তোমার_প্রেমে_মাতাল,পর্ব_34+35
লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
পর্ব_34
ঝলমলে রোদে আকাশ মাখানো। গা পোড়া রোদ নয়, পড়ন্ত বিকেল বলেই। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে আকাশটা কমলা রং ধারণ করছে। পার্কের বেঞ্চে বসে বাদাম খাচ্ছি আর অন্য একটা বেঞ্চিতে এক কপোত-কপোতী জোড়াকে দেখে চলেছি। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে মেয়েটিকে যেয়ে বলে আসি, “এইযে প্রেমিক তোমায় এত ভালোবাসা দেখাচ্ছে তা বিয়ের আগ পর্যন্তই, যখন বউ হয়ে যাবে তোমায় নিয়ে ঘুরতেও বের হবে না, কেয়ার করা তো দূরের কথা।”
-চোখ বের হয়ে যাবে তো। অন্যদের দিকে এভাবে তাকাতে হয়? নজর লেগে যাবে।
-মানে কি? আমি কাপলদের নজর দিচ্ছি?
-তাই তো মনে হচ্ছে। আমাকে দিয়ে বাদাম ছেলাচ্ছো। কখন থেকে ডেকে চলেছি শুনতেই পেলে না। বাদাম নাও। নিজের বর থাকতে, মানুষের দিকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে হয় না।
-এ্যাঁ? মাথা মোটা কোথাকার। ওইদিক চেয়ে দেখ কিভাবে প্রেমিকার যত্ন করছে। আর তুই তোর বৌকে বাদাম ছিলে দিতেই মনমরা হয়ে বসে আছিস। লাগবে না তোর বাদাম।
-অহ আচ্ছা! হিংসুটে মহিলা।
-আমি মহিলা?
বলেই বেঞ্চ থেকে উঠে পা বাড়ালাম। উদ্দেশ্য পার্কের বাহিরে বেরিয়ে যাব। হটাৎ পেছন থেকে আমার ডান হাত ধরে থামিয়ে দিল। পেছন ফেরে দেখলাম অসহায় মুখ করে দাড়িয়ে আছে ছেলেটি। হাতটা ধরে আরো একটু জোরে টান দিলো। একদম কাছাকাছি চলে গেলাম ওর। ওর আর আমার মাঝে চার আঙ্গুলের দূরত্ব। বুক ঢিপঢিপ করছে। চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে নিলজ্জ ছেলেটা। আমি আশেপাশে তাকিয়ে দেখে নিলাম কারা কারা আমাদের দেখছে। এইভাবে এমন অবস্থায় মানুষ কি বলবে? স্বামী-স্ত্রী হয়েও কেমন লজ্জা লজ্জা পাচ্ছে। এই অসভ্য ছেলেটাকে দেখো। দিব্যি পার্কের মধ্যে দাঁড়িয়ে রোমান্স করতে চাচ্ছে।
-আচ্ছা আমার বউ এতো সুন্দর কেন? ইদানীং বেশি সুন্দর লাগছে। কি ব্যাপার বলো তো।
-আহ আদিক্ষেতা। সরো তো। এসব বলে এখন মন জয়ের চেষ্টা? যখন প্রেমিকা ছিলাম কত আদর যত্ন ছিল। আর এখন খেয়াল ও নেই। আজ অফিস থেকে মায়ের ডাকাতে দুপুরের পর এলে। ভাবলাম একটু বাইরে যাই। মুখটা পেঁচার মত হয়ে গেল। আমি যে আমার ভাইবোনগুলোকে রেখে এলাম। আগের মত একটু প্রেম করব ভাবলাম, বাদাম ছিলে খাওয়াতে বলেছি বলে কি বিরক্ত। এখন মানুষের সামনে ঢং করতে এসেছে। যাও আমার মন রাখতে হবে না। (বলেই ভেংচি কেটে অন্যদিকে ফিরলাম)
নিবিড় আমার দুই বাহু ধরে আবার ওর দিকে ফিরিয়ে নিল।
-মায়াবিনী আমাদের বিয়ের দুইবছর পেরিয়ে গেছে। বিয়ে পর থেকেই তোমার সাথে এমন করে এসেছি বুঝি? না তো? দেড়মাস কি অবস্থায় গেছে আমাদের? এখন তুমি আর আমি। কি চাই আমার বউয়ের? কি আবদার আমার প্রেমিকার? বুড়ো বয়সেও আমরা এমন প্রেম করব। তখন ও তুমি আমার প্রেমিকাই থাকবে। আমার চোখে তুমি শ্রেষ্ঠ নারী।
হেসে উঠলাম আমি। কি সুন্দর করে কথা বলে ছেলেটা। এমন পুরুষ প্রতিটা নারী তার জীবনে চায়। ওর মুখেও একটা হাসি খেলা করছে।
-এখানে আজ এভাবে নিয়ে এলেই কেন? একইরকম কাপলসেট। কিছু তো ব্যাপার আজ। কি হয়েছে মায়াবিনী?
বেঞ্চ থেকে আমার পার্সটা তোলে ভেতর থেকে একটা প্যাকেট বের করলাম। একটা ছোট ফতুয়া। ফুল হাতা। একদম নিবিড়ের পাঞ্জাবিটার মতো দেখতে। খুলে মেলে ধরলাম নিবিড় এর সামনে। ওর মুখটার দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে কিছু বোধগম্য হচ্ছে না।
-কাপলসেট না জামাই। ফ্যামিলিসেট। (বলেই মুচকি হাসি দিলাম)
নিবিড় এখনো কোনো রেসপন্স করছে না। শুধু বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে। আমার হাত থেকে ফতুয়া নিয়ে নিল নিজের হাতে। একবার ফতুয়া দেখছে একবার আমাকে। এখন আমার ভয় করছে। নিবিড় কিছু বলছে না কেন? ও কি বুঝতে পারছে না? নাকি এখনই দায়িত্ব নিতে চাচ্ছে না। চোখ হটাৎ জ্বলে উঠলো ওর। আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তারপর চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস টানলো। এবার আমার দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
-Are you pre….. I mean তুমি কি কনসিভ করেছো?
