তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (১২)

0
3072

#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (১২)
#রোকসানা-রাহমান

শিরিন বেগমের কথার মাঝখানেই তিহি মাথা ঘুরে পড়ে যায়। যদিও উনি ধরেছিলেন,কিন্তু শক্তিতে কুলোতে না পারায় মেঝেতে শুয়িয়ে দিয়েছেন। টেনশনে কি করবে বুঝতে না পেরে তাজকে কল দিয়ে বসে।

অন্যসময় তাজ কল রিসিভ না করলেও আজ প্রথম রিংয়েই রিসিভ করেছে। নিজে হ্যালো বলার সময়টুকুও পায়নি তার আগেই ওপাশ থেকে শিরিন বেগম বললেন,,,

“” তিহি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে। ভয়ে আমার প্রেসার লো হয়ে গেছে। আমি নড়তে পারছিনা তাজ। তুই কিছু কর! তাড়াতাড়ি বাসায় আয়!””

~~

পুরো ২৮ মিনিট ধরে,একাএকা বকবক করে যাচ্ছে ইশাদ। ফোনের অপর পাশে মহারানীর আবদারগুলো পুরন করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে ইশাদকে। দিনে দিনে বাচ্চামীসুলভগুলো যেন বেড়েই যাচ্ছে। এখন নাকি তার ইশাদের বকবক না শুনলে ঘুম আসেনা। এভাবে কি একা একা কথা বলা যায়?? এতোকিছুর মধ্যেও তিহির আবদার রাখতে ইশাদের মনে আনন্দের দোল বয়ে যায়। মেয়েটা আর তো কিছু চাইনা মাঝে মাঝে এমন অদ্ভুত আবদার ছাড়া। ইশাদ ফোনটা কানে থেকে মুখের কাছে নিয়ে খুব ভালোবাসা আর যত্ন নিয়ে ছোট্ট একটা চুমু খেলো ফোনের স্ক্রিনে!

“” ভালোবাসি তোমায়,খুব ভালোবাসি তিহিপাখি! আজকাল তোমাকে ছাড়া থাকতে ইচ্ছে করেনা। কেমন জানি রুমটা খালি খালি লাগে। উফ! কবে তোমার রঙে সাজাবে আমার এই বেরঙিন রুমটা?? চলে আসোনা। তোমার কি তোমার মিঃইশের সাথে ঘুমোতে ইচ্ছে করেনা? তার বুকে মাথা রেখে চুপটি করে হৃৎস্পন্দন শুনতে ইচ্ছে করেনা?””
“” হুম!””

তিহির মুখে হুম! শুনে ইশাদ বললো,,

“” তুমি এখনো ঘুমোওনি?””

তিহি ঘুমজড়ানো কন্ঠে বললো,,

“” এতো প্রশ্ন করলে ঘুমানো যায়? তোমাকে কথা বলতে বলছি,প্রশ্ন করো কেন? বিবৃতিমুলক বাক্য ব্যবহার করবে,প্রশ্নবোধক নয়!””
“” এভাবে একা একা কথা বলা যায়?? তাও অডিও কলে? একটু ভিডিও কল দেই? তোমাকে দেখলে দেখবে শুধু আমার কথা নয় আমিও বিবৃতিমুলক বাক্য হয়ে গেছি।””

তিহি ফোনটা কানে ভালো করে চেপে নিয়ে পাশ ফিরে বললো,,

“” আমি তো পাগল না? ভিডিও কল দিয়ে আমি চোখ বন্ধ করলেই দেখা যাবে তুমি নানা জায়গায় নানাভাবে দেখছো। তুমি এতো খাচ্চড় কেন বলোতো?””

তিহির কথা শুনেই ইশাদ উচ্চস্বরে হেঁসে উঠে। হাসতে হাসতে বললো,,,

“” তুমি মাঝে মাঝে এমনভাবে কথা বলো মনে তো হয় আমি কোনো পরপুরুষ,যার নজর খারাপ,তোমাকে জোর করে ধর্ষন করছে।””
“” তার থেকেও বেশি কিছু। তুমি যে আমাকে না ছুয়েও তোমার চোখ দিয়ে আমাকে প্রতিনিয়ত ধর্ষন করো সেটা মনে হয় আমি বুঝিনা?? পচা ছেলে,নো ভিডিও কল!””
“” আমার তো দেখতে ইচ্ছে করছে!””
“” চুপ!””
“” এই।””
“” ঘুুমোতে দাও।””

