#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (১৭)
#রোকসানা-রাহমান
তিহির চোখে চোখ পড়তেই ইশাদ চোখ সরিয়ে নিয়েছে। ওর কাছে এগিয়ে আসলে তিহি কন্ঠ টেনে বললো,,
“” মিঃইশ!””
“” ডঃইশাদ!””
ইশাদের দ্রুততর উত্তরে তিহির দৃষ্টি সরে গিয়েছে। কিছু বলার ভাষা পাচ্ছেনা। ইশাদ এতক্ষন চোখ নামিয়ে রাখলেও আর পারলোনা। তিহির পেটে হাত রেখেই শক্ত চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে তিহির দিকে। মনে হচ্ছে রাগে ফেটে যাচ্ছে। নার্সকে উদ্দশ্য করে কঠিন সুরে বললো,,
“” এটা লেবার পেইন নয়,এ্যাপেনডিসাইটের পেইন! ইমিডিয়েটলি OT তে নেওয়ার ব্যবস্থা করো,হারিআপ!””
~~
জমিল সাহেব ডানকাত হয়ে শুয়ে আছেন। রুমের ড্রিম লাইটের নীল আলোতে জায়নামাজে মোনাজাতরত মরিয়ম বেগমের দিকে চেয়ে আছেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার ব্যাপারে খুবই ধৈর্য্যশীল,এটা যেমন জানে ঠিক তেমনটাও জানেন তাহাজ্জুত নামাজ পড়ার ব্যাপারে কতটা ভিতু। আজ এতো বছর সংসারে নিজের স্ত্রীকে কখনো তাহাজ্জুত পড়তে দেখেননি,কিন্তু লাস্ট ছ’মাস যাবত মাঝরাতে স্ত্রীর কান্নার ফুপানিতে ঘুৃম ভেঙে যাচ্ছে তারঁ। এ ব্যাপারটা নিয়ে এখন পর্যন্ত মুখোমুখি হননি,জানতে চাননি কেন সে এমন নামাজে বসে কেঁদেকেটে রাত পার করছে??? না জানতে চাওয়ারও আরো অনেকগুলো কারন রয়েছে। বিদেশ থেকে আসার পর মরিয়ম বেগমের অনেক পরিবর্তন লক্ষ করছেন।
বিদেশফেরত স্বামীর প্রতি যে ভালোবাসা দেখিয়েছিলো এতোটা বছর,এখন আর সেটা নেই। ছেলেদের প্রতিও কেমন উদাসীন,কথাবার্তার চরন কমে এসেছে,সারাদিন ঘরবন্দী করে রাখছে নিজেকে। বিছানায় শুয়ে থেকে থেকে সারাদিন রাত কিছু একটা ভেবে ভেবে কাহিল হয়ে যাচ্ছে। নিজ থেকে কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা। জমিল সাহেব যে কিছু জিজ্ঞেস করবেন সে সুযোগটাও নেই। কিছু বলার আগেই বিরক্তের নিশ্বাস ছাড়ে।
মরিয়ম বেগম জায়নামাজ ভাজ করে দরজা খুলে বেড়িয়ে গেলেন। কোথায় গেলেন তা অজানা নয় জমিল সাহেবের। নামাজ শেষে ছেলেদের রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকবে বেশ কিছুক্ষন,তারপর রুমে না ঢুকে ফেরত চলে আসবেন। এই একটা জিনিস নিয়ে বেশ চিন্তিত জমিল সাহেব। যদি সে রুমে প্রবেশ নাই করবে তাহলে যায় কেন??
প্রতিরাতের মতো আজকেও ফেরত এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিয়েছেন। জমিল সাহেব জড়ানো কন্ঠে বললেন,,
“” তোমার কি হয়েছে আমি জানিনা,ইশাদের কি হয়েছে তাও আমি জানিনা। অথচ স্বামী হিসেবে স্ত্রীর এবং বাবা হিসেবে সন্তানের সব লুকানো কথাও আমার জানার কথা। জোর করছিনা তোমাদের কারোর উপর,শুধু এইটুকুই বলবো,যদি তোমাদের দুজনের লুকোনো কথা একি সুতার শক্ত বাধন হয়ে থাকে তাহলে আমি চুপ করে থাকবোনা। তুমি স্বার্থপরের মতো সবসময় আমাকে আমার সন্তানদের থেকে দুরে সরিয়ে রেখেছো,আমি কিছু বলিনি,বুঝেও না বুঝার মতো পড়ে রয়েছি,কিন্তু সেই তুমিই যদি আমার ছেলের জীবনটাকে থমকে দেওয়ার কারন হয়ে থাকো,তাহলে এতোবছরেও তুমি আমার যে রুপটা দেখোনি,সেটা দেখতে পাবে,এই শেষ বয়সে!””
