তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,১৯,২০

0
734

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,১৯,২০
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৯)

ইশাদ দাদিকে সালাম দিয়ে পানির গ্লাসটি তুলে নিল। মুখে এক ঢোক পানি জমতেই পাশ থেকে তিহির গলা,

“ইনা যদি আপনাকে বাবাই বলে ডাকে,আমিও কিন্তু আপনাকে বাবাই বলে ডাকব।”

ইশাদের গলায় পানি আটকে গেল। নাকের তলায় উঠে গেল। ভিষম খেতেই মুখের পানি বাইরে বেরিয়ে আসে। পড়ল তো পড়ল একদম তিহির মুখে!

ঘটনার আকস্মিকতায় বসার রুমের সকলের বিস্ময় গগণ ছুঁলো! ইশাদ,তিহি ব্যতীত সেখানে মিহি ও রুবিনা উপস্থিত ছিলেন। শাহিনা শাইখা ততক্ষণে ইশাদের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছেন। সকলেই কয়েক সেকেন্ড পিনপতন নীবরতা পালনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। চোখজোড়া তিহিতে আটকে। তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে সেই কৌতুহল বিচরণ করছে সবার মনে।

ইশাদ নিজের কান্ডে নিজেই বিস্ময়ের অতিকে উঠে বসে আছে। পূর্ণ দৃষ্টি তিহির চোখের পানে। সেকেন্ড কয়েক পেরোতেই সে চোখ নামিয়ে নিল। গ্লাসসহিত হস্তি থরথর করে কাঁপছে! গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। কাতর চাহনি আঁকলো উপস্থিত সকলের উপর৷ বুকের ভেতর ঢিপঢিপ বাজনা নিয়ে তিহির দিকে চোখ ফিরিয়ে আনে। অস্পষ্ট সুরে উচ্চারণ করে,

“‘সরি!”

তিহি কি শুনল? সে এখনো চুপচাপ। চোখের দৃষ্টিতে ফুটে আছে অবিশ্বাস্যতা! সারা মুখে পানির ছিটা রেখা তৈরী করছে। নাকের আগা বেয়ে পানির ফোঁটা ঠোঁটের উপর পড়তে তিহি মৃদু কেঁপে উঠল। এক পলকে চারাপাশে নজর বুলিয়ে নেয়। অপমানবোধটা শক্তভাবে অনুভব করার পূর্বেই মিহি সোফা ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ে। উৎসাহ নিয়ে বলল,

“তিহি আপু,তুমি বাবাই ডাকলে তো আমাকেও বাবাই ডাকতে হবে!”

এ পর্যায়ে সকলের ইন্দ্রীয়শক্তি ফিরে আসে। সবার আগে চটে উঠেন ইশাদের দাদি মেহেরুনা শাইখা। ল্যাপটপের স্ক্রিনে আবদ্ধ থেকেই গর্জে উঠেন মিহির উদ্দেশ্যে,

“ঐ ছেড়ি থাপড়া খাবি? দুই দিন পর যে জামাই হবে তারে বাপ বানাস! চুলের নিচে কি গোবর রাখস?”

মিহি ভয়ে মিইয়ে যায়। ইশাদের বাম হাতের শার্টের হাতা চিমটে ধরে সোফায় বসে পড়ে। নতজানু অবস্থায় চোখ তুলে সামনে তাকালে, মাথাভর্তি পাকা চুলের বৃদ্ধ মহিলার লালচক্ষুতে তার অন্তর কেঁপে উঠে। দ্রুত চোখ মেঝেতে স্থির করে। পরিবেশ আবার শীতল ছায়ায় ঢাকা পড়ে। সবকিছু সামাল দিতে এগিয়ে আসলেন শাহিনা শাইখা। তিহির হাতটা চেপে ধরে ইশারায় চুপ থাকতে বললেন। নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছিয়ে ইশাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে শ্বাশুড়ির সাথে কুশল বিনিময় করলেন। কথার ফাঁকে সুক্ষ কৌশলে ইশাদকে মিহির পাশে বসিয়ে দিয়ে বললেন,

“আম্মা,আপনি কবে আসবেন? টিকিটের ব্যবস্থা হলো?”

মেহেরুনা শাইখা জবাব দিলেন না। পুত্রবধূর দিকে চেয়ে রইলেন৷ মুহূর্তেই তার মুখের রঙ বদলে গেল। অত্যাধিক মায়া ও স্নেহ ভর করে নয়নজোড়ায়। এভাবেই কেটে যায় কিছুক্ষণ। শাহিনা শাইখা বুঝি ব্যাপারটা আঁচ করতে পারলেন। তার গলা ধরে আসছে। মুখ থেকে শব্দ বের হওয়ার পূর্বেই যে চোখ থেকে পানি গলে পড়বে সে বোধটাও তীব্র হয়ে এল। শ্বাশুড়ি মায়ের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলেন। যথাসম্ভব নিজের দুর্বলতাকে আড়াল করার চেষ্টা করছেন। তন্মধ্যেই ইশাদ বলল,

“তোমরা কথা বলো,আমি আসছি।”

ইশাদ উঠে দাড়াতে হাত আঁকড়ে ধরলেন শাহিনা শাইখা। চোখের ইশারায় যেতে মানা করছেন। ইশাদ না চাইতেও গুমোট পরিবেশের অংশীদারি হয়ে বসে রইল। দাদির দিকে তাকাতে দেখতে পায়,তিনি অন্যদিকে তাকিয়ে আছেন। নিমেষেই তাঁর চোখ জলপূর্ণ। ইশাদ দ্রুত সোফা ভেদ করে পেছনে তাকায়। দোতলার সিঁড়ির কাছটায় সোবহান শাইখ দাঁড়িয়ে আছেন। সে চোখ ফিরিয়ে আনার পূর্বেই মেহেরুনা শাইখা উচ্চস্বরে বললেন,

“টিকিট নাই। আমি অনেক ব্যস্ত। আসতে পারব না বউমা। তোমরা বিয়ের কার্যকলাপ শুরু করে দেও। শুধু শুধু আমার অপেক্ষায় থেকে শুভ কাজ আর পিছিয়ো না। আমি আসলেই কী আর না আসলেই কী!”

