তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি,পর্ব (৪)

0
3930

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি,পর্ব (৪)
#রোকসানা_রাহমান

বেশ কয়েক সেকেন্ড পরেই ওপাশ থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠে ভেসে এলো,

” দুঃখিত, কাঙ্ক্ষিত নাম্বারটিতে এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। Sorry, the number you have dial is currently unreachable.”

এতো মধুর কণ্ঠের বাক্যটিকে তিহির কাছে সবচেয়ে বিষাদময় লাগছে। তিহি ফোনটি কানে ধরেই আবার ডুকরে কেঁদে উঠে,’কেন এমন করছো ইশাদ? এ কোন অন্যায়ের শাস্তি দিচ্ছো আমায়? কী করেছি আমি? নিজের জীবন থেকে আমাকে এভাবে ছুড়ে ফেলে দিয়েছো,তাও আমি চুপ করে মেনে নিয়েছি। তোমার কথা মতো অন্য কারও সংসারের সুতাতে নিজেকে প্যাঁচিয়েও ফেলেছি,তাও তোমার শাস্তি শেষ হয়নি? আমি যাতে তোমার সাথে কোনো কন্টাক্ট করতে না পারি সেটা নিয়েও উঠে-পড়ে লেগেছ? তুমি জানোনা, আমার সকাল বেলা তোমার কণ্ঠে ভালোবাসি না শুনলে আমার দিনটা বিষাদে ভরে যায়? ভালোবাসি নাই বা বললে,তোমার কণ্ঠটা তো শুনতে দিবে! তোমাকে ছাড়া তোমার তিহি পাখি যে আকাশে উড়তে পারবে না। তুমি তো আমার আকাশ ছোয়ার রঙিন ডানা ছিলে,সেই ডানা এভাবে হুট করে কেটে দিলে? এর থেকে কি ভালো হতো না? নিজের হাত দিয়ে গলা টিপে মেরে দিতে!’

তিহি ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিল। এই ফোনেই তো কত অসংখ্য ভালোবাসার বুলি আওড়েছিলো দুটো পাখি!

ইশাদের অমন সাংঘাতিক প্রস্তাবে তিহির অবস্থা কাহিল। মাথা তার নষ্ট হয়ে যাচ্ছে নানা চিন্তাতে। প্রথমত,সে এতো বড় লোক বাড়ির ছেলে হয়ে তাকে কেন প্রপোস করবে? দ্বিতীয়ত,সে বিবাহিত হয়ে কেন একটা অবিবাহিত মেয়েকে ভালেবাসতে চায়বে? দুটো প্রশ্নের উত্তর খোঁজায় সে সারা রাত তান্ডব ঘটিয়ে রাত কাটিয়েছে। ঘুম তো বাসার চালের ধারেও আসেনি,চোখে আসবে কিভাবে? সারারাত ছটফট করে কাটলেও সকালেই টুক করে উত্তর এসে ঘণ্টি বাজাল। দুটো প্রশ্নের উত্তর একটাই। ছোট,আলাভোলা, গরীব,অনাথ মেয়ে পেয়ে খারাপ কিছু করতে চাচ্ছে। এই একটা উত্তরই দুটো প্রশ্নের সাথে খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে।

এমন জঘন্য উত্তর পাবে তা তো তিহি জেগে, ঘুমিয়ে কোনোভাবেই আন্দাজ করতে পারেনি। তাই ঐ বাড়িতে যাওয়া মানে নিজের ইচ্ছেতে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া। গরীব হতে পারে,তাই বলে তো নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে সম্মসানহীনতাই সে ভুগতে পারে না। ইশাদের ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে দিয়ে ঠিক করলো আর ঐ বাসায় যাবে না তিহি। ইনার জন্য বেশ মন খারাপ হচ্ছে তিহির। ইশ! অমন লক্ষী মেয়েটার এমন নষ্ট বাপ হলো?

তিহি নানা ভাবনা আর মন খারাপ নিয়েই ভার্সিটিতে ক্লাস করতে গিয়েছিল। ক্লাস শেষে বের হতে চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম। মিঃ ইশ! থুক্কু,মিঃ নষ্ট বাপ এখানে কী করে?

