#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (২২)
#রোকসানা-রাহমান
তিহির রাগে চোখ বড় হয়ে আসছে। ইশাদ ওর কোলের বাবুটাকে নিজের আয়ত্তে নিতে নিতে ওর চোখে চোখ রেখেছে। চাপা কন্ঠে বললো,,
“” তোমার ঘামের গন্ধটাতো আরো বেশি মারাত্মক হয়ে গেছে!””
ইশাদ বাবুটাকে কোলে নিয়ে মুচকি হেঁসে কেবিন থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। সে হাঁসিটা তিহি দেখতে পায়নি,তাহলে হয়তো সে অবাকের তৃতীয় পর্যায়ে গিয়ে চোখটা বন্ধ করে ঠিক বলতো,ইশ! তুমি এতো সুন্দর করে কিভাবে হাঁসো? তোমার এই হাঁসিটা দেখার জন্য আমি যুগযুগ ধরে অন্ধের অভিনয় করে যেতে পারবো!
~~
ইশাদের চেম্বারের বাইরে দাড়িয়ে আছে তিহি। দরজাটার ঠিক মাঝখানে। ভেতরেও যাচ্ছেনা আবার বাইরেও যাচ্ছেনা। মেয়েটাকে টেবিলটার উপরে বসিয়ে তার সাথে খুনসুটিতে মেতে আছে ইশাদ। বাবুটাও কি খুশি! ইশাদের প্রত্যেকটা কথাতে সে দাঁত বের করে হাঁসি উপহার দিচ্ছে। আর ওর ছোয়াতে নানাভাবে নড়ে উঠছে সাথে খিলখিল হাঁসি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট হাতদুটো দিয়ে ইশাদের নাক,মুখ,চোখ ছুয়ে ছুয়ে দেখছে। দুর থেকেই দুজনকে চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে তিহি। বুকের ভেতর থেকে আসতে চাইছে চাপা আর্তনাদ । দুজনকে দেখলে যে কেউ বলবে এরা বাবা-মেয়ে। কেন এমনটা হলোনা? হলে কি খুব বেশিই মন্দ হতো?? ইশাদ তুমি কেন এমনটা করলে???
“” প্রাপ্তি মা,আমার চেম্বারটা তোর পছন্দ হয়েছে তো? তোর পছন্দ না হলে কি হবে? তোকে তো এখানে বার বার আসতে হবে। আমার তো মনে হয় আমি ডক্টর হয়েছি তোর আম্মু আর তোর খালামনির জন্য, বুঝলি? আমার বাকি জীবনটা এদের উপর ডাক্টারি করেই পার করতে হবে!””
ইশাদ নিজের বক্তব্য পেশ করে হেঁসে উঠতেই প্রাপ্তিও হেঁসে উঠেছে। ছোটছোট দুটো দাঁত বের করে হাঁসি। এই হাঁসির কি নাম হওয়া উচিত? দন্তহাঁসি? নাকি ইদুরহাঁসি?
“” এক্সকিউজ মি,ম্যাম?””
তিহি ইশাদের দিকে এতোটাই মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে যে আশেপাশে কি হচ্ছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। নিজের বোনের উপর যে রাগ ছিলো সেতো ইশাদের এক কথাতেই উবে গিয়েছে। এখন সে তৃপ্তি ভরে তার ইশাদকে দেখবে। একবার অতৃপ্তি মন নিয়ে সে এখান থেকে ফিরে গিয়েছিলো এবার আর সে ভুল করবেনা। কথা না হোক,চোখ দিয়েই সে তার ইশাদকে গিলে খাবে। যদি এটাই তার শেষ দেখা হয় তখন?? তার যে ইশাদকে দেখে মন ভরেনা। কতটা সময় পেরিয়ে গেছে সে ইশাদকে দেখেনা,তাও তো বছর হবেই।
“” ম্যাম,একটু সরবেন প্লিজ?””
তিহি ইশাদকে নিয়ে এতোটাই নিমগ্ন যে নার্সের কথা তার কানে ঢুকছেইনা। নার্সটা এবার বিরক্ত হলো। গলার সুর কিছুটা উচু করে বললো,,
“” ম্যাম??””
