তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (২৪)

0
2843

#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (২৪)
#রোকসানা-রাহমান

তাজ সরে যেতেই তিহি হাফ ছেড়ে বেঁচেছে। তবে সস্তি পায়নি। পুরো একটা রাত রয়েছে। যে রাতটা তাকে এক আতংকেই কাটাতে হবে। কিন্তু কেন এতো আতংক? উনি তো আমার স্বামী হয়। স্বামীর ছোয়াকে এতো কেন ভয় পাচ্ছি আমি? আগে তো এমন লাগেনি,তাহলে আজ হঠাৎ কেন এমন লাগছে??

তিহি নানা চিন্তা-ভাবনা নিয়েই একপাশ হয়ে শুয়ে রইলো। এক সময় গভীর নিদ্রায় ডুব দিলো। গভীর ঘুমে যখন আচ্ছাদনে স্বপ্নের তীরে পা ফেলবে ঠিক তখনি ও চিৎকার করে উঠেছে। চোখ মেলে দেখে ওর বা’হাতের বৃদ্ধা আঙুলটি কামড়ে ধরে আছে তাজ!

তিহির চোখের দিকে চেয়ে আছে দুটি চোখ,যে চোখে কোনো হিংস্রতা নেই,রাগ নেই, রয়েছে আবেদনময়ী অনুনয়। এক খুশির রেখার কিছুটা আমেজও ফুটে উঠেছে চোখের অন্তস্তলে। মনিদুটো কেমন ভাসা ভাসা। তিহির চোখের ভয়ের রেশটা কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। কি হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করতে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। চোখটা একটু বাকা করে তাকাতেই খোলা আকাশ দেখতে পেলো। যেখানে রাতের আধারের সাথে খেলা করছে চাঁদের জোসনা। অর্ধচাঁদটার সাথে সঙ্গী হিসেবে তাঁরারাও রয়েছে। পুরো আঁকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে রাতের তাঁরা! তিহি একটু নড়তে গিয়েই বুঝতে পারলো সে তাজের হাতের বাধনে আটকে আছে। নিজের অবস্থানের দিকে নজর দিতেই কানে বাজছে কারো বুকের কম্পন। তারমানে সে তাজের বুকে ল্যাপ্টে আছে? কিন্তু কোথায় আছে সে?? তিহি চোখ ঘুরিয়ে ভালো করে চারপাশটা দেখে নিয়ে বুঝতে পারলো,এই মুহুর্তে তারা ছাদের পুব দিকটাতে বসে আছে,একটি ঝুলন্ত দোলনায়। তিহিকে নিজের পাশে বসিয়ে মাথাটা নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আছে তাজ। তিহি নির্লিপ্ত চোখে তাজের দিকে তাকালে ও মিস্টি করে হাঁসলো। নিজের বাধনের গভীরে নেওয়ার বাহানায় তিহির কোমড়টা আরেকটু গাঢ় করে চেপে ধরে ওর কানে ফিসফিস করে বললো,,

“” Happy 2nd Anniversary,Nesha bou!””

তিহি চমকে গিয়ে তাজের দিকে তীক্ষ্ণভাবে চেয়ে আছে। বিশ্বাস হচ্ছেনা তার। এটা কি আসলেই বাস্তব? মানুষটাকে এতো স্বাভাবিকভাবে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা তিহি। একবার তাজের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার আকাশের দিকে,আবার ডানে বামে। তিহির এই ছুটনি চোখের অস্থিরতা যেন তাজ বুঝতে পারলো। ঠোঁটের কোনদ্বয় বেশ বড়সর করেই প্রশ্স্ত করেছে। তিহির বা’হাতের বৃদ্ধা আঙুলটা তখনো তাজের দাঁতের সাথে আটকে আছে।

তিহির বা’হাতটাতে একটা মিস্টি কামড় বসিয়ে দিতেই তিহি চমকে উঠে হাত সরিয়ে নিলো। তাতে যেন বেশ মজা পেলো তাজ। ওকে দুহাতে আরামভঙ্গিমায় জড়িয়ে ধরে বললো,,

“” এটা স্বপ্ন নয় তিহি,এটা বাস্তব।””

তিহি এক হাত দিয়ে অন্য হাতের আঙুলটা বুলাতে বুলাতে উঠে যেতে নিলে তাজ ওকে আরো বেশি করে ঝাপটে নিয়ে বললো,,

