তোমার_আমার_প্রণয়,14,15

0
1117

#তোমার_আমার_প্রণয়,14,15
#israt_jahan_arina
#part_14

মেঘাচ্ছন্ন আকাশ দৃশ্য সবসময়ই ভীষণ পছন্দ করে। চারিদিকে কেমন শীতল হাওয়া বইতে থাকে। রোদের তাপ এই সময়টাতে ফিল হয় না। আজকের দিনটা অনেকটা সেইরকম। তবুও এত সুন্দর আবহাওয়া দৃশ্যর মনটাকে খুশি করতে পারছে না। এক বিষন্নতায় ছেয়ে আছে তার মন। এমন কেন লাগছে? মানুষটাকে একটা দিন না দেখে এত অস্থির হয়ে উঠছে তার মন? যেমন তেমন করে ক্লাস গুলো শেষ করে বাসায় চলে আসলো দৃশ্য। দুপুরে খেতে বসেও খাবার যেনো গলা দিয়ে নামছে না। অথচ মা তার পছন্দের কৈ মাছ ভুনা করেছে। কৈ মাছ দৃশ্য ভীষণ পছন্দ। এটা দেখলেই সে এক প্রকার খাবারের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ তার সেই পছন্দের কৈ মাছ টাও গলা দিয়ে নামছে না। কোন কারণে মেয়ের মন খারাপ বিষয়টা বুঝতে পারলেন আনিকা কবির। না হলে নিজের পছন্দের মাছ দেখে ও মেয়ে খেতে পারছে না এটা হতে পারে না। কিছুটা চিন্তিত হয়ে তিনি বললেন

-“কিরে দৃশ্য মন খারাপ?”

মায়ের কথায় এক লোকমা ভাত মুখে পুরে দৃশ্য বললো
-“নাতো মা।”

-“তাহলে ঠিকমত খাচ্ছিস না কেন? কৈ মাছ দেখলে তো ঝাঁপিয়ে পড়িস আর আজকে খাচ্ছিস না কেনো?”

-“খাচ্ছি তো। মা ভাইয়া কোথায়?”

-“তোর ভাই কি বাসায় থাকে? সারাদিন টই টই করে বাইরে ঘুরে বেড়ায়।”

-“ভাইয়া সারাদিন বাইরে ঘুরলেও তোমরা কিছু বলো না,আর আমাকে একা কোথাও যেতে দাও না।”

-“তুই এখনো ছোট মানুষ নিজের খেয়াল রাখতে জানিস না। তাছাড়া তোর বাবা মেয়ে মানুষের বাইরে থাকা খুব একটা পছন্দ করে না।”

দৃশ্য এবার কিছুটা মন খারাপ করে বললো
-“বাবার সব রূলস আমার জন্য।”

কথাটা বলেই দৃশ্য টেবিল থেকে উঠে চলে গেল। আনিকা কবির কিছুটা চিন্তিত মুখে মেয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়ের মধ্যে যে অনেক কিছুর পরিবর্তন ঘটছে সেটা তিনি বুঝতে পারছেন। তবে দৃশ্যর এই স্বাধীনভাবে চলার ইচ্ছা দেখে তিনি অনেকটা চিন্তিত। কারণ তিনি খুব ভালো করেই জানেন সেটা কখনোই সম্ভব না। কারণ এই বংশের মেয়েদের স্বাধীনভাবে কখনো চলতেই দেওয়া হয়নি।

আনিকা কবিরের বিয়ে হয়েছিল অনেক ছোট বয়সেই। তখন তিনি মাত্র এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। লেখাপড়া করার তীব্র ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু বিয়ের পর তার সেই ইচ্ছা টাকে মাটিচাপা দিতে হয়েছে। তিনি মোটেও বিয়ে করতে রাজি ছিলেন না। তার পরিবার ছিল নিম্ন মধ্যবিত্ত। কিন্তু আশরাফ হোসাইন এর জন্য যখন তাকে দেখা হয় তিনি এক দেখাই আনিকা কবিরকে পছন্দ করেন। আশরাফ হোসাইন এর আর্থিক অবস্থা দেখে আনিকা কবিরের বাবা-মা এই বিয়েতে রাজি হয়ে যান। বিয়ের পর তিনি আশরাফ হোসেনকে অনেকবার লেখাপড়া কন্টিনিউ করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু কোন লাভ হয়নি। তিনি বরাবরই এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। এই মানুষটাকে তিনি ভীষণ ভয় পান তাই কখোনো আর এ বিষয়ে কথা বলেননি।

সারাদিন বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে সন্ধ্যার দিকে বাসায় ফিরছে ফাহিম। গলির মোড়ে আসতেই দেখতে পেলো তমাকে। তমা তাদের বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে দুইটা বাচ্চা ছেলের সাথে ঝগড়া করছে। যাকে বলে কোমর বেঁধে ঝগড়া। ফাহিম কপাল কুঁচকে সামনে এগুলো। তমাকে উদ্দেশ্য করে বললো

-“এই তোর সমস্যা কি? এতো বড় ধামরি মেয়ে হয়ে এই সন্ধ্যার সময় বাচ্চা গুলোর সাথে ঝগড়া করছিস?”

ফাহিমকে দেখে তমা যেন মুহূর্তেই চুপসে গেল। আর মনে মনে বললো

‘আমার তো মোটেও এই বাচ্চা গুলোর সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছা করে না। আমার তো তোমার সাথে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে ফাহিম ভাই। দিন রাত চব্বিস ঘন্টা আমি তোমার সাথে ঝগড়া করতে চাই। রুটিনমাফিক ঝগড়া করবো আমরা। ঝগড়া করতে করতে যখন আমি ক্লান্ত হয়ে পড়বো তখন তুমি এক গ্লাস পানি বাড়িয়ে দিবে আমার হাতে আর বলবো আর ঝগড়া করেনা সোনা।’

তমার কাছ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে ফাহিম এবার ধমকে উঠলো। ফাহিমের ধমক খেয়ে বাচ্চাগুলোর দৌড়ে পালালো আর তমার কিছুটা কেঁপে উঠলো।

তমা ভাবছে ‘এই লোকটার গুন্ডামি কি আমার কাছে আসলে বেড়ে যায়? কোন অধিকারে আমাকে এত ধমক দিচ্ছে এই বদ গুন্ডাটা। এই খারাপ লোকটা তো আমাকে ভালোবাসে না তাহলে কেন এত ধমক দিবে? আমাকে যদি ভালোবাসতো তাহলে অন্য কথা ছিল। তখন না হয় এই ভন্ড গুন্ডার গুন্ডামি সহ্য করতাম। কিন্তু না গুন্ডাটা জীবনেও আমার ভালোবাসা বুঝবে না।’

নিজের ভাবনার রাজ্য থেকে বের হয়ে কিছুটা তোতলাতে তোতলাতে বললো

-“আ.. আমিতো অকারণে ঝগরা করছিলাম না ফাহিম ভাই। ওই বিচ্ছু দুইটা আমার বাগানের এতগুলো ফুল ছিঁড়ে নিয়েছে। এত সখের বাগান আমার।”

ফাহিম কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললো

-“তোর ওই ফালতু বাগানের দুইটা ফুল ছিঁড়েছে বলে তুই এভাবে ঝগড়া করবি? দিন দিন কি তোর বয়স বাড়ে না কমে?”

