#তোমার_আমার_প্রণয়,part_44
#israt_jahan_arina
ভীষণ ভয় ও আতঙ্ক নিয়ে দৃশ্য পেছনে তাকালো।মাকে দেখে বেশ চমকে গেলো।আনিকা কবির অশ্রুসিক্ত নয়নে মেয়ের দিকে তাকালেন।মেয়ে এমন কিছু পরিকল্পনা করছে সেটা তিনি আগেই টের পেয়েছেন।এই মেয়েটাকে তিনি ভীষণ ভালোবাসেন।মেয়ের কপালে এতটা দুঃখ থাকবে তিনি ভাবতেই পারেননি।মেয়েটা ছোট বেলা থেকেই স্বাধীনচেতা। মুক্ত পাখির মতো উড়তে চাইতো।কিন্তু বাবার ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে।আর আজ তার মেয়েটা মুক্ত হতে যাচ্ছে।তিনি দৃশ্য কপালে চুমু খেয়ে বলেন
-“যেখানই থাকিস ভালো থাকিস।আমিতো তোর জন্য কিছুই করতে পারিনি।তবে আমার বিশ্বাস তুই হেরে যাবিনা।”
দৃশ্য বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো।আসলেই মায়ের কাছে কিছুই লুকানো থাকে না।সে বললো
-“মা আমাকে মাফ করে দিও।আমার জন্য তোমাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে।আর আজ স্বার্থপরের মতো তোমাকে এই বিপদে ফেলে চলে যাচ্ছি।কি করবো আমি মা।বাবার এই অন্যায় মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না।”
তিনি দৃশ্যর চোখের পানি মুছে বলেছিলো
-“আমার মেয়ে মোটেও স্বার্থপর না।আর তুই যা করছিস ঠিক করছিস।তোর বাবার সব অন্যায় আমি মুখ বুজে সহ্য করে গেছি।যদি তোর মতো সাহসী হতে পারতাম তবে কবেই চলে যেতাম এই নরক থেকে।”
তারপর তিনি দৃশ্যর হতে কিছু টাকা গুজে দিয়েছিলেন। এর চাইতে বেশি কিছু তার পক্ষে করা সম্ভব ছিলনা।তিনি দ্রুত দৃশ্যকে যাওয়ার তাড়া দিলেন।আশরাফ হুসাইন টের পেলে দৃশ্যকে শেষ করে ফেলবে।দৃশ্য তার মাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিলো।এই মানুষটাকে ফেলে যেতে দৃশ্যর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে।মায়ের কোলের নিরাপদ আশ্রয় ছেড়ে আজ তাকে যেতে হচ্ছে।দৃশ্য মাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেলো। আনিকা কবির দৃশ্যর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলেন।তিনি জানেন সমনের পথ দৃশ্যর জন্য সহজ হবে না। তবুও মেয়েটা এই নরক থেকে তো মুক্তি পেলো।
বাসার গেটে নাবিলা দাড়িয়ে ছিলো।দৃশ্য আসতেই তার হাতে ট্রেনের টিকিট ধরিয়ে দিলো।দৃশ্য নাবিলাকে জড়িয়ে ধরে বললো
-“তুই না থাকলে আমি এখান থেকে বের হতে পারতাম না নাবি।তোর এই ঋণ আমি শোধ করতে পারবোনা।তুই আমার লাইফের এঞ্জেল।যে আমি কিছু বলার আগেই সব বুঝে যায়।”
নাবিলা দু চোখ ভিজে উঠলো।ছোট বেলা থেকে তারা এক সাথে বড়ো হয়েছে।কতো খুনসুটি করেছে।অথচ আজ জীবন এমন পর্যায়ে এসে পড়েছে যে নিজেদের আলাদা হতে হচ্ছে।আবার কবে দেখা হবে জানা নেই।সে দৃশ্যকে ঝাপটে ধরে বললো
-“আমার বিশ্বাস তুই সব সামলাতে পারবি।এতো সেন্টি খাইস না।ঢাকায় পৌঁছে ওই ফ্রেন্ডের সাথে যোগাযোগ করিস। আই মিস ইউ।”
-“ভালো থাকিস।মায়ের খেয়াল রাখিস।আর কখনো কাউকে অন্ধের মত ভালোবেসে বিশ্বাস করিস না।দেখবি তোকে মাঝ পথে ছুড়ে ফেলে দিবে।তখন নিজেকে সামলাতে পারবি না।ভালো থাকিস।”
কথাটা বলে দৃশ্য চোখের পানি মুছে বেরিয়ে গেলো।আর নাবিলা সেই পথে দাড়িয়ে রইলো যতক্ষণ না দৃশ্য দৃষ্টির আড়ালে হয়।প্রচন্ড কষ্ট আর অভিমান জমে আছে মেয়েটার মাঝে।এই ইমোশনাল মেয়েটা সব সামলাতে পারবেতো?
