তোমার_প্রেমে_মাতাল,পর্ব_১৭,১৮
লেখিকা_মায়াবিনী
পর্ব_১৭
-নীরব বলো তো ব্যপারটা আসলে কি?(চিন্তিত হয়ে নীরবের রুমে পায়চারি করছি)
-আমি কি করে জানবো? তবে তোমার জন্য জানতেই পারি?।
-বাদঁরামি করো না তো?।রুশমির এতো বয়স বিয়ে হয়নি নাকি? বিয়ে তো হয়েছে। হয়েছে বলেই স্বামীর সাথে এবোর্ড গেছে। বিয়ে বেবি শুনে এমন রিয়েক্ট করলো কেন?
-জানি না মায়া।তবে আমি আমার বন্ধুকে আবার ফেরত পেয়েছি। তার খুশির জন্য সবই করতে পারি।
গালভর্তি হাসি দিলাম। নীরবের রুমে এসেছিলাম আমাকে রুশমির ব্যপারে জানতে সাহায্যে করবে কিনা। করবে না আবার? এমন বন্ধু লাখে পাওয়া যায়।
সকালে অফিসে যাইনি নিবিড় এর সাথে। রিক্সা করে গিয়েছি।কেন যাবো? যত মনে হয় নিবিড়কে ভুল বুঝছি, নিবিড় ঠিক, কোনো অন্যায় নিবিড় করছে না। ততই ভুল ভেঙে যাচ্ছে। যত ওকে সুযোগ দিচ্ছি তত নিচ্ছে।
এনিভার্সারী এভাবেই পার হয়ে গেল, নিবিড় উইস করে নাই রাতেও। কিন্তু আমি অপেক্ষা করছিলাম রুমে। ১২টার আগে ওকে বলব আমি নিজেই। আধা ঘন্টা হতে চলেছে নিবিড় ঘরের বাহিরে গেছে। কোথায় গেল? কেকটাও কাটবো তো নাকি? বেরিয়ে গেলাম নিবিড়কে খুঁজতে।
বিকাল বেলায় মায়াবিনীর কথায় রুশমি উত্তেজিত হয়ে গেছিলো। দেখে আসি মেয়েটা কেমন আছে। মানসিক ভাবে এমনি ভেঙে আছে।
-আসতে পারি?
-তুমি? তোমার বাসা তুমি আসতে পারমিশন চাচ্ছো?(মলিন হেসে)
-মেয়ে মানুষের ঘরে আসার আগে পারমিশন নিতে হয়। কি করছো?
-তুমি কি রাগ করলে? এমনি মিছেমিছি বলেছি।
-না রাগ হয়নি।শরীর কেমন তোমার তা বলো?
-শরীরে কিছু না। বাহিরে আমি সুস্থ কিন্তু ভিতরটা? (পলকবিহীন চোখে নিবিড় এর দিকে তাকিয়ে)
-আমি তোমায় এখনো সময় দিতে পারিনি। তোমার সাথে কথা আছে।(দরজার দিকে তাকিয়ে) কিন্তু বাসায় না। কালকে বাইরে দেখা করবে আমার সাথে। আমি অফিস থেকে ফোন করলে চলে আসতে পারবে?
-আমি তো এখন কিছুই চিনি না এখানকার। প্রায় ১১বছর হতে চলেছে। এখন তো কিছুই মিলে না।
-আচ্ছা ফোন করলে রেডি থেকো।নিচে নেমে আসবে।কেমন?
-ঠিক আছে।
-মায়াবিনীর কথা শুনে কিছু মনে করো না। বাচ্চামি স্বভাব ওর এখনো যায়নি।আগ বাড়িয়ে বেশি বলে ফেলে।
-না না।কিছু মনে করিনি। আমার বয়সের মেয়ে বিয়ে হয়েছে বাচ্চা হয়েছে এমন ভাবতেই পারে।ওর কি দোষ এমন ভাবায়। আচ্ছা এসব বাদ দাও। মায়াবীকে মায়াবিনী ডাকো কেন? আমায় তো আলাদা নামে ডাকোনি।
মুখ তুলে তাকালাম রুশমির কথা শুনে।
-যাহ বাবা সিরিয়াস হয়ে গেলে? মজা করছিলাম।
-(হাঁপ ছেড়ে) মায়াবিনীর নাম জানতাম না যখন তখন এই নামকরণ। পরে দেখি মিলে গেছে। তাই আমার দেওয়া নামেই ডাকি।
-মেয়েটা দেখতে সত্যি মায়াবিনী। নামকরণ সুন্দর। তা পাঁচ বছর প্রেম করেছো বুঝি?(খুব স্বাভাবিক ভাবে)
-হ্যা। তুমি কি করে জানলে?মায়াবিনী বলেছে?