-“খবরদার আমার বাগানকে ফালতু বলবেননা।আপনি জানেন কত কষ্ট করে আমি এতগুলা ফুল গাছের চাড়া কালেক্ট করেছি। কতদিন যত্ন নিয়ে তবেই এত সুন্দর ফুল ফুটেছে আমার বাগানে। আমি আজ পর্যন্ত একটা ফুল ছিলাম না অথচ এই বিচ্ছু দুইটা কতগুলো ফুল ছিড়ে নিলো।”

কথাগুলো বলতে বলতে মুখটা একদম কাঁদো কাঁদো করে ফেললো তমা। এতে ফাহিম বিরক্ত হলো,চরম বিরক্ত। এই মেয়েটা এমন ছিঁচকাঁদুনে কেন? ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে কিছু হলেই কেঁদে কেঁদে চোখের জলে নাকের জলে ভাসিয়ে দেবে। ছি! কি বিচ্ছিরি লাগে তখন। ফাহিম চোখ কুঁচকে বললো

-“শোন এমন নাটক আমার সামনে করবি না। আর সন্ধ্যেবেলা বাসার বাইরে বের হয়েছিস কেনো? চাচা কে বলে তোর খবর নিচ্ছি। আর তোর ওই বাগান কোন দিন যেন আমি লন্ডভন্ড করে দেই তার ঠিক নাই।”

কথাটা বলেই ফাহিম আর এক মূহূর্ত দাঁড়ালো না হেঁটে বাসার ভেতরে চলে গেলো। তমা ভেজা চোখে ফাহিমের যাওয়ার দিকে এখনও তাকিয়ে আছে আর ভাবছে

-‘আমার বাগানের কি হবে জানিনা, তবে আপনি যে আমার মনটাকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছেন সেটার কি হবে ফাহিম ভাই?”

দৃশ্য মন খারাপ করে পড়ার টেবিলে বসে আছে। গত এক ঘন্টা যাবত সে পড়ায় মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারছেনা। আজ সারা দিনে একবারও মাহাদের সাথে কথা হয়নি তার। মনটা ভীষন ছটফট করছে। কয়েকবার কল করেছিল সে কিন্তু কলটা রিসিভ হয়নি। বিরক্ত হয়ে ফোনটা বিছানায় আছাড় মেরে ফেলে দিয়েছে।

এত কি ব্যস্ত যে তার কলটা রিসিভ করা যায় না? এই ভালবাসে তাকে? এখনো তো কোনো বড় গায়ক হয়ে যায়নি তাতেই এই ছেলের এই অবস্থা। যদি বড় কোন গায়ক হয়ে যায় নিশ্চয়ই তাকে চিনতেও পারবেনা। চারপাশে সুন্দরী মেয়েরা ঘুরঘুর করবে সেখানে কি আর দৃশ্যের পাত্তা আছে? মুহূর্তেই মনটা ভীষণ ভার হয়ে গেলো তার। আসলেই কি মাহাদ তাকে ভুলে যাবে। হাজারো মানুষের ভিড়ে সে কি হারিয়ে যাবে? নাকি মাহাদ তাকে ঠিক খুঁজে নিবে।

এমন হাজারো চিন্তা দৃশ্যর ছোট্ট মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে মনে ভীষণ অভিমান হচ্ছে তার। আজ সে কিছুতেই এই অভিমান কে ভাঙতে দেবে না। মোটেও মাহাদের সেই দৃশ্য পাখি ডাকে গলে যাবে না।
এইসব ভাবনার মাঝে দৃশ্যর ধান ভাঙ্গে ফাহিমের ডাকে। ফাহিম বললো

-“কিরে দৃশ্য তোর মনোযোগ কোথায়?”

-“এখানেই তো ভাইয়া, বল কি হয়েছে?”

-“তুই নাকি প্রায়ই ওই ছিঁচকাঁদুনির সাথে গলির মোড়ে ফুচকা খেতে যাস।”

দৃশ্য কিছু বুঝতে পারল না তাই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ফাহিমের দিকে তাকালো।
ফাহিম বললো
-“আরে ওই তমা ফাজিলের কথা বলছি।”

এবার দৃশ্য বুঝতে পেরে মুচকি হেসে বললো

-“হ্যাঁ গিয়েছি তাতে কি? ভবিষ্যতে যাতে আমাকে বেশি না জ্বালাতে পারে তাই এখন থেকেই আপুর সাথে একটা ভালো বন্ডিং করে নিচ্ছি।”

ফাহিম দৃশ্যের কথা কিছুই বুঝতে পারলো না তাই জিজ্ঞাসা করল

-“ওই তমা ভবিষ্যতে তোকে কেন জ্বালাবে?”

