তোমার_প্রেমে_মাতাল,পর্ব_32+33
লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
পর্ব_32
একটানা বেশ ধকল গেছে আমার উপর দিয়ে প্রেগ্ন্যাসি অবস্থায়। এতটা সত্যি নেওয়া যায় না বোধহয়। বিয়ের মাত্র দেড় মাস। সবে ১ মাস ১৬ দিন চলছে আর কি। তার মাঝে সবদিন যে কাজ করেছি তার ফলাফল শরীর কেমন যেন করছে। মাথাও ঝিমঝিম করে জানান দিচ্ছে মায়াবী ভালো নেই মোটেও ভালো নেই। কথাটা এতো স্পষ্ট কেন? না না এ তো আমার মন বা আমার মাথা বলছে না। অন্য কেউ বলছে। চটজলদি চোখ খুললাম। মা আমার দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে যেন চোখ দিয়ে গিলে খাবে। হটাৎ মনে হলো আমাদের বেডরুমে মা কেন? আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম আমি আমাদের রুমের বিছানায় শুয়ে আছি। মা আমার পাশে বসে। বাবার সাথেই ফোনে কথা বলছিল। সেখানেই বলেছে মা,
“মায়াবী ভালো নেই, মোটেও ভালো নেই। তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাসায় আসো।”
মা হটাৎ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-মায়াবী তুই প্রেগন্যান্ট আগে বলিসনি কেন? আড়াই মাস চলছে বলে?
ভ্যাবাচেকা খাচ্ছি রীতিমতো।
মনে করার চেষ্টা করছি এ অবস্থায় কি করে পৌঁছালাম। কাল রাতে থেকে কয়েকবার বমি করেছি। ইদানীং বমি হয়। তবে কাল রাতে অনেক বেশি হয়েছে। নিবিড় ভাবছে আমার ফুডপয়জনিং হয়েছে। বলদ একটা! সকালে নাস্তা খাওয়ার পর তাই নিবিড় আমায় অফিস নেয়নি। এত খেয়াল রাখিস, বউ যে মা হতে চলেছে তা চোখে পরেনি?? ওর ও বা কি দোষ। নিবিড় ও তো প্রথম বাবা হচ্ছে। বউয়ের এসব উপসর্গ কি করে বুঝবে? পরের বার যখন আমাদের বাবুর ভাইবোন আসবে তখনের বেলায় ঠিক বুঝবে। এই সাতদিন যে ঝামেলায় ছিলাম নিবিড়কে এখন ও সারপ্রাইজ দিতে পারেনি। বাসায় আমি, খালা আর মা ছিলাম। সোফায় বসেছিলাম। মাথা ভীষন ঘোরাচ্ছিল। কখন পরে গেলাম? কখন জ্ঞান হারালাম জানিনা। অজ্ঞান হয়েছিলাম তখন নিবিড় দের ফ্যামিলি ডক্টর আমাকে চেকাপ করতে আসছিল। তিনি বলে গেছেন,
-মেয়েটা তো প্রেগন্যান্ট। এ অবস্থায় এমন হয়। ওকে সাবধানে থাকতে বলেছিলাম। কিছু প্রবলেম আছে। মেয়েটার অনেক কেয়ার নিতে হবে। আড়াই মাস হয়ে গেছে বেবি বাম্প ও হয়নি একটুকুও। খাওয়া দাওয়া ঠিক মতো করাতে হবে।
বলে বেরিয়ে গেছে।
এখন নিজের রুমে শুয়ে আছি। মা ভীষন রাগারাগি করছেন। বাসায় সবাইকে আসতে বলেছেন। সবাই মানে নিবিড় বাবা এমনকি আমার বাসার সবাইকেই। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মা দাদু হচ্ছেন এই খুশি না হয়ে চিৎকার চেচামেচি করছেন। বিয়ে দেড় মাস, আর ছেলের বউ প্রেগন্যান্ট আড়াই মাসের। এইটাই চলছে। মাকে কোনোভাবে থামাতে পারছি না।
আজকে নিবিড় আসুক সবার সামনে ওকে ক্ষমা চাইতে হবে। ক্ষমা চাইলেই বা কি? আমি কোনোদিন ও ওকে ক্ষমা করব না। মায়াবী তুই মা হতে চলেছিস তাও বলিসনি কেন আগে? বিয়ের আগে এমন বলেই লুকাচ্ছাছিলি। এমন আরো অনেক কিছু বলছে। আমি শেষে না পেরে মাটিতে বসে পড়লাম। এই শরীর নিয়ে আর পারছি না। কেঁদে ফেললাম। এ যন্ত্রণা সহ্য করেছি নিবিড় এর সাথে থাকার জন্য। এখন সবার সামনে এত কিছু হলে অনেক খারাপ হয়ে যাবে। নিবিড় আর কখনো কারো সামনে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবে না। কেদে একাকার করে ফেলছি। মা এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। মাথা উঁচু করে তাকিয়ে দেখলাম মাকে।
-তুই এখনো আমার ছেলের জন্য কাঁদছিস? ও যে কাজটা করেছে আমি কখনোই ক্ষমা করবো না। সেখানে তুই এটা সহ্য করেছিস।
-মা তুমি তো সব জানতে। কেন এমন লজ্জা দিবে আমায় সবার সামনে। নিবিড় অনেক ছোট হয়ে যাবে মা। এমনটা করো না তুমি।
মা নিচে বসে পড়ল আমার সামনে। আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল মা,
-কি দিয়ে তৈরী করেছে সৃষ্টিকর্তা তোকে?
