তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,১১,১২

0
887

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,১১,১২
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১১)

“আমার মনে হয়,আমি ইশাদের মতো দেখতে অন্য কেউ। বাহ্যিকটা এক। কিন্তু ভেতরটা আরেক।”
“তাই নাকি? তা এই অন্য কেউটা কে? তার নাম কী? কোথায় থাকে?”

ইশাদের দীপ্ত মুখটা নিষ্প্রভ হয়ে এল। মৃদু গলায় বলল,

“জানিনা। মনে হয় আমার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে গিয়েছে।”

ইমদাদ চট করে বলল,

“এক মিনিট দাড়া। আমি বাইরে থেকে কয়েকটা ইট নিয়ে আসছি। তোর মাথায় ভাঙলেই স্মৃতিশক্তি ফিরে আসবে!”

ইমদাদ সত্যি সত্যি বেরিয়ে গেল। আশে পাশে কোথাও ইটের দেখা মিলল না। খুঁজতে খুঁজতে রাস্তায় চলে এসেছে। কয়েকটি না পেলেও রাস্তার এক ধারে অবহেলায় পড়ে থাকা ভাঙা আধখানা ইট কুড়িয়ে নিল। মনে মনে বেজায় খুশি! এত দিনের চড়ের বদলা আজ সে ভাঙা ইট দিয়ে নিবে। স্মৃতি ফিরুক বা না ফিরুক বদলা তো পূরণ হবে? ফাজিল ছেলে কথায় কথায় চড় মারা? এবার দেখ তোর মাথার মস্তিষ্কের কী হাল করি! আমায় অবলা পেয়ে তোমার মনে সব সময় সবলা জেগে উঠে? ইমদাদ ব্যঙ্গাত্মক হাসি হাসল। ইট নিয়ে ফিরল নিজের চেম্বারে। তাকে ভেতরে ঢুকতে হল না। ইশাদ বাইরে দাড়িয়ে আছে। তার হাতে ছয় ইঞ্চির সিরিঞ্জ!

ইমদাদের চোখ ছানাবড়। গলার ভেতর জাগছে শুকনো খরা! সে সঙ্কিত স্বরে বলল,

“বন্ধু তোমার হাতে সিরিঞ্জ কেন?”

ইশাদ মহাক্রুদ্ধ হয়ে বলল,

“তোর পাছায় ঢুকাব। আমি সিরিয়াস সমস্যায় ভুগছি আর তুই মশকরা করছিস? ডাক্তার হয়ে ইট দিয়ে স্মৃতিশক্তি ফেরাবি না? আয়! তুই যদি ইট দিয়ে স্মৃতিশক্তি ফেরাতে পারিস তো আমি সিরিঞ্জ দিয়ে স্মৃতিশক্তি বিনষ্ট করতে পারি। দেখি কে আগে সফল হয়!”

ইমদাদের হাত থেকে ইটের টুকরো পড়ে গেল। পালানোর পথ খুঁজছে সে!

________________________________
শাহিনা শাইখা কাপড়ে ইস্ত্রী করছেন। তন্মধ্যেই ইশাদ রুমে ঢুকল। তার উপস্থিত টের পেয়েছেন তিনি। তবে তাকালেন না। ইস্ত্রীরত পান্জাবীটা উল্টিয়ে নিলেন। তারপর আবারও ইস্ত্রীর গরম মসৃণ ছাপের টান মারছেন। ইশাদ কিছু ক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বিছানায় বসে পড়ে। তার চোখে,মুখে কঠোর গাম্ভীর্যের ছাপ। যেন খুবই জরুরী কোনো কথা বলতে এসেছে। এদিকে মায়ের বিশেষ নজরেও আসছে না দেখে ইশাদ ভ্রূ কুটিয়ে তাকাল। মায়ের দিকে নয়,পান্জাবীটির দিকে। এটা বাবার পান্জীবি। গেল বছর ঈদে পড়তে দেখেছিল সে। তারপর আর কখনো পড়ে নি। ইশাদের ভারি অভিমান হল। সামান্য পান্জাবীটাকেও মা কতটা যত্নে হাত বুলাচ্ছেন। যেন পৃথিবীর সবটা ভালোবাসা এই পান্জাবীর জন্য। যার কাছে নিজের ছেলেটাও ঠুনকো! ইশাদ দ্রুত সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে বলল,

“আম্মু?”

শাহিনা শাইখা ছেলের ডাকে নড়লেন না। ছোট্ট করে দায়সারা উত্তর করলেন,

“হুম।”

ইশাদ বসা থেকে দাড়িয়ে গেল। তার গম্ভীরভাব কেটে গিয়েছে। ভেতরটা কেমন যেন অশান্ত হয়ে উঠেছে। বাবার প্রতি মায়ের এই স্বার্থহীন ভালোবাসাটা সে সহ্য করতে পারছে না। কিন্তু কেন? স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা পবিত্র। সেখানে স্বার্থ শব্দটির কোনো জায়গা নেই। তাহলে সে কেন টেনে আনছে?

শাহিনা শাইখা ইস্ত্রী শেষ করে আলমারীর দিকে এগুচ্ছেন। ভেতরে সযত্নে রেখে ছেলের দিকে ঘুরলেন। কাছে এসে বললেন,

“কিছু বলবি?”
“বাবা কোথায়?”
“বাইরে গেছে। কেন?”

