#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি,পর্ব (১৮)
#রোকসানা-রাহমান
ইশাদ ব্যস্ত রাস্তাতেও ফুল স্পিডে ড্রাইভিং করছে। চোখে,মুখে এখনো সেই অবিস্বাস্যের চাপ। নিজের বাসার সামনে এসে কোনোরকম ব্রেক কষেই গাড়ী থেকে নেমে পড়েছে সে। রাগ,ক্ষোভ,অবিস্বাস,জেদ,অভিমান সবকিছু একসাথে নিয়ে মরিয়ম বেগমের রুমের দিকে ছুটছে। ভিড়ানো দরজাটা শব্দ করে খুলে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ঘুমন্ত মায়ের পা চেপে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে ইশাদ। পায়ের মধ্যে মাথা ঠেকিয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বললো,,
“” আম্মু,তুমি এটা কি করলে? কিভাবে পারলে এতোটা পাষান হতে?””
ফজরের নামাজ শেষে বাহিরের প্রকৃতির শোভা দর্শন করা জমিল সাহেবের একটা অভ্যাসে পরিনত হয়েছে। রোজ নামাজ শেষে ধীরে ধীরে পা ফেলে,সচ্ছ রোদের আলো গায়ে মাখবেন,সাথে বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে পাখপাখালির কলরব ও ব্যস্ত মানুষের পথচলা দেখবেন। অন্যদিনের মতো আজও তিনি মত্ত ছিলেন প্রকৃতির ভিন্নরুপী রুপে। নিজের মন-প্রাণ উজার করে প্রকৃতি দর্শন শেষে বাড়ির পথে পা বাড়িয়েছিলেন। রুমে প্রবেশ করে ইশাদকে দেখে কিছুটা চমকালেন। চমকপদে ভেতরে ঢুকে আরো বেশি চমকে গেলেন। ইশাদের কাধে হাত রেখে বললো,,
“” ইশাদ,তুই তোর আম্মুর পা ধরে আছিস কেন?””
ইশাদ জমিল সাহেবের হাতের উপর নিজ হাতটা রেখে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে বললো,,,
“” বাবা,আমার তিহি ভালো নেই, আমার তিহি…””
ইশাদ আর কিছু বলতে পারছেনা। জ্বালা করছে তার,বুকের ভেতরে,গলার ভেতর,চোখের ভেতর। এতো জ্বলা নিয়ে সে কাঁদবে কিভাবে??
জমিল সাহেব ছেলেকে বসা থেকে তুলে নিয়ে নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। ঘুমিয়ে নেই সে,জেগে আছে। জেগে থেকেও কেন উঠছেনা?? কেন এভাবে পাষন্ডের মতো শুয়ে আছে? ছেলের কান্না কি সে শুনতে পারছেনা?? জমিল সাহেব বেশ কড়া গলায় বললেন,,
“” ইশাদ কাঁদছে আর তুমি শুয়ে আছো? ছেলের কষ্টে তোমার কষ্ট হচ্ছেনা? কি হয়েছে কি তোমার? আসছি পর থেকে তোমার অদ্ভুত ব্যবহারে আমি তিক্ত হয়ে যাচ্ছি। তুমি তো এমন ছিলেনা মরিয়ম!””
ইশাদ জমিল সাহেবের হাত থেকে সরে এসে বললো,,
“” আব্বু,তুৃমি একটু বাহিরে যাবে? আম্মুর সাথে আমার কথা আছে।””
জমিল সাহেব ব্রু কুচকে নিয়ে বিরক্তকন্ঠে বললেন,,
“” কি এমন কথা যেখানে আমিও থাকতে পারবোনা। যা বলার আমার সামনেই বলবি। আমিও জানতে চাই তোদের মা-বেটার মধ্যে চলছেটা কি!””
ইশাদ তর্কে না গিয়ে হাত জোর করে বললো,,
“” আব্বু,প্লিজ!””
জমিল সাহেব ছেলের মুখের দিকে তাকাতে পারছেননা। চোখের পানিতে পুরোমুখটা ভিজে যাচ্ছে। কতটা কষ্ট পেলে তার ছেলে এতোটা ভেঙে পড়তে পারেন সেটাও যেন আন্দাজ করতে পারছেননা। তার পক্ষে হয়তো কষ্টের পরিমাপটা বের করা সহজ নয়,খুব কঠিন,কঠিন সুত্র দিয়ে কি এ কষ্টের পরিমাপ বের করা সম্ভব???