“” ব্যথা পেয়েছো?? তোমার এই আঙুল মুখে দিয়ে ঘুমাতে দেখলেই আমার তোমাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। কি আছে গো তোমার এই আঙুলে? বাচ্চাদের মতো সারাক্ষন মুখে লাগিয়ে রাখো?? আমি তোমাকে ছুতে না পেরে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছি আর তুমি আলসে মেয়েদের মতো আঙুল মুখে দিয়ে ঘুমাচ্ছো। বেশি একরোখা হয়ে যাচ্ছেনা? বড্ড বেশিই কি স্বার্থপর লাগছেনা??””

তিহি ব্রু কুচকে তাজের দিকে তাকাতেই ও ঝটপট বললো,,

“” আমি মোটেও তোমার আঙুলের উপর হিংসে করিনি। হিংসেতে জ্বলেপুরে তোমাকে আঘাত করিনি। আমি জাস্ট তোমার ঘুম ভাঙতেই কামড় দিয়েছিলাম। খুব বেশি গভীর কামড় ছিলো কি? আমি তো তোমার ঘুমকে মেপে নিয়েই কামড়টা দিলাম। সাথে চেক করছিলাম তোমার আঙুলের মধুটা কত মিস্টি!””
“” ছাড়ুন আমায়।””
“” কেন,আকাশ দেখতে ভালো লাগছেনা?””

তিহি বিরক্তি নিয়ে বললো,,

“” যেভাবে চেপে ধরে আছেন আনি তো নড়তেই পারছিনা। আমার চোখের সামনে আপনার বোতাম খোলা পান্জাবীর মাঝে অর্ধবুক ছাড়া আর কিছু পড়ছেনা।””
“” যা পড়ছে তাই দেখবে। সবাইতো কালো আকাশের সাদা চাঁদের সাদা জোসনা বিলাস করে,তুমি নাহয় আমার সাদা পান্জাবীতে মোড়ে থাকা অর্ধবুকে লুকায়িত আকাশের লাল জোসনা বিলাশ করবে।””
“” লাল জোসনা?””
“” হুম,বুকের ভেতরেতো আর সাদা চাঁদ নেই,লাল হৃদয় আছে। তো লাল হৃদয়ের লাল জোসনাইতো ছড়াবে তাইনা।””
“” আমি রুমে যাবো। প্রাপ্তি একা আছে।””
“” তাতে কি? আমি তো ওর কানে কানে বলে এসেছি,আমি তোমাকে নিয়ে ছাদে আছি। যদি প্রয়োজন হয় তাহলে যেন আমাকে ফোন করে।””
“” ও আপনাকে ফোন করবে? ও তো এখনো ফোন ধরতেই শিখেনি।””
“” এ ফোন ধরতে হয়না। মনে মনে ভাবলেই কল চলে আসে। এটাকে বলে মনোফোন!””

তিহি এবার বেশ বিরক্ত হচ্ছে। গলার ভেতরে কথারা শুধু জমাটই বাধছে। ইচ্ছে করছে এতোদিনের লুকিয়ে রাখা কথাগুলো আজ গড়গড় করে বলে ফেলুক। একসাথে অনেকগুলো উগলে ফেলতে,যেমনটা বমি করা হয়। হোক সে কথাগুলো প্রয়োজনীয়,প্রস্ঙ্গিত অথবা অপ্রয়োজনীয়,তবুও বলতে ইচ্ছে করছে। তার জীবন থেকে কতগুলো দিন চলে গিয়েছে,যেগুলোতে সে মন খোলে,গলা ছেড়ে কথা বলেনি। সেগুলোর আজ শোধ তুলতে ইচ্ছে করছে।

“” নেশাবউ,এ দুবছরে আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি,তোমার থেকে আড়ালে আড়ালে থেকেছি,আমি আর আড়াল হতে চাইনা। তোমার সম্মুখে থাকতে চাই। এইভাবে তোমার ছোয়ায় থাকতে চাই।””
“” আমার ভালো লাগছেনা। ছাড়ুন।””
“” থাকোনা,প্লিজ! আমি ভেবেছিলাম আমরা আমাদের বিয়ের তৃতীয় বছরের প্রথম সকালটা ভোরের সুর্যের প্রথম রশ্নি দেখে শুরু করবো। যেন আমাদের জীবনটাও এমন আলোয় আলোয় ভরে থাকে। আর কোনো অন্ধকারে ভাসতে না হয়।””

তিহি চুপ করে রইলো। আধার রাতের চাঁদের জোসনার সাথে মিস্টিবাতাসের তীব্র গন্ধটা ভালোই লাগছে তিহির। মনোমুগ্ধকর মুহুর্ত! কিন্তু তাতে তাজের উপস্থিতি সে মেনে নিতে পারছেনা। সাথে তার কথাবলার ভঙ্গি। মানুষটা কি রিহ্যাবে গিয়ে পাগল হয়ে গেলো??

