তোমার_প্রেমে_মাতাল,পর্ব_৩৮+৩৯
লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
পর্ব_৩৮
তোমাকে ভালোবাসি মায়া!
ভালোবাসি শব্দের মতো সুন্দর কোনো শব্দ পৃথিবীতে থাকতে পারে না। অথচ এই শব্দকে আমি এখন নিতে পারছি না। অবাক হবো না রাগ হবো ভেবেই পাচ্ছি না। যেন ভাবনার ও সময় নেই আমার। ছাঁদে পাতা বেঞ্চটায় বসে পরেছি। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছি মেঘলা কিনা। তা বোঝা যাচ্ছে না কুয়াশায় ঢাকা আকাশ বলে। শীতের বৃষ্টি হয় না! হয় তো। কিন্তু ছাঁদে রাখা গাছগুলোর পাতার উপর জমে থাকা পানি বিন্দু বলে দিচ্ছে সবই কুয়াশা নামা শিশির। এই সৌন্দর্য মনোমুগ্ধকর। কিন্তু আমার মন নেই এখানে। জীবন কোথায় কখন এনে মোড় ঘোরাবে বলা যায় না। নীরবের ডাকে চেতনা ফিরে পেলাম।
-আমায় একটু ভালোবাসবে মায়া? আমি অনেক বছর ধরে অপেক্ষা করেছি তোমার আশায়। শুধু তোমায় একবার বলতে পারবো মুখ ফুটে।
দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উঠলাম। এ যে সহ্য সীমার বাহিরে, অনৈতিক ও বটে।
-চুপ করো। আমি ভাবী হই তোমার। কি আজে বাজে বকছো?
-কিসের ভাবী? দুইদিন হলো বিয়ে হয়েছে আমার ভাইয়ের সাথে। অথচ আমার ভালোবাসা বহুবছরের।
-দুইদিনের বিয়ে নয় আমার।
-কয় মাস? কয়বছর? আট বছর হয়নি তো? আট বছর ধরে তোমায় বুকে পুষে রেখেছি আমি!
আকাশ যেন আমার মাথার উপর আঁচড়ে পড়লো। এ কি শুনছি আমি? নীরবের দিকে তাকিয়ে বেখেয়ালি হয়ে উচ্চারণ করলাম,
-আট বছর!
নীরব আমার সামনে এসে দাড়িয়ে দুইবাহু চেপে ধরে বলল,
-হ্যা মায়া আট বছর। আট বছর পেরিয়ে গেছে…
পলকবিহীন ভাবে নীরবকে দেখে চলেছি। চোখ পড়ার চেষ্টা করছি। কিছু আর ভাবনা হলো না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখা হলে না আর…..
————————-
মায়ের রুমে এসেছি অনেকক্ষণ হলো। যেয়ে দেখি মা উল বুনছে বেডের উপর বসে। যখন ঢুকলাম মুখ তুলে তাকিয়ে আবার যে বোনা শুরু করলো কথাও বলল না। শেষে না পেরে আমি বলব তার আগে মা নিজেই বললেন,
-রুম থেকে বেরিয়েছো কেন? নীরব বাসায় আছে। ও মনে হয় জানেও না তুই মা হবি। জানানোর প্রয়োজনবোধ করিনি। তোর পাঁচ মাস হলে বের হবি। তখন সবাই জানবে তোর পৌনে চার মাস। নীরবকে এখন বললে ওর চোখে পরে যেতে পারে। তুইও বের হবি না।
-আচ্ছা মা। উল বুনছো কি বানাবে মা?
-জানিনা। সময় কাটে না তাই।
-আগের মতো গল্প না করলে সময় কাটবে কি করে?
মা কাজ রেখে আমার দিকে তাকালেন। এমনভাব বড় কোনো অপরাধ করে ফেলেছি। ঢোক গিললাম।
-রাগ করেছো মা?
-আমি রাগ করার কে?
-মা। কি হয়েছে বলো না? আমার জন্য কষ্ট পেলে আমি সত্যি সরি। আমি ইচ্ছে করে করিনি কিছু।
মা হেসে দিলেন।
-দূর পাগলি। তুই কি করবি? রাগ হওয়া যায় তোর সাথে? তুই কিছু বলিসনি তাই মন খারাপ করেছিলাম।
-কি বলিনি মা?
-তুই নীরব আর তিন্নির ব্যাপারে জানতি অথচ আমায় বললি না কেন? তবে আমি তিন্নিকে জোর করে রাখতাম না।
-মানে? এ বাসায় থাকতে কিছু হয়েছে?
