#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (১৪)
#রোকসানা_রাহমান
“ইশাদ ভাইয়া,আপনি কান ধরে উঠবস করছেন কেন? স্কুল স্কুল খেলছেন?”
মিহির কন্ঠ পেয়ে আরো দুজোড়া চোখ পড়েছে ইশাদের দিকে!
ইশাদ স্তম্ভ,শক্ত কাঠ হয়ে মাঝপথে আটকে আছে। না বসছে না দাড়াচ্ছে। সে অবস্থায় চোখ ঘুরিয়ে দেখছে সবাইকে। শাহিনা শাইখা তিহির থেকে দু কদম এগিয়ে এসেছেন ইশাদের দিকে। তার চোখ ভর্তি সন্দেহের বীজ! ডাইনিং টেবিলে বসে সোবহান শাইখও ছেলের দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাঁর মুখ দেখে মনে হচ্ছে,ইশাদ পৃথিবীর কোনো প্রাণী,বস্তু নয়। ভিনগ্রহ থেকে ভুল করে ছিদ্র দিয়ে পৃথিবীতে পড়ে গিয়েছে!
সকলের চাপা সন্দেহ দূর হলো মিহির ঝরঝরা কন্ঠে। সে দৌড়ে ইশাদের সামনে এসে দাড়ায়। অতি আবেগে আপ্লুত কন্ঠে বলল,
“আমিও খেলব। আমি স্টুডেন্ট হব নাকি টিচার?”
ইশাদ তখনো নিজেকে সামলিয়ে উঠতে পারেনি। মিহির কথাগুলো মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সে ভুল করেও ভাবেনি এভাবে বাবা,মায়ের চোখে পড়ে যাবে। এই মুহূর্তে তার করণীয় কী? কী করে সামলাবে গোটা পরিবেশটা? তিহি কি সামলাতে দেবে? যদি বলে দেয়? আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়া বুঝি একেই বলে!
ইশাদের দিক থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে মিহির মুখটা বিষণ্ণে ছেয়ে গেল। দুঃখী মুখ করে বলল,
“কতদিন হল স্কুলে যাই না। খুব মিস করছি!”
মিহির কথাটাকে টোপ হিসেবে গিলে নিল ইশাদ। ঠোঁটে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়ে বলল,
“আমিও।”
মিহি মাথা তুলে তাকায়। অতিশয় আগ্রহ নিয়ে বলল,
“তাই? আপনিও বুঝি অনেকদিন স্কুলে যান না?”
ইশাদ কান ছেড়ে দিয়েছে। সোজা হয়ে দাড়িয়ে শরীর ঝাড়া দিল। এক ঝলক তিহির দিকে তাকিয়ে বলল,
“হুম। অনেক বছর। তাও প্রায় বারো/চৌদ্দ বছর হবে।”
ইশাদ কথাটা শেষ করে আবারও তিহির দিকেই তাকাল। মেয়েটার চোখ,মুখ দেখে কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। হাতে গ্লাস নিয়ে এক ধ্যানে ইশাদের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতা ফেলতে কি ভুলে গেল? ইশাদের ইচ্ছে হলো,দৌড়ে তিহির কাছে চলে যেতে তারপর শক্ত গলায় বলতে, এই মেয়ে চোখের পাতা ফেল। দেখছো না ভয়ে আমার বুকের পাটাতনে খরা ধরেছে?
ইশাদের সুপ্ত শোচণীয় অবস্থাটা বুঝি তিহি পড়তে পারল। দৈবকর্ণে কি তার মনের আকুতিটাও শুনতে পারল? হয়তো! সেজন্যই ধ্যান ভাঙতে পাতা ফেলল। মিহির সামনে এসে বলল,
“আমিও!”