মরিয়ম বেগম জমিল সাহেবের দিকে তাকালেন,কিন্তু কিছু বললেননা। চুপচাপ পাশ ফিরে শুয়ে রইলেন। এতে জমিল সাহেবের কপালের চিকন বেগুমি রঙের রগটা ভেসে উঠেছে,,,
“” তুমি যদি ভেবে থাকো,তোমার উপর কোনোদিন রাগ দেখাইনি বলে,এখনো দেখাতে পারবোনা। তাহলে সেটা ভুল! আমি চাইনি তুমি কখনো কষ্ট পাও তাই….””
মরিয়ম বেগম জমিল সাহেবের চোখে চোখ রেখে বললেন,,
“” তাই?””
জমিল সাহেব শুকনো ঢোক গিলে বললেন,,,
“” তাই রাগ দেখায়নি।””
“” তাহলে এখন দেখাও। দেখি তোমার কত রাগ!””
“” আমার এখন ঘুম পাচ্ছে!””
জমিল সাহেব উল্টো হয়ে শুয়ে মনে মনে দোয়া পড়ে বুকে ফু দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলেন। জীবনটাতো আমার শেষ হলো তোমাকে ভয় পেতে পেতে!!
~~
তিহির কন্ডিশন খুবই ক্রিটিকাল,এমতাবস্থায় ইমিডিয়েটলি অ্যাপেনডিসাইটের অপারেশন অত্যাবশ্যকীয়,তারমধ্যে তিহির ডেলিভারীর সময়ও প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। তাই,গাইনি সার্জন ডঃহুমাইরার সহযোগিতায় অ্যাপেনডিসাইটিস ও সিজার দুটো একসাথে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো ইশাদ। প্রাণ আর প্রাণকেন্দ্র দুজনেই সুস্থ!
সদ্যজন্ম নেওয়া শিশুটিকে নিজের দুহাতে আলতো করে ধরে আছে ইশাদ। চোখের কোনে খুশির পানি চিকচিক করছে। হাতদুটো কাঁপছে,সাথে চোখের পাতাগুলো,পলক পড়বে পড়বে ভাব,কিন্তু পড়ছেনা। ঠোঁটের কোনে হাসি নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,প্রাপ্তিমা,হয়তো তুই আমার মেয়ে নস,তবুও তুই আমার। কারণ,এতোদিন তুই যার গর্ভে থেকে নির্ভয়ে শ্বাস টেনে ঘুমিয়ে ছিলি,তার প্রত্যেকটা শ্বাসে আমি রয়েছি। শুধু আমি।
ইশাদ শিশুটিকে আরেকটু আগলে ধরে ঘুমিয়ে থাকা তিহির কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,,
“”নিয়তির কি খেলা দেখো তিহি,দুজন দুজনের নই,কিন্তু তবুও দুজন দুজনার চাওয়াপাওয়া পুরনে ব্যস্ত। তোমার আর আমার গল্প হয়তো ফুরিয়ে এসেছে,কিন্তু আমাদের ভালোবাসার নয়। ভালোবাসার গল্পে শরীরের কোনো প্রয়োজন নেই,রয়েছে শুধু দুটো মনের মিলন,সেই মিলনতো অনেক আগেই হয়ে গেছে।দুটো শরীর এক হয়নি তো কি হয়েছে? দুটো মন আর আত্মাতো এক হয়ে মিশে আছে তাতেই হবে। চলতে থাকুক আমাদের ভালোবাসার গল্পের ধারা,অনন্তকাল,অনন্তসময়ের জন্য!
তোমার থেকে আমি বেশি লাকি তিহিপাখি,তোমাদের প্রথম সন্তান কিন্তু সর্বপ্রথম আমি দেখেছি,তার কানে কানে বলেও দিয়েছি,তোমাদের নিশ্বাসে এমন একজন বেঁচে আছে,যে তোমাদের অগোচরে তোমাদের নামেই বেঁচে থাকার তাগিদে নিশ্বাস নিয়ে যাচ্ছে!
