#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (১৩)
#রোকসানা-রাহমান
তিহিকে নিয়ে সোজা একটা হসপিটালে ঢুকে পড়েছে তাজ। আজ যে তিহি তার পছন্দের রঙের শাড়ীটা পড়েছে,চুলটা অর্ধেক বেনি করেছে ছেড়ে দিয়েছে,চোখে কাজলও দিয়েছে সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। একবার আড়চোখে তাকানোর প্রয়োজনও মনে করেনি। চুপচাপ দুজনে একজন মাঝবয়সী এক সুন্দরী ডক্টরের সামনে বসে আছে। কিছুক্ষন আগে একটু ছোটখাটো টেস্ট করাও হয়েছে। হয়তো সেটার রিপোর্টের জন্যই দুজনে বসে আছে।মহিলাটি ঠোঁটে ভদ্রতাসূচক হাঁসি রেখেই তাজকে উদ্দশ্য করে বললো,
“” প্রেগন্যান্সির এজ অলরেডি তিনমাস। এ্যাবরশন করাতে চাইলে মা-বাবা উভয়ের সম্মতি লাগবে। আপনার স্ত্রীর কি মত আছে??””
ডক্টরের কথায় তিহি যতটা না অবাক হয়েছে তার বেশি ঘৃনা নিয়ে তাজের দিকে চেয়ে আছে। তিহি তাজের থেকে ঘৃন্ন চাহনি কাটিয়ে ডক্টরের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর কোলের উপর থাকা হাতটা খামচে ধরে ফেলেছে তাজ। ওর দিকে তাকানো বা ওর থেকে কোনো মতামত না নেওয়ার উদ্বোধেই ডক্টরের দিকে ভদ্রতাসুরে বললো,,,
“” জ্বী!””
“”ওকে,তাহলে আপনারা ফর্মালিটিগুলো…””
ডক্টরের কথা শেষ হওয়ার আগেই তিহি ঝট করে তাজের হাতটা সরিয়ে ফেলে,ক্ষুব্ধ হয়ে গলার স্বরটা কিছুটা চড়া করে বললো,,
“” আমি কোনো এ্যাবরশন করাচ্ছিনা।””
তিহি কথার তালে উঠে দাড়িয়ে পড়েছে। কিছুটা ডক্টরের দিকে হেলেও পড়েছিলো। তাজও উঠে দাড়িয়ে পড়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে তিহিকে পেছন থেকে ধরতেই ও আরো জোরে চিৎকার করে উঠে,,,
“” ছোবেননা আপনি আমাকে। আপনি..””
তিহি আর কিছু বলতে পারছেনা। গলার স্বরটা ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসছে। চোখ ভরে উঠেছে নোনা জলে। কষ্টটা যেন বুক অবধি নামতে পারছেনা গলাতেই আটকে আছে। গলার ভেতরটা দেবে যাচ্ছে তার। কাঁদতে ইচ্ছে করছে,খুব জোরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কেঁদেকেটে পুরো হসপিটাল ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে সাথে এই ঘৃন্ন মানুষটিকে! এতোটা পাষান মানুষ কি করে হয়???
তিহি তাজের দিকে আর তাকিয়ে থাকতে পারেনি,দাড়িয়ে থাকতে পারেনি সেখানে এক-দন্ড। মনে হচ্ছিলো এই বুঝি কেউ এসে তার পেটের ভেতর ছুরি চালিয়ে তার বাচ্চাটাকে টেনে বের করে ফেলবে,টিপে ধরবে তার গলা,আর বিকট ও পৈশাচিক হাসি নিয়ে বলবে,,
“” কেন আসতে চেয়েছিস এই পৃথিবীতে? তোর এতো বড় সাহস? যেখানে তোর বাবা-মায়ের মধ্যে নেই নিম্নপরিমানের ভালোবাসা,ছোটখাটো বোঝাপড়া সেখানে তুই বোঝা হয়ে কেন আসতে চাচ্ছিস?? তুই জানিস না,তোর এই পৃথিবীতে আসা বারন? তোর জন্য সবথেকে বড় পাপ??””