-মা দয়া করো।(মায়ের পায়ে হাত দিয়ে বললাম)
মা পায়ে থেকে হাত সরিয়ে আমার চোখের পানি মুছিয়ে দিলো।
-তুই কি ভাবছিস মায়াবী? আমি ভাবছি আমার দাদুভাই বা দিদিভাই যেই আসুক সে যে তোদের বিয়ের আগের। এ সন্তান যে অপবি……
মাকে থামিয়ে দিলাম। এ কথা শুনবো আমি কি করে। আমিও যে মা হতে চলছি। অনাচার হয়ে যাবে এ শুনলে।
-না মা! এ বলো না। আমার এই সন্তান পবিত্র।
-মানে?
-মা আমাদের বিয়ে হয়েছে আরো দুইবছর আগে।
মা অবিশ্বাসের চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। ভাবছে নিবিড়কে বাঁচাতে এমন বলছি। তাই আমাকে বুঝিয়ে সবটা বলতে হবে। মাকে নিয়ে ঘরে গিয়ে বিছানায় বসালাম। বিয়ে কবে কিভাবে করেছি বলতে লাগলাম।
———————-
রুশমি আপুর হাসবেন্ড আমাদের বাসায় এসেছিল সাতদিন। আজকে রাতে ফ্লাইটে চলে গেছে আকরাম ভাই আর রুশমি আপু। আমি তো দেখাশোনা করেছি। আকরাম ভাইকে আমি ইচ্ছে করে যেতে দেয়নি। রুশমি আর ভাইয়ার সম্পর্কের ভীষণ অবনতি ছিল। আমি যদি তাদের এক হতে সাহায্য না করি তবে কে করবে? আকরাম ভাইয়ের যে আমি একমাত্র বোন হই। আমি ছাড়া আর কে করবে?
নিবিড় সত্যি মানিয়ে ফেলেছিল আকরাম ভাইয়ের সাথে। পরের দিন আকরাম সকাল সকাল চলে এসেছিল। এই সাতদিন আমি আর নিবিড় অনেককিছু করেছি। আমাদের নিজেদের জন্য না। পুরোনো একটা সংসার জোরা দিয়েছি যা ঠুনকো একটা কারনে ভেঙে গেছিল। আমি অনেক কাজ করেছি। রুশমি আপু প্রথমে আকরাম ভাইকে দেখে তাকিয়ে ছিল। কেউ কারো সাথে কথা বলেনি। শুধু দেখে গেছে একে অপরকে। নিবিড় সত্যি এসব দেখতে বা ওদের জন্য কিছু করতে চাইছিল না। কিন্তু যখন দেখল ওদের মাঝে প্রেম আছে কিন্তু বাস্তবতার টানাপোড়েনে তা আড়ালে চলে গেছে। নিবিড় হয়তো আমাদের সম্পর্ক দিয়ে তুলানা করেছে। আমাদের যত গভীর ভালোবাসা সবার হয়তো এমন হয়না। কিন্তু প্রেম ভালোবাসা থাকেই। আমরা একে অপরকে ভুল বুঝিনি। কিন্তু তাই বলে অন্য দম্পতি এমনই হবে। রুশমি আর আকরাম ভাইয়ের মাঝে যে দেয়াল সে দেয়াল আমাকে আর নিবিড়কে ভাঙতে হবে। নিবিড় এখন আমার পাশে। ও জোর করেই আকরাম ভাইকে এ বাসায় থাকতে বলল।
এই সাতদিনে রুশমি আপু আর আকরাম ভাইয়ের মাঝে সব ঠিক হয়ে গেল। গেস্টরুমকে আমি আর নিবিড় একরাতে ফুল দিয়ে সাজিয়েও দিয়েছি। বলেছি নতুন করে সবটা সাজাতে। হাসি মুখে আকরাম ভাই রুমে গিয়েছে। রুশমি আপু নতুন বউয়ের মতো লজ্জায় লাল হয়েছে। দুইটা বাচ্চা একসাথে দত্তক ও নিয়েছে ওরা। একটা মেয়ে একটা ছেলে। এবোর্ড নিয়ে যাবে ওদের। সব কাগজ রেডি করে দিল নিবিড়। সে কি আনন্দ আমার ওদের দেখে। সত্যি পুরো সুখী পরিবার ওদের। কল্পনা করলাম এ তো আমার আর নিবিড় এর ও হবে খুব শীঘ্রই। মা বাবা ও আর রাগ করেনি। হাসি মুখে রুশমিকে সাদরে গ্রহণ করেছে। মনে হচ্ছিল মা এখন নিশ্চিন্ত। তার ছেলে আর ছেলের বউয়ের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে তো রুশমি নেই তাই হয়তোবা।
রুশমি আপু আর আকরাম ভাই বাচ্চাদের নিয়ে চলে গেল। আমরা এয়ারপোর্টে গেলাম ওদের তুলে দিতে। অবশ্য কে রুশমিকে হেল্প করেছে তা জানা হয়নি। কারন ওদের মিলনে এত ব্যস্ত ছিলাম। এসব নিয়ে কেউ কথা তুলিনি। যা সমস্যা ছিল তা মিটে গেছে। এখন ওসব ভেবে কি হবে। রুশমি আমায় যাওয়ার আগে জড়িয়ে ধরে অনেক কিছু বলেছে। ক্ষমা ও চেয়েছে আমার কাছে অনেকবার। আসলেই রাগ নেই আমার ওনার উপর। একটা মহিলা কত হেল্পলেস হলে এমন করে আমি বুঝি। মাতৃত্বের সাধ কে না পেতে চায়। আমিও রুশমিকে ভালোবেসে জড়িয়ে নিয়েছি। আকরাম ভাই এর বউ বলে কথা। ব্যস আনন্দেই কেটেছে আমাদের এ কয়েকটা দিন। সময় মিলেনি নিজের স্বামীকে শুধু আলাদা সময় দেওয়ার। এই তো আজ রাতেই চলে গেল। কালকেই সারপ্রাইজ দিবো। আজকে ভীষণ বমি হচ্ছে। অনেক কাজ করেছি একটানা তাই হয়ত।
