তোমার_আমার_প্রণয়,56,57

0
1377

#তোমার_আমার_প্রণয়,56,57
#israt_jahan_arina
#part_56

নিকষ কৃষ্ণ আকাশে নির্বিঘ্নে উড়ে বেড়াচ্ছে তুলো রাশির দল। তাদের মাঝে মোহনীয় আলো ছড়াচ্ছে বৃত্তকার চাঁদটি।কিন্তু চারপাশের কোনো সন্দৌর্যই মাহাদকে মোহিত করতে পড়ছে না।সে মুখে মাস্ক পড়ে icu সামনে দাড়িয়ে আছে।দৃশ্যকে এক নজর দেখার জন্য সে এতক্ষণ ঠিক যতোটা অস্থির হয়ে ছিলো,এই মুহূর্তে ঠিক ততটাই ভয় হচ্ছে।দৃশ্যকে দেখে সে স্থির থাকতে পারবে তো?

ফাহিম বাড়িতে কল করে মাকে সব জানালো।আনিকা কবির সব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন।আজ এতদিন পর মেয়েটার খোঁজ পেলো কিন্তু এই অবস্থায়?তিনি হাউমাউ করে কাদতে লাগলেন।দৃশ্যর কথা শুনে আশরাফ হুসাইন এই প্রথম ভীষণ কষ্ট পেলেন।মেয়েটাকে তিনি প্রাপ্য ভালোবাসা দিতে পারে নি।তাই বলে কি মেয়েটা অভিমান করে দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে চাইছে? আনিকা কবির ঢাকায় যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেন।তাই ফাহিম নাবিল কে কল করে সব জানায়।আর তার মাকে দৃশ্যর কাছে নিয়ে আসতে বলে।নাবিল এই সব শুনে বেশ কষ্ট পায়।দৃশ্যকে সে ঠিক নাবিলার মতোই ভালোবাসে।আর আজ সেই বোনটার এই করুন অবস্থা কিছুতেই মানতে পড়ছে না।

বাইরে অলরেডি মিডিয়া এসে ভির জমিয়েছে।একজন সেলিব্রেটি পাগলের মতো কার জন্য হসপিটালে ছুটে এসেছে তা জানার আগ্রহে।সবাই নানান প্রশ্ন করে যাচ্ছে রবিন কে।এসব খবর যেনো বাতাসের আগে ছড়িয়ে পরে।রবিন আর সিকিউরিটি গার্ড মিলে এইসব বিষয় টেকেল দিচ্ছে।

মাহাদ অনেক সাহস যোগিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।দেখলো রুমটির কর্নারের বেডে কেউ শুয়ে আছে। মাহাদ কাপা কাপা পা নিয়ে সে দিকে এগিয়ে গেলো। বেডের কাছে আসতেই তার চোখ ভিজে উঠলো।

দৃশ্যর মাথায় ব্যান্ডেজ,মুখে অক্সিজেন মাস্ক।যা দিয়ে দৃশ্য জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে।পায়ের দিকে নজর যেতে দেখলো ডান পায়ে প্লাস্টার করা।এছাড়া হাতের বেশ কয়েক জায়গাতে ব্যান্ডেজ করা। মাহাদের চোখ আটকে গেলো গলার দিকে।সেখানে বেশ বড় আঘাতের চিন্হ।যাতে অয়েনমেন্ট দেওয়া।সেই আঘাতের ঠিক উপরে কয়েকটা লাভ বাইট নীলচে হয়ে আছে।

মাহাদের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেলো।গতকাল রাতেই তারা ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে ছিলো। যায় বেশ কয়েকটা চিন্হ এখনো তার বউয়ের গায়ে ফুটে আছে।কতটাই না মোহনীয় ছিলো সেই রাতটা।আর আজ তার ভালোবাসা ক্ষতবিক্ষত হয়ে বেডে পড়ে আছে।এমন কিছু ঘটবে বুঝতে পড়লে মাহাদ ভুল করেও দৃশ্যকে চোখের আড়াল করতো না।নিজের বুকে লুকিয়ে রাখতো।

মাহাদ দৃশ্যর কাছে এসে কপালে গভীর ভাবে চুমু খেলো।তার গাল বেয়ে অশ্রু ধারা দৃশ্যর কপালে পড়ছে।সে দৃশ্যর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলো।বেডের পাশের টুলে বসে দৃশ্যর হাত নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিলো।দৃশ্যর হাতেও বেশ আঁচড় লেগে অনেক জায়গায় ছিলে গেছে।সে আলতো করে দৃশ্যর হাতের উলটো পিঠে বেশ কয়েকবার চুমু খেলো।
দৃশ্যর নিস্তেজ দেহ দেখে মাহাদের বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।কতটা যন্ত্রণা সহ্য করছে তার পিচ্ছিটা। মাহাদ দৃশ্যর হাত নিজের গালে ছোয়ালো।আর কাঁপা কাঁপা গলায় বললো

-“তোমার কিছু হবে না পিচ্ছি।তোমার মাহাদ তোমার পাশে আছে।কিছু হতে দিবনা তোমাকে।অনেক কষ্ট দিয়েছি তোমাকে।তাই আমার উপর অভিমান করে চলে যেতে চাইছো তাই না?আমি সেটা মোটেও হতে দেবো না।”

মাহাদ আবারো দৃশ্যর হাতে চুমু খেলো।আর কাদতে কাদতে বললো

-“সুস্থ হয়ে জলদি আমার কাছে ফিরে এসো বউ। আই প্রমিজ আর কোনোদিন তোমাকে কষ্ট দিবো না।এইযে তোমার হাত শক্ত করে ধরেছি,শেষ নিঃশ্বাস অব্দি এই হাত ছাড়বো না।একটা মিষ্টি সংসার হবে আমাদের।সেই সংসারের রানী হবে তুমি আর আমি হবো তোমার গোলাম।আমারা দুজনে মিলে যে যে স্বপ্ন বুনেছি সবটা পূরণ করবো।অনেক কিছু বাকি রয়ে গেছে।জলদি ফিরে এসো বউ। আই অ্যাম ওয়াটিং ফর ইউ।”

মাহাদ খেয়াল করলো দৃশ্য বেশ জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।একটা সময় দৃশ্য অস্বাভাবিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করে। মাহাদ চমকে যায়।সে অস্থির হয়ে দৃশ্য কে ডাকতে শুরু করে

-“দৃশ্য?কষ্ট হচ্ছে তোমার?এই দৃশ্য চোখ খোলো।দৃশপাখী কথা বলো প্লিজ।দৃশ্য…?”