ভার্সিটির গেইটের বাইরে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইশাদ।লাল টি-শাট আর জিন্স পড়ে আছে,সাথে চোখে সানগ্লাস! অনেকে অবাক নয়নে তার দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করতে বের হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ মুচকি হেসেও উঠছে!

এমন নষ্ট বাপের দিকে এভাবে তাকানোর কী আছে তিহি বুজতে পারছে না। তিহি, ইশাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে,’শাক দিয়ে মাছ ঢাকতে আসছে,আপনার কী মনে হয়,এমন নায়কদের মতো সেজে থাকলেই আপনার নষ্টামি ঢেকে যাবে? কখনোই না,আমার নাক অতি সুক্ষ জিনিসেরও গন্ধ নিতে পারে হুহ! তিহি বা হাত দিয়ে নাক ঢাকার চেষ্টা করতে পেছন থেকে ইশাদ বলে উঠল,
“গাড়িতে উঠে বস,তিহি!”

ইশাদের কথা যেন শুনতেই পায়নি এমন একটা ভাব করে আবার হাঁটা ধরলে ওর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে ইশাদ। আর সাথে সাথে তিহি চুপ করে দাঁড়িয়ে যায়। নিজের দমটা আটকে রেখেই বলল,
” হাত ছাড়ুন,মিঃ নষ্ট বাপ। নাহলে আমি চিৎকার করবো!”

ইশাদ পাশ থেকে তিহির মুখোমুখি হয়ে বলল,
” কী বললে তুমি?”
” আমার হাতে লাগছে!”

ইশাদ হাতটা আরো শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
” আগে বলো কী বলছো আমায়?”
” চিৎকার করব।”
” উহু তার আগে!”
” মনে নেই।”
” তিহি!”

তিহি হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা চালাতে চালাতে ভয়ে ভয়ে বলল,
” মিঃ নষ্ট বাপ।”
” আমি নষ্ট বাপ?”

ইশাদের অট্টহাসির শব্দে তিহি হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এই লোকটা কথায় কথায় এতো হাসে কেন?

হাসি নিয়েই বলল,
” তোমার সাথে আমার জরুরি কথা আছে। গাড়ীতে উঠে বসো।”
” না।”
” কেন?”
” আপনি আমার সাথে অসভ্যতামি করবেন!”

তিহির কথায় ইশাদ স্তম্ভিত সাথে রাগান্বিত। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে তাকে জোর করে গাড়িতে বসিয়ে দিল।

তিহি আর ইশাদ একটা রেষ্টুরেন্টে বসে আছে। দুজনেই চুপচাপ। তিহির চোখ টেবিলে রাখা সাদা গ্লাসটার উপর আর ইশাদের চোখ ওর ভয়ে দমে যাওয়া মুখটার উপর।

নিরবতা ভেঙে দিয়ে ইশাদ বলে উঠল,
” আজ ইনাকে পড়াতে আসনি কেন?”
“….”
” তিহি, আমি তোমার সাথে কথা বলছি।”

ইশাদ নিজের প্রশ্নে তিহির কোনো জবাব না পেয়ে তিহির সামনের গ্লাসটা টেবিলে হালকা বাড়ি দিয়ে উঠতে ও চমকে উঠল। হুট করেই ইশাদের হাতটা চেপে ধরে কাঁদোকাঁদো গলায় বলল,
” আমাকে ছেড়ে দিন,প্লিজ! এসব পাপ কাজ করলে তো আমি ইহকাল,পরকাল কোনো কালেই শান্তি পাব না। আর ইনার কথাটা তো একবার ভাবুন,ও যখন বড় হয়ে জানবে,ওর বাবা একটা নষ্ট বাবা তখন ও কতটা কষ্ট পাবে বুঝতে পারছেন? আর আমার আম্মু তো জানেও না আমি টিউশনি শুরু করেছি! তার মধ্যে যদি জানে আমি আপনার সাথে নষ্টটটট…”

দুজনের মাঝখানে থাকা টেবিলটির উপর দিয়ে উপুত হয়েই তিহির মুখ চেপে ধরেছে ইশাদ। রাগে তার চোখ, মুখ পুরোই টুসটুসে লাল টমেটো। ইচ্ছে করছে তিহিকে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে নাহয় দু, চারটা লবণ আর মরিচ মেশানো ধমক শুনাতে। কিন্তু ইশাদের এমন আকস্মিক কান্ডে তিহি এতোটাই ভড়কে গিয়েছে যে মুখবন্ধ অবস্থায় ওর দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। মনে হচ্ছে চোখের মনিগুলো এখনি বের হয়ে আসবে!