তিহির কন্ঠ উদাস। চোখের দৃষ্টিটাও! হাতের গ্লাসটা মাটির দিকে মুখ করা। যেকোনো সময় পড়ে যেতে পারে। ইশাদ জায়গা পরিবর্তন করে। বুঝে ফেলে পরিস্থিতি অন্যদিকে চলে যাচ্ছে। এই দ্রুত পরিবর্তনটাকে আরো দ্রুত করতে হবে। বেফাঁসেও তিহির মুখ থেকে চুমুর কথা বের করা যাবে না। তাহলে কেলেংকারী হয়ে যাবে! এই পূর্ণ বয়সে বাবা-মায়ের সামনে ইজ্জত লুটিয়ে যাবে,এটা কি হতে দেওয়া যায়? তার মধ্যে দুদিন পরে বিয়ে! ইশাদ তিহির পাশাপাশি দাড়ায়। এক হাত দূরত্ব রেখে। মনে মনে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করে, চুম্বককন্যা! সামনা সামনি মিহির উদ্দেশ্যে বলল,
“তুমি তো এসএসসি দিয়েছো। কলেজে ভর্তি হবে না?”
মিহির চোখ দুটো ক্ষনিকের জন্য তেজোময় হয়ে উঠে। ঘাড় ফিরে নিজেদের রুমের দিকে তাকায়। রুবিনা দরজার আড়ালে দাড়িয়ে আছেন। অন্যরা না দেখলেও মিহি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। সেদিকে চোখ রাখতে রাখতে চোখের আনন্দটা নিস্তেজ হয়ে আছে। মুখটা চুপসে যায়। দুর্বল স্বরে বলল,
“কিন্তু মা যে বলেছে,আমার আর পড়তে হবে না।”
ইশাদ তিহিকে পিছে ফেলে মিহির কাছে চলে আসে। কাঁধে হাত রেখে দীপ্ত স্বরে বলল,
“তুমি ভর্তি হবে নাকি তাই বলো। বাকিটা আমি দেখছি।”
মিহি ইশাদের মুখের দিকে তাকায়। নতুন কিছু পেয়েছে,আরো পাবে। সেরকম আশা বাঁধছে বুকে। তবে কী পেয়েছে, আর কীই বা পাবে তা ঠিকঠাক আন্দাজ করতে পারছে না। তার ভেতরে ভেতরে আনন্দের ফুলকি জ্বলজ্বল করছে। এক অদ্ভুত আলোর খেলা চলছে তার সর্বাঙ্গে! মিহির মুখ উজ্জ্বল হয়। সে চোখ মেলে আনন্দিত গলায় বলল,
“হবো।”
“লক্ষী মেয়ে। আমি কালই খোঁজ নিব। এখন তো ফেব্রুয়ারী চলছে। ইন্টারমিডিয়েটের ভর্তির সময় নয়। প্রাইভেট কলেজে কথা বলে দেখতে হবে।”
ইশাদের কথা শেষ হতেই মিহি তিহির কাছে আসে। কোমর জড়িয়ে বলল,
“ইশাদ ভাইয়া,আমি তিহি আপুর কলেজে ভর্তি হব।”
ইশাদ আড়চোখে তিহির দিকে তাকায়। বেশিক্ষণ চাহনি ফেলতে পারে না। দৃষ্টি সরিয়ে সরল গলায় বলল,
“উনি কোন কলেজে পড়েছে আমি জানি না।”
মিহি তৎক্ষনাৎ তিহিকে প্রশ্ন করে,
“তিহি আপু,তুমি কোন কলেজে পড়েছো?”
তিহি মিহির কাঁধ জড়িয়ে ছিল। প্রশ্ন শুনে কাঁধ থেকে হাতটা সরিয়ে ফেলে। নির্লিপ্তে চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। নিমিষেই তার কপালের মাঝে ক্ষীণ ভাজ করে অনেকগুলো। কপালের দুধারে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে। মুখের রঙ ধীরে ধীরে পরিবর্তনের পথে। তার মধ্যেই আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে আসেন শাহিনা শাইখা। বললেন,
“কী হলো? চুপ করে আছো যে? অনেক দিন হল আমাদের এখানে থাকছো। তোমার ব্যাপারে তো তেমন কিছুই জানিনা তিহি। তুমি কি পড়াশোনা করো? কিসে পড়ো?”
