#তোমার_ছায়া,পর্ব ১৩,১৪
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
১৩
– তুমি কি চাও?
সমুদ্রের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো আবরার। এর পর ডাবের পানি খেতে লাগলো। হয়তো উত্তরের অপেক্ষায় আছে।
বাতাসে কানের পাশে উড়তে থাকা অবাধ্য চুল চুল গুলো কানের পেছনে গুজে দিয়ে ফারহা শান্ত ভাবে বললো,
– আপনি যেটা চাইবেন।
আর কিছু না বলে চুপচাপ উঠে হাটা ধরলো আবরার। ফারহা বসে থেকে অবস্থায় চেয়ে রইলো আবরারের চলে যাওয়ার দিকে। চুল গুলো আবারও উড়ে মুখের উপর এসে পরছে।
ভাগ্য টা এতো নিষ্ঠুর কেন? কেন এভাবে সব এলোমেলো করে দিলো? এমন করে তো কিছুই চাইনি। যদি এটা একটা দুঃস্বপ্ন হতো?
ভাবতে ভাবতে আয়রিন এসে হাত ধরে টেনে তোলে তাকে। সবাই ওদিকে আনন্দ করছে আর ফারহা আলাদা বসে আছে এটা হয়তো ভালো দেখাচ্ছিলো না মোটেও।
আয়রিন মুচকি হেসে বললো,
– ব্যাপার কি? আমার কাছে কি কিছু লুকাচ্ছিস তোরা?
ফারহা হাটতে হাটতে বললো,
– কোন ব্যাপারে?
– এখন কিছুই বুঝতে পারছো না তাই না? ঘুরতে আসার পর ছিন’তাই হওয়া। তাও আবার দুজন একই সাথে কোথাও হারিয়ে যাওয়া। আবার এতোক্ষন ডাব হাতে দুজন সমুদ্র পাড়ে বসে আড্ডা দেওয়া। আসলে ভাইয়া তো এতো কাহিনি করার মানুষ না, তাই ব্যাপার টা একটু সন্দেহ হচ্ছে আমার। এমন নয় তো, যে তোরা ডুবে ডুবে জল খাচ্ছির আর আমরা উপর দিয়ে নৌকা চালিয়ে চলে গেলাম, কিছু খেয়ালই করিনি৷
ফারহা কিছু না বলে কিছুক্ষন চুপ থেকে বিরক্তি নিয়ে বললো,
– তোর মাথায় কি এসব চিন্তা ছারা আর কিছুই আসে না?
– হা হা, আমার মাথা সব সময় সিক্রেট ও গভির চিন্তা ভাবনা গুলোই আসে। সো, আই এম ফ্রাউড অফ মাই মাথা।
– মাথা না, হ্যাড হবে।
– হা হা তুই আসলেই বোকা, ফানের মাঝে সিরিয়াস হয়ে যাস। আচ্ছা চল, সবার সাথে মিশে যাই। দেখবি বিষণ্ন মন মুহুর্তেই ভালো হয়ে যাবে।
কেউ সমুদ্রের বালি চরে ফুটবল খেলছে, আবার বিশাল এক দিন পানিতে লাফালাফি করছে। আর কেউ ছবি তুলতে ব্যাস্ত। আর কয়েকজন গোল হয়ে বসেছে মাঝখানে রাজিব গিটার হাতে গানের সুর ধরলো,,,,
‘আমার মন বসেনা শহরে, ইট পাথরের নগরে,,
তাইতো আইলাম সাগরে, তাইতো আইলাম সাগরে।
এই সাগর পাড়ে আইসা আমার মাতাল মাতাল লাগে,
এই রুপ দেখিয়া মন পিঞ্জরায় সুখের পঙ্খি ডাকে।
ফারহা একটা বিরক্ত নিয়ে বির বির করে বললো,
‘কচুর সুখের পঙ্খি। গত কাল থেকে শুধু দুখের পঙ্খিরাই মনাকাশ জুড়ে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে। হয়তো ছোট্ট রাজ্যটা ভালো ভাবেই দখল করেছে তারা। এবার আবরার নামক পরাজিত রাজা টা পালিয়ে না গেলেই হয়। রাজ্য জয় করে সুখ নিয়ে ফিরে এলে কি খুব ক্ষতি হবে?
