তোমার_আমার_প্রণয়,02,03

0
1319

#তোমার_আমার_প্রণয়,02,03
#israt_jahan_arina
#part_2

চাকরিজীবীদের সারা সপ্তাহের তুলনায় শুক্রবারে বেশি ব্যস্ততা থাকে।সারা সপ্তাহের জমে থাকা কাজগুলো এই শুক্রবারেই শেষ করতে হয়। দৃশ্যদের ক্ষেত্রেও তাই। সকাল সকাল একগাদা কাপড় ভিজিয়ে ঘরের কাজে নেমে পড়েছে তারা। দৃশ্যর অফিস শুক্র-শনি 2 দিন বন্ধ। শনিবার টায় সে কলেজে যায়। সারা সপ্তাহ তো ক্লাস করতেই পারেনা অন্তত একটা দিনে তার সব পড়া আর নোটগুলোর জোগাড় করে নিতে হয়। এতে করে কলেজে অনেক ঝামেলায় পোহাতে হয় কিন্তু কিছু করার নেই। ক্লাস কন্টিনিউ করতে গেলে যে জব করা সম্ভব হবে না। আর জব না থাকলে লেখাপড়ার খরচ টা কিভাবে দিবে?

সব কাজ শেষ করে বিকেলের দিকে তারা তৈরি হয়ে নিলো। আজ তারা কনসার্টে যাবে। তিন বান্ধবী মিলে একটা রিক্সা নিয়ে তাদের গন্তব্যে বের হলো। এক রিক্সা তিনজন বসলে বরাবরই দৃশ্যকে উপরে বসতে হয়। কারণ বাকি দুজনের তুলনায় দৃশ্য অনেক স্লিম।

সেখানে পৌঁছেই তারা দেখল মানুষের সমাগম। এত মানুষ দেখে দৃশ্য মনে হচ্ছে ঢাকা শহরের সবাই মনে হয় আজ এখানেই চলে এসেছে। ভিড় ঠেলে তারা কিছুটা সামনে পৌঁছালো। এত মানুষের ভিড়ে দৃশ্যের ভীষণ অস্বস্তি ফিল হচ্ছে। কিন্তু জিনিয়া আর লতা আপুর এক্সাইটমেন্ট দেখে কিছু বলতে পারলো না। দুইজন শিল্পীর পারফরম্যান্স চলছে। সম্ভবত তাদের ডুয়েট গান চলছে। একসময় গানের প্রতি দৃশ্যর ভীষণ আসক্তি ছিল। তবে সময়ের বিবর্তনে আসক্তি অনেকটাই কমে গেছে। আজ কাল তেমন গান শোনা হয় না।

কনসার্টে সকলেই গানগুলোকে ভীষণ এনজয় করছে। কিছুক্ষণ পর একজন লোক এই অনুষ্ঠানের মেইন সিঙ্গারের নাম এনাউন্স করলো। দৃশ্য জানত না এই কনসার্টে কোন কোন শিল্পী গান গাইবে। তবে সেই লোকটার মুখে একটা নাম শুনে দৃশ্য কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছিল।

সামিন ইয়াসার মাহাদ। আসলেই কি সে ঠিক নাম শুনেছে? আসলে কি সে মানুষটাকে আজ দেখবে? দৃশ্য কয়েকবার শুকনো ঢোক গিললো। গলাটা ভীষণ শুকিয়ে গেছে। পানি খেতে পারলে মনে হয় ভালো হতো। ভিতরে এক অজানা অস্থিরতা কাজ করছে তার। মুহূর্তেই মনে হয় মানুষের ভিড় আরো বেড়ে গেলো। দৃশ্যর ভীষণ অস্থির লাগছে। এত মানুষের ভিড় তার কখনোই পছন্দ ছিল না। কিন্তু তার চোখ এখনো স্টেজে আটকে আছে। আজ বহুদিন পর মানুষটাকে সরাসরি দেখবে।

কিছুক্ষণ পর স্টেজে আসলো বর্তমানের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী সামিন ইয়াসার মাহাদ। সেই স্টেজে আসতেই মানুষের মধ্যে এক্সাইটমেন্ট বেড়ে গেলো। সবাই চিৎকার করে তার নাম ধরে ডাকছে। মেয়েদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা একটু বেশি। ছয় ফুট উচ্চতার একজন সুদর্শন যুবকের প্রতি মেয়েদের আকর্ষণ থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কয়েক মিনিটের মধ্যেই সে পুরো স্টেজ মাতিয়ে তুললো।

