তোমার_আমার_প্রণয়,37,38

0
1250

#তোমার_আমার_প্রণয়,37,38
#israt_jahan_arina
#part_37

দৃশ্য আর মাহাদ বসে আছে কাজীর সামনে।দৃশ্যর পুরো শরীর থর থর করে কাপছে।ভয় দৃশ্যর মনে যেকে বসেছে।বাবার হিংস্র রূপ বার বার ভেসে উঠছে।সামনের কাগজটা কেমন ঘোলাটে দেখাচ্ছে।একটু আগে তাকে এই কাগজে সাইন করতে বলেছে। মাহাদ দৃশ্যর হাতে হাত রেখে ভরসা দিলো।মেয়েটার মনে কি চলছে মাহাদ বুঝতে পারছে।দৃশ্য কাপা কাপা হাতে কলম ধরলো।একটা সাইন হয়তো তার পুরো জীবনকে বদলে দিবে।দিকনা বদলে।মাঝে মাঝে কিছু পরিপর্তন ভালোর জন্যই হয়।প্রিয় মানুষটা পাশে থাকলে সব কষ্ট সহ্য করা যায়।দৃশ্য কাগজে সাইন করলো।দু চোখ বেয়ে তার অশ্রু ঝরছে।আনন্দ,ভয়,সংশয় মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে।তারপর কবুল বলে তারা একটা পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেলো।দৃশ্যর কাছে সব স্বপ্ন মনে হচ্ছে।তার ভালোবাসা আজ পূর্ণতা পেল।

তাদের বিয়ে সম্পন্ন হতে সবাই উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। প্রিয় বন্ধু তার প্রিয়তমাকে পেলে বোধয় বন্ধুরাই বেশি খুশি হয়।
আরিফের চোখ ভিজে উঠেছে।এই মুহূর্তে নিজেকে হালকা লাগছে।যে কাজ সে করতে পারেনি সেটা মাহাদ ঠিক করে দেখিয়েছে।নিজের ভালোবাসাকে চিরদিনের জন্য নিজের সাথে বেধে ফেলেছে।এই কাজটা ভুল নাকি সঠিক সেটা আরিফ জানে না।তবে দুজন মানুষ নিজের ভালোবাসাকে নিজের করে পেয়েছে এতেই তার শান্তি।তবে তার ভাই বিষয়টি কি ভাবে নেবে ভাববার বিষয়।

দৃশ্য আর মাহাদ মালা বদল করলো।রাফসান সব মোমেন্ট এর পিক তুলছে। মাহাদ দৃশ্যর কানে ফিসফিসিয়ে বললো

-“কনগ্রাচুলেশন মিসেস।আজ থেকে তুমি আমার ব্যক্তিগত সম্পত্তি।”

দৃশ্য কান্নার মাঝেই মুচকি হাসলো।কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে।নাবিলা কাছে এসে কান্না করে দিলো।আর বললো
-“দৃশ্য আমার এতো খারাপ লাগছে কেনো?মনে হচ্ছে তুই পর হয়ে গেছিস।”

দৃশ্যও ভ্যা ভ্যা করে কেদে দিল।তানিম অবাক হয়ে বললো
-“এই বাচ্চা তুই কেমনে পালবি মাহাদ?”

রাফসান হেসে বললো
-“আরে একবার বাসর ঘরে গেলে দেখবি এই বাচ্চা আরেক বাচ্চা নিয়ে বেরুবে।”

জয় হেসে বললো
-“সব কিছুর ক্রেডিট কিন্তু মাহাদের থাকবে।”

মাহাদ বিরক্ত হয়ে বললো
-“মজা নিচ্ছিস?সময় আমারও আসবে।দেখে নিবো তোদের।”

তানিম বললো
-“ওই ব্যাটা এখন কি করবি?”

রাফসান বললো
-“দূরে কোথাও ঘুরে আস।বাসর প্লাস হানিমুন শেষ করে আয়।”

মাহাদ গম্ভীর হয়ে বললো
-“নারে বাসায় যাবো।বাবাকে জানাতে হবে।তাছাড়া দৃশ্যর বাসায় ওকে না পেয়ে আমার বাসায় ঝামেলা করবে।তাই বাবাকে আগেই সব জানাতে চাই।বাবা নিশ্চয়ই বিষয়টা বুজবে।”

আরিফ এসে বললো
-“চলো আজ আমার পক্ষ থেকে তোমাদের সবার ট্রিট।”

মাহাদ চিন্তিত হয়ে বললো
-“এইসব পড়ে হবে চাচু।আগে বাসায় জানাতে চাই।”

-“আরে বাসায় তো যাবোই।দেখ বাসায় একটু ড্রামা তো হবেই।তাই খেয়ে শক্তি করে নে।আর দৃশ্যকে দেখে মনে হয় কাল থেকে কিছুই খায়নি।”

-“ঠিক আছে।”

তানিম মুচকি হেসে ফিসফিসিয়ে বললো
-“আরে মামা খেয়ে নে।নাহলে রাতে শক্তি পাবি না।”

মাহাদ তানিমের পিঠে একটা কিল মেরে দিল।
তারা সকলেই একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে।সামনে অনেক খাবার।কিন্তু দৃশ্য কিছুই মুখে তুলছে না।ভয়ে তার শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। মাহাদ কাছে এসে বসলো।আর একটা প্লেটে খাবার তুলে দৃশ্যর মুখের সামনে নিয়ে বললো

-“বউ হা করো তো।”

মুহূর্তেই দৃশ্যর পুরো শরীর মৃদু কেপে উঠলো।বুকের ভেতর মনে হচ্ছে কেউ তবলা বাজাচ্ছে।বউ শব্দটার এতো শক্তি?একটা শব্দ এই কিশোরীর অন্তরকে নাড়িয়ে দিয়েছে।মুহূর্তেই দৃশ্যর চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু গড়িয়ে পড়ল।এতো সুখ তার কপালে সইবে তো?দৃশ্য খাবার মুখে পুরে নিলো। মাহাদ পরম যত্নে দৃশ্যকে খাওয়ালো।সবাই তাদের দেখে হাসছে।তৃপ্তির হাসি।