আমি ভাষা হারিয়ে ফেলেছি নিবিড় এর ভাব অবস্থা দেখে। এখন হটাৎ প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলাম। কথা বের হলো না মুখ দিয়ে। মাথা উঁচু নিচু করে হ্যা বুঝিয়ে দিলাম। আমার দুই বাহু ধরে একটা ঝাঁকি দিলো নিবিড়।
-তুমি ঠিক বলছো তো মায়াবিনী? তার মানে আমি বাবা হতে চলছি?
-হ্যা!
নিবিড় আমায় ছেড়ে দিয়ে নিজের কপাল ঘষে এমন একটা কাজ করলো যে আমি হকচকিয়ে গেলাম।
-এই যে সবাই শুনুন আমি.. আমি বাবা হতে চলেছি। আমার ওয়াইফ কনসিভ করেছে। আমাদের ঘরে ফুটফুটে একটা ছোট সদস্য আসবে। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ। আপনারা কি শুনতে পাচ্ছেন? আমার সকল চাওয়া পূরন হয়ে গেছে। আপনারা বুঝতে পারছেন তো? আমি বাবা হবো। মায়াবিনী মা হবে।
আমি অবাক হয়ে গেলাম। আশেপাশে মানুষজনকে ডেকে এসব বলে একটা ছোটখাটো ভীর বানিয়ে ফেলল। আমায় জড়িয়ে কপালে একটা বড় চুমু এঁকে দিলো। আবার সবাইকে এই ওই বলেই চলেছে। আমি এখনো বাকরুদ্ধ। কিছু মানুষ খুবই খুশি। কিছু মানুষ বলাবলি করছে এ ভাগ্যগুনে এমন স্বামী পেয়েছে। বাবা হচ্ছে খবর পেয়েই কেমন করছে। নিজের সন্তানের জন্য না জানি কি করবে। কিছু মানুষ এগিয়ে এসে আমাদের কংগ্রাচুলেশনস করে গেল। আস্তে আস্তে ভীরটা কমে গেল। নিবিড় এর আচরণের বুঝি। সবার সামনে বউকে এমনভাবে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে যেন এটা পার্ক না বেডরুম। এখনো শকের মাঝে আছি। নিবিড় এখন খানিকটা শান্ত হয়েছে। আমার দুইগাল ওর ওর দুইহাতের মাঝে।
-তাই বলি এখন এতবেশি সুন্দর লাগে কেন। আমার বাবু যে তোমার মাঝে। আমাদের ভালোবাসা চিহ্ন তোমার মাঝে বড় হচ্ছে।
-তুমি খুশি হয়েছো?
-আমি খুশিতে আত্মহারা হয়েছি। তুমি আমায় যা দিচ্ছো এ জিনিস দেওয়ার ক্ষমতা আর কারো নেই। তুমি কি করে আমায় এতো বড় সংবাদ দিলে? এত আনন্দ আমার আর কোনোদিন লাগেনি মায়াবিনী।
চোখ বেয়ে পানি পড়ছে নিবিড়ের। এই পানি আমি প্রথম দেখেছি। এ যে আনন্দের অশ্রু। কিছুক্ষণ নীরবতা। রাত হয়ে এসেছে। বাসায় যেতে হবে। মা বলে দিয়েছেন। সন্ধ্যার আগে যেন বাসায় ফিরি। নিবিড় আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে বাসায় রওনা হলাম। রিকসায় তুললো কোলে করে। ইসশ এই ছেলের কি লাজ লজ্জা নেই! রিকসায় উঠেও শান্তি দিচ্ছে না। এমন ভাব করছে যেন পরে যাবো। তাই একদম জড়িয়ে ধরে রেখেছে। জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। ক্ষান্ত দিলো না। একটু আগের কথা বলে আমাকে খোঁচাতে লাগলো। মহিলা বলায় রাগলাম কেন তখন। বাচ্চার মা হচ্ছি, মহিলা বলবে নাতো কিশোরী বলবে নাকি আমায়। লেগপুল করছে অনবরত। কিন্তু আমি জানি এইটা আমাকে রাগাতে না ভোলাতে বলছে। রিকসায় থাকাকালীন যেন ওর থেকে নিজেকে না ছাড়াই। ওর কথার মাঝে ডুবে থাকি। মনে মনে হাসলাম। নিবিড় আমার পেটের উপর হাত রেখে বলল,
-বাবা তোমায় ছুঁয়েছে কেবল। বাসায় যেয়ে চুমু দিয়ে আদর করে দিবে।
হেসে উঠলাম। সবটা এত সুন্দর এত রঙিন কেন কে জানে!
বাসায় ফিরে নিবিড় আরো কতক্ষণ কত কাহিনি করলো। বাবা মাকে কতবার জড়িয়ে ধরলো। বাবা হবো, বাবা হবো বলে বাড়ি মাথায় করে ফেলেছে। শালা শালিদেরকে শুধু মিষ্টি না আরো অনেককিছু কিনে দিয়েছে। আমার বাসার সবাই জেনে গেছে। পাগলামি কতরকম আছে সব করা হয়ে গেছে। একবিন্দু পরিমাণ লজ্জা লাগছে না ছেলেটার। দিব্যি বলছে বাবা হচ্ছি। জানি বিয়ের দুইবছর পর বাচ্চা হবে জানলেও এমন করা যায় না। লজ্জা লাগে মানুষের। অথচ সবাই জানে বিয়ের সবে দেড়মাস। এর মাঝেই এই নিউজ অনেক বেশি চোখে লাগে। কিন্তু এই লোকের মাথার তার ছিড়া। যা ইচ্ছে বলে যাচ্ছে আর করে যাচ্ছে। এমনকি আমার বাবাকেও ফোন করে বলেছে,
“আপনি নানা হচ্ছেন বাবা, আমার মেয়ে হবে। আপনি যোগ্য হলে আপনার সাথেই বিয়ে দিবো।”
লজ্জায় মুখ কই লুকাবো ভেবে পেলাম না। অসভ্য নিলজ্জ কোথাকার! এইদিকে ভাবছি, আড়াই মাস চলছে। মা আর আমি ছাড়া আপাতত কেউ জানে না। কিন্তু কিছুদিন গেলেই বেবি বাম্প হবে। তখন সবাই বুঝে যাবে। জোরে নিশ্বাস ছেড়ে বললাম সবইস সঠিক সময়ের অপেক্ষা এখন।
রাতে খাওয়ানো হলো একগাদা খাবার। এই নিবিড় এর চক্করে আমি দুইদিনের আশি কেজি হবো সিউর৷ মনে হচ্ছে আরো কিছুদিন পর ওকে জানানো উচিত ছিল। আমারই বোকামি হয়েছে। মরন!