তিহি ছিটকে উঠে পেছনে তাকালো। কি হয়েছে বুঝার চেষ্টা করছে। নার্সের উচ্চকন্ঠে ইশাদও চমকে উঠেছে। প্রাপ্তির থেকে মনোযোগ ক্ষুন্ন করে দরজার দিকে পড়লো। তিহিকে দেখে কিছুটা নার্ভাস হয়েই বললো,,
“” তিহি ভেতরে এসে বসো। ওভাবে দরজা আটকে দাড়িয়ে আছো কেন?””
তিহি এতক্ষনে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সরে দাড়িয়েছে। নার্স নিজের কাজ শেষ করে চলে গেলো। তিহি ভেতরে ঢুকবে তার আগেই ইরফাদ হন্তদন্ত হয়ে হাজির।
“” ইশাদ,মিহি কোথায়? ও ঠিক আছে তো?””
হঠাৎ ইরফাদের এমন আগমনীতে তিহি আর ইশাদ দুজনেই চুপ। চেয়ে আছে তার দিকে। মনে হয় দৌড়ে এসেছে,প্রচন্ড টেনশনেও আছে যার ফলে শরীরের শার্টটা ভিজে বুক আর পিঠের দিকে ল্যাপ্টে আছে। ইরফাদ উৎকন্ঠী সুরে আবার বললো,,
“” বল না,মিহি ঠিক আছে তো? ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা। কোনোদিনও না।””
ইরফাদের কথায় এবার ইশাদ ছোট্ট একটা চিন্তানদীতে ডুব দিয়ে নিলো। মিহি কেন সুইসাইত করতে চেয়েছিলো ব্যাপারটা এখনো কেউ সঠিকভাবে জানেনা। তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছে,সমস্যাটা প্রেমঘটিত কোনো মামলাই হবে। তাহলে সেই প্রেমঘটিত মামলার প্রধান চরিত্রে ভাইয়া ভুমিকা পালন করছিলো? কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?
ইশাদ সুক্ষ নয়নে ইরফাদের দিকে চেয়ে আছে। এক অবিশ্বাস্য সত্যির মুখোমুখি হতে যাচ্ছে সে। ইশাদ ইরফাদের দিকে পানিভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,,
“” মিহি ঠিক আছে। তুই এখানে বস। তোর সাথে কথা আছে।””
ইশাদ প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে তিহির দিকে এগিয়ে গেলো। বাবুকে ওর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
“” তুমিও বসো। আমার মনে হচ্ছে। আমাদের মাঝে তোমার থাকাটাও জরুরী। আন্টি কোথায়?””
“” মিহির কাছে।””
তিহির দিকে একটা চেয়ার টেনে দিয়ে ইশারায় বসতে বললো। ইরফাদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,,
“” ভাইয়া কোনো প্রশ্ন করার আগেই সবটা বলে ফেল তো।””
“” কি?””
“” মিহির সুইসাইডের কারন!””
ইশাদের কথায় ইরফাদ কিছুটা ভড়কে গেলো। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছে তার এখন সবটা বলতেই হবে। এই মুহুর্তে নিজেকে আসামী মনে হচ্ছে। আর ইশাদকে বিচারক। একটু ভুল কিছু বললেই সে অর্ডার অর্ডার করে তাকে যাবজ্জীবন জেল নাহয় ফাঁসির রায় শুনাবে। ইরফাদ শুকনো গলা ভিজিয়ে নিতে পানির গ্লাসটায় হাত দিলো।
ইরফাদের মুখে সবটা শুনার পর ইশাদ একটা শব্দও করলোনা। চুপচাপ দুজনকে বসিয়ে রেখে নিজের চেম্বার ছেড়ে বেড়িয়ে গেলো। ইশাদের এমন কাজ ইরফাদকে আরো বেশি ভুগাচ্ছে। কি হচ্ছে কেন হচ্ছে,সে কিছুই বুঝতে পারছেনা। সে তো এমনটা আশা করেনি,স্বপ্নেও ভাবেনি তাহলে কেন হলো??