তিহি ভাবনার মাঝে চমকে উঠে। নিচের দিকে তাকাতেই দেখলো তার ডান পা’টি মেলে নিচ্ছে তাজ। তিহি পা সরিয়ে নিতে চাইলে তাজ জোর করে চেপে ধরলো। ওর দিকে না তাকিয়েই পকেট থেকে এক জোড়া নুপুর বের করে পড়িয়ে দিতে দিতে বললো,,

“” তোমার চলনগতিতে নুপুরের শব্দে আমি বারবার শিহরিত হবো। খুলোনা,প্লিজ! তোমাকে দেওয়া আমার প্রথম গিফট। ভালোবেসে দিচ্ছি।””

তাজ এক পা ছেড়ে আরেকপায়ে হাত দিতেই তিহি চট করে উঠে দাড়ালো। দৌড়ে চলে যেতে নিলেই ওর ওড়না টেনে ধরে তাজ। তিহি থমকে গিয়ে গলার কাছটাতে ওড়নাটা চেপে ধরে আছে।

তাজ ওড়না আকড়ে ধরে বসে আছে। তিহির দিকে ঘুরে তাকায়নি। উঠে দাড়ায়ওনি। বসা অবস্থায় বললো,,,,

**চলতি পথে,হাত রেখে তোমার হাতে,,
চলবো দুজন
অজানা গন্তব্যে
ভোরের দীপ্ত,প্রেমের সুপ্ত
ছড়াবে রশ্বন
শুরু হয়েছে সবে…

♪হয়ে স্মৃতি,করে ইতি
তোমার মনের অনুভূতি
থাকনা অতীতের পাতায়
আলিঙ্গন করে আমায়

আদুলীর এপিঠ, ওপিঠ
বসুক নিরবতা
মুছে নাও অতিতের গ্লানি
মুর্চে নিরব সত্তা

নতুন আলোয়,নতুন সঞ্চয়
তোমায় পেতে চাই
জীবনে নয়,মরনেও হায়
ইহকালে নয়,পরকালেও চাই।
নতুন আহবানে,নতুন ডাকে
কবে সাড়া পাবো??
তোমার বুকে,তোমার চোখে
কবে বন্দী হবো???

♪ইচ্ছে নৌকা ভাসিয়েছি,অপেক্ষার নদীতে,,,
ধৈর্য্যশক্তি করেছি প্রকট,তোমাতে ভেসে যেতে!।।।।

তাজ বসা থেকে উঠে দাড়িয়ে তিহির কাছে এগিয়ে যাচ্ছে। হাতের ওড়নাটা ওর শরীরে পেচিয়ে দিয়ে বললো,,

“” তোমার ইচ্ছেতেই সব হবে। জোর করবোনা। তবে আমি হাল ছাড়বোনা। আমার ভালোবাসার জালে তুমি ধরা পড়বেই।””

তিহি সেখানে আর এক মুহু্র্তও দাড়ালোনা। দৌড়ে নিজের রুমের দিকে ছুটছে। সে পারবেনা ইশাদকে অতিতে ফেলে দিতে। যাকে মন,প্রাণ উজার করে ভালোবেসেছে তাকে কিভাবে অতীতে ছুড়ে ফেলবে? কিভাবে মনের গহীন থেকে ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলবে কেউ একজন ছিলো যাকে আমি ভীষন ভালোবাসতাম?? না সে এমনভাবে বলতে চায়না। সে তো চায় বলতে,একজন আছে যাকে আমি ভীষন ভালোবাসি,ভীষন!

