তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (১৫)

0
3151

#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (১৫)
#রোকসানা-রাহমান

“”আমাদের হিসাববিজ্ঞানের স্যারটা এতো হ্যান্ডসাম,এতো ইয়াং, এতো সুন্দর করে কথা বলে,তার দিকে সবাই মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আর তুই একমাত্র বান্দা যে কিনা এই বুড়ো ইংলিশ স্যারটার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকিস। তোর পছন্দ এমন বুড়ো বুড়……””

নিশি কথা শেষ না করতেই ওর গালে ঠাস করে একটা চড় পড়েছে। শুধু থাপ্পড় মেরেই মিহি ক্ষান্ন নয়। রীতিমতো, নিশির চুলধরে টানাটানি শুরু করেছে আর চিৎকার করে বলছে,,,

“” তোর এতো সাহস হয় কি করে? আমার ক্রাশকে তুই বুড়ো বলিশ?? আজ তোর চুল আমি ছিড়ে ফেলবো। টাক বানিয়ে ফেলবো,তারপর বুঝবি বুড়ি কাকে বলে!””

মিহির আকস্মিক কর্মকান্ড আর গলার চড়াশব্দে পুরো ক্লাস স্তব্ধ। সকলেই উৎসুক চোখে চেয়ে তাদের দিকে।

ইরফাদ মাস তিনেক হলো একটা প্রাইভেট কলেজে গেস্ট টিচার হিসেবে জয়েন করেছে। বাসায় বসে বসে বাবার টাকা নষ্ট না করে আপাতত নিজের অর্জনকে কাজে লাগানোটাকেই ভালো মনে হয়েছিলো। তাই নিজের মেধা প্লাস পারসোনাল পরিচিতির মাধ্যমে সরাসরি কলেজে ইংলিশ লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছিলো। মিহিকেও এখানে এডমিট করা হয়েছে। ইশাদ করেছে। তার ধারনা ভাইয়ের দৌলতে মিহি একটু বেশি সেফ থাকবে। চোখে চোখে রাখা যাবে,তার মধ্যে কলেজের রিপোটেশনও বেশ ভালো। একটা ভালো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পেতে হলে ভালো রেজাল্টটাও খুব জরুরী। এতে সহমতপোষন করেছিলো ইরফাদও। নিজের কলেজে মিহি থাকলে মাঝে মাঝে কথাপোকথনও করা যাবে। ওর সাথে মিশে আরেকটু ফ্রি হতে পারলেই সে ইশাদের কথাটা খোলাশা করবে। ওদের দুজনের সম্পর্ক যতটা ঘনিষ্ঠ তাতে মনে হয়না ইশাদকে বিয়ে করতে মিহি অমত করবে। আর যতদিননা এ ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্তে আসতে পারছে ততদিন তাদের তিনজনের মধ্যে যাতে অন্যকোনো ছেলের আগমন না ঘটে সে ব্যাপারটাও কড়া চোখে রাখতে পারবে।

মিহিদের ক্লাসের ইংলিশ টিচারটা কিছুদিন অনুপস্থিত থাকার জন্যে সে ক্লাসের দায়িত্ব পড়েছিলো ইরফাদের,আজ নিয়ে তৃতীয় ক্লাস তার। সকলের সালাম গ্রহন করে বসতে বলে সরাসরি লেকচারে চলে গিয়েছিলো। বোর্ডে কিছু লিখতে যাবে তার মধ্যে ঘটে গেলো অঘটন।

মিহি নিজের দুহাত দিয়ে নিশার চুল খামচে ধরে আছে। চোখ বন্ধ করে,নাক,মুখ,কপাল কুচকে ইচ্ছেমতো বকে যাচ্ছে আর মারধোর করছে। বসে থেকে পজিশন ঠিক করতে না পেরে উঠে দাড়িয়েও পড়েছে। ইরফাদ ধমকের সুরে মিহির উদ্দশ্যে বললো,,

“” মিহি ছাড়ো ওকে। এসব কি ছেলেমানুষি?””