শেষ কথাটা গাঢ় অভিমানে মিশে যায়। দূর পর্যন্ত কী পৌঁছাবে? যাকে উদ্দেশ্যে করে বলল,সে কি শুনতে পেয়েছে?
শাহিনা শাইখা শ্বাশুড়িকে মানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। কিছুতেই কাজ হলো না। নিজের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে কল কেটে দিলেন। রুমটা আবারও নিবিড় নীরবতায় ডুবে গেল। তিহি আর মিহি একে অপরের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করল। দুজনের চোখে ভেসে আছে প্রশ্নের ফুলঝুড়ি! কী থেকে কী হলো কিছুই বুঝল না। রুবিনা বরাবরের মতো এবারও নীরবে প্রস্থান করলেন।

ইশাদ আরো কয়েক মিনিট মায়ের পাশে বসল। নীরব সঙ্গ দিয়ে উঠে পড়ে। একবার চোখ বুলায় পুরো বাড়িটিতে। বড্ড প্রাণহীন ঠেকে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো,প্রাণহীন বাড়িটির বসবাসরত মানুষগুলোও আনন্দহীন! বুকের ছোট্ট সুখ কামড়াটি শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। একটু সুখের হদিশ কি এই বাড়ির কারো অদৃষ্টে মিলবে? সে আনমনে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। বাবা নিজের জায়গাটি ত্যাগ করেছেন অনেক্ষণ! ইশাদ সেদিকে তাকিয়ে সিঁড়ি কাটতে কাটতে অতীতে ডুবে যায়

ইশাদ তখন ক্লাস নাইনে পড়ে। বাবার সাথে মধুর সম্পর্কগুলো বেদনার ধুলোতে প্রায় ঢেকে পড়েছে। বাবা বাড়ি আসলেন প্রায় নয় মাস পর। এক রাত কাটিয়ে ভোরে ব্যাগ গুছিয়ে বাসা থেকে বের হওয়ার উদ্যত নিতেই সামনে দাদি এসে দাড়ান। ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে কঠিন গলায় বললেন,

“আর কত তামাশা করবি? তোর কি ক্লান্ত লাগেনা? এমন পাষাণ পোলা আমি দুটো দেখিনি। বউয়ের কথা ছাড়লাম,পোলার দিকে চেয়েও কি এবার বন্ধ করা যায় না? ছেলেটা বড় হচ্ছে। ওর অবস্থাটা তো বুঝ।”
“আম্মা ব্যাগ দেও। আমার যেতে হবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

মেহেরুনা শাইখা রাগে ফুঁসিয়ে উঠলেন,

“কোথাও যাবি না তুই। তোর মাস্টারি এখানেও করা যাবে। না করা গেলে করবি না। অন্য কিছু করবি। জমি বেচে খাবি। তাও কোথাও যাবি না। চোখের সামনে বউমা ধুঁকে ধুঁকে মরবে এটা আমি সহ্য করব না। অনেক চুপ থেকেছি আর না। তোর ভাগ্য ভালো যে,এখনো মুখ ফুটেনি। নাহলে..”
“নাহলে কি? কী করবে? তোমাদের আর কী করা বাকি আছে? যা কিছু হচ্ছে এর দায় কী আমার? ভালো করে ভেবে দেখ তো এসবের জন্য আসলেই আমি দায়ী নাকি? আম্মা,জোর করে বিয়ে হয়,সংসার না!”

মায়ের কথার তীব্র প্রতিবাদ করে সোবহান শাইখ ব্যাগ রেখেই বাড়ির চৌকাঠ পার হলেন। গেইটের কাছাকাছি পৌঁছুতে,মেহেরুনা শাইখা কঠিন প্রতিজ্ঞা করে বসলেন,

“আর যদি এক পা বাইরে রাখস তাইলে এ বাড়ি ছেড়ে আমি চলে যাব।”

কথাটা যেন ভূমি কাঁপিয়ে তুলল। সোবহান শাইখ থেমে দাড়ালেন। পিছু ফিরে মায়ের দিকে তাকালেন। ভেতরে দরজার আড়ালে শাহিনা শাইখা ছেলেকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে আছেন। নিশ্বাস আটকে অন্তরের কম্পনটা বন্ধ করায় তোরজোর বাঁধালেন। তাঁর জীবনের শেষ ঢালটাও যে হারাতে বসেছেন তার পূর্বাভাস পাচ্ছেন। আভাসটা বাস্তবে রূপ নিল। সোবহান শাইখ নিজ পথে গমন করলেন। মায়ের কথার অবাধ্য হয়ে বাড়ি ত্যাগ করলেন। সেই সাথে শাহিনা শাইখাকে মায়ের ভালোবাসা থেকেও বঞ্চিত করলেন!

তার এক সপ্তাহ বাদেই মেহেরুনা শাইখাও নিজের প্রতিজ্ঞা রক্ষার্থে চিরতরে বাড়ি ছাড়লেন। মেয়ের শ্বশুড় বাড়ি গিয়ে উঠলেন। কয়েক বছর সেখানে থাকলেও পরবর্তীতে মেয়ের সঙ্গে জাপানে পাড়ি জমিয়ে ছিলেন। তারপর উনার পদধুলো এ বাড়িতে আর পড়েনি। বউ-শ্বাশুড়ির সুখ-দুঃখের আলাপ ফোনকথনের সীমাতে আটকে রইল।

ইশাদের অতীতের সুতো কাটল ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায়। তার মাথা থেকে ঝরঝর করে যেন বৃষ্টি পড়ছে। আজকাল কি বৃষ্টি আকাশ ছেড়ে মাথা থেকে ঝরা শুরু করেছে? তাও ইশাদের!