ইশাদ তিহির কপালে ছোট্ট চুমু খেয়ে কাঁপাকাঁপা কন্ঠে বললো,,
***আমার সমাপ্তি টেনে,তোমার প্রাপ্তির আগমন,,,,
আচড়ে পড়ুক তোমাদের মাঝে,ভালোবাসার বর্ষন***
~~
পেটের মধ্যে কিছুটা ব্যথা অনুভব হওয়াতেই শেষ রাতের দিকে ঘুম ভেঙে যায় তিহির। ইউনিভার্টিতে যায়নি। চুপ করে বিছানায় শুয়ে ছিলো। ভেবেছিলো হয়তো কিছুক্ষন পরেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যত সময় যাচ্ছিলো ব্যথার প্রকট ততই বেড়ে যাচ্ছিলো। ব্যথার যন্ত্রনা এতোটাই তীব্র হতে তীব্রতর হচ্ছিলো যে তিহি সহ্য ক্ষমতা হারিয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়ে।
“” হ্যালো,কি হলো কথা বলছোনা কেন? তিহি,এই তিহিপাখি। কিছু তো বলো,আমার টেনশনে গা গুলোচ্ছে,আমি মনে হয় এক্সামে বসতে পারবোনা। চলে আসি?””
“” উহু!””
“” তাহলে চুপ করে আছো কেন? কিছু তো বলো!””
“” কি বলবো?””
“” কখন থেকে ব্যথা হচ্ছিলো,খুব কষ্ট হয়েছে তাইনা গো? আমি যে সকালে কল দিলাম তখন আমাকে বলোনি কেন??অ্যাপেনডিসাইটিস এর ব্যথা কতটা কষ্টের আমি তো জানি। “”
“” আমি বুঝতে পারিনি!””
“” ডক্টর কি বলেছে?””
“” কিছুনা!””
“” তিহিপাখি,বলোনা। তোমার এমন সময়ে আমি সামনে নেই,আমি কি অবস্থাতে যাচ্ছি,তুমি বুঝতে পারছো??””
“” আমি অপারেশন করাবোনা,ইশ! আমার ভয় লাগে।””
“” এমন ছেলেমানুষি করলে কি করে হবে?? আমি সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তুমি প্লিজ রাজি হয়ে যাও। আমার আসতে এখনো দু সপ্তাহের মতো লাগবে।””
“” আমি তোমার কাছে করবো!””
“” আমার কাছে কিভাবে সম্ভব?? আমার তো এখনো পোস্ট গ্রাডুয়েশনই কমপ্লিট হয়নি। আচ্ছা তাহলে আমি এসে….
“” করবো!””
“” কি?””
“” অপারেশন,এখনি করবো,তোমার আসতে হবেনা।””
“” রাগ করছো?””
“” না।””
“”তিহিপাখি!””
“” বলছিতো করবো।””
“” আমি চলে আসি। আমার সবকিছুর থেকে তুমি বেশি ইম্পর্ট্যান্ট!””
“” না,আসবেনা। তুমি আসলে আমি অপারেশন করাবোনা। তুমি জোর করলেও করাবোনা।””
“” আমার কষ্ট হচ্ছে। এভাবে বলছো কেন?””
“” সরি!””
“” চলে আসি!””
“” আমার কসম খেয়ে বলছি,যদি আমি না বলার আগে তুমি এসেছো তো, তোমার সাথে আমি কোনোদিনও কথা বলবোনা।””
দরজায় কারো নক পেয়ে ইশাদ কপালের উপর থেকে হাতটা সরিয়ে নিয়েছে। চোখদুটো কচলিয়ে নিয়ে স্বাভাবিক সুরে বললো,,
“” কি হয়েছে?””
“” ১১৮ নাম্বার কেবিনের রোগীর জ্ঞান ফিরেছে। আপনি জানাতে বলেছিলেন।””
“” হুম,যাও আসছি!””
ইশাদ সামনের দেয়ালের দিকে থাকা ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে ৭ টা বেজে ৫।
~~
ফরিদা বেগম রেডি হয়ে বের হওয়ার সময় চিৎকার করে বললেন,,
“” মিহি দরজাটা লাগিয়ে নে। আমি গেলাম। সাবধানে থাকিস!””