ইরফাদের কথা যেন মিহির কানে যাচ্ছেইনা। এদিকে নিশা আর সহ্য করতে না পেরে কেঁদেকেটে অস্থির। ইরফাদ আর দাড়িয়ে থাকতে পারছেনা। মিহির কাছে এসে জোর করে ওকে ছাড়িয়ে নিয়েছে। প্রচন্ড শক্ত ঝাড়ি দিয়ে মিহিকে বললো,,

“” তুমি এক্ষনি ক্লাস থেকে বের হয়ে যাবে। রাইট নাও।কুইক””

একটু আগে যে কঠিন ঝগড়া করে এসেছিলো মিহি তা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারছেনা। কপালে এখনো রাগের ভাজ,চোখটাও শান্ত হয়নি,সাথে নিশ্বাস টানার গতিটাও বেড়ে আছে। কিন্তু ইরফাদের ধমকে ওর দিকে কিছু ক্ষন চেয়ে থেকে বললো,,

“” আমি কি ইচ্ছে করে ঝগড়া করেছি ও আপনাকে বুড়ো…””

মিহির সাফাই দেওয়ার প্রচেষ্টাতে ইরফাদ যেন আরো বেশি রেগে যাচ্ছে। পুনরায় রাগ নিয়ে বললো,,

“” কানে ধরো!””
“” কিহ!””
“” আমি বলছি কানে ধরতে!””

ইরফাদের রাগমাখা ঝাড়িতে মিহি কেঁপে উঠেছে। চট করে দুকান ধরে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।

“” ক্লাসের বাইরে গিয়ে এক পা উচু করে থাকবে। আর হ্যা হাতদুটো যেন এভাবেই কানে থাকে। নাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবেনা।””

মিহির চোখে পানি এসে গিয়েছে। ইচ্ছে করছে ছলছল নয়নে ইরফাদের দিকে তাকাতে কিন্তু সে তাকাবেনা। অভিমান হচ্ছে তার গাঢ় অভিমান!

যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর? আমিও আছি এই বুড়ো ব্যাটার উপর কেন ক্রাশ খেতে গেলাম? কলেজে আর স্যারের অভাব পড়েছে?? শুধু স্যার কেন আমাদের সিনিয়র ব্যাচ এমনকি ক্লাসেও তো কত সুন্দর সুন্দর পোলা আছে ওদের উপর কেন ক্রাশ খেতে পারিনা?? আর এই যে রাদিব! ও তো প্রথম দিন থেকে আমার পিছ পিছ ঘুরছে আমি তো ওকে রেখেও আপনাকে ভাবি সয়নে,স্বপনে এমনকি মরনেও!! আর ভাববোনা,বুড়ো একটা,এমন বুড়ো ছেলেকে মিহি আর ভাববেনা,তার জন্য আর ঝগড়াও করবেনা,বলুক সবাই বুড়ো। বুড়ো বলতে বলতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলুক,তাতে আমার কি??

মিহি ক্লাসের বাইরে দাড়িয়েই নানা ভাবনায় বিড়বিড় করছিলো। ঘন্টা পড়তেই ইরফাদ বের হয়ে যায়। মিহির দিকে একবার ফিরেও তাকাইনি,তাতে কি মিহিতো তাকিয়ে আছে,গভীরভাবে যে তাকানোর মধ্যে রয়েছে ভালোবাসার সাগরের ঢেউ,সেই ঢেউতে আচড়ে পড়ে ভেসে যাচ্ছে সে!

পেছন থেকে ত্রিনা বিদ্রুপের সুরে বললো,,,

“” ঠিক হয়েছে,বুড়ো স্যারের ক্রাশ খেলে এমনি হয়,শাস্তি পেয়েও তোর শিক্ষা হয়নি? আবার ও চেয়ে আছিস? কি আছে রে ঐ বুড়োর মধ্যে?””

একটু আগেও যে মেয়েটা ইরফাদের উপর অভিমান করেছিলো। সে মেয়েটাই এখন আগ্নেয়গিরির মতো ফেপে উঠছে। উইথআউট নোটিশে ত্রিনার উপর হামলে পড়লো!