মাহাদ যত্ন নিতে জানেন। ভালবাসার যত্ন সম্পর্কে যত্ন সবকিছুতেই মাহাদ বেশ পটু। এমন একটা কেয়ারিং হাজবেন্ড সব মেয়েই আশা করে। মাহাদের কেয়ারিং ব্যবহারের জন্যই দৃশ্য তার প্রতি ভীষণ দুর্বল।ভাইয়া ছাড়া মাহাদই দ্বিতীয় পুরুষ যে তাকে এতো কেয়ার করে।
তাদের খাওয়া শেষ হলে মাহাদ জয়কে বললো মৌ,নাবিলা আর সায়মাকে বাড়িতে পৌঁছে দিতে।তারা যাওয়ার আগে দৃশ্যর গলা ধরে মরা কান্না করলো।তানিম বিরক্ত হয়ে বললো

-“এতো কান্নার কি আছে?তোমাদের বান্ধুবি শশুর বাড়ি যাচ্ছে, যুদ্ধের ময়দানে না।”

নাবিলা নাক টেনে বললো
-“আপনি বুজবেন না।”

নাবিলা মনে মনে বলছে
‘ আজ বাসায় তার উপর থার্ড ডিগ্রি চলবে সেটা বুঝতে পারছে।তার বাবা চাচার ইগোতে আঘাত লেগেছে।নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলবেননা?’

জয় চলে যেতেই মাহাদ চললো বাসার উদ্দেশ্যে।সেই কখন থেকে দৃশ্য কেঁদেই চলছে। মাহাদ এবার শক্ত গলায় বললো
-“আমি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছি?তাহলে এতো কাঁদতেছো কেন?”

দৃশ্য এবার হিচকি তুলে কাদতে কাদতে বললো
-“তুমি একটা খারাপ।বিয়ে করেই আমাকে ধমক দিতে শুরু করেছ।থাকবনা তোমার সাথে।”

মাহাদের ভীষণ হাসি পেলো।কিন্তু হাসলেই বিপদ।এই বাচ্চা তখন ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিবে। মাহাদ দৃশ্যকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খেয়ে বললো

-“ধমক দেই নি তো বউ। তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয় বুঝনা।তাই কান্না বন্ধ করো আর নিজেকে শক্ত করো। কারণ সামনে কি হতে চলছে আমি নিজেও জানিনা। যেটাই হোক আমার হাত কখনো ছাড়বে না।”

দৃশ্য মাহাদের বুকে মুখ গুজে রইলো। এর চাইতে নিরাপদ স্থান আর হতেই পারে না।
বিকেলের দিকে তারা বাসায় পৌঁছালো।কিন্তু ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ আসছে।চিন্তায় মাহাদের কপালে ভাঁজ পড়ল।দৃশ্য ভয়ে মাহাদের বহু চেপে দাড়ালো।

বাসায় ঢুকে আরিফ একটু অবাক হলো।এতো জলদি আশরাফ এই জায়গাতে পৌঁছে যাবে ভাবতে পারেনি। দুই পক্ষের মাঝে বেশ বাকবিতণ্ডা হচ্ছে। সেখানে মাহাদের দুই মামাও আছে।আমজাদ রহমানের রাজনৈতিক কিছু উচু মহলের লোকও আছে।এটা নিশ্চয়ই মাহাদের মামার কাজ।দরজায় সবার চোখ পড়তেই মুহূর্তেই সব নিস্তব্ধ হয়ে গেল। যাদের নিয়ে এতো ঝামেলা চলছে তারা ঠিক কি কাজ করে ফিরেছে সেটা বুঝতে কারো সময় লাগলো না।দৃশ্যকে বউ সাজে দেখে ফাহিমের বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।শেষ পর্যন্ত বোনটা এই কাজ করলো? নিশ্চই ওই মাহাদ তার বোনের ব্রেন ওয়াস করেছে।নাহলে তার পিচ্ছি বোনটা এমন কিছু করতেই পারে না।

নিজের পরিবারকে এই জায়গাতে দেখে দৃশ্যর ভয় বেড়ে গেলো।পুরো শরীরে কম্পন ধরে গেলো।সামনে ঘোর বিপদের আভাস পাচ্ছে।চোখে পড়লো বাবার রক্তিম চোখ জোড়া।যা তাকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিবে।
ফাহিম দৃশ্য আর মাহাদকে এই অবস্থায় দেখে রাগে ফেটে পরলো।দ্রুত কাছে এসে মাহাদের কলার চেপে ধরলো।আর চিৎকার করে বললো

-“জানোয়ারের বাচ্চা আমার বোনকে কোন সাহসে নিয়ে এসেছিস?তোর গেম আমি বুঝিনা ভেবেছিস?”

তানিম আর রাফসান জোর করে ফাহিমের হাত থেকে মাহাদ কে ছাড়ালো।দৃশ্য ভয়ে মাহাদের পিছনে লুকিয়ে পড়েছে।
মাহাদ শান্ত কন্ঠে বললো

-“দেখ ফাহিম তুই আমাকে ভুল বুঝছিস।আমি কোনো গেম খেলছি না।দৃশ্যকে আমি ভালোবাসি।সেটা তোর পরিবারকে বুঝাতেও চেয়েছি।কিন্তু তোরা বার বার আমাকে আর আমার পরিবারকে অপমান করে গেছিস।”

ফাহিম ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-“নাটক বন্ধ কর।নিজের চাচার সাথে মিলে আমার পরিবারের সুখ শান্তি নষ্ট করার প্ল্যান করেছিস।আমার বোকা বোনটার ব্রেন ওয়াশ করিয়েছিস।”

আরিফ নরম সুরে বললো
-“দেখো বাবা জীবন কোনো নাটক না। মাহাদ সত্যি তোমার বোনকে ভালোবাসে।সে কিন্তু চাইলেই প্রথমে এই কাজটা করতে পারতো।কিন্তু সে চেয়েছে পারিবারিক ভাবে এগুতে।সে যাই হোক। এখন আমাদের উচিৎ সব ভুলে নতুন করে শুরু করা।”

আশরাফ হুসাইন চিৎকার দিয়ে বললেন
-“কখনো না।আমি বলেছিনা এই বেয়াদবের বাচ্চা আমার মেয়েকে নিয়ে ভেগেছে?”

