তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (১৮)

0
771

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (১৮)
#রোকসানা_রাহমান

ফাল্গুন মাসের আজ একুশ তম দিন। প্রচন্ড মাথা ব্যথা নিয়ে বিকেলের শুরুতেই বাসায় ফেরত এসেছে ইশাদ। একটু বিশ্রামের প্রয়োজন। একটা কড়া ঘুমের প্রয়োজন তার। সেই সিদ্ধান্তেই আয়েশে বিছানায় পিঠ এলিয়ে দেয়। চোখ বন্ধ করতেই রাজ্যের ঘুম জড়ো হয় পাতাদুটোতে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হতে বুকের মধ্যে ভারি কিছুর উপস্থিতি অনুভব করে। কঠিন কিছু নয়। নরম,তুলতুলে। সম্ভবত প্রাণশক্তিও বিদ্যমান। উষ্ণ নিশ্বাস তার বুকে পড়ছে। ইশাদের ঘুম হালকা হয়ে আসে। গাঢ় ঘুম ভেদ করে চোখ মেলতেই ছোট্ট প্রাণোচ্ছল মুখ ভেসে উঠে। দাঁত বের করে খুশির ঝিলিক উপহার দেয় ইশাদকে। ইশাদের দুই গাল টেনে ধরে দারুন মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করে,

“তুমি কি আমার বাবাই?”

ইশাদ বিস্ময়ে অভিভূত! ক্ষণকাল মিষ্টি মায়ার শ্যামবর্ণের বাচ্চা মেয়েটির দিকেই গাঢ় দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। এত সুন্দর মুখও বুঝি কারো হয়? চোখের তারায় যেন পবিত্র ফুল ফুটে আছে! রক্তরাঙা ঠোঁট দুটো থেকে ঝরে পড়ছে আহ্লাদীর ললিত পুষ্পরেণু।

“কি গো বলো না। তুমি কি আমার বাবাই?”

চার/পাঁচ বছরের বাচ্চাটি কথার ফাঁকে ইশাদের পেটের উপর পা তুলে বসে পড়েছে। চোখজুড়ে রাজ্যের কৌতুহল,আকাঙ্ক্ষা,প্রত্যাশা! কান পাশে পড়ে থাকা বেনি দুটো পেছনে ঠেলে নেয় মেয়েটি। ঝুঁকে আসে আরো খানিকটা ইশাদের দিকে। কন্ঠে মুগ্ধতা ঢেলে কিছু বলবে তার আগেই তিহি চলে আসে। টেনে হিঁচড়ে ইশাদের পেট থেকে নামিয়ে আনে। মেয়েটি টাল সামলাতে না পেরে বিছানার কোণের সাথে থুঁতনিতে বাড়ি খায়। চাপা আর্তনাদ ছাড়ে। তখনো ইশাদ হুঁশে নেই। ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে আছে বাচ্চাটির দিকে। যেন সে চোখ মেলে স্বপ্ন দেখছে। যেখানে নিজের ইচ্ছে মতো কিছু হয় না। শুধু দেখে যেতে হয়। উপভোগ করতে হয়। তার হুঁশ এল যখন বাচ্চা মেয়েটির গালে সশব্দের দুটো চড় পড়ল। ইশাদ হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছাড়ে। মেয়েটিকে নিজের কাছে আগলে নিয়ে তিহির দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,

“মারছেন কেন?”

তিহি নিজের রাগ বরাদ্দ রেখে ফুঁসিয়ে উঠল,

“বেশ করেছি। আরো মারব। এইটুকু মেয়ে এত অভদ্র হয় কেন? ইচ্ছে করছে গাল টেনে ছিঁড়ে ফেলি। দস্যি কোথাকার!”

তিহির কাছ থেকে এই ধরনের ব্যবহার অপ্রত্যাশিত। ইশাদ ক্ষনিকের জন্য তিহিকে অন্য কারো সাথে গুলিয়ে ফেলল। নিজের বাস্তবতাকেও। সে কি আবারও স্বপ্ন দেখছে? এই বাচ্চাটিই কে? তিহির সাথে কী সম্পর্ক? এমন কঠোর শাসনতো আপন সম্পর্ক ছাড়া কেউ করতে পারে না। তাহলে কি তিহির মেয়ে?

