#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি,০২,০৩
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২)
সরু রাস্তার আনাগোনা হওয়ায় তিহিদের বাসা থেকে বেশ অনেকটা আগেই ইশাদকে গাড়ি থামাতে হয়েছে। এই জায়গাটা সে এর আগেও কয়েকবার এসেছে। ঠিক এই তিন রাস্তার মোড়ের সামনে দাঁড়িয়ে কাটিয়ে দিয়েছে ঘন্টার পর ঘন্টা একজনকে দেখার আসায়। কখনো রাস্তার ধার ধরে এগুনোর সাহস হয়নি। ভাবতেই ইশাদের ঠোঁটগুলো প্রশস্ত হয়ে এলো। কিন্তু আজ সে এখানে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়াবে না,আজ সে একজনকে নিতে এসেছে,হয়তো এটা তার প্রথম নিতে আসা কিন্তু শেষ নয়,আর কখনো শেষ হতেও দিবে না। গাড়িটা সাইডে পার্কিং করেই একটা রিকশায় চেপে বসল ইশাদ!
দরজায় নকের শব্দ পেয়েই বারো কী তেরো বছরের একটা মেয়ে দরজা আটকে দাঁড়াল। ঠোঁট দুটো বেশ ফাঁকা হয়ে উপরে আর নিচে ঝুলে আছে। চোখ দুটো কিছুটা আগের তুলনায় বড়! মেয়েটির মুখের হা’কে আরেকটু বড় করার জন্যই হয়তো ইশাদ ওর গালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে নিয়ে বলল,
“আমাকে বিয়ে করবে মিহিরানি?”
ইশাদের ইচ্ছে পুরণ করতেই যেন বাচ্চা মেয়েটি মুখের হা’য়ের পরিমাণ আরেকটু বাড়িয়ে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে ইশাদের দিকে। ইশাদ আর নিজের হাসি চেপে রাখতে পারেনি,বেশ শব্দ করে হেসে উঠতেই মিহি মুখটা ভাবুক ভঙ্গিমায় বলল,
“আপনি সেই ভাইয়াটা না? ঐ যে আমার স্কুলের সামনে আপু আমাকে বকছিলো,আর আপনি মিটমিট করে হাসছিলেন?”
ইশাদ মিহির দিকে কিছুটা ঝুকে এসে,ওর গাল টেনে বলল,
“না তো,কিন্তু সেই ছেলেটি আমার মতোই দেখতে।”
“তাই?”
“তুমি জানো। বললে না তো আমাকে বিয়ে করবে নাকি?”
মিহি নিজের ভাবুক চেহারা বদলে ফেলেছে,মুখে কিছুটা বিরক্তভাব নিয়ে বলল,
“ইশ! আমার বয়েই গেছে আপনার মতো সুন্দর ভাইয়াকে বিয়ে করতে। আমি তো একটু কম সুন্দর ভাইয়াকে বিয়ে করব। তাহলেই তো সে আমাকে বেশি বেশি ভালোবাসবে।”
“আমি বেশি সুন্দর?”
“হুম!”
“কি করে বুঝলে?”
“এইযে আপনার নাকটা এতটা লম্বা। আমার আম্মু সব সময় বলে যার নাক লম্বা আর খাড়া সেই সব থেকে সুন্দর মানুষ!”
“নাক লম্বা আর খাড়া হলেই সুন্দর? আর কিছু লাগবে না?”
” না।”
” তাহলে তোমাকে বিয়ে করতে হলে কি আমার নাক কেটে আসতে হবে?”
“হুম!”
“”আচ্ছা,তোমাকে বিয়ে করার জন্য নাহয় নাকটা কেটেই আসব। কিন্তু তোমার বোনকে দেখছি না যে,কোথায় সে?”
“আপু তো ঘুমাচ্ছে।”
ইশাদ মিহিকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। দু’কামরা বিশিষ্ট একটি ছোট ফ্লাট। ছোট্ট ডাইনিংও আছে। কিন্তু আশেপাশে রান্নাঘর দেখতে পাচ্ছে না। তিহিরা এখানে ভাড়া থাকে প্রায় ৪-৫ বছর হবে। ওর আম্মু সালেহা বেগম বর্তমানে একটি গার্মেন্টেসে কর্মরত।
ইশাদ ধীর পায়ে তিহির রুমের দিকেই এগুচ্ছে। ছোট রুম তার মধ্যে একটি দুজনের চৌকি। পাশেই একটি পড়ার টেবিল,যাতে বেশ কয়েকটি বই পরপর সাজিয়ে রাখা হয়েছে। একটি আলনাও আছে,সেখানে গোটা কয়েক জামাকাপড় ভাঁজ করা। খুব স্বল্প জিনিসেও সব কিছু কেমন পরিপাটি লাগছে। মনে হচ্ছে এর থেকে বেশি জিনিস হলেই বরং বেমানান লাগতো।
চৌকিতে তিহি ডানদিকে কাত হয়ে কাচুমুচু হয়ে শুয়ে আছে,অর্ধেক শরীর তার কাথা দিয়ে ঢাকা। সারারাত এপাশ-ওপাশ করতে গিয়ে চুলগুলো বেখেয়ালি হয়ে আছে,উশকো-খুশকো হয়ে তিহির মুখেও পড়ে আছে। ফ্যান চলছে ফুল স্পিডে। সেই বাতাসে চুলগুলো বারবার নড়ে উঠছে।
ইশাদ তিহির মাথার কাছটাতে বসল। এতো স্পিডে ফ্যান চললেও মেয়েটা ঘেমে নেয়ে আছে,চিকন ঘন কালো ব্রু দুটোর পাশ ঘেষে ঘামের আানাগোনা। চোখদুটো বন্ধ অবস্থায়ও নড়েনড়ে উঠছে,ফর্সা হলুদ বর্নের বা’গালটায় চুল দিয়ে ঢেকে আছে,নাকের পাতলা পাতাদুটোও ঘামে ভিজে আছে,আর একটু পরপর কেঁপেকেঁপে উঠছে। সব মিলিয়ে এই মুহুর্তে তিহির ঘুমন্তকন্যা সাজ,বেশ আনন্দ দিচ্ছে ইশাদকে। মনে হচ্ছে এমন একটি ঘুমন্ত কন্যার ঘুমন্ত মুখটা দেখার জন্যই তো তার জন্ম!