জমিল সাহেব রুম থেকে বের হয়ে গেলেন। ইশাদ দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে মিসেস মরিয়মের দিকে অগ্রসর হচ্ছে,
~~
প্রায় ১০ মাস আগে,
আজ পনেরো দিন হলো তিহিকে দেখতে পায়নি ইশাদ। এমতাবস্থায় পড়ালেখায় কি মন বসে?? তার মধ্যে ঠিক মতো ফোনে কথাও বলছেনা তিহি,ভিডিও কলের নাম নেওয়ার আগেই মুখভর্তি না। মাঝে মাঝে মেয়েটা এতো বেশি জেদ করে বসে যে ইশাদ সামলে উঠতে পারেনা। আবার কিছু বলতেও পারেনা। রাগ দেখাবে তো দুর একটু কঠিন গলায় কথা বললেই মুখটাকে কালো আধারে ঢেকে ফেলবে। তখন ইশাদের ইচ্ছে হয় এই মেয়েটাকে বুকের খাচায় বন্দী করে নিতে। তারপর সে রাতদিন বন্দীপাখিটাকে অত্যাচার করবে, যাকে বলে রোমান্টিক অত্যাচার। ইশাদ ঠোঁটের কোনদুটো দীর্ঘকরে টেনে মিনমিন করে বললো,তিহিপাখি আমি আসছি,তোমার জেদ মেটাতে আসছি,এই কয়টাদিন আমাকে খুব জ্বালিয়েছো,পরীক্ষার হলের মধ্যেও জ্বালিয়েছো,কি লিখেছি আল্লাহ জানে,আমি তো প্রশ্ন দেখে লিখিনি,তোমাকে দেখে লিখেছি!
ইশাদ নিজের বাড়ীর দিকে না গিয়ে সোজা তিহিদের বাসায় গিয়ে হাজির। দরজায় নক করতেই মিহি এসে খুলে দিলো,হামি তুলতে তুলতে বললো,,
“” সুন্দর ভাইয়া,আপনি? এতো রাতে??””
“” হুম,তোমাদের জ্বালাতে চলে এলাম। আন্টি কই?””
“” আম্মুতো ঘুম,ডেকে দিবো?””
“” না। তুমি দরজা খুললে যে? তিহি কি ঘুমুচ্ছে?””
“” হুম,আমার তো টেস্ট এক্সাম চলছে,পড়ছিলাম। সবেই বই রেখে ঘুমুতে গেলাম আর আপনি দরজায় খটখট শুরু করে দিলেন।””
ইশাদ রুমের ভেতরে ঢুকে নিজেই দরজা লাগিয়ে বললো,,
“” মিহিরানি,আমাকে কি কিছু সময়ের জন্য তোমাদের রুমটা ধার দিবে?””
“” রুম ধার?””
“” হুম। তোমার আপুর সাথে গভীর কথা আছে। অনলি ১০ মিনিটস!””
মিহি পুনরায় লম্বা হামি টেনে বললো,,
“” তাহলে আমি আম্মুর সাথে গিয়ে শুয়ে পড়ছি। দশ মিনিটতো দুরে থাক আমার দ্বারা আর এক মিনিটও জেগে থাকা সম্ভব না। গুড নাইট,সুন্দর ভাইয়া।””
“” গুড নাইট!””
ইশাদ চুপিসারি তিহির রুমে ঢুকে ওর দিকে চেয়ে আছে। তার ঘুমন্তকন্যা,গভীর ঘুমে আছে। তিহির মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে,পাগলিটা কি বিয়ের পরেও এমন বাচ্চাদের মতো আঙুল মুখে দিয়ে ঘুমুবে?? কেন ঘুমুবেনা? অবশ্যই ঘুমুবে,নাহলে আমার চুষনিকন্যার প্রেমে পড়বো কিভাবে?? আমি তো তার আঙুল চুষারও প্রেমে পড়বো,বারবার শতবার,হাজারবার,লক্ষবার,কোটিবার,,সারারাত!
ইশাদ তিহির কাছটাতে বসেছে,বিছানায় নয়,মেঝে তে,ঠিক পেট বরাবর। ধীরেসুস্থে শরীরের কাথাটা সরিয়ে নিয়েছে। পেটের কাছের জামাটায় হাত লাগিয়ে সরাতেই তিহি চট করে উঠে বসে পড়লো। কাথাটা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিয়ে বললো,,
“” তুমি? তুমি কখন এলে?””