জিনিয়া তো মাহাদের ডাই হার্ড ফ্যান। লতা আপুরও পছন্দের শিল্পী মাহাদ। তারা দুজন ভীষণভাবে এনজয় করছে গানগুলো। জিনিয়া তো পারে না দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে মাহাদকে। তবে এত ভিড়ের মাঝে দৃশ্য ভীষণ স্থির। সে মনে হয় চোখের পলক ফেলতে ভুলে গেছে। স্থির দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মাহাদকে। আজ প্রায় চার বছর পর সে এই মানুষটাকে দেখছে। মানুষটা অনেকটাই বদলে গেছে।
আগের তুলনায় আরো বেশি স্মার্ট হয়ে গেছে। তার লুক টাও অনেকটা বদলে গেছে। তবে এত পরিবর্তনের মাঝে যেটা বদলাইনি সেটা হলো তার বেড়াল চোখ। ধূসর এই চোখকে দৃশ্য সবসময় বেড়াল চোখ বলে। এই চোখের দিকে তাকিয়ে সে কতবার তার হার্টবিট মিস করেছিলো তার হিসেব নেই। আজ এতদিন পর তাকে সামনাসামনি দেখে ও দৃশ্য বেশ কয়েকবার তার হার্টবিট মিস করলো। এই মানুষটা বরাবরই তাকে কেমন দম বন্ধ করা অনুভূতি দেয়। কখনো জেনে-বুঝে তো কখনো অজান্তে।

এই চার বছরে সে বেশ কয়েকবার টিভিতে দেখে ছিল এই মানুষটাকে। কিন্তু সে বরাবরই সেটা ইগনোর করেছে। আর যাই হোক সে আর নিজেকে দুর্বল করতে চায়নি। দৃশ্যর মনে হচ্ছে সে এখনো কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। এখানের বেশিক্ষণ থাকা ঠিক হবে না। তাই দৃশ্য আস্তে আস্তে পিছিয়ে গেলো। এখান থেকে বের হতে না পারলে সে দমবন্ধ করে মারা যাবে। দ্রুত সে ভিড় ঠেলে বাইরে বেরিয়ে আসলো। আগে সে বেশ কয়েকবার বড় বড় নিঃশ্বাস নিলো। ওই ভিড়ের মাঝে অক্সিজেনের কমতি মনে হচ্ছিল তার। তাই প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিল সে।

এখনো তার কানে বাজছে মাহাত এর গান। আসলে বিশাল বড় বড় সাউন্ড বক্সে গানের আওয়াজ অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। ভিড় থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেও এই শব্দের রেঞ্জ থেকে সে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সামনে সবকিছু কেমন ঘোলাটে লাগছে। দৃশ্য দ্রুত চোখটা পরিষ্কার করে নিল।

ঘড়িতে দেখল রাত 9 টা বাজে। এত রাত অব্দি তার খুব একটা বাইরে থাকা হয়না। গানের শব্দ বন্ধ হয়ে আসলো নিশ্চয়ই তার পারফরম্যান্স শেষ। হঠাৎ তার ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। জিনিয়া কল করেছে। নিশ্চয়ই তাকে খুঁজেছে। সে দ্রুত কল রিসিভ করে তাদের জানালো সে বাইরে আছে। মিনিট দশেক পর সামনে গেট দিয়ে বেশ কয়েকজন লোককে বের হতে দেখলে সে। মানুষগুলোর মাঝে সেই কাঙ্খিত মানুষটিও রয়েছে। মূলত এই মানুষগুলোর সিকিউরিটি ছিল। মাহাদ বের হতে হতেও বেশ কয়েকজনের সাথে সেলফি আর অটোগ্রাফ দিচ্ছে। দৃশ্য সে দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। মাহাদ বেরিয়ে আসতেই ভিতরের ভিড় বাহিরে জমা হতে শুরু করল। কয়েকজন মানুষের ধাক্কাই দৃশ্য কিছুটা পিছিয়ে গেল। কিন্তু তার চোখ সে মানুষটাতেই নিবন্ধ।সিকিউরিটি মাহাদকে সাবধানে তার গাড়ি অব্ধি পৌঁছে দিলো।আর গাড়িটাও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে দৃষ্টি সীমানার বাহিরে চলে গেলো।