ইশাদের ইচ্ছে হচ্ছে তিহির মুখের চুলগুলো সরিয়ে আরেকটু ভালো করে দেখে নিতে,মন ভরে দেখে নিতে,যাতে তার বার বার এই ঘুমন্ত কন্যা মুখ দেখার পিপাসা না পায়। কিন্তু আসলেই কি তাই? একবার দেখলেই তার পিপাসা মিটে যাবে? নাকি আবার নতুন করে নতুন দিনে,নতুনসাজে,নতুন রুপে দেখার নতুন পিপাসা জন্ম নিবে? ইশাদ হাত দিয়ে তিহির বেখেয়ালি চুলগুলো সরাতে গিয়েও থেমে গেল। নিজের মুখটা তিহির মুখের কাছে এনে আলতো করে ফুঁ দিতেই,তিহি চিকন সুরে গোঙিয়ে উঠে! কপাল কুঁচকে নিয়ে বা’হাতের বৃদ্ধা আঙুলটা মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিল,আর ইশাদকে অবাক করে দিয়ে তা বাচ্চাদের মতো চুষতে চুষতে আবার ঘুমের রাজ্যে পাড়ি!
ইশাদ অবাক, এতোটাই অবাক যে সে পলকহীনভাবে তিহির হাত চুষা দেখে যাচ্ছে। কয়েক মিনিট না পেরুতেই পুনরায় শব্দ করে হেঁসে উঠল ইশাদ!
ইশাদের হাসির শব্দে তিহি চট করে চোখ মেলল। মুখে তখনও তার আঙুল। আঙুল মুখে রেখেই ইশাদের হাসির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের চাহনি যত গভীর হচ্ছে ঠোঁট দুটোর কোণ তত লম্বা হয়ে প্রশস্ত হচ্ছে। হুট করেই তিহি আদুরে গলায় বলল,
“আপনি এতো সুন্দর করে হাসেন কেন? আমার কেমন
কেমন জানি লাগে।”
ইশাদ হাসি থামিয়ে উৎসাহ নিয়ে বলল,
“কেমন লাগে?”
ইশাদের প্রশ্ন যেন তিহি শুনেইনি এমন একটা ভাবলেশ ভঙ্গিমাই আবার বলল,
” আপনার মুখের এই যে খোচা খোচা দাড়িগুলোও কী সুন্দর! দেখলেই আমার ছুঁতে ইচ্ছে করে।”
ইশাদ ঠোঁটে হাসি রেখে নিজের গালটা তিহির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখি একটু ছুঁয়ে দাও তো,আমিও দেখি তুমি কেমন করে ছোঁও!”
“ছুঁবো?”
“হুম!”
তিহি এইবার মুখ থেকে বৃদ্ধা আঙুল সরাল। হাতটা ইশাদের গালে আলতো করে ছুঁয়ে বলল,
“আপনি সবসময় এমনভাবেই থাকবেন,এই দাড়িগুলোকে কখনো বড়ও হতে দিবেন না আর ছোটও না।”
ইশাদ তিহিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিহি এসে বলল,
“আপু,তুই এখনো উঠিসনি?”
তিহি চোখ ঘুড়িয়ে মিহির দিকে তাকাতেই সে যেন বেক্কেল হয়ে গিয়েছে। একবার মিহির দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার ইশাদের দিকে। চট করেই ইশাদের গাল থেকে নিজের হাতটা সরিয়ে নেয়। হুড়মুড় করে বিছানা ছেড়ে উঠে কাঁথা দিয়ে নিজেকে পুরো ঢেকে ফেলে৷ কাঁথার ভেতর থেকেই কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
“মিহি,আমার সামনে আমি একটা লোককে বসা দেখতে পেয়েছি,তুই কি তাকে দেখতে পাচ্ছিস?”
তিহির কথায় ইশাদ আবারও শব্দ করে হেসে উঠে মিহির উদ্দশ্যে বলল,
“মিহি,আমিও আমার সামনে কাঁথা মোড়ানো একটা মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি,তুমি কি দেখতে পাচ্ছো?”
দুজনের প্রশ্নের উত্তরে মিহি কি উত্তর দিবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে তো তাদের দুজনকেই দেখতে পারছে। তাহলে সে কোনটা বলবে? আর তারা কেন তাকে দেখতে পারছে না? একজন শুধু আপুকে দেখতে পারছে, আরেকজন সুন্দর ভাইয়াকে। তার মানে কি আমি এখানে নেই?