-“আরে ভাইয়া তুমি তো জানো না মেয়েরা ননদ নামক জিনিসটা কে খুব একটা পছন্দ করে না।”

দৃশ্য কথায় ফাহিম হা করে তাকিয়ে থাকলো। বিষয়টা ধরতে তার দুই সেকেন্ড সময় লাগলো। যখন বুঝতে পারলো তখন দৃশ্যর মাথায় চাটি মেরে বললো

-“বেশি পেকে গেছিস।ওই তমার সাথে থেকে তোর এই অবনতি।খবরদার তোকে যেনো আর ওর সাথে না দেখি।”

দৃশ্য বিরক্তি নিয়ে বললো
-“তমার আপুর মতো এমন সুন্দরী একটা মেয়ে খুজে বের করো তো ভাইয়া। এখন পাত্তা দিচ্ছো না তো যখন অন্য কেউ নিয়ে উড়ে যাবে না তখন ভ্যা ভ্যা করে কেঁদোনা।”

ফাহিম দৃশ্য টেবিলে থাকা ক্যালেন্ডারটা আছাড় মেরে ফ্লোরে ফেলে রুম থেকে চলে গেলো। দৃশ্য এখন ভীষণ হাসি পাচ্ছে। তবে তার ভাইয়ের মনে কি চলছে সেটা ঠিক ধরতে পারছে না।

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। দৃশ্য শুয়ে শুয়ে ফেসবুকে স্ক্রল করছে। আসলে তার কিছুতেই ঘুম আসছে না। না পড়ায় মন বসছে। আর ওই মাহাদ ব্যাটা! তাকে তো আর কল করেনি। হঠাৎ তার ফোন বেজে উঠলো।দৃশ্য দ্রুত আগে ফোনটা সাইলেন্ট করলো। এত রাতে ফোনের আওয়াজ পেলে বাসার সবাই তার খবর করে ছাড়বে। এতক্ষণে মাহাদ প্রায় কয়েক বার কল করে ফেলেছে কিন্তু দৃশ্য কিছুতেই ফোন ধরছেনা। বারবার কল আসাতে দৃশ্য বিরক্ত হয়েই ফোনটা ধরলো আর বললো

-“হেলো!”

-“বারবার কল করছি রিসিভ করছো না কেনো?”

মাহাদের ধমক শুনে দৃশ্য মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো। একেতো সারাদিন একটা কল করেনি আবার এই রাতের বেলা কল করে তাকেই ধমকাচ্ছে। মাহাদ আবার বলে উঠলো

-“কথা বলছো না কেন? আর এত রাতে অনলাইনে কি হুম?”

দৃশ্যর এখন মন চাইছে হাতের মোবাইলটা দিয়ে মাহাদের মাথা ফাটিয়ে দিতে। এই ছেলেটা ভীষণ খারাপ। তাকে একটুও ভালোবাসো না। ফালতু একটা ছেলে।কিছুটা রেগে দৃশ্য বললো

-“আমি যা খুশি তা করবো তাতে আপনার কি? আপনিও তো সারাদিন যা খুশি তা করে বেড়ান তাতে আমি কিছু বলেছি?”

মাহাদ এবার বুঝতে পারলো তার ছোট্ট পাখিটা অভিমান করেছে। তাই অনেকটা আদুরে গলায় বললো

-“আমার দৃশ্য পাখিটা কী রাগ করেছে?”

মাহাদের আদুরে গলা শুনে দৃশ্যত পুরো আইসক্রিমের মতো গলে গেলো।ইসস!! মাহাদের কন্ঠটা যে কোন মেয়েকে পাগল করতে যথেষ্ট।তার আদুরে গলায় কথা বলা শুনে দৃশ্যর মনে হাজারো বাটারফ্লাই উঠতে শুরু করলো। তবে পরমুহুর্তেই নিজেকে সংযত করে আবার রাগী গলায় বললো

-“আমি কোন পাখি টাখি না। কেউ যেন মোটেও আমাকে আল্লাদ দেখাতে না আসে।”

-“তাই নাকি? মনে হচ্ছে আমার দৃশ্য পাখিটা আজ আমাকে ভীষণ মিস করেছে।”

দৃশ্যর এখন চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে

‘শুধু মিস! আমি আপনাকে আজ ভীষণ রকমের মিস করেছি মাহাদ। না শান্তিতে বসতে পেরেছি, না খেতে পেরেছি।কোন কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারিনি।আপনি একটা চোর। আপনি আমার মনের সকল শান্তি চুরি করে নিয়ে গেছেন। একরাশ বিষাদ দিয়ে এখন আবার ঢং করতে এসেছেন?’

কিন্তু এমন কিছুই দৃশ্য মুখে বলতে পারলো না।সে রাগ নিয়ে বললো

-“আমার বয়েই গেছে আপনাকে মিস করতে। আমি মোটেও আপনাকে মিস করি নি।”

দৃশ্যের কথা শুনে মাহাদ মুচকি হাসলো।আর বললো

-“সকাল থেকেই ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম পাখি। সকালে আমার গানের প্র্যাকটিসে অনেক সময় লেগে গেছিলো। আর আজকে আমার প্রোগ্রাম ছিলো রাজশাহী শহরের বাইরে। দুপুরের দিকে একটু ফ্রি ছিলাম তখন তুমি ক্লাসে ছিলে। আর প্রোগ্রামের সময় ফোনটা সাইলেন্ট করে রেখে ছিলাম তাই তোমার কল রিসিভ করতে পারিনি বুঝেছো পাখি?”

কথাগুলো বলেই মাহাদ নিজেই হাসলো আর ভাবলো নিজের কাজের কৈফিয়ৎ সে কখনোই কাউকে দেয়নি। কিন্তু তার জীবনে এখন একটা মানুষ আছে যার কাছে তার প্রতিটা কাজের কৈফিয়ৎ দিতে হচ্ছে। তবে বিষয়টা যে মাহাদের কাছে খারাপ লাগছে তা কিন্তু নয়। কারো কাছে নিজের কাজের কৈফিয়ত দিতে এত টা ভাল লাগতে পারে তাতো মাহাদের জানা ছিল না।

মাহাদের কথায় দৃশ্য এবার কিছুটা শান্ত হলো। মানুষটা সব সময়ই তার সাথে ভীষণ আদুরে গলায় কথা বলে। যেন দৃশ্য ছয় বছরের ছোট একটা বাচ্চা।

মাহাদ আবার বলে উঠলো
-“আমার ছোট্ট পাখিটার রাগ কমেছে?”