একটা সময় মাহাদ চিৎকার করে দৃশ্যকে ডাকতে লাগলো।বাইরে থেকে নার্স শব্দ শুনে দ্রুত ভেতরে গেলো।ভিতরে প্রবেশ করে দৃশ্যর অবস্থা দেখে দ্রুত ডক্টর কে ডাকতে লাগলো।দুই মিনিটের মধ্যে ডক্টর ভেতরে প্রবেশ করে দৃশ্যকে চেক করতে লাগলো।আর মাহাদকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বললো।কিন্তু মাহাদ নাছোড় বান্দা।সে দৃশ্যর হাত আরো শক্ত করে ধরলো।আর বলতে লাগলো

-“আমি কোথাও যাবো না।আমার দৃশ্যকে ছেড়ে আমি যাবনা।আমি কাছে না থাকলে ও আমার উপর অভিমান করে চলে যাবে।আমাকে এখানে থাকতে দিন ডক্টর।”

ততক্ষণে মাহিম হসপিটালে এসে পড়েছে।ফাহিম আর মাহিম ভেতরে প্রবেশ করে মাহাদকে এক প্রকার টেনে বের করতে থাকে। মাহাদ কাদতে কাদতে বলে

-“মাহিম আমাকে তোর ভাবির কাছে যেতে দে।ওর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।ওর কিছু হলে আমি বাঁচতে পারবো না।ও যদি আমাকে বাবার মতো ছেড়ে চলে যায়,কি নিয়ে বাঁচবো আমি?আমাকে ওর কাছে যেতে দে।”

ফাহিম আর মাহিম মাহাদকে জোর করে বাইরে এনে দার করায়।মাহিমের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ভাইকে এই অবস্থায় দেখে।আর কেউ জানুক বা না জানুক সে তো জানে তার ভাই ভাবিকে ঠিক কতটা ভালোবাসে?আজ ভাবির কিছু হলে তার ভাই যে নিঃশেষ হয়ে যাবে।মাহিম মাহাদকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলো।আর কাঁপা গলায় বললো

-“ভাইয়া এমন পাগলামী করো না।ভাবীর কিছু হবে না। ডক্টর কে দেখতে দাও।তুমি এমন করলে ডক্টর তার কাজ কি করে করবে?তোমার নিজেকে শান্ত করতে হবে।”

মাহাদ মাহিম কে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো।মাহিম ভাইয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগলো।বেশ কিছুক্ষন পর ডক্টর বেরিয়ে আসলো।আর জানালো আজ রাতে দৃশ্যকে অবজারবেশনে রাখা হবে।দৃশ্যর মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ এখনো হচ্ছে।একে ‘ট্রোম্যাটিক ব্রেইন ইনজুরি’ বা টিবিআই বলে।আজ রাতটা তারা দৃশ্যর অবস্থা অবজার্ভ করবে।রাতের মধ্যে যদি প্রগ্রেস না হয় তবে হয়তো দৃশ্যর ব্রেন সার্জারির প্রয়োজন পড়তে পারে।
ডক্টরের কথায় সবাই অনেকটা ভেঙে পড়েছে।ফাহিম দুহাতে মুখ গুজে কাদঁছে।বোনটাকে এতদিন পর পেয়েও বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলনা।এই ছোট বয়সে বোনটা এতো বড়ো সার্জারির ধকল কি করে নিবে?

মাহাদ চুপ করে মাথা নিচু করে চেয়ারে বসে আছে।দু চোখ তার ভেজা।নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে।সে তার বউকে সকল বিপদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি।নিজের কোনো দায়িত্বই সে পালন করতে পারেনি।এই মেয়েটাকে সে নিজের বুকে পরম যত্নে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো।কিন্তু পারেনি কিছুই করতে।বুকে তীব্র যন্ত্রণা হচ্ছে।সে বির বির করে মহান আল্লাহ তায়ালাকে ডাকতে লাগলো।তার পিচ্ছিটা সুস্থ হলে সে আর কোনোদিন নিজের কাছ থেকে তাকে দূরে রাখবে না।সবার সাথে যুদ্ধ করতে হলে তাই করবে।তবুও সে নিজের বউকে আর এক মুহূর্তের জন্য একা ছাড়বে না।

মাহিম মাহাদকে শান্ত করে ফাহিমের কাছে গেলো।মানুষটা ভীষণ ভেঙে পড়েছে।কিন্তু তাকে সান্তনা দেবার কেউ নেই পাশে।ফাহিমের পাশে বসে তার কাধে হাত রাখলো।ফাহিম মাথা তুলে তাকালো।মাহিম দেখলো ফাহিমের চোখ ভেজা আর লাল হয়ে আছে।মাহিম বললো

-“নিজেকে শক্ত করুন।আমার বিশ্বাস ভাবির কিছু হবে না।তার আপন মানুষ গুলো তাকে ভীষণ ভালোবাসে।এই ভালোবাসা উপেক্ষা করে ভাবী থাকতে পারবে না।”

ফাহিম মাহিম কে জড়িয়ে ধরলো।একটা কাধ খুঁজছিলো সে মন খুলে কাদার জন্য।সেটা পেয়ে সে কাদতে লাগলো।অসম্ভব অস্থিরতায় সেই রাতটা পার করলো তারা।
সকালের সূর্য উঠার সাথে সাথে সবাই হসপিটালে এসে উপস্থিত হয়।আনিকা কবির এসেই ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাদছে।ফাহিম মাকে শান্ত করতে করতে এক নজর হুইল চেয়ারে বসা বাবার দিকে তাকালো।আশরাফ হুসাইন ছেলের দৃষ্টিতে অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই পেলেন না।তিনি মাথা নিচু করে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলেন।একপলক তার চোখ পড়ল মাহাদের দিকে।অসম্ভব সুদর্শন ছেলেটা কেমন নিস্তেজ,নিষ্প্রাণ হয়ে চেয়ারে বসে আছে।তার চোখ অসম্ভব লাল হয়ে ফুলে আছে।আজ প্রথম তিনি অনুভব করলেন এই ছেলেটা তার মেয়েকে পাগলের মতো ভালোবাসে।নিজের অপরাধ বোধ বাড়লো আখি রহমানকে হসপিটালে দেখে।