“আমাকে সবার সামনে অপমান করা? নিন,এবার সর্দিতে ভোগেন!”

কথাটা শেষ করেই তিহি আরেক বোতল ঠান্ডা পানি ইশাদের মাথায় ঢেলে দিল। ফ্রিজের নিম্ন তাপমাত্রার অত্যধিক ঠান্ডা পানির ছোঁয়ায় ইশাদের শরীর ঝাড়া দিয়ে উঠল। রীতিমতো কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে গিয়েছে। তার বিছানাও ভিজে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সরে আসে। তিহি বিছানার উপর দাঁড়িয়েই পানি ঢালছিল। ইশাদ সরে যাওয়ায় থেমে যায়। ইশাদ দু’হাতে মুখ থেকে পানি মুছে। চুল ঝাকিয়ে পানি ঝরায়। কানের ভেতরেও কি পানি ঢুকল? কানে আঙুল ঢুকিয়ে পরিষ্কার করতে করতে তিহির দিকে তাকাল। তার চোখের সাদা অংশ লাল রঙ ধরতেই তিহি বিছানা ছেড়ে নিচে নামে। দৌড়ে পালানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পূর্বেই দরজা লেগে গেল। তিহি তেড়ে এসে বলল,

“দরজা খুলুন আমি বাইরে যাব।”

ইশাদ জবাব দিল না। নিঃশব্দে দরজা খুলে দিয়ে স্নাগারে ঢুকে গেল। মিনিট পাঁচ পর বের হয়ে দেখে,তিহি তখনো তার রুমে। ইশাদের ভ্রূ কুঞ্চিত হয়ে আসে। এবারও কিছু বলল না। ভেজা বিছানায় শুয়ে পড়ল।

ইশাদের ঠান্ডা ব্যবহারে খটকা লাগে তিহির। সে ধীর পায়ে ইশাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। ইশাদ উল্টো ঘুরে শুয়ে আছে। তিহি সামান্য ঝুঁকে ইশাদের মুখ দেখতে নিলে,ইশাদ ধমকে উঠে,

“কী সমস্যা?”

তিহি কেঁপে উঠে। ভয় পেয়েছে খুব। বুকে থুতু ছিটিয়ে বলল,

“কিছু না।”
“তাহলে আসুন।”
“কোথায় আসব?”

ইশাদ বিরক্ত হয়। শোয়া থেকে উঠে বসে। কিন্তু রাগ দেখায় না। তিহির হাত ধরে বিছানায় বসায়। শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“কেন এমন করছেন?”
“কেমন?”
“এই যে ছেলেমানুষি। আপনার বয়সের সাথে এগুলো মানায় না। আমরা সতেরো-আঠারো বছরের কিশোর/কিশোরী নই যে ঝগড়াঝাঁটিতে মেতে থাকব। দুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক। আমরা ভালো বন্ধু হতে পারি। ভালো-মন্দে সঙ্গ দিতে পারি। একজনের সমস্যায় আরেকজন সমাধান হয়ে দাড়াতে পারি।”

তিহি চোখ মেলে ইশাদকে দেখল। কী বুঝল কে জানে,সে মাথা নাড়ল। তিহির এই আচড়ণে ইশাদ খুশি হল। উৎসাহ পেল। সে নতুন কিছু বলার জন্য প্রস্তুত হতে,তিহি প্রশ্ন করে বসল,

“আপনার কী কোনো সমস্যা আছে?”

ইশাদের মুখ ছোট হয়ে আসে। ভর করে মেঘের ঘনঘটা। সে মেঘ কাটিয়ে বলল,

“না,নেই। আপনার আছে?”

তিহি চট করে উত্তর দিল,

“আমারও তো নেই। তাহলে এখন কী করব?”
“রুমে যাবেন। রাত হয়েছে,ঘুমাবেন।”

তিহির মন খারাপ হয়ে গেল। বিছানা ছেড়ে উঠেতো ইশাদের দিকে তাকায়। তার যেতে একটুও ইচ্ছে করছে না। আরেকটু গল্প করলে কী হয়?

তিহি দরজার কাছে পৌঁছুলে ইশাদ বলল,

“আপনার ইনার উপর এত রাগ কিসের?”

তিহি থমকে গেল। ইশাদের দিকে ঘুরে বলল,

“কিসের রাগ? কোনো রাগ নেই তো।”

ইশাদ আরো একটা প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে গেল। ঘড়ির দিকে তাকায়। ঘন্টার কাঁটা বারোটা ছুঁই ছুঁই! মেয়েটা এখন কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেনি মানে পরেও করবে না। কথা কালও বলা যেতে পারে। ইশাদ সেই ভরসায় বলল,

“আমরা কাল কথা বলব।”