ধূমকেতু এক্সপ্রেস ছুটে চলেছে তার গন্তব্যের দিকে।দৃশ্য জানাল খুলে বাইরের তাকিয়ে আছে।রাতের আধারে বাইরে তেমন কিছুই দেখা যাচ্ছে না।মাঝে মাঝে দূরে ছোট ছোট আলো ঝল ঝল করে উঠছে।তার অবাধ্য নয়ন জোড়া বার বার ভিজে উঠছে।জীবনে প্রথম সে একা এতটা পথ পারি দিচ্ছে।আজ তার পাশে কেউ নেই।সামনের দিন গুলিতে সে কি করবে কিছুই জানেনা।এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
ট্রেন ঢাকায় থামলো ভোর চার টায়।চারদিকে তখনও ঘুটঘুটে অন্ধকার।ট্রেন থেকে নেমে দৃশ্যর ভীষণ ভয় পেতে থাকে।এই অচেনা শহরের কোনো কিছুই সে ঠিক মতো চেনেনা।রাস্তার সামনে আসতেই দৃশ্যর ভয় বাড়তে লাগলো।চারদিক ভীষণ নীরব।কোনো যানবাহনের দেখা পেলনা সে।একটু সামনেই কয়েকটা মেয়েকে দেখে সে এগিয়ে যায়। এখান থেকে হোস্টেলে যাওয়ার রাস্তাটা জিজ্ঞাসা করতে।সে সেখানে যেতেই একজন লোক তার সামনে এসে দাড়ালো।লোকটা দৃশ্যর দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে।দৃশ্য ভয়ে কয়েকটা ঢোক গিললো।লোকটাকে দেখে তার সুবিধার মনে হচ্ছেনা।সে শুনেছে ঢাকা শহরে চোরের অভাব নেই।এই ব্যাটাকে তার চোর মনে হচ্ছে।সে হাতের ব্যাগ আরো শক্ত করে ধরলো।লোকটা কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে বললো
-“ওই যাবি?”
দৃশ্য ব্রু কুচকে তাকালো।লোকটা আবার বললো
-“আরে যতো চাইবি ততো দিমু।”
দৃশ্য ভয়ে কিছুটা সরে আসলো।লোকটার কথার মানে দৃশ্য কিছুই বুজলো না। লোকটা আবার দৃশ্যর সামনে এসে বাজে ইঙ্গিত করে বললো
-“ওই নাটক করস কেন?আমারে খুশি করলে যতো চাইবি ততো দিমু।তোর ফিগারটা মনে ধরছে।”
দৃশ্যর কান দিয়ে মনে হয় ধোঁয়া বের হচ্ছে।তার বাবার বয়সী লোকটা এমন বিচ্ছিরি কথা কি করে বলতে পারে?দৃশ্য বুজলো লোকটার উদ্দেশ্য খারাপ।সে এক দৌড়ে আবার ট্রেন স্টেশনের ভেতরে চলে আসলো।সকালের আগে এখন থেকে বের হাওয়া নিরাপদ না।প্লাটফরমে দেখলো অনেকেই নিচে বিছানা পেতে শুয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এদের বাড়ি ঘড় নেই।রাস্তায় থাকে তারা।দৃশ্য ভাবছে সেও তাদের মতোই। তারও এই শহরে মাথা গোঁজার জায়গা নেই।দৃশ্য এক বয়স্ক মহিলার পাশে ঠান্ডা ফ্লোরে শুয়ে পড়লো।মহিলার পরনের কাপড় অনেক জায়গাতে ছেড়া।দৃশ্য ব্যাগ থেকে একটা ওড়না বের করে মাথা অবধি ঢেকে শুয়ে পড়লো। কাচু মাচু হয়ে ওই বয়স্ক মহিলার গা ঘেঁষে রইলো।ভয়ে তার শরীর কাপছে।চারপাশে হায়নার দল ঘুরে বেড়াচ্ছে।সুযোগ পেলেই তাকে ছিড়ে খুবলে খেতে সময় নিবে না।
