#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (৭)
#রোকসানা_রাহমান
“আমার কেন মনে হচ্ছে? সম্মোহন বিদ্যা আপনিও চর্চা করছেন!”
ইশাদের সন্দেহী ও দৃঢ় প্রশ্নে তিহির চোখের পাতা পড়ল। কপাল কুঁচকে বলল,
“মিথ্যা আরোপ দিচ্ছেন কেন? অন্যের উপর দোষ ঢেলে নিজে পরিষ্কার হতে চাচ্ছেন? লাইক নিট এন্ড ক্লিন? এত সহজ নয়। দরকার পড়লে ডাস্টবিন থেকে দুর্গন্ধ এনে আপনার শরীরে মাখিয়ে দেব!”
ইশাদ ঠোঁট টিপে হাসল। বলল,
“আপনি কোনটা সেজেছেন? নিট এন্ড ক্লিন নাকি ডাস্টবিন? দেব ঢেলে একটু দুর্..”
ইশাদ নিজেই নিজের বাক্যটা অসম্পূর্ণ রেখে দিল। ততক্ষণে তিহির হুশ চলে এসেছে। প্রচন্ড লজ্জা,বিব্রত এবং হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছে সে। অপ্রস্তুতে পা ফেলছে! একবার ওয়াশরুম তো আরেকবার বিছানার দিকে। ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না তোয়ালে নিয়ে নিজেকে ঢাকবে নাকি তোয়ালে ফেলে গোসলখানায় লুকাবে। নিজের ব্যবহারে নিজেই লজ্জিত সাথে বিরক্ত। অসহায়ত্ব নিয়ে ইশাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে দৌড় লাগায় স্নাগারে। শব্দ করে দরজা লাগিয়ে দেয়। নিজের মাথায় নিজেই কয়েক বার চপেটাঘাত করতে থাকে। তখনি কানে বাজে কারো হাসির শব্দ। উচ্চশব্দের হাসিটা যে ইশাদের সেটা বুঝতে সেকেন্ডতম সময়টাও নিল না তিহি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ভেজা শরীরেই জামা পড়ে নিল। কিন্তু রাগটা কি ইশাদের উপর নাকি নিজের বোকামীর উপর? সে ভাবার কি সময় আছে তার কাছে? নেই। সে কোনোমতে ওড়নাটা প্যাচাতে প্যাচাতে বেরিয়ে এল।
তিহি ভেতরে ঢুকে যেতে ইশাদ নিজের কাজে মনোনিবেশ করে। পকেট থেকে টেস্টার বের করে। সুইচবোর্ডটা দরজার পেছনে। ইশাদ বাম হাত দিয়ে দরজার পাল্লা দেয়াল থেকে হালকা সরাতেই তিহির তীক্ষ্ণ আর্তনাদ,
“দরজা লাগাচ্ছেন কেন?”
ইশাদ দেয়ালমুখী অবস্থায় ঘাড় ফিরে তাকায় তিহির দিকে। কিছুক্ষণ নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে চোখ সরিয়ে নিল। দরজার পাল্লা ধরে রাখা হাতটার দিকে তাকায়। পরক্ষণেই সুইচবোর্ডের দিকে চোখ সরালো। হাতের টেস্টারের দিকেও চেয়ে থেকে রুক্ষস্বরে কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেল। মুহূর্তেই সর্বাঙ্গে অদৃশ্য শীতল দোল খেয়ে যায় । সে তিহির দিকে ঘুরে। নিষ্পলকে চেয়ে থেকে বাম হাতে দরজাটা ভিড়িয়ে দিচ্ছে। তিহি তাৎক্ষণাৎ মিহিস্বরে চেঁচিয়ে উঠে,
“আপনি সিটকিনি লাগাচ্ছেন কেন?”
ইশাদের এক স্থির দৃষ্টির বিঘ্ন ঘটল। সে দরজার কাছে গেল। দরজায় সিটকিনি লাগিয়ে দিল। অতঃপর আগের ন্যায় তিহির দিকে ঘুরে দাড়ায়। হাতদুটো বুকে বেধে শান্ত স্বরে সুধাল,
“তারপর?”