এমন গভীরঘুমেও তিহি জেগে যাবে ভাবতে পারেনি ইশাদ। অনেকটা বিচলিত হয়েই বললো,,
“” এই তো একটু আগে।””
তিহি কাথাটা আরেকটু ভালো করে জড়িয়ে নিয়ে কিছুটা ধমকের সুরে বললো,,
“” এসেই তুমি তোমার লুচুগিরি শুরু করে দিয়েছো? বলা নেই কওয়া নেই ডিরেক্ট জামাতে হাত,তাও পেটে?””
ইশাদ বেশ বিরক্ত নিয়েই তিহির পাশে বসলো।
“” এভাবে বলছো কেন? আমি তো জাস্ট,এটা দেখতে চাইলাম,তোমার পেটের কন্ডিশন কেমন? অপারেশনের সময় ছিলাম না বলেই তো..””
“” বলেই তো? সোজা আমার পেটের কাপড় সরিয়ে ফেলবে? তাও আমাকে জিজ্ঞেস না করে??””
“” তিহি ঠিক করে কথা বলো,বাজে শোনাচ্ছে!””
তিহি চুপ করে গেলে ইশাদ ওর হাত চেপে ধরে বললো,,
“” কেমন আছো তিহি?””
“” তুমি এতো রাতে এটা জানতে এসেছো?””
“” কি হয়েছে বলোতো,এমন করে কথা বলছো কেন?””
“” কিছুনা,আমি ঘুৃমাবো। তুৃমি এখন যাও,ইশাদ!””
ইশাদ তিহির কথার পিঠে কথা না বলে উঠে পড়লো। সোজা হাঁটা ধরে দরজার দিকে এগুচ্ছে। তিহি পেছন থেকে বললো,,
“” সত্যি চলে যাচ্ছো?””
ইশাদ চলতি পথেই ঠোঁট না নাড়িয়েই বললো,,
“” হুম!””
“” আমায় জড়িয়ে ধরবেনা?””
“” না।””
“” আমি কিন্তু কান্না করবো।””
“” করো।””
“” সত্যি করবো কিন্তু!””
ইশাদ ঘুরে দাড়িয়ে তিহির মুখটা দু হাতের তালুতে আগলে নিয়ে বললো,,
“” তুৃমি অনেক পঁচা হয়ে গেছো তিহিপাখি,আমাকে শুধু কষ্ট দাও।””
তিহি টুপ করে ইশাদের গালে চুমু খেয়ে বললো,,
“” তুমি এতোদিন আমার সাথে দেখা করতে আসোনিতো তাই অভিমান হয়েছিলো,আর এভাবে কথা বলবোনা। প্রমিস!””
“” ওকে অভিমানটা তুলে রাখলাম। কাল আম্মুকে নিয়ে আসছি তোমার বাসায়। কোনো আংটি বদল হবেনা। সোজা কবুল বলবে। আমার কালকে রাতেই তোমাকে চাই,আমার বুকের কাছটাতে। তারপর দেখবো তুমি কত অভিমান করতে পারো!””
ইশাদের কথায় তিহি লজ্জায় লাল। ইশাদের বুকের দিকে তাকিয়ে ভাবছে,তাহলে কি সত্যি সত্যি এবার এই বুকটায় আমি বন্দী হতে চলেছি??
~~
তিহিদের বাসা থেকে বের হয়ে নিজের বাসায় আসতে আসতে রাত তিনটে বেজে গেলো। সদর দরজা খুলে দিলো টুম্পা।
“” ঘুমুচ্ছিলি নাকি?””
“” হ স্যার। চোখডা লাইগ্গা আইছিলো তো তাই দরজা খুলতে দেরি অইছে।””
“” আম্মু কোথায়?””
“” মেডামতো আপনার লাইগ্গা অপেকখা করতে করতে ঘুমাইলো। এতো দেরি করলেন যে? জ্যামে আটকা পড়ছিলেন?””
ইশাদ টুম্পার কথার উত্তর না দিয়ে বললো,,
“” খুব ক্ষুধা লাগছে, খাবার রেডি কর,আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি!””
ইশাদ নিজের রুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে চেন্জ করে নিয়েছে। ডাইনিংয়ে বসতে বসতে বললো,,
“” আম্মু,তুমি? টুম্পা যে বললো ঘুমিয়ে পড়েছো?””