দৃশ্যর বুক ফেটে কান্না আসছে।জীবন কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে।আজ নিজের নরম বিছানা ফেলে এই প্লাটফরমে ঠান্ডা ফ্লোরে শুয়ে থাকতে হচ্ছে।এক নতুন জগতে চলে এসেছে সে।যেখানে প্রতিটা মুহূর্তও তাকে সংগ্রাম করে বাঁচতে হবে।দৃশ্য ফুঁপিয়ে কেঁদে চললো। তাকে সান্তনা দেবার মতো কেউ নেই।চোখ জোড়া বন্ধ করতেই মাহাদের মুখটা ভেসে উঠলো।এই মানুষটাকে সে পাগলের মতো ভালোবেসে আজ ঘর হারা।এই মানুষটার ভালোবাসা আজ তাকে রাস্তায় এনে নামিয়েছে।
সকাল হতেই দৃশ্য বেরিয়ে পড়লো স্টেশন থেকে হোস্টেলের উদ্দেশ্যে।
একটা রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে দৃশ্য আর তার সেই ফ্রেন্ড।এই মেয়েটার সাথে আজ দৃশ্যর প্রথম দেখা হচ্ছে।ছিপছিপে গড়নের মেয়েটা দেখতে সুন্দরী।মেয়েটার নাম জিনিয়া।মেয়েটার সাথে তার ফেসবুকের মাধ্যেমে পরিচয়।তখন দৃশ্য ক্লাস টেনে উঠেছে মাত্র।তখন এই অচেনা মেয়েটার সাথে তার কনভারসেশন শুরু হয়।কয়েক দিনে মধ্যেই তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে।দৃশ্যর জীবনের সব কথাই সে তার সাথে শেয়ার করতো।
মাহাদ কেও দৃশ্য জিনিয়ার কথা বলেছিল। মাহাদ কখনোই তাকে ফ্রেন্ডশীপের ক্ষেত্রে বাধা দেয়নি।শুধু একটাই শর্ত ছিল কোনো ছেলে ফ্রেন্ড থাকা যাবে না।সে নাকি দৃশ্যকে কোনো ছেলের সাথে সহ্য করতে পারে না।মেয়েদের সাথে যতো খুশি বন্ধুত্ব গড়ে তোলা যাবে।দৃশ্য ও সব মেনে নিতো।তাছাড়া সে নিজেও ছেলেদের সাথে তেমন মিশতো না।তার প্রধান কারণ তার ভাই আর বাবা।তাদের ভয়ে সে ছেলেদের কাছ থেকে দূরে থাকতো।কিন্তু মাহাদ নামক মানুষ টা কেমন করে যেনো তার জীবনে সাথে জড়িয়ে গেলো।তাকে ভালোবাসার উত্তাল সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো।আর তাই তো আজ সে কুল হারা।
জিনিয়া অবাক চোখে দৃশ্যকে দেখছে।সকালে রুবিনা খালা যখন তাকে খবর দিলো একটা মেয়ে তার সাথে দেখা করতে এসেছে সে ভীষণ অবাক হয়। এতো সকালে কে আসতে পারে?নিচে নেমে দৃশ্যকে দেখে বেশ চমকে গেছিলো সে।
জিনিয়া বললো
-“আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা তুই এমন একটা কাজ করেছিস?আমাকে তো আগে কিছুই জানালি না।”
-“এই ভাবে না বলে চলে আসার জন্য সরি।আসলে আমি যাওয়ার আর জায়গা খুঁজে পাচ্ছিলাম না তাই।আর আগে ইনফর্ম করলে বাবা আমাকে খুঁজে বের করে ফেলবে।আমাকে প্লিজ একটা থাকার জায়গা খুজে দে।”