ইশাদের ছোট্ট প্রশ্নে তিহি মৃদু কেঁপে উঠল। এক কদম পিছিয়ে আত্মরক্ষার্থে দুর্বল গলায় বলল,
“সামনে আসবেন না,প্লিজ। আমি কিন্তু চেচাব! আপনার নামে ক্যাস করব। রেপের ক্যাসে চৌদ্ধ শিকে ঢুকাব।”
তিহির কথার মধ্যেই ইশাদ এক পা এক পা করে সামনে এগুচ্ছে। মুখের ভাব বলছে,সে এখন বাধিত ছেলে। সামনের মেয়েটি যা বলবে তার উল্টো করার জন্য সে বাধ্য!
ইশাদের থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে বড় বড় পা ফেলে পেছাচ্ছে তিহি। একসময় ছোট রুমের অল্প বিস্তার শেষ হয়ে আসে। কোমর গিয়ে ঠেকে ড্রেসিং টেবিলের সামনের অংশে। হঠাৎ ধাক্কাতে ড্রেসিং টেবিলে সাজিয়ে রাখা প্রসাধনি পড়ে গিয়ে ঠক ঠকা ঠক শব্দ তুলে। তিহি সেদিকে একবার চোখ বুলিয়ে সামনে তাকাল। ইশাদ তার সামনে। এক হাত দুরত্বও নেই। তিহি সোজা হয়ে দাড়ালেই তার বুক ও নাকের সাথে বাড়ি খাবে। তিহি সতর্কবাণী ছুড়তে গিয়েও পারছে না। তার কন্ঠনালী কি কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে? গলা দিয়ে কেন সুর বের হচ্ছে না? তবে কি সে বোবা হয়ে গিয়েছে? হতেই পারে! মানুষ অতিরিক্ত ভয় পেলে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় এর একটি শক্তি হারাতেই পারে। একটি কেন? অধিকও হারাতে পারে! তাহলে কি সেও হারিয়ে ফেলল? তবে কি সেও অতিরিক্ত ভয় পেয়েছে?
ভয়ে তিহি ইশাদের থেকে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ছে। পেছনে পড়ে যাওয়ার ভয়ে ড্রেসিংয়ের ড্রয়ারের শক্ত কাঠ ধরে রাখার চেষ্টা করছে। ইশাদ হালকা ঝুকে এল তিহির মুখের দিকে। ধীরস্বরে বলল,
“তারপর?”
তিহি সঙ্গে সঙ্গে নড়ে উঠে। চেঁচিয়ে বলে,
“ছুঁবেন না!”
ইশাদও সময় ব্যয় করে না৷ বাম হাতে জড়িয়ে ধরে তিহির কোমর। শক্ত করে চেপে ধরে ওকে সোজা দাড় করিয়ে নেয়। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলতে যাবে তখনি নজর পড়ে আয়নায়। তিহির পরণের কাল রঙের জামার মধ্যবর্তী চেইনটা লাগান হয়নি। অসাবধানতায় নাকি ইচ্ছে করে সে খেয়ালে ঢুকল না ইশাদ। তার পুরো নজর আয়নায় স্থির। আসক্ত চাহনি কালো নদীর বুক চিঁড়ে জেগে উঠা শুভ্র,স্নিগ্ধ,কোমল পিঠদাঁড়ায়। মুহুর্তেই ইশাদের চোখের সাদা অংশে রক্তিম জাল বুনন শুরু হল। সম্পূর্ণ জাল শেষ হওয়ার পূর্বেই হাতের টেস্টার ছুড়ে মারে আয়নায়। ঝনঝনিয়ে কাঁচের হাজার টুকরো ঝরে পড়ে নিচে। তিহি চাপা শব্দ করে কেঁপে উঠে। ইশাদের বুক খামচে ধরে হাতের মুষ্ঠিদ্বারা। কাঁধে মুখ লুকিয়ে ঘন ঘন নিশ্বার ছাড়ছে। শ্বাসের শব্দেই বলে দিচ্ছে সে কতটা ভয় পেয়েছে। তার পুরো শরীর থর থর করে কাঁপছে। কাঁপছে ইশাদের প্যান্টের পকেট! ফোন বাজছে তার। উচ্চশব্দের রিংটোনের সাথে উচ্চশব্দের ভাইব্রেশনের ভোঁ ভোঁ শব্দ! এক সেকেন্ডের জন্য ইশাদও ভয় পেয়ে গেল। পকেট থেকে ফোন বের করতে যেতেই তিহি নিজের ভার ছেড়ে দেয় ইশাদের উপর। ইশাদ বিস্ময়ে স্তব্ধ। মনে মনে উচ্চারণ করে,আবার জ্ঞান হারাল নাকি?
তিহিকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে তার পাশেই বসল ইশাদ। পরীক্ষিত চোখদুটো তিহির মুখে। তার ফর্সা গালদুটো আরো ফর্সা হয়েছে। রক্তের ছিটেফোঁটাও নেই যেন মুখমন্ডলে! গোলাপী চিকন ঠোঁটদুটো কালচে রঙ ধারণ করে শক্ত হয়ে আছে। হাতদুটো মুষ্ঠি হয়ে শক্তকাঠ। ইশাদ ভাবনায় ঢুকতে ফোনটা আবার বেজে উঠল। সহসা উঠে দাড়ায়। পকেট থেকে ফোন বের করতে করতে দরজাটাও খোলে। বাইরে বের হয়ে ফোনের স্ক্রিণে তাকাল। ইমদাদ কল দিয়েছে। নিমিষেই ইশাদের মুখ থেকে একটি বিশ্রী শব্দ বের হয়ে আসল। যার ক্ষীণ শব্দটা তার নিজের কর্ণদ্বয়ে পৌঁছুল নাকি সন্দেহ!
ইমদাদের কলটা কেটে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই মেসেজ ঢুকল,
“জনাব সাধু,
আমি আপনার বাড়ির সদর দরজায় দাড়িয়ে আছি। আপনি কি নিচে আসবেন নাকি আমি কলিংবেল চাপব? যে কোনো একটা কর্মের অনুমতি দিয়ে আমায় বাধিত করুন। দশ মিনিট ধরে দাড়িয়ে আছি।”
মেসেজ পড়ে ইশাদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। দ্রুত সিড়ি ঘরের দিকে পা বাড়ায়। সিড়ি ডেঙিয়ে দোতলায় আসে। বসার রুম ছেড়ে সদর দরজার দিকে এগুনোর পূর্বেই মিহি ডেকে উঠল,
“ইশাদ ভাইয়া।”
ইশাদ চলন থামায়। পাশে ঘুরে মিহির দিকে তাকায়। সে ফ্রিজের সামনে দাড়িয়ে আছে। ফ্রিজের দরজা খোলা। নিচে ডিমের খাঁচা পড়ে আছে। মিহি এক কদম এগিয়ে এসে বলল,
“এই ডিমটা ফাঁটা। ভেতর থেকে গন্ধ আসছে। মনে হয় পচে গেছে। কী করব?”
ইশাদ সরল উত্তর দিল,
“ফেলে দেও।”
মিহির ছোট্ট সমস্যা সমাধান করে সামনে পা ফেলে ইশাদ। সদর দরজা খুলে। দু’হাত দুরে দাড়িয়ে আছে ইমদাদ। চোখে সানগ্লাস। রোদে সোনালী রঙ ধরেছে। বন্ধুকে দেখতে পেয়ে ইমদাদের ঠোঁটে হাসির ফুল ফুটল। চোখের সানগ্লাস খুলে বুক পকেটে রাখে। আমোদিত ভঙ্গিতে সামনে এক পা ফেলতেই মাথায় কিছু পড়ল। সামাণ্য ব্যথা পেল কি? ইমদাদ কিছু বুঝে উঠার আগেই তরল জাতীয় কিছু কপাল বেয়ে নাকে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে নাক কুঁচকিয়ে ফেলে। ভেতরের নাড়িভুঁড়ি মোচড় তুলছে। ইমদাদ বমি করার প্রস্তুতি নিতেই ইশাদ হো হো হো করে হেসে উঠল। নাক ধরে সামনে এসে উপহাস করে বলল,
“অশ্লীল ছেলের অশ্লীল শাস্তি!”