,
,
দুই দিনের টুর শেষ হলে রাতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সবাই। শেষ রাত তাই সবাই হইচই উল্লাসে কারোরই ঘুম হয়নি বাসে।
সকালে ঢাকা এসে নামলে ব্যাগ নিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় সবাই।
বাড়িতে এসে কলিং বেল চেপে কাধে ব্যাগ নিয়ে কিছুক্ষন অপেক্ষা করে ফারহা। এর পর ফারদিন ঘুম কাতুর চোখে এসে দরজা খুলে দেয়। ফারহাকে দেখেই হাত ধরে এক পাশে নিয়ে গিয়ে বললো,
– সাবধানে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে বসে থাক। আমি তোর জন্য নাস্তা নিয়ে আসছি। মা খুব রেগে আছে তোর উপর। ওদেরকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে তোকে সবার সাথে পাঠালাম। আর তুই গিয়েই ওখানে একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেললি। আজ সামনে পেলে কি করে আল্লায় জানে। তুই রুমে গিয়ে বসে থাক। নাস্তা করে চুপচাপ ঘুমাবি। দরজা খুলবি না। বিষয়টা সামলে নিবো আমি। আজ কোথাও যাবো না।
ফারহা চোখ বড় বড় করে বললো,
– এতোটা রেগে আছে?
– তো রাগবে না, তোর যদি কিছু হয়ে যেত? এটা নিয়ে কতো টেনশনে ছিলো তারা। এখন ওদের সামনে পরলেই গালের মধ্যে কয়েকটা পরবে।
তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রুমে চলে গেলো ফারহা।
,
,
কিন্তু আজ সারা দিন এমন কোনো বিষয় চোখে পরেনি ফারহার। উকি দিয়ে রুম থেকে বের হয়ে দেখে সবই স্বাভাবিক। মা তাকে দেখেও খুব স্বাভাবিক আচরণ করছে। দেখে মনেই হচ্ছে না যে তারা রেগে আছে।
ফারহাও সব স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে চুপচাপ রুমে গিয়ে বসে রইলো। গত দুই দিন ধরে ঘটে যাওয়া কাহিনি টা বার বার চোখের সামনে ভেষে আসছে। যতই ভাবছে ততোই বুকের ভেতর টায় ধুক ধুক শব্দ বেড়েই চলছে।
সে এখন ম্যারিড, নিজেকেই বিশ্বাস করতে পারছে না আজ। মনে হচ্ছে দুঃস্বপ্নে ঘটে যাওয়া একটা কাহিনি এটা। যা ঘুম ফুরালেই হারিয়ে যাবে।
সন্ধার পর মা একটা রুমে এলো হাতে একটা গোলাপি রঙের শাড়ি। বললো, দ্রত এটা পরে নিতে। ফারহা একটু অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো,
– এই অসময়ে শাড়ি পরবো কেন মা?
তার মা কড়া ভাবে বললো,
– পরতে বলেছি পরবি। আর বেশি সাজবি না। কারণ ছেলে পক্ষ বলেছে, মেকআপ হীন নেচারেল সাজে তোকে দেখবে।
ফারহা এবার উঠে দাড়িয়ে বললো,
– ছেলে পক্ষ মানে?
– ছেলে পক্ষ মানে কি তাও এখন তোকে বুঝিয়ে বলতে হবে? কয়দিন আগে সম্মন্ধ এসেছিলো যে ওই ছেলের বাবা মা তোকে দেখতে আসবে।
ফারহার বুকের ভেতর ধুপধুপ শব্দটা বেড়েই চলছে। কাঁপা গলায় মাকে বললো,
– কিন্তু মা, আমি এসবের জন্য মোটেও প্রস্তুত না। আর তুমি এমন করছো কেন? ওই দিন না বললা, আমি যেমনটা চাই তেমটাই হবে?