ইশাদের পাতে ভাত দিয়ে ভাজা মাছটা পাতে দিলেন। পানির গ্লাসে পানি ঢেলে দিতে দিতে পাশের চেয়ারটাতেই বসে পড়লেন।
ইশাদের দিকে বেশ কিছুক্ষন চেয়ে থেকে ধীর গলায় বললেন,,
“” ভালোবাসিস আমাকে?””
ইশাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,,
“” হঠাৎ এমন প্রশ্ন?””
“” বল না।””
ইশাদ মাংসের বাটিটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে মুখভর্তি হাঁসি নিয়ে বললো,,
“” ছেলে মাকে ভালোবাসবেনা এটা কোনো কথা? তাও তোমার মতো এতো আদরী মা??””
“” পেচাচ্ছিস কেন? সোজাসাপ্টা উত্তর দিতে পারিসনা? পুরো বাপের মতো হয়েছিস!””
ইশাদ মুখে খাবার পুরেই হেঁসে উঠে বললো,,,
“” পৃথিবীতে সবচেয়ে উচু আসনে যদি কাউকে বসাতে বলে তাহলে আমি তোমাকে বসাবো। আর ভালোবাসা? কাউকে কিভাবে ভালোবাসতে হয় সেটাতো আমি তোমার থেকেই শিখেছি আম্মু!””
“” তাহলে আমি কিছু চাইলে তুই দিবি?””
“” চেয়েই দেখো তুমি চাইলে এই মুরগির মতো আমি নিজেকে বলিও দিতে পারি। “”
“” তিহিকে ভুলে যা।””
ইশাদ মাংসে কামড় দিতে গিয়ে আটকে গেছে।মাংসে দাঁত বসিয়েই চোখদুটো বিস্ময় নিয়ে চেয়ে আছে মরিয়ম বেগমের দিকে। কয়েক সেকেন্ড পেরুতেই মাংসটা চিবুতে চিবুতে বললো,,,
“” খাওয়ার সময় মজা করো নাতো আম্মু!””
“” ইশাদ,আমি সিরিয়াস!””
ইশাদ খাবার রেখে দাড়িয়ে গেলো। চেয়ার টেনে চলে যেতে নিয়েও আবার ফিরে এসে মরিয়ম বেগমের মুখোমুখি হয়ে বসলো। হাতদুটো টেনে নিয়ে মিনতি সুরে বললো,,
“” কি হয়েছে আম্মু? তিহি কি কিছু ভুল করেছে? ও খুব ভালো মেয়ে,তুমিই তো আমাকে বলতে। আজ হঠাৎ এমন বলছো কেন? তুমি খুব ভালো করেই জানো আমরা দুজন দুজনকে কতটা ভালোবাসি। তুমি কি চাচ্ছো আমরা পাগল হয়ে যাই?””
মরিয়ম বেগম ছেলের থেকে হাত সরিয়ে বললেন,,
“” তুই কিন্তু বলেছিলি আমার চাওয়া রাখবি।””
ইশাদ চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে পরিষ্কার গলায় বললো,,
“” সম্ভব না।””
ইশাদ দ্রুত পা ফেলে চলে যেতে নিলে মরিয়ম বেগম বললেন,,,
“” তাহলে তিহির ভালোবাসার কাছে আমার চাওয়া অতি নগন্য?””
“” আম্মু,তুমি এসব কি ছেলেমানুষি কথা বলছো? ও ওর জায়গায় আর তুমি…””
মরিয়ম বেগমও চেয়ার ছেড়ে ছেলের কাছে এগিয়ে এসে বললেন,,,
“” যদি দুটোর একটা নিতে বলি?””
“” আম্মু!””
মরিয়ম বেগম বেশ দ্রুততার সহিত বললেন,,,
“” তুই টেনশন করিসনা,ওকে আমি অনেক ভালো ঘরে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিবো। ওর বিয়ের সব দায়িত্ব আমার। ও ওখানে খুব ভালো থাকবে। আমি নিজে দাড়িয়ে থেকে ওর বিয়ে দিবো,বাবা। তুই ওকে ভুলে যা!””
“” আম্মু,তুমি পাগল হয়ে গেছো। আমি তোমার সাথে কাল সকালে কথা বলবো।””
মরিয়ম বেগম রেগে যাচ্ছেন। চোখের কিনার লাল হয়ে আসছে,সাথে নাকের পাশটাও। কঠিন স্বরে বললেন,,
“” তিহিকে যেদিন তোর বউ হিসেবে স্বীকৃতি দিবি সেদিন তোর মায়ের লাশটাও কাঁধে নিবি!””
