তোমার_প্রেমে_মাতাল,অন্তিম_পর্ব

0
3996

তোমার_প্রেমে_মাতাল,অন্তিম_পর্ব
লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)

নিরামিষ আমিকে তুমি এসে রংধনুর রং এ রাঙিয়ে দিলে। নেশা জাতীয় দ্রব্যে এত মায়া নেই যা তোমার মাঝে আছে। আমি নেশাগ্রস্ত তোমার মাঝে। তোমায় দেখলে আমার বিভোর হয়ে তোমার মাঝে ডুব দিতে ইচ্ছে করে। ডুব দিয়ে আমি হারিয়ে যেতে চাই তোমার মাঝে। যেন অতল ছোঁয়ার এক কঠিন বাসনায় আমি পাগল প্রায় তখন। কিন্তু আমি জানি এখানে ঠাঁই মেলা ভার। আসক্ত আমি তোমায় দিয়ে তৃষ্ণা মেটাবো। যখন তোমার মাঝ থেকে ভেসে উঠবো তখন আমি পুরো মাতাল। তোমার প্রেমে ডুবিয়ে আমায় মাতাল করে তোলো। আমি তোমার প্রেমে মাতাল।

একটা ফোটোফ্রেমের পেছন থেকে গোঁজা কাগজখানা বের করে একটি তরুণী লেখাটি পড়ছে।

———————————————

ডেলিভারির ডেট অনুযায়ী কালকে মায়াবিনীকে হসপিটালে নিতে হবে। মা বারবার আসছেন আর জিজ্ঞেস করছেন,

-মায়াবী মা তোর কি ব্যথা করছে? পেইন শুরু হচ্ছে? কেমন লাগে তোর? কোনো সমস্যা?

-উফফ মা। কি শুরু করেছো? আরো পনেরো দিন আগে থেকে এইসব জিজ্ঞেস করছো। আমার পেইন হলে তো আমি বুঝতেই পারবো। এত চিন্তা করো কেন বলো তো।(বলে মায়ের গাল ধরে টেনে দেয়)

এই মেয়ের বড্ড সাহস। মা একগাল হেসে মায়াবিনীকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। কপালে চুমু খান। তারপর বলেন,

-আমার দুই ছেলে সময়ের আরো ১মাস আগে হয়ে গেছে। ব্যথায় আমি কাতরাত ছিলাম। তারপর এই ব্যথার মাঝেই দুটো বাচ্চা বেরিয়ে এল কখন টেরই পেলাম না।

মায়াবিনী মায়ের কথায় বাচ্চাদের মতো খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। উল্টো মাকে জিজ্ঞেস করে,

-মা মা শোনো। তোমার এই নাতিনাতনি কি আমায় ব্যথা দিয়ে বের হবে? কিন্তু ওটা অনেক কষ্ট। তার চেয়ে অজ্ঞান করে নিয়ে পেট কেটে বের করে দিবে এই ভালো। কিন্তু এনেস্থিসিয়া! (বলে ভয় পেয়ে মাকে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরে)

মা কতো কিছু বুঝিয়ে পজিটিভ চিন্তা মাথায় ঢুকিয়ে দিয়ে যান। ভালো মেয়ের মতো আবার ভয় কাটিয়ে শিষ বাজাতে থাকে। কে একে দেখে বলবে একটু আগে ভয়ে মাকে খামচে ধরে ছিল।

সকাল বেলায় বাবা বাসায় এসেছেন প্রায় এক ভ্যান খেলনা কিনে। পুতুল, হাঁড়ি-পাতিল থেকে শুরু করে ফুটবল, ব্যাট পর্যন্ত এনেছেন। মায়াবিনী প্রায় লাফিয়ে উঠেছিল। তারপর ধমকে কিছুটা শান্ত হলেও মুখে সেই মন ভোলানো হাসি।