-না না। আমার সামনে ওরা দুইজন কথা ও বলেনি। এই যে বাসায় আমরা তিনজন ছিলাম, কোনোকিছুই এমন দেখিনি। তবে তিন্নি নীরবের রুমে যেতে চেয়েছে। কিন্তু নীরব ঘরে ঢুকতেই দেয়নি। বেশিরভাগ সময়ই দরজা আঁটকে থেকেছে বা বাইরে কাটিয়েছে। এমনকি খাবার ও ঘরে নিয়ে খেয়েছে। আর গ্রামে যেয়ে দেখলাম ছাঁদে। ছি ছি। তবে যা হওয়ার ওখানে যেয়েই। আর তিন্নি এখানে না থাকলে নীরবের চোখে আলাদা করে পরতো ও না।
মায়ের কথা শুনে কি বলব ভাষা খুজে পাচ্ছি না। নিজেকেই জবাব দেওয়ার কিছু নেই।
-এই যুগ হলো কলিযুগ। কি কি করে। বাবা নিজের ছেলের কাজ নিজপ দেখা লাগলো। আর মেয়ে ও তো ছোট। বিয়ে করিয়ে আনা যাবে না। আরো তিন চার বছর যাক ভেবে দেখা যাবে।
মায়ের কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। মা এত ফ্রাংকলি কি করে বলে দিলো। আবার মেনেও নিচ্ছে। মন খুশিতে ভরে গেলো। মাকে জড়িয়ে ধরলাম। ভাবতেই পারছি না সবটা কি করে কি হলো।
-তিন্নি টা তোর মতোই ভীষন তাড়াতাড়ি মিলে যায়। রেখে গিয়ে ভালো করেছিলি একদিক থেকে। তোকে না জেনে শুনে ভুল ধারণায় ছিলাম। এখানে তিন্নি আর নীরবের বেলায় এমন হবে না। অবশ্য তোদের বাড়ির মেয়ে, এমন তো হতেই হতো।
একগাল হেসে দিলাম। মায়ের করা ইশারায়, কোলে শুয়ে পরেছি। মা চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। বুঝেছি মায়ের অভিমান ভেঙে গেছে। তারপর বললেন,
-কিন্তু শোন বিয়ের আগে যেন এসব আর কিছু না করে। ভুল করার বয়স। বোন ও তুই, ভাবী ও তুই। দুইজনকেই বুঝিয়ে দিস।
মায়ের সামনে লজ্জা পেলাম আমি। কেমন যেন লাগছে।
-নীরবকে নিয়ে অনেক চিন্তায় ছিলাম। নিজের মন পরিবর্তন করেছে। এখন চিন্তা মুক্ত।
-পরিবর্তন? কি হয়েছিল নীরবের?
মা জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বলা শুরু করলেন,
-ছোট থেকেই ও অনেক চুপচাপ। পড়ালেখায় তেমন মন ছিলো না। আবার বাহিরে ঘোরাঘুরি ও করতো না। সেখানে নিবিড়ের পুরোই উল্টো। নিবিড় ভীষন দুষ্ট ছিল। আমাকে অতিষ্ঠ করে রাখতো সবসময়। ওর বাবার কলেজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র কত যে নষ্ট করেছে। কিন্তু আবার পড়ালেখায় খুব ভালো। ছোট থেকে সব ক্লাসে ফার্স্ট হবেই। তাই ওর বাবার কাছেও অনেক আদরের ছিলো। দুষ্টামি করলেও মায়ের নেওটা ছিলো। সারাদিন একটু পর পর মা মা বলে ডাকতো। ভালোবাসা এমনি বেশি কেড়ে নিতো। মা বাবা সব সন্তানকেই জান দিয়ে ভালোবাসে। কিন্তু তার মাঝে যে ভালোবাসা কেড়ে নিতে জানে তার প্রতি ভালোবাসা দেখানো ও বেশি হয়। মা হচ্ছিস তো বুঝতে পারবি। তা বলছিলাম নীরবের কথা। অমন শান্ত ছিল বলে ওর বাবা থেকেও দূরেই থাকতো বেশি। নীরবের কিছু লাগবে কিনা ওদের বাবা আমায় জিজ্ঞেস করত। আর নিবিড় নিজেই বাবার কাছে বসে গল্প করতো। কি কি লাগবে ছেলের নিজেই বুঝে কিনে দিতো।
-নিবিড় আর নীরবের মাঝে পার্থক্য অনেক জানি। কিন্তু বাবা আর তোমার সাথে সম্পর্ক এত ভিন্ন? মা, নীরব তো কলেজে সেরা ছিল। বোর্ডে স্ট্যান্ড করেছিল।
-সেটাই বলছি। স্কুল পর্যন্ত এইভাবেই কেটে গেল। তারপর তোর শ্বশুর একদিন নীরবকে ডেকে বলল এভাবে পড়লে উনার চাকরিকৃত কলেজে পড়তে পারবে না। শহরের সেরা কলেজের প্রফেসর হয়েও নিজের ছেলেকে অন্য কলেজে পড়াতে তিনি নারাজ। তারপর কি হলো কে জানে এসএসসি পরীক্ষার আগে তিন চার মাস ওকে পড়তে দেখতাম। যদিও আমি জানি ও বইয়ের সাথেই বেশি সময় কাটায়। কিন্তু তখনের ব্যাপার একটু ভিন্ন। পড়তে পড়তে টেবিলে ঘুমিয়ে যেত। খাবার সামনে তুলে না দিলে পড়া থেকে উঠে খেতো না। এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্ট বেরুলো। মোট নম্বর থেকে মাত্র ৫৬ নম্বর কম। আমাকে আর ওর বাবাকে অবাক করে দিলো। তারপর কলেজে ভালো রেজাল্ট, এইচএসসি তে বোর্ড স্ট্যান্ড। তারপর ভালো ভার্সিটিতে প্রথম সারির সাবজেক্ট। যা নিবিড় থেকেও অনেক ভালো। তারপরে তোর বাবার কাছে একটা আলাদা স্নেহ পাওয়া শুরু করলো। কিন্তু নিবিড় তাও চোখের মনি। নীরব আর নিবিড়ের কখনোই বনিবনা ছিল না। কিন্তু কখনো ঝগড়াও হত না। নীরব নিবিড়কে বরাবরই ভয় পেতো। কোনো জিনিস নিয়ে কেউ কারো সাথে লাগতে যেতো না। এখানেও নিবিড় নিজের বেশিরভাগ কিছু নীরবকে দিয়ে দিতো। ওদের বাবা নিবিড় এর জন্য সব নিজে থেকে আনতো, কিন্তু নিবিড় নীরবকে ছাড়া তা কখনো ব্যবহার করেনি। আমি মা বলে শুধু আমার নজরেই তা পরতো। আর আজ তুই জানলি। কিন্তু হটাৎ..