-আমি নিজেকে শুধরে নিয়েছি, নিজের ভুল বুঝতে পেরেছি তুমিও খুব তাড়াতাড়ি নিজের ভুল বুঝবে। এখন আমার কথা ভাল্লাগে না। যখন একটা গুড নিউজ শুনবে তখন ভুল ভাঙবে। আমি আর জানালাম না। নিজেই জানবে আমি যাওয়ার পরপরই নিশ্চয়ই। বাই ডিয়ার! ”
রুশমি ফোনে এই কথাটা বলে ফোন টা অফ করে দিল। হাসবেন্ড আর বাচ্চাদের নিয়ে ফ্লাইটে যে উঠবে।
——————————————
আমার তখন সবে বিএসসি ফাইনাল এক্সাম কমপ্লিট হয়েছে। রেজাল্ট ও পাবলিস হয়নি। বাবা উঠে পরে লেগেছে আমায় বিয়ে দিবে বলে। এই দিকে নিবিড় দেশের বাহিরে গেছে বিজনেস এর একটা মিটিং এর জন্য। নিবিড় আমার জন্য তাড়াতাড়ি চলে এলো। কিন্তু আমি ওকে বারান্দা দিয়ে বাসায় ঢুকতে দেইনি। বলেছি যতদিন আমায় ওর বাসায় না তুলবে ততদিন একঘরে থাকা বন্ধ। এভাবে লুকিয়ে একসাথে আমরা থাকব না। বাসায় নিবিড় জানিয়েছে। কিন্তু নিবিড় এর মা কোনো ভাবেই মা মরা মেয়ে ঘরে তুলবেন না। বোন ও নেই। বাবা ভাই মানুষ করেছে। তার মানে আমি মেয়ে হিসেবে খুব একটা ভালো হবো না। ঘরনি হবো না। গুরুজনকে সম্মান করতে জানবো না। এমন আরো অনেক কিছু বলেছেন। নিবিড় এর বাবা আমায় চিনতেন। ছাত্রী হিসেবে উনার খুব পছন্দের আমি। কিন্তু বউয়ের সাথে পেরে উঠছিলেন না। নিবিড় ও জেদ ছাড়ছিল না। আমার বাবা ও রেগে গেলেন। যেখানে বিয়ে দিবে সেখানে ছেলের মা নারাজ আমায় নিতে। কি করে বাবা আমায় পাঠাবেন? বাবা জেদ ধরে এক ছেলের সাথে ১৫ দিনের মাঝে বিয়ে ঠিক করে ফেললেন। নিবিড় ভেঙে গেল। দৌড়ে এল আমার বাসায়। বাবার পায়ে পরে গেল, মায়ের ছবির কাছে বসে আমায় চাইলো। বাবা বড্ড কঠিন মানুষ। তাও নিবিড় এর আচরনে বাবা নরম হয়ে নিবিড়কে উঠিয়ে মাথায় হাত দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওর মা আমায় নিতে আসলে নিশ্চয়ই মেয়েকে দিয়ে দিবেন। মা মরা মেয়েকে শাশুড়ীর চোখের কাটা বানাতে চায় না বাবা।
আমার বিয়ের তখন ১৫দিন বাকি মাত্র। নিবিড় এর মা এখনো রাজি হয়নি। নিবিড় বাসায় ভাঙচুর করছে। না খেয়ে পাগলামি করছে। এইদিকে আমার সাথে দেখা করার পথ বন্ধ। আমি শেষে ভেবে নিলাম কি করব। নিবিড়কে ফোন দিয়ে দেখা করতে বললাম। ওর অফিস বন্ধ তখন সন্ধ্যা তাই। তাও আমি রিজাইন করব নিবিড় এর অফিসের জবটা। তাই অফিসেই দেখা করলাম। নিবিড় এর সাথে পালিয়ে যেতে চাইলাম। ছেলেটা আমায় এভাবেও নিবে না। বাবা ভাইকে কষ্ট দিয়ে আমায় নিয়ে ও নাকি সুখী হতে পারবে না। তাই কঠিন সিদ্ধান্তে আমি পৌঁছে গেছি। অফিসে ঢুকে সরাসরি ওর কেবিনে গেলাম। নিচে দারোয়ান মামা ছাড়া একটা মানুষ ও অফিসে নেই। কেবিনে যেয়ে দেখি এ কোন নিবিড়? ষোলদিনে এ কি হাল করেছে নিজের। চুল উসকো খুসকো। না খেয়ে শুকিয়ে গেছে। গাল মনে হয়ে ভেঙে গেছে।
-নিবিড়?
নিবিড় খানিকটা ছুটেই আমার কাছে এলো
-মায়াবিনী তুমি এসেছো? এতদিন কি করে দেখা না করে থাকতে পারলে? দেখো তোমার নিবিড় এর কি অবস্থা।
-দেখো আমি এসব বলতে আসিনি। দেখতেও আসিনি। একটা জিনিস দিতে এসেছি।
-কি দিতে এসেছো? কি জিনিস? (ভ্রুকুটি করে)
-রিজাইন লেটার।
-মায়াবিনী?
-আমি তোমায় আরো কিছু বলতেও এসেছি।
-কি বলতে চাও? তোমার সব শুনবো। বল কি বলতে চাও। কতদিন তোমার কথা শুনি না। কতদিন তোমায় দেখিনা মায়াবিনী। ওইদিন তোমার বাসায় গেলাম কাঁদা মুখখানা দেখেছিলাম। তোমায় ছুঁয়ে দেখতে পারি নাই। চোখের পানি মোছাতে পারিনি। অনেক মিস করেছি তোমায় প্রেম।
(এসব বলে নিবিড় আমায় জড়িয়ে ধরছিলো। বারবার গালে, কপালে, চোখে, নাকে সারা মুখখানায় অসংখ্য চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছিলো। ওর এই অবস্থা দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। চোখের পানি নিবিড় মুছিয়ে দিচ্ছে না। শুধু আমায় আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে আর দেখছে মন ভরে আমায়। আমি চুপ করে ছিলাম অনেকক্ষণ। হটাৎ বলে বসলাম যা বলতে এসেছি।
-I need divorce.