~~
মরিয়ম বেগমকেও নিজের চেম্বারে নিয়ে এসে তিহির পাশে বসিয়ে দেওয়া হলো। দরজাটা ভিড়িয়ে নিয়েছে। ইরফাদকে, তিহি আর মরিয়ম বেগমের দিকে ঘুড়িয়ে নিয়ে ইশাদ আবেদনী সুরে বললো,,
“” আন্টি,তিহি, আমার এই ভাইটাকে কি আপনাদের মিহির বর হিসেবে মেনে নিতে কোনো আপত্তি আছে?””
ইশাদের কথায় ইরফাদ চমকে গিয়েছে সাথে মরিয়ম বেগমও। কিন্তু তিহির কোনো সাড়া নেই। এতে যেন বেশ আহত হলো ইশাদ। মেয়েটা আসার পর থেকে শুধু হা করে ইশাদের দিকেই চেয়ে আছে। ইশাদ ছাড়াও যে একটা ভয়ংকর কান্ড ঘটে যাচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই। ইশাদ একটু বিরক্ত নিয়েই তিহিকে বললো,,
“” তিহি,প্লিজ! হুশে আসো। তোমার কি এখনো হুশে থেকে বেহুশ হওয়ার অভ্যাসটা যায়নি?””
“” তুমি যেতে দিলে তো যাবে।””
“” তিহি!””
ইশাদের ধমকে তিহি কেঁপে উঠে। আশেপাশে সবার উপস্থিতে কিছুটা লজ্জাবোধ নিয়ে নিজের মেয়ের দিকে মনোযোগ দিলো।
ইশাদ আবার বললো,,
“” আপনাদের যদি কোনো আপত্তি না থাকে তাহলে আজকেই মিহি আর ভাইয়ার বিয়ের কার্য শুরু হবে। “”
ইরফাদ কিছু বলতে চাইলে তার আগেই মরিয়ম বেগম বলে উঠলেন,,
“” আমাদের আর কি আপত্তি থাকবে,বাবা? যার জন্য আমার মেয়েটা মরতেও দ্বিধাবোধ করেনি তাকে কোন দ্বিধায় আমরা অমত পোষন করবো? আমার শুধু একটাই চাওয়া আমার মেয়েগুলো সুখি হোক।””
মরিয়ম বেগমের অনুমতি নিয়ে ইশাদ বেড়িয়ে পড়লো। পকেট থেকে ফোনটা বের করে নিজের বাবার নাম্বারে ডায়াল করলো। ততক্ষণে ইরফাদও ওর পিছু পিছু ছুটছে।
“” ইশাদ,তুই কি পাগল হয়ে গেছিস? মিহি আর আমি? কি করে সম্ভব?””
“” সেটা তো বিয়ে হলেই বুঝা যাবে,ভাইয়া!””
“” থাপ্পড় খাবি। ছোট হয়ে বড় ভাইয়ের সাথে ইয়ার্কি করছিস? ভুলে যাস না আমি তোর বড় ভাই হই।””
“” তোমার দিক থেকে ছোট হলে কি হবে? মিহির দিক থেকে আমি বড়। সে হিসেবে সম্পর্কে এখন আমিও তোমার বড় ভাই হই।””
ইশাদ নিজের কথার সাথে একটা চোখ টিপ মেরে দিলো। তাতে যেন ইরফাদ আরো বেশি ফুলে উঠছে।
“” এই বিয়ে কিছুতেই হতে পারেনা। আমার মত নেই।””
“” লাগবেনা।””
“” আমার বিয়ে আর আমার মত লাগবেনা?””
“” না।””
“” তুই কিন্তু বাড়াবাড়ি করছিস!””
“” বোনের সুখের জন্য এতটুকু বাড়াবাড়ি করলে দোষ নেই।””
“” ও তোর বোন হলে আমিও তো তোর ভাই হই। তুই আমার দিকটা দেখবিনা? আমি পর হয়ে গেলাম?””