ইশাদ লম্বাস্বাস ছেড়ে বললো,,

“” আমাকে এতো অবহেলা করছো না?? শুধু একবার কবুলটা বলিয়ে নেইনা। তারপর দেখবে ধর্ষন কাকে বলে?””
“” বলবোনা।””
“” এখন একবার বলোতো লক্ষীটি! আমরা এখনি বিয়ে করবো।””
“” উহু!””
“” উহু! করলে কি করে হবে?? আমার তিনকন্যা কিভাবে আসবে? ওরা তো খুব কষ্টে আছে। বাবা-মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তিহি!””
“” তিনকন্যা ?””
“” তোমার আর আমার ভালোবাসার ছোয়াতে যারা আসবে তারাই তিনকন্যা।””
“” বাবু?””
“” হুম!””
“” এখনো বিয়েই হলোনা আর তুমি বাবুতে চলে গেছো? তাও তিনটা কন্যা? কেন আমার কি কোনো ছেলে হবেনা?””
“” না। আমার সবগুলো মেয়ে হবে।””
“” কেন?””
“” আমি চাই তাই।””
“” তুমি চাইলেই হয়ে যাবে?””
“” হুম! কিন্তু তার আগে বিয়ে করতে হবে,তার আগে কবুল বলতে হবে।””
“” পারবোনা।””
“” পারবে।””
“” না।””
“” হুম!””
“” ইশাদ আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি!””
“” হুম! আমি বুঝতে পারছি। সেজন্যইতো বলছি কবুল বলো। বিয়েটা না হলে আদর দিয়ে রাগ ভাঙাবো কিভাবে?””
“” উফ!””
“” তিহিপাখি বলোনা,আমি আর ধৈর্য্য ধরতে পারছিনা। তুমি কবে আমার বউ হবে? আমার বুকে মাথা রাখবে,তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে ইচ্ছে করে। চলোনা বিয়ে করে ফেলি!””
“”….””
“” কিগো,কাল আম্মুকে নিয়ে আসি?””
“”…..””
“” হ্যালো….হ্যালো…””

ইশাদ ফোনটা কান থেকে সরিয়ে চেক করতেই বুঝতে পারলো তিহি কল কেটে দিয়েছে। খুব বেশি রেগে গেলো নাকি?? ইশাদ আবার কল করে দেখলো ফোন অফ!

৫ মিনিট পর তিহি কল করতেই ইশাদ কল রিসিভ করে কানে ধরে আছে,মুখে কিছু বলছেনা।

“” সরি! রাগ হচ্ছিলো তাই কেটে দিছি। আর এমন হবেনা।””
“”….””
“” কিছু বলছোনা কেন? বললামতো সরি।””
“”…””

তিহির কন্ঠ ভারী হয়ে আসছে,চোখ ভিজে আসছে।

“” ইশ! সরররি…””

আর কিছু বলতে পারছেনা। কান্নায় ভেঙে পড়েছে। শব্দহীনকান্নাতে নিশ্বাসের শব্দটা বেশ জোরালো। একটু পরপর নাক টানছে। ইশাদ আর চুপ করে থাকতে পারেনি। শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লো,আদুরী গলায় বললো,,

“” আরে কাঁদছো কেন? আমি তো মজা করছিলাম। তিহিপাখি,আমার আত্মাপাখি,আমি তো জাস্ট দেখতে চাইলাম,আমি রাগ করলে তুমি কিভাবে রাগ ভাঙাও। কাঁদেনা। এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদলে হবে? এই,প্লিজ থামোনা।””

ইশাদের কন্ঠ পেয়ে তিহির কান্নার রেশ আরো বেড়ে যাচ্ছে। নিশ্বাস টানার শব্দটাও বেড়ে গেছে,সাথে হিচকি!

“” তিহি,তুমি কান্না থামাবে নাকি আমি এখনি চলে আসবো? তোমাকে বলেছি না তোমার কান্না আমার সহ্য হয়না। আমার কষ্ট হচ্ছে। আচ্ছা আর মজা করবোনা। এই কান ধরেছি। সত্যিই ধরেছি। পিক তুলে দিবো?””
“”…..””
“” এই! কথা তো বলো,তিহি!””

তিহির কান্না থামার কোনো লক্ষন না দেখে ইশাদের আদুরী গলা শক্ত হয়ে এসেছে,

“” আমি আসছি!””