~~

সাতমাস শেষ হয়ে আটমাসে পা দিয়েছে তিহি। পেটটা বেশ ফুলে উঠেছে। খাবারদাবারেও এসেছে বেশ পরিবর্তন। এটা খাবেনা,ওটা খাবেনা,আবার এমন জিনিস খেতে চাইবে যেটা বাসাতে নেই। তিহির জ্বালামিতে পুরোপুরিভাবে ভুগতে হচ্ছে শিরিন বেগমকে। মাঝে মাঝে বিরক্ত হলেও একটু পরেই হেঁসে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকেন তিহির দিকে। হয়তো এমন একটা রুপে সেও থাকতে পারতো,কিন্তু নিয়তির সাথে সে পেরে উঠেনি।

তিহি গোসল ছেড়ে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে। বিশেষ করে পেটটাকে,ইশ! কত্ত বড় দেখাচ্ছে। এটার জন্য সে এখন আর শাড়ী পড়তে পারেনা। খুবই বিশ্রী লাগে! থ্রি-পিস পড়লেও কমফোর্টেবল ফিল হয়না বিধায় গোল,বেশ ঢিলেঢালা করে ম্যাকসি বানিয়ে দিয়েছেন শিরিন বেগম। এখন মিহিকে শুধু বউ না,বউয়ের উপরে যা থাকে তাও লাগে। শুধু যার বউ ও সেজে আছে, সে নাই। নাই বলতে তার হাতের কাছে নাই,দিনরাত চব্বিশটা ঘন্টা নিজের রুমে বসে থাকবে। হুট করে বেরিয়ে যাবে আবার হুট করে রুমে ঢুকে দারজা আটকে থাকবে। লোকটা যে কি চায় তিহি আজও ভেবে পায়নি। এতোগুলো মাস কেটে গেলো অথচ তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই,এতো নির্দয় মানুষ কিভাবে হয়?? আমি যদি সব ভুলে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারি উনি কেন পারেননা?? ভালোবাসা না থাকুক একটু দায়িত্ববোধটাও তো সামলাতে পারেন! উনার কাছে ভালোবাসা কে চেয়েছে?? আমি তো মনে প্রাণে চাই যাতে ভালো না বাসুক। যে ভালোবাসার বিনিময়ে আমি ভালোবাসা দিতে পারবোনা,সে ভালোবাসা আমি চাইনা। আমি চাই একটু দায়িত্ববান হোক,একটু ভালো থাকুক,বউ হিসেবেও চাই আবার ইশাদের দেওয়া কথা রাখতে হলেও চাই।

তিহি লম্বা শ্বাস ছেড়ে আয়নার দিকে তাকিয়ে আবার নিজেকে দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু হুট করেই মনে হলো পেছনে কেউ দাড়িয়ে আছে,যার দুটো চোখ তাকে খুব গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করছে। তিহি তাৎক্ষনিক পেছনে ঘুরে কাউকে দেখতে পায়নি। কয়েক সেকেন্ড দরজার দিকে তাকিয়েও যখন কাউকে পেলোনা,তখন মাথায় দুষ্টুবুদ্ধী চাপলো।

ছবিতে নায়িকারা যেভাবে মাথায় হাত দিয়ে পড়ে যাওয়ার অভিনয় করে,তিহিও তাই করবে। দরজার ওপাশে লুকিয়ে থাকা মানুষটাকে ভেতরে আনার জন্য এটি টনকের মতো কাজ করতে পারে। এতোদিনে তিহি অন্তত এটা ঠিক বুঝে নিয়েছে,মানুষটি তার সুখ না চাইলেও দুখ চাইনা। যেমন ভাবা তেমন কাজ,তিহি চোখ বন্ধ করে দুহাতে মাথার দুপাশ চেপে ধরেছে। কিছুটা এদিক ওদিক হেলে নিয়ে পড়ে যাওয়ার ভঙ্গি করতেই দুটো হাত এসে ওকে ঝাপটে ধরে।

তাজ তিহিকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আছে,বা-হাতের তালুটা তিহির গালে স্পর্শ করে অস্থিরতায় বলছে,,

“” তিহি,কি হয়েছে? ঠিক আছো তো? চোখ মেলো,তিহি!””