ইশাদ জবাব দিল না। বেশ কিছুক্ষণ নিরব থেকে রইল। তার মনে উদ্ভুত এক প্রশ্ন জেগেছে। সেটা কি বলবে? বলার পর মায়ের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তাও ভাবনায় ভাবনায় খেলছে। এক সময় সেটা দমে রেখে বলল,

“কিছু না। এক কাপ চা করে দিবে?”

শাহিনা শাইখা মৃদু হাসলেন। বললেন,

“এখনি করে দিচ্ছি।”

শাহিনা শাইখা রান্নাঘরে চলে গেলেন। চটপট চা বানিয়ে কাঁপে ঢাললেন। সোজা ছেলের রুমে চলে গেলেন। ধোয়া উঠা চা ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বললেন,

“তুই কি কোনো ব্যাপারে চিন্তিত?”

ইশাদ চোখ মেলে তাকাল। বলল,

“নাতো।”

শাইখা শাইখা সামান্য হাসলেন। ইশাদের পাশে বসলেন৷ কপালের চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বললেন,

“তোকে অন্য রকম দেখাচ্ছে। ভীষণ ক্লান্ত!”

মায়ের এই একটি বাক্যেই ইশাদের স্বাভাবিক চেহারাটা বদলে গেল। দুর্বল গলায় বলল,

“ঠিক ধরেছো আম্মু। আমি আসলেই ক্লান্ত। হঠাৎ করে সব কিছু ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। চেনা জিনিগুলোকে অচেনা আবার অচেনা জিনিসকে চেনা। দুটো জিনিসকে আলাদা করতে পারছি না। কেন এমন হচ্ছে আম্মু?”

ইশাদের প্রশ্নের উত্তরে শাহিনা শাইখা চুপ। ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ নিরব চাহনি আঁকলেন। হঠাৎ করেই তার বুকের ভেতরটা ধক করে উঠল। যেন অনিশ্চিত কোনো আসঙ্কার ইঙ্গিত দেখতে পারছেন মুখটিতে! তিনি বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই বসে রইলেন। তারপর নিরবতা ভেঙে বললেন,

“আমার মনে হয় তুই উত্তর না খুঁজে প্রশ্নেই জড়িয়ে যাচ্ছিস। আগে প্রশ্ন থেকে নিজেকে ছাড়া,তারপর উত্তরের পথে পা চালা। দেখবি উত্তরে উত্তরে প্রশ্নগুলো চাপা পড়ে যাবে।”

ইশাদ ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে। মাথা হালকা ঝাঁকিয়ে চায়ে চুমুক দেয়। ঠান্ডা চা ঠোঁটে পড়তে সহসা বলল,

“আম্মু,আমার কি কখনো বড় কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছিল?”

শাহিনা শাইখা ততক্ষণে বসা থেকে দাড়িয়ে পড়েছিলেন। ট্রে হাতে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি ছিল। ছেলের প্রশ্নে প্রস্তুতির ব্যাঘাত ঘটে। ঘুরে বললেন,

“না তো। তবে একবার..”
“একবার?”

ইশাদ চা হাতেই উঠে পড়ে। অতিশয় আগ্রহে চেয়ে অপেক্ষা করছে আম্মুর পরবর্তী কথা শোনার। শাহিনা শাইখা ভাবুক কন্ঠে বললেন,

“তোর পায়ে খুব আঘাত পেয়েছিলি। বল খেলতে গিয়ে। হাঁটু ছিলে রক্ত পড়েছিল। পুরো এক সপ্তাহ হাঁটাচলা করতে পারিসনি।”

ইশাদের আগ্রহ আর উত্তেজনা ফুস করে উড়ে গেল। আশাহত কন্ঠে বলল,

“ওটা আমার মনে আছে আম্মু। আমি আরো বড় কোনো এক্সিডেন্টের কথা বলছি। এই ধরো,মাথা ফেটে যাওয়া!”

শাহিনা শাইখা আতঙ্কে মৃদু চিৎকার করে উঠলেন। যেন সত্যি সত্যি ইশাদের মাথা ফেটে গিয়েছে। দ্রুত কাছে এসে বললেন,

“ছি! কী সব অলক্ষুণে কথাবার্তা। আমার ছেলের মাথা ফাটতে যাবে কেন?”

ইশাদ খানিক হেসে বলল,

“কেন? তোমার ছেলের মাথা কি ফাঁটাপ্রূফ নাকি?”

বলেই হো হো করে হেসে দিল। শাহিনা শাইখা সামান্য রাগ নিয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। তারপর নিজেই হেসে ফেলেন। হাসির ছায়া নিয়ে ইশাদের রুম ছাড়েন। দু পা ফেলতেই তিহির আগমন। তার হাতে একটি পেয়ালা। ঝালির ঢাকনা দিয়ে ঢাকা। শাহিনা শাইখার দিকে এগিয়ে দিয়ে সহজ গলায় বলল,

“গাজরের হালুয়া। আম্মা পাঠিয়েছে আপনার জন্য।”

শাহিনা শাইখা সস্নেহে পেয়ালাটি নিলেন। তারপর বললেন,

“তোমাকে তো দেখিই না। সারাদিন রুমে কী করো? দু/একবার দেখা দিয়ে যেতে পারো তো।”

জবাবে তিহি মিষ্টি হাসল। তার মধ্যেই মিহির আনন্দিত গলা,

“আন্টি আমি রেডি। আমরা কখন বেরোব?”