ইশাদের বাসা থেকে তিহিদের বাসায় যেতে গাড়ীরপথে নরমালি ২০-৩০ মিনিট লাগে। কিন্তু এই মাঝরাতে রাস্তা ফাঁকা থাকায় ইশাদ বেশ স্পিডেই গাড়ী চালাচ্ছে। চোখজোরা তারও লাল হয়ে এসেছে,রাগে নয় খারাপ লাগা থেকে। এই মেয়েটাকে এতোবার করে বলি যে ওর কান্না আমার সহ্য হয়না তবুও কেন কাঁদতে লাগে?? এইটুকুতেই কেঁদে দিতে হবে?? উফ! সবকিছুতেই বেশি বেশি না? আজকে ঠাটিয়ে একটা চড় মেরে দিতে হবে। কিছু বলিনা দেখে বেশি বেড়েছে।

ইশাদ তিহিদের বাড়ির সামনে এসে তিহিকে মেসেজ দিলো।

**tmi baire asbe naki ami vitore asbo??**

মেসেজ সেন্ড হওয়ার সাথে সাথে তিহি দরজা খোলে বেড়িয়ে এসেছে। সাদার মধ্যে কালো ছাপের একটা থ্রি-পিস পড়ে আছে,চুলগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে আছে। নিচের দিকে তাকিয়ে এখনো চোখ মুছে যাচ্ছে।

ইশাদ গুটি কয়েক পা ফেলে তিহির কাছে এগিয়ে আসতেই ও ঝাপিয়ে পড়ে ইশাদের বুকে।

ইশাদের সব রাগ পানি হয়ে বরফ বাধার উপক্রম! এভাবে জড়িয়ে ধরলে কি রাগ দেখানো যায়? আজও বুঝি রাগ দেখানো হলোনা আর থাপ্পড় সে নাহয় ভবিষ্যতের খাতায় পড়ে থাক।

“” এমন মাঝরাতে,খালি রাস্তায় একটা পরপুরুষকে জড়িয়ে ধরতে তোমার লজ্জা করছেনা?””

তিহি,ইশাদকে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে আহ্লাদী কন্ঠে বললো,,

“” তাহলে তুমি আসলে কেন? আমি আসতে বলেছি?””
“” ওহ! তুমি কাঁদবে তাতে তোমার দোষ নেই আর এখন আমি আসলাম বলে আমার দোষ?””
“” হুম!””

ইশাদও তিহিকে হাতের বাধনে আবদ্ধ করে বললো,,

“” সবসময়, সব দোষ আমার?””
“” হুম!””
“” সবসময় আমাকেই তোমায় সামলাতে হবে?””
“” হুম!””
“” তাহলে তুমি কি করবে?””
“” তোমার ভালোবাসা নিবো!””

তিহির মাথাটা উচু করে ওর চোখ মুছে দিচ্ছে ইশাদ। ঠোঁটে দুষ্টুমি রেখে বললো,,

“” তাহলে আজকে একটু বেশি দোষ করি?””

তিহি বুঝতে পারেনি এমনভাবে তাকাতেই ওর দুই চিবুক চেপে ধরে বললো,,

“” একটু ছুয়ে দেই?””
“” কি?””
“” তোমার ঠোঁট!””

তিহি নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,,

“” ধুর! তুমি আবার শুরু করলে? আমি গেলাম!””
“” যাও।””

তিহিকে ছেড়ে দিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে,ইশাদ। হাতদুটো নিজের বুক আর পেটের মাঝ বরাবর ভাঁজ করে নিয়েছে। এমনভাবে চেয়ে আছে যেন সে দেখতে চাই তিহি কিভাবে চলে যায়।

তিহি ঘুরে দাড়িয়ে এককদম এগিয়ে আবার পিছু তাকিয়েছে। ইশাদ এখনো তার দিকেই চেয়ে আছে। এই দৃষ্টিকে অগ্রাহ্য করে তিহি কি যেতে পারবে? কখনোই না। তাহলে যে ও মরে যাবে। খুব কঠিন অসুখে মরে যাবে। তিহি আবার ফিরে এসে বললো,,

“” আচ্ছা করবো।””
“” কি?””
“” বিয়ে!””

ইশাদ কপাল কুঁচকে বললো,,

“” এমনভাবে বলছো যেন অন্যকাউকে বিয়ে করার কথা ছিলো আর এখন আমাকে মায়া দেখিয়ে বিয়ে করতে চাচ্ছো?””