– হ্যা বলেছি, আর এখনও বলছি, তুই যখন চাইবি তখনই বিয়ে হবে। কিন্তু আজ তো তারা আসবে শুধু তোকে দেখতে। তারাতারি শাড়ি পরে রেডি হয়ে নে। ওরা এক্ষুনি চলে আসবে। আর তোকে দেখেই চলে যাবে। বেশিক্ষন থাকবে না।
বলেই শাড়িটা রেখে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো মা। ফারহা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে। টুর থেকে আসার পর, সারা দিন তাহলে এই কারণে কিছু বলেনি।
সে আদৌও বুঝে উঠতে পারছে না তার সাথে ঘটতে চলেছে। একটা মেয়ের স্বামী থাকা অবস্থায় আরেকটা বিয়ে নিয়ে উঠে পরে লাগলো সবাই। অথচ চুপচাপ দেখে যাওয়া ছারা কিছুই করতে পারছে না সে।
এই নিয়ে কিছু বলতে পারতো, যদি আবরার ঠিক থাকতো। কিন্তু সে নিজেই তো ফারহাকে চায় না। তাহলে বলেই বা কি লাভ। আগে আবরারের বিষয় টা ক্লিয়ার করতে হবে।
,
,
দুই দিন পার হয়ে গেলো। কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে দিলো ফাহার মা। দেখে বাইরে ফারদিনের সাথে আবরার দাড়িয়ে আছে। ফারদিন বেতরে এসে একটু হেসে দিয়ে বললো,
– আবরারকে দেখলাম আজ নিজে থেকে আমাদের এলাকায় এসে ঘুর ঘুর করছে। দেখা করার জন্য সব সময় আমাকেই তার এলাকায় যেতে হয়। ওকে ডেকেও এখানে আনা যায়না তেমন। আজ দেখছি নিজে থেকেই এসেছে। তাই আর ছাড়াছারি নেই সোজা বাসায় নিয়ে এলাম।
– খুব ভালো করেছিস। আসো বাবা, ভেতরে আসো।
আবরার একটু হেসে সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। মা তাদের দুজনকে সোফায় বসিয়ে ফারহার রুমে গিয়ে বললো,
– তোর স্যার এসেছে। ছেলেটা তেমন আসেও না এই বাড়িতে। তারাতারি নাস্তা বানাতে হেল্প কর আমায়।
ফারহা বসা থেকে বললো,
– কোন স্যার?
– ফারদিনের বন্ধু, আবরার।
মুহুর্তেই বসা থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসলো ফারহা। আমতা আমতা করে বলতে লাগলো,
– উনি কেন এসেছে মা? কিছু বলেছে তোমাকে?
ফারহার চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট। তার মা প্রতি উত্তরে বললো,
– বন্ধুর বাসায় বন্ধু আসতে পারেনা? আবরার নাকি এদিকটায় এসেছিলো। তাই ফারদিন বাসায় নিয়ে এলো। কিন্তু তোকে হুট করে এমন নার্ভাস দেখাচ্ছে কেন?
ফারহা নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে একটু হেসে বললো,
– কই না তো। ওনি তো আমাদের বাসায় আসে না, তাই আরকি।
– আচ্ছা, এখন কিচেনে আয়।
আবরারের সাথে কথা বলছিলো ফারদিনে মা। হটাৎ বাসায় এলে যেমনটা কথা হয় তেমনই স্বাভাবিক। তবুও ফারহার মনের ভয়টা দুর হচ্ছে না। নাস্তা তৈরি করতে করতে অন্য চিন্তায় ডুবে আছে সে। নাস্তা তৈরি শেষে তা নামাতেই বেখেয়ালি ভাবে হাতে তেলের একটু ছিটকা পরতেই ‘আ’ করে শব্দ করে উঠে সে। মা এখান থেকে বলে,
– কিরে পারো কি হয়েছে।
– না মা কিছু হয়নি।
ফারদিন মায়ের দিকে চেয়ে বললো,
– কয়দিন পর সে অন্য বাড়ির বৌ হয়ে চলে যাবে। আর এখন তুমি তাকে এতো খাটাচ্ছো মা?
– আরে তাই তো ভালো করে কাজ কর্ম শিখাচ্ছি, যাতে অন্যের বাড়ি গিয়ে কথা শুনতে না হয়।
আবরার একটু অবাক হয়ে বললো,
– কয়দিন পর অন্যের বাড়ি মানে, ফারহার বিয়ের কথা বলছেন আন্টি?
