#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (১৭)
#রোকসানা_রাহমান
হারিয়ে যাওয়া শীতের ঠান্ডা অনুভূতিটা হঠাৎ করেই যেন ফিরে এল। দূর থেকে ভেসে আসা ঝিরিঝিরি হাওয়ায় কাঁপছে পুকুরের স্বচ্ছ জলগুলো। হয়তো এটাকেই বলে ঢেউ! জলের উচুনিচু আন্দোলনে বেগতিকে পড়ে গিয়েছে স্নানরত কালো পাখিটি। মিহির কৌতুহল বাড়ে। একপা একপা করে আরো খানিকটা এগোয় পুকুরটির দিকে। যেন এই মুহূর্তে স্রোতের সাথে লড়াই করে পাখির টুপ করে মাথাটা ডুবিয়ে ভিজিয়ে আনাটাই সবচেয়ে আকর্ষণীয় দৃশ্য! মিহি বেখেয়ালে আরেক পা এগোতেই ওর হাত ধরে ফেলে ইশাদ। সতর্কবাণী ছুড়ে দেয়,
“সাবধানে,মিহি। পুকুরে পড়ে যাবে।”
মিহি ক্ষণকাল নীরবে চেয়ে থাকে ইশাদের দিকে। হঠাৎ উৎসাহিত গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ইশাদ ভাইয়া,ওটা কী পাখি?”
“কোনটা?”
মিহি ঘাড় ঘুরিয়ে পুকুরে আঙুল তুলে বলে,
“ঐ যে,ওটা।”
“ওখানে তো কোনো পাখি নেই,মিহি।”
ইশাদের কথায় মিহি ভালো করে দৃষ্টি রাখে পানিতে। সত্যিই পাখিটি নেই। কোথায় গেল? এখনি তো ছিল। এত জলদি গোসল শেষ? নাকি লজ্জা পেয়েছে? নিশ্চয় পাখিটি মেয়ে পাখি ছিল। নাহলে ইশাদ ভাইয়া দেখতে চাওয়ায় লজ্জায় পালাবে কেন?
বাড়ি থেকে বের হয়েই মিহিকে নাস্তা করিয়েছিল ইশাদ৷ ভেবেছিল,নাস্তা করে বাড়ি ফিরবে। এতে মাও খুশি,মিহির খাওয়াটাও হবে। কিন্তু ভাবনামতো বাড়ি ফিরেনি। মায়ের কথাই ঠিক। দুজনের একটু আলাদা সময় কাটানো উচিত। জানাশোনার আছে অনেক কিছু। অতি জরুরী কিছু কি? মিহি স্বাভাবিকভাবে নিবে তো? ইশাদ কিছুটা সংকোচে ভোগে। আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। রোদ নেই,মেঘও নেই। সম্পূর্ণ নীল রঙে ছেয়ে আছে বিস্তার আকাশ। একেই হয়তো বলে নীল আকাশ!
ইশাদ আকাশ থেকে দৃষ্টি ছড়ায়। মিহির দিকে তাকায়। সে এখনো পুকুরের দিকেই চেয়ে আছে। জলের মধ্যে কিছু খুঁজছে কি? মিহির মনোযোগ ভঙ্গ করল ইশাদ৷ ধীর গলায় ডাকল,
“মিহি?”
মিহি জলের দিকে চেয়েই উত্তর দিল,
“হুম।”
“তোমরা আগে কোথায় থাকতে?”
“সিরাজগঞ্জ শহরে।”
ইশাদ পরের প্রশ্নটা করতে গিয়ে থেমে গেল। মেয়েটার দিক থেকে কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না। কী খুঁজছে জলে? তাহলে কি কথপোকথন এখানেই শেষ করে দিবে?
ইশাদের ভাবনার মাঝেই বা’হাতে নরম ছোঁয়া পেল। ইশাদ চকিত চোখে তাকায় মিহির দিকে। সে দু’হাতে ইশাদের হাতটা জড়িয়ে ধরেছে। বাহুতে মাথা ঠেকিয়ে বলল,
“আপনার কি আমাকে বেশি ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে?”
