তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (২০)

0
3179

#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (২০)
#রোকসানা-রাহমান

মিহি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টাও করছেনা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রাদিবের দিকে। এমন রুপী ছেলে মানুষকে মিহি আগে দেখেনি,তার সুন্দর ভাইয়া,ইরফাদ ভাইয়া আর সুন্দর বনমানুষ ভাইয়াটার মধ্যে তো এমন রুপ সে দেখেনি!

রাদিব মিহির সাদা এপ্রোনের বোতামগুলো টেনে ছিড়ে ফেলে ওর ফর্সা গলায় মুখ ডুবাচ্ছে। মিহির শরীরের উষ্ণতায় নিজেকে আকড়ে ধরতে চেয়েছিলো রাদিব। কিন্তু তাকে অসফল করে দিয়ে কেউ একজন তাকে টেনে সরিয়ে নিচ্ছে। রাদিব চোখ মেলে তাকিয়েই ভয়ে আৎকে উঠে।অস্ফুটস্বরে বললো,,

“” স্যার আপনি?””

~~

টিফিন টাইম শেষে একাদশ শ্রেনির আর্টস ভবনের দিকে যাচ্ছিলো ইরফাদ। দেলোয়ার স্যারের অনুপস্থিতে পরপর তিনটা ক্লাসের ভার পড়েছে তার উপর। কলেজের বারান্দা পেরিয়ে দোতলার সিড়ির দিকে পা পড়তেই চোখ পড়ে কমার্স ভবনের দিকে। মিহি ব্যাগ নিয়ে আনমনে কোথাও একটা যাচ্ছে। এমন ক্লাস পিরিয়ডে ব্যাগ নিয়ে বের হতে দেখে কিছুটা সন্দেহ হয় ইরফাদের। হয়তো ক্লাস ফাঁকি দিয়ে অন্য প্লেন করেছে। ইরফাদ কয়েকটা কড়া কথা বলবে ভেবেও থমকে দাড়িয়েই থাকে। হঠাৎ মনে হলো,কলেজে জয়েন হওয়ার পর থেকে মিহির সাথে ঠিকমতো দুটো কথাও হয়নি তার । যতবারই দেখা হয়েছে ওর আজগুবি কান্ডের জন্য বকাঝকা করেছে। তার কি দোষ? ইচ্ছে করে তো আর বকা দেয়নি,বকা দেওয়ার মতো কাজ করলে তো বকা খাবেই। ইরফাদ ঠিক করেছিলো আজ সে কিছু বলবেনা। যা বলার ইশাদকে দিয়ে বলাবে। নিজের চিন্তা-ভাবনা নিয়েই ইরফাদ সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। কিন্তু ক্লাসে ঢুকতে গিয়েই ভেতরটা কেমন নড়ে উঠলো। একটা চাপা অসস্থি হচ্ছে,সাথে খারাপ চিন্তারা মাথায় ভর করছে। হঠাৎ করেই ইরফাদের মনে হলো,মিহি যতই দুষ্টুমী করুকনা না কেন,সে কখনো ক্লাস ফাঁকি দেয়না। তাহলে আজ কেন দিচ্ছে? কোথায় যাচ্ছে সে??

ইরফাদ ক্লাসের ভেতরে পা ফেললেও,ঢুকলোনা। দ্রুত কদম ফেলে সিড়ির দিকে ছুটছে। পেছন থেকে ৫০/৬০ জন স্টুডেন্টের সালামের প্রতিধ্বনি বাজছে!

~~

ইরফাদ প্রচন্ড গতিতে টেনে ধরে ছেড়ে দিতেই রাদিব ছিটকে পড়ে দেয়ালটার সাথে। কন্ঠ থেকে ছোট্ট করে বের হয়ে আসে আহ! শব্দটি। ভয়ে ভয়ে ইরফাদের দিকে তাকাতেই কলিজার পানিটুকুও শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা।

ইরফাদ রাগে ফেটে পড়ছে। চোখদুটো লালবর্নে প্লাবিত। কপালের ভাজের সাথে মিশে গিয়ে কুঁচকে আছে তার ঘন ব্রুযুগল। নাকটাও কেমন ফুলে ফুলে নিবে যাচ্ছে। নিশ্বাস উঠা-নামার সাথে সাথে উচ্চশব্দে মুখরিত জনমানবহীন শূন্য লাইব্রেরির করিডোর!