দৃশ্য এখনো সেই দিকেই তাকিয়ে আছে।তার ধ্যান ফিরে লতা আপুর ডাকে।লতা আপু বললো

-“এই তুই বাহিরে আসলি কখন?আমরা তোকে খুজে খুজে অস্থির।”

-“আপু আমার ভীষণ অস্থির লাগছিলো,তাই বাহিরে চলে এসেছি।”

-“ঠিক আছিস?মুখটা এমন মলিন লাগছে কেনো?”

-“কিছুনা আমি ঠিক আছি।চলো বাসায় যাই।অনেক রাত হয়ে গেছে।”

জিনিয়া বললো
-“তুই মাহাদের গান রেখে কিভাবে বাহিরে চলে আসলি?ওর গান আর ওকে দেখলে আমিতো চোখ ফেরাতেই পারিনা।শুধু একটাই আফসোস, অটোগ্রাফ নিতে পারিনি।”

লতা আপু বললো
-“অটোগ্রাফ পরে নিস।আগে বাসায় চল।”

রাতে বাসায় ফিরে তারা ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লো।দৃশ্যর কাল কলেজ যেতে হবে।তাই ঘুমনোর চেষ্টা করছে।কিন্তু ঘুম তার আসে পাসেও নেই।চোখের সামনে বার বার সেই মানুষটার মুখটাই ভাসছে।সাথে নাড়া দিয়ে উঠছে তার অতীত।

দৃশ্যর পুরো নাম নুরপা জাহান দৃশ্য। বাবা মা আর বড়ো ভাই নিয়ে তার তার পরিবার।দৃশ্যর বাবা আশরাফ হুসাইন একজন ব্যাবসায়ী। তার মা আনিকা কবির একজন গৃহিণী।আর বড়ো ভাই আবরার ফাহিম।তার একটাই চাচা।তার নাম মারুফ হুসাইন।দৃশ্যর বাড়ি রাজশাহী শহরে।আশরাফ হুসাইনের আর্থিক অবস্থা বরাবরই ভালো।এলাকায় তার সুনামও রয়েছে।

দৃশ্য ভীষণ সৌখিন ভাবে বড়ো হয়েছে।মুখ ফুটে কিছু চাওয়ার আগেই সব পেয়েছে।বাবা মা ভাইয়ের আদরে বড়ো হয়েছে।তবে দৃশ্য ভীষণ রক্ষনশীল পরিবেশে বড় হয়েছে।তাদের পরিবারে মেয়েরা খুব বেশি সাধীনতা পায়না।আশরাফ হুসাইনকে ভীষণ শান্ত দেখা গেলেও তিনি ভীষণ রাগী।তিনি যা বলে, সকলকে তাই মেনে চলতে হয়।পরিবারের সকলেই তাকে যেমন শ্রদ্ধা করে,তেমনি ভয়ও পায়।দৃশ্যও তার বাবাকে ভীষণ ভয় পায়।কিন্তু দৃশ্য তার ভাইকে ভীষণ ভালোবাসে। ফাহিমেরও কলিজা তার বোন।দুই ভাই বোনের মাঝে সারাক্ষণ খুনসুটি লেগেই থাকে।
প্রতিদিন মায়ের চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভাঙ্গে।সে দিনও তাই ঘটে। দৃশ্য ছিল ভীষণ অলস প্রকৃতির।তখন সে পড়তো ক্লাস এইটে।সকালে ক্লাস করতে তার ভীষণ কষ্ট হয়।প্রথম দুই ক্লাস সে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দেয়।তার মা আসে তাকে তুলে বললো

-“তোকে কি প্রতিদিন এই ভাবে উঠতে হবে? এক্ষনি উঠ ,নাহলে মুখে পানি ছুড়ে মারবো।নাবিলা কখন রেডি হয়ে চলে এসেছে।”

-“উফফ মা!তুমি এতো চিৎকার কেন করো। বাবার সামনে তো মুখ দিয়ে কথা বের হয় না তোমার। যত রাগ তুমি আমার উপর দেখাও।”

-“ফালতু কথা বন্ধ কর আর জলদি রেডি হ।”

