তোমার_আমার_প্রণয়,51,52

0
1318

#তোমার_আমার_প্রণয়,51,52
#israt_jahan_arina
#part_51

শো শো আওয়াজের বাতাস চলছে। কয়েকটা নাম না জানা পাখি ডানা ঝাপটিয়ে কালো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। অদ্ভুত একটা স্তব্ধ পরিবেশ। একজোড়া কপোত-কপোতী নিস্তব্ধ হয়ে চোখের জল ফেলছে। কিন্তু কেউ কারো চোখের জল মুছে দিতে পারছে না। মুখোমুখি বসা মানুষ দুজন আপন হলেও আজ সময়ের ব্যবধানে পাশাপাশি থেকেও ছুঁয়ে দেখতে পারছেনা। অদৃশ্য দেয়াল দুজন মানুষকে আলাদা করে রেখেছে।

দৃশ্য দুহাতে চোখের অশ্রু কনা মুছে গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নিলো।একপলক মাহাদের দিকে তাকালো।সামনে মাথা নিচু করে অশ্রু ঝরানো মানুষটা তার স্বামী।এই সুদর্শন পুরুষটি তার একান্ত ব্যাক্তিগত হয়েও তার না।ছেলেদের নাকি কাদতে নেই।তবে সামনে বসা সুদর্শন পুরুষটির মতো মায়া জড়ানো কান্না দেখে দৃশ্যর মনে হলো পুরুষদের কাদা উচিৎ।মেয়েদের ও অধিকার আছে এই সৌন্দর্য দেখার।দৃশ্যর ইচ্ছে হচ্ছে সামনের মানুষটির লাল হওয়া নাকে একটা বিষাক্ত কামড় বসিয়ে দিতে।তখন কি এই লাল নাকটা নীল হয়ে যাবে?
দৃশ্য কোমল স্বরে বললো

-“এতো কিছু তোমাকে কেনো জানিয়েছি জানো?”

মাহাদ মাথা তুলে তাকাতে পড়লো না।তার চিৎকার করে কাদতে মন চাইছে।সামনে বসা তার হৃদয় হরিণী কে জাপটে ধরে কাদতে মন চাইছে।দৃশ্য আবার বললো

-“জীবনের অনেক প্রতিকূল পরিবেশ আমি এক্সপেরিয়েন্স করেছি।শারীরিক,মানুষিক,আর্থিক সব সমস্যার মধ্যদিয়ে আমি গেছি।তাই এখন আর কোনো কিছুতে ভয় পাইনা।যে কোনো পরিস্থিতিতে নিজেকে সামলাতে শিখে গেছি।পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে আমি ঝরে পড়িনি মাহাদ।তুমি হয়তো ভাবতে পারো আমি একা কি করে চলবো? বাট ট্রাস্ট মি আমার তোমার সাপোর্ট এর কোনো প্রয়োজন নেই।

আমার ভার্সিটির এক ফ্রেন্ডের বাবা আমাকে একটা জবের বেবস্থা করে দিয়েছে।আপাদত ছোট পোস্টে থাকবো। অনার্স কমপ্লিট হওয়ার পর সার্টিফিকেট পেয়ে বড় পোস্টের দিকে যাওয়ার সুযোগ আছে। তখন একটা স্ট্যাবল জব হবে।সামনের মাসে জয়েন করব আমি সেখানে। সুপার শপের জবটা একটা মাসই করবো।

আমি আমার এই লাইফে বেশ ভালো আছি। আমি সবসময়ই স্বাধীনভাবে চলতে চাইতাম। কিন্তু কোনদিনই সেটা পারিনি। কিন্তু এখন আমি স্বাধীনভাবে চলতে পারছি।যেখানে বাবার কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই। কারো কাছে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।আমি মুক্ত পাখির মতো উড়ে বেড়াতে পারছি।আমিতো এমন টাই চাইতাম।

তোমার এত ভালো একটা ক্যারিয়ার গ্রাফ তৈরি হয়েছে। আমি চাইনা অতীতের জন্য সেটা নষ্ট করো। আমি কখনোই একটা মাতাল অসভ্য রকস্টার মাহাদকে দেখতে চাইনি। আমি চেয়েছি আমার মাহাদকে সবাই ভালবাসুক। তোমার এসব কাজে আন্টি হয়তো ভীষণ কষ্ট পায়। সেই মানুষটার চোখে আমাকে আর অপরাধী করো না। হয়তো তোমার এই অবস্থানের জন্য তোমার পরিবার আমাকে দোষারোপ করে।আমার মনে তোমার জন্য কোনো ঘৃণা নেই মাহাদ।পারলে আমাকে আর আমার পরিবারকে ক্ষমা করে দিও।”

দৃশ্য উঠে দাড়ালো।এই জায়গায় আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না।সামনের মানুষটিকে এই অবস্থায় আরো কিছুক্ষন দেখলে হয়তো সে ভয়ঙ্কর কিছু করে বসবে।তার পর হয়তো আর এই মানুষটির কাছ থেকে দূরে থাকা সম্ভব না।দৃশ্য এক কদম সামনে এগিয়ে আবার পেছন ফিরে বললো

-“আমার পেছনে পড়ে জীবনটাকে শেষ করে দিও না।আমাদের ধারা আন্টি ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।পরোক্ষ ভাবে তার কষ্টের জন্য আমরা অপরাধী।তাই মানুষটাকে আর কষ্ট না দিয়ে মুভ অন করো।তিনি নিশ্চয়ই চায় তার ছেলে বিয়ে করে সংসার করুক।আমিও সেটাই চাই। আর বার বার আমার সামনের এসে যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিও না।যা সম্ভব না তার পেছনে ছুঁটে বেড়ানো বোকামি ছাড়া আর কিছুই না।”