অনেকক্ষণ হলো রুমে এসেছি। নিবিড় ডক্টরের সাথে কথা বলে অ্যাপোয়েনমেন্ট নিয়েছে। কালকে আমার ফুল বডি চেকাপ করাবে। হ্যা খালি এইটারই বাকি ছিল। বিরক্তিকর!
নিবিড় ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এলো। টাওয়াল রেখে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বিছানা থেকে উঠে ওর কাছে গেলাম। ও এখনো ভ্রুকুটি দিয়েই রেখেছে। তারপর নিজে থেকেই বলল,
-মায়াবিনী তুমি প্রেগন্যান্ট কতোদিনের? বিয়ের পর তো আমাদের… তবে তুমি কনসিভ কবে করলে?
এখন চোখ নামিয়ে নিলাম। কি বলব বুঝে উঠতে পারছি না। এই নিয়ে আর কখনো আমরা কথা বলবো না বলছিলাম আমি নিজেই। কি করে বলি তবে!
-আড়াই মাসের!
-What? What do you just say?
চুপ করে রইলাম।
-তার মানে ওইদিন……
আমার নীরবতা সম্মতির লক্ষন নিবিড় তা বুঝে গেছে। নিবিড় আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পরলো। আমার দুই হাত ধরে ওর হাতের মুঠোতে পুড়ে নিলো।
-ভেবেছিলাম ওইদিনটা তোমার জীবন থেকে আমি মুছে দিতে পেরেছি। কিন্তু নিজে থেকে ভুলতে পারিনি। বিয়ে হয়ে গেছে পারিবারিকভাবে। একসাথে থাকছি কিন্তু এই দেড়মাসেও আমি তোমার এত কাছে আসতে পারিনি। ওই ঘটনা আমি মানতে পারিনি। পারি না তোমায় কাছে টেনে নিতে। তুমি যে কষ্ট পেয়েছ, যেই যন্ত্রণা তোমায় আমি দিয়েছি তার জন্য আমি অনুতপ্ত। তবুও পারিনি ভালোবাসাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে। একে যে আমি নিজেই নষ্ট করে দিয়েছি। তবে আমি তোমায় কথা দিতে পারি আমি তোমায় আর কোনোদিন কষ্ট দিবোনা। এইটুকু বিশ্বাস করো।
নিবিড় মুখ নীচু করে ফেলেছে। যেন চোখে চোখ রেখে তাকাতে পারছে না। নীচে বসে নিবিড়ের হাতে থেকে হাত ছাড়িয়ে ওর মুখটা উঁচু করে ধরলাম নিজের দিকে। চোখ মেলে আমার দিকে তাকালো না। ওর কাঁধ ধরে জড়িয়ে ধরলাম। আমার কাঁধে ওর মাথা রেখে দিয়ে আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলাে। কতক্ষণ এমন ছিলাম জানি না। পরে আবার ওর মুখ ধরে নিজের দিকে ফেরালাম। চোখে চোখ রেখে বললাম,
-বোকা ছেলে তুমি যে আমার সব। ওইদিনের জন্য তুমি আমায় দূরে সরিয়ে রেখেছো? তুমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারছো না? অথচ আমার কোনো রাগ নেই তোমার উপর। বরং আমি আর তোমার বাবু ভীষন খুশি। ওইদিনের জন্যই তো সে আসছে। আর সত্যি বলতে কি জানো নিবিড়? ওইদিন আমি একদম রাগ করিনি। ভয় পাচ্ছিলাম খুব। তুমি নিজের কিছু করে না ফেলো। আর কষ্ট পেয়েছিলাম এই ভেবে, তুমি ভেবে নিয়েছিলে অন্যের বউ হিসেবে নিজেকে ভেবে ফেলেছি। অথচ আমি অভিমানে সবটা বলেছিলাম। তুমি যে আমার বর। তুমি ছাড়া অন্য কাউকে আমি কল্পনা করতে পারি না। তবে মন খারাপ হয়েছিল খুব। কিন্তু তুমি এখনো এটা মনে রেখেছো কেন? হলুদের আগের দিন রাতে তুমি আমায় প্রপোজ করে সারপ্রাইজ দিয়েছিলে। আমরা বলেছিলাম এসব ভুলে যাবো। তুমি এখনো নিজের মাঝে কেন দমিয়ে রেখেছো? দেখো তোমার সন্তান ও তোমার ভুল ভেঙে দিলো।
নিবিড় আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আমার জীবনে তোমাকে পাওয়া মানে আমি নিজেকে পেয়ে গেছি। মায়াবিনী তুমি ভাগ্যবতী নয় আমায় পেয়ে, আমি ভাগ্যবান তোমায় পেয়ে। এমন অর্ধাঙ্গিনী পায় কয়জন পুরুষ? এতকিছুর পরও তোমার আমার উপর রাগ নেই। কি করে পারো সবটা? আমি বলি আমি তোমার প্রেমে মাতাল। কিন্তু তুমি তো আমার জন্য পাগল। এ কি বুঝো? এত ভালোবাসা কি আমি পাওয়ার যোগ্য আদো?