ইশাদ হাসি থামিয়ে বসা থেকে উঠে পড়েল। কিছুটা গভীর হয়ে বলল,
“আমার সোনামাকে তোমার ৮ টা থেকে পড়ানোর কথা এখন কয়টা বাজে? আমি বাইরে অপেক্ষা করছি। তোমার হাতে শুধু মাত্র ২০ মিনিট আছে তিহি। চট করে রেডি হয়ে আসো। আমি কিন্তু আমার মেয়ের ব্যাপারে খুবই স্ট্রিক্ট!”
তিহি ইশাদের পাশে বসে আছে,ড্রাইভিং সিটে ইশাদ। দুজনের পাশেই জানালার কাচটা নামানো। সকালের মৃদু বাতাসে দুজনেই নানা ভাবনায় ব্যস্ত। এই ব্যস্ততার মধ্যেই ক্ষণে ক্ষণে হেসে উঠছে ইশাদ।
তিহি তো লজ্জায় ইশাদের দিকে তাকাতেও পারছে না। ছি! ছি! ছি! আমি এমন জাগ্রত অবস্থায় কিভাবে এমন অকান্ড করে ফেললাম? ড্যাবড্যাব করে উনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম? ইশ! ভাবলেই কেমন কেমন জানি লাগছে,তার মধ্যে উনার দাড়িতেও হাত দিয়েছিলাম? ছি! এমন বিবাহিত পুরুষ তাও আবার বাচ্চা সংরক্ষিত পুরুষের দিকে তাকিয়ে আমি কিভাবে বেহুশে চলে গেলাম? আল্লাহ! এতো লজ্জা আমি কোথায় রাখব? একটা বড় ব্যাগ কিনতে পারলেও কিছুটা ওখানে রাখা যেতো।
ইনাকে পড়াতে বসে তিহি আরো বিব্রতের মুখোমুখি। তখন থেকে পুচকি দুটো হাত দিয়ে দুগাল চেপে ধরে তিহির দিকে তাকিয়ে আছে,সাথে ইশাদও। যেন একজন আরেকজনকে কপি করছে। এই বাপ,বেটি কী দেখছে এতো? তিহি অসস্থিতে কি করবে বুঝতে পারছে না৷ এতো বড় বাড়িতে পড়াতে এসে যে এতো ঝামেলার মুখোমুখি হবে ভাবতেও পারেনি! বাচ্চাটা দেখতেও যেমন কিউট তার উপর বড় বাড়ির মেয়ে,কিছু বলতেও পারছে না। তার মধ্যে এই লোকটা কেন এমন করছে সেটাও বুঝতে পারছে না। নিজের অসস্থি কাটাতেই হাত দিয়ে কয়েক বার চুল ঠিক করল,আবার জামাকাপড় টানাটানি করল।
ইনা গালে হাত দিয়েই আদুরে সুরে বলল,
“তুমি আমার প্রাইভেট মামনি না হয়ে সত্যি মামনি কেন হলে না,সুন্দর মামনি?”
তিহিকে কিছু বলতে না দিয়েই পাশ থেকে ইশাদ বলে উঠলে,
“হুম,ঠিক বলেছো সোনামা!”
তিহি ভ্রূ কুঁচকে ইশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“মানে?”
“না মানে,আমি বলতে চাচ্ছিলাম যে আমি কেন ইশাদ না হয়ে ইনা হলাম না?”
তিহি এবার ভ্রূর সাথে কপালটাও কুঁচকিয়ে নিয়ে বলল,
“কিহ!”
ইশাদ তিহির কিহ! শব্দটাই একটু নড়েচড়ে বসে,গলাটা পরিষ্কার করার বাহানায় হালকা কেঁশে নিয়ে ইনার উদ্দশ্যে বলল,
“সোনামা,তোমাকে আজকে আমি আমার স্বপ্নের কথা বলিনি,তুমি শুনতে চাইবে না?”
ইনা চট করে তিহির থেকে মুখ সরিয়ে ইশাদের তাকিয়ে বলল,
” আবার স্বপ্ন? তুমি কি আবার রুপকথার দেশে গিয়েছিলে,বাবাই?”
“হুম! এবার তো আমি আগের বারের চেয়ে আরও সুন্দর রুপকথার দেশে গিয়েছিলাম,আর সেখানে এক ঘুমন্ত রাজকুমারীর দর্শন করে আসলাম।”
ইনা বেশ কৌতুহলি হয়ে বলল,
“সত্যি? কী কী দেখলে বাবাই?”
ইশাদ একটু গম্ভীর ভঙ্গিমায় বলল,
” দেখলাম যে একটি সোনার পালঙ্কে এক সুন্দরী রাজকন্যা ঘুমাচ্ছে। গায়ে তার কাঁথাও ছিলো। আর জানো,সে কিভাবে ঘুমাচ্ছিল?”
ইনার মতো এবার তিহিও বেশ কৌতুহলি চোখে তাকিয়ে আছে ইশাদের দিকে,বুকটা তার ধকধক করছে,কিভাবে ঘুমিয়েছি ছিলো সেই রাজকন্যা? কেন মনে হচ্ছে উনি আমাকে ইঙ্গিত করেই বলছেন?
” কিভাবে?”
ইনা প্রশ্ন করতেই ইশাদ ওকে নিজের কাছটাতে চেপে নিয়ে বলল,
” ঠিক তোমার মতো করে,তোমার মতো সেই রাজকন্যাটিও ঘুমের ঘোরে মুখে আঙুল চুষে ঘুমাচ্ছিল।”
ইনা চোখগুলো বড়বড় করে অবাক আর খুশি নিয়ে বলল,
“সত্যি বাবাই?”