ইশাদ নিজের ভাবনার মধ্যেই শিউরে উঠল। কানের মধ্যে কয়েকবার ঝনঝন সুরে বাজল,’তিহি বিবাহিত! তিহির একটা মেয়ে আছে!’ অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় তিহির দিকে। তার নাকের আগা লাল টকটকে। পাটা দুটো ঘন ঘন ফুলে নিভে যাচ্ছে। গালদুটোতে কাঠিন্যতার ছাপ। চোখে ভাসছে অনলশিখা! যেকোনো সময় হামলে পড়বে মেয়েটির উপর। পুড়িয়ে দেবে নরম শরীর! যাকে নিজের পেটের মধ্যে সযত্নে আগলে রেখেছে ইশাদ। ইশাদ বিস্ময়ের ধার নিয়েই মেয়েটির দিকে চোখ রাখে। মুহূর্তেই কোমলতার ঢেউ উপচে পড়ে তার বুক সাগরে। সস্নেহে মেয়েটির চুলে হাত রেখে নরম সুরে বলল,

“সোনা,মাকে রাগাতে নেই। কথা শুনতে হয়। তবেই না বেশি বেশি ভালোবাসবে। আদর করবে। মাকে সরি বলো।”

ইশাদের কথা শেষ হতেই নাক সিঁটকায় তিহি। তাচ্ছিল্যে ঠোঁট বাকিয়ে বলল,

“আমি ওর মা হতে যাব কেন?”

ইশাদ দ্বিতীয় দফায় অবাক হয়। বিস্ফারিত চোখে সুধায়,

“তাহলে?”

এই পর্যায়ে তিহির উত্তর দিতে হয় না। মেয়েটি ইশাদকে ছেড়ে তিহির কোমর জড়িয়ে ধরে। পেটে মুখ গুঁজে মায়াকন্না ছেড়ে অনর্গল বলে চলে,

“সরি আপু। আর এমন করব না। নিচে আসব না। বাবাইকে খুঁজব না। বাবাইয়ের পেটে উঠব না। বাবাই..”

তিহি মেয়েটাকে নিজের কাছ থেকে ছাড়াতে চেষ্টা করে। না পেরে পিঠে আরো কয়েকটি থাপ্পড় লাগিয়ে বলে,

“আমি তোর কেউ না৷ খবরদার আপু ডাকবি না। তাহলে কিন্তু মেরেই ফেলব। ছাড় আমাকে। দস্যিইনা ছাড়তে বলেছি!”

ইশাদ নির্বাক। স্তম্ভিত,কিংকর্তব্যবিমূঢ়,হতবুদ্ধি শূন্য কাঠ হয়ে দাড়িয়ে আছে। দুজনের ব্যবহার এবং সম্পর্ক কোনোটাই স্বাভাবিকভাবে গ্রহনযোগ্যতা পাচ্ছে না। ইশাদ মুহূর্তকাল নীরবে কাটিয়ে হঠাৎ সচল হয়ে উঠে। জাগ্রত হয় চামড়ার ভেতরের অনুভূতিগুলো। সে ব্যস্ত হয়ে পড়ে তিহিকে থামানোর জন্য। কিন্তু পারছে না। ইশাদ জোরপূর্বক তিহির হাতদুটো এক হাতে আটকে নেয়। অন্যহাতে ইনাকে তিহির কাছ থেকে ছাড়িয়ে নেয়। খুব একটা সহজ নয়। ইনা কিছুতেই তিহিকে ছাড়তে চাচ্ছে না। ছোট্ট হাতে কাপড় টেনে ধরে আছে। কান্নার স্রোতের মধ্যেই চিৎকার করে বলছে,

“বাবাই ছাড়ো,আমি আপুর কাছে যাব।”

ইনার কান্নারত কন্ঠে ইশাদের বুক ফেটে যাচ্ছে কিন্তু তিহি? সে এ কোন নির্দয়ের প্রতিরূপ ধারণ করছে? এক চিলতে মায়ার ছটা কোথাও উঁকি দিচ্ছে না। এ কেমন টান? কেমন সম্পর্ক? এমনও হয়? সম্পর্কের মধ্যে এতটা কঠোরতা যে বড্ড বেমানান!