ইশাদ নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে এনে বলল,
” ইনা আমার ভাইয়ের মেয়ে।”

তিহির বড় বড় চোখ এবার প্রশ্ন ক্ষুব্ধে পাল্টাতে ইশাদ ওর মুখ থেকে হাত সরিয়ে বলল,
” ইনার জন্মকালেই ভাবি মারা গিয়েছিল। ভাইয়া আর ভাবির লাভ ম্যারেজ। ভালোবাসার মানুষটিকে এমন অল্প সময়ে হারিয়ে ফেলায় মানুষিকভাবে খুবই ভেঙে পড়েছিল। তারমধ্যে ইনার প্রতি একটা মিথ্যে ক্ষোভ চলে আসে। তার ধারণা ইনার জন্যই ভাবিকে হারিয়ে ফেলেছে। সেই ক্ষোভ থেকেই ওর প্রতি অবহেলা! এক সময় ইনাকে রেখে ভাইয়া অস্ট্রেলিয়া চলে গিয়েছে। মাঝে মাঝে আমাদের সাথে কথা হলেও ইনার ব্যাপারে এখনো নেগেটিভ। ইনা ছোটবেলা থেকেই আমার সাথে আছে। ও জানে,আমি ওর বাবাই! জানো মাঝে মাঝে তো আমার ভাইয়ার উপর মায়া হয় এটা ভেবে যে,এতো মিষ্টি একটা মেয়ের মুখে ভাইয়া বাবা ডাকটা শুনতে পারছে না। ও যখন আনাকে বাবাই বলে ডাকে,তখন নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী পিতা মনে হয়! এখন ওই আমার দুনিয়া। আর সেই দুনিয়াই আমি তোমাকেও আনতে চেয়েছিলাম।”

তিহি চুপচাপ ইশাদের কথা শুনে যাচ্ছে আর মনে মনে নিজেকে বকে যাচ্ছে,’ ছি! এমন ভালো একটা মানুষকে আমি নষ্ট বাপ বানিয়ে দিলাম? আমাকে তো ফাসি দেওয়া উচিত। সাথে যাবজ্জীবন জেল!’

ইশাদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিহির দিকে ঘোমড়া মুখ নিয়ে বললো,
” তিহি,তুমি যেহেতু চাচ্ছো না,আমার সাথে সম্পর্কে জড়াতে,আমি তোমাকে জোর করব না। ইনফেক্ট,আমি তোমার সাথে কোনো কথাবার্তা,দেখা সাক্ষাতও করব না। কিন্তু তুমি প্লিজ ইনাকে পড়ানো বাদ দিও না। ও তোমাকে পেয়ে কতটা খুশি আমি তোমাকে বুঝাতে পারব না। সারাটা রাত ও তোমার গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার ঘুম ভাঙলেই তুমি কখন আসবে বলে বলে আমাকে পাগল করে তুলে। আজ তুমি যাওনি দেখে ওর মুখটার দিকে আমি তাকাতে পারছিলাম না। আমার করা ভুলে আমি ওকে শাস্তি দিয়ে ফেলেছি! আমার ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে,তিহি। আমি ওকে কথা দিয়ে এসেছি,ওর প্রাইভেট মামনিকে নিয়েই ওর সামনে হাজির হব। আমার ভুলের জন্য আমি অনুতপ্ত! তিহি যাবে তো আমার সাথে?”