মাহাদ যেনো আজ কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।বুক ফাটা চিৎকার আসছে।শুধু মাত্র তার জন্য তার প্রিয়তমা এতটা যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে গেছে।যেখানে এই মেয়েটার কোনো অপরাধই ছিলো না। মাহাদ পায়ে কারো স্পর্শ পেয়ে চমকে তাকালো।দেখলো দৃশ্য নিচু হয়ে বসে তার পায়ে সালাম করছে।হঠাৎ তার পায়ে তরল জাতীয় কিছু পড়লো।সে বুঝতে পারলো সেটা তার প্রিয়তমার অশ্রু ছিলো।সে দ্রুত দাড়িয়ে দৃশ্যকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে নিলো।শক্ত করে বুকের মাঝে ধরে হু হু করে কেঁদে দিল।তার অশ্রু ধারা দৃশ্যর গলা ভিজিয়ে দিচ্ছে।দৃশ্য ও মাহাদকে জড়িয়ে ধরলো।তার বুকে মুখ গুজে দিলো।উফফ!আবার সেই মাতাল করা ঘ্রাণ।আজ বহুদিন পর এই বুকে মাথা রাখতে পেরেছে দৃশ্য।মনে অদ্ভুত এক প্রশান্তি বয়ে যাচ্ছে।ভীষণ নিরাপদ এই জায়গাটা।সারাটা জীবন যদি এই ভাবে থাকা যেতো?সময়টা এই জায়গাতে থেমে গেলে ভীষণ ভালো হতো।

কিন্তু এই নিরাপদ স্থলে দৃশ্য থাকতে পারবে না।তাই দৃশ্য দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অস্থির কণ্ঠে বললো

-“আ..আমি চাইনা আমাদের আর দে…দেখা হোক।ভালো থেকো মাহাদ।”

দৃশ্য দ্রুত সেখান থেকে বেরিয়ে গেলো।আর মাহাদ হাঁটু গেড়ে সেখানেই বসে ফুঁপিয়ে কেদে উঠলো।সর্বোচ্চ অধিকার থাকার পরও সে আজ দৃশ্যকে আটকাতে পারেনি। এর চাইতে বড় শাস্তি আর কি হতে পারে?

রবিন নিচের ফ্লোরে দাড়িয়ে সিগারেটে সুখ টান দিতে ব্যাস্ত ছিলো।তখনই দেখলো দৃশ্য আসছে।সে হাতের সিগারেট ফেলে দ্রুত দৃশ্যর সামনে গেলো।মেয়েটার দুই চোখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে।চোখের কোনে জল জমে আছে।দৃশ্য রবিনকে বললো

-“ভাইয়া আপনার স্যারকে বাসায় নিয়ে যান। আমার মনে হয় না আজ স্বাভাবিকভাবে হেঁটে গাড়ি অব্দি যেতে পারবে। আজকের জন্য তাকে একা ছাড়বে না প্লিজ। পারলে জয় ভাইয়া কে তার পাশে থাকতে বলবেন। আপনার স্যারের খেয়াল রাখবেন ভাইয়া। আমি আসছি।”

রবিন হতভম্ব হয়ে দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল। মানুষ দুটোর মাঝে আসলে কি চলছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না। রবিনের বলতে ইচ্ছে করলো’ স্যারের পাশে আমার না,আপনার থাকা প্রয়োজন।’

রবিন দ্রুত উপরে উঠে দেখলো বিধস্ত মাহাদকে।যে ফ্লোরে বসে কাদঁছে। এই প্রথম সে এই মানুষটিকে কাদতে দেখছে। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের দুনিয়ায় মানুষের অনুভূতিগুলো নাকি ভোঁতা হয়ে যায়। কিন্তু তার সামনে থাকা মানুষটি আজ অনুভূতির জোয়ারে ভাসছে। বিধ্বস্ত অনুভূতি।সকাল থেকে ভীষণ এক্সাইটেড থাকা মানুষটা সন্ধ্যায় এসে কান্নায় ভেঙে পড়েছে।

রবিনের মনে হল এই ভালোবাসা জিনিসটাই খারাপ। সুখের চাইতে কষ্টের মাত্রা বেশি দেয় এই ভালোবাসা। জেরিনের সাথে তার যখনই ঝগড়া হয় এই মেয়েটা কয়েক দিন অবধি তার কোন কল রিসিভ করেনা। সেই সময় গুলো রবিন এর কাছে এক একটা বীভৎস দিনের মতো মনে হয়।কিন্তু কাজে ব্যস্ততার জন্য অনেক সময় সে মেয়েটার রাগ ভাঙাতে যেতে পারে না।

বর্ষা আয়নার সামনে দাড়িয়ে শাড়ি পরার চেষ্টা করছে।ভীষণ বিরক্ত সে মাহিমের উপর।আজ মাহিমের সাথে ঘুরতে বের হবে।আর ওই বাঁদরের আদেশ শাড়ি পরে আসতে হবে।তার ছোট হয়েও কেমন শাসন করে তাকে।বর্ষার নিজের কপাল নিজে চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।কেনো যে সেদিন এই ছাগলের সামনে শাড়ি পরে গেছিলো। এখন তো এই ছেলে একটু বেশিই রোমান্টিক হয়ে পড়েছে।বলে কিনা বিয়ের পর সব সময় শাড়ি পরেই থাকতে হবে। ভাবা যায় এসব?

বর্ষার বাবা অনেকক্ষণ যাবত মেয়ের কাণ্ড দেখছে।তবে শাড়ি পড়তে দেখে প্রথমে একটু অবাক হয়েছেন।তার মেয়েকে জিন্স আর টপসে দেখে অভ্যস্থ তিনি।মেয়েটা দেখতে একদম মায়ের মতো হয়েছে।কিন্তু স্বভাব হয়েছে পুরো বিপরীত।বর্ষার মা ছিলেন বেশ লজ্জাবতী।বর্ষার জন্মের পর ও তার লজ্জা ভাঙেনি।কিন্তু মেয়েটার মধ্যে লজ্জার ছিটেফোটাও নেই।বর্ষা পেছনে বাবাকে দেখে বললো

-“আব্বু ওই রাম ছাগল মাহিম কে আমি জীবনেও বিয়ে করবো না।আমার জীবনটা তেজপাতা করে দিচ্ছে।জানে আমি এই শাড়ি টারি পড়তে পারিনা।তবুও শাড়ি পরতে বলে।”

-“তোকে কিন্তু ভীষণ সুন্দর লাগছে।মাহিমের চয়েজ আছে বলতে হবে।”

বর্ষা কপাল কুচকে বললো
-“শাড়িতে আমাকে সুন্দর লাগছে তাতে ওই বাঁদরের চয়েজের কি হলো?”