মিহির আকস্মিক ভিন্নধারার প্রশ্নে বিব্রতবোধ করে ইশাদ। বেশ কিছুক্ষণ ইতস্ততা কাটিয়ে বলল,
“কেন বলো তো?”
মিহি মাথা সোজা করে। ইশাদের দিকে সরল দৃষ্টি রেখে বলল,
“মা বলেছে,এভাবে জড়িয়ে ধরলে আপনি আমাকে বেশি বেশি ভালোবাসবেন।”
ইশাদ মৃদু হাসে। মিহির ওড়নাটা ভালো করে শরীরে জড়িয়ে দিয়ে বলল,
“এদিকটায় বাতাস বেশি। চলো সামনে যাই।”
মিহি ইশাদের হাতটা গাঢ় করে জড়িয়ে নেই। আহ্লাদী সুর ছেড়ে বলল,
“না। আমি এখানেই থাকব। আমার অনেক ভাল লাগছে।”
ইশাদ না চাইতেও চোখটা বার বার মিহির মুখটাতেই আটকাচ্ছে৷ কী নিষ্পাপ চোখজোড়া! ঠোঁটের কোণে সবসময় ছেলেমানুষি লেগে থাকে। তুলতুলে গালদুটো দেখলেই দুষ্টুমী করতে ইচ্ছে করে। নাকের আগায় রাগটা কখন আসবে? চুল টেনে দিলে? ইশাদের ইচ্ছে হলো মিহির গুছিয়ে বাধা চুলটা টেনে দিয়ে পালাতে৷ মিহিও কি ছুটবে তার পিছুপিছু? খুব কি ভুল হতো দুজনের মধ্যে খামখেয়ালিপনার সম্পর্ক থাকলে? যাকে পরিষ্কার ভাষায় বলে ভাই-বোনের খুনসুটি!
“আমাদের স্কুলের পেছনেও এমন একটা পুকুর ছিল। দুইধারেই ছিল কাশবনের ঝোপ। কাশফুল আমার খুব পছন্দ। ইশাদ ভাইয়া,কাশফুল সবসময় কেন ফুটে না? আমার অনেক মন খারাপ হয়!”
মিহির প্রশ্নের উত্তরে কী বলবে খুঁজে পাচ্ছে না ইশাদ। তাই চুপ করেই রইল। মিহিও আর উত্তরের অপেক্ষা করে না। আগ বাড়িয়ে বলল,
“একদিন কী হয়েছিল জানেন?”
ইশাদ মিহির দিকে ঘুরে দাড়ায়। আগ্রহ পোষণ করে বলল,
“কী?”
“কাশফুল ছিড়তে গিয়ে আমি পুকুরে পড়ে গেছিলাম।”
“তারপর?”
“তখন তো টিফিন পিরিয়ড ছিল। ভেজা কাপড় নিয়ে আমার মরি মরি অবস্থা! ক্লাস করব কিভাবে? স্যার যদি কান ধরে দাড় করিয়ে রাখে? সেই ভয়ে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় গিয়েও তো রেহাই নেই। স্কুল ফাঁকি দিয়েছি শুনলে আম্মু খুব বকবে। মারবেও। আমার মা খুব রাগি। একটু কিছু হলেই ঝাড়ু নিয়ে চলে আসে। এদিকে ভেজা কাপড় নিয়ে রাস্তায় ঘুরতে পারছি না৷ শেষে ভয়ে ভয়ে বাসার ভেতরে ঢুকলাম। ভেবেছিলাম,লুকিয়ে জামা পাল্টিয়ে নেব। কিন্তু উঠোনে ঢুকতেই মায়ের চোখে পড়ে গেলাম। তবে মা বকলো না। বলেন তো কেন?”
মিহির উৎসাহ ধরে রাখতে ইশাদ বলল,
“কেন?”