-হু।
-অল্পক্ষণে বলেও ফেলেছে? মেয়েটা এত দুরন্ত। একে নিয়ে যে কি করি আমি!
-আরে বাবা থামো। মায়াবী কিছু বলে নাই নিজে থেকে। আমি জিজ্ঞেস করায় বলেছে। আর তুমি এত কথা কবে থেকে শিখলে? আগে তো কথাই বলতে না। মায়াবী না তুমি বরং দূরন্ত। মায়াবী করেছে মনে হয়। অনেকটা সময় এক সাথে থেকেছো দুজন।
(কি বলবো খুজেখুঁজে পেলাম না। সত্যি মেয়েটা আমায় পাল্টে দিয়েছে।)
-তা বাচ্চা মেয়ের প্রেমে পরলে কি করে?
আমার মনটা আনন্দে ছেয়ে গেল। মায়াবিনীর মুখখানা ভেসে উঠেছে চোখের সামনে।
-জানি না। কি যেন আছে ওর মাঝে। প্রথম দেখায় মন কেড়েছিল। পরের দেখায় আমাকেই।(আনমনে বলেছি)
-খুব ভালোবাসো বুঝি?
-ভালোবাসি খুব ভালোবাসি। এতো ভালোবাসি তা কখনো বলে শেষ করা যাবে না।
-আমাকে কেন কেউ এভাবে ভালোবাসে নাই?(চোখ ভরে এসেছে পানিতে)
-রুশমি! (অবাক চোখে তাকালাম)
-তুমিও তো আমায় ভালোবাসোনি এভাবে। কেন বলো না?(বলেই আমার হাত ধরে রুশমির পাশে বসালো)
এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটি ঘটেছে কিছু বলতে পারলাম না।
-নিবিড় আমি কি এমন ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না?
-তোমার এখন ঘুমানো উচিত।
হাতটা আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। অনেক অসস্তি অনুভব করছি। হাত ছাড়াতে যত চেষ্টা করছি ততই জোরে চেপে ধরছে রুশমি। কোনো মেয়েকে আমি কখনো ছুঁইতে দেইনি আমায়। প্রেমিকা থাকা অবস্থায় সামনে দাড়িয়ে একবার কথা হয়েছিল আর সেদিনই দুইজনের রাস্তা আলাদা হয়ে গিয়েছিল। আর আজ আমি অন্য কারো হাসবেন্ড, সেখানে প্রাক্তন হয়ে তাকে ছুঁতে দেওয়া অপরাধ। শেষে খানিকটা জোর করে হাত ছাড়িয়ে উঠে দাড়ালাম।
-অনেক রাত হয়েছে রুশমি। মেডিসিন নিয়ে শুয়ে পড়। কাল কথা হবে। গুড নাইট।
বলে বের হয়ে এলাম রুম থেকে। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছি। রান্নাঘরে যেয়ে ফ্রিজ খুলে পানি নিয়ে খেলাম। নিজেকে খানিকটা স্বাভাবিক করে মনে হলো রুশমির সাথে শেষটায় বেশি রুড বিহেব করে ফেললাম। মানসিক অসুস্থ হওয়া মেয়েটাকে আবার কষ্ট দিলাম। কালকে সরি বলে নিবো। রুমে যেয়ে দেখি মায়াবিনী শুয়ে পরেছে। লাইট বন্ধ করা রুমের। দরজা আঁটকে মায়াবিনীকে এক ঝলক দেখে নিলাম। ওয়াশরুমে গেলাম।
নিবিড় রুমে এসেছে বলে চোখ তাড়াতাড়ি মুছে ঘাপটি মেরে শুয়ে রইলাম। ওকে দেখানো যাবে না আমি কাঁদছি। একটু আগে যা দেখলাম। নিবিড়কে খুজতে যেয়ে দেখলাম গেস্ট রুমের দরজাটা খোলা। উঁকি দিয়ে দেখি নিবিড় রুশমি বেডে পাশাপাশি বসে আছে। নিবিড়ের ডান হাত রুশমির দুহাতের মাঝে।দুইজন একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে। সহ্য আর হলো না আমার। কি করে এতকিছু মেনে নেব আমি? এ বাসায় আসার পর থেকে নিবিড় ভালো করে আমার সাথে কথাই বলে নাই। সেখানে হসপিটালে সারাদিন থেকেছে। আজ মেয়েকে বাসায় এনে তার বেডরুমে যেয়ে হাতে হাত রেখে দৃষ্টি বিনিময় করছে? বউ হয়ে কি করে এতটা মেনে নেবো। এনিভার্সারীতে খুব সুন্দর উপহার দিলো আমায় নিবিড় খুব সুন্দর উপহার।অনেকখানি চোখেরজল!