ইরফাদ প্রচন্ড ক্ষিপ্রতার সাথে রাদিবের কলার চেপে ধরে। মুখে তার রো শব্দটিও নেই। উপরের ঠোঁট দিয়ে চেপে আছে নিচের ঠোঁটটি। হয়তো চাচ্ছেনা কোনো শব্দ হোক। রাদিবকে টেনে ছিচড়ে লাইব্রেরি থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। রাদিবের আকুতি আর মিনতির কোনো সুরই বাজছেনা ইরফাদের কানে। আজ বুঝি ইরফাদের কানে কোনো শব্দ যাবেনা। দেখবেনা কারো মিনতির হাতদুটো।

ময়লার বস্তাটা যেমন নাক শিটকে ডাস্টবিনে ফেলা আসা হয়,তেমনি রাদিবকেও ঠিক সেভাবেই মাঠের মাঝখানে এনে ঢিল মেরে ফেলে দিলো ইরফাদ। কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলেও পারলোনা। আচমকায় ঝাপিয়ে পড়েছে রাদিবের উপর। মাথায় চড়ে বসা সবটা রাগ গিয়ে ছুড়ে ছুড়ে ফেলছে রাদিবের উপর।

ইরফাদের এমন কান্ডে পুরো কলেজের স্টুডেন্ট,টিচার,দারোয়ান,কেরানীসহ রাস্তারও অনেক মানুষ জড়ো হয়ে পড়েছে। সবাই একে অপরের সাথে কথা বলে বুঝার চেষ্টা করছে,আসলে কি হয়েছে??? কিন্তু কেউ সাহস করে ইরফাদকে আটকানোর চেষ্টা করছেনা। চোখে,মুখে হিংস্রতা যেন সবাইকে ভয় পায়িয়ে দিচ্ছে। রাদিবের ভয়ংকর চিৎকারে মায়ায় পড়ে প্রিন্সিপাল এগিয়ে এলেন,সাথে আরো কিছু সহকারী শিক্ষক।

ইরফাদকে সকলে টেনে ধরে সোজা করে জানতে চাচ্ছে,কি হয়েছে?? কিন্তু কারো কোনো প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেনা ইরফাদ। তার জ্বলন্ত চোখ তখনো পুড়িয়ে দিচ্ছে মাটিতে লুটিয়ে থাকা আহত রাদিবকে।

হটাৎ মিহির কথা মনে হতেই ইরফাদের সব রাগ পানি। রাগের বশে সে এতোটাই নিমজ্জিত ছিলো যে মিহির কথা মাথা থেকে ঝড়ে গিয়েছিলো। কি করছে ও? মনের কাছে প্রশ্ন করেই চারাপাশটা চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু আশেপাশে কোথাও না পেয়ে ছুট লাগালো লাইব্রেরির উদ্দেশ্যে!

লাইব্রেরির ভেতর ঢুকে ইরফাদের শিরদাড়া বয়ে যাচ্ছে ঠান্তা পানির শীতল স্রোত! মিহি মেঝেতে বসে আছে। পা দুটো ভাজ করে হাতদিয়ে চেপে ধরে আছে। জামাকাপড় ঠিক করেনি। চোখ দুটো চেয়ে আছে দেয়ালের দিকে। ইরফাদ দৌড়ে গিয়ে মিহির কাছে বসলো। কন্ঠে যতটা পারলো আদুরী সুর এনে বললো,,,

“” মিহি!””

ইরফাদের ডাক বা উপস্থিতি কিছুই যেন অনুভব করছেনা মিহি। এখনো সে আগের মতোই বসে আছে। দৃষ্টি তার দেয়ালে। তবে কি ও প্রচন্ড ভয়ে থমকে গিয়েছে??? ইরফাদ নিজেই নিজেকে বকে যাচ্ছে। তার উচিত ছিলো আগে মিহিকে সামলানোর। কতটুকুই বয়স মেয়েটার?? ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতাটুকুও এখনো হয়নি। তার মধ্যেই এমন কঠিন পরিস্থিতির স্বীকার সে কিভাবে মানবে??