তিহি মাটি থেকে চোখ সরিয়ে ইশাদের দিকে চেয়ে আছে। এই মানুষটা এমন কেন? আমি যা বলতে চাইনা তাও তো সে বুঝে ফেলে তাহলে এখন যেটা বলতে চাচ্ছি সেটা কেন বুঝতে পারছেনা? এখানে অন্যকেউ কোথা থেকে আসলো?? ও কি জানেনা আমার ভেতরবাহির সবটা জুড়ে শুধু সে আর কেউ নাই!

ইশাদ হাতের ভাঁজটা খুলে তিহির কাছাকাছি ঘেষে বললো,,

“” অনেক রাত হয়েছে,যাও শুয়ে পড়ো।””
“” বিয়ে করবোনা?””
“” না।””
“” কেন?””
“” আমি চাই তুমি আমার ইচ্ছে নয় তোমার ইচ্ছেতে রাজী হও। আমার মতো তুমিও ছটফট করো!””
“” করছিতো!””
“” কি?””
“” ছটফট!””

তিহির দিকে তাকিয়ে থেকে ইশাদ আবার হেঁসে উঠে। ওর নাক টেনে দিয়ে বললো,,

“” ওকে বুঝতে পারছি। আর ছটফট করতে হবেনা। যাও,ঘুমিয়ে পড়ো।””

তিহি ইশাদের চোখে চোখ রেখে বললো,,

***ভালোবাসি তাই,বিয়ে করতে চাই,,,,
ভালোবাসায় মাখবো,দুজনদুজনায়****

ইশাদ চোখের দৃষ্টি স্থির করতেই তিহি আবার বললো,,

“” শুক্রবারে আন্টি আর ইনাকে নিয়ে এসে আম্মুর সাথে কথা বলে সব ঠিক করে যেও। আমিও দেখতে চাই আমার নষ্ট প্রেমিক,বর হিসেবে কেমন নষ্ট!””

তিহি নিজের মনের কথা পেশ করে লজ্জামাখা হাসি নিয়ে চলে যেতে নিলে ইশাদ ওর হাত ধরে ফেলে। পেছন থেকে কোমড় পেচিয়ে নিয়েছে। কানের কাছে পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে ফিসফিস করে বললো,,

“” তবে কি এবার আমার তিনকন্যারা আসতে চলেছে?””

তিহি ইশাদের হাত খামচে ধরে বললো,,

“” জানিনা!””

~~

ইশাদের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। শোয়া থেকে উঠে বসে জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। রুমের ভেতরের এসিটাতো অন করা তবুও কেন এতো গরম লাগছে তার? ঘেমে ভিজে চুপচুপা। পড়নের ধূসর বর্ণের পাতলা টি-শার্টটা গায়ের সাথে ল্যাপ্টে গেছে। মাথার চুলগুলো বাকা হয়ে কপালের সাথে মিশে আছে। কষ্ট হচ্ছে তার,নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। নিজের আশেপাশে ইনহেলারটা খোজার শক্তিটুকুও পাচ্ছেনা। আজ কি সে অক্সিজেনের অভাবে মরে যাবে? নাকি তার তিহিপাখির অভাবে?? যে মেয়েটা পাঁচ মিনিট চুপ থাকার কারনে কেঁদে কেটে নেয়ে ফেলতো সেই মেয়েটা আমিহীনা এতোটা মাস কিভাবে কাটাচ্ছে?? আমার মতো কি ওর ও নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয়?? দেখতে ইচ্ছে করছে তিহিপাখি,তোমাকে দেখার অভাবে আমার শ্বাস আটকে যাচ্ছে। আর পারছিনা আমি,কেন আসো বারবার আমাকে কাঁপিয়ে তুলতে? স্বপ্নগুলো কি একটু অন্যরকম হতে পারেনা,যেখানে তুমি থাকবেনা??

ইশাদের নিশ্বাসের তেজ ক্রমশই কমে যাচ্ছে। রুমের ড্রিমলাইটটার মোটামুটি ভালো আলো দিলেও সে এই মুহুর্তে সব অন্ধকার দেখতে পারছে। তবে কি আজি তার শেষ দিন?? ইশাদ চোখ বন্ধ করে নিতেই মিহির মুখটা ভেসে উঠেছে। সাথে সাথে চিৎকার করে বললো,,

“” ভাইয়া আমাকে বাঁচা!””