-আমিও তোমার প্রেমে মাতাল নিবিড়। তোমার মতো এত দেখাতে পারিনা। তোমার মত ভালোও বাসতে পারি না। কিন্তু যতটা বাসি তা আর কেউ পারবে না।
-আমি জানি। আর তুমি আমায় যত বড় সুখবর দিয়েছো আমি সারাজীবন তোমার কাছে নিজেকে সপে দিয়েও পূরন করতে পারবো না। তোমার জায়গা যে আমার কাছে কোথায় তোমায় বোঝাতে পারবো না।
নিবিড় উঠে খাটে বসলো। আমাকেও দাঁড় করিয়ে দিলো ওর সামনে। তারপর আমার পেটে হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রইলো। তারপর আমার কোমড় ধরে আরো কাছে টেনে পেট থেকে জামাটা উঠিয়ে চুমু এঁকে দিলো। আবার কোমড় জড়িয়ে পেটে মাথা রাখলো। কান পেতে কি যেন শোনার চেষ্টা করছে। তারপর বলল,
-তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো সোনা। বাবা অনেক অনেক সরি। এত পরে তুমি আসার খবর পেয়েছে বাবা। বাবার তো দোষ নেই। সে জানতো না তো। আজ জেনেছে, আজকে তোমায় অনেক আদর করে দিবে। তোমার আম্মুকেও খুব খুব আদর করে দিবে। এতদিনের জমানো ভালোবাসা সব ঢেলে পুষিয়ে দিবে বাবা। বাবু আর বাবুর আম্মুর খেয়াল আমি রাখবো। কথা দিলাম।
এই লোক বলে কি। আমার বাচ্চাটাকেও নিজের মতো অসভ্য বানাবে। চোখ বড় বড় করে শাসিয়ে দিলাম এই সব কথা যেন একদমই না বলে। কিন্তু আমার শাসানি কাজে লাগলে তো? উল্টো আমায় নাস্তানাবুদ করলো। হুট করে কোলে বসিয়ে ভালোবাসায় ভরিয়ে দিলো। নিজের সন্তানকে কথা যে দিয়েছে। অনেকদিন পর আবার সেই ছোঁয়া। যেন আজ নতুন করে সবটা পাচ্ছি। নিবিড় এর ছোঁয়ায় আমার আসক্তি, টেনে নেয় কি করে এভাবে। এই স্পর্শ সত্যি সুন্দর। এ যে পবিত্র। ভালোবাসায় ডুবিয়ে দিচ্ছে। ভুলে যাচ্ছি পৃথিবীকে। আজ নিবিড় নিজের মত কাছে নিয়েছে আমায়। নিজেরা আলাদা ভুবনে ভেসে চলেছি। যা অনন্ত।
মাঝরাতে জানালা দিয়ে আসা চাঁদের আলো মুখে এসে পড়ছে। নিবিড় এর বুকে শুয়ে আছি। আলোতে আমার মুখের দিকে পলকহীন চোখে নিবিড় দেখে চলেছে। চোখ খুলে বললাম,
-এভাবে তাকাবে না। আমার লজ্জা করে।
-এখন লজ্জা? একটু আগে তো পায়নি।
-যাহ! সবসময় এসব!
(বলে বুকে থেকে উঠতে নিলাম। নিবিড় আবার জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে।)
-কোথায় যাচ্ছো? দাড়াও। (বলে আশেপাশে থেকে হাতিয়ে আমার কাপড়টা বের করে নিজে পরিয়ে দিলো।) এখন উঠতে পারো।
-তুমি সবসময় আবার পরিয়েও দাও কেন?
-তুমি সবটা আমার। পুরুষ কেবল বস্ত্র হরণ জানে। কিন্তু প্রকৃত প্রেমিক পুরুষ নিজের মানুষের ভালো লাগা বোঝে। তুমি আমার। তোমায় প্রেমে ভাসাতে খুলতে পারলে, প্রেমে ফেলতে পরাতেও পারি। এইটা স্বামীর কর্তব্য। বুঝলে জান?
একরাশ ভালোলাগা মন ছুঁয়েছে আমার। আবার জড়িয়ে ধরলাম নিবিড়কে। ওর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেলাম। এর চেয়ে শান্তির স্থান যে আর কোথাও নেই।
সকাল থেকে তিন্নি আর মৌ এর যন্ত্রণায় আর বাঁচতে পারছি না। পেরেসানি করে ফেলতাছে আমাকে। আমার একমাত্র দেবরের রুম ঘাটাঘাটি করছে। প্রেম করে কিনা সার্চ করে বের করবে। নীরব নাকি দুইটার একটাকেও পাত্তা দেয় না। আমি শুনে হেসেই শেষ। তাই জন্য আমার বোনগুলোর এত অভিমান।
-দেখ মায়াবী আপি, আমাকে অনেক ছেলে প্রপোজ করে। সব রিজেক্ট করি আমি। আর তোর দেবর উল্টো আমাকে ভাব দেখায়?
-আমাকেও পাত্তা দেয় না।
-এই তুই এখনো স্কুলে পড়িস। চুপ থাক।
-মৌ তুই আসলেই চুপ থাক। তোর সাথে নীরবের অনেক এজ ডিফারেন্স। তিন্নি তাও কলেজে উঠে।
-এজ কোনো ম্যাটার করে না আপি। এইটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ উৎস ভাইয়া।
আমি আর তিন্নি একসাথে বলে উঠলাম
-কিহ!
-না মানে মানে… কিছু না।
আমি আর তিন্নি অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও মৌ এর মুখ থেকে একটা কথা বের করতে পারলাম না। মৌ আসলেই এমন। ওর জায়গায় এখন তিন্নি হলে ঠিকই জানা যেত কি কাহিনি। মৌকে আর জোর করলাম না। ওদের দুইজনকে রুমে রেখে বাইরে আসার পর উৎসকে খুঁজতে লাগলাম। এই বাসায় ওর সমবয়সী নীরব আর আমি আছি। নীরব তো বাসাতেই নেই। আবার আমার সাথেও নেই, তবে উৎস কোথায় গেল? খুঁজতে খুঁজতে ছাদে পেলাম। ফোনে কথা বলছে সে। আর এইদিকে খুঁজে মরছি আমি এই গুনধরকে। আস্তে আস্তে ওর পেছনে যেয়ে দাঁড়াতেই উৎস চমকে উঠলো।
-মায়াবী তুই?