মরিয়ম বেগম ছেলের দিকে না তাকিয়েই নিজের রুমের দিকে ছুটলেন। ভেতরে প্রবেশ করে দরজা আটকে নিলেন। ইশাদের চিৎকার,আকুতি-মিনুতি তিনি শুনবেননা,মাখবেননা নিজের শরীরে!
~~
তিহি সকাল থেকে ইশাদের নাম্বারে কল দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছেনা। সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে লাগলো ইশাদের কোনো খবর নেই,অথচ ওর আম্মুকে নিয়ে সকালেই আসবে বলেছিলো। তাহলে কি কোনো বিপদ! বিপদ শব্দটা উচ্চারন করতেও তিহি ভয়ে সিউরে উঠছে,তার প্রিয় মানুষটার কোনো বিপদ কি সে সহ্য করতে পারবে? এতো সহ্য ক্ষমতা আছে?? কখনোই না,সে কিছুতেই সহ্য করতে পারবেনা। তিহি ভয়ের আসঙ্কা ভুলতে চেয়ে ইশাদের নাম্বারে আবার কল দিলো। কিন্তু এবার ফোন সুইচ অফ,তাহলে কি আমি যা ভাবছি তাই??
ইশাদদের আসার অপেক্ষায় তিহি নিজেকে সাজিয়েছিলো,খুব গাঢ় সাজ নাহলেও খুব একটা হালকাও নয়। সাদা আর আকাশী কালারের কম্বিনেশনের একটা থ্রিপিস পড়েছে,কানে সাদা পাথরের দুল,চোখে চিকন করে কাজল,ঠোঁটে হালকা লিসপ্টিক!
তিহি তড়িগড়ি করে বেড়িয়ে পড়ে ইশাদের বাসায়। বাসার কাছটাতে এসেও পড়েছে,তখনি ফোনের মেসেজটোনটা বেজে উঠেছে।
**Tihipakhi,ami vanga basher sakotate bose achi,tmi ki aktu asbe?**
এতোটা পথ একা যাবে,কিভাবে যাবে এটা কাজ করছেনা তিহির। মাথায় শুধু একটা ভাবনায় চেপে আছে,তার ইশাদ বললে,সে মরনের দুয়ারেও চলে যেতে পারে।
~~
প্রায় আধঘন্টার মতো তিহি,ইশাদের পাশে বসে আছে। ইশাদ নিশ্চুপ,চোখে কথা নেই,মুখে কথা নেই,হাতের ইশারায়ও কথা নেই। কি হয়েছে ওর? এমন অসার হয়ে আছে? ঝিলের পানির কি যাদু আছে যে তিহির ইশকে নিজের বশে করিয়ে নিয়েছে? তিহি পাশে থাকতেও আজ ইশাদ তিহির দিকে নয়,পানির শীতলতার স্রোতের মধ্যে ডুব দিয়ে আছে। তিহি আর অপেক্ষা করতে পারছেনা,সহ্যও করতে পারছেনা। ইচ্ছে করছে পানিতে ঝাপ দিয়ে শীতল স্রোতের সাথে ঝগড়া করে আসতে। তিহি সাতপাঁচভাবা বন্ধ করে ইশাদের শার্টটা খামচে ধরে বললো,,
“” কি হয়েছে তোমার? আমার কল ধরছিলেনা কেন? আজ না আমাদের বাসায় আসার কথা? আসোনি কেন? আমাকে হয়রানি করতে খুব ভালো লাগছে? প্রতিশোধ নিচ্ছো?””
ইশাদ শান্তচোখে তিহির দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরজুরে কম্পন হচ্ছে তার,শিরদাড়া বয়ে যাচ্ছে কষ্টের বর্জ্রপাত। শিরাউপশিরাগুলো উলটপালট হয়ে শরীরের কার্যক্ষমতা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম। চোখটা বন্ধ করে নিয়ে বললো,,
“” আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা, তিহি!””
তিহি ইশাদের শার্টটা ছেড়ে দিয়ে ইশাদের মুখের দিকে চেয়ে আছে,পড়ার চেষ্টা করছে মুখের উপর চেপে থাকা অনুভূতিরধারা।
“” ক্ষমা করে দাও আমায়,সরি তিহি!””