নিবিড় চমকে উঠলো।
-What are you saying?
-আমি যা বলছি তা তুমি শুনেছোই। আমার বিয়ে আর পনেরো দিন পর। তুমিও আমায় নিয়ে পালালে না। বিয়ে করেছো কাউকে বললে না আমার নাকি মান সম্মান যাবে। আমি নাকি ছোট হবো তোমায় মায়ের কাছে। তাই যেহেতু কেউ জানে নাই। না জানাই থাক। ডিভোর্স লেটার রেডি করো। এসে সাইন করে দিয়ে যাবো।
নিবিড় হা করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি ভেবেছিলাম নিবিড় রাগ করবে। কিন্তু এমন কিছু হলো না। উল্টো এমন একটা কথা বলে বসলো আমিই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম……………
চলবে……..
#তোমার_প্রেমে_মাতাল
#লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
#পর্ব_৩৩
বিধস্ত আমি খোলা জানালার পাশে বসে আছি। অগোছালো আমিকে নিজেকে আয়নায় দেখতে ইচ্ছে করছে না। এতক্ষণে নিশ্চয়ই চোখ ফুলে গেছে। কেমন দেখাচ্ছে আমায়? নিবিড় কি এই আমাকে চিনবে? আমার আজ এ দশা যে কেবল ওর জন্যই। ব্যথা করছে, ভীষণ ব্যথা করছে। শরীর বলছে আমায়, “আমি যে ব্যথা পেয়েছি তা তো ফুটে উঠেছে তুমি সবটা জুরে।” আর মন বলছে, “হ্যা আমারটা দেখা যাচ্ছে না বলে কি আমি ব্যথা পাইনি?”
দরজায় সেই ফেরার পর থেকে টোকা পরছে। খুলতে ইচ্ছে করছে না, এমনকি জবাব নিতেও মন চাচ্ছে না। খালা আর ভাবীপু ডাকছে আমি জানি। বাবা রাগ করছেন ভীষণ। চিৎকার করে বলছে, এইটাই নাকি আমার শেষবার বাইরে যাওয়া ছিল বিয়ের আগে। বলতে ইচ্ছে করছে আমি আর বাহিরে যেতেই চাই না। কোনোদিন ও না। কখনোই না। হটাৎ বাহিরে ভীষণ নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেল। ভালোই হলো এখন আবার নিজেকে সময় দিবো। কাঁদতে হবে যে……।
দরজায় কড়া নারাতে হুস ফিরল আমার। কান পেতে শোনলাম এ তো পরিচিত কন্ঠস্বর নয়। ওপাশ থেকে এক মহিলা কন্ঠে বলল,
-মায়াবী, আমি নিবিড়ের মা। দরজাটা একটু খোলো মা। খুব প্রয়োজনে ছুটে এসেছি। আমায় ফিরিয়ে দিয়ো না।
দরজা খোলা মাত্রই ঝড়ের বেগে সামনের মানুষকে ভিতরে ঢুকতে দিয়ে দরজা এঁটে দিলাম।
————————————–
আমি বাসায় ফিরে ভাবছিলাম নিবিড়ের কি হলো। নিবিড়ের কাছে ডিভোর্স চেয়ে মনে হয়েছিল রেগে যাবে। কিন্তু আমায় পুরো অবাক করে দিয়ে বলল ডিভোর্স পেপার রেডি করবে। এসে যেন সাইন করে যাই। চোখের পানি লুকিয়ে ওর সামনে থেকে চলে এসেছিলাম। দারোয়ান মামা আমায় পেছন থেকে অনেক ডেকেছিল। কিন্তু ভেজা চোখ আমি কি করে দেখাই!
তিনদিন ধরে নিবিড় এর সাথে কথা নেই। আমার বিয়ের ও আর ১২ দিন বাকি কেবল। সাজ সকাল থেকে ভাবীপু আমাকে খেতে বলছে। খাবো কি করে। মন যে ভালো নেই আমার। এ কয়দিন শরীর অনেক দূর্বল হয়ে গেছে আমার। তার চেয়েও বেশি ভয়ংকর হলো মন ভেঙে গেছে। নিবিড় হটাৎ ফোন করেছে? ও কি আমায় নিয়ে পালাতে চায়? সংসার করতে চায়? ফোন তাড়াতাড়ি রিসিভ করলাম,
-পনেরো মিনিট এর মাঝে অফিসে ঢুকতে পারবে?
-অফিস? আজ ফ্রাইডে নিবিড়।
-তুমি কি আসতে পারবে?
-ওকে আসছি।
নিবিড় দেখা করতে বলেছে তাতেই আমি খুশিতে আত্মহারা। কোথায় বলেছে সেটা বড় কথা নয়। হাতে ফোন নিয়ে বেরিয়ে এসেছি। অফিসের গেইট খোলা। সরাসরি নিবিড় এর কেবিনে চলে এলাম। যেয়ে দৌড়ে নিবিড়কে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছি।
-আমি জানতাম তুমি আমায় ছেড়ে থাকতে পারবে না নিবিড়।
-হ্যা কিন্তু তুমি তো পারবে। (বলে আমায় ওর থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনে ফিরলো)
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি নিবিড় এর দিকে।
-কি বলছো নিবিড়?