-“আরে ও তোর সৌন্দর্য কিসে বৃদ্ধি পায় সেটা ধরতে পেরেছে।”

-“বুজলাম।ওই বাঁদর তোমাকে ভালোভাবেই পটিয়ে ফেলেছে।”

-“এতো ভালো ছেলেটাকে তুই বাঁদর কেনো বলিস?”

-“বাঁদর কে বাঁদর বলবো না তো কি বলবো?বড়দের সম্মান করে না।”

-“বলিস কি? মাহিমের মতো সভ্য ছেলেই হয়না।আর মাত্র তিন মাসের বড় কোনো বড়ো হলো নাকি?”

-“হয়েছে আর প্রশংসা করতে হবে না।”

বর্ষা একটু থেমে আবার বললো
-“আব্বু মাহিম আমাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করেছে।”

বর্ষার বাবা মুচকি হেসে বললো
-“তুই কি বললি?”

-“মাথার চুল টেনে ছিড়ে দিয়েছি।”

বর্ষার বাবা হো হো করে হেসে বললেন
-“একদম ঠিক করেছিস।”

__________
রবিন এই মুহূর্তে ভীষণ টেনশনে আছে।তার স্যার বাসায় আসার পর থেকে রুমের দরজা আটকে বসে আছে।রবিন কি করবে বুঝতে পারছে না।বাসার ডোরবেল বাজতেই রবিন দরজা খুলে দিলো।জয় কে দেখে সালাম দিলো। জয় চিন্তিত মুখে বললো

-“মাহাদ কই?”

-“স্যার রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে দরজা আটকে বসে আছে।”

জয় দ্রুত মাহাদের রুমের দরজা নক করলো।আর বললো
-“ওই শালা দরজা খোল।নাহলে দরজা ভেঙে তোর ভীমরতি ছুটামু।”

রবিন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।তার বদ রাগী স্যারকে কি ভাষায় ডাকছে তার বন্ধু।স্যারের এমনি মাথা ঠিক নেই।আজ জয় স্যারের গালে কয়েক ঘা পড়বে নিশ্চিত। জয় আবার বললো

-“দরজা খোল ব্যাটা।একে বউয়ের প্যারায় বাচিনা। আবার তোর যন্ত্রণা।”

দরজা খোলার শব্দে রবিনের চিন্তা আরো বাড়লো।জয় স্যারের খবর আছে।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মাহাদ জয়কে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো।জয় নিজেও কিছুটা হতভম্ভ।

রাতের আধারে বারান্দায় বসে বিয়ারে চুমুক দিচ্ছে মাহাদ আর জয়।অনেকক্ষণ যাবত তাদের মধ্যে নীরবতা চলছে। মাহাদ আকাশের চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।হাজারো ভাবনা তার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। মাহাদ হঠাৎ বলে উঠলো

-“জানিস জীবনে যখনই কোনো জায়গাতে এসে আটকে গেলে বাবা এক চুটকিতেই সব সমাধান করে দিতো।আজ বাবাকে ভীষণ মনে পড়ছে।সে থাকলে হয়তো মুহূর্তেই আমার সব সমস্যার সমাধান করে দিতো।”

জয় কিছুই বললোনা।বোতলে আরেক চুমুক দিলো।সচরাচর এসব তার খাওয়া হয় না। মাহাদের সাথে দেখা হলেই খাওয়া হয়। মাহাদ আবার বললো

-“আমি যখন দৃশ্যর হাত ছেড়ে এসেছিলাম,ভেবেছিলাম আমার কাছ থেকে দূরে থাকলে ভালো থাকবে।জানি ভেঙে পরবে।কিন্তু তার ভাই ঠিক সামলে নিবে বোনকে।আর আমার কাছথেকে দূরে থাকলে আশরাফ হুসাইন তার মেয়েকে আর কষ্ট দিবে না।কিন্তু আমি ভুল ছিলাম।দৃশ্য আমাকে এক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেনি।আমাকে ভালোবেসে মেয়েটা নিজের পরিবার ছেড়ে দিয়েছে।এই ঢাকায় এসে আমার পিচ্চিটার কতো সংগ্রাম করতে হয়েছে।মেয়েটা আমাকে ভালোবেসে নরম বিছানা ছেড়ে শক্ত বিছানায় এসে পড়েছে।

সারা জীবন যার পাশে থাকবো বলেছিলাম তাকে মাঝ পথে ছেড়ে দিয়েছিলাম আমি।
মাহাদ আবার বোতলে চুমুক দিয়ে মলিন হেসে বললো

-“আমি রকস্টার মাহাদ কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে কি লাভ হলো, যেখানে আমার বউকে জীবিকার জন্য সীমাহীন পরিশ্রম করতে হচ্ছে।আমজাদ রহমানের পুত্রবধূর তো রাণীর মতো থাকার কথা ছিলো।কিন্তু আমার বউটার ভাগ্য দেখ।যেই মেয়েটাকে আমি সারাক্ষন সকল খারাপ নজর থেকে বাঁচিয়ে রাখতাম তাকে এই শহরে নানা ভাবে অপদস্ত হতে হয়েছে।”

মাহাদের চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে।সে বুকে ঘসতে ঘসতে বললো

-“আমার বুকটা জ্বলে যাচ্ছেরে।আমার বউয়ের দিকে বাজে নজরে তাকানো প্রতিটা চোখ উপড়ে ফেলতে পারলে এই জ্বালা কমতো।”

-“শান্ত হো মাহাদ।এমন ভেঙে পড়িস না।”

-“কি করে শান্ত হবো বলতো। আমি কেমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি বুঝতে পারছিস?দৃশ্য সেদিন যখন বলেছিলো “পারবে এই হাত ধরে তোমার মায়ের সামনে দাড়াতে” আমি ওকে কিছুই বলতে পারিনি।পারিনি ওর হাতটা শক্ত করে ধরতে।

