লাসে যাবো।””
“” এখন গেলে স্যারের হাতে বকা খাবি। তার থেকে ভালো নয়কি আমরা একটু প্রেমালাপ করি?””
“” রাদিব তোর আচরনে আমি ভয় পাচ্ছি।””
মিহি দৌড়ে দরজায় হাত লাগায়,লক খুলে বের হওয়ার আগেই ওকে টেনে নিজের দিকে নিয়ে নেয় রাদিব। মিহি ভয়ে আৎকে উঠছে। কি হতে চলেছে তার সাথে বোঝার ক্ষমতাটুকুও যেন নেই। চিৎকার করেও লাভ নেই,এই টাইমে সবাই যার যার মতো বিজি!
মিহির মাথার স্কার্ফটা টেনে খুলে নিয়ে রাদিব বললো,,
“” অনেক ঘুরিয়েছিস আমাকে। তোর জন্য আমার বন্ধুরা আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করে,খুব দেমাক তোর না? স্যারের সাথে প্রেম করবি?? চল তোর সব দেমাক আমি ভেঙে গুড়িয়ে দিবো!””
মিহি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টাও করছেনা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রাদিবের দিকে। এমন রুপী ছেলে মানুষকে মিহি আগে দেখেনি,তার সুন্দর ভাইয়া,ইরফাদ ভাইয়া আর সুন্দর বনমানুষ ভাইয়াটার মধ্যে তো এমন রুপ সে দেখেনি!
রাদিব মিহির সাদা এপ্রোনের বোতামগুলো টেনে ছিড়ে ফেলে ওর ফর্সা গলায় মুখ ডুবাচ্ছে।
চলবে