“” পর কেন হবে? আমি তো সম্পর্ক আরো গভীর করতে চাচ্ছি,ভাইয়া।””
ইরফাদ নিজের রাগ সংযত করার চেষ্টা করছে। রাগে মাথা ফেটে যাওয়ার অবস্থা। ইচ্ছে করছে ইশাদের গালে দুটো কষে থাপ্পড় মেরে দিতে। নিজের রাগটা যতটা পারলো নিয়ন্ত্রনে এনে অনুনয় সুরে বললো,,
“” ইশাদ,বুঝার চেষ্টা কর,মিহি আর আমার মধ্যে এজের গেপটা অনেকটাই বেশি। ওর বয়স সতেরো আর আমার? আমার ৩৪+, প্রায় দ্বিগুন। আমি একজন এডুকেট পারসন হয়ে কি করে নিজের হাফ এজের একটা মেয়েকে বিয়ে করবো? আমার চিন্তা-ভাবনা আর ওর চিন্তা-ভাবনা সম্পুর্ন ভিন্ন,ওর আচরন,কথাবার্তা এখনো বাচ্চাসুলভ সেটা আমার থেকে তুই বেশি ভালো জানিস। এভাবে দুপ্রান্তের দুটো মানুষ কি করে একসাথে সংসার নামক সম্পর্কে আবদ্ধ হবে? এর ফিউচার কেমন হতে পারে তুই কি বুঝতে পারছিসনা?? শুধু মানসিক কেন শারীরিক…..””
“” আমি কিছু জানতে চাইনা ভাইয়া। আমি শুধু এটা জানি মিহির ইচ্ছে পুরনের দায়িত্ব আমার। আর সেখান থেকে আমি একচুলও নড়বোনা। দুজন দু প্রান্তে তো কি হয়েছে,ও যদি নিজেকে মানিয়ে নিতে না পারে তুমি নিবে। দরকার হলে তুমিও ওর মতো বাচ্চা হয়ে যাবে।””
“” ইশাদ,পাগলের মতো কথা বলিসনা। ইনার কথাটা একবার ভাব। ইনা আর ও তো প্রায় সেম। ইনা ওকে আপু বলে ডাকে।””
“” আপু ডাকলেই তো আপু হয়ে গেলোনা।””
“” ও আচ্ছা। আপু ডাকলে যদি আপু নাহয়,তাহলে তোকে ভাইয়া ডাকলে ভাইয়া কেন হবে?””
ইরফাদের এই প্রশ্নের উত্তর কি হবে ইশাদ ভেবে পেলোনা। বড় ভাইয়ের সাথে তর্কে পেরে উঠবেনা ভেবে বললো,,
“” এইটার উত্তর আমি ভাবিনি,ভাবা হলে তোমায় বলবো!””
“” আবার মজা করছিস??””
“” মজা কেন করবো? তোমার কি মনে হয়,এমন একটা ক্রিটিক্যাল মুহুর্তে আমি তোমার সাথে মজা করতে পারি?””
ইশাদ ফোনটা কানে ধরে ইরফাদকে পাশ কেটে চলে যেতে চাইলে ইরফাদ আবার বললো,,
“” তোর কি মনে হচ্ছেনা,তুই দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে ভুল করছিস? মিহির একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট করে একটা বদ্ধ কুয়োতে ছুড়ে ফেলছিস? ওর সত্যিকারের ভাই হলে হয়তো ব্যাপারটা অন্যভাবে ভাবতো। ওকে বুঝানোর চেষ্টা করত। তোরও উচিত ওকে ওর ভুল ধরিয়ে দিয়ে সুধরিয়ে দেওয়া, তা না তুই ওকে আশকারা দিচ্ছিস। শেষে আফসোস করবিনা তো? জীবনের নেওয়া একটা ভুলের জন্য যেভাবে মুর্চে যাচ্ছিস,দ্বিতীয় ভুলটাকে মেনে নিতে পারবি তো?””