-মেয়ে কি ক্লাস সিক্স-সেভেনে পড়ে? নাকি মেয়ের বয়স ৩৫+? কোনটা উৎস? এভাবে চেপে যাচ্ছিস, লুকিয়ে যাচ্ছিস রিলেশনশিপ। কি সমস্যা আমাকে বল।
-এমন না মায়াবী। তোকে তো আমি নিজেই বলতে চেয়েছিলাম। (উৎস আমার হাত দুইটা হাতে নিয়ে নিলো) তুই একমাত্র পারিস আমায় হেল্প করতে।
উৎস কি বলবে ভাবছি। ও কখনো এমন ইমোশনাল হয়ে যায় না। আমার কাছে তো নয়। আমার সাথে মারামারির সম্পর্ক উৎসের। ভয় করতে লাগলো আমার। জীবনে প্রথম আমার কিছু চাইছে ছেলেটা। আমি কি পারবো ওর জন্য কিছু করতে?
চলবে…………
#তোমার_প্রেমে_মাতাল
#লেখিকা_মায়াবিনী (ছদ্মনাম)
#পর্ব_৩৫
অনেকক্ষণ যাবৎ বেডরুমে আমার সামনে দুইটা অপরাধীর মতো মুখ নীচু করে বসে আছে। এদের কি লজ্জা লাগছে? লজ্জায় মুখ লাল নাতো। তবে কি শরম পাচ্ছে আমার সামনে? কি জানি বাবা। প্রেম করে লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখবে কেন মানুষ? পেয়ার কিয়া তো ডারনাহ কেয়া? যাই হোক গলাটা পরিষ্কার করে বললাম,
-Anyways what’s the matter?
-মায়াবী সবটা জেনেও এমন করার কি মানে?
-আমিও সেম এই কথাই বলছি। প্রেম করছিস অথচ ভাব নিতাছিস চুরি করছিস। বুকের পাটা নেই? পুরুষ মানুষ হয়ে বাসায় বলতে পারিস না?প্রেমিকার বিয়ের বৈঠকখানার দায়িত্ব তুই নিস। মূর্খ!
সুচি তোর বাবার সাথে কথা বলে উৎসকে খাবার টেবিলের দায়িত্বটা দিস। এই একটা কাজ পারফেক্ট করতে পারবে। আমি গ্যারান্টি। আমার ভাই বলে কথা?।
-তোর ভাই কোনো কামের না। খালি আছে মুখে ফুলঝুরি। মিষ্টি কথায় আমায় ভুলাইছে হাঁদারাম। অথচ নিজের বাপকে কিছুই বলতে পারে না।
-আসতাগফিরুল্লাহ (বলে উঠে চুপ মেরে গেলাম)
-তোমার মুখের ভাষা ঠিক করো সুচি।
-না করলে কি করবি?
-না কিছু না ডার্লিং?। তোমাকে আর আমি কিছু বলতে পারি বলো?!
বুঝলাম আমার ভাই বড় ফাঁসা ফেঁসে গেছে। তাই ব্যাপারটা থামাতে সুচিকে বললাম,
-আমার চাচা একটা জিনিস মাইরি। উনার সাথে কথা বলা এত সহজ নয়।
-তবে এখন কি করবো মায়াবী? আমার বিয়ে..
-আরে ভাবতে দে। আমাকে বলেছিস সমাধান পাবি। আমার ও বিয়ে ঠিক ছিল। ভেঙে বয়ফ্রেন্ডের সাথে হয়েছে তো? তোদেরটা ও হয়ে যাবে। চাপ নিস না।
বলে তো দিলাম চাপ নিস না। আসলে কি করব বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমাকে করতেই যে হবে। মাথায় বিভিন্ন প্ল্যান চলছে।
——————————
উৎসের প্রেমিকা আমারই কলেজ বন্ধু সুচি। এক তো সমবয়সী। তার মাঝে সুচি উৎস থেকে ১১মাসের বড়। তাও ভালো এক ক্লাসে পড়ে। এতদিন এসবের জন্যই বাইরে কাউকে বলতো না ওরা। এখন অনার্স কমপ্লিট সুচির। বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছে। এইদিকে উৎসের মাত্র বিএসসি এর রেজাল্ট বেড়িয়েছে। এমএসসি কমপ্লিট করবে পরে জব তারপর যেন বিয়ের কথা বলতে পারবে। এমন একটা পরিস্থিতি কাউকে বলতে পারছে না। তাই এতোদিন লুকোচুরি। কিন্তু এখন ব্যাপারটা ওদের হাতের বাহিরে। উৎস আমার কাছে প্রথম কিছু চাইছে। আমার শুধু ভাই না আমার বেস্টফ্রেন্ড ও। উৎসের জন্য আমায় এইটুকু করতেই হবে যেকোনো কিছুর মূল্যে।
এরপর আমি সুচিকে নিয়ে আসতে বলায় উৎস আজ বিকালে নিয়ে এসেছে আমার শশুর বাড়ি। আমার ঘরে বসে আলোচনা করছিলাম কি করা যায়। সুচি বড় বলেই আমার ভাইটার সাথে এমন করে। এইদিকে আমার ভাই কড়া প্রেমিক। এখনই এমন ভয় পায়। এই মেয়ে বউ হলে আমার ভাইকে জ্বালিয়ে খাবে। কিন্তু আমি জানি সুচির সাথে বিয়ে হলে ও মন থেকে সবচেয়ে বেশি সুখি হবে। সংসারটাও সুন্দর হবে।
——————————
-তুই ও তো মায়াবী ব্যাচমেট বিয়ে করছিস। তোর সাথে তো এমন হলো না। তোর বর কি করে জানিয়েছে পরিবারকে?