বলে মা থামলেন। কি যেন ভাবছেন। উঠে বসলাম মায়ের কোল ছেড়ে। তারপর মা নিজেই বললেন,
-কি হয়ে গেল আমার দুই ছেলের জানি না। তোদের বিয়ের ডেট ফাইনাল হওয়ার পাঁচ ছয়দিন পর প্রথম দেখলাম নিবিড় আর নীরবকে ঝগড়া করতে। নীরব বড় ভাইয়ের দিকে চোখ তুলে কথা বলতো না সে নিবিড়ের রুমে যেয়ে চিৎকার চেচামেচি করছে। আমি দৌড়ে ওই রুমে ঢোকা মাত্র চুপ হয়ে গেল। নিবিড় নিজের খাটে বসে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নীরবের হটাৎ থেমে যাওয়া দেখে উপর দিকে তাকাতেই আমায় দেখতে পেল। নীরব আমার পাশ কাটিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। ছেলেরা এখন বড়। আমাকে জানাতে চাচ্ছে না। তাই আমিও জোর করে জানতে চাইলাম না। তোদের হলুদের রাতেও সেই একই ঘটনা। নীরব নিবিড়ের সাথে এমন ব্যবহার করছে। কিন্তু এবার নিবিড় থেমে থাকলো না। নীরবকে বলল “যা আমার তা আমারই থাকবে। তুই ছোট ভাই তোর সকল আবদার আমি পূরন করব। কিন্তু আবদার চিন্তা ভাবনা করে করতে হবে”।
-কি চেয়েছিল নীরব?
-হ্যা জেনেছি কিছুদিন আগে। বলছি সবটা। তারপর হয় ফয়সাল শশীর হলুদের দিন। তুই জ্ঞান হারিয়ে ফেলিস ওই সময় রুমে কেমন হয়েছিল পরিবেশ তা তো নিজের চোখে দেখেছিলি। ওইখানে থেমে গেলেও ওইদিন বাসায় ফিরে ওদের বাবা সামনেই। যেন ওরা তোয়াক্কা করলো না। ওইদিন অবশ্য রুশমি নিয়ে বাঁধছিল। নীরব বার বার বলছিল তোর সামনে নিজের পুরোনো প্রেমকে এনেছে কেন। তুই ওর বন্ধু বলে তোর পক্ষে নিয়ে ঝগড়া করছিল। এই তিনদিন আমি ওদের ভিন্ন রুপ দেখেছি। নীরব অনেক পালটে গেছে। একরোখা জিদ্দি হয়ে উঠেছে। যা চাই তা চাই চাই। যেকোনো কিছুর মূল্যে। এমন এক জিনিস এখন চেয়ে বসেছে যা দেওয়া অসম্ভব। কিন্তু ভয় করছিল কি করে এই থেকে মুখ ফিরানো যায়। নয়ত অনর্থক হয়ে যেত। তিন্নির সাথে নীরবের সম্পর্ক জেনে এখন আমি নিশ্চিন্ত। এখন আমার ছেলে ভালো থাকবে।
-কি আবদার করেছিল নীরব?
-করেছিল। সবটা সবসময় জানতে নেই। পরিবারের সব তোকে জানানো আমার কর্তব্য। জানিয়েছি। বাকি যা আছে সময় তোকে জানাবে। তবে যদি না জানায় তবে ভেবে নিবি এতে মঙ্গল রয়েছে।
আমার অনেক রকম ভাবনা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। মায়ের কাছে আর কিছু জানা যাবে না। তবে যতটুকু জেনেছি একে একে সাজাচ্ছি। তবুও কিছুর গড়মিল রয়েই যায়। এত চিন্তা মাথায় নিলে আমাদের বাবুটা কষ্ট করবে। তার মাঝে বমি বমি পাচ্ছে। নিজের রুমে চলেছি। শান্তিতে কিছু ভাবা ও যায় না। নিবিড় এর মতই আমায় জ্বালাবে ওর সন্তান। দৌড়ে ওয়াশরুমে গেলাম।
ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে ফোন হাতে নিলাম। কয়টা বাজে তা জানার উদ্দেশ্য। দেখি নিবিড় এর তেইশ মিসকল। জানি এখন এই লোকের ঝারির হাত থেকে আমায় কেউ বাঁচাতে পারবে না। কাচ্চা গিলেও ফেললে অবাক হবো না। ভয়ে ভয়ে কল ব্যাক করব কি করব না ভাবছি আমার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া করে ফোনটা বেজে উঠল। কাঁপা কাঁপা হাতে ফোন রিসিভ করলাম। কানে ধরব তার আগেই এক মোক্ষম উপায় মনে পরে গেল। নারী মানেই প্রতিবাদী। পুরুষ শাসিত সমাজে রুখে দাঁড়াতে হবে নারীকে। জাগো নারী জাগো। আপাতত এই ভাব রেখেই নিবিড়কে হ্যালো বলতে দেওয়ার আগেই নিজে বললাম,
-কেন ফোন দিয়েছো? এতবার ফোন দিবে কেন? যদি ঘুমাতে থাকতাম? তোমার বাবু পেটে গুটলাতো, পরে আমার গা গুলিয়ে বমি হয়ে যেত। এখন বলো কেন ফোন দিয়েছো?
-তোমার এমনি এত রাগ। আমার বাবুটাকে তোমার মত চেয়েছি আর দেখো রাগটাও মায়ের মতোই পেয়েছে। দুইজনের রাগ এখন তোমার কাছে থেকে একসাথে পাচ্ছি। কি কপাল আমার?।
-অসভ্য একটা!