ইমদাদ কয়েকবার উদ্গিরণ করে। বড় বড় ফাঁপা ঢেকুর তোলে তবুও পেট থেকে কিছু বের করতে পারছে না। এদিকে বন্ধুর উপহাসে তার যাচ্ছে তাই অবস্থা। পেট চেপে পকেট থেকে রুমাল বের করে। মাথা থেকে আগত দুর্গন্ধের তরল অংশ মুছতে মুছতে দ্রুত সামনে এগোয়। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“আমার দুঃখে তুই হাসিস? তোর ডাকে এতদূর এসে এই প্রতিদান?”
ইমদাদের এই বিপন্ন অবস্থায় ইশাদের মায়া তো হচ্ছে তবে হাসি আটকাতে পারছে না। পচা ডিমের গন্ধে তার পেটও ফুলে যাচ্ছে। যথন তখন বমি করে দিতে পারে। ইমদাদের শরীরে করলে কেমন হয়?
ইমদাদ আকাশপানে তাকিয়ে বলল,
“আকাশ থেকে পচা ডিম! কী করে সম্ভব? তবে কি এখন আকাশও ডিম পাড়া শুরু করেছে?”
ইশাদ ব্যঙ্গ করে বলল,
“আকাশ তো পুংলিঙ্গ। বিজ্ঞানের ভাষায় তার পক্ষে ডিম পাড়া সম্ভব নয়। ডিমটা আকাশের বউ মানে আকাশী পেড়েছে!”
ইমদাদ চটে গেল। চড়া গলায় বলল,
“আকাশী নয় বাতাশী পেড়েছে। সেদিনের সেই মেয়েটার কাজ।”
“কোন মেয়েটা?”
“ঐ যে হওয়া উড়া মেয়েটা! আমি নিশ্চিত এই মেয়েটা হাওয়ায় উড়ে উড়ে আমার গায়ে পচা ডিম ফেলছে।”
ইমদাদের কথায় ইশাদের টনক নড়ে। ইমদাদ কি মিহির কথা বলছে? এমন নয় তো ডিমটা মিহিই ফেলেছে? আসার সময় তো ওর হাতে ডিম ছিল। পচা ডিম। আর সে তো বলেও এসেছে ফেলে দিতে। তবে কি! ইমদাদ,ডিম আর মিহির যোগসূত্র মেলাতে গিয়ে আরেক দফায় হেসে উঠল ইশাদ। জোর গলায় বলল,
“বেশ করেছে। তোর মতো নোংরা ছেলের এমন নোংরা শাস্তিই পাওয়া উচিত। তবে আমার মনে হয় মেয়েটা না জেনেই শাস্তি দিয়ে ফেলেছে। তাকে জানানো উচিত। তোর কুকীর্তি পূঙ্খানুপুঙ্খ রূপে জানার পর কেমন শাস্তি দেয় সেটা দেখার লোভ হচ্ছে। বন্ধু জানাব নাকি?”
ইমদাদ কড়া চোখে তাকিয়ে আছে ইশাদের দিকে। তেজালো স্বরে বলল,
“হ্যাঁ। জানাতো উচিত। তবে তুই না আমি জানাব। একবার হাতে পড়তে দে,দুই গালে টাস টাস কয়েকটা বসিয়ে চোখের জল আর নাকের জলের বন্যা বসাব। বেয়াদব মেয়ে!”
ইমদাদ না জেনে দেওয়া ঝাড়িটাতে ইশাদের হাসি দমে গেল। একটু রাগও বুঝি এল। তবে সেটা প্রকাশ না করে গম্ভীর গলায় বলল,
“চল,গোসল করবি।”
নিমিষেই ইমদাদের মুখ পাংশুবর্ণ। করুণসুরে বলল,
“কয়টা ডেটল আর কয়টা স্যাভলন মেশাতে হবে! তোর সাথে দেখা করব দেখে,যেচে গোসল করে এসেছিলাম। আমার ফ্রেশ লুকের এভাবে বারোটা বেজে গেল? বন্ধু শুধু মাথা ধুলে হবে না?”