ইশাদ ফোনটা কানে নিয়েই ইরফাদের দিকে এগিয়ে এলো। ইরফাদকে জড়িয়ে ধরে বললো,,
“” বদ্ধ কুয়োটা অন্য কারো নয়,আমার নিজের। আমার ভাইয়ের উপর সম্পুর্ন আস্থা আছে,আমার। সে আর যায় করুক না কেন,কাউকে কষ্ট দিতে পারবেনা। কারো জীবন নিয়ে খেলতে পারবেনা। সে রকম হলে সে কবেই মিহিকে ছুড়ে ফেলতে পারতো! ভাইয়া আর অমত করিসনা। দায়িত্বের বেড়াজালটা একটু হালকা করতে দে। মনের মধ্যে একটু প্রশান্তি আসুক!””
ইরফাদ হতাশ সুরে বললো,,
“” একটা বাচ্চা মেয়েকে একটা বুড়ো ছেলে কিভাবে সামলাবে ইশাদ? আমার তো বিয়েতে অমত নেই,কিন্তু মিহিকে করায় অমত। ওর জেনারেশনের তুলনায় আমি যে অনেকটা পিছিয়ে! আমার ভীষন ভয় করছে। আমি যদি না পারি? আমার চোখের সামনে একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যাবে!””
“” যেভাবে ইনাকে সামলাও সেভাবে সামলাবে।””
“” ইনা আমার মেয়ে,মেয়ে আর বউয়ের পার্থক্যটাও এখন তোকে বুঝাতে হবে?””
“” এতো রেগে যাচ্ছো কেন? আচ্ছা সেরকম হলে মিহিকে আবার বিয়ে দিবো!””
ইরফাদ ইশাদকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,,
“” তোরা দুজন দুপরিবারের ছেলেমেয়ে হলে কি হবে,পাগলের দিক দিয়ে দেখতে গেলে একদম পারফেক্ট ভাইবোনের বৈশিষ্ট্য বহন করছিস। আর তোদের মাঝখানে পড়ে এখন আমিও পাগল হয়ে যাচ্ছি।””
“” তোমাকে পাগল হতে হবেনা। শুধু বিয়েটা করলেই হলো।””
ইরফাদ আর সহ্য করতে পারছেনা। তার আর কিছু বলতেও ইচ্ছে করছেনা। জোর দিয়ে না ও বলতে পারছেনা। যে মেয়েটা এমন দুঃসাহসী কাজ একবার করতে পারে সে মেয়েটা দ্বিতীয়বার যে এর থেকে ভয়ংকর কিছুও করতে পারবে সেটা তার জানা হয়ে গেছে। মনে মনে বিড়বিড় করে বললো,,তুমি এটা ঠিক করোনি মিহি,তোমাকে পস্তাতে হবে!
~~
ইশাদ মিহির মাথায় হাত রাখতেই ও চোখ মেললো। তড়িঘড়ি করে শোয়া থেকে উঠে বসতেই দেখে সামনে ইরফাদ দাড়িয়ে রয়েছে। মনের ভেতর ভালো লাগার শীতল দোলা বয়ে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোনটাও বড় হয়ে যাচ্ছে।
“” শুভ জন্মদিন আমার মিহিরানী। আপনার জন্মদিনে,এই গরীব প্রজা আপনাকে একটা উপহার দিতে চায় সাথে ছোট্ট করে আয়োজনও করতে চায়। যদি আপনি আরজি মঞ্জুর করেন তো, আমি কি বলবো সেই উপহারটা কি?””
“” আপনার আরজি মঞ্জুর করা হলো। নির্ভয়ে বলতে পারেন!””
ইশাদ ইরফাদকে টেনে নিয়ে এসে ওর সামনে দাড় করিয়ে বললো,,
“” এইযে,আপনার রাজাহীন রাজ্যে রাজাকে উপহার দিলাম। আপনি অনুমতি দিলে ছোটখাটো আয়োজন করা যেতে পারে।””
মিহি কিছু বুঝতে পারছেনা দেখে ইশাদ ওর পাশে বসে বললো,,
“” এইটুকুন বয়সে যার জন্য মৃত্যুপথের যাত্রী হতে যাচ্ছিলে,তাকে তোমায় দিয়ে দিলাম। পারবেতো বাকি পথটা আমার ভাই আর আমাদের মেয়ে ইনাকে সামলে নিতে? অনেক বড় দায়িত্ব কিন্তু? মানুষটা ছোট হলে কি হবে? তোমার চাওয়াটা কিন্তু অনেক বড়,আমাদের বাড়ির বড় বউ হবে। দায়িত্বের চাপে নুয়ে যাবে নাতো?””