_______________________________

ইশাদ আর মিহির বিয়েটা পিছিয়ে যাওয়ার মূল কারণই ছিল মেহেরুনা শাইখা। তাঁর অপেক্ষায় দিন গোনা হচ্ছিল। তিনি যখন আসবেন না তাহলে আর দেরি করে কী লাভ? তাই গায়ে হলুদের তারিখ পড়ল ফাল্গুন মাসের চব্বিশ তারিখ। নীরব বাড়িটি হঠাৎ করেই যেন প্রাণের দেখা পেল। দূর-দূরান্ত থেকে আত্মীয়স্বজন ছুটে এলেন। বাচ্চা-কাচ্চার হাসি-কান্নায় মুখর চারপাশ। তার মধ্যে দুষ্টু ইনাতো বাড়ি মাথায় করে রেখেছে। সে আট-দশটা বাচ্চার অভিভাবক সেজেছে। যেন এ বাড়ির কর্ত্রীরানি। এই একজনকে ধমকাচ্ছেতো,আরেকজনকে মিষ্টি চুরি করে আনতে পাঠাচ্ছে। খেলতে খেলতে ফুল ছিড়ে নিজেই বৌ সেজে বসে আছে। আবার আরেকজনকে বর সাজাতেও বাদ রাখল না। শেষে না হেলাখেলায় বিয়ে করে বসে! সেই বিপত্তি কাটাতে ইশাদ ইনাকে সবার মাঝখান থেকে তুলে আনল। নিজের রুমের বিছানার মাঝ বরাবর বসিয়ে বলল,

“তিহি তোমার কী হয়?”

ইনা সুযোগে আচারের বোয়াম তুলে নিয়েছিল। সঙ্গে করে বয়েও এনেছে। মুখ খোলে আঙুল ঢুকিয়ে বলল,

“আপু।”

ইশাদ গলার স্বর খানিকটা নরম করে বলল,

“তাহলে আমি তোমার কী হই?”

ইনা আচার খেতে খেতে ব্যস্ত গলায় বলল,

“বাবাই।”

ইশাদ হতাশ হল। ইনাকে কী করে বুঝাবে তাই ভেবে পাচ্ছে না। ইনা বাবাই ডাকলে তার কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু তিহিও যদি বাবাই ডাকে কেমন শুনাবে? তার মনে হল,পৃথিবীর সবচেয়ে বিশ্রী সম্বোধন হবে তিহির কন্ঠে বাবাই ডাকটি! ইশাদ খানিক্ষণ ভেবে তারপর আবার বলল,

“তোমার তিহি আপুর আম্মাকে তুমি কী বলে ডাকো?”
“আম্মা।”
“কেন ডাকো বলো তো?”

ইনা আচার ফেলে ইশাদের দিকে তাকাল। বোধ হয় প্রশ্নের উত্তর সাজাচ্ছে। অনেকক্ষন পর বলল,

“তিহি আপু ডাকে তাই ডাকি।”

ইশাদ খুশি হল। মেয়েটি ছোট্ট হলেও,বেশ বুদ্ধীমতি। কথা বলে গুছিয়ে। সে উৎসাহ নিয়ে বলল,

“তোমার তিহি আপু তো আমাকে বাবাই বলে ডাকে না। তাহলে তুমি কেন ডাকো?”
“ডাকে না?”
“না।”
“তাহলে আমিও ডাকব না?”
“ডাকবে। কিন্তু অন্য কিছু বলে।”
“কী বলে?”
“ভাইয়া।”
“আপু তোমাকে ভাইয়া বলে ডাকে?”

এ পর্যায়ে ইশাদ চুপ হয়ে গেল। ইনা আচারের বোয়াম ফেলে দিল। বিছানা থেকে নেমে বলল,

“চলো।”
“কোথায়?”
“আপুর কাছে।”
“কেন?”
“আপু তোমাকে যা ডাকবে,আমিও তাই ডাকব।”

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২০)

সাঁঝের আবছা অন্ধকার ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে। তার মধ্যে নানা রঙের আলোকসজ্জা চিকমিক উঁকিঝুকি মারছে। দেয়ালে দেয়ালে তারার মতো ল্যাপ্টে আছে মরিচবাতি! ফুলের গন্ধে মন মাতানো অনুভূতি। তার সাথে রান্নার ঝাল ঝাল গন্ধে তিহির মনোযোগ ক্ষুন্ন হচ্ছে। সে সারাদিন কাটিয়ে দিল মাত্র দুটো কাজ করে। হলুদ বাটা ও আলপনা আঁকা! প্রথমটা নিজের দখলে নিতে অনেক কাঠখর পুড়াতে হয়েছে। শাহিনা শাইখা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না তিহিকে দিয়ে বাটাতে। অক্লান্ত কথার কসরৎ পেরিয়ে সফল হয়েছে। তারপর লেগেছে আলপনা আঁকায়। কারো অনুমতি নেয়নি। নিজ উদ্যোগেই ছাদ থেকে শুরু করে একদম নিচ সিঁড়ি পর্যন্ত আলপনা এঁকেছে সে। সব শেষে যখন রুমে পৌঁছুলো মন ভার হয়ে আসে। তার পরণের জামাটা ভিজে গায়ের সাথে ল্যাপ্টে আছে। কপালে পড়ে থাকা ছোট ছোট চুল যেন ঘামে গড়াগড়ি খেয়ে ক্লান্ত। নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় গায়ে হলুদে যোগ দিবে কিভাবে? কাজের মেয়ের উপাধি পেতে দুই সেকেন্ডও দেরি হবে না। তিহি এখন কী করবে? তিহির ক্লান্ত নজর পড়ে বিছানায়। বাসন্তি রঙের শাড়ির উপর ব্লাউজ আর পেটিকোট রাখা আছে। নিশ্চয় আম্মা রেখে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি গেলেন কোথায়? তিহি আশেপাশে তাকায়। রুম ছেড়ে বাইরেও তাকালো, সেখানেও নেই। তাহলে কি নিচে? তিহি খোঁজ বন্ধ করে ব্লাউজ তুলে নিল। কী ভেবে নিজের শরীরের গন্ধ শুঁকল। নিমিষেই নাক কুঁচকিয়ে বিড়বিড় করে বলল,গোসলটা করতেই হবে!