তিহির চোখের দৃষ্টি বদলাল। সে অবুঝের মতো তাকিয়ে আছে শাহিনা শাইখার দিকে। যেন এই সব প্রশ্ন এই প্রথম শুনছে! তিহির নির্বাক আচড়ণে ইশাদও খানিকটা আশাহত হল। সে মনে মনে কৌতুহল সৃষ্টি করছিল। এই মেয়ের ব্যাপারে তার কাছেও তেমন কোনো তথ্য নেই। তথ্য পাওয়ার কোনো সুযোগ ও নেই। কিছু জিজ্ঞেস করলে তো বলেই না। উল্টো সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করবে। আর ইশাদের উপর বিষ ঢেলে দিবে৷ তিহি কি জানে? এই বিষের যন্ত্রণায় ইশাদ দুনিয়া ভুলে যায়?
শাহিনা শাইখা তিহির গাল ছুঁলেন। বললেন,
“পড়াশোনা করো না? অন্য কিছু করো? কিছুই তো বলছো না। লজ্জা পাচ্ছো? দেখে তো মনে হচ্ছে না।”
“তিহির পড়া শেষ!”
রেখা ভূঁইয়ার কন্ঠস্বরে সকলেই সিড়ির দিকে তাকাল। তিনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। তিহিকে টেনে নিলেন নিজের দখলে। পাশ থেকে জড়িয়ে ধরলেন। ওর মুখটা কাঁধে জোরপূর্বক ফেলে সবার উদ্দেশ্য বললেন,
“অনেক দিন হল মাস্টার্স শেষ করেছে।”
শাহিনা শাইখা কৌতুহল নিয়ে বললেন,
“বাহ! কোন ইউনিভার্সিটি থেকে?”
রেখা ভূঁইয়া অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। শাড়ির আঁচল গলায় ধরছেন। যেন ঘাম মুচছেন। কিছুক্ষণ আমতা আমতা করে বললেন,
“আমাদের ঐদিক থেকে। আপনারা চিনবেন না।”
ইশাদের ভ্রূর মাঝে ভাঁজ পড়েছে। তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে ছিল তিহির দিকে। আপাতদর্ষণে একজন ছাত্রের মাস্টার্স শেষ করতে করতে বয়স চব্বিশ পার হয়ে যায়। কিন্তু তিহি? সে মিহির মতো কিশোরী নয়। তরুণী। পূর্ণযৌবনা! কিন্তু বয়সের সাথে পড়াশোনাটা ঠিক মেলাতে পারছে না। তার ধারণা বলছে,তিহি যদি পড়াশোনা করত তাহলে অনার্স দ্বিতীয় কী তৃতীয় বর্ষে থাকত। ধারণা ভুলও হতে পারে। অনেক সময় বয়সের সাথে শারীরিক গড়নের মিল পাওয়া যায় না। ইশাদ চিন্তা দূর করতে প্রশ্ন করল,
“চিনব না কেন? আজকাল নেটে সব পাওয়া যায়। নাম দিয়ে সার্চ দিলেই সব তথ্য হাজির। আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হলে তো মুখে মুখে থাকার কথা। তিহি কি ন্যাশনালে পড়েছে?”
রেখা ভূঁইয়ার মুখটি পাংশুবর্ণে বদলে যাচ্ছে। গলার স্বর বোধ হয় কাঁপছে। সে কথা বলা বাদ দিতে মাথা দুলাল। তারপর দ্রুত চলে যাওয়ার জন্য উদ্যত হতে ইশাদ দৃঢ় স্বরে বলল,
“কোন বিশ্ববিদ্যালয়? কোন জেলা?”
ইশাদের প্রশ্নটা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করলেন কি? নাকি শুনতেই পাননি? রেখা ভূঁইয়া দ্রুতগামীতে সিড়ি পার হলেন। তিহি মায়ের কাঁধে মুখ রেখেই একবারটি ইশাদের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে ইশাদের শিরদাঁড়ায় শীতল কিছু বয়ে গেল!
তিহিরা চোখের আড়াল হতে ইশাদও সিড়িতে পা ফেলে। উপরের ধাপে উঠার পূর্বেই শাহিনা শাইখা জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাচ্ছিস? খাবি না?”