মিহি ঘুমঘুম কন্ঠে কাথাটা দিয়ে মুখ ঢেকে বললো,,
“” যাচ্ছি!””
চোখ বন্ধ করেই বালিশের নিচ থেকে ফোনটা বের করেছে মিহি। কালকেই নিশির কাছ থেকে একটা সিম নিয়ে এসেছে সে। মাথায় দুষ্টুবুদ্ধীরা খেলা করছে। ইরফাদের সাথে বেশ কিছুদিন হলো ঠিক মতো দেখা হয়না। তাতে ইরফাদের কিছু যায় না আসলেও মিহির মনের কোনে জমে থাকা ভালোবাসারা গুরুতর আহত হচ্ছে। বারবার তাকে দেখতে মনে চাচ্ছে,কথা বলতে মনে চাচ্ছে,কিন্তু তা আর হয়ে উঠছেনা। মিহি মনে মনে হাজারবার দোয়া করে যেন তাদের ইংলিশ টিচারটা অসুস্থ হয়ে যাক,আর তার বদলে তার ভালোবাসার মানুষটা এসে ক্লাস নিক। তাহলেইতো সে হা’করে তাকিয়ে থাকতে পারবে। এই হা’করে তাকিয়ে থাকার জন্য সে হাজারবার কান ধরে দাড়িয়ে থাকতে পারবে,শুধু এক পায়ে কেন,দরকার হলে দুপা উঠিয়ে কানে ধরে থাকবে। তবুও তার মানুষটির দিকে হা’করে তাকিয়ে থাকা চায়।
তিহি ভয়ভয় সাহস নিয়ে ইরফাদের নাম্বারে ডায়াল করে। রিং হওয়ার আগেই কেটে দিলো। মুখ থেকে কাথা সরিয়ে সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে নিজেই নিজেকে সাহস দিয়ে বলছে,মিহি,আজ তুই সব বলবি,তোর মনের রাজত্বে জমে থাকা সবটুকু ভালেবাসার রস কথাতে ঢেলে দিবি যাতে সে তোর ভালোবাসার মাতাল হয়ে বলে,মিহি আরেকটু ভালোবাসা হবে??? তখন তুই ভাব দেখিয়ে বলবি,এমনি এমনি ভালোবাসা কেন দিবো?? আগে একটু নাচ করে দেখানতো!
নিজের কথাতে মিহি নিজেই হেঁসে উঠেছে। হাঁসি শেষে বুকভর্তি সাহস নিয়ে পুনরায় ইরফাদের নাম্বারে ডায়াল করলো। দম আটকে রেখেছে সে। একবার রিং হতেই অপরপাশ থেকে ইরফাদ বললো,,
“” আসসালামু আলাইকুম,””
মিহি সালামের উত্তর দেওয়ারও সময়টুকু পেলোনা। এক লম্বা নিশ্বাস টেনে নিয়ে বললো,,
“” ভালোবাসি!””
“” What! Who are you?””
ইরফাদের ধমক খেয়ে মিহি শোয়া থেকে উঠে বসে পড়েছে। এতক্ষন ইচ্ছে করে দম আটকে রাখলেও এবার সত্যি সত্যি দম নিতে ভুলে গেছে। তোতলাতে তোতলাতে বললো,,
“” আমমমি ররংং নাম্বার!””
ইরফাদ যে ভিষন ক্ষেপে গিয়ে এখনি ধমকে উঠতে চলেছে বুঝতে পেরেই মিহি সাথে সাথে ফোন কেটে দিলো। কাথা দিয়ে নিজেকে জড়িয়ে নিয়ে বিড়বিড় করছে,স্যার হওয়ার পর থেকে শুধু আমাকে ধমকিয়েই যাচ্ছে,ধুর! কেন যে উনি স্যার হতে গেলেন!