তিহি মিহির দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল,

“কোথায় যাবি?”
“মার্কেটে।”
“মার্কেটে?”

মিহি সামনে এগিয়ে আসে। শাহিনা শাইখার পাশে দাড়িয়ে উচ্ছল গলায় বলল,

“আন্টি বলেছে,আজ আমাকে অনেক কিছু কিনে দিবে।”

তিহি মিহির গাল ছুঁয়ে সামান্য হেসে বলল,

“বাহ! তোকে তো খুব সুন্দর লাগছে। চুলটা কে বেঁধে দিল?”
“মা।”

মিহির মায়ের কথা উঠতেই শাহিনা শাইখার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। বললেন,

“তোমার মা যাবে না?”
“না।”
“কেন?”
“তা তো বলেনি। বলেছে অন্যদিন যাবে।”
“ওহ!”

তিহি ভরা চোখে শাহিনা শাইখার দিকে তাকাল। মাত্রই ফুটে উঠা খুশির ছটা’টা এখন আর দেখা যাচ্ছে না। কেন? সে সন্দেহী দৃষ্টি ছুড়তে গিয়েও ছুড়ল না। মনে পড়ে আম্মার কথা। আম্মা বলেছে হালুয়া দিয়েই যেন চলে আসে। তার তো দেওয়া শেষ। তার মানে এখন চলে যাওয়ার কথা। তিহি তাড়া দেখিয়ে বলল,

“আচ্ছা,আমি এখন আসি।”

তখনি মিহি তিহির এক হাত চেপে ধরে। স্বাভাবিক গলায় বলে,

“তিহিআপু,তুমিও চলো না।”

তিহি শাহিনা শাইখার দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে উনি বললেন,

“আমার কিন্তু কোনো আপত্তি নেই। চাইলে যেতে পারো। তোমরাও তো এই শহরে নতুন। অনেক কিছু চেনা জানা হবে।”

তিহি ইততস্ত নিয়ে বলল,

“আমার একা বাইরে যাওয়া বারণ।”
“সেকি কেন?”
“যদি হারিয়ে যাই?”

শাহিনা শাইখা না চাইতেও হেসে ফেললেন। হাসি চেপে বললেন,

“তুমি যথেষ্ট বড় হয়েছো তিহি। হারাবে কেন? আর একা তো যাচ্ছো না৷ আমি আছি,মিহি আছে।”

তিহি মন খারাপ করে বলল,

“আম্মা দিবে না।”

ইশাদ রুমে থেকেই সবার কথা শুনছিল। এক সময় সে বাইরে আসে। তিহির দিকে এক পলক চেয়ে আম্মুর উদ্দেশ্যে বলল,

“ইনিয়ে বিনিয়ে না বলে,সরাসরি বললেই পারেন,আম্মুকে সাথে নিয়ে যাবেন।”

তিহি কড়া চোখে তাকায়। ইশাদ তার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেয়। শাহিনা শাইখা বললেন,

“আচ্ছা। তাহলে তোমার আম্মাকেও নিয়ে চলো। আমার হবু বউমা যখন চেয়েছে তুমি যাবে। তখন তোমাকে যেতেই হবে। দরকার পড়লে তোমার আম্মু কেন পুরো পাড়া শুদ্ধ যাবে।”

মুহূর্তেই দু জোড়া চোখ আটকাল মিহির উপর। তারপর চোখ জোড়া একে অপরের ছুঁলো। এক জোড়া চোখে বিতৃষ্ণা,অবজ্ঞা আর অশ্রদ্ধা। অন্যজোড়ায় করুণা আর অসহায়ত্ব! তিহির বিদ্বেষমাখা চোখ জোড়ায় আর তাকিয়ে থাকতে পারে না ইশাদ। দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলে। ফিরে যায় নিজের রুমে।

___________________________

লাল পাড়ের সোনালী সুতোয় বুনা শাড়িটি আলতো করে হাত বুলাচ্ছেন শাহিনা শাইখা। শাড়ির আঁচল,জমিন,পাড় সবকিছু খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছেন তৃপ্তি ভরে। বেশ কিছুক্ষণ চোখ ভরে দেখে দোকানদারের দিকে তাকালেন। পাশ থেকে তিহি বলল,

“শাড়িটি খুব সুন্দর। কিন্তু মিহির বয়স তো অল্প। আরেকটু ভারি কাজের হলে ভালো হতো না?”