তিহির চোখ থেকে গড়িয়ে গাল বেয়ে পড়ছে ঢেউ কাঁপানো পানি,হাত দিয়ে মুছতেও চাচ্ছেনা। আর কত মুছবে?? সে যে মুছতে মুছতে ক্লান্ত!
“” তিহি,দাড়াও বলছি। আমি তোমাকে দাড়াতে বলেছি।””
তাজের ডাক তিহির কানে পৌঁছুচ্ছে না। পৌছাবে কিভাবে? আজ যে তার দ্বিতীয়বার মরনের দুয়ারে পা রাখা হয়েছে৷ প্রথমবার নাহয় ইশাদের কথা রাখতে সে জীবন্ত লাশ হয়েও বেঁচে ছিলো,মনে আশা ছিলো,কিন্তু এবার?? এবার সে কোন আশায় বাঁচবে??
তাজ বড়বড় কদম ফেলে তিহির সামনে এসে দাড়িয়েছে। ততক্ষনে তিহি হসপিটালের অন্তর্গত থেকে বহির্গত। আনমনে রাস্তার দিকে পা বাড়িয়েছিলো। আচমকা তাজ সামনে আসায় যেন তিহি তা দেখতেও পায়নি। সামনে এগুনোর জন্য পা বাড়াতেই তাজের সাথে বাড়ি খেয়েছে। এবার বুঝি তার হুশ এলো,,
তাজ দাঁত কড়মড়িয়ে বললো,,
“” তুমি কি চাচ্ছো,এই ভরা জনসবাই সিনক্রিয়েট করি?””
“” আমার সামনে থেকে সরুন!””
তিহির স্বাভাবিক গলাতে তাজের দাঁত চিবুনি আরো বেড়ে গেছে। গালদুটো শক্ত হয়ে আছে। তিহির দু-বাহু চেপে ধরে বললো,,
“” তুমি এ্যাবরশন করাবে,আর আজকেই!””
তিহি নিচের দিকে তাকিয়ে আছে,নিজেকে এমনভাবে গুটিয়ে নিচ্ছে যেন তাজ কোনো নর্দমার গন্ধওয়ালা বিষাক্ত কীট! যার ছোয়াতে তিহি বিষাক্ত কোনো রোগে আক্রান্ত হতে পারে,বেরুতে পারে বিশ্রী গন্ধ। তিহি ক্লান্ত স্বরে বললো,,
“” ছাড়ুন,প্লিজ!””
তাজ ওর বাহু ছেড়ে দিয়ে হাত ধরে টেনে ঘুরিয়ে যেতে নিলে তিহি আবার আগের ন্যায় শক্ত হয়ে উঠে। চোখে স্পষ্ট ভেসে উঠেছে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার শক্তি। তাজের শক্ত বাধন থেকে নিমিষেই হাতটা ছাড়িয়ে রাস্তার দিকে পা ফেলেছে। তাজ থমকে গিয়ে নির্বিকারে তাকিয়ে আছে তিহির চলনগতির দিকে। বেশ কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে এনে সামনে হাঁটা ধরে।
তিহি নিজেদের গাড়ীকে ডিঙিয়ে অন্যদিকে পা ফেলতেই তাজ পুনরায় ওর হাত চেপে ধরেছে। তাজের দিকে না তাকিয়েই তিহি নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে আর বিড়বিড় করে যাচ্ছে। ওকে রাগ দেখিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সামনে চোখ যায় তাজের। চারপাশে চোখ বুলিয়ে বুঝতে পারছে তাদেরকে ঘিরে অনেকেই দাড়িয়ে পড়েছে। কি হচ্ছে সেটা বুঝার চেষ্টা করছে,আবার কি হতে যাচ্ছে সেটাও দেখার কৌতুহলিভাবে চেয়ে আছে তাদের দিকে। তাজ চোখ বন্ধ করে বললো,,
