#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (৮)
#রোকসানা_রাহমান
তিহি পড়া শেষে পৃষ্ঠা উল্টানোর জন্য হাত নাড়তেই চুড়ির ঝুনঝুন শব্দে চারপাশ মুখরিত! সাথে কি নুপুরটিও বাজল? ইশাদ নজর পুনরায় পায়ে ফেলল। সঙ্গে সঙ্গে চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে আসে। পায়ের তলায় বৃত্তের মতো ছোপ ছোপ কালো দাগ। এক দুটো নয়,অসংখ্য! ইশাদ খেয়ালহীন হাত রাখে পায়ে। তিহি শিউরে উঠে। ভয়ে পা দুটো টেনে নিল। ভীতস্বরে বলল,
“নষ্ট পুরুষ!”
তিহির ছোট্ট ব্যঙ্গ রসাত্মক সম্ভাষণে ইশাদ বিস্ময়ে অতিকে ওঠে! শিউরে উঠে তার সর্বাঙ্গের লোম বিবর। তেমনটা, যেমনটা শীতের প্রথম ভোরের শিশিরকণায় বেখেয়ালীতে নগ্ন পা ভিজলে কোমল তুলতুলে অনুভূতি হয়। এ কেমন সুড়সুড়ি তুলছে তার হৃদকোঠরে? যা সে প্রকাশে আনতে পারছে না আবার ঠেলে দুরেও ফেলতে পারছে না। কী আছে মেয়েটির মাঝে? যা সবসময় মোহ সৃষ্টিতে মত্ত!
“দেখি হাতটা সামনে আনেন তো!”
তিহির আচমকা বিবৃতিতে ইশাদ ওর দিকে তাকায়। চোখের দৃষ্টি স্বাভাবিক। জিজ্ঞেস করল,
“কেন?”
“কাটব।”
তিহির মুখে এমন ভয়ঙ্কর কথা শুনে ইশাদ চমকিত। সভয়ে তাকাল সামনের মেয়েটির দিকে। তিহি বিছানায় হাঁটু ভরে বসে আছে। তার এক হাতে বই। বইটি বুকের সাথে চেপে রেখেছে। অন্যহাতে একটি ছুরি। ডান হাতের শক্ত মুঠোবন্দীতে আছে। মুখের ভাবে কোনো রকম কঠিনতার ছাপ নেই। থাকবে কী করে? চোখের গাঢ় কাজল দুটো শূভ্র বিল তৈরী করেছে যে। তার মধ্যে প্রগাঢ় কালো রঙের নৌকাও আছে। তবে বৈঠা নেই। মাঝিও নেই। তাহলে কি মাঝি বৈঠা আনতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে? যেমনটা সে হারাতে বসেছে!
তিহির কোমর সমান রেশম কালো চুলের কয়েক গাছা কাঁধ পেরিয়ে সামনে পড়ে আছে। বাইরের ছেড়ে ছেড়ে আসা বসন্তের দমকা হাওয়ায় বাধন ছাড়া উড়ছে! তিহি সেগুলোকে পেছনে নিতেই আবারও সেই চুড়ির ঝুনঝুন শব্দ!
ইশাদ মায়া কাটিয়ে বলল,
“আপনি আমার হাত কাটবেন? কোন অপরাধে?”
“আমার পা ছোঁয়ার অপরাধে।”
তিহির অকপট উত্তরে ইশাদের চেতনা ফিরল। অতিশয় চিন্তিত স্বরে বলল,
“আপনার পায়ে কী হয়েছে?”
“পায়ের আবার কী হবে? পা’দের কি বিয়ে হয়? বিয়ে হলে নাহয় বলতাম একটা মেয়ে হয়েছে আরেকটা ছেলে!”
“আমি কিন্তু মজা করছি না।”
“আমিও না।”
“বলবেন না?”
“কী বলব?”
“পায়ে কী হয়েছে?”