” হুম,আমি কি আমার সোনামাকে কখনো মিথ্যে বলি?”
ইনা এবার অভিমান সুরে বলল,
” তুমি তোমার স্বপ্নে আমাকে কেন নিলে না,বাবাই? এখন তো আমার চুষনী মামনিকেও চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।”
ইশাদ ইনার কাছ থেকে চোখ সরিয়ে তিহির দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো,ও শুধু অবাকই নয় সাথে রাগে ফেটে যাচ্ছে,তবে এই রাগের সাথে লজ্জাও আছে!
ইশাদ ইনাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তিহির পাশ ঘেষে চলে যাওয়ার আগে বলল,
” তোমার চুষনি মামনি কিন্তু তোমার প্রাইভেট মামনির মতোই দেখতে। তুমি চাইলে উনাকেও চুমু খেতে পারো!”
কপালে কারো আদুরে চুমুর ছোঁয়া পেয়ে চোখ মেলে ইশাদ। চোখ মেলতেই ইনার কান্না মাখা মুখটি দেখে, ওকে নিজের বুকের সাথে জড়িয়ে নিয়েছে। উফ! স্বপ্ন থেকে আমি কেন বেরোলাম? যে বাস্তবে তিহি নেই সে বাস্তবে আমি থেকে কী করবো? তার থেকে তিহিময় সেই রঙিন স্বপ্নে ডুবে থেকেও যে অনেক সুখ! স্বপ্নগুলো এমন ক্ষনাস্থায়ী কেন হয়?
“এভাবে হুট করে অজ্ঞান হয়ে গেলি কিভাবে, ইশাদ? তুই তো খুব ভালো করেই জানিস,তোর শ্বাসকষ্ট আছে। তারপরও তুই নিজের সাথে ইনহেলারটা কেন রাখিস না? এটা তুই কেমন ডক্টরি পড়া শিখলি? যে নিজের শরীরের যত্ন করতে পারে না সে অন্যের শরীরের কি যত্ন করবে? একবার কি ভেবে দেখিসনি,তুই ছাড়া তোর মা,আমি আর এই বাচ্চা মেয়েটার কি হবে? কয়েক ঘন্টার তফাতেই ওর মুখটা কেমন শুকিয়ে গিয়েছে দেখেছিস? সারাটা রাত একটুও ঘুমায়নি,শুধু তোর পাশে বসে কান্না করেছে। ওকে তুই ছাড়া আর কেউ কোনো কথা শুনাতে পারে? নাকি পারে ওর কান্না থামাতে!”
ইশাদ ইনাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলেছিল।বাস্তবের এই সকালের রোদের তাপটা যে তার কাছে দুর্বিষহ লাগছে।এমন একটা সকাল,যে সকালে তার তিহি পাখিটা তার নয় অন্য কারো মুখ দেখে জেগে উঠবে এটা কি সে কখনো কল্পনাও করেছিলো?
জনাব জমিল সাহেবের কণ্ঠ পেয়ে আবার চোখ মেলতে বাধ্য হয় ইশাদ।
” তুমি কখন এলে,বাবা?”
জমিল সাহেব এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে থাকলেও এবার ছেলের পাশে এসে বসেছেন। না অভিমান,না রাগ না ধমক এমনি এক কণ্ঠে বললেন,
“শেষ সাতদিন ধরে,তুই আমার কল রিসিভ করছিস না। এদিকে তোর আম্মুর ফোনে কল দিয়ে তোকে চাইলেও তুই কথা বলছিস না। তোর আম্মুও ঠিক করে কিছু বলতে পারছে না। এখানে আসলে হচ্ছে কি? আর যা হয়েছে সেখানে আমি কী করেছি? আমার সাথে কেন কথা বলছিস না? তোর কি মনে হয় এতো টেনশন নিয়ে আমি এখনো সৌদি পড়ে থাকব? টাকার পেছনে ছুটতে ছুটতে আমার জীবনের অনেক আনন্দময় সুখ আমি হারিয়ে ফেলেছি,আর ছুটতে পারবো না। আমার এখন তোদের কাছে থেকে সুখের প্রয়োজন।”
জমিল সাহেব ছেলের মাথায় হাত রেখে আবার বললেন,
“তুই শেষ যেদিন আমার সাথে কথা বলেছিলি,সেদিনও তো অনেক খুশি ছিলি। হঠাৎ কি এমন ঝড় হলো যে তুই এমন ভেঙে পড়েছিস?”
ইশাদ,বাবার হাতটা মাথা থেকে সরিয়ে এনে নিজের বুকটাতে রেখে বলল,
” এই জায়গাটা শুন্য হয়ে গেছে,বাবা। তিহি অন্য কারো হয়ে গেছে। অন্য কারো বুকে ঠাঁই করে নিয়েছে।”
জমিল সাহেব চোখ,মুখ শক্ত করে বললেন,
” কী! ঐ মেয়েটা তোকে ঠকিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে? এতো বড় স্পর্ধা?”
“না,বাবা। ও আমাকে নয়,আমি ওকে ঠকিয়েছি! ও আমাকে নয়,আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়েছি! ও আমাকে নয়,আমি ওকে কষ্ট দিয়েছি! ও আমার নয়,আমি ওর বিশ্বাস ভেঙে দিয়েছি! ও আমার নয়,আমি ওর হৃদয়ে ব্যথার দাগ কেটে দিয়েছি!