মিহি বাহাদুরী ভাবে বললো
“” আপনারা আমার পাশে থাকলে আমি সব পারবো!””
মিহি আড়চোখে ইরফাদের দিকে তাকাতেই হাঁসি হাঁসি মুখটা মিলিয়ে গেলো। কি রাগ! এমন রাগী মানুষটাকেও আমার এতো ভালো লাগছে কেন??
“” কিন্তু মিহিরানী,তোমার উপর কিন্তু আমি ভীষন অভিমান করেছি। তুমি একজনের জন্য আমাদের সবাইকে ভুলে গেলে? তোমার না আমাকে সামলানোর দায়িত্ব ছিলো? তুমি তো নিজ থেকেই নিয়েছিলে,তবে সব ভুলে গিয়ে এমন জঘন্যকাজটা কি করে করলে? তোমার কি আমার উপর ভরসা ছিলো না? একটাবার আমাকে বলতে তো পারতে! এতো অধৈর্য্য হলে কি করে হবে?””
“” সরি সুন্দর ভাইয়া। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আপনার আর আপুর কষ্ট দেখেছি আমি, এখনো দেখছি। আপনাদের মতো এমন কঠিন কষ্ট আমি সহ্য করতে পারবোনা। উফ! কত কষ্ট। আপনারা তো বেঁচে থেকেও মরে আছেন। তাই আমার মনে হলো,তার থেকে আত্মহত্যা করা বেশি ভালো।””
“” এটা ভুল কথা মিহিরানী। আত্মহত্যা কোনো সমস্যার সমাধান নয়,বরং আল্লাহর ভাগ্যকে অস্বীকার করা। তুমি কত বড় পাপ করতে যাচ্ছিলে জানো?? আত্মহত্যা করা মহাপাপ,সৃষ্টিকর্তার নির্ধারিত পথের বিপক্ষে যাওয়া!””
“” সরি,এমন ভুল আর হবেনা। আমি তো খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তাই এমন করে ফেলেছি। আমি ভেবেছিলাম আমি হয়তো ইরফাদ ভাইয়ার অন্যায় আবদার থেকে পিছপা হতে পারবোনা। তাই…””
“” অন্যায় আবদার মানে?””
মিহি আড়চোখে ইরফাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে দেখে ইশাদ আবার বললো,,
“” মিহিরানী,আমি জানি তুমি আমার থেকে কিছু লুকোবেনা। বলো অন্যায় আবদারটা কি ছিলো?””
মিহি টানা করে বললো,,
“” আপনার ভাই চাচ্ছিলো আমি আপনাকে বিয়ে করি!””
“” What!””
ইশাদ মিহির কাছ থেকে উঠে পড়েছে। দ্রুত কদমে ইরফাদের কাছে এগুলো। চোখে রাগ থাকলেও সেটা বিদ্রুপে নিয়ে বললো,,
“” মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে বাচ্চাদের মতো হয়ে যায়,জানিস তো?? এবার আমার সত্যি সত্যি মনে হচ্ছে তুই শুধু মিহির জন্য না,আমার জন্যও বুড়ো হয়ে গেছিস,নাহলে তোর মাথায় এমন আজগুবি বুদ্ধী কি করে এলো?? এতোদিনে তোর তো এটা বুঝে যাওয়ার কথা আমার আর মিহির মধ্যে ভাইবোনের মতো সম্পর্ক। তারপরেও যে এমনটা ভাবতে পারে সে কি নিছকই বাচ্চার কাতারে পড়ে না?? একটু আগে আমাকে যে যুক্তিগুলো দেখাচ্ছিলি এখন তো মনে হচ্ছে সব ভুল। তুই শেষ বয়সের বাচ্চা আর মিহি শুরুর বয়সের বাচ্ছা। শেষ আর শুরু কাটাকাটি করলে দুজনেই বাচ্চা। তো,এখন তোর আর ওকে বিয়ে করতে সমস্যা নাই,ভাইয়া। রেডি হয়ে যাও!””