ইশাদ চলতি পথেই ব্যস্তসুরে উত্তর দিল,
“আসছি আম্মু। তোমরা শুরু করো!”
______________________________
রেখা ভূঁইয়া শাড়ীর আঁচলটি ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে নেন। তিহির মুখটা ভালো করে মুছে দিলেন। তিহিকে খাটে বসিয়ে প্লেটে ভাত বারতে বারতে শাসনের সুর ছাড়লেন,
“কতবার নিষেধ করেছি,একা একা কোথাও যাবি না। তাও কেন যাস? আমার কথা শুনতে ভালো লাগে না? একটু আমার কথা শুনলে কী হয় বল তো মা?”
শেষ কথাটি বড্ড করুণ শোনায়। তিহি ছলছল চোখে তাকায় রেখা ভূঁইয়ার দিকে। নিষ্পলকে চেয়ে থাকে অনেক্ষণ! রেখা ভূঁইয়া নিজ হাতে ভাত মাখলেন। তিহির মুখে তুলে দিয়ে বললেন,
“আম্মার কথা শুনবি না?”
তিহি মাথা নাড়ে। ভাত চিবুতে ব্যস্ত হয়ে যায়। মুখের খাবার শেষ করে আবার হা করে। রেখা ভূঁইয়া দ্বিতীয় বার ভাত মুখে দেন। তিহি দ্রুত গিলে নিয়ে অনুনয়ের সুর ছাড়ল,
“কাঁচকি বোনাটা অনেক মজা হয়েছে। কিভাবে রান্না করেছো? আমাকে একটা রান্নাও শেখাও না। শ্বশুড়বাড়ি গিয়ে আমায় অনেক কথা শুনতে হবে। তখন কান্নাগুলো কে করবে? তুমি না আমি?”
তিহির কথায় রেখা ভূঁইয়ার হাসি পেল। কিন্তু হাসিটি চাপা পড়ে যায় অন্যকিছুতে। বিষাদে ছেয়ে আসে মুখমন্ডল। নিঃশব্দে চেয়ে থাকে তিহির অনুরাগের মুখ পানে। তিহি রেখা ভূঁইয়ার হাত থেকে প্লেট ছিনিয়ে নিল। দৃঢ় গলায় বলল,
“আগে বলো কাল থেকে আমায় রান্না শেখাবে। তারপর আমি খাব। নিজ হাতে। তুমি রোজ রোজ কেন খায়িয়ে দেও,আম্মা? আমি খেতে পারি না? আমি কি মিহির মতো ছোট? মিহিও তো নিজ হাতে খায়। ওর তো কয়দিন পর বিয়েও হয়ে যাবে!”
কথা শেষ করেই গালে হাত দিল তিহি। আফসোসের শিষ বের হয়ে আসে কন্ঠ থেকে। শুকনো গলায় বলল,
“আমার কবে বিয়ে হবে,আম্মু?”
রেখা ভূঁইয়া জবাব দেন না। মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকেন মেয়ের দিকে। তার মধ্যেই কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ আসে কানে। তিনি চেঁচিয়ে উঠেন,
“কে?”
বাইরে থেকে কোনো শব্দ আসে না। রেখা ভূঁইয়া আর অপেক্ষা করেন না৷ ঘন পা ফেলে দুয়ার মেলেন। বাইরে দৃষ্টি রাখতে কিছু দেখতে পেলেন না। তবে মনের সন্দেহ দরজায় ছোট্ট বাড়ি পড়ল। মনে হল,কেউ যেন দৌড়ে পালিয়ে গেলো। কিন্তু কে?