আল্ট্রা-সনোগ্রাফী করা হয়েছে সাত মাসে সিড়ি থেকে পরে যাওয়ার পর। কিন্তু বেবি নাকি পুরো উল্টোদিকে ঘুরানো। তাই আমাদের মেয়ে হচ্ছে নাকি ছেলে তা জানতে পারিনি। বাবা এই বুঝে ছেলে-মেয়ে উভয়ের খেলনা কিনে এনেছেন। আমার বাচ্চার আর খেলার কি দরকার। তাদের মা খেলতে বসে গেছেন। নীরব অবশ্য এসব হইচই শুনে বের হয়েছে। ড্রয়িং রুমে ঢুকে যখন মায়াবিনীকে বসে থাকতে দেখলো সোফায়, চুপিচুপি নীরব নিজের রুমে ফিরে যাচ্ছিলো। কিন্তু যার চোখে ধরা পরার ছিল না, তার চোখেই ধরা পরেছে। কিন্তু আজকে ধমকালো না মায়াবিনী।

-এই নীরব কোথায় যাচ্ছিস? এখানে আয়। নিচে বসতে হবে না পাশে বস। আয় তোর ভাইপো বা ভাইজির খেলনা দিয়ে আমরা খেলি। ও হয়ে গেলে আর খেলতে পারবো না দেখিস। তোর ভাইয়ের মতো হিংসুটে হবে।

বাবা-মা মুচকি মুচকি হেসে মজা নেন আমার সাথে। অসহায় আমি দাঁড়িয়ে থাকি। এইদিকে দেখি খালা ও হাসেন আমায় নিয়ে। কি একটা অবস্থা আমার। নীরব আর মায়াবিনী দিব্যি খেলছে। মায়াবিনী মিছামিছি রান্না করে, নীরব চুকচুক শব্দ করে ভাব নেয় খাচ্ছে। খেলা শেষে একটা বড় পুতুল নিয়ে নিজের রুমে চলে যায় মায়াবিনী। নীরব এসে হাসি মুখে দাঁড়ায় আমার সামনে।

———————————————-

নীরব মায়াবীর বাসা থেকে এসে আমায় বলে কাল পরশুর মাঝে নাকি আমার বউ ওরফে ওর মায়া ভাবী ফিরে আসবে। ওর কথা শুনে আমি হকচকিয়ে যাই। নিজেকে সামলে নিয়ে জানতে পারি নীরব আজ কি করে এসেছে। নীরব আমার পা জড়িয়ে কেঁদে ফেলে। অথচ ওর না ক্ষমা আমার চাওয়া উচিত। আমরা আবার আগের মতো হয়ে যাই। বুকে টেনে নেই ছোট ভাইকে। আমি হাতজোড় করে ক্ষমা চাই। ভুলে যাই সবকিছু বিষাদময় স্মৃতি। কথা দেই একে অপরকে সব ভুলে আবার সবকিছু শুরু করব নতুন করে।

———————————————-

আজ সবাই হসপিটাল যাচ্ছি। মায়াবিনীর ডেলিভারি ডেট। ওইদিক দিয়ে মায়াবিনীর বাসার সবাই হসপিটালের দিকে যাচ্ছে। আমরা সবাই টেনশনে শেষ। কিন্তু মায়াবিনী দিব্যি এক পুতুল নিয়ে গাড়িতে খেলতে খেলতে যাচ্ছে। হসপিটালে পৌঁছানোর পর ডক্টর চেক করে বললেন মায়াবিনীর নরমাল ডেলিভারি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কয়েকটাদিন অপেক্ষা করা উচিত। তবে সিজার করাতে চাইলে এখনো করতে পারে। তবে নরমাল হলে অনেক ভালো। তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে পেশেন্ট। আমরা কোনো ডিসিশন নেওয়ার আগেই পেশেন্ট বলে দিয়েছে নরমাল ডেলিভারি হবে। মা সাথে একমত পোষণ করলো। অগ্যতা আমাদের বাসার দিকে রওনা হতে হলো।

কিন্তু সে নাকি সিনেমা দেখতে যাবে বলে জেদ করে ধরে বসে পড়লো। শেষে আমি, মায়াবিনী, ফয়সাল ভাইয়া, শশী মিলে সিনেমা দেখে বাসায় ফিরবো তখন সে আইসক্রিম খাবে বলে নতুন বায়না আঁটলো। এই মেয়ে যেভাবে চলছে কেউ বলবে না এর আজ ডেলিভারি ডেট ছিল। শশী আর ভাইয়া তিন ঘন্টা আমাদের সাথে থেকে বিরক্ত হয়ে গেল। ভাইয়া না পেরে বলেই ফেললেন,

-কি করে সামলাচ্ছো আমার এই পাগলী বোনটাকে?