-কিহ! ব্যাচমেট? তুই কি পাগল হয়ে গেছিস?
-হ্যা। কেন এইটা নীরবদের বাসা না?
-হ্যা কিন্তু তুই কি করে জানলি এইটা নীরবের বাসা?
-হ্যা হ্যা বলো সুচি।
-উৎস তুই চুপ থাক। যতদিন আমাকে বিয়ে না করবি কোনো কথা যেন তোর মুখ থেকে না শুনি।
-এই সুচি এমন করো কেন। মায়াবী আছে তো, তোমায় ঘরে তুলবোই জানু।
-তুমি এইভাবেই আমায় ভুলাও উৎস। নট ফেয়ার?।
-কিন্তু সুচি কি করে জানলে এইটা নীরবের বাসা?
-না মানে এক কলেজে..
-এক কলেজে পড়তে বলে বাসা চিনে যাবে? মায়াবীর বাসা তো চিনো না।
-মায়াবী তো আমার ক্রাশ ছিল না। উপস?।
-ওহহহহহ! নীরব ক্রাশ ছিল।
শুরু হয়ে গেল?♀️। তবে ওদের খুনসুটি দেখে আমার ভালো লাগছে। কি মিষ্টি প্রেম। মুচকি হাসলাম। খানিকটা পর থামলো। এখন আরো কি কি যে করছে।
এইসব চলছে হটাৎ মৌ আর তিন্নি দৌড়ে এসে আমার ঘাড়ে পরলো।
-আহ! এসব কি রে? মায়াবী প্রেগন্যান্ট। এভাবে এসে ওর উপরে পরতাছিস কেন? সর এখান থেকে।
-আরে উৎস থাক না। কি হয়েছে রে তোদের? এভাবে দৌড়ে এসেছিস?
-মায়াবী আপি তোর দেবরের রিলেশন আছে। জেনে গেছি আমরা।
-বাঁদরের দল। এইটা জেনে এমন ব্যবহার করছিস। ভয় পেয়ে গেছিলাম। কি না কি জেনে এসেছিস।
উৎস ওই দুইটাকে কান ধরে বাইরে নিয়ে গেল। নিজের বয়সের চেয়ে বড় গার্লফ্রেন্ডের কাছে পিচ্চি বোনগুলোর জন্য আর নিজের সম্মানের ফালুদা বানাতে চায় না। আমি আর সুচি হেসে দিলাম। আমাদের অনেকদিন পর দেখা। কলেজে খুব ভালো বন্ধু ছিলাম না ঠিকই। কিন্তু ক্লাসমেট ও না শুধু। কোচিং করতাম এক সাথে। তাই কথা আড্ডা মাঝে মাঝে হয়ে যেত। পুরোনো স্মৃতি নিয়েই অনেক কথা হলো। কতরকম দুষ্টামি শয়তানী করেছি। সুচি আমাকে বলছে এত শান্ত হলাম কি করে? বিয়ে হয়ে গেলে কি মেয়েরা এমন হয়ে যায় নাকি? আরো কত কি উদ্ভট প্রশ্ন করছে এই মেয়েটা। তবে এভাবে পুরোনো স্মৃতি আওড়িয়ে অন্যরকম এক ভালোলাগা-খারাপ লাগা একসাথে কাজ করছে। ভালো লাগছে কারন আমাদের ওই সময়ের সুন্দর মুহুর্তকে কল্পনা করে চোখের সামনে ভাসছে। আবার খারাপ লাগছে এই বলে ওইদিন গুলো আর কখনোই ফিরে পাবো না।
-মায়াবী।
-হু!
-নীরব এখন কি করছে? মানে জব নাকি পড়ালেখা?
-বাইরে যাওয়ার জন্য এপ্লাই করেছে। এছাড়া আপাতত ঘুরছে ফিরছে।
-এমন ছেলের কাছে আঙ্কেল বিয়ে দিলো? জানি ওদের অবস্থা অনেক ভালো। কিন্তু ছেলে তো কিছু করে না। দেখ তোর ভাইয়ের ব্যাপারটাই। মানে আমি তো বাসায় উৎসের কথা বলতেই পারছি না। আর তোদের বিয়েও হয়ে গেল?
-কি আবোলতাবোল বকছিস? (অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেলাম)
-হ্যা হ্যা জানি নীরব তোকে পাগলের মতো পছন্দ করতো। এতো ভালোবাসা তোকে আর কেউ বাসতে পারবে না। এমন ছেলে হাতছাড়া করা বোকামি।
-সুচি থাম। যা জানিস না তাই বলে যাচ্ছিস। আমার বর না নিবিড়। নীরবের বড় ভাই ও। আর নীরব আমার একমাত্র দেবর হয়।
-কিহ! মায়াবী তুই মজা করছিস তাই না? তুই আগের মতোই আছিস। কলেজে তোকে কেউ প্রপোজ করলে বলে বেড়াতি তোর বিয়ে হয়ে গেছে। এখনো আমার সাথে এমন মজা নিচ্ছিস।
-না সুচি। আমি সত্যি বলছি।
-তুই কি বলছিস? নীরবের সাথে তোর বিয়ে হয়নি? ওর ভাইয়ের বউ তুই?
-হ্যা!
-কিহ বলিস? তোর আর নীরবের সম্পর্ক ছিল না কলেজে? সম্পর্ক ছিল কি না জানি না। কিন্তু নীরব তোকে পছন্দ করতো। এসব জেনে কি করে তুই ওর ভাইকে বিয়ে করলি?