_____________________________
রাত বারোটা। এই সময় ইশাদের ঘুমিয়ে পড়ার কথা। কিন্তু সে ঘুমাচ্ছে না৷ পদচারণা চলছে পুরো রুমময়। টনু ঘুমিয়ে পড়েছে অনেক্ষণ। নাক থেকে বের হচ্ছে ভারী নিশ্বাস! সে গভীর ঘুমের দেশে। ইশাদ রুম ছেড়ে বাইরে এসে দাড়ায়। করিডরের এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ছুটে বেড়ায়। মাথার ভেতরটা ধপধপ করছে। কিছু ভালো লাগছে না। সন্দেহে পরিপূর্ণ মস্তিষ্ক! কেমন যেন দম আটকানো অনুভূতিতে ডুবে যাচ্ছে। চেখের পাতা দুটো এক হলেই তিহির চোখদুটো ভাসছে। এমন শীতল চাহনি তার ভেতরটা লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। এখন এই ভগ্নাংশ গুলো আগের ন্যায় সাজাবে কিভাবে? ঠিকঠাকভাবে সাজাতে পারবে তো?
ইশাদ বড় বড় নিশ্বাস ছাড়ে। টেনেও নেয়। চোখ জ্বলছে খুব। অনেক দিন ঠিক মতো ঘুম হয় না। মন ও শরীর স্বাভাবিক সুস্থতার জন্য একটি চমৎকার ঘুম প্রয়োজন। কিন্তু ঘুম কোথায় খুঁজবে সে? কোথায়!
ইশাদ মনে মনে ঠিক করে ঘুমের ট্যাবলেট খাবে। ঘুমটা এখন তার জন্য অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। ইশাদ সিদ্ধান্তমতো রুমে ঢুকতে গিয়েও থেমে গেল। মায়ের রুমের দিকে তাকায়। দরজা খোলা কি? বাইরে আলোর ছটা ছড়িয়ে পড়েছে। ইশাদের পা ঘুরে যায় মায়ের রুমের দিকে। দরজা ভেড়ানো। ইশাদ হালকা বাড়ি দিতেই ভেতর থেকে সাড়া এল,
“ভেতরে আয়।”
ইশাদ দরজা খোলে ভেতরে ঢুকে। সোবহান শাইখ চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। পান্জাবীর বোতাম দুটো খোলা। তার পাশেই একটি ছোট্ট বাটি পড়ে আছে। তাতে সরিষা তেল আর রসুন। শাহিনা শাইখা ছেলের কাছে এগিয়ে এসে বললেন,
“রাততো অনেক হয়েছে। ঘুমোসনি যে? মাথা ব্যথা?”
ইশাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তেলে ভেজা রসুনের দিকে। সেদিকে দৃষ্টি ফেলেই বলল,
“তোমার সাথে কথা আছে। জরুরী।”
“জরুরী? কী কথা?”
ইশাদ মায়ের দিকে তাকাল না। বাবার দিকে তাকাল। দৃঢ় গলায় বলল,
“ব্যক্তিগত কথা। তৃতীয় ব্যক্তি থাকলে বলা যাবে না।”
ছেলের কথায় খানিকটা বিচলিত হয়ে পড়েন শাহিনা শাইখা। দ্রুত স্বামীর দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন,
“তৃতীয় ব্যক্তি কোথায়? এখানে তো আমি,তুই আর তোর..”
“আর কেউ হলে হবে না। শুধু তুমি আর আমি।”
সোবহান শাইখ কড়া চোখে তাকালেন ইশাদের দিকে। নিজের স্ত্রীর দিকেও। শাহিনা শাইখা শুকনো ঢোক গিলে বলল,
“পরে বলিস। এখন ঘুমাব। তুই যা।”
ইশাদের গলার স্বর আরো দৃঢ় হয়ে আসে। অনড় গলায় বলল,
“না। এখনি বলব। আর এখানেই।”
সোবহান শাইখ চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। শোয়া থেকে উঠে বসলেন। বাইরে পা ফেলার পূর্বে কঠিন চোখে তাকালেন শাহিনা শাইখার দিকে। তিনি চলে যেতেই শাহিনা শাইখা কপট রাগ নিয়ে বললেন,
“এটা কেমন ব্যবহার,ইশাদ? বাবাকে কেও তৃতীয় ব্যক্তি বলে? উনি কতটা কষ্ট পেয়েছেন ভাব তো।”
ইশাদ বিছানায় বসল। ঠোঁট বাকিয়ে বলল,
“তার প্রতি তোমার ভক্তিটা আমার একদম সহ্য হয় না। জেগে জেগে স্বামীর রোগ সাড়া হচ্ছে? কী প্রয়োজন? দরকার হলে তার জন্য আমি নার্স ঠিক করে দেব। দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা তার বুক ডলে দিবে।”
শাহিনা শাইখা নাক সিটকিয়ে বলল,
“ছি! কী সব অসভ্য কথাবার্তা। তুই যেমন আমার ছেলে। তিনিও তো আমার স্বামী।”
ইশাদ সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। ক্ষণকাল কিছু ভেবে বলল,
“তোমার সামনে একটা কঠিন মূহূর্ত আসতে চলেছে। আগে থেকেই নিজেকে প্রস্তুত করো। আমি কিন্তু তখন তোমার কথা শুনব না।”
“মানে?”