শাহিনা শাইখা মৃদু হাসলেন। বললেন,

“এটা মিহির জন্য না।”

তিহির সন্দেহ ভাবটা চলে গেল। উৎসাহ নিয়ে বলল,

“আপনার জন্য? খুব সুন্দর লাগবে। আমাকে কিন্তু অবশ্যই দেখাবেন।”

শাহিনা শাইখার মৃদু হাসিটি জোরালো হলো। তিহির দিকে চেপে এসে মৃদু গলায় বললেন,

“আমার জন্যও নয়।”
“তাহলে?”
“আছে। একজন বিশেষ কেউ।”

তিহি আর কোনো প্রশ্ন তুলল না। বিবেক বাধা দিল। যেখানে নাম অথবা সম্পর্ক উল্লেখ না করে বিশেষ শব্দটি ব্যবহার করেছে সেখানে প্রশ্ন তোলা শুধু বোকামীই নয়,অভদ্রতা। এই মুহূর্তে সে অভদ্র হতে চায় না৷ ভদ্র সেজে চুপ করে বসে রইল। পাশ থেকে রেখা ভূঁইয়া চোখের ইশারায় কিছু জিজ্ঞেস করলেন। তিহি মাথা নেড়ে কিছু হয়নি বুঝায়।

দু’হাত ভর্তি শপিং ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে আসে চার মানবী। সকলের চোখে,মুখেই পরিতৃপ্ত ভাব। যেন কত দিন পর এমন একটি আনন্দিত মুহূর্ত কাটিয়েছে। বাইরে বের হয়েই শাহিনা শাইখা সকলের উদ্দেশ্যে বললেন,

“খালি পেটেই ফিরবে? কেউ কিছু খাবে না?”

কারো উত্তরের অপেক্ষা করলেন না তিনি। মার্কেটের পাশেই একটি রেষ্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে পা ফেললেন। ইচ্ছেই হোক বা অনিচ্ছায় সকলে তার পিছু নিল। ভারি কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ে সবাই। মিহির চোখে,মুখে বিস্ময়! দু ধারে বিন্যাসিত টেবিলে চোখ বুলায়। লাল,নীল আলো ছড়ানো লাইটগুলোতেও চোখ রাখতে ভুলে না। এদিক সেদিক চোখ রেখে হাঁটতে গিয়ে নজর পড়ে পাশের একটি টেবিলে। একটি ছেলে বসে আছে। তার কপাল জমে আসে। কোথাও দেখেছে মনে হচ্ছে। কিন্তু মনে করতে পারছে না। কী ভেবে টেবিলের নিচে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। নাক সিটকে ছি! উচ্চারণ করতে ছেলেটির বুলি শুনতে পেল,

“সোনা,আমারটা ভালো লাগছে না। তোমারটা থেকে খাই? জানো তো,ভাগাভাগি করে খেলে মহব্বত বাড়ে!”

বলতে বলতে ছেলেটি নিজের কফিতে ডুবে থাকা পাইপটি নিয়ে মেয়েটার কফিতে ডুবিয়ে দিল। গভীর চুমুক দেওয়ার জন্য উদ্যত হতেই মিহি মুখ ফিরিয়ে নেয়। দ্রুত হেঁটে যাওয়ার জন্য পা ফেলতেই ওয়েটারের সাথে ধাক্কা খেল। তার হাতের গরম স্যুপ গিয়ে পড়েছে মিহির গলায়। সে ছিটকে পাশে সরে যেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল ছেলেটির উপর। ছেলেটি পাইপ দিয়ে কফি খাচ্ছিল। আকস্মিক ধাক্কায় পাইপ তার গলায় গিয়ে ঠেকল,নাক ডুবে গেল গরম কফিতে!

ছেলের অপর পাশে বসে থাকা মেয়েটি দাড়িয়ে যায়। চেঁচিয়ে উঠে,

“বাবু! কী হলো?”

মিহি ভয়ে দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে। দৌড়ে ওয়েটারের পেছনে লুকিয়ে পড়ে। ততক্ষণে ছেলেটি কফি থেকে নাক উঠিয়ে ফেলেছে। টিস্যু নাকে চেপে ধরে,চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে। চোখ দিয়ে যেন অগ্নি ঝরছে। সামনে যাকে পাবে তাকিই জ্বালিয়ে শেষ করে দেবে। ভয়ে মিহির বুক ধুরুধুরু করছে। শ্বাস আটকে পালাবে তখনি সামনে থেকে ভেসে আসে কাতর চিৎকার,

“তিহি? তিহি মা?”

পুরো রেষ্টুরেন্টে শোরগোল শুরু করে হয়। সকলেই উৎসুকে ছুটে যায় সামনে। বিশ/ত্রিশ জনের ছোট্ট গোল বেধে গিয়েছে। মিহি সেদিকে ছুটার পূর্বেই ছেলেটি দৌড়ে যেতে চাইল। কিন্তু তার সঙ্গী মেয়েটি আটকে বলল,

“কোথায় যাচ্ছো ইমদাদ? এসব ঝামেলায় জড়াতে হবে না। আমার সাথে এসো।”

মেয়েটি জোরপূর্বক ইমদাদকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। মিহি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচল। উদ্বিগ্নতায় ছুটে ভিড়ের দিকে!