আনোয়ার হুসাইন রেগে বললো
-“কীরে আমজাদ এই তোর পোলার উপর বিশ্বাস?দেখলি তো আমাদের মেয়ে নিয়ে ভেগেছে।”

আমজাদ রহমান নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না। মাহাদ এমন একটা কাজ করবে ভাবতেই পারেননি।
আশরাফ আর আনোয়ার অকথ্য ভাষায় আমজাদ রহমানকে গালি দিয়ে যাচ্ছেন।আখি রহমান পাশে দাড়িয়ে চোখের জল ফেলছেন।নিজের স্বামীর এতো অপমান তিনি কিছুতেই মানতে পারছে না।আরিফ বার বার তাদের বুঝিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু দৃশ্যর বাবা চাচা গালি গালাগ শুরু করেছে।নিজের ভাইকে আরিফ অনেক ভালোবাসে।তার ভাইতো কিছুই জানতো না।তবুও এতো অপমান সহ্য করছে।তার ভাইয়া নিতান্তই মাটির মানুষ।কাউকে কষ্ট দিয়ে কথা বলতেই পারেনা ।কিন্তু সে ভাইয়ের অপমান সহ্য করবে না। এবার রেগে বললো

-“ফালতু কথা একদম বলবেননা।আমরা সুন্দর ভাবে আপনাদের বাড়িতে মেয়ে চাইতে গেছিলাম।কিন্তু আপনাদের ফালতু ইগোর কারণে আমাদের অপমান করেছেন।অথচ এতে বাচ্চাগুলো কতটা কষ্ট পাচ্ছে সেটা খেয়াল করেননি।”

আশরাফ হুসাইন ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-“আমার মেয়ের বিষয়ে আমি বুজবো।তোদের মাথা ঘামাতে কে বলেছে?”

-“দৃশ্য আর এখন শুধু আপনার মেয়ে না।সে মাহাদের বউ।”

কথাটা যেন আশরাফ হোসেনের কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিলো।তিনি চিৎকার করে বললেন
-“এই বিয়ে আমি মানিনা। আমার মেয়েকে জোর করে বিয়ে করে নিলেই আমি মানবো নাকি? অসভ্যের বাচ্চাগুলো আমার বাড়ির মেয়েদের পেছনে লেগেছিস। নিজে পারিস নি এখন ভাইয়ের ছেলেকে দিয়ে আমার মেয়ের জীবন নষ্ট করতে পেছনে লেগেছিস?”

মাহাদ শান্ত সুরে বললো
-“প্লিজ আংকেল।বাবা আর চাচু কে কিছু বলবেন না।এটা সম্পূর্ণ আমাদের ডিসিশন।এতে তাদের কোনো দোষ নেই।”

আশরাফ হুসাইন রেগে বললো
-“তোর মতো বেয়াদব ছেলের কাছে এর চাইতে বেশি কিছু আশাই করা যায় না।”

শামসুন্নাহার বেগম তেতে উঠল।নিজের ছেলেদের অপমান তিনি কিছুতেই সইবে না।গলা ছেড়ে বললো

-“ওই জল্লাদের বাচ্চা।আমার পোলা আর নাতিরে কিছুই কবি না।আমার নাতির দোষ কি?নিজের মাইয়া সামলাইতে পারস না?তোর মাইয়া আমার নাতিরে রূপে ভুলাইছে।আমার নাতি তোর মাইয়ারে ভালা পায়।নাইলে তোর মতো ছোটলোকের বাড়িত থাইকা আমরা মাইয়া আনিনা।আমার পোলা তোর বইনের চাইছিলো।কিন্তু তুই এক জল্লাদের কাছে বোনরে বিয়া দিলি।কই সংসার করতে পারছে?তুই নিজে অমানুষ আর বোনরে ও আরেক অমানুষের হাতে তুইলা দিছস।আমার পোলা কি খারাপ রাখতো?মানিকে যেমন মানিক চিনে।অমানুষ তেমন অমানুষ চেনে।নিজে যেমন বউ পিডাস বইনরেও তেমন বেডার কাছে দিছস।

আরে তোর কীর্তি সবার জানা।মেয়র হওয়ার লাগি কয়েক বছর ধইরা ভদ্র সাজছোস।নাইলে তোর মতো জানোয়ারের আমার চিনা আছে।”

অপমানে আশরাফের পুরো শরীর রী রী করে উঠলো।রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।এই বুড়ির জায়গাতে অন্য কেউ থাকলে এতো ক্ষণে পরপারে পাঠিয়ে দিতো।
আনোয়ার হুসাইন প্রচন্ড রেগে বললো

-“আমজাদ তোর মাকে সামলা।তোরা যদি এতই ভালো হইতি তাইলে আমাদের বাড়ির মেয়েকে ভাগাইয়া আনতি না।তোদের নামে মামলা দিবো। কিডন্যাপের মামলা।মাইয়া দেখলে তোদের মাথা ঠিক থাকে না।আমরা বউ সামলাইতে জানি।বউয়ের আঁচলে বইসা থাকা তোদের কাজ।”

শামসুন্নাহার বেগম রেগে বললো
-“আরে ছাগলের বাচ্চারা।তোগো বাপ যেমন আছিলো তোরাও তেমন।তোর কীর্তি ও কম নাই।বউ পিডানো যদি সামলানো হয় তাইলে ঘরে ঘরে তোগো মতো কাপুরুষ থাকতো।মাইয়া মানুষের সম্মান কেমনে দিতে হয় তোরা জানবি কেমনে?”

আমজাদ রহমান নিজের মাকে থামলেন।আশরাফ হুসাইন প্রচন্ড রেগে দৃশ্যর সামনে যেয়ে এক থাপ্পর বসিয়ে দিলেন।দৃশ্য ধপ করে ফ্লোরে পড়ে গেলো গেলো।ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন

-“তোর মতো বেয়াদব মেয়েকে জন্ম দেওয়া আমার ভুল হইছে। ছোট বেলায় বিষ খাইয়ে মেরে ফেললে আজ এই দিন দেখতে হতো না।”

চোখের পলকে এমন কিছু হবে মাহাদ ভাবতেই পারেনি।সে দ্রুত দৃশ্যকে ধরে উঠালো।দৃশ্য গাল লাল হয়ে গেছে।চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।

মাহাদের রাগ বেড়ে গেলো।এই লোকটা দৃশ্যকে সেদিনও নির্মম ভাবে আঘাত করেছে।আজ আবার করছে।মাহাদ গম্ভীর স্বরে বললো