বাবা মারা যাবার পর মাকে কখনো মন খুলে হাসতে দেখিনি।মায়ের সেই মিষ্টি হাসিটাকে ভীষণ মিস করি বাবা যেদিন মারা গেলো সেদিন মায়ের চোখে জল আমাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিয়েছিলো।মা তো তখন বাবার মৃত্যুর জন্য সবচাইতে বেশি ঘৃণা আমাকে করছিলো।অপরাধবোধ আমাকে ভেতর থেকে শেষ করে দিচ্ছিলো।আর সেদিন যখন দৃশ্য আমার কাছে ছুটে এলো।মায়ের চোখে আমি যেই কষ্টটা দেখেছি।বিশ্বাস কর তার পর আর কিছুই ভাবতে পারিনি।শুধু মনে হয়েছে আজ আমি দৃশ্যর হাতটা ধরে রাখলে মাকেও বাবার মতো চিরদিনের জন্য হারিয়ে ফেলবো।মাকে মানুষিক প্রশান্তি দিতে চাইলে আমার দৃশ্যর থেকে আলাদা হতে হবে।

কিন্তু দৃশ্যকে ছেড়ে আমি এক মুহূর্তের জন্যও ভালো ছিলাম না।ওকে ভুলে থাকার জন্য নেশায় ডুবে গেলাম।তবুও নেশার ঘোরে দৃশ্যর স্মৃতি আমার পিছু ছাড়েনি।তবুও নিজেকে আড়াল করে ভালো থাকার অভিনয় করে গেছি।কিন্তু যেদিন থেকে দৃশ্যকে আবার দেখলাম।ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার শক্ত খোলস ভেঙে গুড়ো গুড়ো হয়ে গেলো।আমি আবার এলোমেলো হয়ে গেলাম।ওকে একদিন না দেখে থাতে পারছিলাম না।তাই প্রতিদিন অফিসে যেতে লাগলাম।কাজে মন বসাতে পারছি না।ওকে আবার কাছে পাওয়ার নেশা ধরে গেলো।

কিন্তু আমার পিচ্ছি এখন অনেক বড় হয়ে গেছে।অনেক বদলে গেছে।আমার সামনে এসেও নিজের অনুভূতিকে লুকিয়ে ফেলতে শিখে গেছে।আজ যখন দৃশ্য নিজের কথা গুলি বললো আমি অপরাধ বোধে ওর দিকে মাথা তুই তাকাতে পারিনি।ওর সব অভিযোগ মেনে নিয়েছি।কিন্তু যখন ও ডিভোর্সের কথা বললো,তখন আমি একদম শেষ হয়ে গেছি।ও আমার কাছ থেকে দূরে আছে সেটা তবুও মেনে নিতে পারছি। কারণ কোথাও-না-কোথাও মনের মধ্যে একটা তীব্র প্রশান্তি কাজ করতো ও তো আমার বউ। কিন্তু ডিভোর্স আমাদের দুজনকে চিরজীবনের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দিবে।”

জয় বেশ চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো
-“এখন কি করতে চাস?কারণ দৃশ্য কিন্তু একটা বিষয় ঠিক বলেছে।এই ভাবে সম্পর্ককে ঝুলিয়ে রাখার মানে হয়না।”

-“আমি কিছুই জানিনা। শুধু এতোটুকু জানি দৃশ্যকে কখনোই ডিভোর্স দিবোনা।”

-“কিন্তু মাহাদ..

মাহাদ কাপা কাপা গলায় বললো
-“আমার জায়গাতে তুই থাকলে কি করতি?আমি জীবনে অনেক ক্ষেত্রে ভুল ডিসিশন নিয়েছি।কিন্তু দৃশ্যকে ডিভোর্স দেওয়ার মতো ভুল আমি কোনো দিন করবো না।ও শুধুই আমার।”

জয় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো।আসলেই সিচুয়েশনটা এমন যে সে নিজেই কোন সমাধান খুঁজে পাচ্ছে না। সে তো জানে মাহাদ দৃশ্যকে ঠিক কতটা ভালবাসে। অন্যদিকে সে তার নিজের মাকেও ভীষণ ভালোবাসে। আসলে এসব ক্ষেত্রে আন্টিকেও দোষারোপ করা যায় না।যার কারণে নিজের স্বামীকে অপমানিত হতে হয়েছে,আঘাত পেতে হয়েছে,তার মেয়েকে ছেলের বউ হিসেবে দেখা আসলেই কষ্ট সাধ্য। দৃশ্যকে যতবার দেখবে ঠিক ততোবারই সেই দিনের কথা আন্টির মনে পড়বে।

রেস্টুরেন্ট থেকে ফিরে দৃশ্য বেশ স্বাভাবিক আচরণ করছে।জিনিয়া আর লতা দৃশ্যকে বার বার খেয়াল করছে।প্রায় দুই ঘণ্টা যাবত বইয়ের মুখ ডুবিয়ে রেখেছে।জিনিয়া লতাকে বললো

-“আপু ও এতো স্বাভাবিক কেনো আছে?আমি তো আজ ধরেই নিয়েছিলাম এসেই দরজা আটকে কান্না কাটি করবে।”

-“ওর এই স্বাভাবিক আচরণই আমার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে।ওর মনের অবস্থা কাউকে বুঝতে দিতে চাইছে না।”

দৃশ্য তাদের উকি ঝুঁকি দিতে দেখে বললো
-“কি ব্যাপার তোমরা ওখানে কি করছো?”

লতা বললো
-“তুই ঠিক আছিস দৃশ্য?”