-“রেডি হচ্ছি নাবলাকে বলো 5 মিনিট ওয়েট করতে।”

দৃশ্যর মা চলে গেলো। দৃশ্য জলদি রেডি হয়ে বের হলো। নাবিলা হলো তার ছোট চাচার মেয়ে। ছোট চাচার 2 মেয়ে 1 ছেলে। নাবিলা হলো সবার ছোট।তারা দুইজন একই ক্লাসে পরে।নাবিলা দৃশ্যর বেস্টফ্রেন্ড।ছোটবেলা থেকে তারা এক সাথেই বড়ো হয়েছে।

দৃশ্য রেডি হয়ে নাবিলাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো স্কুলের উদ্দেশ্যে। ক্লাসে পৌঁছালো তারা দশ মিনিট পর।আতিক স্যার এর ক্লাস চলছে।দৃশ্য আর নাবিলাকে দেখে বললো

-“আজও দুই বোন লেট।তোদের লজ্জা করেনা প্রতিদিন ক্লাসের বাহিরে দাড়িয়ে থাকতে।একটা দিনও কি সঠিক টাইম ক্লাসে আসতে পারিস না?”

দৃশ্য মলিন মুখে বললো
-“স্যার আমিতো প্রতিদিন ঠিক টাইমেই এলার্ম দেই।কিন্তু এলার্ম ঠিক সময়ে বাজলেও চোখ ঠিক সময়ে খুলেনা।তাহলে আমি কি করতে পারি?”

-“কিছুই করতে হবে না।বাহিরে দাড়িয়ে থাক।আজ তোদের প্রিন্সিপাল স্যারের কাছে নিয়ে যাবো।”

নাবিলা ভয়ে বললো
-“সরি স্যার,আর এমন হবে না।”

স্যারের মনে হয় মায়া হলো।তাই বললো

-“আজই তোদের শেষ চান্স। কাল যদি দেরি করিস তো খবর আছে।”

দৃশ্য আর নাবিলা ক্লাসের বাহিরে দাড়িয়ে রইলো।নাবিলা রেগে বললো

-“প্রতিদিন তোর জন্য আমার বকা শুনতে হয়। কাল দেরি করলে তোকে রেখেই চলে আসবো।”

-“আরে বইন এতো পেরা নিস না।এই আতিক ফটিককে আমি ভয় পাইনা।”

-“ফালতু কথা কম বল।”

প্রায় পনেরো মিনিট পর তারা ক্লাসে ঢুকলো।ক্লাস শেষ হতেই মৌ বলে উঠলো

-“ওই তুই আগে আসতে পারিস না?”

সায়মা হেসে বললো
-“এই অলস প্রাণী আগে আসবে?জীবনেও না।”

দৃশ্য রেগে বললো
-“দেখিস কাল আমি ঠিক সময়ে এসে দেখাবো।”

মৌ হেসে বললো
-“এমন প্রমিজ তুই বহুবার করেছিস।”

-“কাল দেখিস।”

মৌ,সায়মা,নাবিলা আর দৃশ্য বেস্ট ফ্রেন্ড।চার বান্ধবী মিলে সারাদিন বাঁদরামি করে বেড়ায়।
স্কুল ছুটির পর বের হয়ে তাদের কোন আইসক্রিম খাবার ইচ্ছা হলো।কিন্তু তাদের সকলের টাকা মিলে একটা মাত্র কোন আইসক্রিম কিনা সম্ভব।তাই দৃশ্যর মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি আসলো।সে সবাইকে নিয়ে দোকানে ঢুকে গেলো।পাশে দুইজন ছেলে তাদের বিপরীতে দাড়িয়ে আছে।দৃশ্য একটা আইসক্রিম নিয়ে ইচ্ছা করে পাশের ছেলেটার সাথে ধাক্কা খেলো। আর সাথে সাথেই তার হাত থেকে আইসক্রিমটা পড়ে গেলো।নাবিলা,মৌ আর সায়মা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।দৃশ্য ঠিক কি করতে চাইছে তা ঠিক তারা বুঝতে পারছে না।
আকস্মিক ধাক্কায় ছেলেটা ঘুরে দাঁড়ালো।দৃশ্য নিচের দিকে তাকিয়ে মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বললো

-“আল্লাহ!আমার আইসক্রিম ফেলে দিলো। এখন আমি কি খাবো?”