-কি চেয়েছিলে যেন? মুক্তি? ডিভোর্স? এনেছি পেপার। সাইন কর। তোমায় মুক্তি দিয়ে দেই।
-কি বলছো এইসব?
নিবিড় টেবিলের উপর থেকে আমায় একটা কাগজ দিল এগিয়ে সাথে কলম ও।
-নাও মায়াবিনী। তোমার মুক্তির দলিল।
হাতে নিয়ে দেখলাম ডিভোর্স লেটার। এই তিনদিন এইটা রেডি করতে সময় লেগেছে ওর? তাই কথা বলেনি। আর আমিও কত বোকা। ভেবেছিলাম আমায় নিয়ে সংসার বাধবে বলে ডেকেছে। আসলে ডেকেছে সংসার নয় সম্পর্ক ভাঙতে। কাঁদছি আমি। কিন্তু নিবিড় আমার চোখে চোখ রেখে তাকাচ্ছে না। আমার মুখপানে ও তাকাচ্ছে না। ছেলে আমাকে না নিজেকে আমার বাঁধন থেকে মুক্ত করতে চাচ্ছে। কলম আর কাগজ টা ওর হাত থেকে নিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পরলাম। সাইন করব এখন। তার আগে আবার ওর দিকে তাকালাম। উঁহু, আমাকে দেখতেই চাচ্ছে না।
মায়াবিনী তুমি এমন করো না আমার সাথে। আমি যে এ সইতে পারবো না। তাও কি সুন্দর আমায় বলে দিলে ডিভোর্স চাই তোমার। তোমাকে পেতে আমি এতকিছু করেছি। তোমার বাবার কাছে ভিক্ষা চেয়েছি তোমায়। উনি তবুও আমায় ফিরিয়ে দিয়েছেন। তুমি বলো এর বেশি আমি আর কি করতে পারতাম। আজ আমার মায়ের জন্য আমি তোমায় হারিয়ে ফেলব? থাকতো আমাদের এমন বিয়ে। আমরা আজীবন লুকিয়েই সংসার করতাম। কেন তুমি ডিভোর্স চাইলে? এনে দিয়েছি। দেখি কি করে সাইন করো তুমি। আমিও জানতে চাই কি করে আমায় ছেড়ে যেতে পারো। তাকাচ্ছি না তোমার দিকে। অত সাহস যে আমার নেই। তোমার দিকে তাকালে যে আমি আর দূরে থাকতে পারবো না। চোখ বন্ধ করে নিলাম। হটাৎ মায়াবিনীর কথায় চোখ খুলে তাকালাম। মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে কাগজ টা বাড়িয়ে।
-সাইন করে দিয়েছি।
এই কথাটাই নিতে পারলাম না। যেন আকাশ ভেঙে পরল। ওর হাতের কাগজটা একপ্রকার কেড়ে ছিনিয়ে নিলাম। ফেলেও দিয়েছি। এই নারী যে আমার। কি করে একটা সই এ ও আমার থাকবে না? তাকিয়ে আছি মেয়েটার চোখের দিকে। এ তো অভিমান। হাজার বছরেও এ অভিমান আমি ভাঙাতে পারব কি? একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলাম। শরীরের শক্তিতে জড়িয়ে ধরে রেখেছি। অনেক শুকিয়ে গেছে। একদম আমার ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। পারছিলাম না আর দূরে থাকতে। বুকের কাছটায় ভেজা ভেজা অনুভব করছি। মায়াবিনী কাঁদছে। মুখটা তুলে দেখলাম। কেঁদে লাল হয়ে গেছে মেয়েটা। চোখ জোড়া ও লাল। ঘেমে যাওয়া মুখটায় চুল গুলো আঁটকে পরেছে। সরিয়ে দিলাম হাত দিয়ে। ঠোঁটের মাঝেও চুল। সরিয়ে দিতে গেলাম মেয়েটা ঈষৎ কেঁপে উঠলো। কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেই। মেয়েটা চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। এই লক্ষন আমি চিনি। আমার ভালোবাসার ছোঁয়া এখন গভীর হবে। তা মায়াবিনী জানে। তখন ও নিজেও চায় আমার প্রেমকে চুড়ান্ত রূপ দিতে। অনেকদিন বাহিরে ছিলাম। আবার এই ঝামেলাতেও দুইজন একসাথে থাকিনি অনেকদিন হয়ে গেছে। মায়া মাখানো মুখটা এখন মোহনীয় দেখাচ্ছে। কাঁপা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরলাম। নিজেকে সরিয়ে আবার মায়াবিনীর দিকে তাকিয়ে আছি। মেয়েটা এত সুন্দর কেন? ও যে আমায় আরো টানছে। পারছি না নিজেকে দূরে সরাতে। পারছি না মায়াবিনীকেও ঠেলে দিতে। মায়াবিনী আমার দিকে চোখ মেলে তাকালো। চোখে অভিমান নয়। এখন আমার মত তৃষ্ণার্ত। প্রেমের পিপাসা যে পেয়েছে। আবার কাছে টেনে নিলাম। চুলে হাত ঢুকিয়ে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিলাম। ভালোবাসা যে এখন আকাশ ছুঁইছুঁই। কেবিনের একপাশে একটা সোফা আছে। যা একটা স্প্রিং এ টান দিলে বেডের মত ব্যবহার করা যায়। ওখানে বসে মায়াবিনীকে কোলে বসিয়ে নিলাম। ওর