তিহি ঘুমন্ত মেয়েকে জড়িয়ে ধরে বললো,,

“” মা,আমি তোকে আকিঙ্গন করে সারাজীবন কাটাতে পারবো। কিন্তু কাউকে অতীত করে তোর বাবাকে জড়িয়ে ধরতে পারবোনা। তাহলে যে আমার ভালোবাসা আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে। ভালোবাসার গল্পরা ইতি টেনে নিবে। আমি তো তা করতে পারবোনা। আমি খুব অপরাধীরে। তোর অপরাধী মা!””

~~
খাবার টেবিলে বসে নাস্তার প্লেটে হাত দিচ্ছে ইরফাদ। তার পাশে বসেই তাড়াহুড়ো করে খাবার মুখে পুড়ছে ইশাদ। ইরফাদ পানির গ্লাস ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,

“” আসতে খা,ভাই। গলায় ঠেকবে। এতো তাড়া কিসের?””
“” আজ অনেক লেট হয়ে গিয়েছে,ভাইয়া। হসপিটাল থেকে বারবার কল আসছে। আব্বুর জন্য খেতে বসা।””

ইরফাদ নিজের পাশেই জমিল সাহেবকে দেখতে পেলেন। ঘাড়টা ডানদিকে ঘুরিয়ে কিছু একটা দেখছেন আর ঠোঁট বাকিয়ে হাঁসছেন। জমিল সাহেবকে অনুসরন করে ইরফদাও ঐদিকে তাকালো। মিহি আর ইনা দৌড়াদৌড়ি করছে। ইনার পেছনে মিহি দৌড়াচ্ছে,হাতে প্লেট। গাঢ় নীল রঙের থ্রিপিস পড়ে আছে সে। বিয়ের পরদিন এমনি রঙের পাতলা তাতের শাড়ী পড়েছিলো সানজিদা। তাকে বেশ বউ বউ লাগছিলো। কিন্তু মিহিকে? তাকে কি কোনো এ্যাঙ্গেলে বউ বউ লাগছে? আচ্ছা শুধু শাড়ীতেই কি বউ বউ লাগে থ্রি-পিসে লাগেনা?? নাকি ওর বয়স কম বলে বউ বউ লাগা নিষেধ???

“” পরোটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে,ভাইয়া। আব্বুর সামনে বউয়ের দিকে এভাবে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছিস,লজ্জা করছেনা??””

ইশাদের কথায় ইরফাদ কিছুটা লজ্জা নিয়ে পরোটা ছিড়ে মুখে পুরে।

“” ইনাকে দেখ কত খুশি। তোর মতো যদি একটা বুড়ি ভাবী নিয়ে আসতাম তাহলে কি এমন খুশি হতো? একদিনেই দুজনের মধ্যে কি ভাব হয়ে গেছে। মানুষের বয়সের সাথে সাথে চাহিদাগুলো যেমন বেড়ে যায়,তেমন স্বার্থপরতাও। মিহি এখনো নরম মাটির মতোই গলে আছে। শক্ত হয়ে উঠার আগে নিজের মতো করে বানিয়ে নে। দেখিস পরে যেন আফসোস না হয়!””

ইশাদ নিজের খাবারটা শেষ করে পানির গ্লাসটার দিকে হাত বাড়িয়েছে। অমনি ইনা দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ইরফাদের দিকে এগিয়ে এসে বললো,,

“” বড় আব্বু,আপুকে বলোনা আমি আর খাবোনা। আমার পেটতো গোপালভাড়ের মতো বড় হয়ে আছে। পরে যদি ফেটে যায়?””

ইরফাদ কিছু বলার আগেই মিহিও পেছন থেকে শাসনী সুরে বললো,,

“” একদম না,ফেটে গেলে আমি সেলাই করে দিবো। তোমাকে পুরো খাবারটা শেষ করতে হবে। ইরফাদ ভাইয়া,আপনার মেয়েটা এতো দুষ্টু কেন? আমার কথা শোনেইনা। বলুন তো পুরোটা খেয়ে শেষ করতে!””
“” না,আমি আর খাব…””

ইনা কথা শেষ করার আগেই মিহি ওর মুখে শেষ খাবারটুকু ঢুকিয়ে দিয়ে বিশ্বজয়ীর হাঁসিটা দিলো।

ইরফাদ মিহির দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে ইশাদের উদ্দ্যেশ্যে বললো,,

“” মেয়ে মাকে ডাকছে আপু,বউ স্বামীকে ডাকছে ভাইয়া। ইশাদ,এবার তুই ঠিক করে দে,মিহিকে আমি আপু বলে ডাকবো নাকি আম্মু!””