ইশাদ বেড়িয়ে গেলে ইরফাদ মিহির দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষন অভাবে চেয়ে থেকে দপদপ পা ফেলে সেও বেড়িয়ে পড়লো। মনে মনে বিড়বিড় করছে,মেয়ের বয়স ৯,মায়ের বছর ১৮ আর বাপের বছর ৩৪,আহা! এমন ফ্যামিলির নামই তো গিনেস বুক অব ওয়ার্ডে উঠার কথা। মিস করা যাবেনা। একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে,নামটা কবে উঠবে।
~~
খুব দ্রুতগামীতে ইরফাদ আর মিহির বিয়ের কার্য সম্পাদন করা হয়েছে। তেমন জাঁকজমক না হলেও একেবারেই থমথমে ছিলোনা। নিজেদের পরিচিত,কাছের বন্ধুবান্ধব,আত্মীয়স্বজন নিয়ে তিনদিনের মধ্যেই বিয়ের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে তিহি আর ইশাদের দু/একবার দেখা হলেও কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। বিয়ের পুরো কাজটা ইশাদের বাসায় আয়োজন করা হয়েছিলো।
~~
মিহিকে বধু সাজে ইরফাদের রুমে দিয়ে এসে তিহি ছাদের দিকে পা বাড়ালো।
“” চলে যাচ্ছি আমি!””
হঠাৎ তিহির কন্ঠে ইশাদ নড়ে উঠেছে। কিন্তু পিছু ঘুরেনি। ভয় লাগছে তার। যদি পিছুটানে ভুল কিছু করে বসে? এতোদিন বাদে নিজের তিহিপাখিটার উপস্থিতটা সে সামলিয়ে উঠতে পারছিলোনা। বারবার ইচ্ছে করছিলো দৌড়ে ঝাপটে ধরে বলতে,তিহিপাখি,চলোনা আবার নতুন করে শুরু করি!
“” আমার সাথে কি একটু কথা বলা যায়না? তোমার চাওয়া পুরনেই তো দুরে চলে গেছি,তাও আমিই দোষি?””
তিহি ইশাদের পাশে এসে দাড়িয়েছে। তাতে যেন ইশাদের নড়নশক্তি ফুরিয়ে এসেছে। অসস্থিরা তাকে খেয়ে ফেলার উপক্রম,কষ্টগুলোরা নড়েচড়ে উঠছে। বুকের ভেতরটা কিঞ্চিৎ ব্যথা অনুভব হচ্ছে। নতুন ইচ্ছেরা ক্ষুধার্ত হয়ে উঠছে। মনটা খুব করে চাইছে তিহিকে একটাবারের জন্য জড়িয়ে ধরতে। বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলতে,ভালোবাসি তিহিপাখি,অফুরন্ত ভালোবাসি!
“” কিছু বলবেনা? চলে যাওয়ার আগে একটু তোমার কন্ঠে আমি কেঁপে উঠতে চাই,ইশাদ।””
“” সাবধানে যেও!””
তিহির চোখ ভিজে উঠছে। মানুষটা এতো শক্ত হয়ে গেলো কি করে?? তুমি তো এমন ছিলেনা ইশাদ। তোমার এই রুপটা আমাকে দুমড়ে-মুচড়ে পিষিয়ে ফেলছে। তুমি খুব পঁচা ইশ! আল্লাহর কাছে দোয়া করি এটাই যেন আমাদের শেষ দেখা হয়!! এমন পাষন্ড রুপী ইশাদকে দেখার চেয়ে না দেখে মরে যাওয়াও ভালো।
তিহি ধীর পায়ে চলে যেতে নিলে ইশাদ পেছন থেকে বললো,,
ছুবেনা আর তোমায় ইশাদের পবন,,
সাজিয়োনা আর ইশাদময় স্বপন,,,
লাল,নীল ফুলে ভরিয়ে মন,,
সাজিয়ে নিও তোমার ভালোবাসার অঙ্গন,,,,
শেষ হোক আজ,ইশাদ আর তিহির প্রেমের অঙ্কন,,,
তিহি আৎকা দাড়িয়ে পড়লো। আর এগুতে পারছেনা সে। চাপা কন্ঠে বললো,,
“” আমাকে আমার মেয়ের কাছে দিয়ে আসবে? আমি একা যেতে পারবোনা!””