~~

মাথায় কারো হাতের স্পর্শে তিহি চোখ মেলে। সেই হাসি আর আদুরীমাখা মুখটা দেখতে পেয়ে তিহির ঠোঁটও প্রসস্ত হয়ে উঠছে। শিরিন বেগম ঠোঁটের হাসিটা আরেকটু বাড়িয়ে বললো,,

“” এবার যে তোকেও কারো মা হতে হবে। পারবি তো মা ডাকের যথার্থ মর্যাদা রাখতে?””

তিহি না বুঝার ভান করে চেয়ে আছে। কি বলছেন উনি বুঝার চেষ্টা করছে। পাশ থেকে মাঝ বয়সী সেই লোকটা যাকে তিহি প্রথম দিনও দেখেছিলো,সে হাঁসি হাঁসি মুখ নিয়ে বললো,,

“” এই পরিবারে তাহলে সদস্যসংখ্যা বড় হতে চলেছে। নতুন সদস্যের আগমনি বার্তাতো পেয়েই গেলেন। এবার তাহলে তাকে বরন করার পাঠ সাজাতে থাকুন।””
“” হুম!””
“” ভোর হতে চললো,আমি তাহলে আসি বুবু!””

লোকটির চলে যাওয়ার দিকে তাকাতেই দেখলো দরজার কাছটাতে তাজ দাড়িয়ে আছে। চোখ,মুখ তার শুকিয়ে জীর্ন,কপালে চিন্তার ভাজ। ঠোঁটের উপরের মোছটা আর আগের মতো এতো বেশি ভেসে উঠছেনা। মুখের চারপাশের ছোটছোট দাড়ির সাথে মিলে কিছুটা নুয়ে পড়েছে। চোখের নিচটা এতোটা কালশিটে কেন? উনি কি রাতে ঘুৃমাননা? তাহলে করেনটা কি? শুধুই মদ্যপান? এই পৃথিবীতে কি এই মদ্যপানের জন্যই সে জন্মেছে??

শিরিন বেগম চলে গেলে তাজ রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। তিহি পাশ ফিরে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। শুনেছি ভালোবাসাকে ভুলতে হলে ভালোবাসার প্রয়োজন। আমি কিভাবে ভুলবো তোমায় ইশাদ? যার জন্য ভুলবো সে তো আমার দিকে ফিরেও তাকায়না। তুমি না বলেছিলে,আমার বর আমাকে তোমার থেকেও বেশি ভালোবাসবে? আর সেই ভালোবাসার মধ্যেই আমি হারিয়ে যাবো! সব মিথ্যে,তুমি ভুল ছিলে,তোমার তিহিকে তুমি ছাড়া আর কেউ ভালোবাসেনা।

তাজ তিহির পাশে শুতে গিয়েও শোয়নি। ভয় করছে তার,এতো বেশিই ভয় করছে যে মনে হচ্ছে ওর পাশে শোয়া মানে ইচ্ছে করে কাঁদাপানিতে নেমে পিছলে খাওয়া! তাই বালিশ নিয়ে নিচেই শুয়ে আছে। শান্তি পাচ্ছেনা। ভেতরে ভেতরে যন্ত্রনাগুলো কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এপাশওপাশ করতে করতে উঠে বসেছে। অন্ধকারেও তিহির মুখটার দিকে চেয়ে আছে। বেশ কিছুক্ষন থম মেরে বসে থেকে উঠে পড়লো। আলতোগতিতে তিহির কাছে বসে আছে। কাঁপা কাঁপা হাত নিয়ে তিহির পেট থেকে শাড়ীটা সরিয়ে পলকহীনভাবে চেয়ে আছে পেটটার দিকে!

এইখানে কেউ আসুক,সে ইচ্ছেতেই তোমাকে আমি ছুয়েছিলাম। কিন্তু হায়! আজ কেন আমি খুশি হতে পারছিনা? আমার যন্ত্রনায় ঘেরা প্লেনগুলো এভাবে সাফল্যের দিকে এগুলেও আমি কেন তা হাঁসিমুখে মেনে নিতে পারছিনা? আমার ভেতরের পশুটাকে কেন বের করতে পারছিনা?? কেন বারবার ইচ্ছে হয় তোমাকে খুশি করার,তোমাকে হাঁসিমুখে রঞ্জিত করার? তোমার চোখের পানি মুছে দেওয়ার লোকটার কাছে তোমাকে পৌছে দেওয়ার ইচ্ছেটা আমাকে খুব জ্বালাতন করছে তিহি। আমি কি কখনোই নিজের জিনিসটাকে নিজের করে পাবোনা??