দুজনের মধ্যে পড়ে ইশাদের নাজেহাল অবস্থা। ইনা এক হাতে তিহির কাপড় টেনে ধরায় তার জামা ছিঁড়ে যাওয়া উপক্রম। অন্য হাতে ইশাদের পেটের মধ্যে কঠিন আচড় কাটছে। তিহিও কি বাচ্চা হয়ে গেল? নাহলে ইশাদের হাতে কামড় বসাল কিভাবে? কোনো পরিণতি মেয়ের জন্য কি এই স্বভাবটা অশোভন নয়? ইশাদকে বাঁচাতেই বোধ হয় রেখা ভূঁইয়া ছুটে এলেন। ইনাকে কোলে তুলে তিহিকে ধমকে উঠলেন,

“কী হচ্ছে এসব? তিহি চোখ মেলে তাকা।”

উনার কথায় ইশাদের চোখ পড়ে তিহির চোখে। সত্যিই সে চোখ বন্ধ করে আছে। ইশাদের হাতের কব্জীর পাশে কামড়ে ধরে আছে। যেন আয়েশে মুরগির রানের অংশ কামড়ে খাচ্ছে। মাংস শেষে কি হাড্ডিগুলোও কড়কড় করে চিবিয়ে খাবে? রেখা ভূঁইয়ার ধমকে কাজ করল। তিহি চট করে চোখ মেলে। ইশাদের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হতেই সে পিছনে সরে আসে। লজ্জায় গা ঢাকা দিতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

তিহির পেছন পেছন রেখা ভূঁইয়াও চলে যেতে নিলে ইশাদ জিজ্ঞেস করে বসল,

“ইনা কি নতুন মেহমান? আগে তো দেখিনি। কি হয় আপনাদের?”

রেখা ভূঁইয়া পেছন ঘুরলেন না। দায়সারা উত্তর দিয়ে পালালেন,

“তিহির ছোট বোন হয়।”

ইশাদও ঘন ঘন পা ফেলে। রেখা ভূঁইয়া চোখের আড়াল হওয়ার পূর্বেই আবারও জিজ্ঞেস করে,

“আপনার মেয়ে?”

এ পর্যায়ে রেখা ভূঁইয়া কথা বললেন না। এক পলক ভীত দৃষ্টি ছুঁড়ে ঘাড় নারলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইশাদের বুকের অস্থি বেড়াজালে আটকে থাকা নিশ্বাসটি বেরিয়ে আসে। যেন কতকাল বন্দী পড়েছিল! পরম শান্তিতে চোখের পাতা বন্ধ করে ফেলে। অনুভব করে নতুন কিছু। কিছু হারিয়ে ফেলার প্রাপ্তি!
_______________________________
সন্ধ্যা নামতেই কঠিন আঁধার নামে ইশাদের মন কোঠরায়। বুকের ভেতর চলে অসহণীয় অস্থিরতা। রুমের আনাচে-কানাচে সবকিছুতেই পড়ে অবহেলার দৃষ্টি। দূরের ছোট্ট টেবিলে এখনো বিকেলের নাস্তাটা পড়ে আছে। ফোনটা খাটের এক কোণে ঠেকে আছে। যেকোনো সময় নিচে পড়ে যেতে পারে। ল্যাপটপ খোলা অবস্থায় খাটের মাঝখানে বসে আছে। আর ইশাদ? সে কোথায়? রুমের মধ্যে কি? হ্যাঁ রুমের মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে আছে। ডান হাতটা কপালে ঠেকানো। কিসের এত চিন্তা চলছে তার মস্তিষ্কজুড়ে?

“কোথায় যাচ্ছো,মিহি?”
“তিহি আপুর কাছে।”

মিহির কন্ঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসা তিহি নামটাই ইশাদের চঞ্চলতা আরো বাড়িয়ে দেয়। মনের ভেতরের গভীর খচখচানি ভাবটা আরো ক্ষুধার্তের রূপ নেয়। কঠোর মনোযোগ রাখে বাইরে। শুনতে চায় আরো দুটো বাক্য। যে বাক্যের প্রতিটি অক্ষর মিশে আছে তিহির সাথে!

ইশাদের অধীর প্রতিক্ষা শেষ হয় না। মিহির কন্ঠ বাজে না। আম্মুর কন্ঠও না। তাহলে কি তিহির আলোচনা এখানেই শেষ? ইশাদ দ্রুতগামীতে বাইরে বেরিয়ে আসে। সন্ধানী দৃষ্টি রাখে করিডোরের এ মাথা থেকে ও মাথা। না কোথাও নেই। ইশাদের মন করুণ কন্ঠে উচ্চারণ করে,’কোথাও নেই!”