ইরফাদের এমন উৎভুক কথা শোনে ইশাদের মুখের পানি নাকের তালায় গিয়ে ঠেকেছে। কাঁশতে কাঁশতে ইরফাদের দিকে চেয়ে আছে।

~~

তিহির ঘুম ভাঙতে বেশ বেলা হয়ে গেলো। কিন্তু তখনো রুমটা কেমনজানি অন্ধকারে ছেয়ে আছে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো ১০ টা বেজে ৫৯। তড়িঘড়ি করে উঠে বসলো। আশেপাশে কোথাও তাজ আর প্রাপ্তিকে দেখতে পাচ্ছেনা। বিছানা ছেড়ে জানালার পর্দা সরিয়ে রুমে আলো প্রবেশের দ্বার বানিয়ে দিলো। কাথাটা সাইড করে চুলে হাত খোপা করতে করতে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়েছে। রান্নাঘরে ঢুকতেই শিরিন বেগম বললেন,,

“” নাস্তা টেবিলে সাজানো আছে,যা খেয়ে নে।””
“” সরি,ফুপিমা! কখন যে এতো বেলা হয়ে গেলো টের পায়নি। প্রাপ্তি কই?””

শিরিন বেগম চুলোর আঁচটা কমিয়ে দিয়ে তিহির কাছে এগিয়ে এসে বললো,,

“” তোর ঘুম যে এতো গাঢ় আমি এতোদিনেও জানতে পারিনি। মেয়েটা সারা রাত জ্বালিয়েছে। আমাকে নয়,তাজকে!””
“” মানে?””
“” মাঝরাতে প্রাপ্তির কান্নার শব্দে আমার ঘুম ভাঙে। রুম থেকে বেড়িয়ে দেখি তাজ ওকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করছে। আমি নিতে গেলে আমাকে দিলোনা। বলে কিনা,মেয়ের কান্নাই যদি থামাতে না পারি তাহলে বাবা হবো কিভাবে?””
“” আমাকে ডাকলেনা কেন?””

শিরিন বেগম মুচকি হেঁসে কড়াইতে খুন্তি নেড়ে বললো,,

“” তাজ চায়নি তার বউয়ের ঘুম ভাঙুক। ছেলেটা সারারাত মেয়েকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করেছে। যেমন বাপ তেমনি তার মেয়ে হয়েছে,বুঝলি?””
“” এখন কোথায় উনারা?””
“” ছাদে।””

তিহি দ্রুত কদমে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে। উফ! এতো ঘুম কি করে এলো আমার? প্রাপ্তি কেঁদেছে আর আমি ঘুমিয়েছি?? তাও এতো বেলা? কি করে হলো??

তিহি ছাদে উঠে সোজা পুবদিকের দোলনাটার কাছে চলে গেলো। সামনে গিয়ে দাড়াতেই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে বাবা আর মেয়ের দিকে। প্রাপ্তি তাজের বুকের সাথে ল্যাপ্টে ঘুমিয়ে আছে। ছোট্ট বা’হাতের গুটিআঙুল দ্বারা ওর পান্জাবীটা খামচে ধরে আছে। মনে হচ্ছে পান্জাবীটা ছেড়ে দিলেই বাবা হারিয়ে যাবে। তাজও মেয়েকে শক্ত করে চেপে নিয়ে দোলনায় বসে ঝিমুচ্ছে। সুর্যের কড়া রোদের তাপে দুজনেই ঘেমে যাচ্ছে। তাতেও যেন কারে কোনো নড়নচড়ন নেই। দুজনেই গভীরঘুমে তপ্ত!

সুর্যের আলোকে আড়াল করে তিহি প্রাপ্তির দিকে তাকিয়ে আছে। শুধু কি প্রাপ্তি নাকি তাজকেও দেখছে সে মুগ্ধনয়নে?? নিজের ছোট্ট শরীরের কালো ছায়া দিয়ে রোদের তীক্ষ্ণ ছায়াটাকে ঢাকার চেষ্টাটাই বা কেন করছে? মেয়ের জন্য নাকি বাবার জন্য?? তিহি বেশ কিছুক্ষন ওভাবে দাড়িয়ে থাকতেই হঠাৎ তাজ চোখ মেলেছে।

“” তুমি এই রোদে দাড়িয়ে আছো কেন?””