ইরফাদ আলতো করে মিহির মাথায় হাত রেখে বললো,,

“” মিহি,কিছু হয়নি। আমি থাকতে তোমার কিছু হবেনা। দেখো আমি তোমার ইরফাদ ভাইয়া!””

ইরফাদের ছোয়ায় মিহি হালকা নড়ে উঠেছে। চোখের দৃষ্টি ঠেকেছে ইরফাদের চোখে। অবুঝ চোখে চোখ পড়তে ইরফাদের মুর্চে যাওয়ার অবস্থা। এক
অপরাধবোধ দাপিয়ে উঠছে। ইশাদ তো তার ভরসায় মিহিকে এখানে ভর্তি করেছিলো। অথচ আজ কি একটা ভয়ংকর মুহুর্ত পার করতে হচ্ছে মিহিকে। যদি আরেকটু দেরি হতো তাহলে কি কখনো নিজেকে মাফ করতে পারতো???

ইরফাদ ভরসার পলক ফেলে আমি আছি বুঝাতেই মিহি ওকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো। প্রচন্ড বাতাসের তারণায় উত্তাল ঢেউ যেমন আচড়ে পড়ে সমুদ্রের বুকে। মিহিও যেন তেমনি উত্তাল ঢেউ হয়ে আচড়ে পড়েছে ইরফাদের বুকে। নিজেকে মিশিয়ে নিতে চাচ্ছে ইরফাদের সাথে। এই মানুষটার ছোয়ায় থাকলে তাকে যে আর কোনো ভয়ংকর রুপ দেখতে হবেনা।

মিহির আকস্মিক কান্ডে কিছুটা নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলেছিলো ইরফাদ। পেছন দিকে পড়ে যেতে গিয়েও ডানহাতের ভর করে নিজেকে ধরে রাখে। বা হাতে চেপে ধরে আছে মিহিকে। নিজেকে ঠিকঠাকমতো গুছিয়ে নিয়ে মিহির পিঠে ভরসার হাত পড়তেই ও হাউমাউ করে কেঁদে উঠে। ভয়ে কেঁপে উঠছে পুরো শরীর। মিহিকে কিভাবে শান্তনা দিবে বুঝে উঠতে পারছেনা ইরফাদ। তবে এখন অনেকটা শান্তি লাগছে এইটা ভেবে যে মেয়েটার ভেতরের ভয়টা বের হয়ে আসছে। অতিরিক্ত ভয়ে জমে যাওয়া পাথরটা কান্না আর কাপুনি দিয়ে ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে।

ইরফাদ বেশ কিছুক্ষণ অভাবেই চুপ করে রইলো। কিন্তু কান্নার গতি কমার বদলে বেড়ে যাচ্ছে মিহির। ইরফাদ আবার বললো,,

“” মিহি কিছু হয়নি। এতো কাঁদলে মাথা ব্যথা হবে।””

ইরফাদের কন্ঠ পেয়ে মিহির কান্নার রেশ আরো বেড়ে যাচ্ছে। ইরফাদ ওকে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলে ও আরো বেশি চেপে ধরছে। এমন মসিবতে পড়ে ইরফাদ বোকা বনে যাচ্ছে। কি করবে,কি বলবে কিছুই মাথায় আসছেনা। ইশাদকে কল দিবে কি??? এই মেয়েটাকে একমাত্র ইশাদই সামলাতে পারবে।

ইরফাদ পকেট থেকে ফোন বের করেছে। বা হাত দিয়ে লক খুলে কললিস্টে ঢুকতেই মিহির শরীর অসার হয়ে যাচ্ছে। কান্নার রেশ কমে গিয়ে পুরো ভারটা ছেড়ে দিচ্ছে ইরফাদের উপর। ইরফাদ ভয়ে ফোনটা ফেলে দিয়েই ডাকতে লাগলো,,,

“” মিহি! মিহি!! চোখ মেলো।””

~~

ভয় মিহিকে এতোটাই গ্রাস করেছিলো যে ও জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো। এমতাবস্থায় ওকে ওর বাসায় না নিয়ে নিজের বাসায় নিয়ে যায় ইরফাদ। এই সময় মিহির বাসায় কেউ থাকেনা। ফরিদা বেগম অফিসে। এমন খালি বাড়িতে একটা মেয়েকে নিয়ে উঠার চেয়ে নিজের বাসায় উঠায় ভালো হবে। তার উপর,বাসায় আম্মু,আব্বু,ইনা আছে। ইশাদকেও ফোন করে আসতে বলে দেওয়া হয়েছে। সবার মাঝে থাকলে ভয়টাও কাটিয়ে স্বাভাবিক হতে পারবে।