আখি রহমান দৃশ্যর কথা শুনে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।বিনা অপরাধে মেয়েটা অনেক কষ্ট পেয়েছে।তবে আল্লাহ এই বাচ্চা মেয়েটাকে কেনো এই যন্ত্রণা দিচ্ছে?তিনি জানে মেয়েটা যে তার ছেলের প্রাণ।এই মেয়েটার কিছু হলে তার ছেলেকেও তিনি হারাবেন।ছেলেকে নিষ্প্রাণ ভাবে চেয়ারে পড়ে থাকতে দেখে তার বুকটা ধক করে উঠল।কোনো মা পারেনা ছেলের এই যন্ত্রণা সহ্য করতে।

তিনি মাহাদের পাশে বসে গালে হাত বুলিয়ে দিলেন। মাহাদ অশ্রু শিক্ত নয়নে মায়ের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বললো

-“দেখোনা না মা।তোমার বৌমা আমার উপর ভীষণ রেগে আছে।এই ভাবে থেকে আমাকে কেমন নরক যন্ত্রণা দিচ্ছে।আমি যে ঠিক ভাবে নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।দম বন্ধ হয়ে আসছে।ওকে বলো না এই ভাবে আমাকে যন্ত্রণা না দিতে।আমি যে আর নিতে পারছিনা।”

-“কিছু হবেনা বাবা।সব ঠিক হয়ে যাবে।আল্লাহকে ডাক বাবা।”

মাহাদ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।আর আখি রহমান ছেলের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন।
অনেকক্ষণ পর আনিকা কবিরের পাশে বসলেন আখি রহমান।আনিকা কবিরের কষ্ট তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন।তাই সব দ্বন্দ্ব ভুলে তাকে সান্তনা দিতে লাগলেন।আর বললেন

-“আমার বৌমা মোটেও দুর্বল না।সে সংগ্রাম করতে জানে।দেখবেন ঠিক সে আমাদের মাঝে সুস্থ ভেবে ফিরে আসবে।আপনি ধৈর্য ধরুন বেয়াইন সাহেব।”

আনিকা চমকে তাকালো।আখি রহমানের কাছ থেকে এমন কথা তিনি মোটেও আশা করেননি।তিনি ভেবেছেন তার স্বামীর মৃত্যুর কথা মনে করে হয়তো তাদের দিকে ঘৃণার দৃষ্টি ছুড়ে দিবে।কিন্তু এমন কিছু না করে বরং তাকেই সান্তনা দিচ্ছেন।

আশরাফ হুসাইন লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলেন।আজ তিনি ভীষণ অনুতপ্ত।এই মানুষগুলোকে সে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে।কিন্তু তাদের দুঃসময় এই মানুষ গুলি তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে।

সকালে ডক্টর দৃশ্যকে পর্যবেক্ষণ করে জানায় দৃশ্য এখন বিপদ মুক্ত।তার মস্তিষ্কের রক্তক্ষরণ বন্ধ হয়েছে।আরো আটচল্লিশ ঘন্টা পর দৃশ্যর জ্ঞান ফিরবে। ডক্টরের কথায় সকলেই চিন্তা মুক্ত হয়। মাহাদ যেনো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলো।সে খুশিতে ফাহিমকে জড়িয়ে ধরলো।ফাহিম ও মাহাদকে জড়িয়ে ধরে খুশির অশ্রু ঝরালো।কয়েক মুহূর্ত পর নিজেদের ছাড়িয়ে দুই দিকে ফিরে দাড়িয়ে রইলো। এদের কাণ্ড দেখে মাহিমের হাসি পেলো।খুশিতে সব ভুলে নিজেদের জড়িয়ে নিলেও এদের ইগোর কোনো কমতি নেই।ভাইয়া কপাল গুনে এমন শালা পেয়েছে।একদম তার মতোই।
মাহিম আর রবিন মিলে সবাইকে জোর করে নাস্তা খাওয়ালেও ফাহিম আর মাহাদকে কিছুতেই খাওয়াতে পারলো না।ভাবিকে যে এই দুইজন মানুষ অসম্ভব ভালোবাসে।

সবাই একে একে দৃশ্যকে ঘুমন্ত অবস্থায় দেখে এসেছে।আনিকা কবির মেয়েকে দেখে নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি।সারা মুখে অসংখ্য চুমু খেয়েছেন।মেয়েটার মধ্যে অনেক পরিবর্তন দেখেছেন তিনি।

আখি রহমান সবাইকে রিকোয়েস্ট করলেন তাদের বাড়িতে যেয়ে সবাইকে রেস্ট নিতে।কিন্তু সবাই মানা করলো।মাহিম বুঝতে পারছে সবার মধ্যে দ্বিধা কাজ করছে।তার চাইতে বড় কথা দাদী কেমন রিয়েক্ট করে কে জানে?তাই সে ফাহিমকে তাদের ধানমন্ডির বাসায় থাকতে রিকোয়েস্ট করলো।এতে ফাহিম না করলেও মাহিম আর আখি রহমানের জোরাজুরিতে রাজি হলো।ফাহিমের পরিবারে সকলকে নিয়ে মাহিম চলে গেলো।আখি রহমান ছেলের পাশে রয়ে গেলেন।
ফাহিম ফ্রেশ হয়েই মাহিমের সাথে হসপিটালে চলে আসলো।বোনকে রেখে তার ঘুম হবে না।