তাজ তিহির পেটে হাত রাখতেই ও নড়ে উঠেছে। চট করে হাতটা গুটিয়ে নিতেই তিহি বললো,,

“” কোথায় ছিলেন এতোদিন?””

তিহির প্রশ্নে বেশ বিচলিত তাজ। চুপচাপ বিছানা থেকে নামতে নিলে ওর হাতটা চেপে ধরে বললো,,

“” এবার তো আমার শাস্তি মওকুফ করুন। আপনার আর আমার ভালোবাসার স্পর্শ ছাড়াও যে একজন আসতে চলেছে তার দিকে চেয়ে সব ঠিক করে নিন। আমি কথা দিচ্ছি আমি আপনার সব ইচ্ছে মেনে নিবো। প্লিজ! আমি আর এসব নিতে পারছিনা। দম বন্ধ হয়ে আসছে আমার!””

তাজ তিহির হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে বললো,,

“” সব ঠিক করে দিবো। সকালে রেডি হয়ে নিও। আমরা বের হবো!””
“” সত্যি?””
“” হুম!””

তাজ পুনরায় বালিশে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। বুকে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথাগুলো চোখের পানির সাথে বের হতে চাচ্ছে। কিন্তু সে কাঁদবেনা, কোনো মেয়ের জন্য তো নয়ই!

বেশ কিছুক্ষন এভাবে নিজেকে আটকে রাখলেও মনের ভেতর আরেকটা ইচ্ছে উঁকি দিচ্ছে,তিহিকে আরেকবার ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে তার। মদের নেশায় নয় তিহির নেশায়, তার নেশাবউয়ের নেশা আজ নেশা করতে ইচ্ছে করছে। উফ! মন কেন এতো উতলা হয়? কেন এতো বেহায়া হয় কেন এতো অবাধ্য হয়?? তাজ আবার শোয়া থেকে উঠে বসে পড়লো। হাত,পাসহ পুরো শরীর কেঁপে উঠছে,চোখ,মুখ, শরীরের শিরাউপশিরারা টগবগিয়ে ফুটছে। এই মুহুর্তে তার নেশা লাগবে,খুব খারাপভাবে লাগবে হয় মদের নেশা নাহয় তিহির নেশা!

তাজ তিহির কাছে গিয়েও থমকে আছে। ছুয়ে দিলে কি ও রাগ করবে? আজ তো আমি মাতাল নয় স্বামী হিসেবেই একটু ছুবো,এইতো একটুখানি। শুধু আজি আর কোনোদিন নয়। আর কোনোদিন কি ওকে ছোঁয়ার সুযোগটুকু পাবো? নাকি ওর দেখা পাবো?? আজ শেষবারের জন্য একটু ছুয়ে দেই! তারপর থেকে নাহয় আমার চিরচেনা সেই মদেতেই মত্ত হবো। তাজ তিহির পাশে শুয়ে পড়েছে। হাত বাড়িয়ে ধরতে গিয়েও ধরলোনা। বেড়িয়ে পড়েছে তার চিরচেনা সঙ্গীর আশায়!

তিহিকে নিয়ে সোজা একটা হসপিটালে ঢুকে পড়েছে তাজ। আজ যে তিহি তার পছন্দের রঙের শাড়ীটা পড়েছে,চুলটা অর্ধেক বেনি করেছে ছেড়ে দিয়েছে,চোখে কাজলও দিয়েছে সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। একবার আড়চোখে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করেনি। চুপচাপ দুজনে একজন মাঝবয়সী এক সুন্দরী ডক্টরের সামনে বসে আছে। কিছুক্ষন আগে একটু ছোটখাটো টেস্ট করাও হয়েছে। হয়তো সেটার রিপোর্টের জন্যই দুজনে বসে আছে।মহিলাটি ঠোঁটে ভদ্রতাসূচক হাঁসি রেখেই তাজকে উদ্দশ্য করে বললো,

“” প্রেগন্যান্সির এজ অলরেডি তিনমাস। এ্যাবরশন করাতে চাইলে মা-বাবা উভয়ের সম্মতি লাগবে। আপনার স্ত্রীর কি মত আছে??””

ডক্টরের কথায় তিহি যতটা না অবাক হয়েছে তার থেকেও বেশি ঘৃনা নিয়ে তাজের দিকে চেয়ে আছে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here