ইশাদ শান্তভঙ্গিতে তাকাল ইমদাদের দিকে। চোখের পাতা ফেলে দৃঢ় গলায় বলল,
“না।”
___________________________
শাহিনা শাইখা বিকেলের নাস্তা নিয়ে ইশাদের রুমে ঢুকলেন। ইশাদ বিছানায় শুয়ে আছে। এক পা বিছিয়ে আরেক পায়ের হাঁটু শূন্যে রেখে ভাজ করা। মায়ের উপস্থিতি পেয়ে উঠে বসল। বলল,
“আম্মু,তুমি কি ধৈর্য্যশক্তির রানি?”
ছেলের এমন অদ্ভুত প্রশ্নে চা নাড়া বন্ধ করলেন শাহিনা শাইখা। ক্ষণকাল নিরব থেকে মিষ্টি হাসলেন। বললেন,
“কেন বলতো?”
ইশাদ এবার দুপা ভাঁজ করে বসল। বলল,
“নাহলে রেঁখা আন্টির অমন ঝাঁঝাল কথা সহ্য করছিলে কিভাবে? তোমার জায়গায় অন্য কেউ হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিত।”
শাহিনা শাইখা দ্রুত অনুশাসন তুললেন,
“ছি! বাবা। অভাবে বলতে নেই। উনার আর দোষ কী? দোষ তো আমারই।”
“সে যারই হোক। ওভাবে গলা চড়িয়ে বলার কী আছে? মিনিমাম ভদ্রতাটুকু নেই। আর তুমিও ওভাবে মাথা নত করেছিলে কেন? বাড়িওয়ালা সে না তুমি?”
শাহিনা শাইখা ছেলের প্রশ্নে মৃদু হাসলেন। চায়ের কাপটা ইশাদের হাতে দিয়ে বললেন,
“দোষ করতে লজ্জা নেই মাথানত করতে লজ্জা? অন্যায়,ভুল,দোষ এই তিনটি জিনিস যে উপলব্ধি করতে পারে সে মাথানত করতে লজ্জা পায় না! বরং মাফ চেয়ে শুধরে নিতে পারাই উত্তম গুণাবলীর অংশ। এখন কার সামনে মাথানত করছো সেটা না ভেবে মাফটা যথার্থ পেলে নাকি সেটা ভাবা উচিত। আমি ভাড়াতো দিয়েছিলাম কিন্তু তাকে রুমের সাথে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে পারিনি। ভুলটা কি আমার নয়?”
“তাহলে ভাড়া দিতে গেলে কেন?”
শাহিনা শাইখার মুখটা মলিন হয়ে গেল। মুহুর্তকাল নিরব থেকে বললেন,
“জানিনা রে! সেদিন বিকেলবেলা হঠাৎ করেই তিহি আর তিহির মা এসে আমাদের দরজায় দাড়ালেন। জিজ্ঞেস করলেন রুম খালি আছে নাকি। দুজনের মুখ এতো শুকনো আর ক্লান্ত ছিল যে আমার ভীষণ মায়া হল। দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম অনেক দূর থেকে এসেছে। কিছু যে জিজ্ঞেস করব সেই সময়টাও আমার ছিল না। তারমধ্যে আমার একমাত্র ছেলের শুভ অনুষ্ঠান! ফিরিয়ে দিতে মন চায়ছিল না। যদি আল্লাহ অসন্তুষ্ট হন? তাই বাচ-বিচার না করেই চিলেকোঠার রুমে উঠিয়ে দিলাম।”
মায়ের এমন দরদি কান্ডকারখানার গল্প শুনে ইশাদের ঠৌঁটেও হাসি উঁকি দিল। চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে মায়ের কাছে এগিয়ে আসল। দু’হাতে চোখ চেপে ধরে কোমল গলায় বলল,
“তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। চুপচাপ হাঁটো!”
ছেলের কান্ডে বিস্ময়ের অন্ত রইল না শাহিনা শাইখার। তার নির্দেশে নিরবে হেঁটে যাচ্ছে। ইশাদের রুম থেকে বের হয়ে সিড়ি পার হলেন। সদর দরজা ছেড়ে বাড়ির দক্ষিণে গিয়ে থামলেন। ইশাদ মৃদু হাসি নিয়ে চোখ ছাড়ল। নরমসুরে বলল,
“এবার ‘বসন্ত ভিলায়’ বসন্তের ছোঁয়া পড়েছে আম্মু। উপরে তাকাও!”