মাহাদ দৃশ্যর কেবিনে বসে আছে। এখন দৃশ্যর মুখের অক্সিজেন মাস্ক খুলে দেয়া হয়েছে।দৃশ্যর এখনো জ্ঞান ফেরেনি। সে গভীর ঘুমে মগ্ন। মাহাদ দেখলো দৃশ্যর নিচের ঠোঁট কিছুটা কেটে গেছে। মাস্কের জন্য যা আগে বুঝা যায়নি।সে দৃশ্যর কাটা ঠোটে আলতো হাত বুলালো।এই মেয়েটাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।সেই ক্লাস এইটে পরা বাচ্চা মেয়েটা তার জীবনে এসে তার মন মস্তিষ্ক সবটাই দখল করে নিয়েছে। এখন তাকে ছাড়া আর কিছুই চিন্তা করতে পারেনা সে।তার জীবনের সুন্দর মুহূর্ত গুলো এই মেয়েটার সাথেই কাটিয়েছে।নিজের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি সে এই মেয়েটাকেই পাশে চায়।

মাহাদ খুব সাবধানে দৃশ্যর পাশে অল্প জায়গায় শুয়ে পড়লো।দৃশ্যকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরলো।কিযে প্রশান্তি!দুদিনের ধকলে মাহাদ ভীষণ ক্লান্ত ছিলো।সে দৃশ্যকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।

ফাহিম আর মাহিম অনেক রাতে হসপিটালে চলে আসলো।মাহিম নিজের মাকে রবিনের সাথে বাসায় পাঠিয়ে দিল।ফাহিম আর মাহিম কেবিনে ঢুকে দেখলো মাহাদ দৃশ্যকে বুকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।এই দুইজনকে এক সাথে দেখে ফাহিমের বুকটা জুড়িয়ে গেলো।তার বোনকে মাহাদের মতো কেউ ভালোবাসতে পারবে না।তার বোন নিজের জন্য সঠিক মানুষটাই বেচেঁ নিয়েছে।তার বোনের জন্য যে সীমাহীন সুখ অপেক্ষা করছে সেটা সে বুঝতে পারলো।ফাহিম দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলো।মাহিম দ্রুত ভাই আর ভাবির এই সুন্দর মুহূর্তের কয়েকটা পিক তুলে নিলো।তারপর মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো।

সকালে সূর্যের আবছা আলো এসে কেবিন এর অন্ধকারকে কাটিয়ে তুলেছে।দৃশ্যর নাকে একটা ভীষণ পরিচিত ঘ্রাণ আসছে।সে ধীরে ধীরে চোখ খোলার চেষ্টা করতে লাগলো।কিন্তু সামনের সব ঝাপসা মনে হচ্ছে।সে আরো কয়েকবার চোখের পাতা পিটপিট করে তাকালো।মাথায় প্রচন্ড ব্যাথা অনুভব করলো।এমনকি ডান পা টা নাড়াতে পারলো না।মাথা তুলে ধীরে ধীরে উপরে তাকিয়ে মাহাদ কে দেখতে পেলো। মাহাদ ঘুমিয়ে আছে।আর সে মাহাদের বুকে আছে।সে কোথায় আছে কিছুই বুঝতে পড়ছে না।ধীরে ধীরে তার অ্যাক্সিডেন্টের কথা মনে হতে লাগলো।কিন্তু এই মুহূর্তে মাহাদের বুকে তার ভীষণ আরাম লাগছে।ভীষণ শান্তি অনুভব হচ্ছে।সে বির বির করে বললো

-“এটা কি জান্নাত?”

-“না আমার বুক।”

দৃশ্য চমকে তাকিয়ে দেখলো মাহাদ তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।সে মাহাদের বুকে মুখ গুজে বললো
-“এখানে এতো শান্তি লাগে কেনো?”

-“আমার বুকে অশান্তি দিয়ে তোমার তো শান্তি লাগবেই।”

দৃশ্য মুচকি হাসলো। মাহাদ দৃশ্যর কপালে আলতো চুমু খেয়ে বললো
-“আমাকে কষ্ট দিয়ে ভীষণ মজা পাও তাই না?একটা বার ভাবলে না তোমার কিছু হলে আমার কি হতো?”

-“আমি বুঝতে পারিনি এমন কিছু হবে।”

মাহাদ দৃশ্যর হাতটা শক্ত করে ধরে হতে চুমু খেল। মাহাদ নরম সুরে বললো

-“একদিন জিজ্ঞেস করেছিলে না এই হাতটা শক্ত করে ধরে মায়ের সামনে দাড়াতে পারবো কিনা?আজ এই হাতটা শক্ত করে ধরে শুধু মায়ের না সারা দুনিয়ার সামনে দাঁড়াতে পারবো। তোমার হাতটা শেষ নিশ্বাস অব্দি ছাড়বো না বউ। শেষবারের মত আমার উপর বিশ্বাস রেখে দেখো।”

দৃশ্যর চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু ঝরলো। মাহাদ দৃশ্যর চোখের জল মুছে রাগী সুরে বললো

-“তোমার জন্য এতগুলো শাস্তি বরাদ্দ। এত অসচেতনভাবে কেন রাস্তায় হাটছিলে?”

-“আসলে আমি বুঝতে পারিনি।”

হঠাৎ দৃশ্যর মনে পড়লো সে কেনো রাস্তায় ওই ভাবে দৌড়ে গেছিলো।সে অস্থির হয়ে বললো

-“আ…আমি সেখানে ভাইয়াকে দেখেছিলাম।”

-“তোমার ভাইয়াই তোমাকে হসপিটালে নিয়ে এসেছে।”

দৃশ্যর চোখ ঝাপসা হয়ে আসলো।সে করুন দৃষ্টিতে মাহাদের দিকে তাকিয়ে বললো

-“আমি ভাইয়াকে দেখবো। কোথায় ভাইয়া?”

-“বাইরে আছে।তুমি শুয়ে থাকো।আমি ফাহিমকে পাঠাচ্ছি।আর তোমার জন্য আরো অনেকেই অপেক্ষা করছে।”

মাহাদ বেরিয়ে যাওয়ার আগে দৃশ্যকে বললো
-“তোমার দুয়ারে অনাবিল সুখ এসে করা নাড়ছে।সেই সুখটুকু পায়ে ঠেলে দিও না।কারণ তোমার ডিসিশন এর উপর অন্য করো বেচেঁ থাকা নির্ভর করছে।”

দৃশ্য এক দৃষ্টিতে মাহাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।আসলেই কি সুখ তার দুয়ারে বসে আছে?