“” তিহি গাড়ীতে গিয়ে বসো।””
“” আমি কোথাও যাবোনা,আপনার সাথে তো নয়ই,দরকার হলে আমি এই রাস্তাতেই থাকবো। ফুটপাতে বাচ্চা জন্ম দিবো,তারপর মা-বেটি ভিক্ষে করে খাবো,তবুও আপন…””
তিহির অহেতুক আর বাচ্চামী কথা শোনার প্রয়োজনবোধ করেনি তাজ। সময় নষ্ট না করে ওকে কোলে তুলে নিয়েছে। গাড়ীতে বসিয়ে দিয়ে নিজেও চেপে বসেছে। তিহি বের হতে চাইলে ওর সামনে থেকে ঠিক পেট বরাবর নিজের হাতটা দিয়ে আটকে বললো,,
“” খারাপ হয়ে যাবে! চুপচাপ বসে থাকো।””
তিহি ভয়ে সিটে হেলান দিয়েছে। তাজ নিজের হাত সরিয়ে নিতে যাবে তখনি ওর হাতটার উপর তিহি নিজের হাতটা দিয়ে চেপে ধরে। চোখ বন্ধ করেই বললো,,
“” এখানে কত আচর কেটেছেন,মনে আছে? আপনি ভুলে গেলেও আমি কিন্তু কোনোদিন ভুলতে পারবোনা। কেন জানেন? কারন আপনার আচরগুলো শুধু আমার চামড়াতে নয় মনেও দাগ কেটে আছে। সেগুলোই ভুলতে চাচ্ছি,কেন দিচ্ছেননা ভুলতে??””
তাজ নিজের হাত সরিয়ে নিতে চাইলে তিহি নিজের দুটো হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে বললো,,
“” এই যে আমি নিশ্বাসটা নিচ্ছি এটা কিন্তু শুধু আমার জন্য নয়,আমার ভেতরে আরেকজনের ফুসফুসেও গিয়ে লাগছে। তার ফুসফুসটা তো আপনার জন্যই গড়ে উঠছে,আপনার ছোয়াতেই,এক নিশ্বাসের দুই আত্মাকে আলাদা হতে দিননা। আমি আপনার কাছে আর কিছু চাইবোনা। কখনোও না!””
~~
ইশাদ সারারাত নির্ঘুমে কাটিয়েছে। এটা তার জন্য নতুন কিছু নয়। যে রাতে তিহি স্বপ্ন হয়ে তাকে কাঁপিয়ে তুলে সে রাতে ঘুম তার চোখে বসেনা। ঘুম আর তিহি যেন বিপরীত সত্তা হয়ে গিয়েছে। একজন থাকলে অন্যটা আসবেনা,কোনোভাবেইনা। ভোরের আযান পড়তেই মসজিদে ছুটে যায় ইশাদ। আজকাল মসজিদে সে শান্তি খুজে পায়,পারে কিছু সময়ের জন্য তিহিনামক ব্যাধি থেকে দুরে থাকতে। নামাজ শেষেও বেশ কিছুক্ষন মসজিদে বসে ছিলো,এমনি এমনি বসে থাকার চেয়ে কোরআন তেলাওয়াত করা ভালো হবে ভেবে, ইমামের কাছ থেকে কোরআন শরীফ চেয়ে নিয়েছিলো। মনের কষ্টের সুর ভুলে গিয়ে ডুবে গিয়েছিলো তেলাওয়াতের সুরে। মনে কিছুটা প্রশান্তি নেমে আসতেই বেড়িয়ে পড়েছিলো তিহিদের বাসার উদ্দশ্যে।