চলবে
#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৩)
জমিল সাহেব ছেলের কথায় স্তম্ভিত! কি বলছে কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না। একটু আগেও ছেলের কষ্টে যে মুখটাকে ছোট করে ফেলেছিল সেই মুখটাও এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে,তবে তা বেশিক্ষন হয়নি,চেহারায় ফুটে উঠছে নানা প্রশ্ন।
সেই প্রশ্ন ঝুড়ি থেকে সব থেকে জরুরি প্রশ্নটাই নিজের ছেলের উপর ছুড়ে দিলেন,
“কিন্তু কেন, ইশাদ? তুমি কেন এমন করলে? আমি এত দিনে তোমার কাছে তিহিকে নিয়ে যতটুকু বুঝেছি ও যথেষ্ট ভালো মেয়ে। তার থেকেও বেশি ভালো,তুমি ওর মধ্যে সুখ খুজে পেয়েছিলে,পেয়েছিলে এক খুশির সিন্দুক। তাহলে কী এমন হলো যে তুমি নিজের বুকে পাথর চাপা রেখে, তোমার সেই খুশির সিন্দুকটি সাগরে তলিয়ে দিলে? এমনও তো নয় যে এটা তুমি চেয়েছিলে,যদি এমনটাই চায়তে তাহলে তুমি আজ বিছানায় শুয়ে থাকতে না। সবকিছু ছেড়েছুড়ে এভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিতে চাইতে না। কেন করেছিস এমন? তিহি কি এমন অপরাধ করেছিলো যে,তুই ওকে এতো বড় কষ্ট দিলি?”
বাবার হাতটা বুকের মধ্যে শক্ত করে চেপে ধরে এক শব্দহীন কান্নায় ভেঙে পড়েছে ইশাদ! চোখ বেয়ে ঝড়ে পড়ছে হাজারও কষ্টের ফোঁটা। কিন্তু এই ফোঁটা কি তার কষ্ট কম করতে পারবে? না কখনোই পারবে না!
“তুমি আমাকে এ প্রশ্নটা করো না,বাবা। আমি তোমার কাছে কখনো কিছু লুকোইনি,আজ লুকোবো। আর আমি জানি তুমি আমাকে লুকোতে সাহায্য করবে। সরি বাবা! আই এম রিয়েলি সরি!”
সংসারিক জীবনের অর্ধেকের বেশি সময় জমিল সাহেব বাইরে কাটিয়েছেন। তাই ছেলের সাথে ততটা সময় একসাথে না কাটালেও যতটুকু কাটিয়েছেন,সেখানে ইশাদকে এতোটা কষ্ট নিয়ে কাঁদতে দেখেননি। খুব কঠিন সময়গুলোতেও সে যথেষ্ট ঠাণ্ডা আর বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে এসেছে। কিন্তু এই একটা বিষয়ে সে এতো কেন ভেঙে পড়েছে কিছুতেই বুঝতে পারছেন না। এমন কি কারণ থাকতে পারে যার জন্য দুটো পাখি আজ দু’দিকে পাখা মেলেছে?
জমিল সাহেব ছেলের চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,
“বাবার সামনে ছেলে কাঁদলে বাবার কতটা কষ্ট পেতে পারে তা তোমার বুঝা উচিত, ইশাদ! তুমি যখন চাইছো এই বিষয়টা আমার কাছ থেকে লুকোবে। তাহলে বেশ! তুমি লুকোও। আমি তোমাকে বাধা দিবো না। তবে হ্যাঁ,তোমাকেও আমার কথা শুনতে হবে। আমার কথাও তোমাকে রাখতে হবে।”
“কি কথা?”
“আগে তুমি ফ্রেশ হয়ে আসো। আজকে আমরা দুজন একসাথে ভাত খাবো। অনেক দিন হলো তোমার মায়ের হাতের রান্না খাই না। খুব ক্ষিদে পেয়েছে আমার।”
ইনাকে খুব সাবধানে বিছানায় শুয়িয়ে রেখে উঠে পড়ল ইশাদ। সারা রাত হয়তো ওর পাশে বসে থেকে কেঁদেছে,ঘুমোইনি একটুও। ইনার কপালে একটা চুমু খেয়ে মনে মনে বলল,’আমার পাগলি মেয়েটা! এখন তো তোর ভালোবাসায় আমি বাঁচবো।’
ওয়াশরুমে ঢুকে ঝরনার নিচে দাঁড়িয়ে কলটা ছেড়ে দিল ইশাদ। চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠেছে তিহির সেই ভীতু মুখটি!
ইনাকে ইশাদের রুমে পড়াতে হয় তিহির। ইশাদের বিছানার মাথার কাছটার বা সাইডেই একটি ছোট টেবিল আর দুটো চেয়ার। যদিও বা সেখানে খুব একটা বসতে চায় না ইনা। ও সব সময় বিছানায় শুয়ে একটা বালিশের উপর দুটো হাতের কনুই ভাজ করে ভর রাখবে। তারপর দুহাতের কব্জি দুটো একসাথে করে হাতের ভাজে নিজের থুতনিটা রাখবে। হাতের আঙুল দিয়ে গালদুটো চেপে ধরে বেশ কিছুক্ষন তিহিকে দেখে নিয়ে তারপর বলবে,’প্রাইভেট মামনি,আমার দেখা শেষ,এখন তুমি পড়া শুরু করতে পারো!’