ব্যস হয়ে গেল। মায়াবিনীর রাগ কে কমাবে? পুরো ফায়ার। ছোঁয়া লাগলেই পুড়ে যাবো আমি। তবে এবার আমার আর মানাতে হলো না। এবার ভাইয়া অনেকগুলো আইসক্রিম আর চকোলেট দিয়ে তার বাচ্চা বোনকে মানিয়ে ফেললেন। কি এক হাসি যেন গুপ্তধন হাতের মুঠোয় পেয়েছে। বাসায় ফিরে আসার আগে সুন্দর করে তার ভাই আর ভাবীপুকে এমন এক কথা বলে বসলো আমারই কান দিয়ে ধোঁয়া বের হচ্ছে এখনো। ভাইয়া আর শশীর কি হাল হলো মুখ তুলে না দেখে নিজের বউকে জোর করে নিয়ে বাসায় পথ ধরলাম।

-ভাইয়া শোনো, রাতে ইয়ে করবে তবেই আমার মতো মা হতে পারবে ভাবীপু।

বাসায় পৌছে দেখি মায়াবিনীর বাবা বসে আছেন আমাদের ড্রয়িং রুমে আমার বাবার সাথে। বেশ আড্ডা জমে উঠেছে। মায়াবিনী বাবাকে দেখে কি এনেছো জিজ্ঞেস করে যখন দেখেছে কিছুই আনেন নাই বাবা তখন মুখভার করে সে আমাদের রুমে চলে গেল। বাবা নিজেই মায়াবিনীর কাছে যাওয়ায় মেয়ে আর বাবার মাঝে আবার ভাব হয়ে গেল।

রাতে ঘুম পাড়াবো বলে মায়াবিনীকে খুঁজতে রান্নাঘরে গেলাম। দেখি খালার সাথে চুলোর পাশের জায়গায় বসে গল্প করছে। ওকে এখন গৃহিণীর মতো লাগছে। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম কি গল্প করছে তারা। মায়াবিনী একটা লিস্ট করছে। বিয়ের প্রয়োজনীয় সামগ্রীর একটা লিস্ট। খালার সাথে আলোচনা করে খাতায় খসছে। লেখা হয়ে গেলে নেমে আসার আগে খালাকে বলে এলো,

-খালুকে পঁচা পানীয় খেতে মানা করবে। আর গোপন কথা শোনো, তোমাদের গ্রাম থেকে ওই ওঝা বাবাকে আনিয়ে শিমুল গাছের পেত্নীটাকে তাড়িয়ে দিও তো। আমার জামাইটার সাথে ইয়ে ইয়ে করার যেন সুযোগ না পায়। ওই পেত্নীর সাথে পরকীয়া আমি ছুটিয়ে দিবো।

শেষের লাইন শুনে হাসবো না কাঁদবো বুঝতে পারছিলাম না। খালা হেসেই কুটিকুটি। মায়াবিনী দরজার সামনে এসে আমায় দেখে মুখ ভেংচি মেরে রুমে চলে গেল। আমিও পেছন পেছন গেলাম। মায়াবিনী দোলনায় যেয়ে বসে পরেছে। আমি রুমের দরজা বন্ধ করে লাইট অফ করে মায়াবিনীর কাছে যেয়ে পায়ের কাছে বসলাম। চাঁদের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ও। আর আমি ওর দিকে। এতো সুন্দর কেন মেয়েটা? মায়াবিনী আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

-আমি দেখতে সুন্দর, আমার মন সুন্দর তাই আমি পুরো সুন্দর।

বড়বড় করে তাকাতেই মায়াবিনী ভুবন ভোলানো এক হাসি দিয়ে বলল,

-তোমার মনের কথা আমি জানবো নয়ত কে জানবে বোকা ছেলে?