মিহি বেশ কিছু ক্ষন চুপচাপ শুয়ে থেকে ফোনটা আবার হাতে নিলো,তবে এবার ডায়ালপ্যাডে নয় মেসেজের অপশনে গিয়ে লিখলো,,,
**ami aj k apna k niye shopno dekhechi,,,ki shopno janen?? Shopner moddhe ami akta lal shari joriye achi,bichanai bose kadchilam,r tokhoni apni amar samne alen,golden colorer panjabi pore! Amar chokher pani muche diye bollen,,chotobou,ami tomar chokher pani hote chay,jate tmi chaileo amake chokh beye porte na daw!**
মিহির মেসেজ সেন্ড হওয়ার সাথে সাথে রিপলাই এলো,,
**tor lal sharite jodi golden colourer agun jalate na chas tahle amake further call dibini r msg o dibina….nahole lal r golden a mile tui chay hoye jabi!!**
মিহি মেসেজ পড়ে ওহ,মাগো! শব্দে চিল্লিয়ে উঠলো। তখনি মনে পড়লো আম্মু দরজা লাগাতে বলেছিলো। মিহি দৌড়ে দরজা লাগিয়ে নিলো। এমন একটা ভাব যেন এখনি ইরফাদ গোল্ডেন কালারের আগুন হাতে নিয়ে ঢুকে পড়ছে তার লাল শাড়ীতে আগুন লাগিয়ে দিতে!!
~~
ইশাদ তিহির কেবিনের দরজার কাছে দাড়াতেই ভেতরে শিরিন বেগমকে দেখতে পেলো। তিহির সাথে হাঁসি হাঁসি মুখে কথা বলে যাচ্ছে। ইশাদ কিছুক্ষন অপেক্ষা করে ভেতরে পা ফেলে বললো,,
“” আপনি কি একটু বাহিরে যাবেন? পেশেন্টের সাথে জরুরী কথা আছে,আর কিছু চেকআপেরও প্রয়োজন ছিলো।””
শিরিন বেগম ভদ্রতাসুচক হ্যাবোধক হাঁসি দিয়ে বেড়িয়ে গেলেন। ইশাদ তিহির সামনে এসে দাড়িয়ে আছে। কিন্তু কিছু বলছেনা। তিহি নিচের দিকে চেয়ে আছে,বারবার আড়চোখে ইশাদের দিকে তাকাতে চাইলেও পারছেনা। পারবে কি করে?? ঐ অগ্নিদৃষ্টির দিকে তাকানোর তার সাহস থাকলে তো তাকাবে।
ইশাদ কথার ঘুরপাক না করে সরাসরি বললো,,
“” তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছিলে কেন? কেন বলেছিলে তুমি অপারেশন করিয়েছিলে?””
তিহি যে ভয়টা পাচ্ছিলো তাই যেন তিহিকে গলা চেপে ধরেছে। ইশাদের কথার উত্তরে কি বলবে বুঝতে পারছেনা। সাথে অভিমানটাও উকি দিচ্ছে। এতোটা মাস পর দেখা,একটু কি আদরমেখে কথা বলা যায় না?? দুরে ঠেলে দিয়েছে বলে কি আদরমাখা সুরটাও মিলিয়ে গিয়েছে???
ইশাদ গলার কন্ঠ আরো শক্ত করে বললো,,
“” চুপ করে আছো কেন? আমি একটা প্রশ্ন করেছি তিহি। তুমি কেন মিথ্যে বলেছিলে? এতোবড় একটা মিথ্যে কি করে বলতে পারলে? তোমার কি একটাবারও বুক কেঁপে উঠেনি?? আজ যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো??””
তিহি আর চুপ করে থাকতে পারছেনা। কিভাবে থাকবে? যার কন্ঠ শোনার জন্য সে প্রতি রাতে ছটফট করে বালিশ ভিজিয়েছে,একটু মন খুলে কথা বলার জন্য মনের দরজায় কখনো খিল দেয়নি আজ সেই মানুষটা নিজ থেকে তার কথা শুনতে চাইছে। ধমকে হোক আর রাগে হোক,কন্ঠটাতো তার পছন্দের!
“” আমি তোমার হাতে করাতে চেয়েছিলাম!””
ইশাদের রাগ যেন উর্ধ্বগতিতে উপরে উঠে মাথার তালুতে গিয়ে ঠেকেছে,থামানোর কোনো ইচ্ছেও নেই।
“” ইচ্ছে করছে ঠাটিয়ে দুটো চড় বসিয়ে দিতে। আমার হাতে করাবে বলে এতো বড় লাইফ রিস্ক তাও আমার অজান্তে? তোমার এই পাগলামিগুলো জাস্ট স্পিসলেস। একটাবার কি ভেবেছিলে,তোমার কিছু হলে আমার কি হতো?””