“রাতে কী খাবি,বাবা?”

মায়ের প্রশ্নে ছিটকে উঠে ইশাদ। চমকপ্রদের মাত্রাটা চোখে পড়ার মতো। শাহিনা শাইখার চোখেও পড়ল। তিনি উদ্বেগ নিয়ে বললেন,

“কী হলো? ভয় পেলি নাকি?”

ইশাদ দ্রুত মাথা নাড়ে বিপরীতে। নিঃশব্দে রুমে ঢুকতে নিলে শাহিনা শাইখা পুনরায় বললেন,

“তোর দাদিকে একটা কল করা প্রয়োজন। তুই করবি নাকি আমি?”
“তুমি করো।”
“এখন করব নাকি খাবারের পরে?”

ইশাদ ঘুরে দাড়াল। মুহূর্তকাল মায়ের দিকে নীরব চাহনি রাখে। বলে,

“আব্বুকে জিজ্ঞেস করো।”

রুমে ঢুকেই ইশাদ বিছানায় বসল কিছুক্ষণ। মনের ভেতরের তরল দুশ্চিন্তাটা দূর করতে ডান পা’টাকে ক্রমশ নাচাচ্ছে। কোনো কাজ হচ্ছে না। ভেতরের দহনটা বেড়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে বালিশে মাথা রাখে। কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে। মাথা থেকে তিহিনামক মেয়েটাকে ভ্যানিশ করতে চায়। সে তার অস্থিরতার কারণ খুঁজে পেয়েছে। তিহির সাথে তার শেষ দেখা কাল বিকেলে ছিল। ইনার সাথে একটি অপ্রীতিকর মুহূর্তে। তারপর আর দেখা হয়নি। না ইশাদ ছাদে গিয়েছে। না তিহি নিচে নেমেছে। নামলেও ইশাদের চোখে পড়েনি। ইশাদ উঠে বসে। কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকে। কাজ হয় না। মন দুরন্ত হয়ে পড়েছে। রোধ করা কঠিন হচ্ছে। একটু বেখেয়ালি নড়তে মোবাইলটা মেঝেতে পড়ে গেল। ইশাদ তড়িঘড়িতে নিচে নামে মোবাইল কুড়িয়ে পরখ করে। অতঃপর ডায়াললিস্টে ঢুকে এক পরিচিত নাম্বারে কল ঢুকিয়ে সিঁড়ি ঘরের দিকে পা ফেলে। এমন একটা ভাব যে,জরুরী কল এসেছে!

সিঁড়ির সকল ধাপ পার হয়ে শেষটায় পা রাখতেই আচমকা ইনার সাথে দেখা। সে সিঁড়ির দরজা দখল করে দাড়িয়ে আছে। তাড়াহুড়োয় জিজ্ঞেস করল,

“আমার মামনিকে দেখেছো?”

ইশাদ মনে করার চেষ্টায় নামল। রেখা ভূঁইয়াকে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। কিন্তু তার কন্ঠ পেয়েছিল হয় তো। সে ভাবনা ছেড়ে বলল,

“মনে হয় নিচে আছে। কেন বলো তো?”

ইনা প্রশ্নের জবাব দিল না। মহাব্যস্ত ভাব নিয়ে নিচের ধাপে নামে। ইশাদকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ির ধাপে ছোট্ট পায়ের পাতা রাখে। দুটো ধাপ পার হয়েই থেমে যায়। কী মনে করে পেছন ফিরে আসে। ইশাদের কাছে এসে শক্ত গলায় বলল,

“বাবাই,আমার সাথে এসো তো।”

ইশাদের উপর আদেশ ফেলে,পালনের অপেক্ষা করে না ইনা। রীতিমতো ইশাদের আঙুল চেপে ধরে সামনে টানতে থাকে। সোজা নিজেদের রুমের সামনে আসে। খোলা জানালার পাল্লার আড়ালে দাড়িয়ে ভেতরে উঁকি দিল। তারপর ফিসফিসিয়ে বলল,

“তুমি,আপুর মতো চুল বেঁধে দিতে পারবে?”