দীর্ঘ গোসল সেরে চটপট বাইরে বের হয়ে আসে তিহি। সময় দেখে নেয়। সাতটা বেজে পঁয়তাল্লিশ। মিহির সাজ দেখবে না সে? উফ! কত দেরি হয়ে গেল। বোনের সাজে বোন উপস্থিত নেই,ব্যাপারটা বড্ড পানসে । তিহি পুনরায় ঘড়ির দিকে তাকিয়ে শাড়ি তুলে নেয়। কোমরে কোণ গুঁজতে গিয়ে মনে পড়ে দরজার কথা। দ্রুত চোখ তুলে। মন শান্ত হয়! দরজাটা ভেড়ানোই আছে। তিহি আপনমনে শাড়ির আঁচল নিচে ফেলে কুঁচি তুলছে৷ হাতের আঙুলে কয়েকটা কুঁচি বন্দী হতে দরজা খুলে গেল। তিহি চমকে তাকাল। ভয়টা ধুরুম ধুরুম শব্দের বাজনা তুলতেই বোধ হয় ইশাদের চোখে চোখ পড়ল। এমন আপত্তিকর পরিস্থিতির শিকার বার বার এ দুজনেই হয় কেন?

সবসময়ের মতো এবার কোনো ভুলে পা ফেলল না ইশাদ। সে অন্যদিকে ঘুরে যায়। প্রচন্ড অস্বস্থিতে ভুগছে। মন অশান্ত হয়ে পড়েছে। মনে মনে চলছে হাজারও ধমকানি! ইনা নাহয় ছোট,সেও কি ছোট? সে বললেই সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে হবে? ভদ্রতার খাতিরে দরজায় ছোট্ট নক দেওয়ার প্রয়োজন কি ছিল না? তার জীবনের সব ভদ্রতা এই মেয়ের সামনে আসলেই পানিতে ডুবে মরে। ইশাদ বিড়বিড়িয়ে উচ্চারণ করল,মর মর শুধু সম্মান নয়,শরীরটাও নিয়ে মর!

ইনা ইশাদের হাত ছেড়ে দৌড়ে তিহির সামনে এসে দাড়ায়। প্রবল উৎসাহ নিয়ে মিষ্টি কন্ঠে সুধাল,

“আপু,তুমি বাবাইকে কী বলে ডাকো?”

তিহি মাটিতে পড়ে থাকা শাড়ির অংশ কুঁড়িয়ে বুকে জড়ো করছিল। হঠাৎ ইনার কন্ঠ পেয়ে সম্বিৎ ত্যাগ করে। রাগে পুরো শরীরে জ্বলন ধরছে তার। ইনার ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটি তার মন জয় করতে পারল না। তিহি তুলে নেওয়া শাড়ি নিচে ফেলে দেয়। প্রচন্ড বলপ্রয়োগে ইনার গালে চড় বসিয়ে দিল। ইনা দু কদম পেছনে ছিটকে এসে পড়ে। ইশাদ ঝড়ের গতিতে পেছন ঘুরে। ইনাকে সত্বর তুলে নিয়ে তিহির দিকে তাকায়। তার চোখে তৈরী হয় রক্তনদী। অজান্তেই উঁচু স্বর বেরিয়ে আসে,

“ইনাকে মারলেন কেন?”

অন্য সময় হলে হয়তো তিহি ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে পড়ত। কিন্তু এখন তার রাগ দ্বিগুন বেড়ে গেল। অবস্থাটা এমন পর্যায় যে,এই মেয়ের জন্য সে বকা খেয়েছে। এর শোধ সে তুলবেই। এই মুহূর্তে! তিহি ক্ষিপ্র গতিতে ইনার কাছে চলে আসে। সে ইশাদের স্নেহমাখা হাতের মধ্যে বন্দী। মাথাটা যেন জোর করে পেটের সাথে চেপে ধরে আছে। তিহি সামনে চলে আসতেই ইনা ইশাদের স্নেহ থেকে বন্দী হতে অস্থির হয়ে পড়ল। কান্নারত অবস্থায় বলছে,

“বাবাই ছাড়ো,আপুর কাছে যাব। আপু!”

ইনা তিহির দিকে হাত বাড়িয়ে দিতে তিহি হাতের মধ্যেই ছোট ছোট থাপ্পড় বসাল। ইশাদ হতাশ দৃষ্টি রাখছে দুজনের উপর। কাকে রেখে,কাকে সামলাবে? একজন কিছুতেই কাছে টেনে নিচ্ছে না,অন্যজন কিছুতেই দূরে যেতে চাচ্ছে না। এ যেন তীব্র অবজ্ঞা আর ভালোবাসার সম্পর্ক! দুটোকে দুদিকে ঠেলে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব হবে কি? ইশাদ উপায়ন্তর না পেয়ে ইনাকে নিয়ে অন্য দিকে ঘুরে গেল। সেই সময়ে আগমন ঘটে রেখা ভূঁইয়ার। দূর থেকেই সবটা অনুমান করে ছুটে আসেন৷ ইনাকে সানলানোর আগে তিহিকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ দূরে টান খেয়ে পড়ে থাকা শাড়িটি তুলে নামমাত্র তিহির শরীর ঢেকে দিলেন। বিরক্ত প্রকাশ করে বললেন,

“তোদের সাপনেউলে সম্পর্কে আমি অতিষ্ট! দুটো মিনিটের জন্য চোখের আড়াল হতেই হুলস্থুল কান্ড করে বসিস। তিহি?”

রেখা ভূঁইয়ার কথাগুলো তিহির কান পর্যন্ত পৌঁছালেও স্নায়ুতে নাড়া দিতে পারল না৷ সে গভীর ক্ষোভ নিয়ে ঘন ঘন নিশ্বাস ছাড়ছে। যেন শিকারির হাত থেকে শিকার পালিয়ে গিয়েছে!