তিহি তাচ্ছিল্যমেখে বললো,,
“” কি আর হতো? এখন জীবন্ত তিহিহীন দিন পার করছো,তখন মৃত তিহিহীন দিন পার করতে। আমি বেঁচেই থাকি আর মরেই থাকি তাতে তোমার কি? তোমার লাইফ থেকে তো আমাকে মুছেই দিয়েছো,ইশ!””
ইশাদের রাগের সাথে যে একটা চাপাঅভিমানও কাজ করছিলো তা নিমেষেই মুছে যাচ্ছে। আসলেই কি সে তার হৃদয় থেকে তিহিকে মুছে ফেলেছে? তাহলে এখনো কেন এতো লোভ জাগছে? এই যে তিহিকে পাওয়ার লোভ,ইচ্ছে করছে ওকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে,শক্ত করে চেপে ধরে বলতে,তুমি আমার এই বুকটার ভেতরে লুকিয়ে পড়বে তিহি? যাতে অন্যকেউ তার বুকে তোমাকে আলিঙ্গন করতে না পারে!
একটু আগেও যে রাগ নিয়ে সে তিহির কাছে এসেছিলো তা ধুলিসাৎ। শরীরজুরে কম্পন হচ্ছে তার,তিহিকে পাওয়ার কম্পন! তিহির সামনে দাড়িয়ে থাকা মানে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলা। আর একদন্ডও দাড়াবেনা সে,নাহলে যে সে ভুল করে বসবে,আবেগি ভুল!
ইশাদ নিশব্দে চলে যাওয়ার জন্য পা ফেলতেই তিহি বললো,,
“” মিথ্যেতো তুমিও আমায় বলেছো ইশাদ!সম্পর্কের শুরুটাই করেছিলে মিথ্যে দিয়ে।””
ইশাদ থমকে গিয়ে তিহির দিকে তাকালো। তিহি আবার বললো,,
“” ইনা তোমার ভাইয়ের মেয়ে নয়,অন্যকারো মেয়ে!””
ইশাদ ভয়মিশ্রিত অবাক নিয়ে তিহির দিকে এগিয়ে এলো।
“” কে বলেছে তোমায়?””
“”যেই বলুক না কেন,তুমি কি আমাকে ভুল প্রমানিত করতে পারবে? কেন এমন করলে,একজন বাবার বুক থেকে তার সন্তানকে কেড়ে নিতে তোমার বুক কাঁপেনি??””
তিহির কথায় ইশাদ চিৎকার করে বললো,,
“” না,কাঁপেনি। কেন কাঁপবে? আমি কি অন্যায় করেছি?? তোমার কি মনে হয়,আমি জেনেবুঝে একটা মাতালের হাতে ইনাকে তুলে দিবো?? ওর পরিচয় কি হতো? ভবিষ্যৎ কি হতো?? বড় হয়ে যখন জানতে পারতো সে সমন এক বাবার মায়ের মেয়ে,যাদের কখনো বিয়ে হয়নি,অবৈধ সম্পর্কের অবৈধ সন্তান। তোমার কি মনে হয়,এসব জানার পরও ও স্বাভাবিকভাবে চলতে পারতো? আর এখানে আমি তোমাকে মিথ্যে বলিনি,ইনার মা যেহেতু আমার ভাইয়ের বিয়ে করা স্ত্রী,তাহলে বৈধতা আর আইনগতভাবে ইনার বাবা আমার ভাই হবে।””
“” এমনও তো হতে পারতো উনি ইনাকে পাওয়ার পর সব ভুলে যেতেন। নতুন করে সংসা….””
“” না,হতোনা। আমি উনাকে সময় দিয়েছিলাম,যথেষ্ট সময়। আমি বলেছিলাম জাস্ট ছয়টা মাস নেশা থেকে দুরে থাকতে। অন্য সবার মতো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে। যদি পারে তাহলে উনার সন্তানকে উনার কাছে দিয়ে দিবো। কিন্তু! উনি ছয় মাস তো দুরে থাক,একটা মাসও মদ থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারেনি। তাহলে তুমিই বলো এই বদ্ধমাতালের কাছে আমি আমার ইনাকে কোন ভরসায় দিবো? কোন ভরসায় একটা অন্ধকার ভবিষ্যতের হাতে তুলে দিবো??””