~~
শুক্রবার হওয়ায় আজ তিহির আম্মু ফরিদা বেগম বাসায় ছিলেন। মিহি তখনো ঘুম। সকালের নামাজ শেষ করে,বাজার করতে বেড়িয়ে পড়েছিলেন। সকাল সকাল না গেলে আবার ভালো মাছ পাওয়া যায়না। টুকিটাকি বাজার সেরে বাসার কাছে আসতেই ইশাদকে বাইরে দাড়িয়ে থাকতে দেখে। ঘিয়া কালার শার্টের সাথে মাথায় টুপি,মুখের ছোট ছোট দাড়িগুলো একটু বড় হওয়ায় গালদুটো ভরে আছে। সবমিলিয়ে ইশাদকে অনেকটাই মাদরাসা থেকে হাফিজি পড়ুয়া কোনো বালক মনে হচ্ছে।
ফরিদা বেগমকে দেখতে পেয়ে ইশাদ অধিরগতিতে এগিয়ে আসে। উনার হাত থেকে বাজারের ব্যাগ নিতেই ফরিদা বেগম মিস্টি করে হেঁসে উঠেছে।
“” অনেকদিন পরে এলে,বাবা। তোমাকে দেখলেই মনের ভেতর ঠান্ডা ছায়া অনুভব হয়।””
ইশাদও হাঁসি মিলিয়ে বললো,,
“” আমারও। আজ তো আপনাদের সাথে সারাদিন কাটাবো ভাবছি। যদি আপনি অনুমোতি দেন তো!””
ইশাদ আর ফরিদা বেগমের গল্পগুজব আর টুকিটাকি কাজের মাঝেই মিহি ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। হামি দিতে দিতে বললো,,
“” সুন্দর ভাইয়া,আপনি?””
ইশাদ চুলোতে আগুন ধরিয়ে বললো,,
“” হুম! এমন অবাক হচ্ছো যে?””
“” বারে,অবাক হবো নাতো কি? আমার স্কুল নাই দেখেতো আপনি আমাকে ভুলেই গেছেন। আমার এতোদিন কি মনে হচ্ছিলো জানেন?””
“” কি?””
“” আপনি আমার স্কুল বডিগার্ড। স্কুল বন্ধ হওয়ায় বডিগার্ডেরও ছুটি।””
ইশাদ হেঁসে নিয়ে কড়াইতে তেল ঢেলে বললো,,
“” তুমি যদি তা ভাবো,তাহলে তাই।””
“” আপনি কি আজ রান্না করবেন ভাবছেন?””
“” হুম! কেন তুমি খাবেনা?””
মিহি ইশাদের দিকে এগিয়ে এসে উকি মেরে দেখছে কি রান্না হচ্ছে। হলুদ মরিচে মশলা মাখা গুড়ো মাছ দেখে বললো,,
“” ওয়াও,পুটিমাছ?? একটু কড়া করে ভাজবেন। কিন্তু আপনি পারবেনতো? আমি কি হ্যাল্প করবো?””
কড়াইতে মাছ ছেড়ে দিতে দিতে বললো,,
“” না পারলে অবশ্যই হ্যাল্প করবে,মিহিরানি। তোমার কি খবর বলো।””
ইশাদের দিকে খুন্তিটা বাড়িয়ে দিয়ে মিহি নিচু স্বরে বললো,,
“” আমি তো একজনের উপর ক্রাশ খাইছি।””
“” সে ভাগ্যবান ব্যক্তিকে কে,সেটা নিশ্চয় আমাকে বলবেনা?””
“” আপনি কিভাবে বুঝলেন?””
ইশাদ কড়াই থেকে নজর সরিয়ে মিহির দিকে তাকিয়ে বললো,,
“” আমি আরো অনেক কিছুই বুঝতে পারছি,বলবো?””