-“আমার তো কলেজ শেষ।আর পাঁচ দিন পর আমি হোস্টেল ছেড়ে দিবো।ভার্সিটি পরীক্ষার জন্য আবার বাড়িও যেতে পারবো না।তাই একটা আপুর সাথে মিলে ছোট একটা বাসা ভাড়া করেছি।আমাদের আরো একজন রুম মেট দরকার।তুই চাইলে থাকতে পারিস।কিন্তু এই পাঁচ দিন কষ্ট করে কোনো হোটেলে থাকতে হবে তোকে।এই হোস্টেলে ঢুকতে দিবেনা তোকে।”
-“আমার সমস্যা নেই।তুই একটা হোটেল বুক করে দে।আমি তো কিছুই চিনিনা।”
দৃশ্য পাঁচদিন হোটেলে ছিলো।তারপর সে বাসায় শিফট করে।ছোট্ট দুই রুমের বাসা।সেখানেই তার প্রথম দেখা হয় লতা আপুর সাথে।মানুষটা তাকে ভীষণ স্নেহ করে।দৃশ্যর বিষয় সবটাই সে জিনিয়ার কাছ থেকে জেনেছে। এতোটুকু বাচ্চা মেয়ের জীবনে এতো ঝড় বয়ে গেছে ভেবে তার ভীষণ খারাপ লেগেছে।
দৃশ্য দিন রাত নিজের রুমে পড়ে থাকতো।এই বিষাদ ময় জীবনটা আর নিতে পারছিলনা সে।একাকিত্ব তাকে গিরে ধরেছিলো।হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠতো।চিৎকার করে মাহাদের নামে হাজারো অভিযোগ তুলতো।পরিবার ছাড়া সে ভীষণ অসহায় হয়ে পড়েছিলো।হাতে তেমন টাকাও নেই।
আবার তার শিক্ষাগত যোগ্যতাও মাত্র এইচ এস সি।সে তো চাইলেই চাকরিও করতে পারবে না। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছিলনা।সব কিছু ছিলো এলোমেলো।রাতে তার একদম ঘুম হতো না।সে পুরোপুরি ডিপ্রেশনে চলে যায়।ডিপ্রেশন থেকে দৃশ্য আরো একবার সুইসাইডের চেষ্টা করে।বেশ কিছু ঘুমের ঔষধ খেয়ে ফেলে।লতা আর জিনিয়া মিলে তাকে হসপিটালে নিয়ে ওয়াস করায়।দৃশ্যকে বাসায় এনে লতা আর জিনিয়া তাকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।তাকে সময় দেয়।বাইরে ঘুরতে নিয়ে যায়।
ততদিনে দৃশ্য দের রেজাল্ট বের হয়।দৃশ্য পায় 4.60 । এই রেজাল্ট দৃশ্য তেমন মন খারাপ করেনা।কারণ সে যে পরিস্থিতিতে পরীক্ষা দিয়েছে সেখানে পাস করাটাও মুশকিল ছিলো।দৃশ্য আর পড়তে চায়না।কারণ তার সেই মন মানুষিকতা ছিলো না।লতা অনেক বুঝায়।সে যদি স্টাডি করে তবে খুব সহজেই চাকরি খুঁজতে পারবে।নিজেকে এই শহরে টিকিয়ে রাখতে পারবে।লতা নিজের টাকায় দৃশ্যকে জিনিয়ার সাথে ভর্তি করিয়ে দেয়।সাথে দৃশ্যকে দুইটা টিউশন দিয়ে দেয়।লতা চাইতো দৃশ্য ব্যাস্ত থাকুক।বেস্ত থাকলে দৃশ্যর মাথায় সুইসাইডের চিন্তা আসবেনা। ডিপ্রেশন থেকে মুক্তি পাবে।
সে নিজ দায়িত্বের দৃশ্যকে একজন সাইক্রেটিস দেখায়।কারণ দৃশ্য তখন চরম ভাবে ডিপ্রেশনের ভুগছিল। সাইক্রেটিস এর পরামর্শে ধীরে ধীরে দৃশ্য কিছুটা স্বাভাবিক হয়।