উপরে তাকিয়ে সে দেখলো ধূসর একজোড়া চোখ তার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।দৃশ্য কেঁদে কেঁদে বললো

-“এই বিড়াল চোখ ভাইয়া?আপনি আমার আইসক্রিম ইচ্ছা করে ফেলেছেন তাইনা?বিড়ালের মতো চোখ বলে কি নিজেও বিড়ালের মত ছোচো হয়ে গেছেন?”

দৃশ্যর কথায় ছেলেটা অবাক হয়ে বললো
-“সরি আমি খেয়াল করিনি।”

-“খেয়াল করিনি মানে,আপনি ইচ্ছে করে ফেলেছেন।”

বলেই সে নেকা কান্না শুরু করলো।ছেলেটা বিরক্ত হয়ে বললো
-“এই পিচ্চি কান্না বন্ধ করো। আমি তোমাকে আইসক্রিম কিনে দিচ্ছি ওকে?”

দৃশ্য এবার কান্না বন্ধ করে বললো
-“আচ্ছা”

ছেলেটার দোকানদার কে উদ্দেশ্য করে বললো
-“ভাই ওকে একটা আইসক্রিম দিয়ে দেন তো।”

দৃশ্য সাথে সাথে চেঁচিয়ে বললো
-“মামা চারটা দেন।”

ছেলেটা কপাল কুঁচকে ফেললো
দৃশ্য চারটা আইসক্রিম নিয়ে নিজে একটা রেখে বাকি গুলো তিন বন্ধুবিদের দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
আর ছেলেটা এখনো অবাক হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে রইলো।তার পাশের ছেলেটা বলে উঠলো

-“মাহাদ এইটা কি হলো?”

মাহাদ সে দিকে তাকিয়েই বললো
-“আমিও তাই ভাবছি।এই পিচ্ছি আমাকে এইভাবে বোকা বানিয়ে চলে গেলো?”

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_3

শামসুন্নাহার বেগম ধীরে ধীরে তার নাতির রুমে ঢুকলেন।তার নাতি পরম শান্তিতে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে।সকালের তীক্ষ্ণ রোদ গ্লাসের জানালা ভেদ করে না ঢুকতে পারলেও রুমটায় আবছা আলো রয়েছে।আর সেই আলোতেই বিছানায় শোয়া মানুষটাকে এক রাজপুত্র মনে হচ্ছে।আসলেই তার নাতি কোনো রাজপুত্রের চাইতে কম কীসে?হাজারো মেয়ে তার নাতিকে দেখে চোখ সরাতে পারে না।ছেলেটা একদম তার বাবার মতো হয়েছে।তার ছেলেটাও ঠিক এমন চাঁদের মতো সুন্দর ছিলো।

শামসুন্নাহার এগিয়ে গেলেন জানালার দিকে।পর্দা সরাতেই সারা রুম আলোয় ভরে উঠলো।নাতির দিকে ফিরে দেখলেন চোখ কুচকে শুয়ে আছে। এবার তিনি বিছানার পাশে বসে নাতিকে ডাকলেন।

-“এইযে বড়ো সাহেব,আর কত ঘুমাবি?বেলা বারোটা বেজে গেছে। এখন অন্তত উঠ।”

ঘুম ঘুম চোখে মাহাদ বললো
-“প্লিজ দাদী ডিস্টার্ব করবে না।ঘুমাতে দাও।”

-“হারামজাদার, উঠ বলতেছি।”

এবার মাহাদ চোখ কুচকে তাকালো।আর বললো
-“ইসস দাদী,সকাল সকাল গালি দিতেছ কেনো?”

শামসুন্নাহার বিরক্ত হয়ে বললো
-“তো আর কি করবো?সারাদিন তোকে চোখের দেখাও দেখি না।সারাদিন ব্যাস্ত থাকিস।এই বুড়ির জন্য তোর কাছে কোনো সময়ই নাই।”

মাহাদ এবার দাদীকে জড়িয়ে ধরে বললো
-“সুইট দাদী আমার।এতো রাগ করো কেনো?”