ইশাদ মায়ের কথা এড়িয়ে গিয়ে বলল,
“সেদিন তিহি যখন সেন্সলেস হয়ে পড়ে তখন তুমি কোথায় ছিলে?”
“ওর সাথেই। কেন?”
“ও কি কোনো কারণে ভয় পেয়েছিল? বা এমন কিছু খেয়েছিল যাতে মাথা ঘুরে যেতে পারে?”
“ভয় পেয়েছিল নাকি তা বলতে পারব না। তবে কিছু খায়নি এটা নিশ্চিত। আমরা খাওয়ার জন্যইতো রেষ্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই..”
“ডক্টর কী বলেছে? কী সমস্যা ছিল?”
“তেমন কিছু বলে নি।”
ইশাদ অবাক হয়ে বলল,
“কিছুই বলেনি?”
“না।”
“আশ্চর্য!”
ইশাদ বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়ালে,শাহিনা শাইখা বললেন,
“তোর জরুরী কথা কি এটাই ছিল?”
“হুম।”
____________________________
“তুমি সত্যি ভাজতে পারবে তো?”
শাহিনা শাইখার প্রশ্নে মিহি মাথা নাড়ল। উচ্ছল গলায় বলল,
“পারব তো। আমি মায়ের সাথে অনেকবার তেলের পিঠা ভেজেছি।”
শাহিনা শাইখা মিহির কাছে পিঠা ভাজার দায়িত্ব দিয়ে রান্নাঘর ছাড়লেন। সোবহান শাইখ এখনি উঠে পড়বেন। ঘুম থেকে উঠেই তিনি কড়া লাল চা খান৷ সে চা নিয়েই শাহিনা শাইখা ব্যস্ত পা ফেলছেন। সিড়ির মাঝামাঝিতে আসতেই ছেলের সাথে দেখা। গলা ছেড়ে বললেন,
“ইমদাদকে আজ আসতে বলিস তো। অনেকদিন হল ছেলেটাকে দেখিনা।”
ইশাদ হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে বলল,
“ওর এ বাড়ি আসা বন্ধ। তোমার প্রয়োজন থাকলে আমায় বলো। আমি ওকে বলে দেব।”
শাহিনা শাইখা রুমের সামনে দাড়িয়ে পড়লেন। ছেলের দিকে সন্দেহ দৃষ্টি ছুড়ছেন। ছেলেটার চালচলন কেমন জানি সন্দেহজনক ঠেকছে!
ইশাদ মায়ের কাছে এসে বলল,
“কোনো দরকার?”
“তেমন কিছু না৷ আজ পিঠে বানিয়েছিলাম তো তাই। ও তো পিঠা খেতে খুব পছন্দ করে।”
“এখন পিঠা বাইরে কিনতে পাওয়া যায়। আমি কিনে খায়িয়ে দেব।”
শাহিনা শাইখা শক্ত গলায় বললেন,
“তুই তো দিনে দিনে কাঠ হয়ে যাচ্ছিস। অনুভূতিহীন! বাসায় পিঠা আর দোকানের পিঠা এক হল? ও আমার হাতের রান্না কত পছন্দ করে জানিস না?”