মিহি উৎসুক নয়নে তাকিয়ে রয়েছে। বলুন শব্দটি না বলতেও ইশাদ বললো,,
“” সে শুধু ক্রাশেই সীমাবদ্ধ নয়,মনে হচ্ছে ভালোবাসার রাস্তার দিকে পা বাড়াচ্ছে। আই মিন,তোমার প্রথম ভালোবাসার ডায়রী খুলতে চলেছে।””
মিহি চোখ বড় বড় করে ইশাদের দিকে তাকিয়ে আছে,অনেকটা জ্যামিতি বক্সে সাজিয়ে রাখা চাঁদার মতো। ইশাদ মুচকি হেঁসে নিয়ে মাছ উল্টোনোতে মন দিয়ে আবার বললো,,
“” হয়তো তুমি এখনো কনফিউজড। চাইলে আমার সাথে শেয়ার করতে পারো,না চাইলে করোনা। তবে এটাই বলবো,ডায়রী খোলার আগে আমাকে একটু ইনফর্ম করো,কিছু অনুসন্ধান চালিয়ে দেখবো,ডায়রীর প্রথম পাতায় যাকে নিয়ে কালি পড়বে সে আসলেই তার যোগ্য কিনা। কালি ফেলার আগেই বলো কিন্তু নাহলে একবার কালি পড়ে গেলে সেখানে আমার বলা ভালো উক্তিগুলোও তোমার কাছে বিষাক্ত মনে হবে। এটা হলো প্রেমের প্রথম লক্ষন!ভালোবাসার মানুষটি বাদে বাকি সব বিরক্ত!!””
তিহির দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে ইশাদ বললো,,
“” ধরুনীটা কোথায়? কড়াইটা না ধরে মাছ উল্টোতে পারছিনা,ভেঙে যাচ্ছে।””
মিহি চুলার আশেপাশে ধরুনী খুজতেই ফরিদা বেগমের আগমন। পেছন থেকে ধীরগলায় বললো,,
“” তিহির শ্বশুড়বাড়ি থেকে ফোন এসেছিলো।””
তিহি নামটা শুনতেই ইশাদ থমকে গিয়েছে। চুলোয় জ্বলে থাকা আগুনের দিকে চেয়ে আছে। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই ধরুনী ছাড়াই আবার মাছ নাড়াচাড়ায় ব্যস্ততা দেখাচ্ছে। যেন সে কিছুই শোনেনি।
মিহি চুলোর নিচে খুজতে গিয়ে বললো,,
“” কি বললো,আম্মু?””
ফরিদা বেগম ইশাদের দিকে চেয়ে আছেন। কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেননা। বলাটা কি ঠিক হবে? কিন্তু ছেলেটা এ বাড়িতে তো আসেই তিহির জন্য। নিজ থেকে না বলুক,কিন্তু অধির আগ্রহে থাকে তিহিকে নিয়ে কিছু শোনার আশায়। ইশাদ পেছন মুখ করে দাড়িয়ে থাকলেও তিনি যেন স্পষ্ট ইশাদের মুখ দেখতে পাচ্ছেন,পড়তে পারছেন তার চোখে পড়া পলকের ভাষা।
ফরিদা বেগম আমতা আমতা কাটিয়ে বললেন,,
“” তিহি প্রেগন্যান্ট!””
মিহি সোজা হয়ে দাড়িয়ে খুশি খুশি কন্ঠে বললো,,
“”সত্যি মা? কেটে দিয়েছো? আপুর সাথে কথা হয়েছে?””
“” না,ওর ফুপি শ্বাশুড়ি কল দিয়েছিলেন। তাজ আর তিহি নাকি বাইরে বেড়িয়েছে তাই কথা হয়নি,বলেছে,আসলে কল দিতে বলবে।””
মিহি আরো কিছু বলতে যেয়েও থেমে গিয়েছে। হঠাৎ করে মনে পড়লো এখানে শুধু সে আর তার আম্মু নয় আরেকজনও আছে৷ মিহির হাঁসি মুখটা মিলিয়ে যেতেই ইশাদের দিকে তাকালো। আর সাথে সাথে চিল্লিয়ে উঠেছে,,
“” আরে,আপনি গরম কড়াই খালি হাতে চেপে ধরেছেন কেন? হাত পুড়ে যাবেতো!””