তিহি সদর দরজার কাছে এগুতে ইনা দৌড়ে এসে ওকে ঝাপটে ধরে। অভিমানি কান্নায় ভেঙে পড়ে বলছে,
” তুমি কেন আসনি,প্রাইভেট মামনি? আমি আর দুষ্টুমি করব না। তুমি না আসলে আমার অনেক কান্না পায়। অনেকগুলো কান্না। এতোগুলো কান্না করলে তো আমাকে পঁচা দেখাবে। তখন আমার বিয়ে কিভাবে হবে? আমার ঘোড়া চড়া রাজপুত্র তো আমাকে না নিয়ে চলে যাবে।”

তিহি ইনাকে কোলে নিয়ে ওর কপালে একটা চুমু খেয়ে বলল,
” এইতো এসেছি,দুষ্টুমনি,তোমার দুষ্টুমি না দেখলে আমার ও তো কান্না পায়। আমি আর দেরি করব না। দেখি আমাকে একটা চুমু খাওতো।”

সেদিন ইনাকে নিয়ে দু ঘন্টার জায়গায় তিন ঘন্টা পড়িয়েও ইশাদের দেখা মেলেনি তিহির। তাদের রুমে রেখে গিয়ে কোথায় চলে গিয়েছে কে জানে? এই রুমে একবারও পা ফেলেনি। একটু উকিও দেয়নি। এমন কী পুরো বাড়িতে তার কণ্ঠটাও পেল না সে। একি ঘটনা বারবার ঘটাতে তিহির মন আকুপুকু করা শুরু করে দিয়েছে। তার চোখ সারাক্ষণ শুধু ইশাদকে খুঁজছে। তার কান সারাক্ষণ শুধু ইশাদের কণ্ঠ শুনতে চায়ছে। মাঝে মাঝে মনের ভেতরটাও কেমন একটা করে উঠছে।

এর মধ্যে মিসেস মরিয়মের সাথেও সম্পর্কটা অনেকটা ভালো হয়ে এসেছে, তিহির। হাসি ঠাট্টা,নানা গল্পগুজব,টুকটাক সাহায্য সব মিলিয়ে ঠিক থাকলেও তিহির অন্তর আত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে ইশাদের জন্য। নানান বাহানায় পুরো বাড়ি এমন কী ছাদটাও ঘুরা শেষ তিহির। তবুও একটা বারের জন্য কোথাও দেখা মিলেনি ইশাদের। মানুষটা এমন হুট করে কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে? ভাবতে শুধু কান্না আসতে চায় তিহির। এত কিছুর মাঝেও হয়তো হঠাৎ করে দেখা হয়ে যাবে এ আশায় ইনাকে পড়ানো হচ্ছে রোজ। পড়া আর কোথায় হয়? পড়ার নামে দুষ্টুমি! ইনাকে দেখলে তিহির বুকটা ছ্যাত করে উঠে! এই টুকুনি বাচ্চাটা এভাবে মায়ের কোল হারা হয়ে গেল? আর বাবাটাও এমন পাষাণ কী করে হলো?

ইনার দিকে তাকিয়ে তিহি ভাবনায় বিভোর,হঠাৎই ও চিৎকার করে উঠল,
” বাবাই,তুমি কখন এলে?”

ইনার কণ্ঠে আঁতকে উঠে পাশ ফিরে চায়তেই ইশাদকে দেখতে পায় তিহি। মুখে তার সেই অমায়িক হাসি। এই মানুষটার এই হাসি হাসি মুখটা যে কোনো মেয়ের হৃদয় কেড়ে নিতে পারে!

বাবা-মেয়ের আদর-ভালোবাসা চোখ ভরে দেখে নিচ্ছে তিহি। সাথে নিজের আত্মাটাকেও একটু ভিজিয়ে নিচ্ছে।

তিহি বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে ইশাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পলকহীনভাবে চেয়ে আছে ইশাদের দিকে।

ইশাদ, ইনাকে নানা চকলেট আর চুমুতে ভরিয়ে দিয়ে তিহিকে বলল,
” তুমি কি কিছু বলবে?”
” আপনাকে চুমু খেতে ইচ্ছে করছে!”
” কী?”
” চুমু খাবো!”

ইশাদ তিহির চোখের সামনে তুড়ি মেরে একটু জোর কণ্ঠে বলল,
“তিহি,তুমি আবার হুশে থেকে বেহুশে চলে গেছো!”