আগের দিন রাতের করা বিনুনি টা খুলে ফেলেছি। খোলা চুলে মেয়েটা আমায় মাতাল করে দেয়। ওড়না খুলে ওর জামার গলা বাম পাশে টান দিয়ে ঘাড়ের তিল টা বের করে গভীর এক চুম্বন করলাম। হটাৎ ওর বুকে চেপে ধরলো আমায়। ওর কোমড় জড়িয়ে ধরে আছি। ওর শরীরের ঘ্রাণ এত মাতাল করা কেন। ওর প্রতিটা ছোট ছোট সবকিছুতে আমি মাদকিয়তা খুঁজে পাই। আমি যে মায়াবিনী প্রেমে মাতাল। কোনো এক ভালোবাসার ডুব সাগরে ডুবিয়ে দিতে চাই। নিজেও ডুবে যেতে চাই মায়াবিনীর মাঝে। কেউ আমাদের আলাদা না করতে পারুক। চূড়ান্ত প্রেমে আমরা তলিয়ে যাচ্ছি। এত বাধাহীন।
এ ছোঁয়া এমন কেন? এ যে সহ্য করা যায় না। কি করে হবে? এ যে আমার মাতাল প্রেমিক পুরুষ। আমার মাঝে বিলীন। আমায় প্রেমে ফেলতে, ও আমায় ছুঁয়ে দেখে না। নিজেকে আমার মাঝে খুঁজতে, আমায় প্রেমে ফেলে দেয়। অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে। হটাৎ আমার বাস্তবতার খেয়াল এলো। এ তো যা হচ্ছে তা ঠিক হচ্ছে না। একঝটকায় নিবিড়কে আমার উপর থেকে সরিয়ে বসে পরলাম। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছি। নিজের মুখটা হাত দিয়ে মুছে নিলাম। নিবিড় উঠে বসেছে আমার পাশে। ওর দিকে তাকাতেই দেখি আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ সময় কেউ এমন করে আসলে আমার জানা নেই। আমিও কখনো এমন করব বুঝতে পারিনি। নিজের খোলা চুল দিয়ে নিজের সবটা সহ মুখটাও ঢেকে দিতে ইচ্ছে করছে। ভীষন লজ্জা লাগছে। কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। তাই চুপ করে রইলাম।
-কি হয়েছে মায়াবিনী?
-এ ঠিক না।
-কোনটা ঠিক না মায়াবিনী?
আমি আবার চুপ।
-কথা বলছো না কেন? তুমি আমার লিগ্যাল ওয়াইফ। তবে ঠিক না কোনটা?
-লিগ্যাল ওয়াইফ? তবে সে যোগ্যতা নেই তোমার বাসায় বলতে পারলে না? নিজের বউকে ঘরে তুলতে পারছো না? উল্টো আমায় ডেকে এনে এমন ব্যবহার করছো আমার সাথে? এ কেমন লিগ্যালিটি?
-আমি এত কিছু করলাম তোমার তা চোখে পরল না মায়াবিনী? শুধু এই একটা জায়গায় আমি পারিনি তাই এমন বলতে পারলে?
-এই একটা জায়গা না। এইটাতে পুরো ভবিষ্যত আমাদের। তোমার মা রাজি হলে একসাথে নয়ত সারাজীবনের জন্য আমরা আলাদা। যেহেতু আলাদা নির্ধারিত তবে এভাবে কাছে ডাকার মানে কি? ডিভোর্স পেপারে আমি সাইন করে দিছি। আমি তোমার ওয়াইফ ও না। আর তোমার মা তোমায় সুশীল মেয়ে দেখে বিয়ে দিবেন। যার মা মারা যাবেন না। আমার মা নেই না, এমন ভাব আমি আমার মাকে মেরে ফেলেছি। তোমার মার পছন্দে দুইদিন পর ঠিকই বিয়ে করে সংসার করবে। এখন নাটক দেখাচ্ছো। নিজের চাহিদা পূরন করতে এসেছো।
হা হয়ে মায়াবিনীর কথা শুনছি। এ মেয়ে কি বলছে এসব? রাগ হচ্ছে। প্রতি কথায় রাগ কয়েকশো গুন করে বাড়ছে। মায়াবিনী কখনো আমার রাগ দেখেনি। আমি কোনোদিন দেখাতেও চাই না। বাসায় রোজ এসব দেখছে সবাই। মা তবুও এক কথায় অনড়। আমি এখন যত রাগছি যা শুনছি নিজেকে ধরে রাখা মুশকিল। এই মেয়ে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। ওকে মেরে দিবো নয়ত নিজে মরে যাবো। নিজের চুল টেনে ধরে রাগ কমানোর চেষ্টা করছি। কোনো উত্তর মায়াবিনীকে দিচ্ছি না। ও অনবরত বলেই চলেছে। ওর শেষের দিককার কথা গুলো কানে বাঁধলো। আমি মাত্র জানলাম মায়াবিনীর বিয়ে। তাও নাকি বারোদিন পর। ও কেন এখানে। কি করছে এইসব ওইসব অনেক কিছুই বলছে শুনছি।
-আমার বিয়ে। অন্যের বাগদত্তা আমি। অন্যের হবু স্ত্রীর সাথে এসব করছো এভাবে ছুঁইছো এটা অন্যায় না মিস্টার নিবিড় আহমেদ? যেটা করা উচিত ছিল সেটা করতে পারোনি। ডিভোর্স পেপারে সাইন করে দিয়েছি, আমি তোমার বউ না। যেটা করা উচিত না, আমায় ডেকে তাই করছো। ছিহ! আমি চলে যাবো। আমায় তুমি ছুঁইতে পারো না, পরপুরুষ তুমি….