-“হুঁম।”

-“আজ তোমাকে ভীষণ মিস করেছি ছোট্ট পাখি।”

দৃশ্যর একবার বলতে মন চাইলো আমিও আপনাকে ভীষণ মিস করছি। আমার জীবনে এত বেশি মিস আমি আর কাউকে করিনি। কিন্তু সে বললো না।

মাহাদ আবার বললো
-“অনেক রাত হয়ে গেছে এখন ঘুমিয়ে পড়ো কাল সকালে স্কুল আছে।”

কিন্তু দৃশ্যর কিছুতেই ফোন রাখতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে সারারাত মাহাদের কথা শুনতে। কিন্তু সে সেই ইচ্ছাটা প্রকাশ করল না। কারণ আজ সারাদিন মাহাদ ভীষণ ব্যস্ত ছিল। নিশ্চয়ই অনেক টায়ার্ড। তাই সেও বায় বলে কল কেটে দিলো।
___________________________
মাহাদ এই মুহূর্তে নিজের উপর ভীষণ বিরক্ত। এই নিয়ে সে প্রায় বেশ কয়েকবার গান রেকর্ড করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রত্যেকবারই কোনো না কোনো ভুল হচ্ছে। কিছুতেই সে কনসেনট্রেট করতে পারছে না। তার এই অবস্থা দেখে আদ্রিয়ান বললেন

-“মাহাদ আজ বাত দাও। আমরা বরং রেকর্ডিংটা কাল করি।”

মাহাদ মাথা নেড়ে সায় দিল। আসলে সে নিজেও বুঝতে পারছে তার বারবার ভুল হচ্ছে। রেকর্ডিং রুম থেকে বের হতেই আদ্রিয়ান বললেন

-“আরে মাহাদ ব্যাপার না এমন মাঝে মাঝেই হয়।”

মাহাদ অনেকটা মন খারাপ করে বললো

-“সরি ভাই আজকের দিনটা পুরা ওয়েস্ট গেলো। আসলে কিছুতেই কনসেনট্রেট করতে পারছিলাম না।”

-“ব্যাপার না। আসলে প্রায় সময়ই আমাদের পার্সোনাল লাইফের অনেক কিছুই আমাদের প্রফেশনাল লাইফে এফেক্ট করে। তাছাড়া তুমি বরাবরই এক টেকেই গান রেকর্ড করে ফেলো। সবসময় একরকম হবে এমন কোন কথা নেই।”

মাহাদ মুচকি হেসে সেখান থেকে বেরিয়ে আসলো। আদ্রিয়ান হচ্ছে একজন বড় মিউজিক ডাইরেক্টর। মাহাদের সিঙ্গিং ক্যারিয়ারের প্রথম দিক থেকেই সে আদ্রিয়ান কে চেনে। মাহাদের প্রথম দিকের সব হিট গানগুলো আদ্রিয়ানের ডিরেকশনে গাওয়া হয়েছে। মানুষটা ভীষণ সাপোর্ট করেছে তাকে।আর আজও করে।

এই রাতেও রাস্তায় এতো ট্রাফিক দেখেও মাহাদের কোনো ভাবান্তর হচ্ছে না।কারণ তার ভাবনা জুড়ে এখন শুধু দৃশ্য বিচরণ করছে। সে ভাবছে দৃশ্য ঢাকায় কেনো? তাহলে কি তার পুরো ফ্যামিলিই ঢাকায় শিফট করেছে? কিন্তু দৃশ্য তার ফ্যাশন হাউসে জবই বা কেন করছে? কারণ তার জানা মতে দৃশ্য ফ্যামিলি এটা কখনোই অ্যালাউ করবে না। আচ্ছা দৃশ্য কি আজও একা আছে নাকি তার জীবনে খুবই স্পেশাল কেউ চলে এসেছে? কথাটা ভাবতেই মাহাদের বুক ধক করে উঠলো। চোখ জোড়াও কেমন ঝাপসা হয়ে আসলো। এই মেয়েটার আশেপাশেও সে কাউকে সহ্য করতে পারে না। আর আজ মেয়েটার জীবনে কি ঘটছে সে কিছুই জানেনা। মাহাদ আর কিছুই ভাবতে চাইছে না। তার ভেতরটা তো এমনিতেই পুড়ে কয়লা হয়ে আছে। আবার সেই কয়লার আগুন জ্বালাতে চায়না সে। এই মেয়েটা কেন আবার তার সামনে আসলো? সে তো বহু কষ্টে নিজেকে অনেকটা সামনে নিয়েছিল। তাহলে এভাবে আবার তার জীবনে এসে কেন সব এলোমেলো করে দিচ্ছে। এই মেয়েটা কি তাকে কখনোই শান্তিতে থাকতে দেবেনা। এতদিন চোখের সামনে না থেকে যন্ত্রনা দিয়েছে। আর এখন তো চোখের সামনে এসে যন্ত্রণার মাত্রা আরো দিয়েছে। এই যন্ত্রণা থেকে কী মুক্তি মিলবে না?

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_15

সকালের ঘুমটা যদি সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের ধ্বনিতে ভাঙ্গে তবে সকালটা খুব বেশি মিষ্টি হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দৃশ্যের জন্য আজকের সকালটা ও ঠিক তেমনি মিষ্টি। বিছানা ছেড়ে উঠে সে পা বাড়ালো ব্যালকনির দিকে। সাত তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরো সমুদ্র সৈকত টাকে খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা যাচ্ছে। ব্যালকনির গ্লাসটা খোলা মাত্রই এক দমকা শীতল হাওয়া দৃশ্যকে ছুয়ে গেল। সাথে আরও তীব্র ভাবে শোনা গেল সমুদ্রের ধ্বনি।দৃশ্য মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ সেদিকেই তাকিয়ে রইলো। এই মুহুর্তটা তার ভীষণ ভালো লাগছে। সময়টা এখানেই থেমে গেলে মনে হয় ভালো হতো। কোন দুঃখ কষ্টও তার মনকে গ্রাস করতে পারত না। ব্যালকনি থেকে পিছনে ঘুরে তাকাতেই দেখতে পেল বিছানায় ঈশিতা ঘুমাচ্ছে। এই মেয়েটার শোয়ার ধরণ একটুও ভালো না। হাত-পা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমানোর অভ্যাস। কই সে আজ কয়েকটা বছর ধরে জিনিয়ার সাথে ঘুমাচ্ছে, কিন্তু কখনোই জিনিয়া তার গায়ের উপর হাত পা ছুড়ে ফেলেনি।
গতকাল রাতেই দৃশ্য, ঈশিতা আর মৃদুল কক্সবাজার এসে পৌঁছেছে। বাস জার্নি দৃশ্যর কখনোই পছন্দ না। সে ভীষণ উইক হয়ে পড়ে এ সকল জার্নিতে। আজ বিকেলে মাহাদের একটা গানের শুটিং আছে কক্সবাজারে। মিস লুবনা তাদের এই টিম টাকে পাঠিয়েছে। মাহাদ এবং মডেল অরিন এর ড্রেসগুলো তারা নিয়ে এসেছে।