“কারণ ঐদিন মা সামনে আংকেল ছিল। সেজন্যই তো বেঁচে গেলাম।”
মিহির মুখ থেকে আংকেল সম্বোধনটি শুনতেই ইশাদের ভেতরের উত্তেজনা সজাগ হয়ে গেল। কান দুটো গভীর উৎকর্ণের রূপ ন্যায়। তার অবচেতন মন বলছে,এই আংকেল আর কেউ নয় তার বাবা সোবহান শাইখ! ইশাদ সংশয় দূরীভূত করতে জিজ্ঞেস করে বসল,
“উনি কি আমার বাবা?”
মিহি কোনো ভণিতা ছাড়াই বলল,
“হুম। ভাগ্যিস উনি ঐদিন ছিল নাহলে কপালে কী ছিল আল্লাহই জানতেন।”
পূর্বে স্থগিত করা কথপোকথন টি পুনরায় আরম্ভ করল ইশাদ,
“তুমি আমার বাবাকে কতদিন ধরে চেনো?”
মিহি সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। বোধহয় খানিকটা ভেবে নিচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড বাধে ভাবুক কন্ঠেই বলল,
“কেমন চেনা? দেখা চেনা নাকি কথা চেনা?”
মিহির কথার মানেটা শুরুতেই বোধগম্য হয়নি ইশাদের। তাই বলল,
“দুটোই।”
মিহি ইশাদের হাত ছেড়ে দেয়। ঘাসের উপর বসে পড়ে। ইশাদকে ইশারায় বসতে বলে। সে হাত দিয়ে ঘাস কুড়িয়ে নিতে নিতে বলল,
“দেখা চেনা অনেক বছর। আমি যখন সিক্সে ভর্তি হয় তখন থেকে। আমি প্রায়ই উনাকে স্কুলের সামনে দেখতাম। কখনো কথা হত না। উনিও বলতো না। আমিও বলতাম না। তবে আমি বুঝতে পারতাম উনি আমার দিকেই তাকিয়ে থাকতেন। মাঝে মাঝে আমার আশেপাশে ঘুরতেন।”
“এ ব্যাপারটা তোমার মা জানতো?”
“জানিনা।”
“কেন? তুমি তোমার মা,বাবাকে বলোনি? তোমার ভয় করত না? একটা অপরিচিত লোক তোমার দিকে তাকিয়ে থাকতো?”
মিহি দুই হাতে ঘাস জড়ো করেছে। কুটি কুটি করে দূর থেকেই পুকুরে ছিটিয়ে দিয়ে বলল,
“না। বাসায় গেলে আমার উনার কথা মনেই থাকতো না।”
“কেন?”
মিহি দ্বিতীয় বারের মতে ঘাস কুড়িয়ে নেওয়ায় মনোনিবেশ করেছিল। ইশাদের প্রশ্ন শুনে সোজা হয়ে বসে। পুকুরে ভেসে থাকা ঘাসগুলের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছু্ক্ষণ। তারপর উদাস গলায় বলল,
“স্কুল,প্রাইভেট শেষ করে বাসায় ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। আমি বাসায় পৌঁছানোর আগেই বাবা চলে আসতো। ব্যস! আমাকে আর পায় কে? আমি তো বাবার কোলে চড়ে ভালোবাসা নিতে ব্যস্ত হয়ে যেতাম। মা ডেকেও আমাকে সরাতে পারত না। বাবার সামনে মা আমায় কড়া গলায় ধমকও দিতে পারতো না। সেই সুযোগে আমি মাকে শুধু বিরক্ত করতাম! এত কিছুর মধ্যে আংকেলের কথা মাথায় আসতো না।”
ইশাদ মিহির কাঁধে আলতো করে হাত রাখে। ধীর গলায় বলল,
“তোমার বাবা?”