সকালে উঠে দেখি মায়াবিনী পাশে নেই। বুঝলাম ওয়াশরুমে গেছে। রুমের টেবিলে ঢাকনা দেয়া বক্স দেখলাম। খুলে দেখি কেক। এটা আজকের না বাসি। কালকে এমন রান্না আবার কেক? চটজলদি ক্যালেন্ডারে চোখ বোলালাম। এতো বড় ভুল কি করে করলাম আমি? ভুলেই গেলাম? দেখি মায়াবিনী রেডি হয়ে বের হয়েছে ওয়াশরুম থেকে। আমাকে কেক এর সামনে দাড়িয়ে থাকতে দেখল। কিছু না বলে বেরিয়ে গেল। আমাকেও বলতে দিল না। নাস্তা করে বের হলাম বাসা থেকে। বাইক গ্যারেজ থেকে বের করতে করতে দেখি মায়াবিনী রিক্সায় উঠে পরছে।ডাকলাম উত্তর দিল না। এভাবে হবে না। আমাকে কিছু করতে হবে।মানাতে হবে আমার মায়াবিনীকে।বড্ড অভিমান জমেছে মেয়েটার।
অফিসে কাজের অনেক তোড়জোড় চলছে। সামনে ফ্যাশন শো। বাইরে থেকে অনেক ক্লাইন্ড আসবে। ফোটো সেশন, ড্রেস কোড এসব নিয়ে অনেক কাজের দায়িত্ব আছে আমার। এ শো এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রোডাক্ট যাবে। ব্যান্ড এর নাম হবে। পার্শ্ববর্তী দুইটা দেশে নতুন করে লঞ্জ করা হবে। বাংলাদেশে আপাতত ৩টা শোরুম আছে। এটার ও বিস্তর হবে আশা করি। এতো তাড়াতাড়ি নিবিড় আগাবে আমরা আসলেই ভাবি নাই। সবকিছুর জন্য আলহামদুলিল্লাহ। নিবিড় আমাকে ডেকেছে কেবিনে। আমি আমার এসিস্ট্যান্টকে মডেলদের ম্যাজারমেন্টের জন্য পাঠালাম। নিবিড় এর কেবিনের দরজায় দাঁড়িয়ে,
-মে আই কামিং স্যার?
-তুমি স্যার ডাকছো কেন? আর পারমিশনই বা কেন? (চেয়ার থেকে উঠে দাড়িয়ে হাসি মুখে)
-দেখুন এসব না বলে কেন ডেকেছেন বলুন? (মুখভার করে)
-বিয়ের আগেই তো স্যার ডাকতে না অফিসে। এখন স্যার কেন?