-“আপনি আমার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলতে পারেন না।আগে সে আপনার মেয়ে ছিলো।কিন্তু এখন সে আমার স্ত্রী।আমার স্ত্রীর গায়ে সামান্য তম আঘাত আমি সহ্য করবো না।বউ পিটানোর সভ্যাব আপনার থাকতে পারে,কিন্তু আমার নেই।”

এতো সময় ফাহিম নিজের বাবা সম্পর্কে এতো কিছু সহ্য করলেও এবার আর পারলো না।সে দ্রুত ছুটে এসে মাহাদকে মারতে শুরু করলো।তানিম আর জয় মিলেও কিছুতেই ছাড়তে পারছে না।রিজভী আর ওর বন্ধুরা ফাহিমকে থামাতে পারছে না।ফাহিমের মধ্যে যেনো অসীম শক্তি ভর করেছে।
দৃশ্য ফ্লোরে বসে চিৎকার করে কাদতে লাগলো।বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে।কে ভুল কে সঠিক সেটা সে জানে না।শুধু জানে তার স্বামীর গায়ের আঘাত গুলি তার গায়ে কাঁটার মতো বিদছে।নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছে।

আরিফ নিজেও কিছুতেই ফাহিমকে থামাতে পারছে না।আশরাফ যেনো মনে মনে খুশি হলো।সে কিছুতেই ছেলেকে থামাতে আসলো না।দৃশ্য দৌড়ে এসে ফাহিমকে থামাতে চেষ্টা করতে লাগলো।ভাইয়ের পায়ে ধরে কাদতে কাদতে বললো

-“ভাইয়া ছার ওকে।ও মরে যাবে।প্লিজ ভাইয়া।ওর কোনো দোষ নেই।”

ফাহিম ক্ষিপ্ত হয়ে দৃশ্যকে এক ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। মাহাদকে ছেড়ে দৃশ্যকে মারতে লাগলো।আজ যেনো সে নিজের মধ্যে নেই।মাথায় শুধু এটাই আছে দৃশ্যর বোকামির জন্য বাবা চাচাকে এতো খারাপ কথা শুনতে হলো।তার বাবা কোনো দিন তার মায়ের গায়ে হাত তুলতেই পারে না।অথচ এই পরিবারের সবাই কেমন মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছে।সে তার বাবাকে ভীষণ সম্মান করে।তার নামে বাজে কথা সে সহ্য করবে না।

মাহাদ এতো সময় ইচ্ছে করে ফাহিমের গায়ে হাত তুলেনি।এই ভাইকে দৃশ্য খুব ভালোবাসে।তার গায়ে হাত তুললে দৃশ্য কষ্ট পাবে।কিন্তু এখন সে এই ফাহিমকে কিছুতেই ছাড়বে না।তার সামনে তার স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার শাস্তি সে পাবে।
মাহাদ রেগে ফাহিমকে দৃশ্যর কাছথেকে দূরে সরিয়ে মুখ বরাবর কয়েকটা ঘুসি মেরে বসলো।আর চিৎকার করে বললো

-“আমার দৃশ্যর গায়ে কোন সাহসে হাত তুলেছিস?এই হাত আজ আমি ভেঙে ফেলবো।তোরা বাপ ছেলে এক।মেয়েদের গায়ে হাত তুলে ক্ষমতা দেখাস?তোরা সব কাপুরুষের দল।”

রিজভী আর তার বন্ধুরা ফাহিমকে বাঁচাতে মাহাকে মারতে গেলে মাহাদের বন্ধুরা পাল্টা তাদের মারতে লাগলো।
মুহূর্তেই পরিবেশ ভীষণ গরম হয়ে গেলো।দুই পক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়ে গেলো।কেউ যেনো হারতে রাজিনা।

দৃশ্য চিৎকার করে কাদঁছে।তার প্রিয় দুইজন মানুষ এইভাবে সংঘর্ষে মেতে উঠেছে।কাকে থামবে সে? এরা যে একে অপরকে শেষ করেই দম নিবে।পরিস্থিতি এতটা খারাপ হবে সে ভাবতেই পারেনি।

আমজাদ রহমান এই পরিস্থিতি দেখে কি করবেন ভেবে পাচ্ছে না।বুকের বেথা বাড়তে লাগলো।আখি রহমান কাদছেন।আর শামসুন্নাহার বেগম বিলাপ করছেন।এই পরিস্থিতি তাদের জীবনকে কোথায় নিয়ে যাবে?

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_38

পশ্চিম আকাশে রক্তিম সূর্যটা ডুবে গেছে অনেকক্ষণ আগে।রাজশাহী শহরের দুই প্রভাবশালী পরিবারে তখনও চলছে সংঘর্ষ। এ যেনো ক্ষমতার লড়াই।নিজেদের শক্তি জাহির করার লড়াই।

আমরিন আখি রহমানকে জড়িয়ে ধরে আছে।চোখের সামনে এমন অবস্থা দেখে তিনি ভীষণ ভেঙে পড়েছে।আমরিন এর চোখ পড়ে দৃশ্যর দিকে।গোলাপি আভা মিশ্রিত এক নতুন বউ যার আর্তনাদের শব্দ সবচাইতে বেশি শোনা যাচ্ছে।হবে নাইবা কেনো?দুই পক্ষই তার আপনজন।যেই জিতুক হার তো তারই। চোখের কাজল লেপ্টে এলোমেলো অবস্থায় মেয়েটাকে কি মারাত্মক লাগছে।আচ্ছা সেও তো অনেক সুন্দর।কিন্তু বউ সাজে তাকে কি ঠিক এতটা মায়াবী লাগবে?দৃশ্যর গালে আঙ্গুলের ছাপ।এই দুর্বিষহ অবস্থায় ও মেয়েটাকে কেমন মায়াবতী লাগছে। মাহাদ ভাইয়া নিশ্চয়ই এই মায়ায় আটকে গেছিলো।বউ সাজার পরও মেয়েটার মধ্যে একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব রয়ে গেছে।এই মুহূর্তে এই মেয়েটার উপর ভীষণ হিংসে হচ্ছে তার।