_________________________
ইশাদ দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। সাতটা বেজে বিশ। মিহিরা বেরিয়েছে চারটার পর। এখনো ফিরছে না দেখে কিঞ্চিৎ চিন্তার ভাজ পড়ে ইশাদের কপালে। হঠাৎ করেই ভেতরটা হাসফাঁস করছে। ফোন তুলে নেয় হাতে। কল করে মায়ের নাম্বারে। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ রিসিভ করছে না। ইশাদের ভেতরের অস্থিরতা বেড়ে যায়। আবারও কল লাগায়। এবার রিসিভ করল। তবে মা নয়,মিহির গলা,

“আন্টি তো এখানে নেই ইশাদ ভাইয়া। আসলে কল দিতে বলব।”

বলেই মিহি কল কেটে দিল। ইশাদ কিছু বলার সুযোগই পেল না। নিমিষেই তার রাগ জেগে গেল। মনে হলো মিহি সামনে থাকলে একটা চড় বসিয়ে দিত। রাগ নিয়েই আবার কল দিল। এবারও মিহিই ধরল,

“আন্টি আসেনি তো।”

ইশাদ ঝারি দেওয়ার অবস্থায় থাকলেও দিল না। দ্রুত বলল,

“কোথায় গেছে?”
“ভেতরে।”
“কিসের?”
“হাসপাতালের।”
“হাসপাতাল? আম্মু হাসপালে কি করছে? তুমি কোথায়?”
“আমিও হাসপাতালে।”

মিহির ছোট ছোট উত্তরে ইশাদের ধৈর্য্য হারিয়ে যাচ্ছে। খানিকটা শক্ত গলায় বলল,

“তোমরা ওখানে কী করছো?”
“আমি অপেক্ষা করছি। দুই আন্টি ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। আর…”
“আর?”
“তিহিআপু সাদা বিছানায় শুয়ে আছে। অজ্ঞান হয়ে গেছে তো তাই।”

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১২)

সূর্য তার সকল আলো নিজ দখলে নিয়ে হারিয়ে গিয়েছে পৃথিবী থেকে। বিপরীতে দিয়ে গিয়েছে এক দলা কালো আঁধার। সেই আঁধার কাটাতে মানুষের কত চেষ্টা! শুধু কি নিজের ব্যক্তিগত রুম? রুম ছেড়ে বারান্দা,ছাদের এক অংশে,বাড়ির সামনে গেইটের এককোণেতেও আজকাল রঙবেরঙের আলোর উৎস দেখা যায়। রাস্তার ধারে ধারে তো ল্যাম্পপোস্টের জুড়ি নেই। তাদের মধ্যে কি ইশাদ পড়ে না? সন্ধ্যার আঁধার কাটাতে সে কেন রুমের আলো জ্বালায়নি? তবে কি এই অন্ধকারেই সে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে? জড়িয়ে পড়েছে আঁধারের মায়ায়? নাকি লুকাতে চাচ্ছে নিজের উন্মাদ অনুভূতিকে?

ইশাদ ফোন ফেলে উদাসীন পা ফেলে ছাদের উদ্দেশ্যে। পায়ে পায়ে কাটে সিড়ির মসৃণ ধাপ। আজও রেলিং ঘেরা ছাদটি অন্ধকার। আকাশে চাঁদ নেই। লুকিয়েছে? মেঘের বুকে? নাকি অভিমানে ঘাপটি মেরে বসে আছে কোথাও? ইশাদ জানে না। জানতে চায়ও না৷ হয়তো জানার মতো অবস্থাতেই নেই। কেমন এক ভ্যাপসা অস্বস্থি হচ্ছে তার। দগদগ করে জ্বলছে অস্থিরতা। যেন মারাত্বক কিছু ঘটে গিয়েছে তার সাথে। এমন কিছু যা সে মনপ্রাণ দিয়ে ধরে রাখতে চেয়েছিল কিন্তু পারে নি। এ কেমন অনুভূতি? কেমন!

আচমকা বেখেয়ালি নজর পড়ে তিহিদের রুমে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে আছে রুমটি। এক ফোঁটা আলোর রশ্মি দেখা যাচ্ছে না। সঙ্গে সঙ্গে ইশাদের হাত চলে যায় গলায়। কী হলো তার? শ্বাসনালীতে জ্যাম পড়েছে? নিশ্বাস নিতে পারছে না কেন? ইশাদ হা’করে নিশ্বাস টানছে আর বিড়বিড় করে উচ্চারণ করছে,

“আপনি জ্ঞান হারালে আমার কী? যাব না আপনাকে দেখতে। কেন যাব? কোন মায়ায় যাব? কি হোন আপনি আমার? কিছু না। সামাজিক সম্পর্ক ধরলে আমাদের ভাড়াটিয়া হোন। সে সুবাধে তো আমার আম্মু আছেই তাহলে আমার যাওয়া কী দরকার? বেশি কিছু তো আর হয়নি। শুধু জ্ঞান হারিয়েছেন। মরে তো যাননি!”

শেষ কথাটা উচ্চারণ করতেই ইশাদের গলা ধরে এল। যেন কেউ তার গলাটা হাতের মুঠোতে নিয়ে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে। শেষ করে দিতে চাচ্ছে তার অস্তিত্ব,স্থিতি,বিদ্যমানতা! এমন ভীষণ রকম জ্বালাপোড়া নিয়ে কি বাঁচা যায়? না সহ্য করা যায়? ইশাদও সহ্য করতে পারছে না। এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে ছটফট করতে থাকে। এক পর্যায়ে চোখ,মুখ খিঁচে দৌড় লাগায় বাইরের উদ্দেশ্যে!