ইশাদের কণ্ঠে তিহি চমকে উঠে! কয়েক বার চোখের পলক ফেলে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,
” আপনার সাথে কোনো কথা নেই।”

ইশাদ ইনাকে কোলে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ল। পরনের শার্টের বোতামে হাত রেখে বলল,
” আমি চেন্জ করবো। তুমি আসতে পারো।”

তিহি ইশাদের দিকে এগিয়ে আসলে ইশাদ আবার বলল,
” আসতে পারো বলতে আমার কাছে আসতে বলিনি। বাইরে যেতে বলেছি।”

তিহি কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে কিছু বলতে গিয়েও থমকে গিয়ে বলল,
” আপনি শুধু নষ্ট বাপই নন আপনি একটা নষ্ট প্রেমিক আমি আপনাকে অভিশাপ দিলাম আপনার জীবনে যাতে কোনো নারীর আগমন না ঘটে হুহ!”

তিহি মুখ বাঁকিয়ে চলে আসতে নিলে পেছন থেকে ইশাদ ওর একটা হাত চেপে ধরে বলল,
” যেদিন তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম সেদিনই অভিশাপ লেগে গেছে। কিন্তু কোনো নারীর জায়গায় হবে অন্য নারী!”
” মানে?”

ইশাদ তিহির সামনে এসে ওর চোখ মুছে দিয়ে বলল,
” এই চোখে আর কখনও যেন পানি না দেখি। বিশেষ করে আমি রিলেটেড কোনো কারনে। বুঝেছো? তোমার কী ধারণা আমি তোমাকে ভুলে যাওয়ার জন্য দূরে ছিলাম? মোটেও না।আমি আমার ইন্টার্নির জন্য বিশেষ কাজে ছিলাম। ঐদিন তো ঐসব কথা এমনি এমনি বলেছি!”

ইশাদ আবার উচ্চ স্বরে হেসে উঠলে তিহি রাগ দেখিয়ে চলে যেতে নিলে ইশাদ আবার পেছন থেকে বলল,
” যতদিন পৃথিবীতে আমার নিশ্বাস চলবে ততদিন আমার তোমাকে চাই। এবার সেটা তুমি না চাইলেও আমি জোর করে রাখবো। দরকার হলে তোমাকে খাচায় বন্দী করে রেখে তোমাকে দেখবো। আর জোরে জোরে নিশ্বাস নিবো!”

তিহি চোখ মেলে ফোনটা পাশে ঢিল মেরে ফেলে চিৎকার করে উঠলো,’সব মিথ্যা ইশাদ। তুমি আমাকে সব মিথ্যে আশ্বাস দিয়ে তোমার মায়াই বন্দী করেছো। যে মায়ায় আমি দম বন্দ করে মরে যাচ্ছি!’

——
ইশাদ মিহির স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মিহির জন্য। এই জায়গাটাতেই তো সে তার তিহি পাখিটাকে দেখেছিল। চোখ, মুখে বিরক্ত নিয়ে কিচিরমিচির করে বকছিলো মিহিকে!

” সুন্দর ভাইয়া,আপনি এখানে?”

ইশাদ ভাবনা থেকে বের হতে মিহিকে দেখতে পেল। লাল আর সাদা রঙের স্কুল ড্রেস পরে আছে। চোখে তার বিস্ময়! হয়তো আশা করেনি ইশাদকে এখানে এভাবে দেখতে পারবে। ইশাদ মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,
” তোমাকে দেখতে এসেছি মিহিরানী।”

ইশাদের কণ্ঠ পেতে মিহি ওকে ঝাপটে জড়িয়ে বলল,
” আপনি কেন আপুকে বিয়ে করলেন না সুন্দর ভাইয়া! আপু কত কষ্ট পেয়েছে জানেন? সারারাত কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ ফুলে গিয়েছিল!”

মিহিও কান্নায় ভেঙে পড়েছে। মিহিকে কী বলে সান্ত্বনা দিবে বুঝতে পারছে না। তিহি যে কত কষ্ট পেয়েছে সেটাতো তিহি নিজেও জানে না!

” তুমি যদি এভাবে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করো তাহলে আমি কিন্তু নাক না কেটেই তোমাকে বিয়ে করে ফেলব মিহিরানী!”