#তোমার_আমার_প্রণয়
#israt_jahan_arina
#part_57

নিস্তব্দতা ছেয়ে আছে সারা রুম জুড়ে।দৃশ্য এক দৃষ্টিতে তার ভাইকে পর্যবেক্ষণ করছে।ফাহিম মাথা নিচু করে দৃশ্যর সামনে বসে আছে।অনেক অন্যায় করেছে সে বোনটার সাথে।নিজেকে তার জন্য কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না।
একটু আগে মা এসে দেখা করে গেছে।দৃশ্যকে দেখে হাউ মাউ করে কেঁদেছে।কোনো মা সন্তানের এই করুন পরিস্থিতি সহ্য করতে পারেন না।মেয়ের মুখে কতো শত চুমু খেয়েছেন তিনি।কেদে বলেছেন

-“তুই ঢাকায় এসে আমার সাথে যোগাযোগ কেনো রাখিস নি?আমি তোর চিন্তায় শান্তি পেতাম না।”

-“মা আমাকে মাফ করে দিও।আমি বাবার ভয়ে তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।”

-“তুই কেমন আছিস মা?”

-“চিন্তা করোনা আমি ভালো আছি।বাবা কেমন আছে?বাবা আসেনি?”

আনিকা কবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে দৃশ্যকে তার বাবার অবস্থার কথা জানালেন।দৃশ্য ডুকরে কেঁদে উঠে।বাবা নামক মানুষটি কাছ থেকে কখনো কোনো ভালোবাসা পায়নি।কিন্তু তবুও সে বাবা।তার সাথে রক্তের সম্পর্ক।বাবার অবস্থা দৃশ্যকে প্রচন্ড যন্ত্রণা দিয়েছে।সে অস্থির হয়ে বাবাকে দেখতে চাইলো।
আশরাফ হুসাইন লজ্জায় প্রথমে মেয়ের সামনে যাননি।একমাত্র মেয়েকে তিনি ভীষণ কষ্ট দিয়েছেন।অহংকারের বেড়াজালে থেকে তিনি সন্তানদের নিজের কাছ থেকে দূর করে ফেলেছেন।দৃশ্যর সামনে যাওয়ার সাহস তিনি পাচ্ছেন না।আনিকা কবির বুজিয়ে তাকে দৃশ্যর সামনে নিয়ে যায়।
হুইলচেয়ারে বসা প্যারালাইজড বাবাকে দেখে দৃশ্যর ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো।শক্ত সবল মানুষটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে।চেহারায় বয়সের ছাপ পড়েছে।সেই কঠিন ভাব আর বাবার মধ্যে নেই।ডান পাশ সম্পূর্ণ অবশ।

আশরাফ হুসাইন এক হাতে দৃশ্যর হাত ধরে অনেক সময় কাদলেন।দৃশ্যর কাছে মাফ চাইলেন নিজের কর্মকাণ্ডের জন্য।পরম আদরে দৃশ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।দৃশ্যর চোখ ভিজে উঠেছিলো।বাবার এই স্নেহময় হাতটাই সে সারা জীবন খুঁজেছে।কিন্তু পায়নি।আজ বাবার স্নেহ পেয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদেছে।

ফাহিমের দিকে তাকিয়ে দৃশ্য বললো
-“আমার সাথে কথা বলবে না ভাইয়া? এখনো রেগে আছো?”

ফাহিম ভেজা চোখে তাকালো দৃশ্যর দিকে।দাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে কাপা কাপা গলায় বললো
-“এই ভাইটার উপর একটু ভরসা রাখতে পাড়লি না?কেনো এই ভাবে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসলি?আমি তো ওই বিয়েটা কখনোই হতে দিতাম না।”

-“আমি ভীষণ ভয় পেয়ে গেছিলাম ভাইয়া।কি করা উচিৎ কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।”

-“আমি তোর ভাই হওয়ার যোগ্যই না।নিজের বোনকে কি করে এত কষ্ট দিলাম?সারা জীবন যাকে আগলে রেখেছি তার গায়েই হাত তুলেছে।যায় মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই সব বুঝে যেতাম,সে হাজার বার মুখে বলার পরও কেনো তার ভালোবাসা উপলব্ধি করতে পারলাম না।তোর যন্ত্রণা কমানোর বদলে আরো বাড়িয়ে দিয়েছি।”

কথা গুলো বলেই ফাহিম কেদে দেয়।দৃশ্যই ভাইয়ের হাতে হাত রেখে বলে
-“তুমি আমার বেস্ট ভাইয়া।যেই মানুষ গুলিকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করতে পারি তার মধ্যে তুমি অন্যতম।তুমি আমাকে আগলে রেখেছো।কোনো কষ্ট আমাকে ছুঁতে দাওনি।আর আগে যা হয়েছে ভুলে যাও।আমিও অনেক ভুল করেছি।পরিবারকে না জানিয়ে বিয়ে করেছি।আমাকে মাফ করে দিও ভাইয়া।”

ফাহিম দৃশ্যর কপালে চুমু একে বললো
-“আমার বুড়িটা অনেক বড়ো হয়ে গেছে।সব কিছু বুঝতে শিখে গেছে।”

দুই ভাই বোনের মধ্যে অনেক কথা হলো।নিজেদের মদ্যকার সকল মান অভিমান দূর করে নিলো।তখনই আনিকা কবির ভিতরে প্রবেশ করে বলেন
-“দেখ দৃশ্য তোর সাথে দেখা করতে কে এসেছে?”

দৃশ্য সামনের মানুষটিকে দেখে চমকে গেলো।পরক্ষণে বিশাল হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো
-“তমা আপু!”

তমা দৃশ্যর কাছে এসে দাড়ালো।ফাহিম বসা থেকে উঠে জানালার পাশে দাঁড়ালো।তমা সে দিকে এক পলক তাকিয়ে বললো
-“কেমন আছিস পিচ্ছি?”

-“ভালো।তুমি কেমন আছো আপু?”

আনিকা কবির হেসে বললেন
-“তমাকে আর আপু ডাকা যাবে না।সে তোর ভাবী হয়।সে এখন আমাদের বাড়ির বউ।”

দৃশ্য চমকে তমার দিকে তাকায়।তমা তখন মাথা নিচু করে বসে আছে।আনিকা কবির চলে যেতেই দৃশ্য উচ্ছসিত কন্ঠে বললো

-“বলেছিলাম না তুমিই আমার ভাবী হবে।মিললো তো?”