নিবিড় এর মৃদু হাসি আমার কানে আসছে। যাক বাবা উল্টো ঝেরে এই দফায় বেঁচে গেছি। কিন্তু ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। আর কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না। আমার না বলা কথা কি করে নিবিড় বুঝে যায় জানি না। কিন্তু মন পড়তে পারে আমি জানি। তাই বলে এত? টেলোপ্যাথিতে কি? কিন্তু না দেখেও বুঝে গেছে? এ বুঝি মনের টান। না হলে সন্তানের ক্লান্ত হয়ে যাওয়া ডিএনএ বুঝি সব জানিয়েছে।
-ঘুমাওনি না? পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে ডক্টর বলেছেন। ঘুম পেয়েছে মায়াবিনী? আমি গান শুনিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই। তারপর মিটিং এ যাবো। তুমি শোও।
চোখ বন্ধ করে ইয়ারফোন কানে দিয়ে শুয়ে পরলাম।
“নতুন ভোর উঠলো সুরে
দিল তোমার ঘুমকে তুলে
তখন আমি আলো হয়ে
ছুঁয়ে তোমার কপালে
ও চোখ খুলে আমায় দেখে
আলসেমিতে, খুব তুমি অভিমানে
কুয়াশা মেখে তোমার ঠোঁটে
লুকোচুরি খেলে গানে
ছেড়ে দিয়ে নাটাই সুতো
উড়াই ইচ্ছে ঘুড়ি
এঁকে দেই নীল আকাশে
শত ডানার প্রজাপতি
ছেড়ে দিয়ে নাটাই সুতো
উড়াই ইচ্ছে ঘুড়ি
এঁকে দেই নীল আকাশে
শত ডানার প্রজাপতি
প্রজাপতি… শত ডানার… প্রজাপতি
শত ডানার… প্রজাপতি
হো একটা দুপুর, রঙ্গিন সাজে
ডানা মেলে ওই বাতাসে
হারাবো আজ মেঘের ভাঁজে
দেখবো তোমায় নতুন সাজে
ও একটা দুপুর রঙ্গিন সাজে
ডানা মেলে ওই বাতাসে
হারাবো আজ মেঘের ভাঁজে
দেখবো তোমায় নতুন সাজে
ও চোখ খুলে আমায় দেখে
আলসেমিতে, খুব তুমি অভিমানে
কুয়াশা মেখে তোমার ঠোঁটে
লুকোচুরি খেলে গানে
ছেড়ে দিয়ে নাটাই সুতো
উড়াই ইচ্ছে ঘুড়ি
এঁকে দেই নীল আকাশে
শত ডানার প্রজাপতি
ছেড়ে দিয়ে নাটাই সুতো
উড়াই ইচ্ছে ঘুড়ি
এঁকে দেই নীল আকাশে
শত ডানার প্রজাপতি
শত ডানার প্রজাপতি”
(আরাফাত মহসিন)
-হ্যালো? মায়াবিনী?
ঘুমিয়ে গেছে মেয়েটা। আমার উপর রাগ দেখিয়ে দিলো অথচ নিজের দোষ কাটাতে এমন করেছে আমি কি তা জানি না? এত পাগলি আমার বউটা। খুব বড় বড় ভাব। কিন্তু এখনো ইমম্যাচিউর। তুমি যেমন আমার অমনই ভাল্লাগে। ভালোবাসি বউ। খুব ভালোবাসি। তুমি শুধু আমার থেকো। পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখ তোমায় এনে দিবো আমার বাবুর মা। কিন্তু ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পারছি না। তুমি আমায় ছেড়ে যাবে না তো সত্যি জানলে? বুক কেমন কেঁপে উঠলো। কিছু কি হবে? আর কিছু না বলে ফোন রেখে মিটিং এ চলে গেলাম।
ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। বেলা হয়ে গেছে। তিন্নির সাথে কথা বলার দরকার। খুশি খুশি মনে ফোন দিলাম তিন্নিকে। দুইবার বেজে কেটে গেল। খুব বিরক্ত হলাম। রাগে ফেটে যেতে ইচ্ছে করছে। মনে পরল নিবিড়ের আজ দেওয়া এত গুলো কলের কথা। এই ছেলেটার রাগ নেই নাকি? আছে। কেবল আমার বেলায় কেমন চুপ হয়ে যায়। আমার সব রাগ হাসিমুখে মেনে নিয়ে আমার অভিমান ভাঙায়। ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে ফোন বেজে উঠেছে। তিন্নি কল ব্যাক করেছে। ওকে আর কিছু বলতে দিলাম না। ভাববে বড় বোন বলে বকতে ফোন করেছি। তাই নিজেই গড়গড় করে সব বললাম। বিয়ের আগেই শাশুড়ী তোকে মেনে নিয়েছে। চুপ হয়ে গেলাম। মেয়েটা কথা বলছে না। কিন্তু শব্দ হচ্ছে। এটা কান্নার শব্দ। চাপা কান্না। চমকে উঠলাম। তারপর তিন্নি যা বলল তা শুনে শরীর হিম হয়ে গেল। ফোন রেখে নিজেকে বড় সুতি ওড়না দিয়ে পেঁচিয়ে নীরবকে খুঁজতে প্রায় দৌড়ে গেলাম ওর রুমে। না পেয়ে ছাঁদে গেলাম। অন্যকিছু বলার সময় পাইনি। নীরব নিজেই আমায় দেখা মাত্র যা বলল এখনো ডুবেই আছি ওই ভাবনায়।
চলবে………….