রেখা ভূঁইয়া তিহির বাহু চেপে ঝাকি দিলেন। তিহি কেঁপে উঠে। পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় আম্মার দিকে।

“আন্টি,আমি ইনাকে নিয়ে যাচ্ছি।”

ইশাদ আর পেছন ঘুরল না। সেই অবস্থায় ইনাকে পাঁজাকোলায় তুলে নিয়ে তিহিদের রুম থেকে বেরিয়ে আসে।

_________________________________

রুম থেকে বেরিয়ে করিডরের সামনে দাঁড়ালেন সোবহান শাইখ। চোখ মেলে চারপাশের সাজসজ্জা আর সকলের ব্যস্ততার মাঝে সুখভোগ করছেন। তারমধ্যেই কল্পনায় এসে উঁকি দিয়ে গেল প্রায় ত্রিশ বছরের আলোকিত একটি দিন। সেদিনও বাড়ির সকলের মধ্যে ব্যস্ততা,আনন্দ, প্রফুল্ল,প্রচন্ড রকমের উত্তেজনা কাজ করছিল। নতুন সদস্যকে বরণ করার উত্তেজনা। শুধুমাত্র একটি মানুষ বাদে। সে হল স্বয়ং সোবহান শাইখ। তাঁর মনে তখন প্রচন্ড পরিমানের রাগ,ক্ষোভ,আক্ষেপ আর এক আকাশ সমান বিষাদ জমেছিল। দুটি ভিন্ন অনুভূতি এক হতে পারেনি। এখনো পারছে না! সেই ব্যর্থতার অভিশাপের গ্লানি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে পরিবারের প্রতিটি প্রাণ। এবার কি তবে সেই অভিশাপ কাটতে চলেছে? সোবহান শাইখ মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম জপলেন। কিছু একটা ভেবে পা চালালেন সিঁড়ির দিকে।

মিহিদের রুমের সামনে এসে দরজায় মৃদু আঘাত করলেন সোবহান শাইখ। সহজ গলায় ডাকলেন,

“মিহি?”

মিহি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। সে তখন বিউটিশিয়ানদের আড়ালে বন্দী৷ তাকে ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। পাশেই রুবিনা বসে ছিলেন। বেশ আগ্রহ নিয়ে মেয়ের সাজ দেখছিলেন। হঠাৎই পরিচিত কন্ঠ পেয়ে চমকে গেলেন। চট করে সরে গেলেন অন্যত্র। লুকিয়ে পড়লেন গোসলখানার দরজার আড়ালে। সোবহান শাইখ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুনরায় কন্ঠ ছাড়লেন,

“ভেতরে আসব?”

এতক্ষণে মিহি মুক্তি পেয়েছে। তার সাজ সমাপ্ত! আমোদিত গলায় বলল,

“আসুন।”

সোবহান শাইখ ধীর পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। মিহি তখনো আয়নার সামনেই বসে আছে। বিস্মিত চোখে নিজেকে দেখছে। সোবহান শাইখের উপস্থিতি টের পেয়ে সাবধানে পেছন ঘুরল। টান টান হয়ে বসে ঠোঁট অল্প নেড়ে বলল,

“বসুন না।”

সোবহান শাইখ আন্তরিকতার হাসিসহিত বসলেন। মিহি আলগোছে টুলটা সামনে টেনে আনে। ভাবসাব এমন,একটু নড়লেই তার সব সাজ ঘেটে যাবে। আগের মতো বসে সোবহান শাইখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“আমাকে কেমন লাগছে?”

সোবহান শাইখ ক্ষণকাল মনোযোগ ভরে মিহিকে দেখে নিলেন। তারপর সহাস্যে বললেন,

“খুব সুন্দর।”

মিহি উৎসাহ নিয়ে বলল,

“প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর?”

সোবহান শাইখের হাসি মিলিয়ে গেল। ভ্রূ কিঞ্চিৎ সংকুচিত হয়ে এল। বললেন,

“প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর? সেটা আবার কেমন? আমি তো এমন সুন্দরের দেখা পাইনি।”

মিহি চট করে বলল,

“আন্টি পেয়েছেন।”
“কোন আন্টি?”
“আপনার বউ,ইশাদ ভাইয়ার আম্মু,আমার আন্টি।”

শাহিনা শাইখার কথা উঠতে তিনি চুপ হয়ে গেলেন। আগ্রহটা নিভিয়ে দিয়ে ভিন্ন প্রসঙ্গে যেতে চাইলেন। কিন্তু মিহির তেমন ইচ্ছে নেই। সে প্রবল উৎসাহ নিয়ে বলল,

“আন্টির যেদিন বিয়ে হয়েছিল? সেদিন এমন প্রেমে পড়ার মতো সুন্দরের দেখা পেয়েছিলেন। উনার প্রথম প্রেমে পড়ার অধ্যায়টি কিন্তু সেখান থেকেই শুরু। সব থেকে মজার ব্যাপার কী জানেন?”

মিহি প্রশ্নটা করে বিরতি নিল। মুঁচকি হাসল। সে তার সাবধানি ভুলে গিয়েছে। বিছিয়ে রাখা হাত ঠোঁটে চেপে অনেক্ষণ হাসল৷ তারপর বলল,

“আন্টি এখনো শুধু প্রেমেই পড়ে যাচ্ছেন কিন্তু প্রেম করতে পারছেন না। আচ্ছা বলুন তো এক মানুষের উপরে কি বার বার প্রেমে পড়ে যায়?”