“কেন বলব?”
ইশাদ কিঞ্চিত বিরক্ত হয়ে বলল,
“আশ্চর্য,আপনি তো প্রচন্ড রকমের প্যাচো!”
তিহি ক্ষণকাল নিরব হয়ে রইল। সহসা জানালার কাছে এসে দাড়ায়। ইশাদের মুখের কাছে এসে কৌতুহল নিয়ে বলল,
“প্যাচো কী?”
ইশাদ রহস্য রেখে বলল,
“এটার মানে বোঝা আপনার জন্য দুর্বোধ্য!”
তিহি রেগে গেল। তেজালো স্বরে বলল,
“শুধু আপনার শরীর নয়,কথাও নোংরা।”
“এখানে নোংরার কী পেলেন?”
“যে শব্দের মানে আমি বুঝতে পারব না সে শব্দই নোংরা।”
ইশাদ কিছু বলতে চেয়েও বলল না। ভেতরে ভেতরে তার হাসি পাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ করা দায় হয়ে পড়েছে। তারমধ্যে যা জানার জন্য এতো উৎসুক তা জানতে পারছে না। ইশাদ বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,প্যাচো-প্যাচানি-প্যাচোরানি!
সামনে সামনে গম্ভীর স্বরে বলল,
“বলবেন না?”
“কী?”
“পায়ে পোড়া দাগ কী করে হলো।”
“কিসের পোড়া দাগ? আমি তো চুলার ধারেই যাই না। পুড়বে কিভাবে?”
“আপনার কি মনে হয় আমি অন্ধ? একজন চক্ষু বিশেষজ্ঞের চোখের উপর আঙুল তুলছেন?”
তিহি কপাল কুঁচকে ফেলল। ঘন ঘন নাকের পাতা ফুলিয়ে মেঝেতে সোজা হয়ে দাড়াল। একটু জানালা থেকে দূরে সরে বলল,
“কোথায় পোড়া? দেখেন তো!”
ইশাদ দ্রুত জানালা গলে তিহির পায়ে তাকায়। বলল,
“উপরে নয়,তালুতে। পা উল্টান দেখাচ্ছি।”
তিহি সরু চোখে তাকাল। সন্দেহ সুরে বলল,
“আপনার চোখে ছানি পড়েছে। নোংরামীর ছানি। উপরটুকু দেখে চোখ ভরছে না? এখন নিচটাও দেখতে হবে? মেয়ে দেখলেই চোখ চকচক করে? জিভ লকলক করে? হাত খচখচ করে? নিচটা দেখালে বলবেন,দূর থেকে দেখা যাচ্ছে না। কাছে আস। তারপর টুপ করে ছুঁয়ে ফেলবেন। আপনার পেটভর্তি খাচরামি!”
তিহির গড়গড়ে বলা তেতো কথায় ইশাদের চিন্তিত ভাবনাগুলো বিষিয়ে গেল। রাগ ঝেড়ে বলল,
“আমার এখানে আসায় ভুল হয়েছে।”
তিহিও সঙ্গে সঙ্গে প্রতিত্তোর করল,
“তো ভুল করতে এসেছেন কেন? আমি ডেকেছি? আমি বলেছি, আমার রুমের সামনে আসতে? আমার জানালার কাছে আসতে। আমার পা ধরতে?”
“আমি আপনার পা ধরতে এসেছি?”
“তা নয় তো কী? হাতে-নাতে ধরা খেয়েও উল্টো কথা বলছেন? আপনার চারিত্রিক সনদে সাইনটা কে করেছে বলুনতো! নিশ্চয় তার মনও আপনার মতো কুমতলবে আঁটা। নাকি ঘুষ দিয়ে সাইন নিয়েছেন?”