“ইশাদ,তুই এখানে? কখন এলি?”

মায়ের ছোট ছোট চোখে অবাকের মৃদু ছাপ। উত্তর দিতে গিয়ে এক গাদা জড়তা চেপে ধরল। ইশাদ এসেছে পাঁচ মিনিট হবে। ক্ষুধার্ত চোখ নিয়ে এদিক সেদিক চোখ ফেলছিল। তিহিকে ঠিক কোথায় ভর্তি করা হয়েছে এই তথ্যটি তার অজানা। জানতে হলে মায়ের নাম্বারে কল দিতে হতো। কিন্তু সে চাচ্ছিল না কেউ জানুক। কোনো রকম সন্দেহের স্বীকার হতে চায় না। বিশেষ করে মায়ের। মায়ের চোখ দুটিকে সে ভীষণ ভয় পায়। মনে হয় চোখদুটো তার চামড়া ভেদ করে রূহ পর্যন্ত পৌছে যায়। কোনো রকম সামান্য বাধার স্বীকারও হয়না!

“কিরে? কিছু বলবি?”

মায়ের সামান্য ধমকে ইশাদ নড়ে উঠল। যথা সম্ভব জড়তা কাটিয়ে ছোট্ট করে উত্তর দিল,

“তোমাকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছিল খুব।”

শাহিনা শাইখা কিছু বলতে চেয়েও থেমে গেলেন। ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে মমতা ঢেলে বললেন,

“খুব ভালোবাসিস?”

মায়ের কাছ থেকে এমন অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে ইশাদ চমকে উঠে। চোখের পাতা পরিপূর্ণ উর্ধ্বে উঠে স্থির হয়ে আছে। কিছু সেকেন্ড সময় নিয়ে চমকের মাত্রা শূন্যে আনে। আমতা আমতা করে বললো,

“কাকে?”
“কাকে মানে?”

শাহিনা শাইখার কোমল মুখটি কাঠিন্যতায় ছেয়ে এসেছে। সরু চোখে চেয়ে আছে ছেলের দিকে। ইশাদ হাত দুটো প্যান্টের পকেটে ভরে মৃদু গলায় বলল,

“ভীষণ। তোমার বুঝি অজানা? নাকি নতুন করে ছেলের ভালোবাসার পরীক্ষা নিবে,আম্মু?”

শাহিনা শাইখা হেসে ফেললেন। ছেলের মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন,

“তোর ভালোবাসায় ভর করেই তো এখনো হেঁটে চলেছি। অনেক দিন তো একা একা চললাম। এবার সঙ্গী নিয়ে চলব। ভালোবাসার পথটা সমান ভাগে থাকবে নাকি কম বেশি হবে?”

ইশাদ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চেয়ে আছে। মা সঙ্গী বলতে কাকে বুঝাচ্ছে? শাহিনা শাইখা ইশাদের পাশে এসে দাড়ালেন। আঙুল উচিয়ে ইশারায় দেখালেন,

“ঐ যে মিষ্টি মেয়েটা। তুই বললে আমার ভাগেরটাও ওকে দিয়ে দিতে পারি।”

ইশাদ সামনে তাকায়। বেশ কয়েকজন অপেক্ষারত মানুষের সঙ্গে মিহি বসে আছে। তার কোলের শপিং ব্যাগগুলো নিচে পড়ে গিয়েছে। সেগুলোই তুলছে আর বিরক্ত প্রকাশ করছে। তার ছোট ছোট নরম হাত এতোগুলো ব্যাগ সামলাতে পারছে না। একটা তুলছে তো দুটো পড়ে যাচ্ছে। এদিকে চুল ঠিক করতে গিয়ে আরো নষ্ট করে ফেলেছে। গলার ওড়নাটা পড়ে যেতেই ইশাদ দ্রুত ছুটে যায়। মেঝেতে বসে পড়ে ব্যাগগুলো নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল,

” এগুলো আমি দেখছি। তুমি সাবধানে বসো।”

মিহি ওড়না তুলে নিল। বসল না। দাড়িয়ে বলল,

“বসে থাকতে থাকতে পা ব্যথা হয়ে গিয়েছে। আমি একটু হাঁটি?”

ইশাদ সামান্য হাসে। মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই সে চটপট পা ফেলে। এদিক সেদিক হেঁটে এসে বলল,

“চলুন তিহি আপুকে দেখে আসি।”

শেষ শপিং ব্যাগটা গুছিয়ে নিয়ে ইশাদ দাড়াল। পড়ে থাকা যন্ত্রণাটা আবার মাথা তুলে তাকিয়েছে। যাকে দেখার জন্য এভাবে ছুটে আসা তাকেই যে দেখা হয়নি। ইশাদ এক পলক তাকায় মিহির দিকে। তার চোখে উৎসুকরা খেলা করছে। ইশাদ আর কথায় বাড়ায় না। মিহিকে চোখের ইশারায় বুঝিয়ে দিল। মিহিও যেন এক মুহূর্তেই বুঝে ফেলল। সে ছোট ছোট পা ফেলে করিডোর পার হচ্ছে। তার চলন গতি বলে দিচ্ছে তিহির অবস্থান সম্পর্কে সে অবগত।