-“রাগ করবো না তো কি করবো? সারাদিন এই বুড়িটার সাথে কথা বলার জন্য বাসায় একটা মানুষ নাই। তোর মা তো নিজের ধ্যানে মগ্ন। আর তোর ছোট ভাই , তার দেখা তো সারা সপ্তাহে পাইনা। কত করে বলি একটা বিয়ে কর, না তা করবি কেন? ওই কালনাগিনী টা আমার সোনার সংসার ধ্বংস করে ফেলেছে।”

এবার মাহাদ বিরক্ত হচ্ছে ভীষণ বিরক্ত। সে দাদীকে ছেড়ে উঠে সোজা বাথরুমে চলে গেলো। আর পেছনে দাদি বকবক করেই যাচ্ছে। ফ্রেশ হয়ে মাহাদ নাস্তা সেরে এক কাপ কফি নিয়ে বারান্দায় বসলো। গত পরশু সে বাংলাদেশে এসেছে। গত তিন মাস সে লন্ডনে থেকেছে। তার বেশ কয়েকটা কনসার্ট হয়েছে সেখানে তাই তিন মাস থাকতে হয়েছে।আর পরশু এসেই কাল আবার ঢাকায় কনসার্ট করলো। তাই আজকের দিন টা একদম ফ্রি। মাঝে মাঝে নিজের জন্য কিছুটা সময় রাখা দরকার। কিন্তু সকাল সকাল দাদী তার মাথাটা বিগড়ে দিয়েছে। সব কিছু ভুলতে সে যতই পালাতে চায় অতীত তার পিছন আরো বেশি জাপটে ধরে।আজও তার সেই প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে। কিভাবে এক পিচ্চি মেয়ে তাকে বোকা বানিয়ে চলে গেছিল।

মাহাদ তখন ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে। তখন থেকেই সে টুকটাক গান-বাজনা করতো। স্কুলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান এবং এলাকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সে গান গাইতো। গানের প্রতি আসক্তিই তার ছোটবেলা থেকেই।

সেদিন সে আর তার বন্ধু রাফসান মিলে দোকানে গিয়েছিল কোলড্রিংস কিনতে। হঠাৎই পিছন থেকে একটা মেয়ের ধাক্কা লাগলো। সে দেখতে পেলো ফ্লোরে আইসক্রিম পড়ে আছে। মেয়েদের দিকে তাকাতেই সে কিছুটা চমকালো। কোন এক অদ্ভুত আকর্ষণে সে মেয়েটা থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। কাঁদো কাঁদো ফেইস নিয়ে আইসক্রীমের দিকে একবার তাকাচ্ছে আর একবার তার দিকে তাকাচ্ছে। সেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসতেই সে বুঝতে পারলো ওই মায়াবতী পিচ্চি মেয়েটা তাকে ভীষণভাবে বোকা বানিয়ে চলে গেছে।
এই বিষয়টা নিয়ে রাফসান সারাটা দিন বেশ মজা নিয়েছে।তার বেশ কদিন পর মাহাদ,রাফসান,তানিম,জয় সকলে মিলে কলেজ গেটে বসে ছিলো। মূলত বন্ধুদের আড্ডা বাজি চলছিলো।

হঠাৎ দেখতে পায় দুইটা মেয়েটা গেট দিয়ে ঢুকছে। তার মধ্যে একটা মেয়েকে খুব ভালো করে চেনে। কারণ এই কয়দিনে মাঝেই এই মেয়েটাকে সে বহুবার কল্পনা করেছে। জামার উপর ক্রস বেল্ট পাড়া আর মাথায় দুইটা জুটি করা এই পিচ্চি মেয়েটা সেদিন তাকে বোকা বানিয়ে চলে গেছিলো। সেদিন খেয়াল করতে না পারলেও মাহাদ আজ বুঝতে পেরেছে মেয়েটা তাদের স্কুলে পড়ে। মূলত এটা স্কুল এবং কলেজ একসাথে।

মাহাদকে সে দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে জয় বললো

-“কি মামা! কলেজের সুন্দর সুন্দর মেয়ে রেখে এ বাচ্চাদের দিকে চোখ যায় কেন?”

জয়ের কথায় রাফসান সে দিকে তাকালো। আর দেখতে পেল সেদিনের সেই মেয়েটা। রাফসান হেসে জবাব দিলো

-“আরে ব্যাটা এটাইতো সেই মেয়ে যার কথা তোদের বলছিলাম। আমাদের মাহাদকে বলদ বানাইছে এই পিচ্চি।”

তানিম ভীষণ এক্সাইটেড হয়ে বললো
-“দারা মামা মেয়েটার ক্লাস নেই।সিনিয়রদের বোকা বানানো?”