-বিয়ের আগে?(তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম)
-(নার্ভাস হয়ে গেলাম) আই মিন যখন কেউ জানতো না তুমি আমার ওয়াইফ।
-এক্সকিউজ মি স্যার প্রাইভেট টাইম স্পেন্ড করার জন্য কি আমাকে কেবিনে ডেকেছেন? মেটেরিয়াল আমি এখনো চেক করিনি। আমার আরো অনেক কাজ আছে। আপনার দরকারী কিছু বলার থাকলে তাড়াতাড়ি বলুন।
-এভাবে কথা বলছো কেন মায়াবিনী? (কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে ওর বাহু ধরতে গেলাম)
-ডোন্ট ইউ ডেয়ার! অফিসে আমি আপনার রক্ষিতা নই। যখন তখন ছুঁবেন। ঘরে বউ থাকতে তাকে না ছুঁয়ে পরনারীকে ছুঁতে খুব ভালো লাগে বুঝি?( রাগে পিছিয়ে গেলাম। নিবিড়কে ছুঁতে দিবো না।কাল রাতের দৃশ্য এখনো আমার চোখে ভাসছে)
-মায়াবী?(এত জোরে চিৎকার করে উঠলাম কেবিনের বাইরে মেবি স্টাফরা চলে এসেছে। সবাই আমার এমন রাগের সাথে অভস্ত্য। কিন্তু মায়াবীর সাথে কোনোদিনও জোরে কথাও বলতে দেখেনি কেউ)
-এই নামেই আমাকে ডাকবেন স্যার।ধন্যবাদ। (বলে বের হয়ে এলাম)
পিছনে শব্দ পেলাম নিবিড় টেবিলে হাত দিয়ে বারি মারলো।
সবার সামনে দিয়ে কোনোরকমে নিজের কেবিনে চলে এলাম। এখন চোখের পানি বাধ মানছে না। আমাকে নিবিড় মায়াবী বলে ডাকলো!
মায়াবিনী কি করে এমন বলতে পারলো আমায়? হটাৎ ফোন এলো রিসিভ করে
-নিবিড় তুমি তো কল করলে না।
-রুশমি তুমি রেডি হও আমি আসছি।
-ওকে।
বাসার সামনে থেকে রুশমিকে বাইকে করে নিয়ে এলাম একটা কফিসপে।কোনো ভনিতা না করে মুখোমুখি হয়ে বসে বললাম,
-তুমি আমায় ওই রাতে কেন ফোন দিয়েছিলে রুশমি? আর তুমি বাংলাদেশে হুট করে কেন এসেছিলে?
-বাংলাদেশ ছাড়া অন্য কোথাও পালানোর জায়গা ছিল না। আর তুমি ছাড়া কাউকে আমি চিনি না।
-শশী?
-(চোখ মেলে নিবিড় এর দিকে তাকিয়ে) ওর সাথে যোগাযোগ নেই।
-আমার সাথেও তো ছিল না।তবে ফোন নাম্বার কি করে পেলে? (আসলে মায়াবিনীর কথায় রাগ অনেক চড়ে গেছে মাথায়। মনে হচ্ছিল রুশমির আসার পর থেকেই এমন হচ্ছে। রুশমিকেই মন দায়ী ভাবছে সবকিছুর জন্য। তাই কথাতে বারবার ধারালো শব্দ বের হচ্ছে)
-না যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু তোমার ফেসবুক থেকে তোমার প্রতিষ্ঠিত ব্যান্ডের ফ্যাশন ওয়াল্ডের নাম জেনে ছিলাম) তারপর তোমার পার্সোনাল নাম্বার জোগাড় করতে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। কিন্তু তাও পসিবল ছিল। শশীরটা কি করে পেতাম?
-ঠিক আছে। ইমারজেন্সি ফোন করে এয়ারপোর্টে আসতে বলেছিলে কেন? কাঁদছিলেই বা কেন?
-বাংলাদেশে নেমে এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে দাড়ালাম টেক্সি নিতে। লাগেজ সহ হ্যান্ডব্যাগটা ছিনতাই হয়ে গেলো। ফোন টা হাতে ছিল লোকেশন দেখছিলাম।লাগেজের উপর ব্যাগটা ছিল। তাই দুইটাই গেল। না ছিল টাকা। না ছিল সাহস। পুরোটা সময় ভয়ে ভয়ে ছিলাম জার্মান থেকেই। ওইখানের এয়ারপোর্টে পৌছানো তারপর চেকিং, প্ল্যানে উঠা। ভয়ে আমি অনেকটাই শেষ। তার উপর নামার সাথে সাথেই এমন সিচুয়েশন। ভয় থাকবে না? ট্যাক্সি নিতে পারতাম না। হোটেল ও যেতে পারতাম না। তুমি আমার একমাত্র ভরসা ছিলে তখন। (চোখ দিয়ে পানি পরে গেল)
-তবে রাস্তার উপর দৌড়াচ্ছিলে কেন? আর এয়ারপোর্ট থেকে এতো দূরে ছিলে কেন? গাড়ির সামনেও এসে পড়লে। ভাগ্যিস বেশি কিছু হয়নি।
-ক্ষুদা পেয়েছিল অনেক। বড় দোকানে কিছু পেতাম না ফ্রীতে।ছোট দোকান খুজতে খুজতে অনেকটাই সরে এসেছিলাম জনবহুল এয়ারপোর্টের রাস্তা ছেড়ে। কিছু বাজে ছেলে আমার পিছু পিছু নিল। শুনশান রাস্তা। তাও আবার এত রাত। যতটুকু সাহস পেয়েছিলাম তোমায় কল করে। ওইসবটুকুও শেষ হয়ে গেল। দৌড়ে পালাতে নিলাম। লোক গুলোও এমন দৌড়ালো। সামনে গাড়ি এসে পড়ল হটাৎ।ধাক্কা খেলাম। লোক গুলো ভয়ে চলে গেল। (কেঁদেই চলেছে অনবরত)
-যদি এক্সিডেন্টে বড় কিছু হতো? ঠিক সময়ে তোমার কাছে না পৌছাতাম? আমি হসপিটালে নিতে না পারতাম? তবে?