আবার মাহাদের মুখোমুখি হতে হবে ভেবে দৃশ্যর মনটা অস্থির হয়ে উঠল। বারবার কেন এই মানুষটার সামনে পড়তে হচ্ছে তাকে? সব ভাবনা বাদ দিয়ে দৃশ্য ওয়াশ রুমের দিকে এগুলো।

সকালের ব্রেকফাস্ট তারা হোটেলের লবিতে বসেই করছে। এটা একটা ফাইভ স্টার হোটেল।দৃশ্য বারবার এদিক সেদিকে তাকিয়ে হোটেলটা পর্যবেক্ষণ করছে। খুব সুন্দর ভাবে সাজানো গোছানো হোটেল। ঈশিতা সে কখন থেকেই বকবক করেই যাচ্ছে। আসলে সে ভীষণ এক্সাইটেড। মৃদুল এর সাথে এই প্রথম সে বাইরে কোথাও বের হতে পেয়েছে। গত এক বছরে সে এরকম নানা জায়গায় গেলেও মৃদুলের সাথে কখনোই তার যাওয়া হয়নি। মৃদুল চুপচাপ খাচ্ছে আর মাঝে মাঝে আড় চোখে দৃশ্যকে দেখছে। এর মাঝে ঈশিতা বলে উঠলো

-“এই ফাইভ স্টার হোটেল গুলো আমার ভীষণ পছন্দ। এখানে আসলে নিজেকে কেমন রানী রানী ফিল হয়। যখন যেটা খুশি অর্ডার করো আর মুহুর্তেই তা সামনে চলে আসে। পারলে তো আমি সারা বছর এই হোটেলে থেকে যেতাম।”

ঈশিতার কথায় মৃদুল এবং দৃশ্য দুজনেই হাসতে লাগলো।দৃশ্য বললো

-“এটা কিন্তু ভুল ধারণা। নিজের বাড়ির মত আপন কোন কিছুই হয় না। দেখবে এখানে কিছুদিন থাকার পর আর তোমার মন টিকবে না। বাড়ির জন্য অস্থির হয়ে উঠবে।”

কথাটা বলেই দৃশ্য চোখের সামনে নিজের বাড়ির প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠলো।সেও বাড়িটাকে ভীষণ মিস করে সাথে বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ গুলোকে ও। মৃদুল দৃশ্যের কথায় সায় দিয়ে বললো

-“এটা ঠিক বলেছ দৃশ্য। বাইরের দুনিয়া যতই জাকজমক পূর্ণ হোক না কেন নিজের বাসার শক্ত বিছানাতেই কিন্তু শান্তির ঘুম হয়।”

মৃদুলের কথায় দৃশ্য এবং ঈশিতা দুজনেই হাসতে লাগলো। হঠাৎ দৃশ্যর চোখ পড়লেও সামনের দিকে। হোটেলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে মাহাদ। স্বচ্ছ কাচের ফাকে দৃশ্য মাহাদকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। হঠাৎই দুজনের চোখাচোখি হয়ে গেল। মুহূর্তেই মাহাদ চোখ সরিয়ে নিলো আর তার পাশে দাড়ানো একজন গার্ডকে কিছু বলতে লাগলো। দৃশ্য দেখলো মাহাদকে ঘিরে চারজন গার্ড দাঁড়িয়ে। সম্ভবত মাহাদ এখন বাইরে বের হবে।

সকাল সকাল দৃশ্যকে মাহাদ এই জায়গায় মোটেও আশা করেনি।তাহলে কি লুবনা ওকে পাঠিয়েছে?তবে সেই কয়েক সেকেন্ডে মাহাদের তীক্ষ্ণ নজর মৃদুলের বিষয়টা খুব সহজে ধরে ফেলেছে।দৃশ্য কি বুঝতে পারছে না ছেলেটা তাকে ঠিক কি নজরে দেখে?নাকি দৃশ্যই এই সুযোগটা ইচ্ছা করে দিচ্ছে? কথাটা ভাবতেই মাহাদের মাথায় রক্ত চড়ে উঠল। তাহলে মেয়েটার এতটা অধঃপতন হয়েছে?

বিকেলের দিকে দৃশ্য খাটে অসহায় হয়ে বসে আছে। ঈশিতা গেছে অরিনের ড্রেসগুলো নিয়ে তার রুমে। আর তাকে বলেছে মাহাদের রুমে তার ড্রেস নিয়ে যেতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা শুটিং স্পটে পৌছবে। তাই এখনি রেডি হয়ে নিতে হবে। দৃশ্য কিছুতেই মাহাদের রুমে যেতে চাচ্ছেনা। পরক্ষনেই নিজেকে সামলে নিল। এটা তার প্রফেশন। তাই এরকম অবুঝের মতো বিহেভ করাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। অনেকটা সাহস যুগিয়ে দৃশ্য গেল মাহাদের রুমের সামনে। সেখানে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে মাহাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট রবিন। দৃশ্যকে দেখে হাসিমুখে দরজা খুলে দিলো।

দৃশ্যর বুকটা ধক ধক শব্দ করছে। নিশ্চয়ই আশেপাশের মানুষজন ও তার এই শব্দ শুনতে পাবে। নিজেকে খুব কষ্টের সংযত করে রূমে ঢুকলো দৃশ্য। কিছু আশ্চর্য ব্যাপার মাহাদ রুমে নেই। দৃশ্য ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেল।সেখানেও কাউকে দেখতে পেলো না। হঠাৎ কিছুর শব্দ পেয়ে দৃশ্য পিছনে ঘুরে তাকালো। কিন্তু যা দেখলো তাতে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে এই রুমে অক্সিজেন সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে। সে কি একবার বেলকুনির গ্লাসটা খুলে দেবে? এই মুহূর্তে তার মুক্ত হাওয়ার বড্ড প্রয়োজন। মাহাদ শুধু একটা ব্ল্যাক জিন্স পরে আছে। একটা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়েছে সে। এইরূপে সে মাহাদকে কখনোই দেখেনি। এতদিন সে মাহাদের এই ফোলা পেশীগুলো জামার উপর থেকে দেখেছে। কিন্তু আজ…। আচ্ছা এখানে কি সিক্স প্যাক আছে? মনের অজান্তেই দৃশ্য গুনতে শুরু করলো। হ্যা আসলেই সিক্স প্যাক।

হঠাৎ মাহাদ দৃশ্যকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।
দৃশ্য মুহূর্তেই চোখ নামিয়ে নিলো। ছি!এতটা বেহায়া হয়ে গেছে সে? নিজের উপরই রাগ হচ্ছে তার। দৃশ্য গলা নামিয়ে বললো

-“আপনার আজকের কস্টিউম এখানে আছে।”

কথাটা বলেই হাতের বক্সটা বিছানার উপর রেখে সে সোজা দরজার দিকে হাটতে লাগলো। এখানে আর এক মুহূর্ত তার পক্ষে থাকা সম্ভব না। দেখা যাবে দম আটকে এখানেই মারা গেছে। দৃশ্য দরজাটা খোলা মাত্রই হঠাৎ করে পেছন থেকে এক শক্ত হাত দরজাটা আবার শব্দ করে লাগিয়ে দিলো। মুহূর্তেই দৃশ্যর পুরো শরীর কেঁপে উঠল। তার কি এখন সেন্সলেস হয়ে যাওয়া উচিত?