লতা আপু আর জিনিয়াকে নিয়ে তার নতুন জীবন শুরু হয়।সে অনেকটাই নিজেকে সামলে নিতে শুরু করে।সারাদিন ক্লাস আর টিউশন নিয়ে ভীষণ ব্যাস্ত হয়ে পড়ে।লতা আর জিনিয়া তাকে আর্থিকভাবে অনেকটা সাপোর্ট দিতো।কিন্তু তারা নিজেরাও তেমন সচ্ছল পরিবারে না।তাই তাদের উপর আর বোঝা হতে চাইতো না।অর্থ কতটা জরুরি সে প্রথম তখন বুঝতে পারে।অর্থ উপার্জন যে সহজ বিষয় না সেটা বুঝতে পারলো।একটা টাকা খরচ করতে তার অনেকবার ভাবতে হতো।লেখাপড়ায় প্রচন্ড মনোযোগী হতে শুরু করে সে।তার এই অবস্থা থেকে বের হতে একমাত্র লেখাপড়ায় সাহায্য করতে পারবে। এই নতুন শহরে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে থাকে।অনেক বার হোচট খেয়ে পড়ে যেতো।আবার নিজেকে শক্ত করে নতুন পথ চলা শুরু করতো।তবে দিন শেষে ভালোবাসার মানুষটা ঠিক তার কল্পনায় এসে হানা দিতো।তাকে আবার দুর্বল করে দিতো।
অনেক ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ একদিন দৃশ্য টিভিতে মাহাদের গান শুনতে পায়।সেই চিরো চেনা সুর।কতো রাত এই গলায় গান শুনে সে ঘুমিয়েছে তার হিসেব নেই।
যতবার দৃশ্য টিভি তে মাহাদ কে দেখতো ততো বার তার অন্তরের ক্ষতটা আরো বেড়ে যেতো।সুন্দরী মডেলদের সাথে মাহাদের ভিডিও গুলি চোখে পড়লে সহ্য করতে পারতো না।দৃশ্যর ভীষণ অভিমান হতো।মানুষটা তাকে ভুলে দিব্যি ভালো আছে।অথচ সে মানুষটার বিরহে শেষ হয়ে যাচ্ছে।ধীরে ধীরে দৃশ্য এই সব এভোয়েড করতে লাগলো।সে দেখতে চায়না মানুষটাকে।নিজেকে আর এলোমেলো করতে চায় না।
অনেক দিন যাবত দৃশ্য চাকরির সন্ধান করছিলো।আসলে শুধু মাত্র টিউশনির টাকায় সে কিছুতেই চলতে পারছিলো না।বেশ কয়েক জায়গাতে ইন্টারভিউ দিয়েছে।কিন্তু অনার্স কমপ্লিট করা ছাড়া কোথাও চাকরি হচ্ছে না।ভার্সিটির এক ফ্রেন্ডের মাধ্যেমে ড্রিম ফ্যাশন হাউসের কথা জানতে পারে।সে এবারও আশা ছেড়ে দিয়েছিলো।কিন্তু ভাগ্যের জোরে তার চাকরিটা হয়ে গেলো। তবে এটা যে মাহাদের কোম্পানি সেটা খুনাখরেও টের পায়নি।তাহলে কখনো সে চাকরিটা করতো না।সে অলরেডি ডিসাইড করে ফেলেছে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চাকরিটা ছেড়ে দিবে।অন্য একটা জবের চেষ্টা করছে।সামনে ফাইনাল এক্সাম।অনেকগুলি টাকার ব্যাপার।তাই এই অসময়ে সে জবটা ছাড়তে পারছেনা।
মাহাদ জিমে দাড়িয়ে পঞ্চিং ব্যাগে অনবরত মেরে যাচ্ছে।ঘামে তার পুরো শরীর ভিজে উঠেছে।কপাল, ঘাড় বেয়ে সেই নবনাক্ত ঘাম ঝরে যাচ্ছে।