-মরে যেতাম! নর পশুদের খাদ্য তো হতাম না!(চোখে চোখ রেখে)
মনটা নরম হয়ে গেল। শুধু শুধু হার্ট করে কথা বলছিলাম। মানসিক ভাবে অসুস্থ সে। তারপর শারীরিকভাবেও দূর্বল।কি বলে ফেললাম আমি? এতো নিষ্ঠুরতা? আমার চোখ ছলছল করে উঠলো…..
চলবে
#তোমার_প্রেমে_মাতাল
#লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৮
নীরবের বাহুবন্ধনে জড়িয়ে আছি আমি। আজ নীরব ছিল বলেই বেঁচে আছি। নিশ্বাস নিচ্ছি খুব জোরে জোরে। কেঁদে কেঁদে মরে যাওয়া যায় না? আজকে মনে হচ্ছিল মরে যাওয়া নিতান্তই সহজ।মরে যাচ্ছি না বলে অগাধ আপস হচ্ছিল আমার মন। ঠিক খানিক আগেই বুঝতে পারলাম মৃত্যু এতো সহজ নয়! কঠিন থেকেও কঠিন। এখন বাঁচতে ইচ্ছে করছে।
নীরব আমার মাথা বুক থেকে তুলে দুহাতে মুখটা চেপে ধরলো।ওর দুই হাতে আমার দুগাল।
-মায়া কি করছিলে তুমি?
আমি নিশ্চুপ।
-কি করে এমন করতে পারলে? তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি নিজেকে কি জবাব দিতাম? বাড়ির লোকদের কি বলতাম? আগে জানতাম তুমি ক্রেজি। ভীষণ পাগলামি করতে পারো। আজ জানলাম তুমি সাইকো। এভাবে কেউ নিজের ক্ষতি করে? অন্যের জন্য নিজেকে কেউ শাস্তি দেয়? যার দোষ শাস্তি সে পাবে। তুমি না।
-আমি বাঁচতে চাই নীরব! (কাঁদতেই আছি। ওর কথা শুনে নিজেকে আরো অপরাধী লাগছে।)
-তোমার কিছুই হয়নি দেখো। তুমি ঠিক আছো। আগে যদি জানতাম তুমি এমন করবে কখনো তোমায় জানাতাম না। আমায় ক্ষমা করে দাও। প্লিজ মায়া প্লিজ!