মিহি আবারও বিরতি নিল। কিন্তু তার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না সোবহান শাইখের। দিচ্ছেনও না। তা নিয়ে মিহিরও কোনো মাথাব্যথা বোধ হলো না। সে নিজের মতো কথার পর কথা যোগ করে যাচ্ছে।

“আবার বলে প্রেম করা হয়ে উঠছে না। তাহলে প্রেমে পড়ার কী দরকার? আন্টি আসলেই বোকা।”

মিহির শেষ কথাটা কোথাও যেন ছুঁয়ে দিল সোবহান শাইখের। অবহেলায় সরিয়ে নেওয়া আগ্রহটা ঝেঁকে বসল। ব্যাপারটা কি মিহির চোখেও পড়ল? হয়তো! নাহলে কথপোকথন এখানেই থেমে যেতে পারত। কিন্তু থামেনি। মিহি আবারও যোগ করল,

“আংকেল আপনার জানতে ইচ্ছে করছে সেই প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর মুখটি কার?”

সোবহান শাইখ দ্বিধায় পড়ে গেলেন। হ্যাঁ বলবেন নাকি না বলবেন বুঝতে পারছেন না। এদিকে মিহিও যেন এবার উত্তর না পেয়ে পরের কথাটি বলবে না। সে উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সোবহান শাইখ বেশ অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। জড়ানো গলায় অস্ফুটস্বরে কোনো রকমে বললেন,

“কার?”
“আপনার!”

মিহির দ্রুত উত্তরে লজ্জার মৃদু ছাপ পড়ল গালে। মিহির সামনে থেকে উঠে পড়তে মিহি বলল,

“না বলেই চলে যাচ্ছেন?”
“কী?”
“আমাকেও আপনার মতো প্রেমে পড়ার মতো সুন্দর লাগছে নাকি?”

সোবহান শাইখ জবাবে শব্দ প্রয়োগ করলেন না। মাথাটা সামান্য নাড়িয়ে ইতিবাচক মতামত প্রকাশ করলেন। ব্যস্ত পায়ে সেখান থেকে প্রস্থান করলেন। কয়েক কদম এগিয়ে যেতেই বসার রুমে নজর পড়ে।

শাহিনা শাইখা কাঁখে করে ভারি ফুলদানি নিয়ে ভেতরে ঢুকছেন। চোখের নিচে ক্লান্ত ছায়ায় ভারি মায়া দেখাচ্ছে। ঘর্মাক্ত কপালটি আঁচলের ঘোমটায় ঢাকা পড়েছে। তার শরীরের সাথে ফুলদানির ভারটা খাপ খাচ্ছে না। পায়ের পাতা টাল সামলাতে বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। এতদূর থেকেও যেন সোবহান শাইখ নিজের স্ত্রীর ক্লান্তভরা ভারি নিশ্বাসের শব্দ পাচ্ছেন। সহসা মিহির কথাটি কানে বাজে। তবে কি সেও এই বয়সে এসে প্রেমে পড়ার মতো সুন্দরের দেখা পেলেন?

সোবহান শাইখের উদাসী ভাবনার পাশ দিয়ে টনু যাচ্ছিল। অজ্ঞাতসারে তার হাতটি চেপে ধরেন তিনি। টনু থেমে যায়। জিজ্ঞেস করে,

“কিছু কইবেন বড়সাব?”

সোবহান শাইখের সরল দৃষ্টি। সহসা বলল,

“ফুলদানিটা নিয়ে আয়।”
“কোন ফুলদানি?”

সোবহান শাইখ আঙুল উচিয়ে ধরলেন শাহিনা শাইখার দিকে। টনু বুঝতে পেরে সেদিকে দু কদম ফেলতে পেছন থেকে গম্ভীর গলা,

“টনু,দাড়া।”

টনু থমকে গেল। পেছন ঘুরতে ইশাদকে দেখতে পায়। সোবহান শাইখের চোখও ইশাদের দিকেই। ইশাদ বাবার দিকে দৃষ্টি রেখে টনুর উদ্দেশ্যে বলল,

“তোর সাথে কাজ আছে। আমার রুমে যা। আমি আসছি।”

টনু চলে যেতে ইশাদ মায়ের কাছে ছুটে যায়। ফুলদানিটা নিজের কাছে নিয়ে বাবার কাছে ছুটে আসে। চাপা স্বরে বলল,

“তুমি শুধু স্বামী নয়,একজন পুরুষ হিসেবেও সর্বনিম্নে অবস্থান করছো। একবার কি ভেবে দেখেছো বিনিময়ে কী পেলে? আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি তোমার পথ চলার থলিটি আজও শূন্যতায় ভরপুর।

_______________________________
তিহি নিজেকে সাজিয়ে গুছিয়ে তাড়াহুড়োয় সিঁড়িতে পা ফেলে। দোতলায় আসতেই শাহিনা শাইখার সাথে দেখা। তিনি বললেন,

” কোথায় ছিলে,তিহি? গায়ে হলুদতো শুরু হয়েছে অনেক্ষণ। মিহি বার বার তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল। অভিমানে গালদুটো ফুলে আছে। তোমার হাত থেকে হলুদ পরবে বলে বসে আছে।”

মুহূর্তেই তিহির উজ্জ্বল মুখটিতে মেঘ জমল। একে তো মিহির সাজের সময় উপস্থিত থাকতে পারে নি তার উপর সবার হলুদ দেওয়া শেষ। তার উল্লসিত আনন্দগুলো মাটিতে মিশে গেল। মনমরা হয়ে শাড়ি গুটিয়ে দৌড় লাগায়। শেষে না সে হলুদ লাগানোর পূর্বেই হলুদ সন্ধ্যা শেষ হয়ে যায়!