মিহি দ্রুততার সাথে ইশাদের হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে কড়াই থেকে। হাত উল্টিয়ে নিতেই চোখ ছলছল হয়ে উঠলো,,,
“” আপনার হাততো পুড়ে গেছে। আল্লাহ!””
ততক্ষনে ফরিদা বেগম ও এগিয়ে এসেছেন। হাত দেখতে যেতে নিলেই ইশাদ নিজের হাত গুটিয়ে নিয়ে বললো,,
“” কই পুড়ে গেছে? কিছু হয়নি।””
“” হয়েছে। ওষুধ লাগাতে হবে।””
ফরিদা বেগম ঠান্ডা পানিতে ইশাদের হাত ডুবিয়ে দিয়েছে। মিহি মলম আনার জন্য পা বাড়াতেই মসজিদের আযান ভেসে উঠেছে। ইশাদ পানি থেকে হাত সরিয়ে মিহিকে বললো,,
“” আজ নাহয় তুমিই রান্নাটা করে ফেলো,আমি নামাজে যাবো।””
কারো দিক থেকে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই ইশাদ বাইরে বেরোনোর জন্য পা চালায়। পেছন থেকে মিহি ডাকতে নিলে ফরিদা বেগম বাধা দিয়ে বললেন,,
“” পিছু ডাকিসনা,নামাজ শেষে আবার আসবে। যা মাছের ঝোলটা ভালো করে রাধ দেখি,আজ আমরা সবাই মিলে তোর রান্না খাবো। ঠিক করে রান্না করিস,যেন আয়েশ করে,হাত চেটেপুটে খেতে পারি!””
~~
বাসার সামনে এসে গাড়ীর ব্রেক কষে তাজ।
“” নামো।””
“” নামবোনা। আমি আপনার সাথে কোথাও যাবোনা।””
তাজ আর কথা বাড়ায়নি। চুপচাপ নিজে নেমে তিহির পাশে এসে দাড়িয়েছে। গাড়ীর দরজাটা খুলে তিহির হাত ধরে হেচকা টানে বের করে নিয়ে আসে। সজোরে দরজা লাগিয়ে বাসার দিকে হাঁটা ধরতেই তিহি বেকে বসে। নিজের শাড়ীর আঁচলে টান খেয়ে পেছনে তাকিয়ে আছে। তাজ তিহিকে অনুসরন করে পেছনে তাকিয়ে দেখতে পেলো,তিহির শাড়ীর আচল গাড়ীর দরজার সাথে আটকে আছে। তিহিকে টেনে ধরে হাঁটাতে আচলে টান লেগে গিয়েছিলো। যার ফলে অনেকখানি ছিড়েও গিয়েছে। তাজ তিহির আঁচল হাতের মুঠিতে নিয়ে টেনে ছিড়ে আলগা করে ফেললো।
শিরিন বেগম দরজা খুলে দিতেই তাজ হুড়মুড়িয়ে তিহিকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে।
“” কি হয়েছে,তোদের মুখের অবস্থা এমন কেন?””
শিরিন বেগম তিহির দিকে এগিয়ে শাড়ীটা ধরে বললো,,
“” শাড়ী কিভাবে ছিড়েছিস?””
“” তোমার ছেলে শুধু শাড়ী কেন,আমাকেও ছিড়ে ফেলতে চাচ্ছে।””
“” মানে?””
শিরিন বেগমের কথার উত্তর দেওয়ারও সময়টুকু পায়নি তিহি। তার আগেই তাজ ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,,,
“” চুপ,আর একটা কথা বলবে তো..””