রবিন ট্রেডমিলে দৌড়াচ্ছে আর মাহাদকে পর্যবেক্ষণ করছে। স্যারের মতিগতি সে কিছুই বুঝতে পারেনা।প্রায় তিন বছর ধরে সে মাহাদের সাথে আছে। এতো সুদর্শন মানুষটি এতো গম্ভীর কেনো থাকে সেটাই বুঝে না। মাহাদের রাগের তোপে তাকেও বহুবার পড়তে হয়েছে।কখন কোন কথায় এই মানুষটা রেগে যায় তা বোঝা মুশকিল।যেমন আজ সকাল সকাল উঠে স্যার কোথায় গেলো সে কিছুই জানে না।আবার সেখান থেকে এসে এমন রেগে আছে।কোনো বডিগার্ড ছাড়া এই ভাবে চলা তার জন্য কতটা বিপদের হতে পারে সে কি জানেনা? ফ্যানদের তোপে পড়লে বিপদজনক অবস্থার শিকার হতে পারে।স্যারের মেয়ে ফ্যানরা তো তুলেই নিয়ে যাবে।ইসস!কথাটা ভাবতেই রবিনের গা শিউরে উঠছে।আজকালের মেয়েরা বহু ডেঞ্জারাস।দেখা গেলো স্যারের ইজ্জত নিয়ে টানাটানি শুরু হয়ে যাবে।অন্য কাউকে কি বলবে?তার নিজের গার্লফ্রেন্ডই দিনে চব্বিশ বার মাহাদের নাম জপে।
আজ সকালে মাহিমের কাছ থেকে সবটা শুনে মাহাদ ভীষণ কষ্ট পায়।নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করে।কি করে সে দৃশ্যকে আঘাত করতে পারলো?ঠিক তখনই তানিম তাকে কল করে।
-” তানিম দৃশ্যর বিষয়ে জেনেসিস?ও একা ঢাকায় কেনো আছে?”
তানিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।সে জানে এখন যা বলবে তাতে মাহাদের কষ্টের মাত্রা আরো বাড়বে।সে বললো
-“সেদিন তুই দৃশ্যকে তার বাসায় রেখে আসার পর মেয়েটা ভীষণ ভেঙে পড়েছিলো।হয়তো তোর ওই ডিসিশন সে কিছুতেই মানতে পারছিলো না।ওর বাবা তাকে বাসায় আটকে রাখে।যেদিন তোরা ঢাকায় চলে এসেছি সেদিন দৃশ্য তোর বাসায় ছুটে এসেছিলো।কিন্তু ততক্ষণে তোরা চলে গেছিস।মেয়েটা তোদের দরজায় বসে চিৎকার করে কেঁদেছে।সারাদিন সেই দরজায় বসে ছিলো। পরে মনেহয় ফাহিম এসে নিয়ে গেছে।”
মাহাদের দুচোখ ভিজে উঠেছে। ঘাড়ের রগটাও ফুলে উঠেছে।হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে।তানিম আবার বলতে শুরু করলো
-“তারপর থেকে দৃশ্য অনেকটা চুপসে যায়।সে তোদের ঢাকার ফ্লাটেও তার এক মামাতো বোনকে পাঠিয়েছিলো।কিন্তু তুই তো সেখানে ছিলিনা।ভীষণ খারাপ সময় কাটাচ্ছিলো মেয়েটা।কলেজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো।নিজেকে চার দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ করে রেখেছিলো।এরপর ও ভীষণ বাজে একটা কাজ করে বসে।”
মাহাদের বুকটা ধুক ধুক করছে।সে অস্থির হয়ে বললো
-“কি করেছে ও?”