ইশাদ তিহির হাতটা আকড়ে ধরলো। ওকে নিজের দিকে ঘুড়িয়ে নিলো। চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে ছোট্ট চুমু একে বললো,,
“” তুমি পারবে,তুমি সব পারো। আমার তিহিপাখি দুর্বল নয়। সে সব পারে। যাও!””
তিহি ভেজা চোখ নিয়ে আকুতিভরা কন্ঠে কিছু বলতে চাইলে ইশাদ হাতের তর্জনি দিয়ে ওর ঠোঁট চেপে ধরে বললো।
“” যাও।””
তিহি নিজের চোখের পানি মুছে নিয়ে সিড়ির দিকে পা বাড়িয়ে বললো,,
“” আমার বাগান তো তুমি নিজের হাতে গুছালে,এবার নিজেরটাও গুছিয়ে নাও। শুন্য বুকটা এভাবে খালি ফেলে রেখোনা। তাহলে কারো লোভীমন জেগে উঠতে পারে।””
“” বুকটা খালি নেই,একজনের নামে দলিল করা,সে আছে এখানে। তাকে কথা দিয়েছিলাম অন্য কারোর ছোয়া এখানে পড়বেনা!””
তিহি আর একদন্ডও ওখানে দাড়ালোনা। চোখের নোনাজলগুলো বাধ মানছেনা। আজ হয়তো মানবেনা বলে শক্ত পণ করেছে।
~~
ইশাদের বাসা ছেড়ে নিজের বাসায় আসতে রাত প্রায় ন’টা বেজে গিয়েছে তিহির। শিরিন বেগমের কাছে মেয়েকে দিয়ে এসে গোসল সেরে নিলো । এখন মনটা একটু হালকা হয়েছে। রুম থেকে বেরোতেই শিরিন বেগম বললো,,
“” আমি দিভাইকে নিয়ে ছাদ থেকে ঘুরে আসি!””
“” আচ্ছা।””
তিহি একা একা কি করবে বুঝতে পারলোনা। বারবার শুধু মন ভেঙে আসতে চাচ্ছে। কিন্তু সে যে আর কাঁদতে চায়না,আর কত কাঁদবে? তার জীবনটাকি কেঁদে কেটেই শেষ হবে??
তিহি সোফায় বসে টিভিটা অন করলো। চ্যানেল চেন্জ করতে করতে হঠাৎ আটকে গেলো। হিন্দী সিনেমায় রোমান্টিক সিন হচ্ছে। রিমোটটা নামিয়ে রেখে অপলকে চেয়ে আছে। এ রকম ছোয়া পাওয়ার জন্য সে কত ছটফট করেছে। কিন্তু কখনোই সে ইশাদের সামনে প্রকাশ করেনি। মানুষটা তো এমনি পাগলাটে আর যদি একটু উশকে দেয় তাহলে কি ওকে আটকানোর শক্তি হতো তিহির? কখনোই পারতোনা। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ প্রেমিকারাই তাদের প্রেমিকের ছোয়া থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে পারেনা। তাহলে সে কি করে পারতো? সে তো কোনো মহীয়সী নারী নয়? অন্যসব সাধারন মেয়ের মতো সেও সাধারন। কিন্তু বিয়ের আগে যে এগুলো পাপ!
তিহির ভাবনার মাঝেই হঠাৎ কারো ছোয়ায় শিউরে উঠে। তার পিঠে পড়ে থাকা ভিজে চুলগুলো সরে যাচ্ছে। কারো উষ্ণ ঠোঁটের উষ্ণ নিশ্বাসে তিহি নিজের চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। মনের অজান্তেই কন্ঠে ভেসে উঠলো,,,
“” ইশ!””
নামটা উচ্চারন হওয়ার সাথে সাথে তার গলার পাশে লেগে থাকা ঠোঁটজোড়া সরে যাচ্ছে।
চলবে