তিহি পিটপিট করে চোখ মেলে তাজকে দেখার চেষ্টা করছে। ভেবেছিলো অভিনয়টা কনটিনিউ করবে কিন্তু তাজের ভয়ার্ত চেহারা দেখতেই ও খিলখিলিয়ে হেঁসে উঠে। হাঁসতে হাঁসতে বললো,,

“” লুকিয়ে লুকিয়ে মেয়ে মানুষ দেখা,লজ্জা করেনা?””

তাজ তিহির হাঁসি আর কথা শুনে ওর দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে। তিহি সোজা হয়ে দাড়িয়ে বললো,,

“” আমি তো আপনার রুমে যায়নি,তাহলে আপনি কেন আমার রুমে এসেছেন। জরিমানা দিন!””

তিহির মজার কাহিনি ধরতে পেরে তাজ বেশ বিরক্ত মুখ বানিয়ে ফেলেছে। তিহির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছে। তিহি ও দৌড়ে ওর সামনে এসে পথ আটকে বললো,,

“” আপনার মেয়ে হুবহু আপনার মতো হয়েছে। এই যে আপনার চোখদুটো আর ইনার চোখদুটো একদম সেম। আর আপনার হাসি ওমাইগড,ফুল টু ফুল এক। আমি এখন বুঝতে পেরেছি আপনাকে আমার এতো চেনা কেন লেগেছে। ইনার সাথে আমি দেড় বছর সময় কাটিয়েছি। ও তো পুরো আমার সাথে মিশে ছিলো। লাইক এ্যা চাইল্ড আন্ড মাদার। ও আমাকে মামনি…””
“” সামনে থেকে সরো।””
“” কেন,যে আপনার কাছে নেই তার সম্পর্কে শুনতে ভালো লাগছেনা?? আমি তো জানি ভালোবাসার মানুষটি কাছে না থাকলে তার সম্পর্কে কথা উঠলেও ভালো লাগে। আমি আপনাকে রোজ ইনার গল্প শোনাবো। আমাকে আপনার রুমে থাকার অনুমোতি দিননা প্লিজ। এই রুমে একা ঘুমাতে খুব ভয় লাগে।””

তাজ তিহিকে পাশ কাটিয়ে গম্ভীর সুরে বললো,,

“” একা ভয় লাগলে ফুপির সাথে ঘুমালেই হয়।””

তিহি পেছন থেকে চিৎকার করে বললো,,

“” না, হয় আমি আপনার সাথে ঘুমাবো নাহয় একাই থাকবো।””

তাজ পা ফেলতে গিয়ে থেমে গিয়ে মাথাটা পেছনে ঘুরিয়ে বললো,,

“” এতো জেদ ভালো নয়।””
“” সেম কথাতো আমিও আপনাকে বলতে পারি,এতো জেদ ভালো নয়,তাজ!””

তিহির কথায় তাজের দৃষ্টি থমকে আছে। দুজনের বিয়ের বয়স এক বছর হতে চললো কিন্তু এতোদিনেও তিহি কখনো তাজের নাম ধরে সম্বোধন করেনি,তাহলে আজ কেন করছে?? উফ! ওর মুখে নিজের নাম শুনে তাজের ভেতরের সবকিছু শিউরে উঠেছে। ইচ্ছে করছে আজ সব জিদ,রাগ,ক্রোধের পালাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বলতে,

“” নেশাবউ,আমি তোমার নেশায় ডুবতে চাই।””

তাজের ভাবনার মধ্যেই তিহি এসে ওকে ঠেলতে ঠেলতে বললো,,

“” বেড়িয়ে যান আপনি আমার রুম থেকে। আমি আপনার মুখদর্শন করতে চাইনা। আপনার মতো পৈশব বাবার মুখ আমার অনাগত সন্তানও যাতে কোনোদিন না দেখে সে ব্যবস্থা আমি করে যাবো। যে আপনার একটা সন্তান পিতৃপরিচয় দিয়ে আগলে রাখতে পারে সে দ্বিতীয়টাও রাখতে পারবে। আমার জন্য হলেও রাখবে””