ইশাদ আপত্তি জানিয়ে কিছু বলবে তার আগেই মা বললেন,
“চুপচাপ নিচে গিয়ে বস। আমি টিফিন ক্যারিয়ারে দিয়ে দেব। অর্ধেক তোর অর্ধেক ইমদাদের। এখন খেতে বললে তো খাবি না। নানা অযুহাত ধরবি।”
“নানা নয় আম্মু,একটা। আর সেটা অযুহাত নয়,সত্যি কথা। আমার মিষ্টি পিঠা পছন্দ না।”
শাহিনা শাইখা আর কিছু বললেন না। কাঠিন্য চাহনি ফেলে ভেতরে ঢুকে গেলেন। যার মানে এই-নিচে গিয়ে বস,আমি আসছি।
মিহি পরপর দুটো পিঠা ভেজে হতাশ! সে কি ভাজতে পারছে না? এমন সাদা সাদা হচ্ছে কেন? বেশি ভাজলে পুড়ে যাচ্ছে। তাহলে কি সে পিঠা ভাজা ভুলে গেল? কিন্তু মায়ের সাথে যখন ভাজতো তখন তো লাল লাল কী সুন্দর রঙ হতো! মায়ের মুখে কত প্রশংসা পেয়েছে। মিহি হতাশ মনে আরেকটি পিঠা ভাজার জন্য উদ্যত হল। তার হঠাৎই চোখ পড়ল,চালের মিশ্রণটির উপর। তার কপাল কুঁচকে আসে। এগুলো এত সাদা কেন? আম্মুরটা তো সাদা হত না। লাল লাল হত! তাহলে কি আন্টি লাল কিছু দিতে ভুলে গিয়েছে? মিহি মহাভাবনায় পড়ে গেল। সে শুধু ভাজতে পারে আর কিছু পারে না৷ তাহলে বুঝবে কিভাবে? কোন জিনিসটা বাদ পড়েছে? মিহি বাইরে তাকায়। না আন্টি আসছেন না। এদিকে পিঠাও হচ্ছে না। কী করবে? সহসা তার চোখ পড়ে সামনের একটি কৌটোতে। তাতে লাল মিহিজাতীয় কিছু আছে। মিহি চটপট ওটা হাতে নেয়। চালের মিশ্রণে ঢেলে দেয়। একটু,তারপর আরেকটু। সবশেষে পুরোটা। এবার খুশি মনে আরেকটি পিঠা বানায়। চোখ চকচক করে উঠে। অজান্তেই উচ্চারণ করে, বাহ! কী সুন্দর রঙ হয়েছে। আন্টি খুব খুশি হবেন। সে ফুরফুরে মেজাজে একে একে সব পিঠা বানিয়ে ফেলল। তখনি শাহিনা শাইখা ভেতরে ঢুকেন। চুলায় পুনরায় চা বসিয়ে বলল,
“আগের চা’টা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে বুঝলে? তোমার আংকেল তো আবার ঠান্ডা চা একদম খেতে পারেন না।”
মিহি আগ্রহ নিয়ে সবটা শুনল। কৌতুহলী হয়ে বলল,
“আংকেলের জন্য আমি চা নিয়ে যাব? দৌড়ে যাব। একটুও ঠান্ডা হবে না।”
শাহিনা শাইখা মিষ্টি হাসলেন। ওর সামনে হটপট রেখে বলল,
“তোমার চা নিয়ে যেতে হবে না। এই বাটিভরে পিঠা সাজিয়ে দেও। ইশাদ বসে আছে। ওর দেরি হয়ে যাচ্ছে।”
“আচ্ছা।”
শাহিনা শাইখা আবারও চা নিয়ে ব্যস্ত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। মিহি সময় নিয়ে সুন্দর সুন্দর পিঠাগুলো ভালো করে সাজিয়ে নিল। ঢাকনা লাগিয়ে ইশাদের কাছে পৌছে দেয়। ইশাদ কোমলসুরে বলল,
“এগুলো তুমি বানিয়েছো?”
মিহি হাসি মুখে উত্তর দিল,
“হুম।”
চলবে