-আমি সত্যি তোর কথা বুঝতে পারছি না। খুলে বল সুচি।
—————————-
রাত অনেক। কিন্তু ঘুম আসছে না মোটেও। এক প্রকার অসস্তি আমায় ঘিরে রেখেছে। নিবিড় এর বাহুডোরে শুয়েও মনটা শান্ত নয়। পেট টা হালকা ব্যথা করছে। আজকে ডক্টর দেখিয়ে এনেছে নিবিড়। ফুলবডি চেকাপ করানো হয়েছে। আমাকে ডক্টর অনেককিছু বলেছেন। প্রেগ্ন্যাসির প্রথম তিন মাস খুব যত্নে সাবধানে থাকতে হয়। সেখানে আড়াই মাস চলছে আমি এই প্রথম চেকাপে কেন গেলাম। আবার এই সময় আমি প্রচুর কাজের চাপে থেকেছি। আবার মানসিক চাপেও। আমাকে বলে দিয়েছে একদম যেন কোনো চাপ না নেই। নিবিড় তো একটু শুনতেই অস্থির। এমন ভাব করছে ডক্টরের চেম্বার উঠিয়ে দিবে। এই পাগল ছেলেকে নিয়ে আর বাঁচি না। মাথামোটা একটা।
-কি হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন? ব্যথা করছে? বমি পাচ্ছে? ক্ষুদা পেয়েছে? কি খাবা বলো। এনে দিবো বা বানিয়ে দিবো? বলো।
-আহ! কিচ্ছু ভাল্লাগছে না। কথা বইলো না তো।
নিবিড় উঠে বসেছে। আমি কি ঘেমেছি কি না। বা ঠান্ডা লাগছে কিনা দেখছে। উঠে যেয়ে রুমের লাইট অন করলো। কাছে এসে পেটে হাত দিলো।
-উফফ!
-ক্ষুদা পেয়েছে না? বলো না কেন? উঠো মায়াবিনী।
-কেন?
-উঠো বলছি। কিচেনে যাবো।
বলে আমায় টেনে বসিয়ে দিলো। তরপর হাত ধরে আমায় কিচেনে নিয়ে গেল। চুলার পাশের জায়গায় আমায় বসিয়ে দিলো। রাগে ফুঁসছি আমি। কিছুই বলছি না। খালি দেখে যাচ্ছি কি করে।
-কি খাবে মায়াবিনী?
-তোমার মাথা।(বুকে হাত গুঁজে মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখলাম)
-আমার বউয়ের ফ্যাবারিট নুডুলস রান্না করবো। সবজি আর চিকেন দিয়ে রাঁধবো।
-এখন চিকেন না শুধু ডিম আর সবজিতেই হবে।
নিবিড় খানিক হেসে রান্না শুরু করলো। ওকে আগে কখনো রাঁধতে দেখি নাই শুনি ও নাই। নুডুলস ভালোই রাঁধছে। ভুল হচ্ছে না। জিজ্ঞেস করতে খুব ইচ্ছে করছে কি করে শিখলো। কিন্তু মেজাজ গরম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। নিবিড় সার্ভ করে সামনে এনে ধরলো। খাওয়া শুরু করে দিয়েছি। আপাতত অনেক ক্ষুদা পেয়েছে। রান্নার স্মেইলে তো কথাই নেই । অনেক মজা করে খেয়ে নিলাম। শেষে একটু বাকি। মনে পরল আমার গুনধর জামাইকে একবার ও সাধি নাই। ঢোক গিললাম বড়সড় করে। এতক্ষণ মুখ তুলে তাকানোর সময় পাইনি। তাকালাম ওর দিকে। কি অসহায় মুখ করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। বুকে হাত গুঁজে আমার সামনে দাঁড়িয়ে। ওর এই চাহনিতে অভিমান নেই। তৃপ্তির নয়নে আমাকে দেখে চলেছে। ঠোঁট বাকিয়ে আছে। যাকে হাসি হাসি মুখ বলা চলে। নিচের ঠোঁট ফুলিয়ে একচামচ এগিয়ে দিলাম নিবিড় এর দিকে। ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে বোঝালো সে খাবে না। আমার কোল থেকে বাটি নামিয়ে রাখলাম। সে খাবে না আমি কেন খাবো? নিবিড় আমার আরো কাছে এসে দাঁড়ালো। নিজে হাতে তুলে নিলো বাটি, তারপর মুখের সামনে ধরে বলল,
-বউ এমন করো না তো। আমার বাবুটাকে শান্তিতে খেতে দাও।
-অহ আমার জন্য না! তাহলে এক কাজ করো, বাচ্চা বের করে নিজে খাইয়ে দাও গা।
নিবিড় এক হাত আমার পেটে রেখে বলল,
-আমার মেয়েকে জ্বালিয়ো না মায়াবিনী। খেয়ে নাও পরে ঝগড়া করো। ক্ষুদা লাগলে তোমার মেজাজ বিগড়ে যায়। আমি জানি। খাও না জান প্লিজ।
হা করে রইলাম। নিবিড় খাইয়ে দিলাে। এই ছেলেকে মাঝরাতে এনেছি। না খেলে মন খারাপ ও করবে।
-কি করে রাঁধতে জানলে?