কি হলো জানি না। বারান্দায় দেয়াল ঘেষে পা মেলে বসে মায়াবিনীকে হাত ধরে টেনে এনে আমার কোলে বসালাম। ও আমার বাম দিকে পা রেখে আমার ডান পাশের বুক ঘেষে কোলে বসেছে। মুখের উপর থেকে চুল সরিয়ে পেছনে নিয়ে একটা বিনুনি করতে লাগলাম আর কিছু কথা বলতে লাগলাম।

-আমি অভিমান করে তোমায় সেদিন ওসব বলেছিলাম শিমুল তলায়। আমায় ক্ষমা করে না দাও কিন্তু তাই বলে তুমি আমায় রেখে কি করে এতদিন দূরে থাকলে? তুমি জানো না তোমায় ছাড়া আমার জীবন তুচ্ছ!

চাঁদের আলোয় মেয়েটার চোখের জ্বল চিকচিক করছে। দুই চোখে চুমু খেয়ে নিলাম। মেয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে খানিক হেসে আমার আমার গালে হাত রাখলো।

-আমার জীবনের একমাত্র পুরুষ কেবল তুমি নিবিড়। তোমায় আমি এত ভালোবাসি দূরে থাকলেও আমার সমস্তটা জুড়ে শুধু তুমি ছিলে।
তুমি বহুদূরে তাও তিন মাস কথা না দেখা না করেও কি করে একে অপরের জন্য একই টান অনুভব করেছি? রাগে যতই তোমায় সরিয়ে দিতে চেয়েছি তুমি ততোই কাছে এসেছো। তবে সম্পর্কের মাঝে চির ধরেছিল কখনো? শুধু ছিল অভিমান। কিন্তু টান ছিল আগের মতোই। টানের মায়া গাঢ় করেছে আমাদের এই বেবি। বেবি আমাদের মাঝে এক প্রকার দড়ির মতো যা দুইজনের দুপাশে বাঁধা গিট্টু দিয়ে। একজন বাঁধন ছেড়ে দিলেও লাভ হতো না। অপর পাশে বাঁধন আঁটসাঁট।

আমি চুপচাপ কেবল শুনে গেলাম মেয়েটির কথা। অনেকদিন পর ওকে ম্যাচিউর দেখালো। সুন্দর মানুষ কি কেবল সুন্দর কথা বলে? মায়াবিনী আমার কপাল চোখ নাক গাল ঠোঁট থুতনিতে ডান হাতের আঙুল দ্বারা স্পর্শ করছে। আবেশে আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেল। কেমন এক অনুভূতি যেন মাদকতা। মায়াবিনীর দুইহাত খপ করে ধরে ওর পেছনে পিঠের সাথে ধরে রাখলাম আমার ডান হাত দিয়ে। মেয়েটি হটাৎ আচমকা হওয়ায় অবাক হলো। আর বাম হাত ওর চুলে ঢুকিয়ে ওকে আমার আরো কাছে টেনে এনে গলায় মুখ গুঁজে দিলাম। নাক ঘষে যাচ্ছি আর জোরে জোরে শ্বাস টানছি। এই ঘ্রাণ এত টানে কেন আমায়? মেয়েটা কেঁপে উঠছে। সেই কম্পন। আরো অস্থির হয়ে উঠলাম। এক গভীর চুম্বনে মায়াবিনীকে উতালপাতাল করে তুললাম। যখন মুখ তুলে ওর দিকে তাকালাম তখন ভারী নিশ্বাস পরছে মেয়েটার। চোখ লাল হয়ে উঠেছে। এই লক্ষন আমি চিনি। মায়াবিনীকে স্বাভাবিক করার জন্য আমি ওকে আস্তে করে ছেড়ে দিলাম। ওকে ধরে রেলিঙের সামনে দাঁড় করিয়ে, পেছনে নিজেও দাঁড়ালাম ওর দুইদিকে আমার দুইহাত রেখে রেলিং এ। বললাম,