ঠিক সেই সময় বাসায় হন্ত দ্বন্ত হয়ে প্রবেশ করে মাহিম।সে বাইরে থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে দৌড়ে আসে।কিন্তু বাসায় পৌছে এই পরিস্থিতি দেখে হতবম্ব হয়ে যায়।বিকেলে তার ভাই কল করে জানিয়েছে সে বিয়ে করে বাড়িতে বউ নিয়ে আসছে।কথাটা শুনে প্রথমে মাহিম চমকে গেলেও পড়ে ভীষণ খুশি হয়েছে।ওই বাচ্চা মেয়েটা ভাবী হিসেবে একদম পারফেক্ট।দেখতেও পুতুল।কিন্তু তার ভাইয়ের এতো কিসের তারা বিয়ে করার?ভেবেছে বাসায় আজ দাদীর একটু ড্রামা দেখবে।এই বুড়ি একটা ড্রামাবাজ।তবে আজকের ড্রামাটা অনেক ইন্টারেস্টিং হবে।কিন্তু এই জায়গাতে তো অন্য কাহিনী চলছে।তার ভাই নিজের শালার সাথেই যুদ্ধ শুরু করেছে।তবে বিষয়টা অনেকটা সিরিয়াস পর্যায় পৌঁছে গেছে সেটা বুঝতে একটু সময় লাগলো।

আমজাদ রহমান কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। মাহাদ আর ফাহিম একে অন্যকে আঘাত করছে।যেনো কোনো প্রতিযোগিতা চলছে।শামসুন্নাহার বেগম বিলাপ করে বলছেন

-“আমার নাতির কেউ বাঁচা।ওই জল্লাদের বংশ আমার নাতিরে শেষ কইরা ফালাইবো।ওই কেউ ধর।”

আরিফ মাহাদ আর ফাহিম কে থামানোর চেষ্টা করছে।মাহিম দৌড়ে গেলো মাহাদকে ছাড়াতে।মাহিম বললো

-“ভাই কি শুরু করেছো?থামো বলছি।”

মাহাদ ক্ষিপ্ত হয়ে বললো
-“ছার আমাকে।একেতো আজ মেরেই ফেলবো।ওরা বাবাকে অপমান করেছে।আর আমার দৃশ্যর গায়ে কতবার হাত তুলেছে জানিস? সব কয়টার হাত ভাঙবো আমি।”

ফাহিম একটা ঘুসি দিয়ে চেঁচিয়ে বললো
-“আস দেখি কে কার হাত ভাঙ্গে। মেয়েবাজ কোথাকার।মেয়ে দেখলে তোদের মাথা ঠিক থাকে না।আমার বোনের দিকে বদ নজর দিয়েছিস?তোর চোখ উপড়ে ফেলবো।”

-“আরে শালা তোর বোন আমার বউ।ওর দিকে আমি যেমন খুশি তেমন নজর দিবো।তুই বলার কে?”

-“কিসের বউ।আমার বোনকে কোনোদিনই তোর হাতে তুলে দিবো না।”

-“আমার বউকে তুই তুলে দেওয়ার কে?”

এই বলে এদের মধ্যে আবার ঝামেলা শুরু হয়েছে।
মাহাদের বুকটা জ্বলে যাচ্ছে।তার চোখের সামনে এই মানুষ গুলি বাবা আর চাচু কে অপমান করে যাচ্ছে।তার ভালোবাসা,তার স্ত্রীর গায়ে হাত তুলছে।আজ সে কিছুতেই এদের ছাড়বে না।সব কটাকে মাটিতে পুঁতে ফেলবে।
আশরাফ হুসাইন এই ঝামেলার মাঝে দৃশ্যর সামনে এসে তার হাত ধরে দার করালো।আর বললো

-“তোর মতো কুলাঙ্গার মেয়ের জন্য আজ এই দিন দেখতে হচ্ছে।চল এক্ষনি এখান থেকে।আর এক মিনিটও এই জায়গায় থাকবো না।”

দৃশ্য কাদতে কাদতে বললো
-“আমি কোথাও যাবনা বাবা। মাহাদ কে ছেড়ে আমি যাবো না। ও আমার স্বামী।ওকে ছেড়ে আমি থাকতে পারবো না।”

আশরাফ প্রচন্ড রেগে আবার দৃশ্যর গালে একটা থাপ্পর বসিয়ে বললেন
-“তুই যাবিনা তর ঘাড় যাবে।আমি মানিনা এই বিয়ে।আমার মান সম্মান ধূলায় মিশিয়ে ছেরেছিস তুই।তোর নিস্তার নাই আজ।”

-“বাবা প্লিজ আমি যাবো না।তুমি না মানলেও ওই মানুষটা আমার স্বামী।ওই মানুষটার হাত আমি কোনোদিন ছাড়বো না।”

-“চুপ বেয়াদব।তোর মতো মেয়েকে জন্মের সময় মেরে ফেলা উচিত ছিলো। নষ্টা মেয়ে কোথাকার।”

আশরাফ প্রচন্ড রেগে দৃশ্যর হাত ধরে দরজার কাছে নিয়ে যেতে চাইলে আমজাদ রহমান সামনে দাড়ায়। এতক্ষণ তিনি সব মুখ বুজে সহ্য করলেও এখন আর পারলেন না।তিনি কঠিন সুরে বললেন

-“আশরাফ বৌমার হাত ছারো।আমার ঘরের লক্ষীকে এই ভাবে নিয়ে যেতে পারবে না।যে ভাবেই হোক বিয়েটা তো হয়েছে।সেটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না।তাই সে তার স্বামীর বাসায় থাকবে।”

আশরাফ হুসাইন ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন
-“আমার মেয়ে আমি নিয়ে যাবো।দেখি কে আটকায়।”

-“আমি আটকাবো।দেখ এই সব ঝামেলা করে কোনো লাভ হবে না।আমার ছেলে যেহেতু বিয়ে করেছে সেহেতু দৃশ্য এখানেই থাকবে।বৌমা যদি যেতে চাইতো আমি মানা করতাম না।কিন্তু তুমি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যাচ্ছো সেটা আমি হতে দিতে পারিনা।”

রাগে আশরাফ হুসেনের কপালের রগ ফুলে উঠেছে।এই মানুষটির সামনে সে কখনোই মাথা নত করবে না।সে জোর করে দৃশ্যকে নিয়ে যেতে চাইলে আমজাদ রহমান তাকে সামনে দাড়িয়ে বাধা দেয়।আশরাফ হুসাইন রেগে হিতাহিত জ্ঞান ভুলে আমজাদ রহমানকে বুকে জোরে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয়।