তিহি কথা শেষ করতেই ওর চিবুক শক্ত করে চেপে ধরে তাজ। কঠোর অগ্নিদৃষ্টি নিয়ে বললো,,

“” কি বললি তুই? কই যাবি? তোর ঐ ইশাদের কাছে?? আমার জীবন থাকতে তা কোনোদিন পারবিনা। দরকার হলে ক্যারোসিন দিয়ে জীবন্ত জ্বালিয়ে দিবো তোকে,তারপর আমিও জ্বলে যাবো!””
“” আর কি জ্বালাবেন? জ্বালানোর মতো এখনো কি বাকি আছে? স্বামীহীন স্ত্রীরাও এতো কষ্ট পায়না,যতটা আপনি আমাকে দিচ্ছেন! রুমটাকে নরক বানিয়ে রেখেছেন। আপনার বুঝি বাইরে খেয়েও পুষায়না এখন নিজের বাড়িটাকেও…””
“” তুই আমার রুমে ঢুকেছিলি? কেন ঢুকেছিলি বল,কি প্রয়োজনে ঢুকেছিলি?””
“” কোনো প্রয়োজন নয়,অধিকারে!””

তিহির আত্মঅধিকারের উপর তাজ নিজের রাগ দেখাতে পারছেনা। তিহিকে ছেড়ে দিয়ে ধপধপ পা ফেলে বেড়িয়ে পড়ে। কষ্ট কাকে বলে সে এই ৪ মাসেই টের পেয়েছে। তিহির কাছ থেকে এক সেকেন্ডও দুরে থাকলে মনে হচ্ছে কেউ তার গলা টিপে ধরে আছে। কিন্তু সে যে চায়না মাতাল হয়ে তিহির সামনে যেতে। দিন যত এগুচ্ছে মদের নেশা তাকে তত গ্রাস করে নিচ্ছে। কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছেনা। তিহির কাছে না হোক তার পাশের রুমে থেকেও একটু সস্থির নিস্বাস নিতে পারে সে। তাই এখনো এ বাসায় পড়ে আছে,নাহলে কবেই বাড়ির মায়ার গন্ডি পেরিয়ে মদের সাগরে ভেসে নিজেকে বিসর্জন দিতো।

~~

ইশাদ নিজের পেশেন্টদের ভিড় ছেড়ে মিহিকে ডেকে নিয়েছে নিজের চেম্বারে। মাস দুয়েক হলো সে একটা প্রাইভেট হসপিটালে আছে। বাবা আর ভাইয়ের অনুরোধেই নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা। তিহির মতো তারাও যে তার খুব আপন। এতো অনুরোধ সে কিভাবে ফেলতো??

ইশাদ মুখে মধুর হাসি নিয়ে বললো,,

“” কতক্ষন ধরে অপেক্ষা করছিলে?””
“” হিসেব করিনি।””

মিহি নিজের কলেজ ব্যাগ থেকে টিফিনকারীটা বের করে ইশাদের দিকে বাড়িয়ে বললো,,

“” আম্মু,আপনার জন্য গুড়ো মাছের ঝোল,বেগুন ভাজা আর ভাত পাঠিয়েছে!””

ইশাদ অনেকটা লোভাতুর দৃষ্টি নিয়ে ভাত মাখতে মাখতে বললো,,

“” তুমি খেয়েছো?””
“” হুম,আমি তো টিফিনেই খেয়ে নিয়েছি।””

ইশাদের দিকে কিছুক্ষন চেয়ে থেকে মিহি বললো,,

“” ডাক্তারী পোষাকে আপনাকে তো আরো বেশি সুন্দর লাগে,সুন্দর ভাইয়া। এখন থেকে আপনি আমার সাথে দেখা করতে আসলেও এগুলোই পড়ে আসবেন।””

মিহির কথায় ইশাদ ভাত মুখে নিয়েই হেঁসে উঠে। হাঁসি থামিয়ে পানি খাচ্ছিলো,তারমাঝেই মিহি আবার বললো,,

“” কিন্তু এমন দেবদাসসাজে ডাক্তার মানাচ্ছেনা,মনে হচ্ছে ক্লিন সেভ হলে বেশি মানাতো। আপনাকে কখনো ক্লিন সেভে দেখিনি,এবার করিয়েনতো,দেখবো কেমন লাগে!””
“” সম্ভব না।””
“” কেন?””
“” কেউ একজন বলেছিলো,আমার এই খোঁচা খোঁচা দাড়ি তার খুব পছন্দের। আমি যেন কখনো না কাটি।””

ইশাদ কথার প্রসঙ্গ পাল্টিতে আবার বললো,,

“” শুনলাম তুমি নাকি আজকাল বেশি দুষ্টুমী করছো,বাচ্চাদের মতো ঝগড়া করছো। এগুলো কি সত্যি?””