মিহির জ্ঞান ফিরলে পিটপিট করে চোখ মেলে। তার কাছেই একহাত দুরে বসে আছে ইরফাদ,হাতে খাবারের প্লেট। সামনে চোখ,মুখ কুচকে বসে আছে ইনা। তার মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সে খেতে চাইছেনা তবুও তাকে জোর করে খাওয়ানো হচ্ছে। বাবা মেয়ের ভালোবাসা দেখে চোখে হাসির ঝলক ঝিলঝিল করছে মিহির। আপনমনে চেয়ে আছে ইরফাদের দিকে। দক্ষিনসাইডের জানালা দিয়ে বয়ে আসছে মৃদু বাতাস। বাসাতের দাপটে ক্ষনে ক্ষনে বাড়ি খাচ্ছে ইরফাদের কপালে পড়ে থাকা ছোটছোট চুলগুলো। একটু পর পর নড়ে উঠে কপালটাকে প্রদর্শন করছে। এ যেন প্রদর্শন খেলা চলছে। ইনাকে উদ্দেশ্য করে বলা আদুরী কন্ঠ শুনে মিহি মনে মনে বললো,,,ইশ! আমাকে কি এভাবে কখনো ভালোবাসবেন???

“” বড় বাবাই,দেখো আপুটার মনে হয় ক্ষিধে লেগেছো,কেমন করে চেয়ে আছে তোমার দিকে। তুমি বরং বাকি ডিমটা আপুকে খায়িয়ে দাও।””

ইনার কথায় চমকে উঠে ইরফাদ। চট করে মিহির দিকে চোখ পড়ে। মিহি তখনো মুগ্ধ নয়নে চেয়ে আছে ইরফাদের দিকে। ইরফাদ হাতের প্লেটটা রেখে উচ্চকন্ঠে ইশাদকে ডেকে উঠে। হঠাৎ আদুরী কন্ঠ এমন জোরালো হওয়াতে মিহির হুশ এলো। শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লো। আশেপাশে তাকিয়ে বললো,,

“” আল্লাহ! আমি কোথায়?? আমি এতক্ষণ স্বপ্নে ছিলাম না??””

ইনা টুপ করে মিহির হাতে চিমটি কেটে বললো,,

“” নাতো। তুমি তো আমাদের বাড়িতে। সোনাপু আমি তোমার হাতে খাবো।””

ইনা গড়িয়ে এসে মিহির কোলে বসে পড়লো। ইরফাদের হাত থেকে ডিমের প্লেটটা নিয়ে মিহির হাতে ধরিয়ে দিয়ে ফিসফিস করে বললো,,

“” তুমি আমাকে একটু একটু করে খায়িয়ে দিবে আর তুমি চুপচুপ করে বেশি খেয়ে নিবে। কেমন?””

অসহায় চোখে ইনার দিকে তাকিয়ে আছে আছে,,,আমি তোর বাবার বুকে ঠাঁই নিয়ে মা হতে চাচ্ছি,আর তুই আমাকে বোন বানিয়ে ফেলছিস?? একবার মা হয়ে আসতে দে,তোর এই ঘোর অন্যায়ের জন্য তোকে কান ধরে উঠবস করাবো,পাজি মেয়ে!

ইরফাদ মিহির হাতে ওমলেটটা ধরিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেছে। মনটা তারও খারাপ,যেখানে মিহিকে ইশাদের বউ বানাতে চাচ্ছি সেখানে ইনা ওকে আপু বলে ডাকছে,সবকিছু এমন জগা খিচুরি পেকে যাচ্ছে কেন???