সে একটু হেসে বললো,
– হ্যা বাবা, মোটামুটি সব ঠিকঠাক আছে। পরিক্ষার পর কথা বার্তা আগাবে আরকি। গত পরশু দেখতে এসে ওরা পছন্দ করে আংটি পড়িয়ে দিয়ে গেছে।
তখনই নাস্তা নিয়ে ওদের সামনে এসে তা রাখলো ফারহা। আবরার নিশ্চুপ হয়ে ফারহার বাম হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। এর পর ফারহার মুখের দিকে তাকাতেই ফারহা হাতটা লুকিয়ে মাথা নিচু করে চুপচাপ চলে গেলো সেখান থেকে।
পাশ থেকে আন্টি বললো,
– নাও বাবা, শুরু করো।
আবরার ভদ্রতার খাতিরে দুই একটা মুখে নিয়ে কিছুক্ষন নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো। এর পর ফারদিনকে ফিস ফিস করে বললো,
– প্রচুর মাথা ব্যাথা করছে দোস্ত। আর কিছুক্ষন এখানে থাকলে মনে হয় আমি এখানেই মাথা ঘুরে পরে যাবো।
ফারদিন তাকে ধরে বললো,
– হুট করে আবার মাথা ব্যাথা শুরু হলো কেন? আর খুব বেশি ব্যাথা করছে?
– হুম, আমার এখনই বাসায় যেতে হবে।
– পাগল নাকি তুই যে, তোকে এই অবস্থায় যেতে দিবো? প্রয়োজনে আজ এখানেই থাকবি তুই।
পাশ থেকে মা ও বললো,
– ফারদিন ঠিকই বলেছে বাবা, আজ এখানেই থেকে যাও তুমি।
– মন খারাপ করবেন না আন্টি। বাসায় টেনশন করবে খুব। ওদেরকে বলে আসিনি। আরেক দিন আসলে তখন থাকবো।
মাথা ব্যাথার কারণটা নিয়ে আর জোড় করেনি কেউ। বিদায় নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায় সে। একটা গাড়ি ডেকে ফাদিনকে বললো,
– আচ্ছা, তুই বাসায় চলে যা। আমি একাই যেতে পারবো। প্রব্লেম হবে না।
– তোকে বাসা অব্দি এগিয়ে দিয়ে আসি?
– না দোস্ত থ্যাংক্স। যেতে পারবো আমি। আঙ্কেল টান দেন।
প্রায় বাসার কাঠাকাছি আসার পর রাস্তায় নেমে গেলো আবরার। দোকান থেকে একটা ঠান্ডা স্প্রিড নিয়ে বড় ব্রিজটার পাশে গিয়ে দাড়ায় একা। স্প্রিড বের করছে আর ফোনটা বের করলো সে। ওই দিন চট্টগ্রাম থেকে ফিরে আসার পর পরিচিত এক উকিলের নাম্বার নিয়েছিলো সে। যত বারই তাদের এই বিচ্ছেদের ব্যাপারে কথা বলার জন্য ফোন দিতে যাবে ততোবারই দেয় নি। অজানা এক কারণে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে, আবার রেখে দিতো ফোন টা। কিন্তু আজ আর পারছে না। ফারহার বিয়ে ঠিক হয়ে আছে অলরেডি।
নিজেকে সামলে নিয়ে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে ওই নাম্বারে কল দেয় আবরার।
– আসসালামু আলাইকুম, আঙ্কেল।
– জ্বি ওয়ালাইকুম সালাম, কে বলছেন?
– আঙ্কেল আমি আবরার।
– ওহ্ আচ্ছা, নাম্বার চেন্জ করেছো নাকি?
– জ্বি আঙ্কেল, আগের ফোন টা চুরি হয়ে গেছে। আপনার সাথে কুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়ে কথা বলতে চাইছিলাম। আপনার কি সময় হবে?
– হ্যা, আমার অপিশে চলে আসো।
– আচ্ছা, আর আঙ্কেল, বিষয়টা খুব সিক্রেট তাই কেউ যেন না থাকে, তাই সময় চাইলাম। আমি চাইনা এসব বিষয় আমি আর আপনি ছারা কেউ জানুক আমি এসেই আপনাকে সব বলছি।
– আচ্ছা আসো। তারপর শুনবো।
– ঠিক আছে আঙ্কেল ধন্যবাদ৷
To be continue…..
#তোমার_ছায়া (পর্ব ১৪)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ
– বিয়ের কি রেজিট্রি হয়েছিলো?