ভিড় ঠেলে মিহির সামনে উপস্থিত হতে কৃতকার্য হলো। আঙুলে এক দলা হলুদ নিয়ে মিহির সামনে এগিয়ে আসতে তিহির হাত থমকে যায়। তার পাশাপাশি অবস্থান করছে ইশাদ। তাঁর হাতেও হলুদ! তিহি ঘাড় বাকিয়ে ইশাদের দিকে তাকিয়ে আছে৷ ইশাদের দৃষ্টিও তিহির দিকেই। যেন কেউ কাউকে প্রত্যাশা করেনি। সেই অবস্থায় পেছন থেকে একজন বলল,

“ইশাদ,হলুদটা লাগা। গায়ে হলুদে হবু বর,বউকে হলুদ লাগাচ্ছে ব্যাপারটা কিন্তু বেশ রোমান্টিক!”

হঠাৎই হাসির কলরব তৈরী হয়ে গেল। চারপাশে চাপা গুঞ্জরণের মধ্য থেকেই চারপাঁচটি কন্ঠস্বর এক সাথে ভেসে আসে। তাড়া দিচ্ছে ইশাদকে। ইশাদ তিহির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে মিহির গালে হলুদ ছুঁয়িয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে ইশাদের হৃদয়ে ধারালো শূলের আঘাত পড়ল। তিহির চোখ জলপূর্ণ! সে এক মুহূর্তও সেখানে দাড়াল না। হাতের হলুদ ফেলে পালিয়ে এল।

________________________________

গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হতে প্রায় মাঝরাত হয়ে গেল। ইশাদ সবার কাছ থেকে মুক্তি পেয়ে সোজা রুমে চলে আসে। বিছানায় বসে। শান্তির খোঁজ চলছে তার ছোট্ট রুমটিতে। সে বিছানা ছেড়ে বারান্দায় যায়। মিনিট খানেকও দাড়াতে পারে না। রুমে ফিরে আসে। ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়ে। মাথায় পানি দেয়। মাথার পানি মুখে বেয়ে পড়তে চমকে যায়। ঢালছে ঠান্ডা পানি,কিন্তু বেয়ে পড়ছে উষ্ণ গরম পানি। কী করে সম্ভব? ইশাদ তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছে বিছানায় শুয়ে পড়ে। ঘুম আসছে না৷ চোখের পাতা এক হলেই তিহির চোখের বর্ষার থৈ থৈ পুকুরটি ভেসে উঠছে। সে এপাশ ওপাশ করে কিছুক্ষণ। বুকে চলা অদম্য ঝড়টাকে শান্ত করা কি এত সহজ? সে পারছে না। ভেঙে যাচ্ছে সব৷ এমন বিধ্বস্ত হৃদয় নিয়ে বাকি জীবনটা কাটাতে পারবে তো? জীবনতো পরে এই মুহূর্তের,এই সময়টা পার করতে পারবে তো? ইশাদ লম্বা নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে,পারে না। অশান্ত মনে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

ছাদে পৌঁছাতেই ইশাদের বুকটা ছ্যাত করে উঠে। হৃদপিন্ডটি পাজর ভেঙে বেরিয়ে পড়তে চাচ্ছে যেন। সে কদমে কদমে যত সামনে এগুচ্ছে তত হৃদকম্পন বেড়ে যাচ্ছে। চাঁদের জোসনার আদুরে আলোতে তিহির পরণের ধূসর রঙের টি-শার্টটি স্পষ্ট হচ্ছে। ইশাদ তিহির কাছে এসে দাঁড়ায়। তার হাত কাঁপছে। নিজের টি-শার্টটিতে নিজের হাত রাখতেও এত দ্বিধা? কেন? শরীর বদলেছে বলে? সে কম্পিত কন্ঠে বলল,

“তিহি?”

তিহি ঝাপিয়ে পড়ে ইশাদের বুকে। একটি বারের জন্য চেয়ে দেখার প্রয়োজনও মনে করল না! সে ডান হাতে ইশাদের বুকের পাশটায় খামচে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। চাপা কান্নায় চোখ ছেড়ে বেরিয়ে আসে নোনা পানি। পাঞ্জাবির নিখুঁতভাবে বিন্যস্ত সুতোর ফাঁক গলে ইশাদের বুক ছুঁয়ে দিল। ইশাদ শিউরে উঠে। তার হাত দুটো তখনো সরল রেখায় নিম্নমুখী পড়ে আছে। হাত দুটো মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে আসে। উষ্ণ অনুভূতির খেলা চলে শিরায় শিরায়! তিহি চাপা স্বরেই বলল,

“আপনি মিহিকে হলুদ লাগালেন কেন? বলুন কেন লাগিয়েছেন?”
“লাগাব না?”
“না।”
“কেন?”
“আমার কষ্ট হয়। ব্যথা হয় বুকের খাঁচায়। মনে হয়,খাঁচায় বন্দী করে রাখা বহুদিনের পাখিটি পালিয়ে গিয়েছে। স্ব ইচ্ছে বন্দী হয়েছে অন্য কারো খাঁচায়।”

ইশাদ প্রতিত্তোরে কিছু বলতে পারে না। বলার মতো কিছু খুঁজে পেলে তো,বলবে। তিহি আবার বলল,

“আপনি কাউকে হলুদ লাগাবেন না। কখনোও না।”
“কাউকেই না?”

তিহি মাথা তুলে। ভেজা চোখে তাকায় ইশাদের দিকে। সেই চোখে চোখ রাখতেই ইশাদ পুড়ে গেল। অনুভব করছে,সে নিস্ব হয়ে যাচ্ছে। তার অমূল্য সম্পদটি এবার হাত ছাড়া হয়েই গেল বুঝি!

তিহি ঘোরলাগা কন্ঠে বলল,

“আমাকে লাগাবেন।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here