-“হে একদম ঠিক আছি। বরং বেশ ভালো আছি।নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে।”

লতা আর কিছুই বললো না।সে জানে দৃশ্য ঠিক নেই।মেয়েটা উপরে নিজেকে স্ট্রং দেখলেও সে জানে দৃশ্য ভেতরে ভেতরে বেশ দুর্বল।বিশেষ করে স্বামী নামক মানুষটির প্রতি ভীষণ দুর্বল।

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_52

সকাল প্রায় দশটা।শামসুন্নাহার বেগম বসে আছে মাহাদের পাশে। মাহাদ তখনও গভীর ঘুমে মগ্ন।মায়া ভরা দৃষ্টিতে দেখছেন বিধ্বস্ত মাহাদ কে।এই ছেলেটাকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন।তাইতো মাহাদের সামান্যতম কষ্ট তাকে যন্ত্রণা দেয়।কয়দিন যাবত মাহাদ বাসায় যাচ্ছেনা বলে তিনি চলে এসেছেন।নিজের চোখে মাহাদকে না দেখলে মন শান্ত হবে না।

শামসুন্নাহার বেগম একবার পুরো রুমে চোখ বুলালেন।সারা রুম থেকে বাজে গন্ধ বের হচ্ছে।বারান্দায় বেশ কয়েকটা বোতল পড়ে আছে।সারা রুমে জুড়ে সিগারেটের ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে।তিনি রাগী চোখে জয়ের দিকে তাকালেন।

জয় ভীত হয়ে পাশে দাড়িয়ে আছে।সকাল সকাল দাদী এসে হামলা দিবে জানলে রুম পরিস্কার করে রাখতো।শামসুন্নাহার বেগম ভীষণ রেগে বললেন

-“ওই তোরা কি বন্ধু নাকি শত্রু?বন্ধুর এই সব ছাইপাশ খাওয়ার থাইকা ফিরায়া না আইনা নিজেও হের লগে তাল মিলাস?নিজে তো বিয়া সাদি কইরা সংসার জুইড়া নিছোত। বন্ধুরে তো একটু বুঝাইতে পারিস?বিয়াসাদির লাইগা রাজি করতে পাড়িস?”

জয় নরম সুরে বললো
-“দাদী ও তো আমার আগেই বিয়ে করে বসে আছে।কয় বিয়ে করাবেন ওকে?ওর বউ যদি এসে মামলা করে দেয়?”

-“হারামজাদা!!তোরাই ওরে নষ্ট করছিস।”

জয় কি করবে বুঝতে পারছেনা।এই মুহূর্তে এই জায়গা থেকে কেটে পরাই উত্তম।জয় দাদীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

শামসুন্নাহার বেগম বেশ কিছুক্ষন মাহাদকে পর্যবেক্ষণ করলেন।তার চাঁদের টুকরা নাতিতার এই বিষণ্ণতা তিনি কিছুতেই মানতে পারছে না।জীবনে সব কিছু পেয়েলেও ছেলেটা সুখ পায়নি।একটা মেয়ে তাদের জীবনে এসে সব সুখ কেরে নিয়েছে।

জয় বাসায় পৌঁছেই দেখলো তার বউ রেগে বোম হয়ে আছে।জয় বেশ ভয়ে আছে।এই মেয়ে একটা বাঘিনী।তবে রাগলে মৌয়ের সৌন্দর্য যেনো কয়েক গুণ বেড়ে যায়।মৌ রেগে বললো

-“তুমি আবার এই ছাইপাশ খেয়েছো?তোমার বন্ধু তো শেষ হবেই সাথে তোমাকেও শেষ করে ছাড়বে।”

-“আসলে মাহাদ ভীষণ কষ্টে আছে।তাই ওর পাশে থাকাটা জরুরি ছিলো।”

-“আমার বন্ধুবিকে কষ্ট দিয়ে ভালো থাকবে নাকি?কখনোই না।নিজের কাজের জন্য কষ্ট পাচ্ছে।”

জয়ের বেশ রাগ হলো।সে রেগে বললো
-“সবটাই তুমি জানো।তার পরও মাহাদকে দোষারোপ করছো?”

-“দৃশ্যকে তো ছেড়ে দিয়েছে। এখন আবার কি চায়।”

-“কি চায় মানে কি?কষ্ট কি শুধু তোমার বন্ধুবি পাচ্ছে নাকি?”

-“পাচ্ছেই তো।এতো সব করে আবার নাকি ওর পিছু নিয়েছে।আমি এই অবস্থায় না থাকলে ঠিক দৃশ্যর সাথে দেখা করতে যেতাম।”

-“হে যাও।তোমার বন্ধুবিও কম না।আমার বন্ধুকে ডেটে ডেকে নিয়ে একদম চিৎপটাং করে ফেলেছে।ভালো ছেলে ডেটে গেলো আর ফিরলো অসুস্থ হয়ে।ভাবা যায়।কি করা ডোজ দিয়েছে তোমার বন্ধুবী ভাবতে পারো?”

-“ফালতু কথা বলবে না।তোমার বন্ধু আমার বান্ধুবিকে দেখেই ফিট খেয়ে গেছে মনে হয়।”

-“ফিট খেলেই বা প্রবলেম কি? নিজের বউ।ফিট খাবে নাকি চুমু খাবে তাতে তোমার কি?”

মৌ এবার আরো রেগে গেলো।সেই ঘটনার পর থেকে সে মাহাদকে খুব একটা পছন্দ করেনা।দৃশ্যর জন্য বেশ চিন্তা করে।দৃশ্যর হঠাৎ সবাইকে ছেড়ে চলে যাওয়াতে সে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে।যেদিন জয়ের মুখে শুনলো দৃশ্য ঢাকায় আর মাহাদের অফিসে আছে।সেদিন বেশ খুশি হয়েছিল।দৃশ্যর সাথে দেখা করতে চেয়েছিল।কিন্তু জয় রাজি হয়নি।কারণ মৌ এখন সাত মাসের প্রেগনেন্ট।

মাহাদ দৃশ্যকে ছেড়ে চলে আসার পর মৌ জয়ের উপর ভীষণ রেগে গেছিলো।এমনকি জয়ের সাথে সব রকম যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলো।জয় বহু কষ্টে দুই পরিবারকে রাজি করলেও মৌ কিছুতেই রাজি হচ্ছিলো না।জয় যেনো অস্থির হয়ে পড়েছিলো।শেষে জয়ের পাগলামি দেখে রাজি হয়ে যায়।দুই বছর আগে তারা পারিবারিক ভাবে বিয়ে করে।
মৌকে অস্থির হতে দেখে জয় তাকে শান্ত করলো।আর নরম সুরে বললো

-“মৌ এই অবস্থায় এতো রেগে যেয়ো না।দৃশ্য মাহাদকে ডিভোর্সের কথা বলেছে।বুঝতেই পারছো মাহাদের কি অবস্থা হতে পারে।রবিন ওকে ধরে রেস্টুরেন্ট থেকে বাসায় নিয়ে এসেছে।ছেলেটা কাল অনেকক্ষণ কাদলো।সিচুয়েশন এতটা কমপ্লিকেটেড যে কি বলবো বুঝতে পারছি না।”

মৌ এবার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো।মুখে যাই বলুক সে তো ঠিকই জানে মাহাদ দৃশ্যর প্রতি কতটা দুর্বল।সে বললো
-“তোমার বন্ধু কি করবে বলেছে?”