তানিম জোরে ডেকে উঠল ‘এই পিচ্চি’ বলে। কিন্তু মেয়েটা তাদের দিকে ফিরেও তাকালো না। তানিমের অবস্থা দেখে বাকি বন্ধুরা হেসে উঠলো। তানিম আবার ডেকে উঠলো ‘এই দুই জুটি’ বলে। দৃশ্য আর নাবিলা প্রথমে না বুজলেও এবার বুঝতে পেরেছে তাই পিছনে ঘুরে তাকালো। তামিম তাদের ইশারায় কাছে ডাকলো। তারা কাছে আসতেই তানিম বললো

-“তোমাদেরকে যে ডাকছি শুনতে পাওনা?”

দৃশ্য বলে উঠলো
-“ভাইয়া আপনি তো পিচ্চি, দুই জুটি এগুলো বলে ডাকছিলেন আমরা কিভাবে বুঝবো আপনি আমাদের ডাকছেন।”

তানিম বেচারার অবস্থা দেখে এবার জয় বলে উঠলো
-“তোমাদের নাম কি বলতো?”

দৃশ্য বলে উঠলো
-“আমার নাম নুরপা জাহান দৃশ্য।আর ও নাবিলা।”

-“তোমাকে ওর নাম বলতে বলেছি?”

-“আপনি তো বললেন তোমাদের নাম বলো তাই আমি আমাদের নাম বললাম। আপনি তো আর এটা বলেন নি যে শুধু তোমার নাম বলো।”

জয় এবার বুঝতে পারলো এই মেয়ে অতি চালাক।
সে আবার বললো

-“কোন ক্লাসে পড়ো?”

-“ক্লাস এইটে।”

এবার তানিম কিছুটা রেগে বললো
-“তোমাদের তো অনেক সাহস।ক্লাস এইটে পড়ে সিনিয়রদের বোকা বানাও।”

দৃশ্য প্রথমে কিছু বুঝতে না পারলেও পরে মাহাদ এর দিকে চোখ পড়তেই সে বুঝতে পারলো বড়ো ফাসা ফেঁসে গেছে। নাবিলা তো ভয়ে শেষ।এবার সে বলল

-“আমি কোথায় বোকা বানালাম।এই ভাইয়া তো আমার আইসক্রিম ফেলে দিয়েছ তার বদলে আমাকে আইসক্রিম কিনে দিয়েছ।”

এবার জয় বলে উঠলো
-“তুমি ইচ্ছা করে ধাক্কা দিয়েছো।তাইনা?”

-“আমি ইচ্ছা করে দেই নি তো ভাইয়া। আচ্ছা ঠিক আছে আমি ওই ভাইয়াকে টাকাটা দিয়ে দিবো।আমিতো জানতামনা ভাইয়াটা এতো গরীব।”

মাহাদ এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব দেখছিলো। মেয়েটা আবার তাদের ঘোল খাওয়াতে চাইছে এটা সে বেশ বুঝতে পারলো।তাই সে বললো

-“তোমাকে কোন টাকা দিতে হবে না যাও ক্লাশে যাও।”

-“আরে না ভাইয়া,আমি আপনাকে কাল টাকাটা দিয়ে দিবো।ইসস নিশ্চয়ই আপনার আম্মু অনেক বকা দিয়েছে।আবার মারেনি তো?”

মাহাদ এবার কিছুটা থতমত খেয়ে গেলো। মেয়েটাকে ঠিক এই পরিমাণ বাঁদর হবে সেটা তার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।

মাহাদ কিছুটা রেগে বললো
-“বলেছিনা টাকা দিতে হবে না। যাও ক্লাসে যাও।”

দৃশ্য মুচকি হেসে চলে গেলো।
রাফসান হেসে বললো

-“মামা এটা তো পুরাই বোম। এই মেয়ে তো আমাদের এক ঘাটে বেঁচে আরেক ঘাট থেকে কিনে আনতে পারবে।”

মাহাদ এখনো দৃশ্যর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটার নাম টা তার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। মনে মনে বেশ কয়েকবার নামটা আওরালো দৃশ্য,দৃশ্য,দৃশ্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here