মিহির চোখ টলমল। যেন সামনের পুকুরের সবটা পানি তার চোখে এসে জমেছে। যেকোনো সময় বাঁধ ভেঙে যেতে পারে। মিহির না বলা কথাটা ইশাদ বুঝে গেল। প্রশ্নটা ঢেকে ফেলার উপায় খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তার আগেই মিহির চোখ গলে ঝরে পড়ে নোনা পানি। ভেজা গলায় বলল,
“নেই। দুই বছর হলো মারা গিয়েছে।”
ইশাদ নির্বাক,নিঃশব্দ। বিষন্নতা হানা দেয় বুকের মাঝে। সুক্ষ্ম ব্যথাটা তীব্র হয়ে খোঁচাচ্ছে! বাবার অভাববোধটা কি সেও অনুভব করে না? মিহির চোখ মুছে দেয় বৃদ্ধাঙুলের সহায়তায়। অনুতপ্ততায় ভোগে। দুর্বল স্বরে বলল,
“সরি। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”
মুহূর্তেই মিহির চোখ শুকিয়ে গেল। নাক টেনে বলল,
“বাবা মারা যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন আংকেল আমার সামনে এসে দাড়ালেন। প্রথম কথা বললেন। সেদিন আমি খুব ভয় পেয়ে যাই। আমি বাসায় গিয়ে মাকে সব বলি। মা একটুও চিন্তিত হয়নি। বলেছিল,উনি আমার কোনো ক্ষতি করবেন না। তারপর থেকে আমার ভয়ও কেটে যায়। উনি প্রায় আসতেন৷ আমরা অনেক গল্প করতাম। উনি তো আমাকে অনেক কিছু কিনে দিতেন। কিন্তু মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করতেন,’খুকি আমার সাথে যাবি?”
মিহির কথার মাঝেই ইশাদ প্রশ্ন করল,
“বাবা,তোমাকে খুকি বলে ডাকতো?”
“হুম। সবসময় না। শুধু যখন উনার সাথে যাওয়ার কথা উঠতো তখন বলতেন। আমি সবসময় না বলতাম। কিন্তু একদিন কি যে হলো আমি বলে ফেললাম,মা গেলে যাব।”
ইশাদ সন্দেহী গলায় বলল,
“তার মানে তোমরা আব্বুর সাথে এসেছো?”
মিহি মাথা দুদিকে নেড়ে বলল,
“না৷ আন্টির সাথে।”
ইশাদ বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আম্মু?”
মিহির নাক টানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মুখে আগের উজ্জ্বল,পবিত্র জ্যোতি ফুটে উঠেছে। কেউ দেখলে বলতেই পারবে না একটু আগে এই মেয়েটিই বাবার জন্য কেঁদেছে। সে ঘাস থেকে ক্ষুদ্র নীল রঙের ফুল ছিড়ে নিল। কানে গুঁজতে গুঁজতে বলল,
“হুম। তারপর দিন স্কুলে আংকেলকে দেখতে পায়নি। আমি অনেক্ষণ উনার জন্য অপেক্ষা করেছিলাম। হতাশ মনে বাসায় ফিরতে দেখি মায়ের সাথে একজন অপরিচিত আন্টি কথা বলছেন। আমাকে দেখে আমার কাছে আসলেন। কপালে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ছলছল নয়নে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললেন,মিষ্টি মেয়ে! আমরা কালই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হব। আজ রাতটা তোমাদের এখানে থাকতে দেবে?”
ইশাদের মস্তিষ্ক দ্রুত কাজ করতে শুরু করে। একে একে অনেক অগোছালো প্রশ্নগুলোর গোছালো উত্তর সাজিয়ে ফেলে। তার মনে পড়ে,মিহিরা যেদিন তাদের বাড়িতে আসে তার আগেরদিন মা বাসা থেকে বের হয়ে যান। তাকে শুধু একটি মেসেজ লিখেছিল। অনেকটা এ রকম, ‘ এক বিশেষ প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে যাচ্ছি। তুই চিন্তা করিস না। রাতে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িস। সকালে ঘুম থেকে উঠার পূর্বেই তোর জন্য সারপ্রাইজ নিয়ে হাজির হব। ইনশাআল্লাহ!’