আরো কেঁদে দিলাম নীরবের চোখে পানি দেখে। আবার নীরবকে জড়িয়ে ধরলাম হাইওয়ের শুরুতে রাস্তার পারে দাঁড়িয়ে। কেঁদে ওর শার্ট ভিজিয়ে ফেলেছি। তারপরও কোনো হুঁশ নেই। মরতে মরতে বেঁচে গেছি।জীবনের মূল্য কয়েক মিনিট আগে আমি বুঝতে পেরেছি।
নিবিড়ের কেবিন থেকে বের হয়ে আমি কান্নাকাটি করছিলাম। হঠাৎ দেখলাম নিবিড়কে বের হয়ে বাইরে যেতে। আমার কেবিন গ্লাসের ছিল বলে বাইরেরটা দেখা যায়।চলে গেলে কি মনে হল পিছনে বেরিয়ে পরলাম। ফলো করবো কিনা ভাবছি।নিবিড়ের মন ভালো না। এমনি অফিস থেকে হসপিটালে যেতো। আজকে কোথায় যাচ্ছে? ভাবছিলাম হয়তো কোন ভুল করে ফেলবে কিনা ফলো করা উচিত। নিবিড় এর পিছনে সি এন জি নিলাম। দেখি বাসার দিকে যাচ্ছে নিবিড়।নীরবকে কল করলাম। নীরব দেখো তো নিবিড় কেন বাসার দিকে যাচ্ছে। বুঝলাম না। আমার অফিসে একটা জরুরি কল এসেছে। আমাকে মেটারিয়াল চেক করতে যেতে হবে। তুমি দেখো নিবিড় বাসায় কি করতে যাচ্ছে।
মেটারিয়াল চেক করতে হাইওয়ের মাথায় গেলাম হাউসে। নীরবের সাথে কথা হয়নি। চেক শেষে মাথা টা চাপ ধরেছে। ভাবলাম কফি খেয়ে আসি। সামনেই কফিসপ। ঢুকতে নিয়েও থমকে গেলাম।
নিবিড় আর রুশমি। রুশমি হেঁচকি তুলে কাঁদছে। নিবিড় রুশমির কাছে যেয়ে বসে জড়িয়ে ধরলো। সপের সবাই ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসবেন্ড ওয়াইফ ভাবছে সবাই ওদের। আমার দম আঁটকে আসছে। বের হয়ে গেলাম হন্তদন্ত হয়ে কফিসপ থেকে। নীরবের সাথে ধাক্কা খেলাম।
-এমন করে কোথায় যাচ্ছো?
-নীরব ভভিতরে ননিবিড়… (কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে)
-হ্যা আমি জানি। তুমি তো দেখতে বললে ভাইয়া বাসার দিকে কেন যাচ্ছে অসময়। দেখলাম ভাইয়া নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। রুশমি নিচে নেমে ভাইয়ার বাইকে চড়ল। ফলো করে দেখলাম এখানে আসলো। বাকিটা তো তুমি দেখলেই।
-কি কথা বলছিল ওরা। আবার নিবিড় মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো কেন?
-জানি না!
-কি কথা বলছে শুনোনি?
-এত দূর থেকে কি করে শুনবো? কিন্তু কাল রাতে কিছু শুনেছি। তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম না। কিন্তু আজ তুমি অনেকটা দেখে ফেলেছো। তাই তোমাকে আর লুকচ্ছি না। আমি কালরাতে পানি খেতে রান্নাঘরে যেতে দেখি গেস্টরুমের দরজা খোলা ছিল।সামনে যেয়ে দেখি ভাইয়াও ওখানে। জানো ওরা কথা বলছিল যা আমি শুনে ফেলেছি। কি কথা জানতে চাও?
কথা বলতে পারছিলাম না।নীরবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। কালকে রাতে আমি গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু বলতে শুনিনি।
নীরব ফোন বের করে কি যেন বের করলো। একটা রেকর্ডিং। অন করে দিল। দুইটা মানুষের কথপোকথন।
“খুব ভালোবাসো বুঝি?
ভালোবাসি খুব ভালোবাসি। এতো ভালোবাসি তা কখনো বলে শেষ করা যাবে না।”
নিবিড় তবে রুশমিকে আজও ভালোবাসে? যতখানি নিজেকে আঁটকে রেখেছিলাম সবটা শেষটা হয়ে গেল। দিক বেদিক না দেখে দৌড়ানো শুরু করলাম। মনে হচ্ছিল মরতে যাচ্ছি। কিভাবে মরব জানি না। শুধু মরতে হবে জানি। নিবিড় এর সাথে কাটানো সব মুহুর্তে মনে পড়ছে। ওর মুখে বলা ভালোবাসি শুনতে তৃষ্ণার্ত ছিলাম। আজ শুনেছি। তবে আমার জন্য নয় রুশমির জন্য। এখন জানি নিবিড় কেন আমার সাথে কথা বলছিল না। আমায় এড়িয়ে চলছিল কেন। প্রাক্তনকে হটাৎ দেখে পুরোনো অনুভূতি জেগেছে। যে অনুভূতি মিস করছিল তা নিবিড় পেয়ে গেছে।
হটাৎ মাথাটা ঘুরে গেল। থেমে গেলাম। সামনে প্রাইভেট কার আসছে। মরতে চেয়েছিলাম আমি। সুযোগ চলে এসেছে। কিন্তু ভয় করছে কেন? আর পারছিলাম না। আতংকে আমি মুষড়া গিয়েছি তখন। নীরব আমার পিছনেই আসছিল। গাড়ীটা আমায় উড়িয়ে দিবে বুঝি এখন।ঠিক সে-সময় নীরব হেঁচকা টেনে আমায় সরিয়ে নিল। হ্যা একদম ওর বুকে এখন আমি। নীবর আমায় আজ বাঁচিয়ে নতুনভাবে বাঁচতে শিখালো।
সন্ধ্যার পর শশী আপু আর ভাইয়া এসেছে।ওদের অনুষ্ঠান করে বিয়ে হবে।ইনভাইটেশন করতে এসেছে।
-হ্যা রে ভাবী কালকের দিন কেমন কাটলো??