তমা এক পলক জানালায় দাড়ানো ফাহিমের দিকে তাকালো।ফাহিম তখন বাইরের ব্যাস্ত রাস্তা দেখায় ব্যাস্ত।তমা ভেজা চোখে দৃশ্যর দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বললো

-“ঠিক বলেছিস।আমি তোর ভাইয়ের বউ ঠিকই হয়েছি।কিন্তু ফাহিমের না নাবিলের বউ হয়েছি।”

দৃশ্য আঁতকে উঠল।এমন কিছু শুনবে আশা করেনি।তমা আপু তো ভাইয়াকে পাগলের মতো ভালোবাসতো।তাহলে নাবিল ভাইকে বিয়ে কেনো করলো?তমা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।আজও তার সেই দিন গুলির কথা স্পষ্ট মনে আছে।
“দৃশ্যর ব্যাপারটা নিয়ে সে ফাহিমের উপর ভীষণ রেগে ছিলো।মানুষটা এমন কেনো?আদরের বোনটাকে একটুও বুজলো না।সেখানে তাকে কি করে বুজবে?সে ফাহিমের সাথে তেমন কথা বলতনা।ফাহিমকে আগের মত জ্বালাতো না।দৃশ্য বাড়ি থেকে চলে আসার পর ফাহিম অনেকটা ভেঙে পড়ে।দিন রাত এক করে দৃশ্যকে খুঁজতে থাকে।

তার বেশ কিছুদিন পর তমার বাবা একদিন জানায় তার বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে।তমা তখন অস্থির হয়ে পড়ে।কি করবে কিছুই বুঝতে পারেনা।বাবার উপর সে কোনোদিন কথা বলে নি।কিন্তু সেই দিন বলে।সে বিয়ে করবে না বলে জানায়।কিন্তু বাবা নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। আরো বেশি চমকে যায় তখন যখন শুনে তার বিয়ে নাবিলের সাথে ঠিক হয়েছে।এক ভাইকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবেসে অন্য ভাইয়ের সাথে সে কি করে সংসার করবে?

তমা দিক বেদিক ভুলে ফাহিমের সাথে কথা বলতে চায়।কিন্তু ফাহিম তখন রাজনীতি নিয়ে ভীষণ ব্যাস্ত।তমা ফাহিমকে একবারের জন্য সামনে পেতো না।যেনো মানুষটা ইচ্ছা করে তাকে এড়িয়ে চলছিলো।

সেদিন তমার হলুদ ছিলো।তমা হলুদ শাড়ী পরে বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলো। দু চোখ বেয়ে তার অশ্রু ঝরছিল।তার বিয়ে নিয়ে সবার মাঝে আনন্দের শেষ নেই।একমাত্র সেই পারছেনা আনন্দ করতে।চোখ বন্ধ করলে সে শুধু ফাহিমকে দেখে।কষ্টে তার বুক ফেটে যাচ্ছে।ছোট বেলা থেকে সে মানুষটিকে ভালোবাসে।কিন্তু কোনোদিন মুখ ফুটে বলতে পারেনি।আর মানুষটিও কখনো কি কিছুই বুঝে নি?

হঠাৎ তার চোখ পড়ে সামনের বাড়ির ছাদের উপর।সেখানে দাঁড়িয়ে ফাহিম সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। তমা আর কিছুই ভাবতে পারলো না।সে এক দৌড়ে সেই বাড়ির ছাদে চলে গেলো। ফাহিম এর সামনে এসে হাপাতে লাগলো।ফাহিম সিগারেট টান দিয়ে কপাল কুচকে ধোঁয়া ছাড়তে লাগলো। তমা বললো

-“আপনি এমন কেনো ফাহিম ভাই।আমি কবে থেকে আপনাকে খুঁজছি।আর আপনি গা ঢাকা দিয়ে আছেন?”

-“তুই এখানে কি করিস?আজ না তোর হলুদ?”

তমা ভীষণ রেগে গেলো।সে ফাহিমের সামনে এসে বললো
-“আপনি কি সত্যি জানেনা আমি কেনো ছুটে এসেছি?এতটাই অবুঝ আপনি?”

-“কি বলছিস এসব?”

-“আপনি কি সত্যিই বুঝেন না আমি কেনো আপনার পেছনে পড়ে থাকি?কেনো আপনার এতো অপমানের পর ও বার বার আপনার পেছনে ছুটে আসি?কেনো আপনার সাথে কথা বলার জন্য অস্থির হয়ে থাকি? কেনো একটা দিন আপনাকে না দেখলে অস্থির হয়ে পড়ি?”

-“আমি কি করে বলবো?”

-“আমার মুখ থেকেই শুনতে চান তাই তো? ওকে তবে বলছি,আমি আপনাকে ভালোবাসি।সেই ছোট বেলা থেকেই আমার স্বপ্ন পুরুষ আপনি।আমার চিন্তা ধারা সবটা জুড়ে শুধু আপনি।আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না ফাহিম ভাই।”

বলেই সে ফাহিমকে জড়িয়ে ধরে কাদতে লাগলো।কয়েক মুহূর্তের জন্য ফাহিম স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে থাকে।পড়ে ফাহিম দ্রুত তমাকে ছাড়িয়ে ধমকে বললো

-“পাগল হয়ে গেছিস?আজ বাদে কাল তোর বিয়ে।আর তুই পর পুরুষকে জড়িয়ে ধরে আছিস?তোর লজ্জা করে না?”