___________________________________
“এখনি,এখনি,এখনি আসবে,আম্মা। আমার কষ্ট হচ্ছে,আমি ঘুরতে যাব৷ আমাকে রেখে তুমি একা একা ঘুরতে গেলে কেন? আমি খুব রাগ করেছি। আমি ঠিক করেছি তেমার সাথে আর কথা বলব না৷ দুই মিনিটের মধ্যে আমার সামনে না আসলে,আমি ছাদ থেকে ঝাপ…”
কথাটা শেষ করতে পারে না তিহি। কোনো বলিষ্ঠ হাতের চাপে ঠোঁটজোড়া ঢাকা পড়েছে। তিহি ব্যাপারটা বোঝার আগেই কান থেকে ফোনটা কেড়ে নিল ইশাদ। তিহির কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
“আপনি জানেন,মা জাতির অসুস্থতার পেছনে বিশাল কারণ বহন করে সন্তানরা?”
তিহি বাকা চোখে তাকায়। বন্ধ মুখ ছাড়ানোর চেষ্টা করছে। পারছে না। ইশাদ ফোনটা নিজের কানে নিল। অন্যদিকে ঘুরে কিছু বলেই লাইন কেটে দিল। তিহির হাতে ফোন ধরিয়ে বলল,
“একজনের রাগ আরেকজনের উপর ঝারছেন কেন?”
তিহি কড়া চোখে তাকায়। নাক ফুলায়,গাল ফুলায়,অভিমানে ঠোঁট ভারী করে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ইশাদ তিহির পাশে এসে দাড়াল। ছাদের রেলিংয়ে কনুই ঠেকায়। সামনে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে তিহির দিকে তাকায়। মেয়েটা এখনো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে আছে। ইশাদ সামান্য হাসল। বলল,
“আকাশ এতটা থমথমে কেন? কার দুঃখে সে কালো মেঘ জমাচ্ছে?”
তিহির দিক থেকে কোনো সাড়া এল না। ইশাদ আগের উপমার সাথে যোগ দিয়ে বলল,
“আকাশ কি জানে না? তার মন খারাপের ঝরণায় শুধু সে নয়,সকলকেই ভিজতে হয়?”
তিহি এবারও কিছু বলল না৷ একটি বারের জন্য ঘাড় বাকিয়ে তাকাল না পর্যন্ত। সেভাবেই জায়গা ত্যাগ করলে ইশাদ দ্রুত বলল,
“হাঁটতে যাবেন?”
তিহি থেমে যায়। ফিরে তাকায় ইশাদের দিকে। দূরের ল্যাম্পোস্টের আলো এসে ভর করে তিহির মুখে। চিকচিক করছে চোখভর্তি অভিমান। কিন্তু এই অভিমানের আদৌ কি কোনো যুক্তি আছে? ইশাদ কারণ খুঁজতে চায় না। মানে খুঁজতে চায় না। হোক না কিছু অভিমান সম্পর্কহীন! সব অনুভূতির অর্থ খুঁজতে নেই। তাহলে অর্থের দায়ভারে অনুভূতিগুলো হারিয়ে যায়৷ সে রেলিং ছেড়ে তিহির সমুখে আসে। গাঢ় কন্ঠে বলে,
“রাতের আঁধারে মন হারিয়েছেন কখনো? নিদ্রিত রাস্তায় কদম ফেলেছেন? কোলাহূলহীন রজনীতে নিশ্বাস ছেড়েছেন? বিশ্রামরত পাখিদের বিরক্ত করেছেন? ল্যাম্পোস্টের হলুদ আলোতে ফিসফিসিয়ে গল্প করেছেন? চুপিচুপি,কানাকানি?”
তিহি মুগ্ধনয়নে চেয়ে আছে ইশাদের দিকে। বুঝতে চাচ্ছে ইশাদের শব্দ চয়ন৷ এত কঠিন লাগছে কেন? কঠিনের মাঝেও এক অদ্ভুত মুগ্ধতা ভর করে আছে। মিশিয়ে নিবে কি সর্বাঙ্গে?