~~

তিহির কাছ থেকে ফেরত এসে ইশাদ আর বাড়িমুখো হবেনা প্রতিজ্ঞা করেছিলো। হসপিটালের কাছেই একটা ফ্ল্যাটও ভাড়া নিয়েছিলো। কিন্তু থাকার সৌভগ্য হয়নি। আব্বু আর ভাইয়ের সাথে পেরে উঠছিলোনা তার মধ্যে তার কলিজার টুকরো ইনা?? ওকে ছাড়াও যে কখনো অন্য কোথাও রাত কাটানো হয়নি! সবাইকে উপেক্ষা করে ফ্ল্যাটে পা ফেললেও ইনার ফুপানি শুনে তখনি নিজের প্রতিজ্ঞা পা মাড়িয়েছিলো। ছুটে চলে আসে তার পুরোনো মাতৃছায়ার নিচে।

“” তোর,মা যে সারাদিন ধরে অনশন পালন করে আসছে,সে খবর কি তুই রাখছিসনা?””

হঠাৎ জমিল সাহেবের প্রশ্নে ইশাদ বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,,

“” কেন?””
“” কি কেন?””
“” অনশন করেছে কেন?””
“” আমি কি জানি? আমাকে তো কিছু বলেনি!””

ইশাদ ফোন টিপতে টিপতে ছোট্ট করে বললো,,

“” ওহ!””
“” তোদের মা-বেটার রহস্য কি এবার খুলবি?? আমি রহস্যের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমার হাই প্রেসার,লো হয়ে গেছে “”
“” তোমাকে কে বলেছে প্রেসার পরিবর্তন করতে?””
“” তাহলে কি করবো? আমার এতো প্রাণবন্ত সংসারটা দিনে দিনে খর্ব হয়ে যাচ্ছে। পরিবারের প্রধান কর্তা হয়ে আমি কিভাবে সহ্য করবো?””

ইশাদ ফোনটা বিছানায় ফেলে বললো,,

“”আমা সাথে আসো,আব্বু!

ইশাদ টুম্পাকে ডিনার রেডি করতে বলে মরিয়ম বেগমের রুমের দিকে পা বাড়ালো।

~~

মরিয়ম বেগম আধশোয়া হয়ে বসে আছেন। পায়ের দিকটায় পাতলা কাথা দিয়ে ঢাকা। তার পাশেই ইরফাদ আর ইনা বসে আছে। মরিয়ম বেগমের মুখটা অন্যদিকে ঘুরানো।

“” আম্মু,এভাবে না খেয়ে থাকলে তোমার শরীর আরো দুর্বল হয়ে যাবে। শুধু শুধু কেন অভিমান করছো?””

ইরফাদের প্রশ্নে মরিয়ম বেগম চুপ। এতে যেন ইরফাদ আরো বেশি হাতাশ হলো। পুরো আধঘন্টা যাবত মায়ের অভিমান ভাঙানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে সে। কোনোভাবেই তুষ্টি করতে পারছেনা। এমন কি মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করাতে পারেনি।

ইশাদ ধীরপায়ে রুমের ভেতরে ঢুকে মরিয়ম বেগমের দিকে অগ্রসর হলো। বিছানার উপর উঠে বসলো। সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে। আম্মুর ডানহাতটি নিজের চুলের উপর রেখে বললো,,

“” কি করেছো,কেন করেছো, জানিনা। কিন্তু মা কখনোই ভুল করতে পারেনা। যে মায়ের পায়ের নিচে আমার জান্নাত বয়ে যাচ্ছে তার উপর রাগ করে আমি জাহান্নামী হতে চাইনা। তার ভুলও ধরিয়ে দিতে চাইনা। শুধু চাই তোমার মুখের হাঁসি। তার জন্য আমাদের কি করতে হবে??””

ইশাদের দিকে তাকিয়ে আছেন মরিয়ম বেগম।

“” কি হলো,মাথায় হাত বুলিয়ে দিবেনা?? বড় হয়েছি বলে কি আদর শেষ হয়ে গিয়েছে?””

মরিয়ম বেগম ছলছল নয়নে ইশাদের চুলে বিলি কেটে বললো,,

“” এমন নিরামিষ সংসার আমার আর ভালো লাগছে না রে। এতো বড় বাড়ি কেমন খালি খালি লাগে। তোদের মতো দুটো বিয়েপোক্ত ছেলে থাকতে আমার একটাও বউ মা নাই!””
“” ভাইয়াকে বিয়ে করিয়ে দাও!””