-“তুমি নিজেও জানো মাহাদ কখনোই ডিভোর্স দিবে না।”

-“আর যদি দৃশ্য দেয়?”

জয় এবার বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লো।তার চোখে মুখে স্পষ্ট চিন্তার ছাপ।

ঘুম থেকে উঠে মাহাদ দাদীকে দেখতে পেলো।প্রথমে বেশ চমকে গেলো।পড়ে মুচকি হেসে বললো

-“দাদী তুমি?এতো সকাল সকাল?”

-“আর সকাল কই?বারোটা বাজে।”

-“ওহহ!হটাৎ এখানে?”

-“কি করতাম।তুই তো বাড়িত আসোস না।তাই দেখতে আইলাম।আচ্ছা এমন আর কত দিন থাকবি?একটা বিয়া সাদি কর মাহাদ।”

মাহাদ থমথমে গলায় বললো
-“বিয়ে তো করেছি দাদী।”

শামসুন্নাহার বেগম রেগে বললেন
-“ওইডা কোনো বিয়া না।ওই মাইয়ারে ভুইলা যা।আমি তোর লাইগা সুন্দরী মাইয়া আনমু।কতো সুন্দরী আর ভালা বংশের মাইয়া লাইনে দাড়ায় রইছে।তুই একবার হে কইলেই হইবো।”

-“দাদী আমি এই বিষয়ে আর কথা বলতে চাইছি না।তুমি বসো।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

বলেই মাহাদ ওয়াস রুমে চলে গেলো।শামসুন্নাহার বেগম বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হলেন।ছেলেটা কি এই ভাবেই জীবন পার করবে?
দৃশ্য আজ সপ থেকে বেরিয়ে একটা পার্কে বসলো।সামনের লেকে কয়েকটা হাঁস সাঁতার কাটছে।দৃশ্য এক দৃষ্টিতে সে দিকে তাকিয়ে রইলো।দৃশ্য দেখলো হাঁস গুলো জোড়ায় জোড়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে।হঠাৎ দৃশ্য করো ডাকে চমকে যায়।পাশে তাকিয়ে দেখে একটা বাচ্চা মেয়ে হাতে ফুল নিয়ে দাড়িয়ে আছে।মেয়েটা দৃশ্যকে দেখে বললো

-“আপা ফুল নিবেন?একদম তাজা ফুল।”

দৃশ্য দেখলো সামনের এই মেয়েটার মুখে ভীষণ মায়া।বয়স বারো কি তেরো হবে।যে বয়সে মেয়েটার হেসে খেলে বেড়ানোর কথা ছিলো,সেই বয়সে মেয়েটা জীবিকার তাগিদে ফুল বিক্রি করছে।সারাদিন রোদে পুড়ে মেয়েটার মুখটা মলিন হয়ে আছে।দৃশ্য মুচকি হেসে বললো

-“না আপু আমার লাগবে না।”

-“নেন না আপা।ভাইয়া কই। তারে কইলে ঠিকই নিবো।”

-“আমাকে ফুল দেয়ার কেউ নেই।তবে তুমি এই টাকাটা রাখো।”

বলেই দৃশ্য ব্যাগ থেকে একশো টাকা বের করে দিলো।মেয়েটা ভীষণ খুশি হয়ে বললো
-“আপা অন্তত একটা গোলাপ রাখেন।”

দৃশ্য আর মানা করলো না।গোলাপটা নিয়ে নিলো। ফুলটার দিকে তাকিয়ে দৃশ্যর মনে পড়ে গেলো সে দিনের কথা।যেদিন মাহাদ তাকে ক্লাস রুমে প্রথম প্রপোজ করেছিলো।দৃশ্যর চোখ ভিজে উঠলো।মুহূর্ত গুলো আজও তার সামনে পরিষ্কার। গোলাপ ফুল টার দিকে তাকিয়ে দৃশ্য হু হু করে কেঁদে ফেললো।ভেতরটা তার দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। মাহাদের অশ্রুসিক্ত সেই দৃষ্টির কথা মনে পড়ছে।মানুষটা একটুও বদলায় নি।আজও তার ক্ষেত্রে ভীষণ ইমোশনাল।
_________
আজ দৃশ্য শপ থেকে ফিরেই রান্না বসিয়েছে।সন্ধায় লতা ফিরে এসে দেখলো দৃশ্য বিরিয়ানি রান্না করছে।সে কপাল কুচকে বললো

-“কি ব্যাপার দৃশ্য?আজ হঠাৎ বিরিয়ানি।”

দৃশ্য মুচকি হেসে বললো
-“এমনি আপু।হঠাৎ ইচ্ছে হলো তাই।”

-“হুম!!বেশ ভালো ঘ্রাণ আসছে।জলদি ফ্রেশ হয়ে আসি তার পর খাবো।”

-“আচ্ছা যাও।”

দৃশ্য আবার রান্নায় মনোযোগ দিলো।তখনই বাসার ডোরবেল বেজে উঠলো।দৃশ্য দৌড়ে এসে দরজা খুলে দেখলো জিনিয়া এসেছে।জিনিয়াকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে।দৃশ্য কপাল কুঁচকে বললো

-“কি হয়েছে তোর?বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে।”

জিনিয়া দাত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে আনমনা হয়ে বললো

-“আমার মনে হয় বাসার সামনে আমি মাহাদকে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি। বাট শিওর না।”