-“না করে না।আমি এই বিয়ে কিছুতেই করবো না।আমার বর শুধু আপনি হবেন।এই বিয়ে বন্ধ করে দিন।”

-“পাগলামি করিস না।আমি তোকে ভালবাসি না।এমনি দৃশ্যর বিষয়ে নিয়ে আমি ভীষণ চিন্তায় আছি।তার মধ্যে তোর এই সব পাগলামি মোটেও সহ্য করবো না।”

তমা ফাহিমের পা জড়িয়ে ধরলো।আর কেদে কেঁদে বললো
-“আমাকে আজ ফিরিয়ে দিবেনা ফাহিম ভাই।তাহলে আমি শেষ হয়ে যাবো।অন্য কাউকে আমি কোনো দিন মেনে নিয়ে পারবো না।আপনি একবার বাবার সাথে কথা বললে বাবা এই বিয়ে বন্ধ করে দিবে।”

ফাহিম দ্রুত নিজের পা ছাড়িয়ে তমাকে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলো।আর রেগে বললো
-“সব কিছুর একটা সীমা থাকে।আমি তোকে বিয়ে করতে পারবো না।নাবিলের মতো ডক্টর ছেলে তোকে বিয়ে করছে এটাই তোর ভাগ্য।নাহলে তুই ওর যোগ্য ও না।”

তমা যেনো শেষ ভরসা টুকু হারিয়ে ফেললো।আজ তার মরে যেতে ইচ্ছে করছে।সে কাপা কাপা গলায় বললো

-“আপনি কোনো দিন আমাকে বুঝতে পারেন নি।আমার অনুভূতির কোনো মূল্য দেননি।আরে যে নিজের বোনের ভালোবাসা বুঝতে পারেনা সে আমার ভালোবাসা কি করে বুজবে?আপনাকে ভালোবাসা আমার জীবনের সবচাইতে বড়ো ভুল।একদিন আপনিও আমার মতো এই আগুনে জ্বলবেন।দেখে নিয়েন?”

তমা কাদতে কাদতে চলে এসেছিল।পরদিন রোবটের মতো বউ সেজে বসে ছিলো।ফাহিম বিয়ের নানা কাজে ব্যাস্ত ছিলো।কাজী যখন তমাকে কবুল বলতে বলছিলো।তখন সে এক দৃষ্টিতে দূরে দাড়ানো ফাহিমের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তার মন বলছিলো ফাহিম ভাই শুধু একবার ইশারা করুন।আমি সব ফেলে আপনার বুকে চলে আসবো।কিন্তু তেমন কিছুই হলো না।চোখ ভিজে উঠেছে তার।

ফাহিম ও তমার দিকে তাকিয়ে আছে।বউ সাজে অসম্ভব সুন্দর লাগছে তমাকে।ফাহিমের দৃষ্টি যেনো নড়ছেই না।এই প্রথম ফাহিম ফিল করলো সে তমার প্রতি দুর্বল।ভীষণ দুর্বল।এই দুর্বলতা আজ থেকে না,ছোট বেলা থেকে।সে তো কোনো মেয়ের সাথে কথাও বলে না।এমনকি চোখ তুলে কোনো মেয়ের দিকে তাকায় না।কিন্তু তমা!সে তোমার সাথে সারা দিন ঝগড়া করে।ওকে শাসন করে।ওর সব বক বক শুনে।ওর দিকে অন্য কোনো ছেলে তাকালে সহ্য করতে পারে না।এমন কেনো হতো?এটাই কি ভালোবাসা?তার মানে সে কি অনেক আগে থেকেই তমাকে ভালোবাসতো?তবে বুঝতে কেনো পারতো না?

ফাহিম এতো দিনে বুঝতে পারলো তমার প্রতি তার কি ফিলিংস।কিন্তু ততো খনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।তমা কবুল বলে অন্য কারো হয়ে গেছে।

ফাহিম সেদিন সারা রাত দুচোখ এক করতে পারলো না।তমা অন্য কারো বউ এই বিষয়টা সে ঠিক হজম করতে পারছে না। মেয়েটাকে সেদিনও হলুদ শাড়িতে ভীষণ সুন্দর লাগছিলো।সে কেনো সেদিন তমাকে ফিরিয়ে দিলো?ভালোবাসার অনুভূতি সে তখন বুজলো যখন মেয়েটা তার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে গেছে।চোখ বার বার ভিজে উঠছে।সে যে বুঝতে ভীষণ দেরি করে ফেলেছে। এখন তমা তার জন্য নিষিদ্ধ।তমার বলা কথা একদম মিলে যাচ্ছে।সে সত্যি আগুনে জ্বলছে।অনুভূতির আগুনে।

সব শুনে দৃশ্য থ হয়ে বসে রইলো।তার চোখ ভিজে উঠেছে।এই অসীম ভালোবাসাকে তার ভাই পায়ে ঠেলে দিয়েছে?কেমন করে করলো।তমা তখনও ফুঁপিয়ে কেঁদে চলছে।দৃশ্য তমার হাতে হাত রেখে শান্ত করলো।তমা চোখের জল মুছে মলিন হেসে বললো

-“আমি ঠিক আছি।নাবিল আমাকে অনেক ভালো রেখেছে।সে আমাকে যথেষ্ট সময় দিয়েছে।তোর ভাইয়ের কাছে যে সম্মান আর ভালোবাসা আমি পাইনি সেটা নাবিল আমাকে দিয়েছে।”

দৃশ্য জানালার পাশে দাড়ানো ভাইয়ের দিকে তাকালো।দেখলো তার ভাই টিশার্টের হাতার সাহায্যে চোখ মুছছে।দৃশ্য বুঝতে পারলো তার ভাইয়ের মনের অবস্থা।ফাহিম তাদের দিকে না তাকিয়ে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।
তখনই নাবিল তার কেবিনে ঢুকলো।দৃশ্য অনেকদিন পর নাবিলাকে দেখে খুশি হয়।তবে তার কোলে ছোট একটা বাচ্চা মেয়েকে দেখে চমকে যায়।তমা মুচকি হেসে বললো

-“আমাদের মেয়ে।”

নাবিল হেসে বললো
-“কীরে এতদিন পর দেখা। তাও হসপিটালে?আমার খোঁজে এসেছিস নাকি?তার জন্য অ্যাকসিডেন্ট করতে হবে?”