সুযোগ বুঝে ইশাদও ভেতরে উঁকি মারে। তিহি খাটের উপর উপুত হয়ে শুয়ে আছে। পরনে সবুজ শাড়ী। মাথার চুলগুলো একসাথে করে বেনি পাকিয়ে পিঠে ফেলে রেখেছে। পা দুটো জানালার তাকে বিছিয়ে রাখা। তিহির এই রূপটি ইশাদের চেনা। কিন্তু তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে,এই নারীর এই রূপটি কত সাধনার পর আজ অর্জন করতে সক্ষম হলো! সাধনার বয়স নিশ্চিত কয়েক যুগ পার করেছে। তার মুগ্ধতায় টান পড়ল ইনার কারণে। সে ইশাদের শার্টটা খামচে ধরে নিচে টানছে। ইশাদ নিজেকে সংবরণ করে চোখের পাতা ফেলে ধীর গলায় বলল,

“পারব।”

ইনা আর সময় খরচ করে না। ইশাদের হাতে চিরুনি ধরিয়ে দিয়ে উল্টো ঘুরে। ইশাদও সযত্নে তার কাধছাড়া চুলে চিরুনি চালায়। বার কয়েক তিহির বেনির দিকে তাকিয়ে চুল বাঁধায় সাফল্য পেল। ইনা নিজের বেনি ভালো করে পরখ করে ইশাদের দিকে তাকাল। গম্ভীর,থমথমে মুখটা হাস্যোজ্জ্বল রূপ নিয়ে ইশাদের ডান গালে চুমু খেল। তারপর ছুটে চলে গেল ভেতরে। ইশাদ জানালার সামনেই দাড়িয়ে রইল। তবে চোখদুটো তিহিতে নয় ইনাতে আটকে আছে। তার হাস্যোজ্জ্বল মুখটা আবার মলিন হয়ে এসেছে। তিহির দিকে চেয়ে থেকে ছুটে যায় ওয়াড্রবের দিকে। পাশে পড়ে থাকা মোড়াটি ঠেকায় ওয়াড্রবের দেয়ালে। মোড়াতে চড়ে একে একে সব ড্রয়ার খুলছে আর কাপড় বের করে বাইরে ফেলছে। ইশাদের মধ্যে আগ্রহ জাগে। সে গভীর মনোনিবেশ করে ইনার কর্মকান্ডে। দেখতে দেখতে ওয়াড্রবে গুছিয়ে রাখা সব কাপড় বাইরে ফেলে দিয়েছে ইনা। বহুক্ষণ পর একটা সবুজ ওড়না পেতেই ঠোঁটের কোণে তৃপ্তি হাসি ফুটে উঠে। চট করে তাকায় জানালার দিকে। ইশাদ চোখ সরিয়ে নেয়। যেন চুরি করে দেখতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ইনা আবারও বাইরে ছুটে আসে। ইশাদের হাতে ওড়না ধরিয়ে দিয়ে মিষ্টি সুরে বলল,

“আপুর মতো পরিয়ে দেও।”

ইশাদ শুকনো ঢোক গিলল। বেনি করা মিহির কাছ থেকে শিখেছিল। কিন্তু শাড়ী? এটাতো শিখেনি। পারবে তো?

ইশাদ ভয়ে ভয়ে ইনার কোমরে ওড়নার কোণ গুঁজে দেয়। তিহির দিকে তাকিয়েও লাভ নেই। সে শুয়ে আছে। কোথায় কোন কোণ ঢুকিয়েছে বোঝার জোঁ নেই। তাই বলে কি তাকাবে না? এমন সুযোগ কি এড়ানো যায়? ইশাদতো পারল না। সে তিহিকে দেখতে দেখতে কোনো রকমে ইনার শরীরে ওড়নাটা পেঁচিয়ে দিল। অসহায়সুরে বলল,

“সোনামা,দেখতো হয়েছে নাকি।”

ইনা দেখল না। যেন তার সময়ের অভাব সে আবারও ভেতরে ঢুকে পড়ল। তিহির দিকে তাকিয়ে কী সব মিলিয়ে রুমের অন্যপ্রান্তে চলে যায়। টেবিলের উপরে সাজিয়ে রাখা বইগুলো থেকে একটা বই তুলে নেয়। তারপর খাটের কাছে এসে আবারও জানালার দিকে তাকায়। ইশাদ যে তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পারছে। সে ধীর পায়ে দরজার কাছে আসে। ইশারায় ইশাদকে ডাকে। ইশাদও বাধ্য ছেলের মতো ওর সামনে ঝুঁকে দাড়ায়। ইনা ইশাদের কানে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আমারতো আপুর মতো সবুজ চুড়ি নেই। কাল কিনে দিও।”