বলতে চেয়েও বাকি টুকু শেষ করতে পারিনি। নিবিড় মুখ চেপে ধরেছে। নিবিড় এর চোখে আগুন জ্বলছে। আমায় মেরেই ফেলবে মনে হচ্ছে। আগুন জ্বালিয়ে দিবে। সেই আগুনে দগ্ধ হবো আমি। ও নিজেকেও ছাড় দিবে না।
-How dare you talking like a cheaper? কি বলছিস জান? তোকে আমি ছাড়া কে ছুঁইবে? এই গাল নাক ঠোঁট গলা বুক পুরো তুই কেবল আমার। এই যে হাত এটাও আমিই ছুঁইবো। এই চুলে শুধু আমি মুখ ডুবাবো। এই যে ঠোঁট এখানে আমি চুমু খাবো আবার আমি কামড়ে ব্যথা দিবো।
নিবিড় পাগলামো শুরু করেছে। ভয় লাগছে আমার। এ নিবিড় যে বড্ড অচেনা আমার কাছে। আমায় ছুঁয়েছে ও বহুবার। কোনোদিন এমন কাটা লাগেনি। আজ অসম্ভব যন্ত্রণা দিচ্ছে। ভালোবাসা নয় মনে হচ্ছে বিষিয়ে দিচ্ছে আমায়। আমার পুরো শরীরে ওর প্রেম বেয়ে উঠছে না। উঠছে ওর রাগ ক্ষোভ। যা আমি কিছুক্ষণ আগে জাগিয়ে দিয়েছি। যদি জানতাম এমন কিছু হবে তবে এ ভুল আমি করতাম না। বাঁধা দিতে চাচ্ছি কিন্তু আজ এ অসম্ভব। ওকে আটকানো। যতটুকু শক্তি ছিল তা দিয়ে ওকে ধাক্কা দিয়েছি লাভ হয়নি। আমি জানি আমি পারব ও না। ওর ছোঁয়া আমার বিষ লাগছে না ঠিকই। কিন্তু ব্যথা পাচ্ছি। আমার কষ্ট কি ও দেখছে না? আমি তো ওর স্ত্রী। কেন জোর খাটাবে? জোর খাটানো ও না। এমন ব্যবহার করছে যেন নিজের নাম আমার শরীরের পোরোতে পোরোতে লিখে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে আমায় যেই দেখবে সেই যেন বোঝে যায় এ সম্পত্তি নিবিড়ের। আমার মনে কষ্ট হচ্ছে তা কি নিবিড় দেখছে না? শুধু নিজের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে আমার সাথে এমন ব্যবহার করছে। একফোঁটা শক্তি আর নেই। শরীর ছেড়ে দিয়েছি। অভুক্তের মত নিজের সকল জেদ আমায় না পাওয়ার, সব মেটাচ্ছে আমারই উপর। দেখে গেলাম কেবল।
কতটা সময় গেছে জানি না। যখন নিবিড়ের রাগ কমেছে তখন আমি বিধস্ত। নিবিড় আমায় ছেড়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। উঠতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে। আর কিছুক্ষণ শুয়ে রইলাম। ঘুম ভেঙে দেখি বেলা ৩টা বাজতে দশ মিনিট বাকি। উঠে নিজেকে দেখলাম। এই প্রথম নিবিড় আমায় কাপড় পরিয়ে দেয়নি। আরো কান্না পেল। নিজেকে গুছিয়ে বেরিয়ে এলাম অফিস থেকে। নিবিড় নেই আশেপাশে। কিন্তু আমি জানি ও এখনো অফিসে। আমায় এখানে একা রেখে যাবে না জানি। কিন্তু মন ভালো নেই আমার। শরীর নিয়ে চলতেও পারছি না। কোনোরকমে রিকসা ডেকে চলে এলাম। বাসায় এসে একপ্রকার দৌড়ে রুমে ঢুকে সাওয়ার ছেড়ে দিলাম। সকাল থেকেই বাহিরে ছিলাম। আসছি এই সময়। বাবা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। ভেবেছিল মেয়ে পালালো কিনা। কিন্তু আমার এই চেহারা দেখে সবাই যে বুঝে যাবে সবটা। এ আমি কি করে দেখাই। ওয়াশরুমের আয়নাতে দেখলাম গাল ঠোঁট গলায় অনেক দাগ। লালচে-নীলচে রং ধারন করেছে। বাকি আমিকে আমার দেখতে ইচ্ছে করল না। পানি শরীরে লাগা মাত্রই জ্বলছে। এ জ্বলন সহনশীল। নিবিড় মনে যে আঘাত করেছে তা কি করে সইবো আমি?
——————————
বাসায় নিবিড় থাকেই না আজকাল। খাওয়া দাওয়া করে না। নিজের ঘরটা কি করে রেখেছে। ভাঙচুর করে বাসায় এলেই। আমি কি বেশি অন্যায় করে ফেলছি? মা মরা মেয়ে বলে কি সে ভালো হবে না? আমার ছেলে ওই মেয়েটার জন্য পাগল। ওদের আলাদা করা কি ঠিক হচ্ছে? আমার ছেলে তো বাঁচবে না এই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেলে। মেয়েটার নাম যেন কি? হ্যা হ্যা মায়াবী। নামের সাথে মুখখানার অনেক মিল। পুরো মায়াবী চেহারাটা। ভীষণ সুন্দর ও। আমার ছেলে কি সৌন্দর্যের পাগল হয়েছে? না না। এমন নয়। শুধু সুন্দরের জন্য এমন হতে পারে না। মেয়েটার মাঝে কিছু তো আছে। আমার একটু কথা বলা উচিত। মেয়েটারই বা কি দোষ। নিজের ছেলের জন্য হলেও আমায় পারতেই হবে।
বেলা সাড়ে তিন টা বাজে এসময় কে এলো? নিবিড় এলো মনে হয়। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দেখি নিবিড় ওর রুমে ঢুকছে। ওর পিছু পিছু ওর রুম পর্যন্ত গেলাম। শার্ট খুলছে। এ কি ওর পিঠে কিসের দাগ? রক্ত শুকিয়ে লেগে আছে। এ তো খামছির দাগ! আপনাআপনি মুখ থেকে বেরিয়ে এলো,
-এ কি সর্বনাশ!