ইশাদ তিহির পাশে এসে দাড়ায়। চোখে চোখ রেখে ভ্রূ নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“যাবেন? শুধু হ্যাঁ অথবা না তে জবাব দিবেন।”
তিহি চোখ সরিয়ে নিল। হ্যাঁ/না কিছুই বলল না। নীরবে পা বাড়ায় সিঁড়ির দিকে। ইশাদ মৃদু হেসে তিহির পায়ের চলনকে অনুসরণ করে।
তিহির মুখের অভিমান মিলিয়ে গেলেও,আকাশ এখনো মন খারাপ করে আছে। যেন ইশাদকে সতর্ক করে রাখছে, ভুলেও তিহিকে কষ্টের আঁধারে ঠেলে দিলে সে তীব্র প্রতিবাদ করবে। ভিজিয়ে দিবে বিদ্যুৎ ঝরণায়!
তিহি আর ইশাদ পাশাপাশি হাঁটছে। সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে। দুজনের মধ্যেই অদ্ভুত জড়তা কাজ করছে। যা কাটিয়ে উঠা দুর্লভ বলে ঠেকছে। প্রায় আধ ঘন্টা হতে চলল,অথচ কারো কন্ঠই কেঁপে উঠল না! তিহি আনমনে পথপ্রান্তে তরুতলের নিচে দাড়ায়। ইশাদও দাড়ায়। এভাবে আর কত? নীরবতা ভেঙে সেই প্রথমে বলল,
“Acceptable.”
তিহি মৃদু কম্পনে চমকে উঠে। নিরবতাতে সে গভীরভাবে হারিয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ ইশাদের কন্ঠে সরাসরি চোখ পড়ে তার মুখে। সেকেন্ড কয়েক পর বলল,
“মানে?”
ইশাদ জায়গায় দাড়িয়েই তিহির দিকে সামান্য ঝুঁকে এসে বলল,
“আপনার সরি এক্সেপ্টেবল।”
তিহি লজ্জা পেল। দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলে। গালে পড়ে থাকা একগাছা চুল কানে ঢুকিয়ে নেয়। অন্যদিকে চোখ রাখলেও আড়দৃষ্টিটা ইশাদেই আটকে আছে। ইশাদের মুখটিও কি লাজুকতায় ছেয়ে আছে?
“আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি? ব্যক্তিগত প্রশ্ন। যদি অনুমতি দেন তবেই করব।”
মুহূর্তেই তিহির মুখের লজ্জা আভা হারিয়ে গেল। ইশাদের সামনাসামনি এসে কপাল দলিয়ে বলল,
“একটু সরি বলেছি দেখেই সুযোগ নেওয়া শুরু করে দিয়েছেন? কৌশলে নিরালায় টেনে এনে নষ্টামি শুরু করে দিয়েছেন? ছি! এই জন্যই খারাপদের সামনে কখনো ভালো হতে নেই। আমি ভাবলাম কাল রাতে আমার জন্য এত কিছু করলেন। একটু সরি..”
“আপনার সব মনে আছে?”
ইশাদের প্রশ্নে থতমত খেল তিহি। ফ্যালফ্যাল নয়নে তাকালে,ইশাদ অতিশয় আগ্রহ নিয়ে বলল,
“বলুন না। আপনার সব মনে আছে?”
“কী মনে থাকার কথা বলছেন? আর মনে না থাকারই কী আছে? আমার মাথায় কি গোবরে ঠাসা? কাল রাতে আপনি আমাকে কী কী বলেছেন সব মনে আছে। শুধু আমাকে না,আমার আম্মুকেও অপমান করেছেন। কোথায় আপনি সরি বলবেন তা না আমি সরি বলায় উল্টো অসভ্যতামি শুরু করেছেন।”
ইশাদের হঠাৎ উদিত হওয়া আশার আলো ধপ করে নিভে গেল। বুকের গভীর থেকে বেরিয়ে আসল দীর্ঘশ্বাস। ফিরতি পথে পা ঘুরিয়ে বলল,
“আমার আগ বাড়িয়ে কথা বলা ভুল হয়েছে। খারাপ ছেলে চলে যাচ্ছে। ভালো মেয়ের যা ইচ্ছে হয়,তাই করুক।”
ইশাদ দ্রুত কদম ফেলে দূরত্ব বাড়াতে তিহির বুক ধক করে উঠে। চারপাশে চোখ বুলালে শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠল। দৌড়ে ইশাদের সামনে এসে পথরোধ করে দাড়ায়। করুণস্বরে বলল,
“অনুমতি দিলাম।”
“দরকার নেই। আমি এমনিই অনেক ক্লান্ত। ঘুমাব। পথ ছাড়ুন।”
তিহি দুঃখী মুখ করে মাথা নামিয়ে বলল,
“আর খারাপ বলব না।”
“কেন বলবেন না?”