পুরো কাহিনি শুনে চেয়ারে লম্বা লম্বি ভাবে বসে কথাটা বললো, উকিল।
আবরার মাথাটা হালকা দুই দিকে নাড়িয়ে বললো,
– আজ্ঞে না। ধর্মিয় ভাবে হয়েছিলো।
– মানে কোনো ডোকোমেন্সই নেই, তাই তো?
– জ্বি। আর থাকলেও তা ওখানকার ওদের কাছে।
– তাহলে তো ঝামেলা। তোমরা আগে রেজিট্রি করে ফেলো খুব দ্রুত। এরপর রেজিট্রির ছয় মাস পর তোমাদের যদি মনে হয়, তোমরা একসাথে থাকতে চাও না। তখন ডিবোর্স করে নিও।
– মানে আরো ছয় মাস অপেক্ষা করতে হবে?
– হ্যা।
– কিন্তু আঙ্কেল ওর ফ্যামিলি তো ওর বিয়ের কথাবার্তা বলছে। যদি কোনো ভাবে ছয় মাসের আগে বিয়েটা ঠিক হয়ে যায়। তাহলে স্বামী থাকা অবস্থায় একটা মেয়ে দ্বিতীয় বিয়ে কিভাবে করবে?
উকিল আঙ্কেল এবার সোজাসুজি ভাবে বসে বললো,
– আচ্ছা সত্যি করে বলো তো, তুমি কি চাও?
আবরার কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বললো,
– আমি চাইলেই কি সব হবে আঙ্কেল? আচ্ছা একবার ভাবুন তো। একজন শিক্ষক আর একজন ছাত্রী লুকিয়ে বিয়ে করে ফেলেছে, তাও আবার এমন ভাবে। বিষয়টা মানুষ কোন চোখে নিবে? আর অন্যান্য স্টুডেন্টদের সামনেই বা দাড়াবো কি করে?আর তাছারা সে আমার বন্ধুর বোন। বন্ধুর বোন মানে তো নিজেরও বোন, তাই নয় কি? বন্ধুর সামনেই বা কোন চোখে দাড়াবো?
– দেখো আবরার, আমি বুঝতে পারছি বিষয় টা। তবে বিয়ে জিনিস টা মানুষের লাইফে খুব গুরুত্ব পূর্ণ একটা পয়েন্ট। যা মানুষের জীবনের গতিশীলতা একটু হলেও পাল্টে ফেলে। ধরো তোমাদের ডিবোর্স হয়ে গেলো। তার পর কি তোমরা দুজন খুব সুখে থাকতে পারবে? আর লোকে কি বলছে তা ভেবে তুমি কেন নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত টা নিবে? যারা তোমাদের নিয়ে কথা বলবে তারা কি তোমার বাকি জীবন চলার জন্য দু পয়সা দিয়ে সাহায্য করবে? নাকি বাকি জীবনটা তোমার পাশে থাকবে? তাই লোকে কি বলবে তা না ভেবে, এটা ভাবো যে, তোমার মন কি চায়? কারণ দিন শেষে আশে পাশের মানুষ গুলো খোজ নিতে আসবে না, তুমি ভালো আছো কি নেই।
আবরার কিছুক্ষন নিশ্চুপ থেকে বললো,
– আচ্ছা আঙ্কেল আমি উঠি।
– হুম, আবার দেখা হবে। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গুলো মাথা ঠান্ডা রেখে ভেবে চিন্তে নিবে।
,
,
অনেক দিন পর আবার আয়রিনের শশুর-শাশুড়ি তাদের বাড়িতে পা রাখলো। গত কাল তার শাশুড়ি ফোন দিয়ে বললো এই বাড়িতে আসবে তারা।
তাই পরদিনই চলে আসে। ছেলে বিয়ে করিয়েছে কিন্তু পূত্র বধু পরে আছে বাবার বাড়ি। তাদের একটু অমত থাকলেও আয়রিনের ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলো তারা। বিয়ের আগে তো মাহিনের বাবা বলেছিলো তারা ছেলের বৌ চায় না। চায় শুধু একটা মেয়ে। যেখানে নিজের মেয়ে আর পূত্র বধুর মাঝে কোনো পার্থক্য থাকবে না।
মাহিন যখন মায়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলো তখন আয়রিন পাশেই ছিলো। মাহিন চলে যাওয়ার পর তেমন একটা কথা বলেনি তার সাথে।