দৃশ্যর বুকটা ধক করে উঠলো।জিনিয়া দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে বললো

-“আরে ভুল ও হতে পারে।উনি থাকলে তো সোজা বাসায় আসতো।এতো রিস্ক নিয়ে একা রাস্তায় নিশ্চয়ই দাড়িয়ে থাকতো না।”

দৃশ্য কিছু না বলেই তার বারান্দার দিকে দৌড়ে গেলো। লম্পস্টের আলোতে একজন মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে।গড়িয়ে সাথে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।দৃষ্টি তার এই বারান্দার দিকেই।মানুষটাকে চিনতে তার ভুল হলোনা।দৃশ্য দ্রুত রুমে চলে আসলো।দেয়ালে হেলান দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।নিঃশ্বাস তার দ্রুত গতিতে চলছে।জিনিয়া রুমে এসে দৃশ্যকে এই ভাবে দেখে অস্থির হয়ে বললো

-“সত্যি কি ওটা মাহাদ?”

দৃশ্য কিছু বললো না।আবার রান্না ঘরে চলে গেলো।জিনিয়া কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।কিছুক্ষণ পর লতা আসলে জিনিয়া জিজ্ঞেস করলো

-“কাহিনী কি আপু।রকস্টার সাহেব আসবে এটা দৃশ্য আগে থেকেই জানতো নাকি? এর জন্যই কি ভালো ভালো রান্না করছে?”

-“মানে কি?”

-“বারান্দা দিয়ে উকি দিয়ে রাস্তার দিকে দেখো।”

লতা দেখলো রাস্তায় কেউ দাড়িয়ে আছে।সে বললো
-” কে যেনো দাড়িয়ে আছে?”

-“আরে ওরা রকস্টার মাহাদ।”

লতা বিস্ময় নিয়ে তাকালো।আর বললো
-“দৃশ্য জানে?”

-“মাত্র দেখেছে।”

লতা আর জিনিয়া বেশ চিন্তায় পড়ে গেলো।
দৃশ্য এই নিয়ে বেশ কয়েক বার বারান্দায় উকি দিয়ে তাকিয়েছে। মাহাদ এখনো দাড়িয়ে আছে।দৃশ্য দেখলো আকাশ ভীষণ মেঘলা।যে কোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে।এই ছেলেটা আবার পাগলামি শুরু করেছে।দৃশ্য তো ভেবেছে সেদিনের পর মাহাদ ওর পিছু ছেড়ে দিবে।কিন্তু না।

রাতে দৃশ্য লতা আর জিনিয়াকে নিজ হাতে খাবার বেড়ে দিলো।তাকে খেতে বললে বললো সে পড়ে খাবে।তারা আর কিছুই বললো না।দৃশ্যর মনের অবস্থা বুঝতে পারলো।জিনিয়া আজ দৃশ্যকে একা ছেড়ে দিয়ে লতার রুমে ঘুমাতে চলে আসলো।

দৃশ্যর চোখে ঘুম নেই।সন্ধ্যা থেকে মাহাদ বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। এখন প্রায় সারে এগারোটা।দৃশ্য বারান্দার দরজার পাশে ফ্লোরে বসে আছে। হটাৎ আকাশে বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। সাথে সাথে ঝুম বৃষ্টি শুরু।দৃশ্য হন্তদন্ত হয়ে উঠে বারান্দা দিয়ে সামনের রাস্তায় তাকালো।দেখলো মাহাদ বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে।দৃশ্য মনে মনে খুশি হলো।যাক এবার বাসায় চলে যাবে।কিন্তু প্রায় দশ মিনিট হতে চললো মাহাদ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।দৃশ্যর মনে অস্থিরতা বাড়তে লাগলো।এই ছেলে পাগল হয়ে গেছে।এতো রাতে বৃষ্টিতে ভিজলে অসুস্থ হয়ে পড়বে।দৃশ্য হাসফাঁস করতে লাগলো।কি করবে কিছুই বুঝতে পড়ছে না।

মাহাদ বৃষ্টির মধ্যে দাড়িয়ে আছে।সন্ধ্যা থেকে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে শুধু একটা বার দৃশ্য কে দেখার জন্য।রাস্তা টা নির্জন হওয়ায় তার বেশি একটা সমস্যা হলো না।হটাৎ তার চোখ পড়ল সামনের দিকে। ছাতা হাতে কেউ একজন আসছে। মাহাদ কপালের ভেজা চুল গুলো হাত দিয়ে পেছনে ঠেলে দেখার চেষ্টা করলো কে আসছে।কিন্তু বুঝতে পারছে না।সব কেমন ঝাপসা হয়ে আসছে।মাথা টাও বেশ ভারী মনে হচ্ছে।দাড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।তবে কয়েক মুহূর্ত পর বুঝতে পারলো তার প্রিয়তমা আসছে।

দৃশ্য এসে মাহাদের মাথায় ছাতা ধরলো।ততক্ষণে মাহাদ ভিজে টইটুম্বুর।দৃশ্যকে দেখে মুখের মাস্ক খুলে ফেললো মাহাদ।দৃশ্যকে দেখে মুচকি হাসলো।দৃশ্যর ইচ্ছে করছে মাহাদের ফর্সা গাল থাপ্পরে লাল করে ফেলতে।দৃশ্য রেগে বললো

-“পাগল হয়ে গেছো?এই বৃষ্টি মধ্যে এই জায়গায় কেনো দাড়িয়ে আছো?অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।কি বলেছিলাম তোমায় মনে নেই?আমার সামনে আসতে মানা করেছিলাম না?বাসায় যাও মাহাদ।”

মাহাদ পিট পিট করে দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে মাথা ডানে বায়ে নাড়িয়ে না বুঝালো।দৃশ্য কপাল কুঁচকে বললো
-“না মানে কি? বাসায় যাও বলছি।”

মাহাদ তখনও বাচ্চাদের মতো মাথা নেড়ে না জানাচ্ছে।দৃশ্যর রাগ হলো।এই অবস্থায় কেউ দেখে নিলে বাজে সিচুয়েশন ক্রিয়েট হবে।তাছাড়া মিডিয়া জানলে কাল ব্রেকিং নিউজ হয়ে যাবে।দৃশ্য মাহাদের হাত ধরে গাড়িতে উঠাতে চাইলো।কিন্তু মুহূর্তেই থেমে গেলো।দৃশ্য দ্রুত মাহাদের কপালে হাত রাখলো। শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।দৃশ্য দ্রুত গালে গলায় হাত দিয়ে দেখলো ভীষণ গরম।সে বুঝতে পারলো এই জ্বর আগেই এসেছে।দৃশ্য অস্থির হয়ে বললো

-“তোমার তো ভীষণ জ্বর।এই জ্বর নিয়ে সন্ধ্যা থেকে এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার মানে কি?আবার বৃষ্টিতেও ভিজতেছো?”