#তোমার_প্রেমে_মাতাল
#লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
#পর্ব_৩৯
আজকের দিনকে মন খারাপ দিবস হিসেবে ঘোষনা করা যায় কিন্তু বড় কোনো মাপের কিছু আমি নই। তাই আপাতত ওই চিন্তা থেকে সরে মন খারাপ কি করে ভালো করা যায় তা ভাবা যায়। রাত আটটা প্রায়। কিন্তু নিবিড় আসে নাই এখনো অফিস থেকে। এইসবই হয় আমার সাথে। আজকে ওকে খুব প্রয়োজন তার জন্যই দেরি করছে। বারান্দার দরজা খোলা। ওখানেও যাওয়া যাবে না। মায়ের কড়া নির্দেশ। সন্ধ্যা থেকে পরদিন ফজরের আগ পর্যন্ত যেন আমি বারান্দা না মাড়াই। এই বারান্দা লাগোয়া এক শিমুল গাছ আছে। বাসার ভিতরেই গাছটা। মা বহুবার কাটতে চেয়েছেন। কিন্তু নিবিড় এর জন্য পারে নাই। বাবা ও নিবিড় এর সাথে একমত। মায়ের মিছামিছি ভূতের ভয়ে এত সুন্দর এক গাছ কেটে ফেলার কোনো মানে আছে? যাইহোক আমাকে শিমুল গাছের ছায়া না মাড়াতে আদেশ করা হয়েছে নয়ত এই দফায় গাছকে কেউ মায়ের হাত থেকে বাঁচাতে পারবে না। মায়ের ধারণা এই গাছে এক পেত্নী থাকে যা এককালে নিবিড়কে নিজের কাছে নিয়ে যেতো প্রতিরাতে গাছে। তাই ভোর হওয়ার আগ পর্যন্ত সারারাত নিবিড় এর দরজা ধাক্কালেও সাড়া পেত না। এইদিকে আমি জানি মায়ের আদরের ছেলেকে পেত্নী নয় আমি ধরেছিলাম। রাতে আমার কাছে থাকতো। এবার নাকি আমার পেটে ওই পেত্নীর নজর লাগবে। ওসব কথা থাক এখন! আর এই শিমুল গাছের এক বড় ডাল আমাদের বারান্দা সামনে এমন ভাবে পরে, আমরা রাস্তা দেখতে পাই কিন্তু রাস্তার মানুষ বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নারী পুরুষ মূর্তি আলাদা বিবেচনা করতে পারে না। যাহা নিবিড়কে অফিসে থাকতে প্রশান্তিতে রাখে। এলাকার দুষ্ট ছেলেগুলো তার সুন্দরী বউকে দেখতে বাসার বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে না। অগত্যা এই আদেশ আমার কাছে শিরোধার্য।
আকাশ ছোয়া ভাবনা ভাবতেই নিবিড় এর ঘরে প্রবেশ। মন বড্ড খারাপ আমার। নিবিড় এসেই ল্যাপটপের ব্যাগটা সোফায় নামিয়ে ওয়াশরুমের চলে গেল। হাতমুখ ধুয়ে টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে আমার কাছে এসে দাড়িয়ে কপালে ঠোঁট স্পর্শ করলো। সবচেয়ে গভীর চুম্বন। একজন আরেকজনের হৃদয় স্পর্শ করতে পারে। আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে আসে আমার। নিবিড় যখন থেকে একা অফিস যাচ্ছে তখন থেকেই এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। যাওয়ার আগে এবং ফিরে এসেই কপালে ওর ঠোঁট ছোঁয়াবে। তারপর নিচে বসে আমার পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে আরেকটি। একটা আমায় একটা আমাদের বেবিকে। খিলখিলিয়ে হেসে উঠি প্রতিবার। ভীষণ সুড়সুড়ি আমার। কিন্তু আজ হাসলাম না। নিবিড় নিচে বসেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো।
-হাসি পেল না নাকি সুড়সুড়ি লাগেনি? মনে হয় আমার মায়াবিনীর অভ্যেস হয়ে গেছে।
কোনোকিছু না বলে নিবিড় এর চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। এমন কিছু কি আছে যা নিবিড় আমার থেকে লুকিয়ে গেছে। নিবিড় আমায় আজ ধরতে পারলো কিনা জানি না তবে জিজ্ঞেস করল,
-কি হয়েছে মায়াবিনী?
-তুমি কি কখনো আমার কাছে কিছু লুকিয়েছো যা আমার জানা দরকার ছিল?
নিবিড় এর কাছে আমার প্রশ্ন কেমন ছিল জানি না। তবে হকচকিয়ে গেল। নিজেকে কিছুটা আঁটকে তারপর বলল,
-এই কথা বলছো যে। কি লুকোবো?
-জানি না। তাই জিজ্ঞেস করছি।
নিবিড় উঠে দাঁড়িয়েছে। ঘড়ি দেখে বলছে অনেক বাজে খাবার নিয়ে আসবে আমার জন্য। নিবিড় এই বলে বের হতে নিবে আমি আবার বললাম,
-তুমি একদিন বলেছিলে যা কিছু হয় যেন তোমার কাছে না লুকাই।যেকোনো কিছু হোক তা যেন বলে দেই। আমার সত্যি জেনে হয়তোবা তুমি কষ্ট পাবে কিন্তু নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু লুকোনো কথা অন্য কারো দ্বারা জানলে তা ভুলতে পারবে না। সেদিন আমিও বলেছিলাম তোমার কাছেও আমি একইরকম আশা করতে পারি কিনা। তুমি বলেছিলে এমনটাই হবে। আজ আমার প্রশ্ন সবসময় এমনই হয়েছে তো নিবিড়?
নিবিড় দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে। পা বাড়ানোর আগে আমার কথা শুনে থমকে দাঁড়িয়ে গেছে। দরজার দিকে মুখ করে রেখেছে বলে ফেসিয়াল এক্সপ্রেশন কেমন হলো বলা গেল না। কিন্তু আমার কথার প্রতুত্তরে তিন শব্দের এক বাক্য আওড়িয়ে চলে গেল।
-খাবার নিয়ে আসছি।
নিবিড় এর চলে যাওয়া দেখলাম। মন খচখচ করে উঠলো। দম আঁটকে রেখে চোখ বুঁজে রইলাম কয়েক মুহূর্ত। তারপর জোরে নিশ্বাস ছেড়ে আশ্বস্ত করলাম কিছু হবে না। আদো কি সত্যি কিছু হবে না!