মাহিনের সাথে কথা বলার মহুর্তে আয়রিন ও তাদের নানান বিষয় প্রশংসা করতে ব্যাস্ত সে। আয়রিন কিছুটা লজ্জা ভঙ্গিতে বসে ছিলো এক পাশে।
ইচ্ছে হচ্ছিলো শাশুড়ি মাকে বলে ফোনটা নিয়ে অন্য রুমে চলে গিয়ে লুকিয়ে কথা বলতে দুজন।
হয়তো তার ধারণ মাহিন তাকে প্রথমে পছন্দ না করলেও, আস্তে আস্তে মানিয়ে নিতে শিখবে। কারণ হুট করে তো আর ভালোবাসা হয় না।
ফোনালাপে অল্প অল্প করে শুরু হবে সব কিছু। বিয়ের পরও ফোনালাপে প্রেম শুরু, বিষয় টা খুবই ইন্টারেস্টিং।
এতোদিন নিজে অনেকবার মাহিনকে ফোন দিয়েছিলো। কিন্তু সামান্য একটু হাই হ্যালো করে ব্যাস্ততা দেখিয়ে রেখে দিতো সে। আয়রিনও নিজেকে শান্তনা দেয়। অফিস থেকে বাইরে দেশে গেলো, ব্যাস্ততা তো একটু থাকতেই পারে।
কিন্তু আজ মায়ের সাথে অনেক্ষন কথা বলছে মানে আজ হয়তো ফ্রি আছে সে। আয়রিনের এমন পাশে বসে থাকার কারণটা হয়তো কিছুটা বুঝতে পারে তার শাশুড়ি। তাই মাহিনকে বলে,
– নে আয়রিনের সাথে কথা বল। অনেক্ষন ধরে দেখছি, তোর সাথে কথা বলার জন্য পাশে বসে আছে।
শাশুরির ডিরেক্ট এমন কথায় একটু লজ্জা পায় আয়রিন। কিন্তু মুহুর্তেই সব লজ্জা বিষণ্নতায় মিলিয়ে যায়। যখন মাহিন ব্যাস্ততা দেখিয়ে বলে,
– ওর সাথে পরে কথা বলবো মা। এখন ডিউটিতে যেতে হবে। ডিউটি শেষে কথা বলবো ওর সাথে।
বলেই ফোন রেখে দেয় মাহিন। আয়রিন বিষণ্ন মনে শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করে।
– ও কি সব সময় এমন ব্যাস্ত থাকে? আপনাদের সাথে তেমন কথা বলে না তাই না?
তার শাশুড়ি একটু হেসে বলে,
– ব্যাস্ততা তো থাকবেই। আর কথা বলবে না কেন? ফোন দিলে তো সবার সাথে কথা বলেই ফোন রাখে। কেন, আজ কথা হয়নি তাই তো? ডিউটি শেষে কথা বলবে বলেছে। মন খারাপ করার কিছু নেই।
জোর পূর্বক একটা হাসি দিয়ে সেখান থেকে উঠে হাটা ধরলো আয়রিন। সে মাহিনকে যতই মানিয়ে নিতে চায়, ততোই দুরে দুরে থাকে সে।
,
,
সকাল হতেই মায়ের ডাকাডাকি তে ঘুম ভাঙে ফারহার। তাও কি ডাক, মনে হচ্ছে হিংস্র বাঘিনি হুংকার ছারছে। টুর থেকে ফিরে আসার চার-পাঁচ দিন হয়ে গেলো। ফারহা কলেজের ও কোচিং-এর কিনারেও যায় নি এই কয়দিন। তার মা জানতে চাইলে বলে ভালো লাগছে না। তাই আজ সকাল সকাল ডেকে বলে, কলেজে না গেলে, আর যাওয়ারও দরকার নেই, পড়ালেখা করারও দরকার নেই। বিয়ে করে সংসার শুরু করার ব্যাবস্থা করবে।
প্রাইভেট কলেজ, রেগুলার ক্লাস করতে হয়। এদিকে মায়ের এমন ঘ্যান ঘ্যান। সব মিলিয়ে উঠে, খেয়ে দেয়ে কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে।
কলেজে যাওয়ার জন্য বের হলে রাস্তায় গাড়ির জন্য দাড়িয়ে ছিলো ফারহা। তখনই একটা গাড়ি এসে দাড়ায় ওখানে। প্রথমে বিষয়টা এতো গুরুত্ব না দিলেও সাদাফ কে দেখে অবাক হয় সে।
সাদাফ তার কাছে এগিয়ে এসে বললো,
– গাড়িতে উঠো, কথা আছে তোমার সাথে।
ফারহা কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে বলে,
– কেন এসেছেন আপনি? আর গাড়িতে উঠবো মানে কি? আপনি আমার কে যে আপনার গাড়িতে আমার উঠতে হবে?