কয়েকবার শুকনো ঢোক গিলে দৃশ্য পেছনে তাকালো। মুহূর্তেই এক কদম পিছিয়ে গেলো। কিন্তু বেশি দূর যেতে পারলো না দরজায় আটকে গেলো। মাহাদ তার খুব কাছে দাঁড়িয়ে আছে।এখন তার ঠিক কি করা উচিত তা সে বুঝতে পারছে না। এই জায়গা থেকে পালাতে পারলে সে বেঁচে যায়।
মাহাদ তার দুই হাত দরজায় দিয়ে দৃশ্যকে মাঝে আবদ্ধ করে রাখলো। দৃশ্য যেন বরফের মতো জমে গেছে। মাহাদের স্পর্শ তার গায়ে না লাগলেও মাহাদের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস মুখে ঠিক আছরে পড়ছে। এতগুলো বছর পর আবার সেই অনুভূতির জোয়ার বয়ে যাচ্ছে তার মনে। দৃশ্য মাথা তুলে তাকাতে পারছে না। কারন সামনের মানুষটার চোখে চোখ রাখলে সে আবার হারিয়ে যাবে।যা সে মোটেও চায়না।

হঠাৎ ভারী কন্ঠে মাহাদ বলে উঠলো

-“বেশ উরছো মনে হয় আজ কাল। পাখা গজিয়েছে তাই না? ছেড়ে রেখেছি বলে যা খুশি তাই করে বেড়াবে? মনে রেখো যতই উরো না কেনো নাটাই টা কিন্তু আমার হাতে। প্রয়োজন পড়লে পাখা কেটে খাচায় ঢুকিয়ে রাখবো।”

মাহাদের কথা শুনে দৃশ্যর পুরো শরীর প্রচন্ড রকমের কাঁপতে লাগলো। এত বছর পর তার সাথে কথা হচ্ছে, অথচ সেখানেও হুমকি। তার চাইতে কথা না বললেই তো ভালো ছিল। এই মানুষটা আসলেই খারাপ। তার ক্ষত হৃদয়টাকে আরো ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে। তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে সেটা কি মানুষ টা দেখতে পারছেনা। দেখবে কিভাবে এখন তো সে ভীষণ ফেমাস মানুষ। দৃশ্যর মতো সাধারন মানুষের হৃদয়ের অবস্থা কি আর বুঝবে এই মানুষটা?

এতক্ষণে দৃশ্যর দুচোখ বেয়ে অনবরত অশ্রু গড়িয়ে পরতে শুরু করলো। মাহাদ সেদিকে মোটেও ভ্রুক্ষেপ করলো না। আবার রাগী কন্ঠে বলে উঠলো

-“তোমার আদরের ভাই কই? আজকাল মনে হয় বোনকে দিয়ে টাকা কামাই করা লাগে তার? এখন তোমাদের মান সম্মান যায় না?”

দৃশ্য দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করলো। এই মানুষটা তাকে কেনো এত কষ্ট দিচ্ছে। এই মানুষেটার কাছে কোন কৈফত দিবেনা সে। এত বছর পর কিসের অধিকার দেখাচ্ছে?

বিচের পাশে খুব সুন্দর একটা জায়গায় গানের শুটিং হচ্ছে।অরিন মেয়েটা দেখতে ভীষণ সুন্দর আর ভীষণ স্মার্ট। এককথায় মডেল হওয়ার জন্য পারফেক্ট। ক্যারিয়ার ও বেশ ভালো চলছে তার। এটা নিয়ে মাহাদের সাথে তৃতীয়বারের মতো কাজ করছে। তাই মাহাদের সাথে সখ্যতা ও বেশ ভালো গড়ে উঠেছে।

দূরে প্রোডাকশনের সাথে দাঁড়িয়ে মাহাদের শুটিং দেখছে দৃশ্য আর ঈশিতা। ঈশিতাই তাকে জোর করে এখানে নিয়ে এসেছে। সে ঘটনার পর দৃশ্য আর মাহাদের মুখোমুখি হতে চায়নি।

এই মুহূর্তে গানের একটা রোমান্টিক সিন শুট হচ্ছে। অরিন দৌড়ে এসে মাহাদকে জড়িয়ে ধরবে ঠিক এমনই একটা সিন চলছে।দৃশ্য সে দিকে ইচ্ছে করে তাকাচ্ছে না।তার মনে হচ্ছে কেউ তার বুকে বড়ো কোনো তলোয়ার দিয়ে আঘাত করছে।ঠিক এই ভয়ে সে মাহাদের কোনো মিউজিক ভিডিও দেখে না।কিন্তু কপাল দোষে আজ সামনে থেকে এই সব দেখতে হচ্ছে। তারপর আবার একই সিন বারবার রিটেক নেওয়া হচ্ছে।

দৃশ্যর মাথায় একটা জিনিষ আসেনা যে একজন সিঙ্গারকে কেনো মডেল হতে হবে। সিঙ্গাররা শুধু গান গাইবে।কিন্তু না,এই ছেলের সব করতে হবে।অসভ্য একটা।
ভীষণ বিরক্ত হয়ে দৃশ্য ঈশিতাকে বললো

-“ঈশিতার আমার এখানে ভীষণ বিরক্ত লাগছে। চলনা একটু সামনে সমুদ্রে হাটি।”

-“আচ্ছা ঠিক আছে চলো।”

দৃশ্যর যাওয়ার দিকে মাহাদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এতক্ষণ সে ইচ্ছে করে দৃশ্যকে জ্বালানোর জন্য একই সিন বারবার রিপিট করছিলো। কিন্তু যাকে জ্বালাতে চাইছিলো সে তো নিজেই চলে গেলো।তাই মাহাদ আর সময় নিলোনা।এক বারেই সিন কমপ্লিট করলো।

দৃশ্য আর ঈশিতা একসাথে সমুদ্রের পাড়ে হেঁটে যাচ্ছে।হটাৎ দৃশ্য বললো

-“মৃদুল ভাইয়াকে নিজের মনের কথা বলছো না কেনো?”