মাহাদ কিছুই বললো না।তার শরীর কিছুটা ঢুলতে লাগলো।দৃশ্য কি করবে বুঝতে পারছে না।একবার আশেপাশে চোখ বুলিয়ে নিলো। মাহাদের অবস্থা দেখে সে মাহাদের হাত ধরে বাসায় নিয়ে আসলো।বাসায় ঢুকেই দেখলো লতা দাড়িয়ে আছে।দৃশ্য আর মাহাদ কে দেখে কপাল কুচকে ফেললো লতা।দৃশ্য ভীষণ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।আপু কি ভাববে আল্লাহই জানে।কিন্তু দৃশ্যকে অবাক করে দিয়ে আপু বললো

-“রুমে নিয়ে গা মুছে দে।দেখে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে।”

দৃশ্য আর কিছুই বললো না। মাহাদের হাত ধরে নিজের রুমে নিয়ে আসলো।আর মাহাদ ও বাধ্য ছেলের মতো দৃশ্য পিছু পিছু আসলো।দৃশ্য মাহাদকে দার করিয়ে কাভার্ড এর সামনে চলে আসলো। মাহাদ ভিজে গেছে।এই মুহূর্তে তার ড্রেস চেঞ্জ করা প্রয়োজন।দৃশ্য কাভার্ড থেকে একটা ব্যাগ বের করলো।এই জায়গায় একটা টাউজার আর টিশার্ট আছে।এগুলো সে মাহাদের জন্যই কিনেছিলো।

মাহাদের অফিসে জয়েন করে প্রথম সেলারি পেয়ে সবার জন্যই কিছু না কিছু কিনেছে।জিনিস গুলো বেশি দামী না।তবুও নিজের প্রথম সেলারি দিয়ে মায়ের জন্য একটা সিম্পল শাড়ি,ভাইয়ার জন্য আর মাহাদের জন্য টাউজার আর টিশার্ট কিনেছে।তার ভাই আর মাহাদ সব সময় ব্র্যান্ডের জিনিস ইউজ করে অভ্যস্থ।এক সময় সে নিজেও অভ্যস্থ ছিলো।কিন্তু পরিস্থিতে পড়ে এখন নিজেকে বদলে নিয়েছে।বাবার প্রতি ঘৃণা থাকলেও সে তো বাবা।তার জন্যও একটা সিম্পল পাঞ্জাবি কিনেছে।সে জানে বাবা এটা কোনোদিন পড়বে না।এই জিনিস গুলো তাদের দিতে পারবে কিনা জানা নেই তবুও কিনেছে।

মাহাদের চোখ পড়লো কাভার্ড এর ভেতর সুন্দর করে ভাঁজ করা একটা শাড়ির দিকে।তাদের বিয়ের শাড়ী। মাহাদ বাঁকা হাসলো। দৃশ্য কতো যত্ন করে রেখে দিয়েছে।
এই জামা গুলো মাহাকে দিতে তার বেশ অসস্তি বোধ হচ্ছে। মাহাদের মতো সেলিব্রেটি কি এই সব পড়বে?কিন্তু এটা ছাড়া আর অপসন নেই।সে ব্যাগটা মাহাদের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো

-“ড্রেস চেঞ্জ করে নাও।ভেজা কাপড়ে থাকলে জ্বর আরো বাড়বে।”

-“এটাকি আমার জন্য কিনেছো?”

দৃশ্য কিছু না বলে মাহাদকে ব্যাগ ধরিয়ে দিলো।মাহাদ ড্রেস হাতে নিয়ে ওয়াস রুমে চলে গেলো।দৃশ্য সেখানে দাড়িয়ে ভাবতে লাগলো মাহাদের কথা।এতো অসুস্থ হয়েও আজ এমন পাগলামি কেনো করছে?ইসস! লতা আপুর সামনে কতো লজ্জায় পড়তে হলো।

মাহাদ চেঞ্জ করে এসে দৃশ্যর বিছানায় বসে পড়লো।জামাটা মাহাদের গায়ে বেশ মানিয়েছে। মাহাদের শরীরটা ভীষণ খারাপ লাগছে।সকাল থেকেই এই জ্বর শুরু হয়েছে।এই মেয়েটাকে না দেখে এতদিন অসুস্থ ছিলো।আর আজ তাকে দেখে আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েছে।

দৃশ্য দেখলো মাহাদের চুল গড়িয়ে পানি পড়ছে।এই ছেলেটা কি মাথা মুছতে জানেনা?এমন ভেজা অবস্থায় থাকলে আরো জ্বর বেড়ে যাবে।দৃশ্য তোয়ালে নিয়ে মাহাদের সামনে দাড়িয়ে মাথা মুছে দিতে লাগলো। মাহাদ প্রথমে চুপ থাকলেও কয়েক মুহূর্ত পর দৃশ্যের কোমর ঝাপটে ধরলো।মুহূর্তেই দৃশ্য চমকে গেলো।শরীর বেয়ে শীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে।তার হাত থেমে গেলো। মাহাদ তার পেটে নাক ঘষতে ঘষতে নেশাক্ত কন্ঠে বললো

-“হ্যাপি ফোর্থ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি বউ।”

মুহূর্তেই দৃশ্যর নিঃশ্বাস আটকে গেলো।সে স্তব্ধ হয়ে ভাবতে লাগলো মাহাদ তাহলে মনে রেখেছে আজকের দিনে কথা?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here