“এমনি।”
ইশাদ তিহিকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে তিহি ওর শার্টের সাইড অংশ টেনে ধরে। টান খেয়ে বুকের কাছ থেকে একটা বোতাম খুলে পড়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় দুজনেই বিস্মিত। দুজনেই চোখ দু’দিকে ফেলে। ইশাদ ব্যাপারটাকে এখানেই শেষ করতে বলল,
“আপনার আম্মুর সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?”
তিহি দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে। চট করে মেজাজ উর্ধ্বে তুলে বলল,
“আপনার মাথার মতো।”
ইশাদ কপট রাগ নিয়ে বলল,
“ধুর!”
তিহি বুঝতে পারে ইশাদ আবার রেগে যাচ্ছে। সে পানি ঢালতে বলল,
“নিজে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করবে আর আমি উল্টাপাল্টা উত্তর দিলেই দোষ।”
“এটা উল্টাপাল্টা প্রশ্ন?”
“তা নয় তো কী? মেয়ের,মায়ের সাথে সম্পর্ক কেমন হবে? ভালো হবে। যেমনটা আপনার আর আন্টির।”
ইশাদ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমি অন্য রকম বুঝাতে চেয়েছি। এই যেমন ধরেন,উনি কি আপনার উপর কোনো কারণে রাগ? আপনার গায়ে হাত তুলেন। তার থেকেও বেশি কিছু?”
ইশাদের প্রশ্নে তিহির চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল। চোয়াল ঝুলে পড়তে,ইশাদ বলল,
“এভাবে হা’করে আছেন কেন?”
“আপনার মাথায় কি ভালো কিছু থাকতে নেই? বিধিনিষেধ আছে?”
“মানে?”
“আম্মা আমাকে মারতে যাবে কেন? রাগ করলে ধমক দিবে। মারবে কেন? আবার বলছেন তার থেকেও অন্যকিছু। সেটা আবার কী?”
ইশাদ তিহির প্রশ্নের উত্তর দিতে চেয়েও থেমে গেল। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে বলল,
“আপনার বাবা?”
“আছে।”
“কোথায়?”
“আপনাকে বলব না।”
“কেন?”
“আপনাকে সন্দেহজনক ঠেকছে তাই। কী পরিকল্পনা করছেন বলুন তো। আমাকে দিয়ে কী করবেন?”
তিহির কথার বিপরীতে আর কথা রাখল না ইশাদ। সে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা শুরু করল। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,’যার জন্য করি চুরি, সেই বলে চোর!’
_________________________________
ফাল্গুন মাসের আজ একুশ তম দিন। প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে বিকেলের শুরুতেই বাসায় ফেরত এসেছে ইশাদ। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। একটা কড়া ঘুমের প্রয়োজন তার। সেই সিদ্ধান্তেই আয়েশে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করতেই রাজ্যের ঘুম জড়ো হয় পাতাদুটোতে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হতে বুকের মধ্যে ভারি কিছুর উপস্থিতি অনুভব করে। কঠিন কিছু নয়। নরম,তুলতুলে। সম্ভবত প্রাণশক্তিও বিদ্যমান। উষ্ণ নিশ্বাস তার বুকে পড়ছে। ইশাদের ঘুম হালকা হয়ে আসে। গাঢ় ঘুম ভেদ করে চোখ মেলতেই ছোট্ট প্রাণোচ্ছল মুখ ভেসে উঠে। দাঁত বের করে খুশির ঝিলিক উপহার দেয় ইশাদকে। ইশাদের দুই গাল টেনে ধরে দারুন মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করে,
“তুমি কি আমার বাবাই?”
চলবে