“” যে ভরসায় আমাকে দিয়েছো!””
“” তোমাকে!””
“”আমি কি দোষ করলছিলাম,ইশাদ? তোমাদের মাঝে আমাকে কেন টেনে আনলে? তোমাকে ভালোবাসেছিলাম বলে এতো বড় শাস্তি দিলে?””
“” তিহি,আমি কিছু বুঝতে পারছিনা!””
তিহি বিদ্রুপ হাঁসি নিয়ে বললো,,
“” আমাকে কোন পাত্রে দান করছো,সেটা একবার দেখারও প্রয়োজনবোধ করলেনা?? আমি কি এতোটাই তুচ্ছ ছিলাম? কেন এমনটা করলে ইশাদ? কোন অপরাধের শাস্তি দিলে?? তোমার দেওয়া শাস্তি আমি আর বইতে পারছিনা। ক্লান্ত হয়ে পড়ছি।””
“” ভালোবাসার পরীক্ষা দিতে ভালোবাসার বিসর্জন দিয়েছি!””
“” মানে?””
“” সবমানের উত্তর দিতে হয়না। ধরে নাও,ভালোবাসার সম্মানে ভালেবাসার প্রশ্ন থেকে দুরে সরে গিয়েছি!””
ইশাদ তিহির কাছ থেকে সরে দরজার দিকে এগুতেই তিহি পেছন থেকে বললো,,
“” তুমি এখনো যেহেতু আমার স্বামীর মুখদর্শন করোনি,তারমানে সে হসপিটালে প্রবেশ করেনি,করবে কিভাবে? সেন্সে থাকলে তো করবে। দেখো গিয়ে নিশ্চয় গাড়ীতে মাতাল হয়ে পড়ে আছে!””
ইশাদ দ্রুতকদমে বেড়িয়ে গেলো। তার মাথা ঝিম ধরে আসছে। মনের ভেতর চলছে হাজারও আকুতির মিনতি। যা ভাবছে তা যেন না হয়। কিছুতেই না। প্রার্থনা সহিত হেঁটে যাচ্ছে। হেঁটে যাচ্ছে বললে ভুল হবে,দৌড়ে বেড়িয়ে যাচ্ছে হসপিটাল থেকে। ভয়,আসঙ্কা একসাথে মিশে যাচ্ছে। ৫ মিনিটের পথটাকেও যেন ইশাদ পাঁচ ঘন্টা ধরে পার করছে।
গাড়ীটা চোখের সামনে পড়তেই ইশাদের হৃদ কম্পন বেড়ে যাচ্ছে,উচ্চশব্দে বেজে উঠছে প্রত্যেকটা কম্পন। ধীর পায়ে এগিয়ে এসেছে গাড়ীরটার দিকে। সামনের ড্রাইভিং সিটেই হেলে পড়ে আছে লোকটি। মাথাটা উল্টোদিকে ঘুরে আছে। ইশাদ কাঁপা কাঁপা হাতে মাথাটা ঘুরিয়ে নিতেই ছিটকে পেছনে সরে গেলো। চোখদুটো বড় হয়ে আসছে অবিশ্বাস্য চাহনিতে। বারবার শুধু একটা কথায় বিড়বিড় করছে,এটা হতে পারেনা,কিছুতেই না।
~~
ইশাদ ব্যস্ত রাস্তাতেও ফুল স্পিডে ড্রাইভিং করছে। চোখ,মুখে এখনো সেই অবিস্বাস্যের চাপ। নিজের বাসার সামনে এসে কোনোরকম ব্রেক কষেই গাড়ী থেকে নেমে পড়েছে সে। রাগ,ক্ষোভ,অবিস্বাস,জেদ,অভিমান সবকিছু একসাথে নিয়ে মরিয়ম বেগমের রুমের দিকে ছুটছে। ভিড়ানো দরজাটা শব্দ করে খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ঘুমন্ত মায়ের পা চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইশাদ। পায়ের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বললো,,
“” আম্মু,তুমি এটা কি করলে? কিভাবে পারলে এতোটা পাষান হতে?””
চলবে