দুই-তিন দিন ধরে অদ্ভুত নিবিড়কে দেখছি। কথা কম বলছে আমার সাথে। কিন্তু আমার প্রতি খেয়ালের কোনো কমতি নেই। তবে আমি কিছু বলতে নিলেই এই ওই বলে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখেছি নয়ত কথা পাল্টে দিতে।
————————————-
-তিন্নি? কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে বোন? মা মেনে নিয়েছে তো। বল না। দেখ আমিও রেগে নেই। এই বয়স এমন হয় আমি জানি। তবে এমন আর কিছু না করলে তোর মায়াবী আপি বকবে না। কেন কাঁদছিস?
-মা..মায়া..বী.. মায়াবী আপি
কান্নার জন্য কথা ও বলতে পারছে না মেয়েটা। থামিয়ে দিলাম। খুব কষ্ট লাগছে। আমারই দম বন্ধ হয়ে আসছে। যেন মরা কান্না। এত জোরে চিৎকার করে ওর নাম ডেকে উঠলাম মেয়েটা কান্না থামিয়ে দিলো। এখন ভয় পাচ্ছে আমি বেশ বুঝতে পারছি। তারপর খানিকক্ষণ চুপ মেরে রইলাম। তারপর নিজেই বলতে লাগলো একে একে সব ঘটনা। আমি চুপচাপ কেবল শুনে গেলাম।
নীরব আর তিন্নির মাঝে আসলে কি ছিল তার নাম নিজেই জানে তিন্নি। তবে এই সময়ের আবেগ অনুভূতি বড্ড প্রকট। নীরবকে আসলেই ভালোবেসেছে তিন্নি। যেদিন নীরব ফিরে বাসায় বান্দরবান থেকে সেদিন থেকে খেয়াল করে নীরবের দিক থেকে কিছু আগ্রহ আছে। তার আগে কখনো তাকিয়েও দেখে নাই। ছেলেরা এমন ইগনোর করে জীবনে দেখা হয়নি তাই প্রেমটা জোড়ালো হয়ে উঠছিল তিন্নির। পুরুষমানুষের এত ব্যক্তিত্ব! কিন্তু মেয়ে বলে নিজে থেকে এগোতে পারছিল না। তবে মন যে উড়ো হাওয়ার মতো বারবার নীরবের গায়ে পরে যাচ্ছিল। দমকা হাওয়ার মতোই নীরব তাই বুঝি ধরা দিয়ে দিলো তিন্নির কাছে। ওই একটা দিন ছিল স্বপ্নের মতো তিন্নির কাছে। আমরা দাদাবাড়ী গেলাম কিন্তু তিন্নির এক বড় রকমের চাওয়ায় পূর্নতা পেল নীরবের সাথে থাকতে পারার। কিন্তু নীরব আবার আগের মত হয়ে গেল। এই তিন-চার দিন নীরব কথা পর্যন্ত বলল না। তিন্নি না পেরে একদিন রুমের বাইরে নক করে জানতে চায় বলে দেয় মা একা বাসায়। নোটিশ করলে খারাপ ভাববে তিন্নিকে। এই কথা শুনে মেয়ে আরো বেশি প্রেমে ডুবে পরে। প্রথম অনুরাগ। তারপর যেদিন দাদাবাড়ীতে গেল ওইদিন পুরো রাস্তা নীরব তিন্নির সাথে গল্প করে কাটিয়েছে। তবুও প্রেম নিবেদনটা করে উঠা হয় না। তারপর একটু একটু চোখে চোখে কথা। দুইজনের মনে এক অন্যরকম ভালোলাগা জানান দেয়। যা চোখে চোখে বিনিময় হয়ে যায়। এর গভীরতা বোঝা মুশকিল। মুখে বলার আর প্রয়োজন পরেনি কারো। তারপর পুকুরে পানি ছিটাছিটির মাঝে তিন্নিকে থামাতে নীরব ঝাপটে ধরে। তারপর কেমন কেমন এক অনুভুতি। প্রথম ছোঁয়া কোনো পুরুষের। এই সব ছোট ছোট ব্যাপার গুলো আমি দিব্যি বুঝছিলাম। একসময় আমিও এমন পার করেছি। তারপর তিন্নির মনে হয়েছে নীরবকে নিজেই জিজ্ঞেস করবে এ সম্পর্কের কি নাম। নামহীন অজ্ঞাতনামা কেন? উৎসের বিয়ের দিন ইশারায় ছাঁদে ডাকে নীরবকে। তারপর নিজেই জিজ্ঞেস করবে তখন নীরব ওর ঠোঁটে আঙ্গুল স্পর্শ করে চুপ করিয়ে দেয়। আবার সেই অনুভূতি। নিজেকে সপে দেওয়া যায় না ঠিকই কিন্তু বাধা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না। বোধবুদ্ধি লোপ পায়। তারপর কি হয়ে গেল, মা আর আমি দাঁড়িয়ে যাই। তিন্নির কথায় মনে পরেছে ওইদিনের কথা। নীরব ছাঁদে যাওয়ার আগে আমায় বলে যায় একটা কথা বলবে ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে, তাই উপরে যেতে। সাথে বলে খুব ক্ষুদা লেগেছে। কিছু নিয়ে যেতে তাড়াতাড়ি। আমি উপরে যেতে থাকি খাবার নিয়ে। আমায় পেছন থেকে ছোটচাচ্চি ডাকে একটা কাজে। মাকে সামনে দেখায় বলি উপরে নীরব আছে খাবার দিয়ে আসো। মা নিয়ে যেতে লাগেন তখন চাচ্ছি বলে কাজ হয়ে গেছে আমায় আর লাগবে না। তাই মায়ের পেছনে উপরে যাই। কি বলতে ডাকলো? আবার পুকুরের ঘটনা নিয়েও আমায় নীরবকে বলতে হবে বলে উপরে যাই। তারপর আবার তিন্নির কথায় মনোযোগ দেই। নীরব ওইদিন চলে আসার পর তিন্নি অনেকবার নীরবের সাথে কন্টাক্ট করার চেষ্টা করে কিন্তু নীরব রেসপন্স করে না। প্রায় পঁচিশদিন ধরে কোনো খোঁজ খবর রাখে নাই। মেয়েটি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এর মাঝেও