প্রথম প্রথম এমন দৃশ্যে বেশ অসস্থি কাজ করলেও এখন এটাতে তিহি অভ্যস্ত,বেশ উপভোগ ও করে,মাঝে মাঝে ইনার নাক টেনে দেওয়া,গাল টেনে দেওয়া আর চুমু খাওয়াও হয়৷ এতে যেন ইনা আরও বেশি খুশি,খিলখিলিয়ে হেঁসে বলবে,’তুমি তো আমার দুষ্টু মামনি,তোমাকে আবার চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।’ এতো কিছুর মাঝেও ইশাদের উপস্থিতিটা বেশ লাজুকতা সৃষ্টি করে তিহির। মাঝে মাঝে ইনার পাশে সেও উপুত হয়ে শুয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে। ইনার নানা বাচ্চামীর কথার সাথে তাল দিয়ে তিহিকে ভীষণ অসস্থিতে ভরে দেয়। তখন তিহির ইচ্ছে হয় ইনার মতো যদি উনার গালটাও টেনে দেওয়া যেতো!
তিহি মিটিমিটি হাসি আর ভাবনা নিয়ে ইশাদের বাসায় ঢুকেছে। ওর রুমটাতে ঢুকতেই দেখে আজ ইনা তার জন্য অপেক্ষা করছে না। বিছানাও খালি। মেয়েটা গেলো কোথায়? তিহি পায়ের পাতাটা ঘুরিয়ে চলে যেতে নিলে ইশাদের কণ্ঠ শুনতে পেল,
” চুষনি কন্যা,আপনি চলে যাচ্ছেন কেন? আপনি চলে গেলে আমার তোয়ালেটা কে দিবে?”
তিহি আবার আগের জায়গায় ঘুরে সামনে তাকিয়ে আছে। ওয়াশরুমের দরজাটা একটুখানি মেলে তা দিয়েই মাথাটা বের করে আছে ইশাদ। পুরো শরীরে তার সাবান মাখা,চুলেও কি সাবান মেখেছে নাকি শ্যাম্পু?
” কি হলো দাঁড়িয়ে আছো যে? তুমি কি ভাবনাতেও আঙুল চুষা শুরু করো?”
তিহি এবার বেশ ক্ষেপে গেল। চোখ,মুখ কুঁচকিয়ে ইশাদের কাছটাতে তেড়ে এসে বলল,
” আমি চুষনি কন্যা?”
” না তো,আপনি ফিডার কন্যা!”
কথাটা শেষ করেই ইশাদ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। অট্টহাসির শব্দে তিহির রাগ আরও বেড়ে যাচ্ছে। রাগে বড় বড় নিশ্বাস টানছে। সাথে সাথে পায়ের তলাটাও চুলকুনি শুরু করে দিয়েছে। এদিকে ইশাদের হাসি থামার কোনো গন্ধ না পেয়ে তিহি ডান হাতটার শাহাদাৎ আঙুল উচিয়ে ইশাদের দিকে ধরে বলল,
” দেখুন মিঃ ইশ! ভালো হচ্ছে না কিন্তু। আপনাদের এখানে পড়াতে আসি বলে আপনি যা খুশি তাই…”
তিহির কথা শেষ হওয়ার আগেই ইশাদ হাসি থামিয়ে ফেলেছে। বেশ কৌতুহলি হয়ে বলল,
” কি বলে ডাকলে আমায়?”
তিহি নিজের হাতটা গুটিয়ে নিয়ে কাচুমুচু হয়ে বলল,
” কই কিছু না তো।”
ইশাদ দরজাটা আরেকটু খুলে তিহির দিকে আরেকটু ঝুকে এসে একটু শক্ত গলায় বলল,
” বলো কি বলেছো। মিথ্যে কথা বললে কিন্তু তোমার কঠিন শাস্তি পাওনা হবে!”
তিহি ফ্যালফ্যাল করে ইশাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ইশাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে সে কোনো ক্লাসে বসে আছে, যে ক্লাসের টিচারটা খুবই কড়া,কথায় কথায় ধমক আর একটু এদিক ওদিক হলে বারি। কিন্তু এটা কি সম্ভব এখানে তো আমি টিচার আর ইনা আমার স্টুডেন্ট,এর মধ্যে ইশাদ কী করে টিচার হয়ে গেলো? আর উনিই বা আমাকে শাস্তি দিবেন কেন? কেমন কঠিন শাস্তি দিবেন? বেত দিয়ে মারবেন নাকি?
“কি হলো বলছ না কেন?”
ইশাদের পুনরায় কণ্ঠে হালকা কেঁপে উঠে তিহি। ইশাদের দিকে তাকিয়েই অস্পষ্ট স্বরে বলল,
” মিঃ ইশ!”
” কী?”