মিহি চট করে ইশাদকে ছেড়ে দিয়ে ভেজা চোখ নিয়েই ইশাদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ইশাদ কিছুটা নিচু হয়ে বলল,
” বোনের সাথে কথা হয়নি বুঝি?”
” উহু!”
” কেন? তিহি তোমাকে কল দেয়নি?”
” কী করে দেবে? আমার তো মোবাইল নেই। আর আম্মু নিজের মোবাইল সাথে করে নিয়ে অফিসে চলে গেছে।”

ইশাদ পকেট থেকে একটা ফোন বের করে মিহির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
” আজ থেকে এটা তোমার ফোন। এটাতে দুটো নাম্বার সেভ করা আছে,একটা তিহির আরেকটা আমার। তুমি আমাকে যে কোনো সময় কল করতে পার।”
” সত্যি?”
” হুম। তোমার আপুর নাম্বারে এখনই কল করো। আমিও শুনি তোমার আপুর নতুন সংসারের গল্প!”

কিভাবে কল দিতে হয় মিহিকে দেখাতে দেখাতে তিহির নাম্বারে কল দিয়েছে ইশাদ। একটা বার ওর কণ্ঠটা শোনার জন্য ভেতরটা চাপা চিৎকার করে হা-হুতাশ করছে!

মিসেস শিরিন বেগম নিজ হাতে তিহিকে খাবার খায়িয়ে দিয়েছেন। খেতে না চায়লেও উনার এমন আদরমাখা ধমককে ফেলে দিতে পারছিল না তিহি। তবে খাবারটা খাওয়ার পর এখন নিজের মধ্যে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ব্যথাগুলোও অনেকটা মিইয়ে পড়ে যাওয়ায় শরীরের ভারটা কমে এসেছে। আর কতক্ষণ এভাবে বিছানায় পড়ে থাকবে? একটু উঠে বসে জানালার কাছটাই গিয়ে দাঁড়িয়েছে তিহি। বাইরের প্রকৃতিতে মনোযোগ দেওয়ার আগেই নিজের ফোনটা বেজে উঠে।

ধীর পায়ে এগিয়ে এসে ফোন হাতে নিতে আননোন নাম্বার ভেসে উঠল। হয়তো ইশাদ কল করেছে অন্য নাম্বার থেকে। এমন ভাবনায় কলটা রিসিভ করে কানে ধরে হ্যালোটা আর বলা হয়নি। তার আগেই কেউ একজন ফোনটা কেড়ে নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলেছে। তিহি নিজের চুলে কারো গভীর হাতের মুঠো অনুভব করতে আহ! বলে চিৎকার করে উঠেল।

” তুই বলে অসুস্থ? বিছানা থেকে নড়তে পারিস না? এই তোর বিছানা? কার সাথে কথা বলছিলি?”

এমন ঝাঝালো কণ্ঠ পেয়ে তাজের দিকে তাকিয়েই তিহি থমকে গিয়েছে। রাগে লোকটার মুখে অনেকগুলো ভাঁজ পড়েছে। শ্যাম বর্নের চেহারাটা লালচে হয়ে এসেছে। চোখগুলো বড়বড় হওয়াই এমন রাগের মাঝে বেশ ভয়ানক লাগছে। পাতলা সরু নাকের পাতাগুলোও বারবার কেঁপে উঠছে। পুরো ঠোঁটের উপরে ঘন চুলের মোচ। এত কিছুর মাঝেও সেই ভয়ানক চোখটার দিকেই তিহির চোখ আটকে গেল। যেখানে চুলে টান পড়াই তিহির চোখ বন্ধ করে ব্যথা অনুভব করা উচিত সেখানে তিহি চোখের পলক ফেলা বন্ধ করে দিয়েছে।

এই চোখ দুটো তো আমার চেনা,খুব কাছ থেকে,খুব পাশ থেকে, খুব গভীরভাবে দেখেছি আমি। কিন্তু আর কিছু তো চিনি না। এই লোকটাকে তো আমি আগে কোথাও দেখিনি,তাহলে উনার চোখ দুটো এতো চেনা লাগছে কেন? এতো গভীর পরিচিতি বুঝাচ্ছে কেন? কোথায় দেখেছি আমি এই চোখ???

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here