শাহিনা শাইখা উপরে তাকালেন। চোখভর্তি বিস্ময়। বিস্ময় ছাপিয়ে আনন্দের পাহাড় জমতে শুরু করেছে। এক পর্যায়ে ছলছল নয়নে ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“এত আগুন গাছ মনে হচ্ছে রে ইশাদ। ফুলের রঙগুলো দেখেছিস? কেমন তেজরাঙা? প্রত্যেকটা পাপড়িতে আলাদা আলদা দম্ভ লেগে আছে। যেন ছুঁলেই ছাই করে দিবে।”
ইশাদ মায়ের ছলছল নয়নের আড়ালে আনন্দটাকে উপভোগ করছে। এমন খুশিভরা মুখটা শেষ কবে দেখেছিল মনে নেই। তবে দেখেছিল বহু বছর আগে। যে সময়ের স্মৃতিগুলো ঝাপসা! শাহিনা শাইখা আনন্দের অশ্রু চোখে বন্দী করতে ব্যর্থ হলেন। চোখের তীর ভেঙে গড়িয়ে পড়ছে চিবুকে। তবে আর গড়াতে দিলেন না। দ্রুত শাড়ির আঁচলে শুষে নিচ্ছেন। ইশাদ বিড়বিড় করে প্রশ্ন রাখল,আনন্দেরও অশ্রু হয় কেন? অশ্রু! সে তো দুঃখের সাথে থাকবে। আনন্দের সাথেও মিশতে চায় কেন? নিজের প্রশ্নের উত্তর নিজেই খুঁজে,’মানুষ যখন কোনো কারণে সুখের অনুভূতি নেয় তখন আত্মা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে। এই অতি আবেগের ফলস্বরূপ আমাদের দেহের স্বাভাবিক অবস্থার চেয়েও বেশি পরিমাণের রাসায়নিক পদার্থ ও হরমোন নিঃসরণ হয় শরীরের বিশেষ অংশ থেকে। এই অতিরিক্ত রাসায়নিক পদার্থ ও হরমোন নিঃসরণ এক রকম অসস্থি তৈরি করে। যার ফলে চোখের ল্যাক্রিমাল গ্রন্থ থেকে এক ধরনের তরল বের হয়ে আসে। যাকে বলা হয় জল,পানি বা অশ্রু। মূল তথ্য হলো,অশ্রু চলে আসার কারণ কান্না বা আনন্দ নয়। গভীর আবেগ। যার দুটি পক্ষমাত্র কান্না বা খুশি! এই দুটির যেকোনো একটির সাথে অতি যুক্ত হলেই চোখে পানি আসে। যেমন ইশাদের মায়ের আনন্দটি অতিমাত্রায় ছিল তাই পানি চলে এসেছে। তবে এই গভীর আবেগ হওয়া ভাল। কেননা, গভীর আবেগের ফলে যে তরল(জল) নিঃসরণ হয় তা দেহকে হালকা ও আরামদায়ক করে তোলে। ইশাদ প্রশ্ন-উত্তরের পর্ব শেষ করেই মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,
“কেমন লাগছে আম্মু?”
শাহিনা শাইখা আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন,
“বেশ ভাল।”
মায়ের সাথে ইশাদ ও চুপ। শাহিনা শাইখা নিরবতা ভেঙে আবার বললেন,
“আমি যেদিন এ বাড়িতে উঠেছিলাম সেদিনও গাছটি কৃষ্ণচূড়া ফুলে লাল সাজে সেজেছিল। কিন্তু তারপর? কি যে হলো অনেক বছর ফুল ফুটল না। গাছের সাথে আমার মন খারাপটাও দিনকে দিন বেড়েই চলছিল। তারপর হঠাৎ এক ফাল্গুন মাসে গাছ তার প্রকৃতির রূপে সাজল। সেদিন তুই আমার কোলে এসেছিল। তোর সাথে সাথে গাছটাও নিত্য বছর বসন্তের বাতাস বয়ে চলেছিল। তবে হাতেগোনা কয়েক বছরই। হঠাৎ করেই গোনা শেষ করে বসন্ত হারিয়ে গেল।”
শাহিনা শাইখার দুঃখী মুখটাতে হাত রাখল ইশাদ। নরমসুরে বলল,
“এইতো আবার চলে এসেছে! আর যাবে না।”
শাহিনা শাইখা কৌতুহলী প্রশ্ন ছাড়লেন,
“কী করে বুঝলি?”