-এই শিমুল গাছের পেত্নী তোমাকে আমি কখনো পাত্তা দেইনি কারন আমার ঘরে সুন্দরী বউ আছে। এখন তুমি নিজের জন্য একটা মামদোভূত খুঁজে নাও।

মায়াবিনী ঘাড় ঘুরিয়ে এমনভাবে হাসি দিলো যেন সত্যি ও এক স্বর্গসুখ অনুভব করছে। তাই মুচকি হাসলাম। কোলে নিয়ে বিছানা শুইয়ে দিলাম। পেটে থেকে কাপড় সরিয়ে চুমু দিতে নিলেই বলল,

-আজকে শুধু আমি আদর পাবো। কালকে থেকে তোমার মেয়েকে তুমি আদর করো।

অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি এই প্রথম মায়াবিনী স্বীকার করলো আমাদের মেয়ে হবে। মায়াবিনীকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে পরলাম। বলে দিলাম আজ আমার সমস্ত ভালোবাসা কেবল ওর জন্য। সারাটা রাত আমাদের একটু গল্প একটু দুষ্টামীতে পার হয়ে গেল।

সকাল থেকে মায়াবিনী আরেক কাহিনী শুরু করেছে হসপিটালে যাবে। সিজার করাবে। মা কোনোভাবে রাজি না। কোনো সমস্যা হচ্ছে না তবে কেন করাবে। দুই একদিন যাক না হলে হসপিটালে নিবেই। আমি এই ব্যাপারগুলো মোটেও বুঝছি না বলে চুপ করে আছি। মায়াবিনী আমাকে কাছে মুখ গুমরা করে এসে বলল,

-আমার পেট কাটবে, পরে সেলাই এর দাগ থাকবে। আমাকে আগের মতো সুন্দর লাগবে না বলে তুমি হসপিটাল নিচ্ছো না। তাই না?

মায়াবিনীর কথা শুনে ভেতরে কেমন যেন লেগে উঠলো। সবাইকে বলে দিলাম সিজার আজকেই হবে। মা আমাকে মানাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কিন্তু আমি নাছোরবান্দা সবাইকে রেডি হতে বললাম। মায়াবিনীর বাসায় ফোন দিলাম। এই ফাঁকে মায়াবিনীর পেইন উঠে পরলো। হটাৎ এতবেশী পেইন মায়াবিনী একপা কোথাও নড়তে রাজি না। রহিমা খালা চেক করে বললেন নরমালে বেবি হয়ে যাবে। বাসায় মা আর খালা ব্যবস্থা শুরু করলেন। আমি আমার বউকে কোনোভাবেই বাসায় রাখবো না, হসপিটালে নিবো বলে ডক্টরকে কল করে জানলাম আজ ডক্টরদের স্ট্রাইক চলছে। কোনো ডক্টর আজ কোনো পেশেন্টকে ধরবে না। অগ্যতা বাসাতে রাখতে রাজি হলাম। এইদিকে শশী বানু খালাকে নিয়ে এসেছেন। মায়াবিনীর আত্মচিৎকারে আমার ভেতর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। এরই মাঝে ভেতর থেকে মা খবর নিয়ে এলেন। আমার কন্যা সন্তান হয়েছে। মায়াবী পূর্ণ সুস্থ। একটুপর মা আমার বাচ্চাকে এনে দেওয়াতে সবাই একে একে কোলে নিচ্ছে কিন্তু আমি মায়াবিনীকে দেখতে আকুল হয়ে উঠেছি। বানু খালা এসে মাকে খবর দিলো ভেতরে যেতে।

আমাদের রুমে যেয়ে দেখি মায়াবিনী বিছানায় শুয়ে আছে। ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওকে। আমাদের বেবিকে ওর পাশে শুইয়ে দিলাম।

-তুমি কেঁদেছো নিবিড়?