তিহি এবার বেশ ঘাবড়ে যাচ্ছে। মানুষ সাধারনত তিনটি কারনে ঘেমে উঠে। ১.অতিরিক্ত গরম ২.অধিক টেনশন আর ৩. খুব ভয়ে ঘাবড়ে গেলে। প্রথমটা সিজন অনুযায়ী হলেও বাকি দুটো সিজনের কোনো তোয়াক্কা করে না। যখন তখন ঘামিয়ে দিতে পারে! তিহি এই মুহুর্তে তিন নাম্বারে অবস্থান করছে। ভেতরে ভেতরে নানাভাবে নিজেকে বকে যাচ্ছে৷ এত বড় একটা মানুষ,এমন একটা মানুষকে সে কিভাবে এমনভাবে রাগ দেখাতে গেল? তার মধ্যে আবার নামের শর্টকাট করতে গেছে। এখন কী হবে? এতো বড় মানুষটা নিশ্চয় চায়বে না তার মতো এমন গরীব মানুষের মুখে নিজের নামের শর্টকার্ট নাম শুনতে! উনারা চাইবে নামের সাথে অতিরিক্ত কিছু শব্দ যেমন,স্যার,জনাব ইত্যাদি যোগ করে নামটাকে আরো বড় করে সম্বোধন করাতে।
তিহি নিজের বোকামীর জন্য ইশাদের দিকে তাকাতে পারছে না। ভয়ে অনেক আগেই ওর দিক থেকে চোখ সরে মেঝেতে চলে এসেছে। যতটা পারছে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
ভয় কাতুরে মুখ নিয়েই আবার বলল,
” সরি,আমি ভুলে বলে ফেলেছি। আমি তো আপনাকে বলতে চাইনি অন্য কাউকে বললতে…”
তিহি কথা শেষ করার আগেই ওকে টুপ করে ওয়াশ রুমে টেনে নিয়ে এসেছে ইশাদ। ঝরনাটা ছেড়ে দিয়ে ওকে ঠিক পানির মাঝখানে দাঁড় করিয়ে বলল,
” তোমাকে বলেছিলাম না আমার বাসায় আসলে তোমার ঘামা নিষেধ? তাও কেন ঘেমেছো তুমি?”
হুট করে ইশাদ এমন কিছু করে বসবে ভাবতেই পারিনি তিহি। ঝরনার জলধারা বেয়ে পড়ছে পুরো শরীরে। ভিজে যাচ্ছে তার পরোহিত হলুদ জামাটি। তিহি নিজের শুকনো জামাটিকে ভেজার হাত থেকে রক্ষার জন্য পানির নিচ থেকে সরতে চাইলে ইশাদ ওর হাত চেপে ধরে। ওর দুবাহু চেপে ধরে নিজেও পানিতে ভিজতে থাকে।
” বলো কেন ঘেমেছো তুমি? আমার নিষেধকে তুমি অগমান্য করেছো। এর জন্য তোমাকে শাস্তি পেতে হবে,কঠিন শাস্তি!”
ইশাদের এক একটা পদক্ষেপে তিহি ঘাবড়ানোর চরম পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। ইশাদের এতো কাছে চলে আসবে এটা তো ও কল্পনায়ও ভাবেনি। তাহলে কেন এতো কাছে চলে এসেছে? ভয়ে তিহির বুকের ভেতর চলছে নানা ধুকপুকুনির শব্দ। মনে মনে বলছে,’আমি কি ইচ্ছে করে ঘেমেছি? আপনার জন্যইতো ঘেমেছি,আপনি কেন আমার উপর রাগ দেখালেন? কেন অমন শক্ত কন্ঠে কথা বললেন? আপনি জানেন না মেয়েদের সাথে শক্ত কণ্ঠে কথা বলতে হয় না? কিন্তু মুখে বলল,
” সরি আর ঘামব না। ছেড়ে দিন প্লিজ! আমি আর কখনও এমন ভুল করবো না।”
” পরে কী করবে সেটা পরের ব্যাপার। এখন যে ভুল করেছো তার শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে।”
তিহি চোখ বন্ধ করেই হতাশা কণ্ঠে বলল,
“কি শাস্তি?”
ইশাদ তিহির বাহু ছেড়ে দিয়ে ওর মুখটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ওর দিকে চেয়ে আছে। ওর খুব কাছটাতে এসে দাঁড়িয়েছে। তিহির মুখটা নিজের দিকে টেনে এনে বলল,
” তোমাকে মিসেস ইশ হতে হবে।”
“হুম।”
” তুমি এমনভাবে হুম বলছো যেন তুমি জানতে আমি তোমাকে এখন প্রপোস করবো?”
” হুম!”
ইশাদ তিহির গালদুটো আরেকটু গভীরভাবে চেপে ধরে একটু জোর কণ্ঠে বলল,
” তিহি পাখি,তুমি কি আবার হুশে থেকে বেহুশ হয়ে গেছো? চোখ মেলো,আমি এখনি চোখ মেলতে বলছি!”
ইশাদের ছোট ধমকানিতে যেন তিহির হুশ ফিরে পেল। চট করে চোখ মেলতেই সরাসরি ইশাদের চোখে চোখ পড়েছে। দুজনেই ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছে পানি বেয়ে পড়ায়। কিন্তু এই ঘন ঘন পলকেও দুজন হারিয়ে আছে দুজনকে দেখার নেশায়। হুট করে ইশাদ তিহিকে জড়িয়ে ধরল।ঘোর লাগা কণ্ঠে বলল,
” আমি ভেবেছিলাম,কোনো নতুন সকালে,নতুন সাজে,নতুন রঙে,নতুন শব্দ আউড়িয়ে তোমাকে আমার মনের অনুভূতির কথা জানাব। কিন্তু তোমার ঘামের মারাত্মক গন্ধ আমাকে তা কিছুতেই করতে দিল না। আমার সব পরিকল্পনায় পানি ঢেলে দিয়েছে। আমার ভেতরের ভালোবাসার অভিব্যক্তিগুলোকে আর দমিয়ে রাখতে পারছি না। তিহি,ভালোবাসি আমি তোমাকে। খুব বেশিই ভালোবাসি।বলোনা,হবে আমার মিসেস ইশ!”
ইশাদের ছোঁয়াই যেন তিহি বরফের মতো জমে গিয়েছে। কি বলছেন এসব উনি? আমাকে ভালোবাসে কিন্তু এটা কী করে সম্ভব?