রাগে ইশাদের চোয়াল শক্ত হয়ে এসেছে। ভেসে উঠেছে কপালপার্শ্বের বেগুনি রগ। নিজেকে যথাসাধ্য সংযত করে ঘুরে দাড়াল। এক কদম এগুতেই তিহির ডাক।
“শুনুন।”
ইশাদ থামল। ঘাড় ফেরাতে তিহি আবার বলল,
“এক মিনিট দাড়ান।”
তিহি দৌড়ে মায়ের পার্সের চেইন খুলল। কয়েকটি টাকার নোট ফেলে দুই টাকার একটি নোট বের করল। তাতে কলম দিয়ে কিছু লিখে রুম ছেড়ে বেরিয়ে আসে। ইশাদের হাত টাকাটা দিয়ে বলল,
“পা ধরেছেন, বখশিশ নিবেন না?”
তিহি মুঁচকি হেসে উল্টো ঘুরল। উচ্চশব্দের হাসিটা দমিয়ে রেখেছে। রুমে গিয়ে ছাড়বে। সামনে হাঁটার পূর্বেই পেছন থেকে ভারী ঝড়ো হাওয়া বয়ছে। তিহির পিঠ ঢাকা চুলগুলো সব এলোমেলোভাবে সামনে পড়ছে। সে চুলগুলো এক ঝটকায় পেছনে ফেলতেই ইশাদের মুখে গিয়ে পড়ল! ইশাদ চোখ বন্ধ করে ফেলে। চোখের রাগ চোখেই ডুবে গেল। চোখ মেলে যখন তাকাল তিহি সামনে নেই। খপ করে জানালার লাগানোর শব্দ এল কানে। ইশাদ মুড়িয়ে রাখা টাকাটি খোলে। তাতে গুটি অক্ষরে লেখা,
“ভালো হতে টাকা লাগে না। তবুও আপনাকে টাকা দিলাম। ভাঙিয়ে খরচ করবেন আর ভালো ব্যক্তিত্ব কিনবেন।”
ইশাদ মৃদু হাসল। ঘাড় বাকিয়ে বন্ধ জানালার দিকে তাকাল। পরিশেষে টাকাটা বুক পকেটে ভরে রাখল সযত্নে।
_____________________________
ভারী কিছু পড়ার শব্দে ঘুম ভেঙে যায় ইশাদের। আলসেমি ঝেঁকে বসতে চাইছে সর্বাঙ্গে। কিন্তু ন্যায়পরায়ণতার খাতিরে হলেও তাকে উঠতে হয়। মনে হচ্ছে কোনো বস্তু নয়,বিশালদেহীর অধিকারী কোনো প্রাণ মানে মনুষ্য হাঁটতে গিয়ে পড়ে গিয়েছে। সে নিজেও তো একজন মানুষ!
ইশাদ বিছানা ছাড়ে। এলোমেলো পা ফেলে দরজায় দাড়াতেই তার চোখ কপালে। অন্য কেউ নয় তার বাবা সোবহান শাইখ চিৎ হয়ে পড়ে আছেন। তার পেটের উপর রঙের ডিব্বা উপুত হয়ে আছে। ছি! কী লজ্জা ও বিব্রতকর অবস্থা। ইশাদ কি গিয়ে বাবাকে সাহায্য করবে? কিন্তু তাকে দেখে যদি তিনি লজ্জা পান? ইশাদ কিছুতেই চায় না তার বাবা লজ্জা পাক। তাই সে দরজার আড়ালেই দাড়িয়ে রইল। মনে মনে ভেবে রেখেছে,যদি নিজ ইচ্ছায় উঠতে না পারেন তবেই সে সামনে যাবে। বাবাকে সাহায্য করবে। এক মিনিট,দুই মিনিট,পাঁচ মিনিট ছেড়ে দশ মিনিটে গিয়ে ঘড়ির কাঁটা থামল। এদিকে বাবা উঠবে কী উঠার চেষ্টাও করছেন না। তাহলে কি ইচ্ছে করেই শুয়ে আছেন? রঙ দিয়ে খেলছেন?