তিহির জ্ঞান ফিরেছে অনেক্ষণ। চোখে শীতল চাহনি। মুখটা গম্ভীর,ক্লান্ত,থমথমে! তার পাশেই বসে আছেন রেখা ভূঁইয়া। রাজ্যের দুশ্চিন্তা যেন তার মুখেই বাসা বেঁধেছে। এক হাতে মেয়েকে আগলে নিয়ে নিচু গলায় কিছু বলছেন। মিহি পর্দা ঠেলে ভেতরে চলে গেল। ইশাদ পা তুললেও সামনে ফেলতে পারেনি। আগের জায়গায় ফেলে নিষ্পলকে তাকিয়ে আছে তিহির দিকে। কিছু ঘন্টার ব্যবধানেই মেয়েটার মুখটা ফ্যাকাশে রূপ নিয়েছে। এই মেয়েটিই যে সুযোগ পেলে তাকে দু বেলা কথা শোনায় তা কেউ বিশ্বাস করবে? ইশাদের নিজেরই তো বিশ্বাস হচ্ছে না। ইচ্ছে করছে রেখা আন্টির জায়গায় নিজেকে বসাতে। সেটা কি আদৌ সম্ভব?

“দাড়িয়ে রইলি যে? ভেতরে চল।”

শাহিনা শাইখা কথা পারতে পারতে ছেলেকে নিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলেন। তিহি আড়চোখে তাকাল। তাকিয়েই রইল। ইশাদ খেয়াল করল তিহির মুখের রং বদলাচ্ছে। কিছু বুঝার আগেই তিহি চোখের ইশারায় ইশাদকে ডাকে। ইশাদের চোখের পাতা নড়ে। চোখ ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল। তাকেই যে ডাকছে সেটা নিশ্চিত হওয়ার পূর্বেই তিহি খানিকটা উচু গলায় বলল,

“আসতে হবে না। বিরক্তকর!”

তিহির আকস্মিক কান্ডে সকলেই অবাক। আগাগোড়া কিছুই বুঝল না। রেখা ভূঁইয়া বুঝার জন্য কিছু সুধাবেন তার আগেই তিহি আরেক দফায় চেঁচিয়ে উঠল,

“আমি এখনি বাসায় যাব।”

____________________________

চিন্তায় চিন্তায় ইশাদের নাওয়া,খাওয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম। সারাক্ষণ মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ সুর তুলে চলেছে তিহিনামক ভ্রমরটি। কিছুতেই এক সেকেন্ডের জন্যও ভুলে থাকতে পারছে না। তার মধ্যে প্রশ্নের বাজনা তো আছেই। সময় পেলেই ঝনঝন সুর তুলে মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে। এই মেয়েটির জন্য এত মায়া,এত উতলা কেন? কি আছে? কিসের টান অনুভব করে? শুধুই কি রূপের আকৃষ্ট? নাকি অন্যকিছু! যা চোখের পাতায় ঝাপসা হয়ে উঁকি দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। বার বার তাকে নিয়েই কেন স্বপ্ন দেখছে? তাও এমন ভয়ঙ্কর,দুর্বিষহ কষ্টদায়ক? ইশাদের সকল স্নায়ুতন্ত্রগুলো বার বার প্রশ্নে জড়িয়ে পড়ছে। কোনো রকম উত্তর পাচ্ছে না। কোনো দিশাও খুঁজে পাচ্ছে না। কি করে মুক্তি পাবে এই অদ্ভুত যন্ত্রণা থেকে?

রাত দুটো। ইশাদ শত কষ্ট,শত ট্যাকনিক খাটিয়েও চোখে ঘুম নামাতে পারেনি। এক সময় চোখ খিঁচে বন্ধ করে পড়ে থাকে। কিন্তু কতক্ষণ? সব শেষে বিরক্ত হয়ে উঠে বসে। চোখ মেলে চারপাশ দেখে। বিছানা ছাড়ে। বন্ধ জানালা খুলে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত হাওয়া ফুরফুর করে ঢুকে পড়ে। ইশাদ প্রাণভরে নিশ্বাস টানে। উপায় খুঁজে রাত কাটাবার। এভাবে শুধু শুধু বসে থাকলে এক মিনিটকে এক যুগ মনে হবে। বহুক্ষণ ভেবে সময় কাটানোর পন্থা খুঁজে পেল। ল্যাপটপ খুলে বসে। ছবি দেখবে। অনেক দিন হলো মুভি দেখা হয় না। ভাবনামতে ইউটিউবে ঢুকে পড়ে। সার্চ অপশনে ক্লিক করতে গিয়ে নজর পড়ে হোমপেজে। শাহ রুখ খানের ওম শান্তি ওম ছবিটা ভেসে আছে। মুহূর্তেই ইশাদের মাথায় পুরো ছবির কাহিনি পর পর ঘুরপাক খাচ্ছে। এক পর্যায়ে উচ্চারণ করে,’পুনর্জন্ম!’