তিহি এতক্ষন চুপ করে থাকলেও আর পারলোনা৷ ইশাদের কলার চেপে ধরে রাগে ফুসছে,,,
“” ফাজলামি করো আমার সাথে?? এক্কেবারে মেরে ফেলবো।””
ইশাদ চোখ মেলে তিহির দিকে তাকিয়ে আছে,আকাশ সাজে তিহিকে বেশ লাগছে। এতো সুন্দর সাজটার মধ্যে সে কেন বিদ্যুতের ঝটকা টেনে আনলো? কেন কেন? এই মেয়েটাকে ছাড়া সে কি করে বাঁচবে? আদৌ কি বাঁচা সম্ভব??
ইশাদ নিজের শান্ত চাহনিতে রাগ টেনে এনে মুখের স্বরে তীর্যকতা রেখে বললো,,
“” তোমার ফ্যামিলির সাথে আমার ফ্যামিলি যায়না তিহি। তুমি ভাবলে কি করে আমার মতো এমন গুডলুকিং,স্মার্ট,স্টাইলিশ,গ্রাজুয়েট, ফিউচার ডক্টর,হাইক্লাস ফ্যামিলির ছেলে তোমার মতো এমন লো-ক্লাস ফ্যামিলির মেয়েকে বিয়ে করবে?? ইজ ইট পসিবল??””
ইশাদের কথায় তিহির হাতের বাধন নরম হয়ে এসেছে। নিজেকে ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়িয়ে পড়ে বললো,,
“”তুমি সুন্দর,বাট এতোটাও সুন্দর নও যে আমি পাগল হয়ে তোমাকে বিয়ে করতে চলে যাবো। নেক্সটটাইম আমাকে টাচ করার আগে নিজের পরিধিটা বিবেচনায় রাখবে,ওকে? নাও লিভ!””
তিহি বসে থেকেই নিচের দিকে তাকিয়ে বললো,,
“” তুমি মজা করছো। আমার ইশ! এর মন এতোটা নিচু নয়। ইশাদ আমার চোখে পানি চলে এসেছে। কষ্ট হচ্ছে!””
“” এসব ইমোশনাল কথাতে আমাকে বশ করতে পারবেনা। তোমাদের মতো লো-ক্লাসের মেয়েদের চোখের পানিটাই তো সম্পদ!””
“” ইশ! এমন করে বলোনা প্লিজ!! আমি মরে যাবো!!!””
তিহির কথায় ইশাদ বিদ্রুপের হাঁসি হেঁসে বললো,,
“” যা খুশি করো আমার কিছু যাবে আসবে না।””
“” তাহলে আমাদের এতো দিনের ভালেবাসা,এগুলো কি ছিলো?””
“” অবসর সময়ের বিনোদন!””
তিহি বসা থেকে উঠে দাড়ালো। নিজের গলা ঢেকে রাখা ওড়নাটা খুলে ফেলে দিলো। গলার কাছের সামনের দিকে তিনটে বোতামের দুটো খুলে নিয়ে ইশাদের কাছে এসে বললো,,
“” তোমাকে কাছে আসতে দেয়নি দেখে রাগ করেছো তাইনা? আমি আর কখনো বাধা দিবোনা৷ তুৃমি চাইলে আমাকে ছুতে পারো,যেখানে খুশি সেখানে। আমি তোমার জন্য সব করতে পারি। আমারি ভুল হয়েছে,আজকালকার প্রেমেতো এগুলো কমন ব্যাপার,আমি তো এখনো সেই আদিকালে পড়ে আছি তাইনা,ইশ!””
তিহি শেষ বোতামটা খুলতেই,ওর গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিলো ইশাদ। দাঁতের সাথে দাঁত চেপে বললো,,
“” বলেছিনা বিয়ে করতে পারবোনা?? আবার নাটক করে বেড়াচ্ছো? শরীর দেখিয়ে আমার মন ভুলাতে চাচ্ছো? এক্ষুনি আমার সামনে থেকে যাবে।””
তিহি গালে হাত দিয়ে ধপ করে বসে পড়লো। মিনমিন করে বললো,,
“” আমি যেতে পারবোনা।””
“” তোমাকে যেতে হবে।””
“” পারবোনা। আমি আমার মাঝে নেই,মনে হচ্ছে মরে গেছি,মাটি চাপা দিয়ে দাও।””
ইশাদ তিহিকে বসা থেকে টেনে উঠালো। টানতে টানতে নিজের গাড়ীতে বসিয়ে নিয়ে তিহির বাসার উদ্দশ্যে বেড়িয়ে পড়েছে।
“” তিহি,নামো।””
“” কারনটাতো বললেনা।””
“” কিসের?””