পেছনে না ফিরেই জানি এ মা। ক্লান্ত শরীরে একটা কথা বের হলো না। কিন্তু মা থামলো না। এসে আমায় সামনে ঘুরিয়ে কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারলো। কিন্তু আমার কোনো বোধ হলো না। মনে হচ্ছে এর চেয়েও আরো বেশি শাস্তি পাওয়ার যোগ্য আমি। মা আমায় দেখেই বুঝে গেল তবে মায়াবিনী কেমন আছে? এ কি করেছি আমি? আমার জীবনকে আজ আমি যে কষ্ট দিয়েছি এই জীবনে তা কি ভোলাতে পারব? নাকি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো? মা কি কি যেন বলছে কিছুই কান দিয়ে ঢুকছে না। শুধু মায়াবিনী মুখখানা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। চোখ ভিজে এলো আমার। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদছি।
-নিবিড়?
-মা আমার মায়াবিনীকে আমার কাছে এনে দাও। আমি বাঁচবো না মায়াবিনীকে ছাড়া। ও খুব কষ্ট পাচ্ছে মা। যার কাছে ও সবচেয়ে বেশি নিরাপদ ছিল সে ওর বিশ্বাস ভেঙেছে। মা আমি মরে যাবো মা। আমি আর বাঁচতে চাই না। শুধু আমার মায়াবিনীকে বাঁচতে দাও। মেয়েটা এতকিছু নিতে পারবে না। ওর যে সহনশীলতার বাহিরে।
———————–
নিবিড়কে আমি মা হয়ে ক্ষমা করতে পারছি না। কি করে এই মেয়েটা ক্ষমা করে দিয়েছে? উল্টো নিবিড় কেমন আছে ঠিক আছে কিনা খোঁজ করছে। মেয়ে জাতি বড়ই অদ্ভুত। মন আমার আগেই গলেছিল। নিবিড়ের কান্নায় বুঝে গিয়েছিলাম আমার ছেলে বাঁচবে না মায়াবীকে ছাড়া। আর এই মেয়েটার জন্যই নিবিড় এই বয়সেই জীবনে অনেক এগিয়েছে। আমার ছেলেকে এভাবে কাঁদতেও দেখিনি কখনো। ছুটে গেলাম মায়াবীর কাছে। ওকে দেখেই বুঝলাম এসব আমার ছেলের কাজ। কিন্তু মেয়েটা একবিন্দু রাগ করছে না আমার সাথে। এক তো আমি একাই এই বিয়েতে ভেটো দিয়েছিলাম আবার আমার ছেলেই ওর উপর জোর খাটিয়েছে অথচ মেয়েটা আমার সাথে কি সুন্দর করে কথা বলছে। বুকে জড়িয়ে নিলাম মেয়েটাকে। আমার মেয়ে নেই কিন্তু মেয়েটাকে জড়িয়ে মনে হচ্ছে নিজের মেয়ে পেয়েছি আমি। ওর চেয়ে ভালো কোনো মেয়ে আমি পাবো না নিবিড়ের জন্য। ক্ষমা চাইলাম। কিন্তু মায়াবী আমায় জড়িয়ে ধরলাে। পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। কপালে চুমু খেয়ে বলে এলাম তুই আমার মেয়ে। মা বলেই ডাকবি। মায়াবীর বাবার কাছে যেয়ে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিলাম। দুইহাত পেতে মায়াবীকে চাইলাম আমার ছেলের জন্য। কি সুন্দর পরিবার এদের। বারোদিন পর মেয়েটার বিয়ে। অথচ আমি বলা মাত্র ওই বিয়ে ভেঙে আমায় মেয়ে দিতে রাজি হয়ে গেল। পরেরদিন নিবিড়ের বাবা, আমি আর নিবিড় এসে বিয়ে ঠিক করে রেখে গেলাম। একমাস পর ডেট ফেলেছি। মায়াবীর এখন যা অবস্থা এভাবে এত ধকল নিতে পারবে না। শশীকে বলে এলাম যত্ন নিতে। অন্য কারো চোখে যেন না পরে। আমি ধন্য মা হিসেবে এমন একটা মেয়েকে নিজের ছেলের বউ হিসেবে পাচ্ছি।
—————————————-
প্রেগ্ন্যাসির খবরটা মা চেপে গেলেন সবার থেকে। আমার বাসার সবাই এসেছে। মা এ বলে কাটিয়েছে যে সবাইকে একসাথে খাওয়াবে তাই এভাবে ডাকা। আমি বলেছি মাকে কয়েকদিন গেলে বলতে। উৎস, তিন্নি, মৌকে রেখে দিলাম। ওদের সেই কবে আনতে চেয়েছি। বাবা, ভাইয়া, ভাবীপু চলে গেল। এই তিনটা আমার বাসায় থাকবে বলে চাচা চাচীদের সাথে চলে যায়নি। তাই আমিও আর ছাড়লাম না। নিবিড় কে আজকেই জানাতে হবে। আজ মা জেনেছে দেখা যাবে কাল অন্যকেউ জানবে। এসব ছেড়ে নিবিড়কে বলা বেশি জরুরি। এই তিন্নি, মৌ এর যন্ত্রণায় বাচতাছি না। আসার পর থেকে আমার দেবরের ঘরে ঢুকেছে। নীরব অবশ্য নেই। বন্ধুদের সাথে বান্দরবান গেছে। এসব ভাবা বাদ দিয়ে ভাবি কি করব? কি করে সারপ্রাইজ দিবো আমার বরকে? শাড়ি পরে নিলাম। চুল খোঁপা করে নিয়েছি। নিবিড় রুমে এসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়না দিয়ে মুখ ভেংচি কেটে বললাম বিছানার উপর পাঞ্জাবি আছে পরে রেডি হয়ে নাও। মাথায় আমার অনেক চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে….
চলবে……