দৃশ্যের কথায় ঈশিতা কিছুটা অবাক হলো। মৃদুলের ব্যাপারটা তো সে কখনোই কারো সাথে শেয়ার করেনি। তাহলে দৃশ্য জানলো কি করে? ঈশিতার অবাক হওয়া দেখে দৃশ্য মুচকি হাসলো আর বললো

-“অবাক হওয়ার কিছু নেই। তোমাকে দেখেই বোঝা যায় তুমি মৃদুল ভাইয়াকে কতটা ভালোবাসো।”

ঈশিতা মলিন হেসে বললো
-“যদি তাই হতো তাহলে মৃদুল কেন বুঝতে পারেনা?”

-“এমনও তো হতে পারে তিনি সবই বুঝে।”

-“সে যদি বুঝতো তাহলে তো ভালই হতো।”

-“ঈশিতা জানো মাঝে মাঝে ভালবাসি বলাটা অনেক জরুরী হয়ে পড়ে। একটা সম্পর্কে সরি বলাটা ঠিক যতটা জরুরি ভালবাসি বলাটা ঠিক ততটাই জরুরী।”

-“কিন্তু আমার ভীষণ ভয় হয় দৃশ্য। যদি সে আমাকে ফিরিয়ে দেয়।”

-“সেটা তার ডিসিশন।কিন্তু তোমার মনের কথাটা তাকে জানানো দরকার।”

এবার ঈশিতা মুচকি হেসে বললো
-“কিন্তু আমার কেন যেন মনে হয় সে তোমাকে পছন্দ করে।”

একথা শুনে দৃশ্য খুব একটা অবাক হলো না। কারণ মৃদুলের ব্যবহার দেখলে যে কেউ সেটা আন্দাজ করতে পারে।দৃশ্য ঈশিতার মনের অবস্থাটা বুঝতে পারছে। হেসে বললো

-“কিন্তু আমার দিক থেকে তেমন কিছু নেই।”

-“আচ্ছা দৃশ্য তুমি কি কখনো কাউকে ভালবাসনি?”

দৃশ্য একদৃষ্টিতে দূরের সমুদ্র ঢেউ গুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। আর বললো

-“হ্যাঁ বেসেছি তো! ভীষণ ভালবেসেছি। যতটুকু ভালবাসলে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায়। আমার জীবনের ম্যাজিক্যাল মোমেন্ট গুলো তার কাছথেকে পেয়েছি।”

-“কে সে?আমার ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে।”

দৃশ্য মলিন হেসে একবার পেছনে তাকালো। মানুষের ভিড়ের মাঝে আবছা মাহাদকে দেখা যাচ্ছে। সে আবার দৃষ্টি ফেরানো সমুদ্র পানে। আর বললো

-” ভালোবাসাটা আমার কাছে থাকলেও সেই মানুষটা আমার কাছে নেই।”

ঈশিতা বিস্ময় নিয়ে বললো

-“আল্লাহ কি বলো?তোমাদের কি ব্রেকআপ হয়ে গেছে?”

কথাটা শুনে দৃশ্য মুচকি হেসে বললো
-“আমাদের সম্পর্কটা এতটাই গভীর ছিলো যে সেখানে ব্রেকআপের কোনো অস্তিত্ব নেই।”

-“তোমার মতো এতো কিউট একটা মেয়েকে কেউ কি করে কষ্ট দিতে পারে?”

-“তোমার এমন কেনো মনে হলো যে আমি কষ্টে আছি?তেমন কিছুই না।আমি ভীষণ ভালো আছি।সবচাইতে বড় কথা আমি স্বাধীন ভাবে আছি। ঠিক মুক্ত পাখির মতো।”

____________________
মাহাদ আর দৃশ্য তখন গভীর প্রণয়ে বিভোর। দিনে স্কুলে তাদের বেশ কয়কবার দেখা হয়।তার পরও মাহাদ বিকেলে দৃশ্যর কোচিং এর সামনে এসে দাড়িয়ে থাকে আরো একটা বার প্রিয়তমাকে দেখতে। সারারাত জেগে ফোনালাপ চলে তাদের।সময় গুলো যেনো সপ্নের মত কাটছে।

দৃশ্য আর নাবিলা বের হয়েছে কোচিং এর জন্য।কোচিং এর কাছাকাছি আসতেই দৃশ্যর নজর পরে রাস্তার ধারের একটা আম গাছের দিকে। গাছের ঝুলন্ত পাকা আমের লোভ দৃশ্য কিছুতেই সামলাতে পারছে না। তাই সে নাবিলাকে তার ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে গাছে উঠে পড়লো। এদিকে নাবিলা বারবার তাকে মানা করছে। কিন্তু কে শুনে কার কথা।

মাহাদ অনেকক্ষণ ধরে দৃশ্যের জন্য গলিতে অপেক্ষা করছে। কিন্তু এই মেয়ের আসার নাম নেই। কয়েকবার কল করেছে কিন্তু রিসিভ করছে না। কিছু একটা ভেবে সে সামনের দিকে এগোতে লাগলো। ভাবলো হয়ত রাস্তায় দৃশ্যের সাথে দেখা হবে। কিন্তু এভাবে দেখা হবে সেটা ভাবেনি। একটু সামনে এগোতেই দেখতে পেলো নাবিলা একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছে। আশেপাশে চোখ বুলিয়েও দৃশ্যর দেখা পেলো না। নাবিলার কাছাকাছি আসতেই তার চোখ পড়লো গাছের উপরে। সাথে সাথে মাহাদের মাথায় হাত।

এই মেয়ে কি জীবনেও বড় হবে না। বাঁদরামি এই মেয়ের রগে রগে মিশে আছে।এই মেয়ে গাছে কি করছে? মাহাদ চিৎকার করে ডেকে বললো

-“এই ফাজিল মেয়ে তুমি গাছে উঠে কি করো?”

মাহাদ কে দেখে দৃশ্য কিছুটা ভয় পেলো। তবুও জোরপূর্বক হেসে বললো

-“গাছে উঠে মানুষ কি করে আমিও তাই করছি। মশা মারছি।”

-“আমার সাথে ফাজলামো করছো? এখান থেকে পড়লে একদম ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে যাবে।”

-“তাতে কি হয়েছে, তখন কি আর আমার সাথে কথা বলবেন না? আমাকে বিয়ে করবেন না?”