তিন্নি কল করতেই থাকে শেষে কাল রাতে নীরব ফোন রিসিভ করে। বলে দেয় নীরবের মনে কখনো তিন্নির জন্য কোনো অনুভূতি ছিল না। তিন্নি এসব কথা মানে না। ভাবে নীরব চাপে পরে এসব বলছে। অনেক জোর করে তিন্নি। শেষে বলে যদি মিথ্যে হয় তবে পুকুরপাড় আর ছাঁদে এসব কি ছিল। তখন নীরব ভীষন রেগে যায়। রেগে গেলে নাকি মানুষ সত্যি বলে। নীরবের তাই হলো। রেগে নাকি বলছে সে আমায় ভালোবাসে। নিজের ভাবীকে কেউ ভালোবাসে? ব্যস আর কিছু বলতে পারে নাই। কেঁদে ফেলে। ওই কান্না থামার নয় আমি জানি। কোনো কিছুর বলার সামর্থ্য আমার নেই। তাই ফোন রেখে দেই।
এইদিকে আমি ভাবছি নীরবের কথা। সব ঘটনা সাজাই একে একে। তার মানে নীরব আমায় পরীক্ষা করছিল? আমি ঈর্ষান্বিত হই কিনা? এ কেমন বোকা ছেলে। আমি কেন ওকে আর তিন্নি একসাথে দেখে ঈর্ষা বোধ করবো? নীরব আমার বন্ধু। খুব খুব ভালো বন্ধু। যে আমায় একদিন মৃত্যুর মুখ থেকে বাঁচিয়ে এনে ছিল। না না। এসব ভুল। নীরবের মনে এসব কিছুই নেই। নিশ্চয়ই মজা করছে সবার সাথে। দৌড়ে ছুটে গেছিলাম নীরবের কাছে। যখন বলল আট বছরের প্রেম আমি। আমি বিশ্বাস করিনি। আরো বলছিল,
-বিশ্বাস করো না তো আমায়? যেয়ে নিজের স্বামীকে জিজ্ঞেস করো। সব জেনে যাবে। আমার বিশ্বাসঘাতক ভাই আমার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। শুধু কি আমাকে? তোমাকেও অন্ধকারে রেখে আমার কাছে থেকে তোমায় কেড়ে নিয়েছে।
ঠাসস!
নীরবের বলতে দেরি হয়েছে ওর গালে কর্নপাতে আমার থাপ্পড় মারতে দেরি হয়নি। ওর দিকপ ঘৃন্য দৃষ্টি দিয়ে নিচে নেমে চলে আসি। এরপর আর কথা হয়নি নীরবের সাথে। নিবিড়কে আমি সন্দেহ করি না। কিন্তু ওর এড়িয়ে যাওয়াটা প্রতিবার আলাদা করে আমার মনে নতুন ভয় এসে জমা হচ্ছে।
——————————–
-আমি তোমাকে বলতে নিশ্চয়ই বাধ্য নই।
আকাশ থেকে পরলাম নাকি মাটির ভেদ সরে গিয়ে আমায় শূন্যে ভাসিয়ে দিলো তা বোঝা মুশকিল। শুধু নিবিড় এর মুখপানে চেয়ে রইলাম। এই ছেলে আদো আমায় ভালোবাসে তো?
পাঁচ ছয়দিন ধরে নিবিড় এর এমন আমায় এড়িয়ে যেতে দেখে অনেক কিছুই নতুন করে ভাবায়। তারপর খেয়াল আসে রুশমির কথা। ওকে বাংলাদেশে কে সাহায্য করেছিল। আমার এক বান্ধবীর হাসবেন্ড আইটি বিভাগে জব করে। বান্ধবীকে বলে এই ওর হাসবেন্ডকে দিয়ে কাজটা করিয়ে দিলো৷ ওদের বিয়ে পালিয়ে হয়েছে। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড হওয়ার আমি ওইবার অনেক সাহায্য করি। তাই আমার এই কাজ ভাইয়া নিজ দায়িত্বে করে দিলো। এই সামান্য কাজ তার জন্য ব্যাপার না। ফোন দিয়ে বাকি সব তথ্য আমায় নিজেই জানিয়ে দিলো ভাইয়া। আরো বললেন,
-মায়াবী তোমার যা যখন আমাকে বলবে। শালীর জন্য এইটুক করা কোনো ব্যাপার না।
যাহোক পেয়ে গেলাম সব তথ্য। যা সন্দেহ করেছি তাই। নীরবের বায়োডাটাতে এই সিম কেনা।
রুশমিকে নীরব বাংলাদেশে আনে। তার আগে মনে পরলো নীরবের কথা যা আমায় আমার হলুদের রাতে বলেছিল। সবার সামনে নীরব আমার গালে হলুদ মাখিয়ে দেয়। লজ্জা মাখানো এক হাসি দিয়েছিলাম। বন্ধুর সাথে অনেকদিন পর দেখা। আবার আমি তারই ভাইয়ের বউ হচ্ছি। তাই এমন লাগছিল। নীরবকে হলুদ দিয়ে পাঠানো হয়েছে আমাদের বাসায়। ছাদে পেন্ডাল করে হলুদের আয়োজন করা হয়েছে। আমি তখন স্টেজে বসে আছি। নীরব সামনে এসে দাড়িয়ে হলুদ লাগিয়ে দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি ওর দিকে মুখ তুলে হাসিমুখে তাকাতেই নীরব বলে,
“এই হাসি যার বরাদ্দে তাকে তুমি জীবনে পাবে। একটা মানুষকে অন্ধ বিশ্বাস করতে নেই। প্রাক্তন জীবনে চলে আসতে পারে।”
নীরবের এই কথার মানে আমি আগে না বুঝলেও আজ বুঝেছি। ও ইচ্ছে করে সব বিষিয়ে দিতে চেয়েছিল আমার মনে নিবিড় এর প্রতি। বিয়ের পর থেকেই একে একে এত কিছু হয়েছে। হসপিটালে আমাকে নিয়ে যাওয়া। সব ওর প্ল্যানে ছিল। রুশমিকে এনে নিবিড়কে ব্যস্ত করে দিয়েছিল। আর আমার সাথে সেই পুরোনো বন্ধুত্বের সুযোগ নিয়ে কাছাকাছি থেকেছে। এখানে আসলেই নিবিড় এর একবিন্দু পরিমাণ দোষ ছিল না। কিন্তু পরে আকরাম ভাইকে কেন নিজেই ফোন করে আসতে বলল? তাহলে তিন্নিকেই বা কেন জোড়ালো?