-আগে মুভি দেখতাম, মা ঘুমে থাকলে বা অন্যকাজ করতে থাকলে নিজে রাঁধতাম। আর নুডুলস রাঁধতে রাধুনি হতে হয় না। (বলে নাক টেনে ধরলো আমার)
-(ভেংচি কেটে বললাম) তুমি কি করে বুঝলে আমার ক্ষুদা লেগেছিল? আর রান্না করবে ভালো কথা। আমাকে কিচেনে এনেছো কেন? রুমে রেঁধে নিয়ে যেতে।
-আমার বউ পেটে হাত রেখে আমার বুকের মাঝেই নড়াচড়া করছে। আবার মেজাজ দেখাচ্ছিল এসব কি আমি বুঝি না? আর রুমে রেখে এলে তোমাকে, ওইখান থেকে বকাঝকা করে আমার গুষ্টি উদ্ধার করতে। আর আমার একা একা রান্নাঘরে মন টিকতো না। তাই এনেছি তোমায়। মাঝরাতে ঘুম ভেঙে কাজ করছি বলে যে আপস হতো সেটা তোমাকে দেখে পুষিয়ে নিলাম। এত সুন্দর বউ যত দেখি তত দেখার বাসনা বাড়ে।
হেসে উঠলাম আমি। নিবিড় এর গলা জড়িয়ে ধরলাম চেপে। নিবিড় কপালে চুমু দিয়েছে। ওর থুতনিতে কামড় দিয়ে কালশিটে দাগ করে দিয়েছি। যদি বা হালকা খোঁচা খোঁচা দাড়িতে তেমন বোঝা যাচ্ছেনা। কিন্তু নিবিড় আহ বলে আমার কোমড় চেপে ধরে আরো নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। নিবিড় কানের কাছে মুখ এনে বলল,
-খেয়ে এনার্জি বেড়ে গেছে দেখছি।
কোনো কথা বললাম না আর। দুইপা দিয়ে নিবিড় এর কোমড় পেঁচিয়ে ধরলাম। তারপর নিবিড় আমায় ওই অবস্থায় কোলে নিয়ে রুমে নিয়ে গেল। আমি জানি নিবিড় এর এ খেয়াল শুধু ওর বাচ্চার মা হচ্ছি বলে না। আমি ওর ভালোবাসা বলেই এত খেয়াল আমার। তবে ওর বেবি আমার গর্ভে বলে প্রেমটা আরো ঘনীভূত।
——————————–
আজ অনেক বেলায় ঘুম ভেঙেছে আমার। নিবিড় পাশে নেই। জানি অফিসে চলে গেছে। আমাকে বলে যায়নি? ভীষন রাগ পাচ্ছে। সাইড টেবিল থেকে হাতে ফোন নিয়ে দেখলাম, নিবিড় আমার ফোনের মেসেজ অপশনে টাইপ করে কিছু লিখে রাখছে। আর কি লিখেছে,
“মায়াবিনী তুমি নাস্তা খেয়ে নিও তাড়াতাড়ি। আমার বাবুটাকে না খাইয়ে রেখো না বেশিক্ষণ। অনেকে রাতে ঘুমিয়েছো তাই ডাকলাম না বউ। রাগ করো না।”
এখন আসলেই রাগ পরে গেল আমার।
সকালে উঠে দেখি তিন্নি আর মৌ সাজুগুজু করে টিপবাবু উপস সরি টিপবিবি সেজে বসে আছে। কারন আর কিছুই না, মায়ের কাছে শুনেছে নীরব আজ বাসায় আসবে। তাও আসতে আসতে সন্ধ্যে। এই মেয়ে গুলো পুরোই পাগলি। তবে নীরব আসবে শুনে কেমন যেন লাগলো আমার। হয়তো কালকে বলা সুচির কথা গুলো মনে পরায়।
———————————
-নীরব তোকে কলেজ থেকেই পছন্দ করতো এটা ক্লাসের সবাই জানতো। তুই ওর একমাত্র বন্ধু ছিলি। কোনোদিন কাউকে হেল্প করা তো দূরের কথা। প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলে নাই অন্য কারো সাথে। সেখানে ক্লাস শেষে তোর জন্য লাইব্রেরিতে থাকতো। শুধু তোর জন্য নোট করতো। এসব আমরা বুঝতাম। তুই ওর সাথে পড়ার জন্য হলেও অনেক সময় কাটাতি। আমরা ভাবতাম তোদের রিলেশন চলে। কিন্তু তুই সবার সাথেই এতো ফ্রেন্ডলি ছিলি বলে আমরা বুঝে গেলাম রিলেশন নেই। যখন তোকে কেউ প্রপোজ করতো, কলেজের ব্যাচমেট বা কলেজ সিনিয়র বা কলেজ লাগোয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছেলেগুলো। তখন তুই বলতি তোর বিয়ে হয়ে গেছে। তোর চঞ্চলতা সবার চোখেই উন্মোচিত করতো সত্যটা। বিবাহিতা মেয়েরা মোটেও এমন নয়। যখন আবার তোকে ডিস্টার্ব করতো তখন নীরব ওদের ম্যানেজ করতো। তুই ওর গার্লফ্রেন্ড বলে পরিচয় দিয়ে তোকে ডিস্টার্ব করতে না করতো। এতে নাকি তোদের সম্পর্কে ঝামেলা হচ্ছে। তাই ওই ছেলেগুলো তোকে আর কিছু বলতো না। তখন বুঝলাম আসলেই নীরবের তোর প্রতি আলাদা একটা টান আছে। অন্য কারো জন্য তো এমন করতো না। তবে নীরব আমার সহ কলেজের অনেক মেয়ের ক্রাশ ছিল। কিন্তু তার মাঝে নওমির কথা তোর মনে আছে কিনা জানি না। তবে একবার নীরবকে প্রপোজ করে বসে নওমি। নীরব রিজেক্ট করে এবং সাথে এটাও বলে যে ও তোকে ভালোবাসে। এরপর থেকে আমরা সবাই হান্ড্রেড পারসেন্ট শিউর হলাম নীরব মায়াবীকে ভালোবাসে। আর আজ যখন উৎস আমায় এখানে নিয়ে এলো ওর বাসা দেখে ভাবলাম তোদের বুঝি বিয়ে হয়েছে। নীরবের প্রেম বুঝি স্বার্থক। এখন শুনি ও তোর দেবর? সত্যি বুঝতে পারছি না কিছু।
সুচির বলা কথা গুলো শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছি সবটা। এমন কিছুই না। আমরা ভালো বন্ধু। এখনো তাই। এসব বলে, নিবিড় এর সাথে পাঁচ বছর প্রেম করেছি বললাম। তা কলেজে থাকতেই শুরু হয়েছিল। কিভাবে প্রেম, প্রেম থেকে পরিণয়ের গল্প শুনিয়ে দিয়েছি। আড়স্থ করেছি ওর আর উৎসের মিলন ঘটানোর দায়িত্ব আমার। সন্ধ্যার নাস্তা সেরে উৎস সুচিকে পৌঁছে দিতে চলে গেল। কিন্তু নিজের মনে একটা উটকো চিন্তা আমায় ঘায়েল করছে……. নীরবের সাথে আমায় কথা বলতেই হবে।
চলবে………….