তমা ধমকে বললো
-“তুমি এই সময় মজা করছো?জীবনেও ঠিক হবে না?”
-“তুমি পাশে থাকলে আমি এমনই ঠিক থাকি জান।দূরে গেলেই এমন অস্থির হয়ে পরি।”

তমা বেশ লজ্জা পেলো।ছোট বোনের সামনে নির্লজ্জের মতো আচরণ শুরু করেছে।দৃশ্যর মনটা ভরে গেলো তাদের দেখে।এই মানুষ দুটি ভালো আছে এতেই সে ভীষণ খুশি।

আসলে নাবিল অনেক আগে থেকেই তমাকে পছন্দ করতো। তমার চঞ্চলতা তার মনে ভালোবাসার সৃষ্টি করেছে।ছোট্ট তমাকে দেখেই তার হৃদস্পন্দন বেড়ে যেতো।কিন্তু কখনো সে তমাকে মনের কথা জানায় নি।তার পর সে ঢাকায় হোস্টেলে চলে আসে।নিজের ক্যারিয়ারের ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।কিন্তু তমা তার মনে সব সময় বিচরণ করতো।ডক্টর হয়ে সে বাবাকে জানায় তমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব দিতে।বাবাও ছেলের কথায় রাজি হয়ে যায়।এই ভাবেই সে তার ভালোবাসা কে নিজের জীবনে পেয়ে যায়।সে বুঝতে পেরেছে তমার জীবনে হয়তো অন্য কেউ ছিলো।তাই সে তমাকে সময় দিয়েছে।নিজের ভালোবাসা দিয়ে তমার মন জয় করেছে। এখন তারা ভীষণ সুখে আছে।

সবাই চলে যেতেই দৃশ্য কিছুক্ষণ রেস্ট নিলো।প্রায় বিকেলের দিকে তার ঘুম ভাঙলো।মাথায় এখনো চিনচিন ব্যথা করছে। চোখ মেলে আশে পাশে তাকাতেই হঠাৎ কিছুটা চমকে উঠলো। তার সামনে আখি রহমান বসে আছে। দৃশ্যকে তাকাতে দেখেই তিনি মুচকি হাসলেন। আখি রহমানকে এখানে দেখে দৃশ্য কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। এই মানুষটাকে সে ভীষণ সম্মান করে। তাইতো তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মাহাদকে তার নিজের জীবনে চাইনি। তিনি কি তাকে কিছু কটু কথা শোনাতে এসেছেন? নাকি মাহাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে বলতে এসেছেন?কিন্তু সে তো মাহাদের কাছ থেকে দূরেই আছে।সেদিন রাতে যাই হোক।তার অজুহাতে সে মাহাদকে কিছুতেই আটকে রাখবে না। মাহাদ নিজের জীবন গুছিয়ে নিক সেটাই চায়।

আখি রহমান বুঝতে পারলেন তাকে এখানে দেখে দৃশ্য কিছুটা চিন্তিত হয়ে আছে। তাই তিনি নরম গলায় দৃশ্যকে বললেন
-“কেমন আছো মা?”

দৃশ্য চমকে গেল। সে এতটা শান্ত ব্যবহার কিছুতেই আশা করেনি।আখি রহমান আবার বললেন
-“কি আমার সাথে কথা বলবে না?”

-“জি…..ভালো আছি।”

-“অনেক বড় হয়ে গেছো।আমার ছেলে যখন প্রথম তোমাকে নিয়ে এসেছিল তখন অনেক ছোট ছিলে। আমিতো প্রথম দেখে অবাক হয়েছিলাম আমার ছেলে এই বাচ্চা মেয়েটির প্রেমে পড়েছে?”

দৃশ্য কেমন রিয়েক্ট করবে বুঝতে পারছে না।সে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আখি রহমান আবার বললেন
-“আমার ওপর রেগে আছিস মা?”

-“ছি ছি! না আন্টি।এমন কিছুই না।আমার জন্য বরং আপনি ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন।আমার জন্যই আংকেল…

দৃশ্য আর বলতে পারলো না।আখি রহমান বললেন
-“এতে তোমার কোনো দোষ নেই মা।বরণ আমার জন্য তোমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে।তোমার শশুর আমাকে তোমার দায়িত্ব দিয়ে গেছিলো। কিন্তু আমি সেই দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। তোমাকে যোগ্য সম্মান দিয়ে বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নিতে বলেছিল। কিন্তু তখন আমি এর কিছুই করতে পারিনি। তোমার শ্বশুরকে হারিয়ে আমি আসলে তখন নিজের মধ্যে ছিলাম না। তাই ভুল সঠিক কিছুই বিবেচনা করতে পারিনি। আমাকে মাফ করে দিও মা। আমার জন্য তোমরা দুইজন অনেক কষ্ট সহ্য করেছো। আমিতো এতটাই স্বার্থপর হয়ে গেছিলাম যে নিজের ছেলের কষ্টটা অনুভব করতে পারিনি। আমার ছেলেটা ভালো নেই মা তোমাকে ছাড়া। ছেলের চোখে আমি তোমার জন্য অসীম ভালোবাসা দেখেছি। এ কয়েক বছরে আমার ছেলেটার মুখে আমি কোন হাসি দেখতে পাইনি। একদম বখে গেছে আমার ছেলেটা। এবার অন্তত আমার ছেলের হাতটা শক্ত করে ধরে তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসো। তোমাদের দুজনকে সুখে দেখলেই তোমার শশুরের আত্মা শান্তি পাবে। আর আমিও অপরাধমুক্ত হব। তুমি ছেলেটাকে কষ্ট দিও না মা আর নিজেও কষ্ট পেয়ো না।”

আখি রহমান চোখের জল মুছে দিলেন। দৃশ্যর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।দৃশ্যর কপালে চুমু খেয়ে তারপর মুচকি হেসে বললেন

-“আমার ঘরের লক্ষ্মীকে আর দূরে রাখতে চাইনা। এত মিষ্টি ছেলের বউটাকে কি কিছুতেই দূরে রাখা যায়? আমি আর তুমি মিলে আমার ছেলেটাকে একদম সোজা করে ফেলব। কি আমাকে সাপোর্ট করবে না?তোমার মায়ের সাথে আমি অলরেডি কথা বলে নিয়েছি। আমার ছেলে বউকে আমি ধুমধাম করে ঘরে তুলতে চাই। এখন শুধু তোমার মতামত বাকি। আমার উপর অভিমান করে আমার ছেলেটাকে আর কষ্ট দিওনা। তোমাকে ছেড়ে আমার ছেলেটা ভালো থাকবে না।”

দৃশ্য ফুঁপিয়ে কেদে উঠল।তার চিৎকার করে কাদতে ইচ্ছে করছে।মানুষ গুলো তাকে এতো ভালোবাসে কেনো?সে কি আদো এতো ভালোবাসার যোগ্য?

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here