আমজাদ রহমান সোজা যেয়ে পড়ে পাশের ছোট কাচের টেবিলে।সাথে সাথে টেবিলের কাচ ভেঙে বিকট শব্দ হয়।দৃশ্য চিৎকার দিয়ে উঠে।আখি রহমান অস্থির চোখে সে দিকে তাকিয়ে আছে। মাহাদ আর ফাহিম নিজেদের মারামারি ভুলে দাড়িয়ে পড়ে। মাহাদের হাত কাপছে।মুহূর্তের মধ্যেই কি হয়ে গেলো কেউ বুঝতে পারলো না।

আমজাদ রহমানের কপাল বেয়ে রক্ত ঝরে পড়ছে।তিনি উঠে বসতে চাইলেন।কিন্তু বুকের তীব্র ব্যাথায় কিছুতেই উঠতে পারছে না।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।তিনি জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন। মাহাদ দৌড়ে বাবার কাছে এসে বসলো। মাহিম আর আরিফও দৌড়ে আসলো। মাহাদ জোরে কাদতে লাগলো আর বললো

-“বাবা তুমি ঠিক আছো?কষ্ট হচ্ছে তোমার?এই মাহিম জলদি গাড়ি বের কর।বাবাকে হসপিটালে নিতে হবে।বাবা!বাবা! কথা বলো বাবা?”

আমজাদ রহমান এক পলক ছেলেকে দেখলো।ছেলেটা বাচ্চাদের মতো করছে।ঠিক যেমন ছোট বেলায় করতো।বাবা বলতে পাগল ছেলেটা। মাহিম কি করবে ভেবে পাচ্ছে না।দৌড়ে গেলো গাড়ি বের করতে।কিন্তু আদো গাড়ি চালাতে পারবে কিনা সন্দেহ।

মাহাদের মামা কিছু বুঝতে পেরে আমজাদ রহমানের বুকে ঘসতে লাগলেন।আখি রহমান শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের রক্ত মুছে দিচ্ছেন।দৃশ্য দৌড়ে আমজাদ রহমানের পায়ের কাছে বসে পড়লো।তার দেখা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষটির আজ এই অবস্থা।

মাহাদের মামা প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে আশরাফ হুসাইন এর কলার চেপে ধরে শাসিয়ে বললেন

-“তোমার সাহস কি করে হয় আমজাদ ভাইয়ের গায়ে হাত তোলার?এতো অহংকার?তোমার এই ক্ষমতার বড়াই খুব শীগ্রই শেষ করবো।আজ ভাইজানের কিছু হলে তোমাকে আমি ছাড়বো না।তোমার মেয়েকে যে ভাইজান বাড়ির লক্ষ্মী বলে শিকার করেছে এটাই তোমার সাত কপালের ভাগ্য।নেহাত মাহাদ তোমার মেয়েকে ভালোবাসে বলে।নাহলে আমার ভাইজানের নখের যোগ্যতা তোমার নেই।”

শামসুন্নাহার বেগম প্রচন্ড রেগে বললো
-“জানোয়ারের বাচ্চা তোর কোনোদিন ভালা হইবো না।তোর অহংকার একদিন খোইসা খোইসা পারবো।আমার সোনার টুকরা পোলার গায়ে হাত দিছস।আল্লাহর গজব পড়বো তোর উপরে।তোর মতো জল্লাদের মাইয়া আমি বাড়িতে তুলুম না।বের হয় এক্ষনি।তোর অলক্ষী মাইয়া নিয়া বাইর হো আমার বাইত থাইকা।”

আশরাফ হুসাইন নিজেও বুঝতে পারেননি এমন কিছু হয়ে যাবে।কিন্তু যায় হয়েছে তাতে তার বিন্দু মাত্র আফসোস নেই।তবে এদের কথা শুনে রাগটা আবার বাড়তে লাগলো।এতো অপমান কেউ কোনোদিন করেনি।আজ এই বদমাইশ মেয়ের জন্য কতো কথা শুনতে হচ্ছে।এই মেয়েকে তো আজ সে কেটে টুকরা টুকরা করবে।প্রচন্ড আক্রোশে ফেটে পড়ছে তিনি।দ্রুত দৃশ্যর হাত ধরে টানতে লাগলেন।দৃশ্য চিৎকার করে কাদঁছে।আর বার বার হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।চিৎকার করে কাদতে কাদতে বললো

-“বাবা ছাড়ো আমাকে।আমি কোথাও যাবো না।এতো নিষ্ঠুর হইও না।আংকেল কষ্ট পাচ্ছে।আমাকে তার পাশে থাকতে দাও।বাবা প্লিজ। মাহাদ!মাহাদ! প্লিজ বাবাকে কিছু বলো।আমি কোথাও যাবো না।ভাইয়া প্লিজ বাবাকে বল আমাকে ছেড়ে দিতে।”

মাহাদ বাবার মাথা বুকে নিয়ে চোখের জল ফেলছে।দৃশ্যর চিৎকার শুনে একবার দৃশ্যর দিকে তাকালো।পরক্ষনেই বাবাকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

ফাহিম অবাক চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।তার বাবা এমন একটা কাজ করতে পারবে ভাবতেই পারেনি।সে আর মাহাদ মারামারি করছে মানা যায়।তাদের বয়স কম।রক্ত গরম।কিন্তু তার বাবা এমনটা কি করে করলো?তার মধ্যে কি বিন্দু মাত্র আফসোস কাজ করছে না? এ কোন বাবাকে দেখছে সে।

আশরাফ জোর করে টেনে হিচরে দৃশ্যকে সেখান থেকে নিয়ে আসলো।দৃশ্য ভেজা চোখে মাহাদ আর আমজাদ রহমানকে দেখে যাচ্ছিলো। মাহাদরাও দ্রুত হসপিটালের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো তখন।

বাড়িতে পৌঁছে মেয়েকে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললেন আশরাফ।দৃশ্য তখন কনুইতে অনেক বেথা পেলো।আনিকা কবির চিৎকার দিয়ে দৃশ্যকে জড়িয়ে ধরলেন।আশরাফ হোসাইন পায়ের জুতা খুলে দৃশ্যকে মারতে লাগলো।আনিকা কবির কেদে বললেন

-“আমার মেয়েকে আবার কেনো মারছেন?”