-ভাবীপু বাজে কথা বইলো না তো। (ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে সোফায় বসে আছি)
-আমার বোনটাকে জ্বালিও না তো শশী।
-আমি আমার ভাবীকে জ্বালাই তোমার কি?
-তোমাদের না সামনে বিয়ে? ঝগড়া করছো কেন? দুই বছর সংসার করে ফেলছো। তাও এভাবে ঝগড়া। আর ভাইয়া ভাবীপুকে তাড়াতাড়ি বাচ্চা দিয়ে দে তো। আমার ভাইজি এসে ওকে জ্বালিয়ে খাক?।
-আরে শয়তান মেয়ে।(কান মলতে আসছে মায়াবীর)
-এই আমার বনু ঠিকই বলছে। বাসায় চলো দিচ্ছি।(বলে ফয়সাল শশীকে চোখ মারলো)
নীরব নিবিড় আমি ভাইয়া শশী আপু ড্রয়িং এ বসেছিলাম। আমি ভুলেও নিবিড় এর দিকে তাকাইনি।নীরব এর সাথে বাসায় চলে এসেছিলাম। বাসায় বসে ডিজাইন রেডি করে মেইলে সাবমিট করেছি।নিবিড় মাত্রই বাসায় ঢুকলো। চেঞ্জ না করেই সবার সাথে আড্ডায় যোগ দিলো।
-তা আমার নন্দ জামাই কি সারপ্রাইজ দিবেন যেন বললেন? (শশী আপু নিবিড় এর দিকে তাকিয়ে)
-সারপ্রাইজ? (আমি ভ্রু কুঁচকে)
-হ্যা। তোর জামাই এখানের আসার আগে ফোন করলো।বলল বাসায় আসিস সময় করে। সারপ্রাইজ আছে। তখন বললাম আমি ফয়সাল রেডি হচ্ছি। তোদের বাসাতেই আসছি। ও বলল আমিও অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরছি তবে।
-মা ভাইয়ার জন্য রসমালাই আনছি। বেরে দাও তো।(নিবিড় মাকে জোরে ডেকে বলল)
-আরে ভাই বসো। অস্থির হতে হবে না। মাত্রই আন্টি(নিবিড় এর মা) কতো কিছু খেতে দিলো।
-ভাইয়া আপনার পছন্দ বলেই আনলাম। খেতে তো হবেই।
-আচ্ছা আচ্ছা আমার জামাই খাবে। আগে সারপ্রাইজ দে তো।
-দাড়া আনছি।
নিবিড় গেস্ট রুমের দিকে গেল। আমি নীরব চোখাচোখি করলাম।
নিবিড় এর পাশের মানুষটাকে দেখে শশী আপু খুশি হলো নাকি অবাক হলো বোঝা ভার। একবার আমার মুখের দিকে একবার নিবিড় এর মুখের দিকে তাকাচ্ছে শশী আপু। রুশমিকে দেখার যেন সময় নেই তার। আমি মাথা নিচু করে নিলাম। আপু বোধহয় বুঝে গেল।
-(এগিয়ে গেল রুশমির দিকে হাসি মুখে) রুশমি তুই?