এসব জানতে হবে আমার। তবে তার আগে নিবিড় এর সাথে কথা বলা জরুরি। তাই সন্ধ্যাতে যখন বাসায় ফিরলো। জিগ্যেস করেছিলাম ওই অপরিচিত নাম্বার কি নিবিড় চিনত কিনা। নিবিড় কিছু না বলে চুপ করে রইলো। তারপর নিজেই বললাম ওইটা নীরবের নম্বর ছিল। মানে রুশমিকে এখানে নীরব এনেছে। নিবিড় এর কোনো প্রকার ভাবাক্রান্ত হলো না। চুপ করে থেকে নিজেই উল্টো প্রশ্ন করল,
-তুমি কি করে জানলে?
অবাক তখন আমি হলাম। এই ছেলে কি পাগল নাকি? কিছু বললাম না আর। চুপ করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম,
-সেটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ নয়। তুমি জানতে ওইটা নীরবের নাম্বার ছিল। কিন্তু বলো নাই কেন আমায়? আর নীরবকে এই নিয়ে কিছুই বলো নাই?
এইসব বলে অনেকবার ফোর্স করতে লাগালাম। নিবিড় কোনো কথা বলছিল না। খাটে বসে মাথা নিচু করে রয়েছে। সহ্যের বাঁধ ওর ভেঙে গেল। দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল আমায় সব বলতে নাকি ও বাধ্য না। আমার কষ্টে বুক ব্যথা করা উচিত। কিন্তু এমন কিছু হলো না। মনে হচ্ছিল এক প্রবাদের কথা, “চোরের মায়ের বড় গলা”।
————————
নিবিড় আমায় আট বছর আগে কি হয়েছিল তা বলল না। কিন্তু নিজের করা একটা অন্যায় স্বীকার করে নিলো। ভাবতেই পারছিলাম না নিবিড় এমন কোনো কাজ করতে পারে। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। মনে পরলো আমার কলেজের র্যাগ ডে এর কথা। হ্যা দীর্ঘ একমাস পর কি করে আমায় পেয়েছিল নিবিড়? পেয়েছিল বা কি করে? হটাৎ রাস্তায় দেখা এমন নয় তো। সোজা আমার কলেজে উপস্থিত ছিল। এমন কি ওইদিন কলেজ বন্ধ ছিল। শুধু র্যাগ ডে এর জন্য কিছু টিচাররা ছিল। নিবিড় কি করে জেনেছিল আমি এইচএসসি পরীক্ষার্থী। কিছুই হিসেব মিলচ্ছিল না। নিবিড় বাসা থেকে বের হয়ে যায় আমার সাথে সন্ধ্যার সময়ের কথা কাটাকাটিতে। রাত বেশ অনেক নিবিড় বাসায় ফেরে না। আজ রাতে নিজেই বারান্দায় যাই। খোলা হাওয়া দরকার। নয়ত দম বন্ধ হয়ে মরে যেতাম। বারান্দায় আসতেই দেখি শিমুল তলায় যে বেঞ্চ পাতা ওখানে বসে আছে। আমার প্রশ্নের উত্তর চাই চাই। নিচে নেমে নিবিড় এর পাশে বসি। জানি ও খেয়াল করেছে। কিন্তু আমায় তাকিয়ে দেখে নাই। দুইজনই চুপ করে বসে আছি। কতক্ষণ নীরবতায় ছিলাম জানি না। কিন্তু মন হচ্ছিল অনন্তকাল অপেক্ষা করছি নিবিড় এর মুখে সত্যি শুনবো বলে। শেষে নিবিড় বলা শুরু করলো,
-তোমার আমি কি করে খুঁজে পেয়েছি আজও বলিনি। বলেছিলাম বাসররাতে বলে দিবো সত্যিটা। কিন্তু সময়ের বাস্তবতা এখানে আমায় নিয়ে খেলেছে। আমি যেমন পাঁচবছর আগে কঠিন সত্যকে মাটি চাপা দিয়ে নিজের জীবনকে সামনে রাখি। এতে অন্যের ক্ষতি চোখে পরেনি। জীবনে এত বড় অন্যায় আমি করব তা ওইরাতের আগে জানতাম ও না। কিন্তু করে ফেলেছিলাম। অন্যায় তো অন্যায়ই হয়। বাসররাতে সব স্বীকার করা আমার হলো না। সময় নিজে জিতে আমায় তখন হারিয়ে দিলো। ওইদিন জানালে ক্ষমা পেতে পারতাম। আজ আর ক্ষমা করবে না তুমি আমায় মায়াবিনী। ক্ষমা চাওয়ার মত মুখ ও আমার নেই। অনেক নিচে নেমে গেছি। তাও আজ সত্যি বলার সময় এসে গেছে। বলতে আমায় হবেই। আমি সত্যি ছোট ভাইএর প্রেম ছিনিয়ে নিয়েছি……
চলবে……