কথাটা শেষ করেই ইশাদের দুই গালে পরপর দুটো চুমু খেয়ে পেছন ঘুরল। সাবধানে পিলপিল পায়ে খাটের উপর উঠে। তিহির পাশে সেও বই মেলে উপুত হয়ে শুয়ে পড়ে। কিন্তু একি! তার পা তো জানালা পর্যন্ত আসছে না। ইনা বিছানা ঘেষে জানালার ধারে এসে তাকে পা রাখতে মন খারাপ হয়ে যায়। সে যে তিহির থেকে অনেকটা নিচে চলে আসছে। এখন কী হবে? সমান সমান কী করে হবে? ইনা আবারও বিছানা ঘেষে সামনে আগাতে নিলে,ওকে ধাক্কা মেরে নিচে ফেলে দেয় তিহি!

ইশাদ বাইরে থেকে সব দেখছিল। ঘটনার আকস্মিকতায় তার বুক কেঁপে উঠে। দৌড়ে ইনাকে নিচ থেকে কোলে তুলে নেয়। চেপে ধরে বুকের সাথে। ইনা কনুইতে ব্যথা পেয়েছে। পা ওড়নার সাথে পেঁচিয়ে আছে। ব্যথায় চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কান্নার মাঝেই হাত দুটো বাড়িয়ে দেয় তিহির দিকে। বিরামহীন বলতে থাকে,

“আপুর কাছে যাব। আপু!

ইশাদ চেপে ধরেও নিজের কাছে রাখতে পারছে না। ইনার কন্নারত কথাগুলো তীব্র মায়া তুলে ইশাদের মনে। কিন্তু তিহি সে ফুঁসে উঠে। ইনাকে আঘাত করতে চায়লে,ইশাদ সরে যায়। কড়া গলায় ধমকে উঠে,

” কী করছেন? দেখছেন না মেয়েটা এমনি ব্যথা পেয়েছে? আবার মারতে চায়ছেন?”

তিহি অনুযোগ তুলে বলল,

“তাহলে আমার কাছে আসে কেন? আমি মানা করেছি না আমার কাছে আসতে?”

ইশাদের কন্ঠস্বর পরিবর্তন হয়। বলল,

“আপনার কী হয়েছে বলুন তো? এই বাচ্চাটার সাথে এমন কঠোর ব্যবহার করছেন কেন? ভালো করে দেখুন আপনাকে কতটা ভালোবাসে!”

প্রতিত্তোরে তিহি কিছু বলল না। সামনে থাকা বইটা নিচে ফেলে দেয়। চিৎকার করে রেখা ভূঁইয়াকে ডাকে,

“আম্মা?”

ডাকতে ডাকতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়।

______________________________

“একটু বসার রুমে আসবেন? আম্মা ভিডিও কল দিয়েছে।”

সোবহান শাইখ বিছানায় বসে ঝিমুচ্ছিলেন। হাতে নীল রঙের কলম। বুকের উপর বই পড়ে আছে। তিনি নড়েচড়ে বসলেন। বইটা মেলে তাতে কলমের দাগ বসাতে বসাতে বললেন,

“সেখানে আমার কী প্রয়োজন? তুমি কথা বলে নেও।”
“আম্মা মুখে কিছু বলেন না। কিন্তু চোখদুটো আপনাকে খুঁজে। আমি বুঝতে পারি।”

শাহিনা শাইখার কথাটা যেন সোবহান শাইখ শুনেননি এমন ভাব করে বসে রইলেন। বইয়ের পাতা উল্টিয়ে গভীর নজর বুলাচ্ছেন। শাহিনা শাইখা ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়লেন। রুম ত্যাগ করার পূর্বে আরেকবার স্বামীর দিকে তাকালেন। চোখের কোণে কি অশ্রুকণা দলা পাকাচ্ছে?

ইশাদ দাদিকে সালাম দিয়ে পানির গ্লাসটি তুলে নিল। মুখে এক ঢোক পানি জমতেই পাশ থেকে তিহির গলা,

“ইনা যদি আপনাকে বাবাই বলে ডাকে,আমিও কিন্তু আপনাকে বাবাই বলে ডাকব।”

ইশাদের গলায় পানি আটকে গেল। নাকের তলায় উঠে গেল। ভিষম খেতেই মুখের পানি বাইরে বেরিয়ে আসে। পড়ল তো পড়ল একদম তিহির মুখে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here