-শশী কতোদিন পর তোকে দেখলাম।পাল্টে গেছিস অনেক।
-তুই তো আগের মতো নেই। নিষ্পাপ সহজ সরল মুখ টা আর নেই। বিদেশিনীদের মতো হাবভাবে। তা তুই এখানে?
রুশমি নিবিড় এর দিকে তাকাতে নিবিড় শশী আপুকে বলল।
-আমি তোকে পরে বলছি সব।
শশী আপু নিবিড় এর সাথে নিবিড় এর রুমে। এদিকে আমি চা করে ভাইয়া, নীরব, রুশমি আর বাবা মাকে দিলাম। সবাই ড্রয়িং রুমে।বাবা ভাইয়ার সাথে বিয়ের আয়োজন নিয়ে কথা বলছে।
-এসব কি নিবিড়? রুশমি এ বাসায় কেন?
-তুই এতদিন পর তোর বান্ধবীকে দেখে খুশি না?(অবাক হয়ে)
-আমার খুশি এখানে ফ্যাক্ট না। বউ আছে তোর। এক্সকে কেউ বাসায় আনে? আর ও বাংলাদেশেই কেন? তোরই বা কাছে কেন?
-কতো প্রশ্ন একসাথে করিস?
-মায়াবী জানে রুশমি তোর এক্স?
-হ্যা।
-কিহ। এই মেয়েটা এমন স্বাভাবিক আচরণ করছে কি করে?
-(তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে) ও সবকিছুই সুন্দর করে ম্যানেজ করতে জানে। তোর মতো রিয়েক্ট করে না।
-হেয়ালি ছাড়। নিবিড় আমাকে বল ব্যাপারটা কি?
নিবিড় রুশমির সাথে যোগাযোগ করা, দেখা হওয়া, এক্সিডেন্ট, আজকে কফিসপের সব কাহিনি খুলে বলল।
-এখন বুঝেছিস তোকে ডাকার কি মানে?
-এতকিছু হয়ে গেছে? মেয়েটা অনেক কিছু ফেস করেছে। ওর সাথে কথা বলতে হবে।
-আমি এটাই চাই তুই রুশমিকে টাইম দে।
-কিন্তু এখন বিয়ের ফাংশন। তুই বল কিভাবে দিবো? কয়েকটা দিন তুই ম্যানেজ কর। অনুষ্ঠানের দিন শেষ হলে আমি দেখবো। কিন্তু প্লিজ রুশমিকে এ বাসায় রাখিস না।
-তবে কোথায় রাখবো?
-হোটেলে।
-এই অবস্থায়? ওকে একা রাখতে ডক্টর না করেছে।
-দেখ তোর সাথে মায়াবীর কেমন সম্পর্ক আমি জানি। বিয়ের পর রুশমির জন্য তুই চাপে ছিলি আমি বুঝেছি। কিন্তু প্লিজ এখন মেয়েটার সাথে অন্যায় করিস না।
-আমি অন্যায় করছি না। তবে আমি দেখছি। তুই এটা নিয়ে না ভেবে রুশমির ব্যাপারটা মাথায় রাখ। আর এ কথা মায়াবীকে বলিস না। রুশমি কমফোর্ট ফিল করবে না। আর যে পাগলি। কি থেকে কি বলবে। রুশমি নতুন করে কোনো কষ্ট পাক চাই না।
-ঠিক আছে।
বের হয়ে আসতে নিয়েও দাড়ায় শশী,
– তবে হ্যা মায়াবীর জন্য তোর কেমন অনুভূতি আমি তা দেখেছি।রুশমির চলে যাওয়ার পর আমি তুই কি কি করছিলি তাও দেখেছি। রুশমির কথা ভাবতে যেয়ে নিজের সংসার ছেড়ে দিস না। মায়াবী মেয়েটা অনেক ভালো। ওকে কষ্ট দিলে তোকে ক্ষমা করবো না।মায়াবী আমার কেবল বন্ধুর ওয়াইফ না।আমার হাসবেন্ডের একমাত্র বোন। একটা মানুষ ও ছেড়ে দিবে না তোকে। এমনকি তোর বাবা মা ও নয়। তুই নিজেও কোনোদিন ভালো থাকতে পারবি না। মাইন্ড ইট।
বলে বেরিয়ে চলে আসলো। নিবিড় ভাবছে,
“আসলে কি আমি মায়াবিনীকে কষ্ট দিচ্ছি নাকি ও আমাকে……. “