ইশাদ চার পাপড়ির লালারঙা ফুলের থোকায় চোখ রাখে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করছে,এমন তেজরাঙা,দম্ভ কি অন্য কোথাও বিরাজমান? যেখানে ছোঁয়া তো দূর তাকালেই ছাই করে দেয়! শাহিনা শাইখা ছেলের কাঁধে হাত রেখে পুনরায় সুধালেন,
“বলছিস না যে?”
ইশাদ উদাস গলায় বলল,
“মনে হল!”
______________________________
এক জরুরী কলে মনোঃসংযোগ চলছে ইশাদের। কথার মধ্যেই নেটওয়ার্ক বিপত্তি ঘটাল। কথা তো ঠিক মতো আসছেই না তারমধ্যে বার বার কেটে যাচ্ছে। ইশাদ কয়েক বার চেষ্টা করেও দুর্বল নেটওয়ার্ককে শক্তিশালী করতে পারল না। অবশেষে ছাদের দিকেই ছুটল। খুব জরুরী কথা চলছিল। শেষ নাহলেই নয়!
ছাদে পৌঁছাতে ইশাদ থমকে গেল। রাতের অন্ধকার সম্পূর্ণটাই যেন তাদের ছাদে তাবু গেড়েছে। এ মাথা থেকে ও মাথা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হাঁটতে গিয়ে হোচট না খেলেই হয়! ইশাদ অন্ধকারে এক পা সামনে এগিয়ে ডানপাশে তাকাল। সাধারণত তাদের ছাদের চারকোণায় চারটে সৌন্দর্য বহনকারী কাঁচে ঘেরা আলো জ্বলে। আজ জ্বলছে না কেন? টনু কি আজ ছাদে আসে নি? ইশাদ কী মনে করে বামপাশে তাকাল। যা ভেবেছিল তাই। তিহিদের রুমে আলো জ্বলছে। জানালা দিয়ে সাদা আলো রহস্য সাজে ঠিকরে বের হচ্ছে। একটা মিষ্টি গন্ধও আসছে সেদিক থেকে। মৃদু বাতাসের মিষ্টি গন্ধে মাতাল হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি করছে। শরীরজুড়ে ফুটছে আকর্ষনের তীব্র তির! একটু কি উঁকি দিয়ে আসবে? মন বলছে অন্ধকারের কারণ এই মেয়েটিই। ইশাদের দ্বিধায় নাড়া পড়ল চুড়ির ঝুনঝুন শব্দে। ইশাদের আচঞ্চল পা দুটো হঠাৎই চঞ্চল হয়ে উঠল। মন্থরগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে আলোয় ঘেরা ছোট্ট জানালাটির দ্বারে! জানালার মুখোমুখী দাড়াতেই চোখ পড়ল কোমল দুটি পায়ে। পায়ে নুপুরও আছে। একটি পায়ের উপর আরেকটি পায়ের বিন্যাস খোলা জানালার উপর রেখে উপুত হয়ে শুয়ে আছে তিহি। সম্পূর্ণ মনোযোগ একটি বইয়ের উপর। কী পড়ছে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না। দেখার প্রয়োজনও কি আছে? ইশাদের চোখ তো আটকে আছে হালকা কমলা রঙের শাড়ী পরিহিতার উপর।
তিহি পড়া শেষে পৃষ্ঠা উল্টানোর জন্য হাত নাড়তেই চুড়ির ঝুনঝুন শব্দে চারপাশ মুখরিত! সাথে কি নুপুরটিও বাজল? ইশাদ নজর পুনরায় পায়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে। পায়ের তলায় বৃত্তের মতো ছোপ ছোপ কালো দাগ। এক দুটো নয়,অসংখ্যা! ইশাদ খেয়ালহীন হাত রাখে পায়ে। তিহি শিউরে উঠে। ভয়ে পা দুটো টেনে নিল। ভীতস্বরে বলল,
“নষ্ট পুরুষ!”
চলবে