ইশাদের কথায় তিহি শটাং করে উঠে দাড়িয়ে পড়েছে। ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,,

“” আপনাদের সাথে আমার আর কোনো কথা নাই। একজন কলেজে আমাকে শাস্তি দিতে দিতে জীবনটা ত্যানা ত্যানা করে ফেলছে তো আরেকজন শালিশি করতে করতে। আপনাদের দু ভাইয়ের কি আর কোনো কাজ নেই?””

ইশাদ নিজের হাঁসি আটকিয়ে বললো,,

“” ভাইয়াতো দেখছি ভুল কিছু বলেনি,তুমি তো বড় না হয়ে ছোট হয়ে যাচ্ছো,মিহিরানী।””

মিহি চেয়ার ছেড়ে চলে যেতে নিলে ইশাদ পেছন থেকে ডেকে উঠে বললো,,

“” বাব্বাহ! এতো রাগ। রাগটা কি আমার কথাতে ফুটলো নাকি অন্য কারনে? কেউ চাইলে শেয়ার করতে পারে। আমি এক ঘন্টার জন্য ফ্রি আছি!””

মিহি মন খারাপ নিয়ে আগের জায়গায় বসে পড়ে বললো,,,

“” আমার কি দোষ,আমি কি ইচ্ছে করে এমন করি?? আপনিই বলেন আমার পছন্দের মানুষটাকে নিয়ে যদি কেউ কিছু বলে, তাহলে আমার রাগ হবেনা?””
“” আলবাত হবে। কিন্তু বেশি হওয়া ঠিক না। তোমাকে এটাও দেখতে হবে নিজের পছন্দের মানুষের জন্য অন্য কাউকে হার্ট করছো নাকি। আমি ভাইয়ার মুখে যতটুকু শুনেছি মেয়েটাকে নাকি তুমি খুব মেরেছো। সে খুব কান্নাকাটিও করেছে। এটা কি ঠিক হয়েছে?””
“” আমিও তো শাস্তি পেয়েছি। আমার পা তো এখনো ব্যথা করছে!””

ইশাদ হাত ধুয়ে বললো,,

“” তুমি অন্যায় করেছো তাই শাস্তি পেয়েছো। কাল ঐ মেয়েটাকে সরি বলবে।””

মিহি মন খারাপ করে বললো,,

“” আচ্ছা।””

মিহি সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই ইশাদ আবার বললো,,,

“” ভালোবাসার ডায়রীটা তাহলে খুলেই ফেলেছো। আমাকে কি এখনো শেয়ার করা যায়না? আইএম ভেরি টেনসড এবাউট ইউ!””

মিহি হাঁসি হাঁসি মুখ নিয়ে বললো,,

“” অবশ্যই বলবো। আগে তাকে বলে নেই তারপর। আর আপনাকে এতো টেনসড হতে হবেনা। আমার মতো আপনিও চোখ বন্ধ করে তাকে বিশ্বাস করতে পারেন। পৃথিবীতে দুটো পুরুষকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি,একজন আপনি আর দ্বিতীয়জন সে।””

ইশাদ মিহির কাছে এসে মাথায় টুকা দিয়ে বললো,,

“” এখনো ভালোবাসার কথা জানাওনি তাও এতো বিশ্বাস,যদি এক্সেপ্ট না করে? প্রথম প্রেমের প্রত্যাখ্যান সহ্য করতে পারবেতো??””
“” প্রত্যাখ্যান করতে দিলেতো? আমি কি আপুর মতো? আমি উনাকে বেধে গলায় ঝুলিয়ে রাখবো।””

মিহির কথায় ইশাদের চোখ বড় বড় হয়ে গিয়েছে। এই প্রথম ইশাদের বদলে মিহি অট্টস্বরে হেঁসে উঠে বেড়িয়ে যাচ্ছে।