ইশাদ দরজা ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এল। তখনি সোবহান শাইখ একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে করুণ চোখে তাকিয়ে রইলেন। যার মানে এই-তাড়াতাড়ি আমাকে টেনে তোল বাপ!
ছেলের সাহায্যে সোজা হয়ে দাড়ালেন সোবহান শাইখ। ছেলেকে প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে নিজের বললেন,
“তোমার মায়ের বুদ্ধি কবে হবে বলতো? তোমার বিয়ে নিয়ে আমরা নিজেরাই ব্যস্ত সেখানে আরেক ঝামেলা তুলে এনেছেন। এই ঝামেলা মেটাতে কি আমার আসা?”
বাবা কোন ঝামেলার কথা বলছেন তা বোধগম্য হচ্ছে না ইশাদের। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাতে তিনি আবার বললেন,
“সাত সকালে আমার মিস্ত্রী ডাকতে হলো। শুধু রান্নার ব্যবস্থা করে দিলেই তো হবে না। একটা রান্নাঘর ও তুলে দিতে হবে।”
বাবা যে তিহিদের কথা বলছেন বেশ পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারল ইশাদ। তবে কথার পিঠে কথা তুলল না। প্রসঙ্গ এড়িয়ে বলল,
“হাঁটতে পারবে কি? নাকি আমি রুমে দিয়ে আসব?”
সোবহান শাইখ ছেলের দিকে তাকালেন। ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে বললেন,
“পারব।”
ইশাদ উনার কাঁধ ছেড়ে দিল। ফের রুমে ঢুকবে তখনি বললেন,
“কোমরে হালকা চাপ লেগেছে। মনে হয় না আর উপরে উঠতে পারব। টনু একা সব সামলাতে পারবে না। তুমি গিয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়ে দেও।”
ইশাদ বাধ্য ছেলের মতো মাথা উপর নিচ করে। এগিয়ে যায় ছাদে উঠা সিড়ির দিকে। এক ধাপ ছেড়ে দুই ধাপে পা পড়েছে ইশাদের। তখনি টনু হড়বড়ে উপর থেকে নেমে আসছে। ইশাদকে পাশ কাটতে গেলে,ইশাল বলল,
“কোথায় যাচ্ছিস?”
“সিমের বিচি আনতে।”
“সিমের বিচি?”
“হ,তিহি আপা আনতে কইছে। আমাগো গেইটের সামনে ভাজতাছে।”
ইশাদ আর কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল না। টনু নেমে গেল। মুহুর্তকাল সে টনুর চলে যাওয়া দেখল। অতঃপর উপরে উঠে। সে ভেবেছিল উপরে উঠলে সবার আগে তিহি নজরে পড়বে কিন্তু তার ভাবনা ভুল। উপরে তিহি নেই। দু’টো ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। তারা কোমরে লুঙ্গির উপরে গামছা বেঁধে কাজ করছে। একজন সিমেন্ট নাড়ছে অন্যজন ধাপে ধাপে ইট সাজিয়ে দেয়াল তুলছে। চার দেয়ালের মাঝে দুটো চুলা বসানো হয়েছে। পাশে সিলিন্ডারের পাম্প লাগানো। ইশাদ খানিকটা অবাকই হলো। রাতারাতি এত কিছু করা হয়ে গেছে? সে কি একটু দেরি করে উঠেছে? কয়টা বাজে এখন? ইশাদ অভ্যাসবশত হাতে তাকায়। হাতে ঘড়ি নেই। সাথে সাথে মুখটা ম্লান হয়ো আসে। ম্লান মুখেই আকাশের দিকে তাকায়। সূর্য উঠেছে। তবে তেমন তেজ নেই,আলোটাও সব জায়গায় পড়ছে না। নির্মল কিরণ বলে দিচ্ছে সময় এখন আটটা কী নয়টা!
“টনু ভাই,মোড়া তো একটা। তুৃমি বসবে নাকি আমি?”