” তিহি পাখি,এভাবে চুপ করে থেকো না প্লিজ! কিছু তো বলো,তোমার নিস্তব্ধতা আমাকে খুব অস্থির করে তুলছে। এই বুঝি ঢেউ হয়ে আছড়ে পরে সমুদ্রের তীর ভেঙে নিয়ে যাবে।”
তিহি বিড়বিড় করে বলল,
” আমি এতো বড় পাপ কিছুতেই করতে পারবো না। ছাড়ুন আমাকে!”
ইশাদের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলো তিহি!
ইশাদ আর বেশিক্ষন পানির নিচে দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। আজ তিহিকে ছাড়া এই ঠাণ্ডা পানিগুলোকেও তার কাছে চুলোয় বসানো ফুটন্ত পানি মনে হচ্ছে।
মরিয়ম বেগম ইশাদের প্লেটে ভাত বেড়ে দিতে ইশাদ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ল। পা বাড়িয়ে চলে যেতে নিলে জমিল সাহেব হেঁকে উঠেন,
” না খেয়ে উঠে যাচ্ছিস যে? কথা ছিলো দুজনে একসাথে ভাত খাবো।”
ইশাদ থমকে গিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা ভেবে বাবার হাতে কয়েকটা ভাত তুলে নিয়ে নিজের মুখে পুড়ে বলল,
” নাও খেয়েছি,আমার একবার তিহিদের বাড়ি যেতে হবে,বাবা। ইট’স ভেরি আরজেন্ট। এসে তোমার সাথে আবার খাব। প্রমিস,এখন আর আটকিয়ো না। তোমরা তো জানো আমি তোমাদের কথা ফেলতে পারি না!”
জমিল সাহেব একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন। ইশাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ফেললে ইশাদ সদর দরজার দিকে এগুল। পেছন থেকে মরিয়ম বেগম চিৎকার করে উঠলেন,
” ইনহেলারটা নিয়ে যা,বাবা।”
ইশাদ পেছন না ঘুরেই থমথমে গলায় বললো,
” যেখানে নিজের ইচ্ছায় নিজের নিশ্বাসকে অন্যের কাছে দিয়েও বেঁচে আছি,সেখানে এই নিষ্প্রান দেহে ইনহেলার কি কাজে আসবে?”
তিহি চোখ মেলতে নিজের মাথার কাছে আধ পাকা চুলের এক বয়স্ক মহিলাকে দেখতে পেল। মুখে তার চিন্তার ছাপ। একজন মাঝ বয়সী লোকের সাথে কথা বলছে। লোকটি বের হতে বয়স্ক মহিলাটি একটু ধমকের সুরে বলল,
” এক রাতেই মেয়েটার একি অবস্থা করেছিস,তাজ? মনে তো হচ্ছে ঠিক মতো দাঁড়াতেও পারবে না। তুই কি একটু মানুষ হবি না?”
পাশ থেকে একটি ঝাঝালো কণ্ঠও শুনতে পাচ্ছে তিহি,
” আমার বউকে আমি যা খুশি তাই করবো,এখানে তুমি কেন কথা বলছো,ফুপি? কে বলেছে তোমাকে আমার রুমে আসতে? আর ডাক্তার আংকেলকে বাসায় ডেকে এনেছো কেন?”
” আর একটা কথা বললে থাপড়িয়ে গাল লাল করে ফেলবো। দিনে দিনে চুড়ান্ত বেয়াদবীতে চলে যাচ্ছিস। ফুপির সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
” আমি বলি।”
তাজ সেখান থেকে প্রস্থান করতে বয়স্ক মহিলাটি তিহির মাথায় হাত রেখে বললো,
” তেমন কিছু হয়নি,একটু বেশি ভয় পেয়ে গিয়েছিলি তো তাই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলি।”
তিহির ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকানো দেখে উনি ঠোঁটে মিষ্টি হাসি নিয়ে বললেন,
” আমি তোর ফুপি শাশুড়ি হই। তুই আমাকে ফুপিমা বলে ডাকিস,কেমন? বেলা তো অনেক হলো,তুই শোয়ে থাক,আমি তোর জন্য খাবারের ব্যবস্থা করে আসি!”
শিরিন বেগম উঠে চলে যেতে নিলে উনার হাতটা টেনে ধরে তিহি। তিহির হাতের উপর নিজের বা’হাতটি রেখে ভরসা মেখে বললেন,
“তাজ চলে গেছে,রাতের আগে আর বাসায় আসবে না। ভয় পাস না,আমি তো আছি।”
শিরিন বেগম চলে গেলে তিহি আসতে আসতে করে উঠে বসার চেষ্টা করল। পুরো শরীরে ব্যথারা দেনিয়ে উঠছে। এতো ব্যথা নিয়ে উঠার সাহস পাচ্ছে না তিহি। তাই আগের ন্যায় শুয়েই ডুকরে কেঁদে উঠল। মনে মনে হাজারও অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে ইশাদকে। ইচ্ছে মতো নিজের বক্তব্য তুলে দিয়ে চারপাশটার হাত বুলাচ্ছে। রাতে ফোনটাতো এখানেই রেখেছিলো,কেউ না সরালে এখানেই থাকার কথা। বালিশের নিচে হাত দিতে নিজের ফোনটা বের করে নেয়। কল লিস্টে ঢুকতে আরেক বার পানিতে ভরে উঠে তার চেখ দুটো। ‘মিঃ ইশ’ লিখা নামটাতে কল দিয়ে কানে চেপে ধরে আছে ফোনটা।
চলবে