-“সুইসাইড অ্যাটেম করেছিলো।হাত কেটে ফেলেছিলো।”
মাহাদের পুরো শরীর কাঁপতে লাগলো।সে কি করে ভুলে গেছিলো যে তার পিচ্ছিটা ভীষণ ইমোশনাল।যে তার সামান্য অবহেলা সহ্য করতে পারতো না।সে কি করে এই বিচ্ছেদ সহ্য করতো।নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে তার।রাগে তখন কেনো এই বিষয় গুলো তার মাথায় আসেনি?তানিম আবার বললো
-“ফাহিম ওকে সময় মতো হসপিটালে নিয়ে গেছিলো।এই ঘটনার পর ওর বাবা ভীষণ ক্ষেপে যায়।এমনি ওই ব্যাটা রগচটা।দৃশ্যর বোকামির জন্য আরো চটে গেলো।ওই গর্ধব হটাৎ দৃশ্যর বিয়ে ঠিক করে ফেললো। তাও ওই সুদখোর নিজাম উদ্দিনের ড্রাগ অ্যাডিক্টেড ছেলে রাসেলের সাথে।ওই শুয়োরের বাচ্চার দৃশ্যর দিকে আরো আগে থেকেই নজর ছিলো।আমরাই বুঝতে পারিনাই।”
মাহাদের চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো।আশরাফ হুসাইনকে কেটে টুকরো টুকরো করতে ইচ্ছা করছিলো।তার বিয়ে করা বউ এর কিনা অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেছে?ওই মানুষটার মধ্যে কি সামান্যতম বিবেক বুদ্ধি নেই।স্বামী থাকা অবস্থায় কি মেয়েদের অন্যত্র বিয়ে হয় নাকি?আর ওই রাসেলকে তো পেলে চোখ উপড়ে ফেলতো।তার দৃশ্যর দিকে নজর দিয়েছে সাহস কতো বড়।তানিম বললো
-“ওই ফাহিম ব্যাটার মতি গতি কিছুই বুঝিনা।সে তো গিরগিটির মতো রং বদলায়।যে তোকে দুই চোখে দেখতে পারতোনা বলে বোনকে মেরেছিলো।সেই এই বিয়ের পথে অনেক বাধা দেয়।কিন্তু ওর বাপ তো হারামী।সে বিয়ে দিয়েই ছাড়বে।পড়ে ফাহিম দৃশ্যর পরীক্ষা পর্যন্ত সময় চায়।হারামিটা কেমনে যেনো মেনে নেয়।দৃশ্য কেমনে জানি পরীক্ষা দিতে রাজি হয়।পরীক্ষার পর হারামিটা বিয়ের প্রিপারেশন শুরু করে।দৃশ্য এই সব কিছুতেই মানতে পারছিলো না।খুব স্বাভাবিক সে তোর জায়গা অন্য কাউকে দিতে চায়নি।তুই মেয়েটাকে ছাড়লেও সে কখনো তোকে ভুলেনি।হলুদের আগের দিন নাকি দৃশ্য বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। কোথায় গেছে কেউ জানে না।ওর বাবা ভাই অনেক খুঁজেছে।থানায় মিসিং ডাইরি খুলেছিল।কিন্তু কেউ জানেনা দৃশ্য সেদিন কোথায় গেছে।তোর কাছে শুনে বুজলাম দৃশ্য ঢাকায় গেছে।”
সব শুনে মাহাদের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে।পিচ্ছিটাকে কতটা সাফার করতে হয়েছে।যাকে সারা জীবন আগলে রাখতে চেয়েছিল আজ তার কারণেই সে সবচাইতে বেশি কষ্ট পেয়েছে।তার কারণেই চোখের জল ফেলতে হয়েছে।আচ্ছা পিচ্ছি টা একা এই ঢাকায় কি করে সব সামলেছে?ফাইন্যান্সিয়াল সাপোর্ট কোথা থেকে পেয়েছে? মাহাদ আর কিছুই ভাবতে পারছে না।এই মুহূর্তে পিচ্ছিটাকে বুকে জড়িয়ে না ধরতে পারলে সে হয়তো মরেই যাবে।তাইতো ছুটে গেছিলো দৃশ্যর বাড়িতে।
দৃশ্যর সেই কঠিন রূপ তাকে ভীষণ কষ্ট দিয়েছে।কিন্তু দৃশ্য তো তার জায়গায় ঠিক।সেই তো দৃশ্যর হাত ছেড়ে দিয়েছিল।মেয়েটাকে কষ্টের সাগরে ফেলে এসেছিলো।নিজের উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে।কিন্তু মাহাদের আসলে কি করার ছিলো।বাবাকে হারিয়ে সে সব ভুলে গেছিলো।মায়ের চোখের জলের কাছে সে হেরে গেছিলো।মাকে কষ্ট দিয়ে সেকি দৃশ্যকে নিয়ে সুখী হতে পারতো? কখনোই না।