-এ যে কান্না না। আনন্দোশ্রু। কি করে আমাকে দেখেই সবটা বুঝে যাও মায়াবিনী।

-আমরা বাবা মা হয়ে গেছি নিবিড়। কতো দায়িত্ব আমাদের।

এই মুহুর্ত ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম মুহুর্ত। আমাদের তিনজনের ছোট্ট এক পরিবার। একসাথে আমরা। হটাৎ কিছু সময় পর মায়াবিনী অস্থির অস্থির করতে লাগলো। কি হয়েছে জানতে চাইলে মা আর খালাকে ডেকে দিতে বলে। খালা চেক করে বলেন মায়াবিনীর ইন্টারনাল ব্লিডিং কমছে না। আধা ঘন্টার মাঝে অনেক ব্লিডিং হয়ে গেছে। আমি, বাবা, ভাইয়া যত ডক্টরের নাম জানতাম ফোন করছিলাম। কিছুতেই কেউ কোনো পেশেন্ট ধরবে না। আমার পৃথিবী থমকে গেছে। কিছুই চোখে দেখছি না। শুনছি না। মায়াবিনীর কাছে ছুটে গেলাম। আস্তে আস্তে নিজের চোখের সামনে দেখছি মেয়েটা নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। মা, শশী, দুই খালা চোখের পানি মুচ্ছেন। আমায় জায়গা করে দিয়ে রুম থেকে সবাই বেরিয়ে গেল। কারো সাথে আমি কথা বলিনি। কিন্তু আমি জানি সবাই বুঝিয়ে গেল শেষ চেষ্টা তাদের বৃথা হয়েছে। মায়াবিনী আমায় ইশারায় ওর কাছে যেতে বলল। শক্তি নেই আমার তাও ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম। বিছানায় ওর পাশে বসতে বলায় বসলাম। ওর চোখ বেয়ে অনবরত পানি পড়ছে। মুছে নিলো নিজেই। তারপর খানিক হাসি ফুটিয়ে একটা আবদার করলো।

-একটু কাছে এসে আমায় জড়িয়ে ধরবে?

এই আবদার আমি কি করে ফেলতে পারি? একটানে ওকে একটু উঁচু করে বুকে চেপে ধরলাম। কথা বের হচ্ছে না আমার মুখ দিয়ে। চোখ বারবার ঘোলা হয়ে উঠছে। মায়াবিনী বুকে থেকেই মুখ উঁচু করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দুইজন দুইজনের দিকে তাকিয়ে আছি। যদি এই দেখা অনন্তকাল থাকতো। কথা বলতে মেয়েটার বড্ড কষ্ট হচ্ছে। চুপ করার জন্য ঠোঁটে আঙ্গুল রাখতেই সরিয়ে দিয়ে বলল এরপর তো আর ওকে শুনতে পারবো না। আজ যেন একটু বলতে দেই। বুকের ভেতর কি চলছে তা কেবল আমি জানি। চুপ করে ওর ভাঙা ভাঙা কথাগুলো শুনছিলাম। কয়েকটি কথা বলতে দেওয়ার পর যখন বুঝলাম ও আর বলতে পারছে না। তখন ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলাম। কপালে ইশারায় চুমু দিতে বলছে। ঠোঁট বসিয়ে চুমু এঁকে দিলাম।

-ভালোবাসি!

আর সহ্য হলো না ওর বলা কথা শুনে। ওকে জোরে চেপে ধরে কেঁদে দিলাম।

-যেও না মায়াবিনী যেও না। আমায় ছেড়ে যেও না। আমি মরে যাবো। আমায় এই কষ্ট দিও না। প্লিজ যেও না বউ। ও বউ যেও না।