– এখন কেউ না হলেও, এক সময়তো ছিলাম তাই না?
– ওটা অতিত, আর আপনি ভুলে গেলেও আমি ভুলে যাইনি অতিতে আপনি কি করেছিলেন আমার সাথে?
সাদাফ একটা শ্বাস নিয়ে চার পাশে চোখ বুলিয়ে বললো,
– দেখো ফারহা সব কিছুর জন্য আ’ম রিয়েলি সরি। আমি আসলে এমনটা করা উচিৎ হয়নি।
– আমি সরি বলতে বলেছি আপনাকে? আর কোন মুখে সরি বলছেন আপনি? ওই দিন আয়রিনের বিয়েতে যে মেয়েটার পাশে ছিলেন, ওটা কোথায় এখন? ছেরে দিয়েছেন তাকে, তাইনা? আপনার থেকে এর চেয়ে বেশিই কি বা আশা করা যায়?
– আমি তোমাকে সব বলবো। কিন্তু এখানে রাস্তায় না। চলো কোথাও গিয়ে বসি আমরা।
– জ্বি না, পর পুরুষের সাথে এখানে দাড়িয়েও কথা বলার ইচ্ছে নেই।
– এখন পর পুরুষ হয়ে গেছি তাই না?
– হ্যা, কারণ আই এম ম্যা……
এতটুকু বলেই থমকে গেলো ফারহা। সাদাফ একটু ভ্রু-কুচকে বললো,
– কিছু বলছিলে?
– না কিছু না, আমার দেড়ি হয়ে যাচ্ছে।
ফারহা কথা ঘুরিয়ে পাশ দিয়ে যাওয়া একটা রিক্সা ডেকে উঠে কলেজের উদ্দেশ্যে ছুটলো।
,
,
ক্লাস শেষে কলেজ থেকে ফিরার সময় হটাৎ ভাইয়ার সাথে দেখা হয় ফারহার। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিয়ে ফিরছিলো ফারদিন। হাতে এটা ফাইলে কিছু কাগজ পত্র। ফারহাকে বললো,
– ক্লাস শেষ?
– হুম, এখন কোচিং-এ যাবো।
তখনই আয়রিন পাশে এসে ফারহাকে বললো,
– চলে এখন, দেড়ি হলে আবার ভাইয়ার বকা খেতে হবে।
হটাৎ আয়রিনকে দেখে হাসি মুখটা মলিন হয়ে যায় ফারদিনের। আর এদিকে ফারদিনকে দেখে আয়রিন হাসি মুখে বললো,
– কেমন আছেন ভাইয়া?
ফারদিন একটু মুচকি হেসে বললো,
– আলহামদুলিল্লাহ ভালো, তুমি কেমন আছো?
– জ্বি ভালো? কাগজ পত্র নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?
ফারদিন খুব স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
– ইন্টারভিউ ছিলো একটা।
– এখন আমাদের বাসায় যান না কেন? আগে তো প্রায়ই ভাইয়ার সাথে যেতেন। সবাই মিলে গল্প করতাম।
ফারহা স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে দুজনকে দেখছে। ভাইয়াকে বাইরে থেকে যতটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে, ভিতর ভিতর মোটেও এতোটা স্বাভাবিক নয় সে। রাত ভর কেঁদেছিলো নিজের ভালোবাসা হারিয়ে। আর আজ কতো স্বাভাবিক সাজার চেষ্টায় আছে সে। হয়তো এখনো একজনের মন পুড়ছে খুব, আর অন্য জন কিছুই জানে না।
To be continue…..