-“তোর কুলাঙ্গার মেয়ে কি করেছে জানিস?সে পালিয়ে ওই ছেলেকে বিয়ে করেছে।তুই না বলতি তোর মেয়ে ছোট বাচ্চা।তাইলে এতো কিছু কেমন করে করলো? আজ ওর বিয়ে করার সখ জন্মের মতো ঘুচিয়ে দিবো।”

ফাহিম দৌড়ে বাসায় আসতেই দেখলো বাবা দৃশ্যকে জুতা দিয়ে অনবরত মেরে যাচ্ছে।কয়েকটা বারি মায়ের গায়েও পড়ছে।সে দ্রুত দৌড়ে এসে বাবাকে থামালো আর বললো

-“বাবা প্লিজ থামুন।পাগল হয়ে গেছেন?এই ভাবে মারলে তো ও মরেই যাবে।কি করছেন এইসব।সরুন!”

ফাহিম ঠেলে বাবাকে সরিয়ে দৃশ্যর দিকে তাকালো।দৃশ্য ততক্ষণে অচেতন হয়ে ফ্লোরে পড়ে গেছে।তার দুই গাল টকটকে লাল হয়ে গেছে।হাতের কোথাও কোথাও দাগ হয়ে রক্ত জমাট বেধে গেছে।সে দৃশ্যর কাধ ঝাকিয়ে ডাকতে লাগলো।

-“দৃশ্য!দৃশ্য চোখ খোল। পাখি আমার কি হলো তোর?”

আনিকা কবির কেঁদে কেঁদে বললেন
-“মনে হয় সেন্সলেস হয়ে গেছে। ওকে দ্রুত রুমে নিয়ে চল।”

ফাহিম দ্রুত দৃশ্যকে কোলে তুলে রুমে নিয়ে গেলো।
মাহাদ হসপিটালের করিডোরে বসে আছে।চোখ যেনো আজ কোনো বাধা মানছে না।মাহিম অস্থির হয়ে পায়চারি করছে।আখি রহমান চেয়ারে বসে কান্নায় ভেঙে পড়েছে।আর আরিফ সবাইকে পর্যবেক্ষণ করছে।বিষয়টা এমন জটিল হবে সে ভাবতেই পারেনি।তাহলে হয়তো আর এমনটা করতো না।আশরাফ যে এমন একটা কাজ করে বসবে সে ভাবতেই পারেনি।

মাহাদ কিছুই ভাবতে পারছে না। আজ বাবার কিছু হয়ে গেলে নিজেকে কিছুতেই ক্ষমা করতে পারবে না।কিছুক্ষণ পর ডক্টর বেরিয়ে এসে জানালেন আমজাদ রহমান স্ট্রোক করেছেন।মেন্টাল প্রেসার আর বুকে প্রচন্ড চাপ পড়ায় এমনটা হয়েছে।আর তাছাড়া তার বুকে হয়তো আগে থেকেই ব্যাথা ছিলো।যেটা তিনি হয়তো গুরুত্ব দেয়নি। অবস্থা খুব একটা ভালো না।তারা কিছু সময় অবজারভেশনে রাখবেন।
কথাটা শুনে মাহাদের পরিবারে যেনো শোকের ছায়া নেমে গেলো। মাহাদ সেখানেই স্থির হয়ে গেলো।বাবা যে তার সবচাইতে ভালো বন্ধু।যার কাছে সে নিজের মনের কথা নির্দ্বিধায় বলে দেয়।এই মানুষটার কিছু হলে সে নিঃশেষে হয়ে যাবে।আরিফ মাহাদের কাধে হাত রাখতেই মাহাদ তার চাচু কে জড়িয়ে ধরলো।কাধে মুখ লুকিয়ে ফুপাতে লাগলো।বুকটা তার ফেটে যাচ্ছে।পরিস্থিতি এতটাই বেগতিক যে সে কিছুই সামলে উঠতে পারছে না।

তার ঠিক দুই দিন পর তাদের জীবনে সবচাইতে বড় ঝড় আসে।প্রথম দিকে আমজাদ রহমান কিছুটা ভালো থাকেও পরে তার শরীর বেশি খারাপ হতে থাকে।দৃশ্য বাসা থেকে লুকিয়ে একবার হসপিটালে আসলেও শামসুন্নাহার বেগম তাকে আমজাদ রহমানের সাথে দেখা করতে দেয়নি।দৃশ্য অনেক বার মিনতি করেও শশুরের সাথে দেখা করতে পারেনি।বরং অনেক বকা ঝকা করে বের করে দিয়েছেন।তাদের মনের অবস্থা চিন্তা করে দৃশ্য আর জেদ করেনি।কিন্তু দৃশ্যর কিশোরী মন একটাবার নিজের স্বামী দেখা পেতে চেয়েছিল।মানুষটা ঠিক আছেতো?কিন্তু মাহাদের দেখা পায়নি।সে আমজাদ রহমানের কাছে কেবিনে ছিলো।বাচ্চা মেয়েটা সেদিন কাদতে কাদতে বাসায় ফিরেছিল।

পুরো বিষয়টি নিয়ে ফাহিমের মধ্যে খারাপ লাগা কাজ করছিল। মাহাদকে সে পছন্দ না করলো কেনো যেনো আমজাদ রহমানের প্রতি তার একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করতো।এই মানুষটার সম্পর্কে সে একমাত্র তার বাবা ছাড়া আর কারো কাছে কোনো খারাপ কথা শুনেনি।বরং প্রশংসাই শুনেছে।সে নিজেও রাজনীতিতে যুক্ত।একজন আদর্শ নেতার মধ্যে ঠিক যেমন গুন থাকে আমজাদ রহমানের মধ্যে সবই আছে।কিন্তু নিজের ফুপির বিষয়টা জানার পর ওই পরিবারের প্রতি একটা অদৃশ্য রাগ রয়ে গেছিলো।যা সময়ের সাথে সাথে বাড়তে থাকে।আর প্রায় সময় মাহাদের সাথে তার ঝামেলা বেধে যেতো।যার ফলে সে আরো ওই পরিবারকে ঘৃণা করতে থাকে।কিন্তু আজ এতো কিছুর পর একটা অদৃশ্য অপরাধ বোধ কাজ করছে।তাই সে লুকিয়ে একবার হসপিটালে যায় আমজাদ রহমানকে দেখতে।