“” আমাকে দুরে সরিয়ে দেওয়ার!””
ইশাদ গাড়ী থেকে নেমে তিহিকে নামাতে নামাতে বললো,,,
“” আমার যা বলার আমি বলে দিয়েছি। এটাই আমাদের শেষ দেখা এবং শেষ কথা!””
~~
“” ছেলের ছবিটা দেখে নিস!””
মরিয়ম বেগমের দিকে না তাকিয়েই ইশাদ আকাশের দিকে চেয়ে উত্তর দিলো।
“” প্রয়োজন নেই।””
“” কার সাথে তিহির বিয়ে দিচ্ছি তা তুই দেখবিনা?””
ইশাদ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,,,
“” একটা লোক বিনে অপরাধে একজনের ঘৃন্ন নজরে থাকুক এটা কি ভালো দেখাবে?””
“” মানে?””
“” আমার তিহিকে যে নিজের দখলে করে নিচ্ছে সেই হবে আমার চোখের সবচেয়ে নিকৃষ্ট লোক। পৃথিবীতে যদি কাউকে ঘৃনা করতে হয় তাহলে আমি তাকে করবো।এই ভুমন্ডে যদি কাউকে হিংসের আগুনে জ্বালাতে হয় আমি তাকে জ্বালবো। কারন সেই একমাত্র পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যামান মানুষ,যার কাছে তিহি আছে,থাকবে। আমি চাইনা জীবনে চলার পথে,ভুল করেও তার সাথে দেখা হলে,তার দিকে যেন ঘৃন্ন বা হিংসা চোখে তাকাতে হয়। মনের অজান্তে তার দিকে চেয়ে যেন ভদ্রতাসুচক হাঁসিটাই দিতে পারি!””
“” তিহি কি এই বিয়েতে রাজি হবে?””
ইশাদ এবার মরিয়ম বেগমের মুখোমুখি হয়ে দাড়িয়েছে। হাতের ভাজে থাকা এক টুকরো কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললো,,
“” তোমার উপর ভরসা আর বিশ্বাস রেখে আমি আমার তিহিকে দিয়ে দিলাম আম্মু! এটা তিহিকে দিও।””
~~
**তিহিপাখি,
এখনো কাঁদছো? আমার জন্য?? তুমি জানোনা তোমার কষ্টে আমি কষ্ট পাই? আমাকে কেন কষ্ট দিচ্ছো?? চোখ মুছো, মুছেছো তো?
তুমি সবসময় বলতেনা তুমি আমার জন্য সব করতে পারবে?? তাহলে আজ একটু করে দেখাবে? আমার যে দেখতে ইচ্ছে করছে আমার তিহিপাখিটা আমার জন্য কি কি করতে পারে! জানোতো,সব ভালোবাসার পুর্নতা পেতে হয়না,বিশেষ করে আমাদের মতো প্রেমীদের! কেন জানো?? কারণ আমরা শরীরের মিলনের জন্য নয় আত্মার মিলনে প্রেম করেছি,দুটো মনের মিলনকে ভালোবেসেছি। এই ভালোবাসায় কোনো খুত নেই,নেই কোনো অতৃপ্তি, আমাদের এই খুতহীন ভালোবাসাকে নাহয় পুর্নতা নাই দিলাম। থাকনা তোমার আর আমার গল্পটা থেমে। তাতে কি খুব বেশি কষ্ট পাবে? অবশ্যই না। কারণ আমি জানি,আমার আত্মাপাখিটা আমাকে কষ্ট দিতেই পারেনা।
ভালোবাসি গো তোমায়,আমার ভেতর-বাহির জুরে শুধু তুমি থাকবে। কিন্তু তোমার ভেতর-বাহিরে আমি নই,অন্যকারো বসবাস হবে,এটাই আমার চাওয়া। রাখবেনা আমার চাওয়া?? আমার তিহিপাখি কি আমাকে ফিরিয়ে দিবে??