———————————————

মা বারবার আঁচল দিয়ে ভিজে আসা চোখগুলো মুছচ্ছেন। বাবার ধমকে মা একটু থামেন। বাসা ভর্তি লোকজন। বাবা ধমক দিলেও নিজের মন খুব ভালো তা না। তিন্নি এসে মায়ের কাঁধে হাত রেখে শান্ত হতে বলে। অথচ ওর ফোলা চোখগুলো দেখলেই বলে দেওয়া যায় ওয়াশরুমে অনেকক্ষণ কেঁদে এসেছে। বাসায় উৎসব চলছে। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে সবাই উৎসবে মেতেছে। শুধুমাত্র আমাদের মেয়ের জন্য এই আয়োজন।মেয়েটা পুরো হুবহু মায়ের মতো হয়েছে। স্বপ্নে যে মেয়েটাকে দেখতাম ঠিক তেমন। আমাদের ছোট পরী। পাঁচবছরে পা দিয়েছে সে আজ। সাদা একটা ফ্রক পরায় সত্যি পরী লাগছে। এই বয়সে আমার বাবা মাকে নিজের পেছনে ছোটায়। খাওয়া নিয়ে খুব জ্বালানো তার। এখানেও মায়ের মতো। সারাদিন খালার উপর আঙ্গুল উঁচিয়ে এই ওই করিয়েই চলেছে। নীরবের কোলে ঘুরে ঘুরে সারা বাসার ডেকোরেশন দেখছে। সে কি উচ্ছ্বাস তার। নীরব তাকে মায়াপরী ডাকে। ভুলে পরী বলে ফেললে কোলে উঠে চাচ্চুর চুল টেনে ধরে। বেচারা ভাই আমার। তখন বলে একদম ভাবীর মতো দজ্জালনী হয়েছে। তখন তিন্নি পেছন থেকে এসে বলে,

-কি বলছো? আমার বোন দজ্জালনী? আমার পরী দজ্জালনী? তুমি কি তাইলে?

লেগে গেল এদের। আমাদের পরী বড়দের মতো ওদের ঝগড়া দেখে খুব মজা পাওয়ার বদলে দুইজনকে থামিয়ে কান ধরে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে। বলা হয়নি আগের বছর বিয়ে হয়েছে এদের দুইজনের। ওইদিন রান্নাঘরে মায়াবিনী বিয়ের জন্য যে খসড়া করছিল তা তিন্নি আর নীরবের বিয়ের জন্য ছিল। ভাইয়া আর শশীর ফারহান নামের চার বছরের একটা ছেলে আছে। মায়াবিনীর সাথে উৎসের যেমন সম্পর্ক, পরীর সাথে ফারহানের তেমন সম্পর্ক। মায়ের কোনো স্বভাব সে ছাড়ে নাই। আমার একটা ডেইলি রুটিন করে দিয়েছে গুগল দেখে নীরবের সহায়তায়। সময় থেকে একটু লেট করলে আমার পিঠে কয়েক ঘা বসিয়ে দেয়। আমি নিজেই বলি হ্যা এখন মেয়েকে দিয়েই করাচ্ছো।

-নামটা পছন্দ হয়েছে? একদম তোমার মন মতো। মায়াবী যেমন ছিলে নাম অনুযায়ী, আমার মেয়ে পরী নাম অনুযায়ী। প্রতি বছর জন্মদিন ও করি বড় করে। বুঝতে দেই না মোটেও ওকে কষ্টটা। সব তোমার কথা মতো হচ্ছে কিন্তু। মেয়েকে বড় হয়ে কি বানাবো বলে দিও আজ রাতে।

রাত হতেই লাইট বন্ধ করে রাখি আমাদের রুমের।
-আলো থাকলে তো তুমি আসতে চাও না। এখন কাছে আসো বউ। তোমার সুন্দর মুখখানা দেখি।
(সামনে বসে থাকা ছায়ামূর্তি মৃদু হেসে কাছে এসে বসে।)
আগের থেকে এখন বেশি সুন্দর লাগে তোমায়। মনে হয় ঝাপটে ধরি নিজের সাথে। কাছে নিয়ে তোমার মাঝে ডুবে যাই। আদর করতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আজকাল তোমাকে ছাড়া আমার কিছুই বুঝতে ইচ্ছে করে না। বোঝো না? এতো কাছে তবুও ছোঁয়া যায় না। ছুঁতে নিলেই মিলিয়ে যাও৷ প্রথম দিকে ছুঁয়ে ফেলতাম আর অমনি তুমি হারিয়ে যেতে। এতগুলো বছরে নিজেকে সামলে নিয়েছি। প্রতিরাতে প্রেমিক প্রেমিকার মতো দেখা করি। ভোর হতেই তোমায় চলে যেতে হয়। দেখো মায়াবিনী আমি এখনো বেঁচে আছি কারন তুমি কথা দিয়েছিলে আমার কাছেই থাকবে। তুমি কথা রেখেছো। বেডের যে পাশে তুমি শেষ শুয়ে ছিলে ওই পাশে আমি শুয়ে পরি। কেমন? তোমার প্রেমে মাতাল হয়ে পাগলের মতো কাছে ডাকি তোমায়। তারপর তুমি নিজে এসে আমার মাঝে মিশে মিলিয়ে যাও।