তার পরদিন আমজাদ রহমান পৃথিবীর মায়া তেগ করেন।কথাটা শোনা মাত্র আখি রহমান অচেতন হয়ে ফ্লোরে পড়ে যান।মানুটিকে তিনি ভীষণ ভালোবাসে।আর মানুষটাও তাকে সবসময় আদর,যত্ন আর সম্মান করতো।বন্ধু মহলে সবাই তাকে বউ পাগলা উপাধিও দিয়েছে।আজ সে পাশে নেই সেটা যেনো ভাবতেই পারছেন না।

মাহিম বাবাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কাদতে থাকে।তার মামা জোর করে তাকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। মাহাদ কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে যায়।তার কান এই কথাটা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারেনি।সে বাবার লাশের পাশে বসে মাথাটা কোলে তুলে নেয়।অজস্র চুমুতে ভরিয়ে তুলে বাবার মুখে।ছোট বেলাতেও নাকি সে এই কাজ করতো।বাবার পুরো মুখে লালায় ভরিয়ে চুমু খেতো।আর বলতো

-“আমাল বাবা বেস্ট। আমাল বাবা বেস্ট।”

আর আমজাদ রহমান হেসে বলতেন
-“উঁহু!আমার রাজপুত্র বেস্ট।”

কথাটা মনে পড়তেই মাহাদের বুকটা ধক করে উঠলো।সে বাবাকে ঝাকিয়ে বলতে লাগলো

-“বাবা উঠো প্লিজ।চোখ খোল।এই দেখো আমি কান ধরছি।আর কোনো দিন তোমার কথার অবাধ্য হবো না।চোখ খোল বাবা।আমার উপর অভিমান করে এমন করছো তাই না?উঠনা বাবা।তুমি না বলেছিলে আমার প্রথম গানের অ্যালবামের গানে তুমি ডান্স করবে? আর সবচাইতে রোমান্টিক সঙ্গে মায়ের সাথে কাপল ডান্স করবে?আমি কিন্তু মাকে বলিনি আমার প্রথম অ্যালবামের কথা।তুমি বলেছিলে যেদিন বের হবে সেদিন মাকে সারপ্রাইজ দিবে?তাহলে এমন করছো কেনো?আমাকে রকস্টার হতে দেখতে চেয়ে ছিলে না? তাহলে এতো জলদি কেনো চলে যাচ্ছো?”

আরিফ পাশে দাড়িয়ে কাদঁছে আর মাহাদের পাগলামি দেখছে।নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে।হয়তো তার ডিসিশন ভুল ছিলো।যার কারণে তার ভাই আজ চলে গেলো।শামসুন্নাহার বেগম ফ্লোরে বসে কখনো বুক চাপড়াচ্ছেন তো কখনো মাথা চাপড়াচ্ছেন। কাদতে কাদতে বির বির করছেন

-“আব্বা।আমার আব্বা কই গেলা?মায়ের বুক খালি কইরা কই গেলা আব্বা।আমারেও নিয়ে যাও আব্বা।এই নিষ্ঠুর দুনিয়ায় আমারে ফালায়া কই গেলা আব্বা?”

মাহাদ বাবাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদতে লাগলো। এ যেনো এক হৃদয় বিদারক কান্না।তার আর্তনাদে পুরো হসপিটাল গরম হয়ে উঠলো।আসে পাশে মানুষ জন তাকে দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারছে না।এক সুদর্শন যুবক তার বাবাকে কোলে নিয়ে বাচ্চাদের মতো কাদছে। এর চাইতে মর্মান্তিক দৃশ্য আর কি হতে পারে?
মাহাদ চিৎকার করে বলছে

-“বাবা আমাকে ছেড়ে যেও না।আমি একা হয়ে যাবো।তোমাকে ছাড়া আমি কি করে থাকবো?মায়ের বকুনি থেকে আমাকে কে বাঁচাবে?আমাকে কে বড়ো রাজপুত্র বলে ডাকবে?আর মাহিম?ও কে না ডক্টর হতে দেখতে চেয়েছো? আরতো মাত্র কয়েকদিন।তার পরই তোমার ছোটো রাজপুত্র ডক্টর হয়ে যাবে।তুমি বলেছিলে তার প্রথম পেশেন্ট হবে তুমি।তাহলে এক্ষনি কেনো চলে যাচ্ছো?তুমি চলে গেলে বাবা বলবো কাকে?আমাকে এতিম করে যেওনা বাবা।মাকে কি জবাব দিব আমি?সব আমার জন্য হয়েছে।আমার জন্য হয়েছে।সব আমার দোষ।”

এই বলে মাহাদ পাগলামি করতে লাগলো।পাশের টেবিল থেকে একটা ছুরি দিয়ে হতে হাতে একটা আঁচড় কাটলো।সাথে সাথে চুয়ে চুয়ে রক্ত পড়তে লাগলো।আঘাতটা তেমন একটা গভীর না হওয়াতে সে আবার আঘাত করতে যাবে তখনই আরিফ আর তার ছোট মামা আটকায়। মাহাদ নিজেকে আঘাত করার জন্য পাগলামি শুরু করে।আর বলতে থাকে

-“চাচু ছাড়ো আমাকে।আমার জন্য বাবা চলে গেছে।আমার সাথে অভিমান করে বাবা চলে গেছে।আমি খুব কষ্ট দিয়েছি বাবাকে।আমার জন্য বাবা এতো অপমানিত হয়েছে।আমি শেষ করে ফেলবো নিজেকে।”

আরিফ মাহাদের মাথা বুকে চেপে ধরে।আর মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে থাকে

-“শান্ত হো মাহাদ।এমন পাগলামি করিস না।তোর কিছু হলে তোর মায়ের কি হবে ভেবেছিস?তোর ভাইয়ের কি হবে?তাদের যে তোকেই সামলাতে হবে।আর ভাইয়া তোর উপর কোনো অভিমান করেনি।সে সব সময় তোদের সুখে দেখতে চেয়েছে।এমন করলে ভাইয়া কষ্ট পাবে। এখন তোকে শক্ত হতে হবে।বাবার সব স্বপ্ন পূরণ করতে হবে।এমন পাগলামি করিস না।”

মাহাদ চাচু কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো।আরিফ কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেনা এই ধাক্কাটা মাহাদ কি করে সামলাবে। এই ঝড় যে মাহাদ আর দৃশ্যর জীবনে জলোচ্ছাস নিয়ে আসবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here