তাজের প্রশ্নে হকচকিয়ে যাচ্ছে তিহি। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে তাড়াহুড়ো করে প্রাপ্তিকে নিজের কোলে নিয়ে নিচ্ছে,,

“” ঘুমুচ্ছেতো,থাকনা।””

তিহি আড়চোখে তাজের দিকে তাকালে ও আবার বললো,,

“” মেয়ের সাথে আমার সন্ধি হয়ে গেছে,এবার মেয়ের মা’টার সাথে হওয়া বাকি। কিন্তু তার এই নিশ্চুপতা আমাকে দমিয়ে দিতে চাচ্ছে। তাতে কি! কথার খই তো ফুটবে,টগবগিয়ে ফুটবে,তাইনা নেশাবউ?””

তিহি ছোঁ মেরে নিজের মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে নিলে তাজ আবার বললো,,

“”ও বাতাসীর মা, গরম লাগছে। একটু তোমার ভালোবাসার পাখা দিয়ে বাতাস দিয়ে যাওনা।””

তিহি চোখ পাকিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললো,,

“” এইসব ফালতু নামে আমার মেয়েকে ডাকবেননা। ওর নাম প্রাপ্তি। এ নামে ডাকতে না পারলে ডাকবেননা।””

~~

বাবুকে গোসল করিয়ে টাওয়াল দিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছিলো তিহি। ওমনি তাজ এসে ওর কপালে অন্য একটা টাওয়াল দিয়ে ঘাম মুছতে মুছতে বললো,,

“” গোসল কি আমার আম্মাকে করিয়েছো নাকি নিজে করেছো? যাও তুমি গোসল সেরে এসো,প্রাপ্তিকে আমি রাখছি।””

তিহি কিছু বলতে চেয়েও চুপ করে গেলো। প্রাপ্তিকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে গোসলখানায় ঢুকতে নিলে তাজ মেয়ের দিকে তাকিয়ে দুষ্টুমী করে বললো,,

“” তোকে তো তোর আম্মু গোসল করিয়ে দিয়েছে,তোর আম্মুকে কে করিয়ে দিবে বলতো? তুই বললে আমি চেষ্টা করতে পারি। রাতের বেলাতো তোর থেকে তোর আম্মুকেই বেশি বাচ্চা লাগে। একা একা গোসল করতে পারে তো??””

তাজ প্রাপ্তিকে কোলে নিয়ে তিহির দিকে এগিয়ে আসলো। কিছুটা ওর দিকে ঝুকে বললো,,

“” দাড়িয়ে পড়লে যে,গোসল করিয়ে দেওয়ার জন্য কাউকে চায় নাকি?””

তিহি মুখে কিছু বললোনা। ওয়াশরুমে ঢুকে মগভর্তি পানি নিয়ে এসে তাজের মাথায় ঢেলে দিলো। কড়কড় কন্ঠে বললো,,,

“” আপনার পেটে আর মাথায় সবসময় গভীর খারাপমানুষী বাস করে। আপনার রক্তে গড়া আমার মেয়েটাও যদি এসবে পৌষ্য হয়,তাহলে আপনাকে আমি ছাড়বোনা।””
“” ছাড়তে বলেছে কে? এই পানির মতো তুমিও আমাতে মিশে যাও।””
“” খারাপ মানুষ একটা!””
“” এভাবে বকা না দিয়ে একটু ভালোবাসলেই তো হয়,খারাপ মানুষটাতো খুব করে চাইছে,তার নেশা বউয়ের ভালোবাসায় সিদ্ধলাভ করে ভালো হতে। সে কেন বুঝছেনা? নাকি ইচ্ছে করেই অবুঝ সেজে আছে???””