নিবিড় শুয়ে যাওয়ার পর মায়াবীর বলা শেষ কথাটি কানে বেজে উঠে বারবার। “ভালোবাসি”, “ভালোবাসি”, “ভালোবাসি”। আবেশে চোখ বন্ধ করে নিতেই সামনে দাড়িয়ে থাকা ছায়ামূর্তি নিবিড় এর উপর শুয়ে পড়ে একদম ওর গায়ের সাথে মিলিয়ে যায়।

—————————————–

বাইশ বছরের এক মেয়ে একটা ছবির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। একজন সুদর্শন যুবক এক সুন্দরী যুবতী মেয়ের কোমড় ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে রেখেছে। যুবতীটি যুবকের বুকে হাত রেখে মন খোলা একহাসি দিচ্ছে। যুবক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যুবতীর দিকে। তেইশ বছর আগের একটা ছবি, তবুও কতো জীবন্ত। সুন্দরী এই মেয়েটিকে পাত্র পক্ষ দেখতে এসে না করে দিয়ে গেছে কারন আর কিছুই না। মা মরা মেয়ে শিক্ষা দীক্ষা পেয়েছে কিনা কে জানে। তার উপরে বাবা পাগল। রুমে বন্দী করে রাখা হয় তাকে। কি জানি পাগলের বংশধরকে কে জেনে শুনে ঘরে তুলবে? তবে মেয়েটির মনে মোটেও দুঃখ নেই। ছবির সামনে দাড়িয়ে মৃদু হাসছে। এ যে হবার ছিল যেন তা আগেই জানতো। মধ্য বয়স্ক একজন পুরুষকন্ঠে মেয়েটিকে ডেকে উঠেছে বাহির থেকে।

-মায়াপরী”

মেয়েটি ঠোঁটে হাসি রেখেই আসছি বলে বের হয়ে চলে যায়।

সমাপ্ত

বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ ইন্টারনাল ব্লিডিং এ মায়াবী মারা যাবার পর নিবিড় চুপচাপ হয়ে যায়। মাঝে মাঝে নিজের মেয়ে পরীর সাথে কথা বললেও কারো সাথে কথা বলে না। তবে সবাই প্রায় একা একা কথা বলতে শুনতো নিবিড়কে। সময় যত বাড়তে থাকে নিবিড় আরো বেশি ঘোরে মাঝে চলে যেতে থাকে। সবার মাঝে সে মায়াবীকে দেখতে পায়। পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে গেলে নিবিড়কে ওর ঘরে বন্দী করে রাখা হয়। কিছু মানুষ একদিনে পাগল হয় কিছু মানুষের সময়ের সাথে সাথে সুস্থ চিন্তা ভাবনা করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে একটা ঘটে যাওয়া ঘটনা মানুষ মেনে নিতে না পারলে কল্পনায় নিজে নিজে বাকিটা সাজিয়ে নেয়। আমরা স্বাভাবিক মানুষ ওদের অস্বাভাবিকতা চটজলদি ধরে ফেলি। অথচ তারা তাদের কল্পনার পৃথিবীতে এত মেতে থাকে, পাশ্ববর্তী মানুষগুলোর যা চিন্তার উর্ধ্বে। নিবিড় বুঝিয়ে দিয়েছে সে সত্যি মায়াবীর প্রেমে মাতাল। ভালোবাসা অমর। ভালোবাসার মৃত্যু নেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here