“” কি করবেন? মারবেন? মারুননা।””
তিহির রাগের সাথে তাজ পেরে উঠছেনা। মেয়েটার যে এতো রাগ থাকতে পারে এটা তাজের ভাবনা-চিন্তার বাইরে ছিলো। যতটা না রাগ হচ্ছে ততটাই অবাক হচ্ছে তাজ। কিন্তু তাকে নরম হলে চলবেনা, সবকিছু ঠিক করতে হলে যে তার ছোয়ার বিনাশ করতে হবে।
তিহি তাজের দিকে এগিয়ে এসে গালটা বাড়িয়ে ধরে বললো,,
“” কোথায় মারবেন? গালে মারতে ইচ্ছে করছেনা? তাহলে নিন পেটে মারুন। তাহলে আর কষ্ট করে হসপিটালের শরণাপন্ন হতে হবেনা!””
তিহির কথাতে তাজের মাথার তালু গরম হয়ে ফুটে উঠছে। এতো জেদ আর রাগ কোথা থেকে পেয়েছে? ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে দুটো চড় মেরে বলতে,এতো সাহস কি করে হয় যে তাজের সামনে চোখ রাঙায়??? কিন্তু পারছেনা মারতে। যে মুখে সে ঠোঁটটাও ছোয়ায়নি সে গালে হাতের দাগ কিভাবে বসাবে?? হ্যা ছুয়েছে সে তিহির শরীরের বিশেষ বিশেষ জায়গায়,বিচরন করেছিলো নামা আন্তেপ্রান্তে কিন্তু তিহির মুখের একটি বিন্দুতেও সে তার ঠোঁট ছোয়ায়নি। কেন এমনটা করেছে কেনই বা ইচ্ছে জাগেনি সে জানেনা। কিন্তু আজকাল তার খুব ইচ্ছে হয় তিহির কপালে এঁকে দিতে ভালোবাসার টিপ! ঘনঘন পলক ফেলা চোখে ছোট্ট করে চুমু খেয়ে ক্লান্তি দুর করে দিতেও ইচ্ছে করে,গালে চুমু খেয়ে হলদে গালটা লালটে করে দিতে ইচ্ছে করে। আর এই ঠোঁট!
তাজ নিজের ভাবনা রাজ্য থেকে বেড়িয়ে তিহির দুগাল নিজের দুহাতে চেপে ধরেছে। শক্ত করে নয়,আলতো করে,,চোখে চোখ রেখে বললো,,
“”এতো উত্তেজিত হয়োনা। তোমার শ্বাস টানতে কষ্ট হচ্ছে।””
তিহি এতক্ষন ভাবনালেশ আর ক্রোধ নিয়ে তাকালেও এবার ভালো করে তাকিয়েছে তাজের দিকে। চোখের সাগরে ডুবার আগেই তাজ তিহিকে টেনে ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে। নিজেও একটা চেয়ার ঘুরিয়ে ওর মুখোমুখি হয়ে বসেছে। কন্ঠটা যতটা সম্ভব শান্ত রেখে বললো,,
“” তুমি চাওনা সব ঠিক হয়ে যাক? আমি সব ঠিক করে দিবো। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে আর কষ্ট পেতে হবেনা। চোখের পানি ফেলতে হবেনা। ভরসা করো প্লিজ! জাস্ট একবার।””
তাজের কথার দিকে তিহির কোনো খেয়াল নেই,সে তাকিয়ে আছে ডাইনিং টেবিলের স্পুনক্যারিটার দিকে। ওখানে নানারকম চামচের সাথে বিভিন্ন সাইজের ছুরিও দেখতে পারছে।
তাজ একটা লম্বা দম নিয়ে আবার বললো,,
“” সবকিছু ঠিক করতে হলে তোমার এ্যাবরশন করা জরুরী! তিহি বুঝার চেষ্টা…””
তাজের কথা শেষ করার আগেই তিহি চেয়ার ছেড়ে ছুরিটা নিজের আয়ত্বে করে নিয়েছে। তাজের থেকে কয়েক কদম পিছিয়েও গিয়েছে। ছুরিটা নিজের গলায় ধরে বললো,,
“” শুধু বাচ্চাটাকে মেরে কি লাভ? আমাকেও তো মেরে ফেলবেন তাইনা? হয়তো ওর মতো এতো সহজ পদ্ধতিতে নয়, ধুকেধুকে মারবেন আমায়। তার থেকে ভালো আমরা মা-বেটি একসাথে মরে যায়। তাতে আপনার কষ্টটাও কম হবে আর সময়ও বেঁচে যাবে।””
তিহির আকস্মিক কান্ডে তাজ এতোটাই আতংকিত যে সে বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তিহির দিকে। তার যে এখন হস্তিনস্তি হয়ে তিহিকে আটকানো প্রয়োজন সেটাও মাথায় ঢুকছেনা।
শিরিন বেগমও আতংকিত ও ভয়তুর স্বরে বললো,,
“” তিহিমা,কি করছিস লেগে যাবে!””