ইশাদ ল্যাপটপ ফেলে ফোন তুলে নেয়। ইমদাদের নাম্বার ডায়েল করে। এক,দুই তিন বার রিং হতে কল রিসিভ হলো। অপরপাশ থেকে কোনো উত্তর শোনার পূর্বেই ইশাদ প্রবল উদ্দীপনায় বলল,

“বন্ধু,আমার মনে হয় পুনর্জন্ম হয়েছে।”
“কে বলছেন?”

মেয়েলি কন্ঠ পেয়ে ইশাদ ফোনটি কান থেকে নামাল। অতিশয় উত্তেজনায় ভুল নাম্বারে কল দিয়ে বসেনি তো? ফোনের স্ক্রিনে চোখ ফেলেই মুখ তেতো হয়ে আসল। শক্ত গলায় বলল,

“ইমদাদকে ফোন দিন।”
“ও তো ঘুমাচ্ছে। কে আপনি?”

ইশাদের ইচ্ছে হলো ইমদাদের ঝাঁঝটা এই মেয়ের উপর ঢেলে দিতে। সব ইচ্ছে পূরণ করতে নেই। এতে ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব পড়ে। ইশাদ নিজেকে সংযত করে বলল,

“সকাল দশটায় ইমদাদকে আমার সামনে দেখতে চাই।”

___________________________

ইশাদ হাতের ঘড়িতে চোখ রেখে দাঁতে দাঁত পিষছে। ঘন্টার কাটা দশ ছেড়ে এগারতে পড়েছে। একটু পর বারোতে পড়বে। এই ছেলের জন্য অপেক্ষা করা মানে জীবন থেকে মূল্যবান সময়টা অকারণে ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলা। যা করতে ইশাদ নারাজ। সে চোখের রাগ শুকনো ঢোকে পেটে ঢুকিয়ে দিল। নিজের ক্লিনিক ছেড়ে রাস্তায় চলে আসে। ড. রিদিমার সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। উনি মনোরোগ বিশেষজ্ঞ!

কাল রাত থেকে ইশাদের মাথায় ‘পুনর্জন্ম’ নামের নতুন পোকা ঢুকেছে। যদিও এই ব্যাপারে সে বিশ্বাসী নয়। কেননা,হিন্দু,জৈন,বৌদ্ধ ধর্ম পুনর্জন্ম বিশ্বাস করলেও ইসলাম ধর্ম করে না। করে না বললে ভুল। ইসলাম ধর্মেও পরিষ্কার করে পুনর্জন্মের কথা উল্লেখ করা আছে। তবে তার অর্থ বা ব্যাখ্যা অন্যরকম। এই ধর্মে পুনর্জন্ম বলতে মৃতদেহে আবারও আত্মা দেওয়া হবে। উজ্জীবিত করা হবে পুনরায়। তবে সেটা পৃথিবীতে নয়। হাশরের ময়দানে। যেখানে পাপ-পুন্যের বিচার করা হবে। আর ফলস্বরূপ জান্নাত বা জাহান্নামে পাঠানো হবে। কিন্তু অন্যান্য ধর্মে পুনর্জন্ম মানে আবারও পৃথিবীতে আসা। বিশেষ করে হিন্দুসমাজে বিশ্বাস করা হয়,আগের জন্মে অপূর্ণ ইচ্ছে পূরন করতে ভিন্নভাবে ভিন্ন দেহের সাহায্যে পুনর্জন্ম হয়। অনেকে এ রকম বিশ্বাসও করেন,আগের জন্মের পাপের শাস্তি বা পূন্যের ভালো ফল ভোগ করতেও পুনর্জন্ম ঘটে। ইশাদ মুসলমান। সেদিক থেকে পুনর্জন্ম শব্দটা ব্যবহার করতে না চাইলেও মাথা থেকে বের করতে পারছে না৷ বার বার তিহির আর্তনাদ কানে আসে। মনের কোনো এক কোণে এমন প্রশ্নও জাগে যে হয়তো তিহির বন্দী দশা,অতি করুণ ও শোচনীয় অবস্থার দায় সে। নাহলে তিহির বিপরীতে বার বার নিজে উপস্থিত হয় কী করে? এই রকম শত শত প্রশ্ন থেকে মুক্তি পেতেই সে সাইক্রিয়াটিস্টের শরণাপন্ন হচ্ছে। হোক সত্য,হোক মিথ্যা মনের সন্দেহ থেকে তো মুক্তি পাবে? তাকে যে মুক্তি পেতেই হবে!

“নাম?”

সুমধুর তরঙ্গের মতো ছোট্ট প্রশ্নে ইশাদের হুশ এল। সে কোথায় হারিয়েছিল কে জানে? সামনে তাকাতে দেখল খালি চেয়ারটি খালি নেই। সেখানে একজন মহিলা বসে আছেন। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি হবে। বেশিও হতে পারে! মুখ দেখে বুঝার জো নেই। ফর্সা বর্ণের গোলগাল মুখটিতে চশমা এঁটে আছে। ঠোঁটে কি লিপস্টিক পড়েছে? মুহুর্তেই ইশাদের মনে বাড়ি খেল। সব ছেড়ে তার চোখ ঠোঁটে আটকাল কেন? তবে কি তিহি ঠিক? সে আসলেই নষ্ট পুরুষ?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here