তিহি তাজের কথার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করলোনা। ওয়াশরুমে ঢুকে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিলো।

~~

রাতে ডিনার শেষে মিহি রুমে ঢুকেছে। ইরফাদ বিছানায় শুয়ে আছে। কপালটা বা’হাত দিয়ে ঢাকা। মিহি গুটিগুটি পায়ে ইরফাদের কাছে এসে দাড়িয়ে আছে।

“” কিছু বললে বলো নাহলে সরো। আমার ঘুমের ডিস্টার্ভ হচ্ছে মিহি!””
“” সরি।””

ইরফাদ কপাল থেকে হাত সরিয়ে মিহির দিকে তাকিয়ে আছে। শোয়া থেকে উঠে বসে বললো,,

“” তোমার সমস্যা কি বলোতো,আজ এক সপ্তাহ ধরে তুমি রোজরাতে ঘুমানোর আগে আমাকে সরি বলছো,হোয়াই?””
“” আপনি আমার সাথে কথা বলেননা তাই।””
“” তাহলে এখন কি বলছি?””
“” নিজ থেকে বলেননা। আমি কিছু বললে তারপর বলেন।””
“” প্রয়োজন ছাড়াও তোমার সাথে কথা বলতে হবে?””

মিহির চোখ ভিজে উঠছে। এখন উনার আমার সাথে কথা বলার জন্যও প্রয়োজন লাগবে? অথচ আগে উনি অপ্রয়োজনীয় কথা নিয়েও কি সুন্দর হাসি-ঠাট্টা করতেন। এই বিয়েটা আমার থেকে সব ছিনিয়ে নিয়েছে। মিহি বিছানায় শুয়ে পড়েছে। ইরফাদ তখনো বসে আছে। এমনভাবে মিহির দিকে তাকাচ্ছে যেন সে নিজের করা প্রশ্নটির উত্তর না পেয়ে বিরক্ত।

মিহি শোয়া অবস্থায় বারবার ইরফাদের দিকে তাকাচ্ছে। উল্টো হয়ে শুয়ে থাকায় হাতটাও উল্টোদিকে পড়ে আছে। এমন করে শুলে ও হাতটাকে কিভাবে বালিশ বানাবে? উনি কি জানেননা আমি উনার হাতে গাল ছুয়ে না শুলে আমার ঘুম আসেনা?? মিহি বারকয়েক ইরফাদের দিকে চেয়ে থেকে ঘুরতে নিলেই ইরফাদ চোখ বন্ধ করে একটু ডান দিকে ঘুরলো। তাতেই যেন মিহি চাঁদ হাতে পেয়েছে। চট করে ইরফাদের হাতটা নিজের গালের কাছে টেনে শান্তির দম ছেড়ে বললো,,

“” একদিন ঠিক আপনি আমার সাথে নিজ থেকে কথা বলবেন,প্রয়োজন না অপ্রয়োজনে।””

~~

আজ একমাস যাবত মরিয়ম বেগম বিছানায় এলে পড়েছেন। খাওয়া-দাওয়া ছেড়েছেন এক সপ্তাহ হলো। দিনকে দিন শরীর অধপতন হচ্ছে। এখন তো শোয়া থেকে উঠে দাড়াতেও পারছেননা ঠিক মতো। বাসার সবাই খুব উদগ্রীব। ইশাদ পরপর নানা টেস্ট করে যাচ্ছেন মরিয়ম বেগমের। কিন্তু সেরকম কোনো বড় রোগের লক্ষন খুজে পাচ্ছেনা। যারজন্য তাকে হসপিটালে এডমিটও করা হচ্ছেনা। বাসায়ই পড়ে আছেন। টেনশনে তার ডক্টরি ছেড়ে দেওয়ার অবস্থা। মায়ের চিকিৎসাই যদি করতে না পারে,মাকে সুস্থই করতে না পারে তাহলে কিসের ডক্টরি? সবকিছুই তার কাছে মিথ্যে মনে হচ্ছে। তার সব শিক্ষাকে শূন্য মনে হচ্ছে!

সকাল থেকেই মরিয়ম বেগমের শরীরটা একটু বেশিই খারাপ,স্বামী জমিল সাহেব,ছেলে ইরফাদ,ইশাদ,ছেলের বউ তাকে ঘিরে রেখেছে।সকলের মনেই যেন কিছু হারানোর বড় পাথর চেপে রয়েছে।

মরিয়ম বেগম,অস্পষ্ট স্বরে বললেন,,

“” সবাই একটু বাইরে যাও। ইশাদের সাথে আমার কথা আছে!””

ইশাদ মায়ের দিকে হামলে পড়ে বললো,,

“” আম্মু,এখন কোনো কথা নয়,পরে শুনবো!””
“” এখন না বললে হয়তো আর কখনোই বলা হবেনারে,বাপ। সবাই চলে গেলে দরজাটা আটকিয়ে আমার কাছে আয়!””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here