“” ফুপিমা আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেনা। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি গলায় ঘা বসিয়ে দিবো। প্লিজ! তুমি এসোনা। আজ হয় তোমার ছেলের জিদ জিতবে নাহয় আমার!””
শিরিন বেগমের চিৎকারে তাজ সম্ভিত পেয়েছে। চেয়ার ছেড়ে তিহির দিকে এগুতে এগুতে বললো,,,
“” তিহি,পাগলামী করোনা। আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি।””
তিহি ছুরিটা গলার কাছে শক্ত করে চেপে ধরে চড়া গলায় বললো,,
“” আপনি যে আমার কেমন ভালো চান সেটা এতোদিনেও আমার অজানা নয়।””
“” তিহি ছুরিটা সরাও,বলছিতো লেগে যাবে।””
“” লাগুক তাতে আপনার কি? আপনি তো আমার শরীর- মনে কম আঘাত করেননি তার কাছে এটা কিছুই নয়। আপনি আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেননা।””
“” তিহি প্লিজ!””
“” আগে বলুন আপনি আমায় কোন অপরাধের শাস্তি দিচ্ছেন? যার জন্য শুধু আমি নই একটা নিষ্পাপ শিশুকেও শাস্তি দিতে চাচ্ছেন?””
“” তুমি কোনো অপরাধ করোনি। আমি বলছি তো সব ঠিক করে দিবো ছুরিটা আমাকে দাও।””
তাজ অনেকটাই তিহির কাছে এগিয়ে এসেছে। খুব সাবধানতার সাথে তিহির হাত চেপে ধরেছে। দুজনের দস্তাদস্তির মাঝেও তিহি চিৎকার করে বলছে,
“” তাহলে কার অপরাধে আমি শাস্তি পাচ্ছি? আজকে আপনাকে বলতেই হবে।””
“” ইশাদের!””
ইশাদের নাম শুনতেই তিহি থ হয়ে গিয়েছে। জমাট বেধে যাচ্ছে তার শরীর। নিঃসার সুরে বললো,,
“” ইশাদ!””
ততক্ষনে তিহির হাতের ছুরি তাজের হাতে। ছুরিটা সর্ব শক্তিতে মেঝেতে ঢিল মেরে বললো,,
“” আমার সন্তানকে ও কেড়ে নিয়েছে। আমার বুক খালি করে নিজের বুক ভরে নিয়েছে।””
তিহির নিঃসার কন্ঠ ধীর হয়ে এসেছে। চমকের সাথে চমকে তিহি নড়ে উঠে বললো,,
“” আপনার সন্তান?””
“” ইনা আমার সন্তান,আমার মেয়ে। ও শুধু আমার মেয়ে আর কারো নয়। ও আমার হৃদপিন্ড। আমার হৃদপিন্ডকে আমার শরীর থেকে ইশাদ ছিনিয়ে নিয়েছে!””
চলবে