তিহির কন্ঠ পেয়েই ইশাদের চোখ সূ্র্য ছেড়ে অন্য কোথাও পড়তে চাইল। কিন্তু মাঝপথেই ইশাদ থমকে যায়। মন বলছে, সূর্যের না ফোটা তেজটা এই মানবীর মাঝে ভর করেছে। তাকালেই তার গলা শুকিয়ে আসবে। যেমনটা মরূভূমির প্রখর উত্তাপে তৃষ্ণার্ত পথিকের হয়! মুহূর্তেই স্নিগ্ধ,শুভ্র,কোমল সকাল ফুরিয়ে চৈত্রের দুপুর নেমে আসবে।
“তোমার বয়স কত টনু ভাই?”
টনু নিচে বসেছে। হাঁটু ভাজ করে। এক হাত পেতে আছে তিহির দিকে। তিহি সিমের বিচি ছিলে খোসাগুলো টনুর হাতে দিচ্ছে আর কথা বলছে।
“বাইশ বছর।”
“তুমি বিয়ে করেছো?”
কানে বিয়ের প্রসঙ্গ আসতেই ইশাদের কান খাড়া হয়ে গেল। সে পাঁচিলের উপর দুই হাত রেখে বাইরের প্রকৃতি দেখছিল। এবার মনোযোগটা সম্পূর্ণ তিহির দিকে পড়ল। এমনকি চোখের দৃষ্টিটাও। তিহি দরজার পাশের দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে মোড়ার উপর বসে আছে। তিহির প্রশ্নে টনু হালকা নড়ে উঠল। কিঞ্চিত লজ্জার আভা ফুটছে মুখে। গলার দুপাশে পড়ে থাকা গামছাটা টেনে বলল,
“হ,আপা। তিন মাস হলো বিয়া করছি। বউ গেরামে আছে। ছুটি পাইলেই দেখতে যামু।”
তিহি হালকা হাসল। আড়চোখে ইশাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করেছো কেন? তোমার তো বিয়ের বয়সই হয়নি। বিয়ে করতে হয় আটাশ পার হলে।”
টনু খানিকটা হকচকিয়ে গেল। মাথা চুলকে বলল,
“কি কন আপা? বিয়ার বয়স তো একুশ হইলেই হয়। আমি তো তাও বাইশ বছরে করছি। আর দেরি করলে তো বুড়া হইয়া যামু। বুড়া বয়সে বিয়া কইরা কী লাভ?”
শেষ কথাটা বলে টনু মাথা নিচু করে ফেলল। যেন সে লজ্জাজনক কথা বলে ফেলেছে। বেফাঁসে! তিহি সেদিকে না গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছো তোমার ছোটসাব বুড়া হইয়া গেছে?”
তিহি ফিসফিস করলেও টনু জোরালো স্বরে বলল,
“আমার স্যার বুড়া হইব ক্যান?”
“কারণ তার বয়স উনত্রিশ!”
তিহি কথা শেষ করেই হেসে উঠল। দু’পাটির সাদা চকচকে দাঁতগুলো সূর্যের কিরণে ঝিলিক দিচ্ছে। তার হাসির ঝংকারের সাথে টনুও তাল মেলাচ্ছে। পাশ থেকে ইশাদ অবাকের চরম পর্যায়ে!
তিহি হাসি থামিয়ে দ্বিতীয় দফায় আলাপ শুরু করল। ছোট কাগজের ঠোঙা থেকে সিমের বিচি বের করে নখের কাজ চালাতে চালাতে বলল,
“টনু ভাই,তোমার বউয়ের বয়স কত?”