-“দৃশ্য এটা মজার করার টাইম না। এখনি নিচে নামো। কারন আমি যদি গাছে ওঠি তাহলে তোমার খবর আছে। একদম থাপরাইতে থাপরাইতে নিচে নামাবো।”

দৃশ্য এবার কিছুটা ভয় পেলো। এই ছেলের যা রাগ, দেখা যাবে সত্যি সত্যি তাকে থাপ্পড় মেরে বসেছে। তাই কোন রিক্স নেওয়া যাবে না। তাই সে ধীরে ধীরে গাছ থেকে নিচে নেমে আসলো।

মাহাদ যেন এতক্ষণে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। মাহাদ ভেবে পায়না এই উঁচু গাছটায় বাঁদরটা কিভাবে উঠলো। যদি ভুল করেও এখান থেকে পড়ে যেত তাহলে? মাহাদ আর ভাবতে পারলো না। সে এগিয়ে এসে দৃশ্যর চুল থেকে পাতাগুলো ছাড়াতে লাগলো। পুরাই জংলি অবস্থায় এই মেয়ের। এদের অবস্থা দেখে নাবিলা মুচকি মুচকি হাসছে।

মাহাদ দৃশ্যর বেনুনি করা চুলে টান মেরে বললো

-“ফাজিল মেয়ে আর কোনদিন যদি দেখেছি এমন করতে?”

দৃশ্য মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো

-“ঠিক আছে এমন করব না তবে একটা শর্তে?”

মাহাদ কপাল কুঁচকে বললো
-“কি শর্ত?”

দৃশ্য এবার মুচকি হেসে বললো
-“এই গাছ থেকে আমাকে মিনিমাম পাঁচ টা আম আমাকে পেরে দিতে হবে।”

মাহাদ একবার গাছটার দিকে তাকিয়ে তারপর বললো
-“ইম্পসিবল। আমার কি তোমার মতো মাথার দুটো তার ছেঁড়া নাকি?”

দৃশ্য বিরক্ত হয়ে বললো
-“আমার মাথার তার ছিরা তাইনা? এখনতো আমি প্রতিদিন এই গাছে উঠবো।”

দৃশ্যের কথা শুনেন নাবিলা খোঁচা মেরে বললো
-“দৃশ্য এবার চুপ যা বইন। মাহাদ ভাই রেগে গেলে কিন্তু ঝামেলা হয়ে যাবে।”

দৃশ্য ও তার কানে কানে বললো
-“রেগে যাক বা যাই করুক,এই ব্যাটা আমাকে তার ছেড়া বলেছে না।আজকের ওর খবর আছে।”

এতক্ষণের মাহাদের ভীষণ রাগ উঠে গেছে। এই জেদী মেয়েকে নিয়ে সে সংসার করবে কিভাবে? এই মেয়ে নির্ঘাত আমাকে নাকানি-চুবানি খাওয়াবে। তবে সে চাইলেও দৃশ্যর সাথে কঠোর হতে পারে না। তাছাড়া এই মেয়ে কোন বিশ্বাস নেই। দেখা যাবে সত্যি সত্যিই প্রতিদিন এই গাছে উঠে বসে আছে।

অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক আম তাকে পেড়ে দিতে হবে। অনেক খোজা খুজি করে একটা লাঠী পেলো। বেশ কিছুক্ষণ চেষ্টা করে কয়েকটা আম পাড়তে পারলো। তারা যখন আম পারায় ব্যস্ত তখন হঠাৎ দৃশ্যর চোখ গেলো পিছনের রাস্তার দিকে। একটা লোক লাঠি নিয়ে দৌড়ে তাদের দিকে আসছে। দৃশ্যর আর বুঝতে বাকি রইলো না এটা গাছের মালিক। দৃশ্য দ্রুত আমগুলো কুড়িয়ে চিৎকার করে বললো

-“নাবিলা জলদি ভাগ।”

নাবিলা কথাটা শুনেই দৃশ্যের দিকে তাকাতেই দেখলো দৃশ্য অলরেডি ভোঁ দৌড়। সে কিছু না বুঝেই দৃশ্যের পিছনে দৌড়ে গেলো। কিন্তু এদিকে মাহাদ পুরো বোকা বনে গেলো। দুই বান্ধবীর হলো কি? কিন্তু কয়েক মুহুর্ত পরেই বুঝল তাদের দৌড়ানোর কারণ। একটা লোক লাঠি হাতে দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। এতক্ষণে লোকটা গালিগালাজ শুরু করে দিয়েছে। লোকটার গালিগালাজ শুনে মাহাদে কান গরম হয়ে উঠলো। দৃশ্য যে তাকে এভাবে ফাসিয়ে চলে যাবে তাতো সে ভাবতেই পারেনি।

লোকটা কিছুক্ষণ বকাবকি করার পর মাহাদের দিকে ভাল করে তাকিয়ে বললো

-“ওই তুমি আমজাদের পোলা না?”

মাহাদ যেন এবার অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। তার মানে এই লোক তার বাবাকে চেনে।এ কোন বিপদে পড়লো। বাবার কানে একথা গেলে লজ্জায় তার মাথা কাটা যাবে। মাহাদ মাথা নিচু করে বললো

-“জি।”

-“আরে বাবা এতো বড় হয়েও তোমরা এহোনো গাছের আম চুরি করো?আমজাদ এতো ভালা মানুষ। তার পোলা হয়ে তোমারে এই কাম মানায় না।”

মাহাদ যেনো এবার চরম লজ্জায় পড়লো।এই পিচ্চিটা যে আর কত ভাবে তাকে নাকানি চুবানি খাওয়াবে আল্লাহ জানে। মাহাদ নিচু স্বরে বললো

-“মাফ করবেন চাচা। আর এমন হবেনা।”

-“আচ্ছা যাও। তোমার বাপেরে আমার সালাম জানাইও।”

-“জি আচ্ছা।আসি আল্লাহাফেজ।”

মাহাদ সেই দিন কোনো মতে সে স্থান ত্যাগ করলো। আল্লাহ বাঁচিয়েছে লোকটা আর লাঠি দিয়ে দু এক ঘা বসিয়ে দেয় নি। তাহলে আর মান-সম্মান থাকতো না তার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here