~~

রাতের খাবার শেষ করে তিহি নিজের রুমে পায়চারী করছে। ইদানিং কোমড়টা একটু ব্যথা ব্যথা করছে। পায়ের ভারটাও যেন বেড়ে যাচ্ছে। মা বারবার বলে দিয়েছে,যেন শুয়ে বসে সময় না কাটায়। হাত,পা অনেকটা ফুলে উঠেছে,মুখটাও ভরে গিয়েছে। তিহির মাঝে মাঝে হাঁসি পায় এমন গালফুলো মুখ দেখলে।

কিছুক্ষন হেঁটে ক্লান্ত হয়ে নিজেকে বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে তিহি। চোখটা বন্ধ করতেই ইশাদের মুখটা ভেসে উঠেছে। সাথে সাথে নানা প্রশ্নও নড়েচড়ে উঠছে তিহির। এটা নতুননা,প্রতিরাতেই এমন হয়। প্রশ্নগুলো খুববেশি জ্বালায় ওকে। উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত হয়তো এই জ্বালানো বন্ধও হবেনা। আর এই উত্তর তাকে একমাত্র ইশাদ দিতে পারবে তারজন্য ইশাদের মুখোমুখি হওয়া খুব জরুরী। কিভাবে হবে তিহি জানেনা। তবে মন বলছে খুব শিঘ্রই সে তার ইশাদের মুখদর্শন করবে। অনেকটা মাস পেরিয়ে গেছে ইশাদকে দেখেনা। মনের ভেতর খুব আনচান হয়,একটাবার দেখার জন্য। কেমন কাটছে তার তিহিবিহীন জীবন? এতোদিনে কি নতুন কেউ এসেছে তার জীবনে? তিহির চোখ ভিজে আসছে বুঝতে পেরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ে। রুমের লাইটটা অফ করে পুনরায় শুয়ে পড়েছে। সাথে নিয়ে এসেছে ছোট্ট ফলকাটার ছুরি।

ভিড়িয়ে দেওয়া দরজার দিকে চেয়ে আছে। একা রুমে থাকতে বড্ড ভয় হয় তিহির। আগে দরজা লাগিয়ে ঘুমালেও লাইট অন থাকতো। কিন্তু এখন লাইট অন থাকলে চোখের পাতা এক করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে তার জন্য। তাজের সাথে জিদের খেলায় মেতে থাকায় ফুপিকেও সাথে নেয়না। তবু দরজা খোলা রেখেই ঘুমায় যাতে কোনো বিপদে আপদে কাউকে ডেকে নিতে পারে। ডেলিভারীর সময়টাও ঘনিয়ে আসছে। অনেকের তো আটমাসেও প্রসববেদনা শুরু হয়ে যায়।

দরজা খোলা থাকা অবস্থায় আরেকটা কান্ড ঘটে যাচ্ছিলো। ব্যাপারটা তিহি আগে টের না পেলেও সপ্তাহ দুয়েক হবে টের পেয়েছে। মাঝরাত হলেই তার পেটে চুমু খেতে আসে তাজ। তিহি ইচ্ছে করেই বাধা দেয়না,বুঝতে দেয়না সে জেগে আছে। থাকুকনা বাবা-মেয়ের মধ্যে একটু লুকোনো বন্ধন। লোকটা সামনাসামনি যা কিছুই বলুকনা কেন,তিহির পেটের অস্তিত্তটাকে যে খুব করে ভালোবাসতে চায় সেটা তিহি এতোদিনে বুঝে গিয়েছে। আজ রাতেও আসবে। কিন্তু আজ সে চুমু খেতে দিবেনা। এতোদিন পরে একটু সামনাসামনি এলো তাও আমার সাথে ঝগড়া?? আসুননা আজকে, আমার পেটে হাত দিয়েছেনতো,এই ছুরি দিয়ে আপনার হাত,সাথে আপনার পেটটাও ফুটো করে দিবো। আমার সাথে ঝগড়া করবেন আবার আমার পেটে চুমু খাবেন? আজ আপনার চুমু খাওয়া আমি বের করে ছাড়বো।

তিহি ছুরিটা যত্নসহকারে নিজের বালিশের কাছে রেখে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে সাথে ঠোঁটে ফুটে আছে হাঁসির ছোট রেখা।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here