কেন করেছি তোমাকে বলতে পারবোনা। শুধু জেনে রাখো এক ভালোবাসার সম্মান রাখতে আরেক ভালোবাসাকে অসম্মান করছি। আর আমার ভালোবাসাকে সম্মান রাখতে তুমিও আমাকে সাহায্য করবে। করবে তো?? নিজেকে সাজিয়ে নিয়ো বউ সাজে,বেধে যেয়ো অন্যের বাধনে। মনে রেখো,তোমার সম্মতিতে নয় এ বিয়ে হবে আমার সম্মতিতে। আমি জানি তুমি আমার সম্মতি ফেলতে পারবেনা। আমার পুরো বিশ্বাস আছে তোমার উপর!
তোমার আমার মাঝে যে আসছে,তাকে কখনো অসম্মান করবেনা,আঘাত দিবেনা,অবহেলা করবেনা। তার সংসার জীবন গুছিয়ে পুর্ণতা এনে দিবে তুমি।তার দ্বারা কখনো কষ্ট পেলে চোখ বন্ধ করে আমাকে স্মরণ করবে আর ভাববে সেই তৃতীয়পুরুষটা আমার পছন্দের!
তোমার কাছে কখনো ক্ষমা চাইবোনা। আমি চাইওনা তুমি আমাকে ক্ষমা করো কেননা,আমি পুড়তে চাই তোমার আগুনে,হোক সেটা ভালোবাসার নাহয়,ঘুণার!
ইতি,
তোমার অপরাধী প্রেমিক
~~
বর্তমান,
“” আমি তোমাকে ভরসা করেছিলাম আম্মু,বিশ্বাস করে তোমার হাতে তিহিকে তুলে দিয়েছিলাম। কেন এমন করলে? কেন তছনছ করে দিলে আমার তিহিপাখির জীবন? তোমাকে বলতেই হবে!””
মরিয়ম বেগম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন। কাথাটা ভাজ করলেন। তারপর রুম থেকে বের হতে নিলেই ইশাদ বললো,,
“” আম্মু,আজ আমি আমার উত্তর না নিয়ে যাবোনা। তোমাকে বলতেই হবে,কেন এমন বিভৎস কাজটা করলে? কেন?তাজের মতো এমন মাতালের হাতে তুলে দিয়ে আমার তিহিকে শেষ করে দিলে?? আমি চাইনা এই জঘন্যতম কার্যের উৎস না জেনে কেউ তোমাকে খারাপ ভাবুক,কেউ তোমার দিকে একটু বাজে ভাবে তাকিয়ে থাকুক। তাই সবটা নিজের ঘাড়ে নিয়েছি,তাও কি তোমার পরীক্ষা নেওয়া শেষ হয়নি? মায়ের ভালোবাসার পরীক্ষা দেওয়ার জন্যই কি ছেলেকে জন্ম দেয়? কোলে পিঠে মানুষ করে?””
মরিয়ম বেগম ছেলের দিকে ঘুরলেন,,
“” আমি মরে যাওয়ার আগে এই উত্তর তুই পাবিনা। আমার মৃত্যু কামনা করতে থাক,যাতে খুব শীঘ্রই আমি মরে যাই।””
“” আম্মু!””
~~
ইশাদ বাড়ি ছেড়ে হসপিটালের দিকে ছুটছে। পারবেনা সে আর তার তিহিপাখিকে ছাড়া থাকতে,পারবেনা সে আর তিহিকে দুঃখের সাগরে ভেসে যেতে দিতে। তার তিহিকে চাই,বুকের মধ্যিখানে,যেখানে রয়েছে তার ভালোবাসার অনুভূতিরা। অনুভূতির সাগরে ডুবিয়ে রাখবে,খুব করে ভালোবাসা দিয়ে ভরিয়ে রাখবে। তিহিপাখি,আমি আর তোমার চোখের পানি ঝড়তে দিবোনা,দরকার হলে তোমাকে নিয়ে অন্য এক জগতে পাড়ি দিবো,যেখানে থাকবে শুধু তিহিপাখি আর ইশাদের বুকের বিশাল আকাশ!
ইশাদ দ্রুতপদে তিহির কেবিনে ছুটছে,মনে হচ্ছে আর একটা সেকেন্ডও সে তিহিকে ছাড়া থাকতে পারবেনা। কেবিনের কাছটাতে এসে ইশাদ থমকে গিয়েছে,পাদুটো জমে যাচ্ছে। আর এগুতে পারছেনা,অন্তরআত্মা চিৎকার করে তিহিকে ডাকলেও ঠোঁটদুটো নড়ছেনা,চোখদুটো চেয়ে আছে সামনের দিকে। যেখানে তিহিকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে আছে তাজ!
চলবে