“উনিশ।”
তিহি কপাল, মুখ কুঁচকিয়ে অপ্রসন্নভাব নিয়ে বলল,
“মানায়নি টনু ভাই। তার বয়স তো তোমার বয়সের অর্ধেক হওয়া লাগতো। এই ধরো এগার কী বারো।”
টনু বসা থেকে দাড়িয়ে গেল। সামান্য রোষ গলায় বলল,
“এগুলা কী কন তিহি আপা? আপনারা বড়লোক সমাজে থাইকা আমারে বাল্যবিবাহ করতে কন? আমি তো পড়ালেখা না কইরাও জানি,আঠারো বছরের আগে কোনো মাইয়া রে বিয়া করা অন্যায়। পুলিশ জানতে পারলে জেলে নিয়া যাইবো।”
তিহি ঠোঁট টিপে হাসছে। বিপ্লবী টনুরে ইশারায় বসতে বলল। ফিসফিসিয়ে বলল,
“তোমার ছোটসাবও তো বাল্যবিবাহ করবে তাকেও জেলে পাঠানো উচিত। পুলিশের নাম্বারটা তুৃমি আমাকে সংগ্রহ করে দিবে। কেমন?”
তিহি আবারও শব্দ করে হেসে উঠল। রোদ্দুরের হলুদ আলোয় তিহির চোখের কোণের জল চিকচিক করছে। টনু হতবাক, সাথে হতাশ। একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা ইশাদের অবাকমাখা বিস্ময় এবার গগণচুম্বী!
তিহি হাসি থামিয়ে সিমের বিচি মুখে ঢুকাল। দাঁতের চাপে কট কট শব্দ তোলে বলল,
“টনু ভাই আরেকটু সামনে এসো বসো।”
টনু বাধ্য অনুচরের মতো সামনে এসে বসল। তিহি কন্ঠ খাদে নিয়ে প্রশ্ন করল,
“ধরো,তুমি গোসল করতে গেছো। গোসলখানার দরজা খুলে দেখলে সামনে একটি মেয়ে দাড়িয়ে। তার শরীরে কাপড় ঠিক নেই। তখন তুমি কী করবে?”
টনু সাত-পাঁচ না ভেবেই সরল গলায় উত্তর দিল,
“কী আর করুম। লজ্জা নিয়া বাইরে চইললা আমু।”
“কেন? তোমার তাকে ছুঁতে ইচ্ছে করবে না কিংবা চুমু…”
ইশাদের ধৈর্য্যের বাধ ভেঙে গেল। তিহির কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই কন্ঠ ছাড়ল,
“টনু? কাজ ফেলে ওখানে কী? জলদি এদিকে আয়।”
টনু ভয় পেয়ে গেল। তিহির কাছ থেকে দৌড়ে ইশাদের সামনে চলে আসে। সভয়ে বলে,
“ভুল হইয়া গেছে ছোটসাব। কী করমু কন।”
তিহি মোড়ায় বসে মিটিমিটি হাসছে। সে হাসির বাধা টানল ইশাদ। টনুর কাঁধ চেপে বলল,
“আচ্ছা বলত, একটি মেয়ের বয়স পঁচিশ। অথচ সে এখনো বিয়ে না করে ঘরে বসে আছে। এর কারণ কী হতে পারে?”
“দোষ!”
“কেমন দোষ?”
“তা তো কইতে পারুম না। দেখতে হইব। তয় দোষটা হয় মাথায় নাহয়..”
“আমার বয়স মোটেও পঁচিশ নয়।”
তিহির এমন আচমকা বাক্যে টনু অবাক। ইশাদও। তবে ইশাদের মুখে উড়ে বেড়াচ্ছে দুষ্টুমীর আভা। প্রশ্নটা ইশাদকে করতে হলো না। টনুই করল,
“তাহলে?”
তিহি খানিকটা দমে গেল। মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“বলা যাবে না। জানো না,মেয়েদের বয়স জিজ্ঞেস করতে নেই?”
পাশ থেকে ইশাদ ছড়া কাটার ভঙ্গিতে বলল,
পার হলে কুড়ি
ডাকে তারে বুড়ি!
চলবে