ইশাদের কথায় ইরফাদ বসা থেকে উঠে পড়ে বললো,,

“” কি সব ভুলভাল বকছিস? আমার কি বিয়ের বয়স আছে নাকি?””
“” তাহলে কিসের বয়স আছে,ভাইয়া? তুমি এখনো ত্রিশের কোঠায় আছো,বুড়ো হয়ে যাওনি!””
“” মার খাবি। চুপ করে থাক।””
“” কেন চুপ করবো? তোমার কি মনে হয়,সারাজীবন আমরা তোমাকে সঙ্গ দিবো? তোমার কোনো সঙ্গীর প্রয়োজন নেই?””

ইরফাদের ঝটপট উত্তর,,

“” না,নেই। আমার ইনা মা থাকলেই চলবে।””
“” কিন্তু ইনার মামনির প্রয়োজন আছে।””
“” তোকে বলেছে এ কথা?””
“” না,বলবে।””

ইশাদ মরিয়ম বেগমের কোল থেকে সরে গিয়ে ইনার উদ্দেশ্যে বললো,,

“” সোনামা,তোমার মামনি চায়না?””
“” চাইতো। আমার দুটো বাবাই আছে কিন্তু একটাও মামনি নাই।আমার মামনি চাই,আদর চাই!!””

ইরফাদ হা করে ইনা আর ইশাদের তাকিয়ে রইলো।দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে,প্লেন করে ইরফাদকে ফাঁসাতে চাচ্ছে। ইশাদ নিজের কথাটাকে আরেকটু পোক্ত করতে আবার বললো,,

“” তুমি বিয়েতে হ্যা না বলা পর্যন্ত আম্মু অনশন ভাঙবেনা। সাথে আমরাও এখন থেকে অনশন শুরু করবো।””

ইরফাদ একটা ব্রু খানিকটা উচিয়ে বললো,,

“” আম্মু এ কথা কখন বললো?””
“” এখনি।””
“” কই আমি তো শুনলাম না।””
“” আম্মু শুনিয়ে বলেনি তাই শুনোনি, ওয়েট!””

ইশাদ এবার মরিয়ম বেগমের দিকে ফিরে বললো,,

“” আম্মু,তুমি একটু আগে মনে মনে যেটা বলেছো ঐটা এখন ভাইয়াকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলোতো!””

কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুই বুঝছেননা মরিয়ম বেগম। ইশাদের দিকে তাকিয়ে থাকলে ও ইশারা করতেই উনি বললেন,,

“” ইশাদ ঠিকই বলেছে। তুই যদি চাস আমরা এখন ডিনার করতে যাই তাহলে তোকে বিয়ের জন্য হ্যা বলতে হবে।””

ইরফাদ অসহায়ভঙ্গিতে জমিল সাহেবের দিকে তাকালে উনি বললেন,,

“” আমি আমার ইনাদিদুনের দলে!””

ইরফাদ অসহায়ভঙ্গিতে সবার দিকে তাকিয়ে আছে। সকলের দৃষ্টি তার উপর। তার উত্তরের আশায় উৎসুক। ইরফাদ ঠোঁটের কোনে হাঁসি জমিয়ে বললো,,

“” ফেঁসে যখন গিয়েছি আমি রাজী হলাম। তবে একটা শর্ত আছে,মেয়ে আমার মতো হতে হবে!””

ইনা সাথে সাথে উঠে দাড়িয়ে বললো,,,

“” আমার ক্ষুধা লেগেছে,আর কতক্ষন অনশন করতে হবে?””

ইনার কথায় সকলে হেঁসে উঠলো। সবাই ডাইনিংয়ের দিকে এগুলে ইরফাদ ইশাদের হাত ধরে আটকালো।

“” বিয়েতো আমি করবো,তার আগে তোর আমাকে প্রমিস করতে হবে,এ বাড়িতে বড় বউয়ের পা পড়ার সাথে সাথে ছোট বউয়ের পা ও পড়বে।””

ইশাদ ইরফাদের হাত সরিয়ে দৃঢ়কন্ঠে বললো,,

“” ঝড় একবারই উঠেছিলো,এখনো সামলাতে পারিনি,আর মনে হয়না কখনো সামলিয়ে উঠতে পারবো।””
“” আমি পারলে তুই কেন পারবিনা?””
“” তুমি বুকে টেনে নিয়েছিলে,আর আমি দুরে সরিয়ে দিয়েছি বলে!””

ইশাদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে ইরফাদ,তোর বুকে ঝড় আমি আবার উঠাবো,এমন একজনকে দিয়ে যাকে তুই ফিরিয়ে দিতে পারবিনা।

~~

সুখ,দুখ,হতাশা,সাফল্য,ব্যর্থতা মানুষকে ক্ষনিকের জন্য থমকে রাখলেও সময় কখনোই থমকে থাকেনা। সময় তার আপনগতিতে চলতেই থাকে। তিহি,ইশাদ,তাজ,মিহি,ইরফাদ,ইনা তাদের জীবন থেকেও আরো ছ’টা মাস চলে গিয়েছে। এই স্বল্প সময়ে তাদের জীবনে খুব একটা পরিবর্তন না এলেও মিহি আর ইরফাদের সম্পর্কে এসেছে। নুয়ে যাওয়া সম্পর্কটা আবার তাজা হয়ে এসেছে। একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দুটি মানুষের দুরত্ব অনেকটাই কমে এসেছে। মিহির মনের গভীরে পড়ে থাকা ভালোবাসাগুলো জমে জমে বিশাল পাহাড়ে পরিনত হচ্ছে। সেদিকে ইরফাদের কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। সে যে অজান্তেই মিহির এক তরফা ভালোবাসাটাকে আরো বেশি গাঢ় করে দিচ্ছে তার পরিনতি কি হবে???

মিহির সাথে ঘটে যাওয়া সেই ভয়ংকর ঘটনার পর মিহির উপর কড়ানজর রাখছে ইরফাদ। রোজ সময় করে ওকে কলেজে নিয়ে আসা,ছুটি শেষে বাড়ি পৌছে দেওয়া এমন কি পুরো টিফিনটাইমেও ওর সাথে গল্প করে কাটাচ্ছে। যাতে কারো মাধ্যমে কারো কোনো কথাতে কোনো প্রভাব না পড়ে মিহির উপর। সাথে এক দীর্ঘ পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে হলেও মিহির সাথে যথেষ্ট ফ্রি হওয়ার প্রয়োজন। আর বেশি সময় নেওয়া যাবেনা।

~~

ইরফাদের বিয়ের তোরজোর শুরু হয়ে গেছে। একের পর এক পাত্রী দেখা হচ্ছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই ইরফাদ পরিষ্কার গলায় না করে দিচ্ছে। পুরোপুরি ফেঁসে যাওয়ার আগে ইশাদের ঝড়ের একটু আবাস মাখাতে চায় ইরফাদ। তার মধ্যে ইদানিং মিহির আচরনে বেশ অবাক হচ্ছে ইরফাদ। ওর চোখের চাওয়া,কথাবার্তাতে অন্যকিছুর ছোয়া দেখতে পারছে ইরফাদ। এই বয়সটাতো সেও পার করে এসেছে। এইটাকে প্রশ্রয় দেওয়ার কোনো মানে হয়না যত দ্রুত সম্ভব মিহির সাথে কথ বলা দরকার!

ইরফাদ ক্লাসে বসেই মিহির নাম্বারে মেসেজ দিলো,,,

**aj coaching sese amar jonno Wait koro,joruri kotha ache**

~~

আজ মিহি ক্লাসে কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা। মাথা তার পুরো হট। কাল ইশাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে শুনেছে ইরফাদের জন্য পাত্রী দেখা হচ্ছে। খুব শিঘ্রই বিয়ে। খবরটা শোনার পর থেকে মিহির মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরপাক পাচ্ছে তার ভালোবাসার মানুষ বিয়ে করবে,অন্য কাউকে। সারারাত সে ঘুমুতে পারেনি। থেকে থেকে কান্না এসেছে। ঘুমের মধ্যে স্বপ্নও দেখেছে,ইরফাদ বউ নিয়ে খাটের উপর বসে আছে। মিহি এটা কিছুতেই হতে দিবেনা। ঐ বুড়োটাকে তার চায়,অন্য কেন নিবে??? মিহির জল্পনা কল্পনা ভেঙেই ফোনের টোন বেজে উঠেছে। চুপিচুপি ফোন চেক করে দেখে ইরফাদের মেসেজ। মেসেজটা ওপেন করে সেও রিপলাই করলো৷,,,

**amar o apnar sathe kotha ache,apnar thekeo digun joruri..**

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here