তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,২১,২২

0
709

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,২১,২২
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (২১)

বাংলা সনের দ্বাদশী এবং সমাপনী মাস চৈত্রের সূচনা ঘটতে এখনো পাঁচ দিন বাকি। কিন্তু চৈত্রের চোখ রাঙা উত্তপ্ত, খরা,শুষ্ক রূপ সবই যেন উপচে পড়ছে সোবহান শাইখের অন্তরে! মাথার উপরে তিন পাখার বিশাল ফ্যানের কৃত্রিম বাতাস তৈরী করছে অক্লান্তিতে। ছুঁতে কি পারছে না পঞ্চাশ পার হওয়া সোবহান শাইখের পিতলরাঙা শরীরটিকে? তিনি অনবরত ঘেমে যাচ্ছেন। অনল দাবদাহে পুরছে সর্বাঙ্গ! জোর পূর্বক বন্ধ করে রাখা চোখদুটি ভিজে চুপচুপে। পানি গড়িয়ে পড়ার অনুমতি চাচ্ছে সেকেন্ডে সেকেন্ডে। ঘরের অন্ধকার দূর করতে তিনি বিছানার পাশের বাতিটি জ্বালিয়ে নিলেন। উঠে বসলেন। বার কয়েক দীর্ঘায়িত দম টেনে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালেন। চারটা বাজতে পনেরো মিনিট বাকি। কিছুক্ষণের মাঝেই ফযরের আযান পড়বে। মাথাটা ধরে আছে। কপালের সুক্ষ শিরা যেন দুপাশ থেকে কেউ টানছে! বহুদিন পর এমন বিনিদ্রায় রাত কাটালেন তিনি। তাহলে কি দুশ্চিন্তাগুলো ঝেপে বসেছে মস্তিষ্কের কোণায় কোণায়? কিন্তু কিসের এত দুশ্চিন্তা? তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে কি কিছু চলছে? তার চোখে তো পড়েনি!

সোবহান শাইখ বিছানা থেকে নামলেন। দরজা ঠেলে বারান্দায় প্রবেশ করছেন। গাছের কচি পাতার দুলুনি খেলার শীতল বাতাস মুখে পড়তেই মায়ের মুখটি ভেসে উঠে কল্পনারাজ্যে। মনে পড়ে বহু পুরনো একটি বাণী,’মাটির সেই পাত্রটি সার্থক ও পরিতুষ্ট,যে সুখ-দুঃখের সাদাকালো পানি একসাথে মিশিয়ে গলা পর্যন্ত ভরে পরিপূর্ণ থাকে। অতি সুখে ফেটে যায় না আবার অতি কষ্টে ফুটোও হয়ে যায় না!’

সোবহান শাইখ চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কাঁপা হাতে চেপে ধরলেন বারান্দার লোহার গ্রিল। মায়ের ভাষ্যমতে কি তার মাটির পাত্রটি ফুটো হয়ে গিয়েছে? পানি ফুরিয়ে শূন্য হয়ে অবহেলায় পড়ে আছে?

তাঁর ভাবনার মাঝে মসজিদ থেকে ভেসে আসে সুমধুর আযানধ্বনি! সোবহান শাইখ হালকা নড়লেন,চোখ খুললেন না। আযান শেষ হতে বারান্দা ছেড়ে রুমে আসলেন। ওযু করে জায়নামাজ বিছিয়ে নিলেন। নামাজের প্রস্তুতি নিতেই তার অন্তর কেঁদে উঠল। সে নিয়ত বাঁধা ছেড়ে হলদে আলোর বাতিটির কাছে পড়ে থাকা ফোনটি তুলে নিলেন। দ্রুত কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকে একটি পরিচিত নাম্বারে কল দিয়ে বসলেন। ওপাশের রিং বাজার শব্দে তিনি নিশ্বাস বন্ধ করে আছেন।

মেহেরুনা শাইখা সকালের নাস্তার জন্য অপেক্ষা করছিলেন নিজ কক্ষে। বয়স তো আর কম হয়নি? দু কদমের জায়গায় তিন কদম ফেললেই শরীর কেঁপে উঠে! বিছানায় শোয়া,বসার মধ্যে আল্লাহ আল্লাহ জপতে জপতে মৃত্যুর অপেক্ষায় শরীর ছেড়ে দিছেন। কার জন্যই বাঁচবেন? মেহেরুনা শাইখার মেয়ে সুমি রহমান খাবার নিয়ে মায়ের রুমে আসছিলেন,তখনি ফোনের রিং শুনতে পান। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

“আম্মা,তোমার ফোন বাজে।”

মেহেরুনা শাইখা শুনলেন কি শুনলেন না বোঝা গেল না। তিনি চোখ বন্ধ করে ঝিমুচ্ছেন। সুমি রহমান হাতের খাবার তাড়াহুড়োয় বিছানায় রাখলেন। মায়ের মোবাইল খুঁজছেন। বালিশের পাশেই থাকার কথা। সেখানে নেই! বেশ কিছুক্ষণ পর মায়ের পেছন থেকে পেলেন। ফোন হাতে নিতেই উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলেন,

“আম্মা,মিয়া ভাই কল দিছে আপনারে!”

মেহেরুনা শাইখার চোখ খুলে গেল। সোজা হয়ে বসে বললেন,

“বয়স বাড়ে আমার,আর বুদ্ধি লোপ পাইতাছে তোর! তোর মিয়া ভাই এই জীবনতো দূর,পরজীবনে যদি মোবাইল ব্যবহারের সুযোগ থাকতো তাও কল দিতো না। জেগে জেগে খোয়াব দেখস?”

সুমি রহমান মায়ের কথার পাত্তা দিলেন না। চট করে কলটা রিসিভ করলেন। লাইড স্পিকার অন হতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসলো,

“আসসালামু আলাইকুম।”

পুরো এক যুগ পার করে ছেলের কন্ঠ পেয়ে মেহেরুনা শাইখার হৃদয় জুরিয়ে গেল। যেন জ্বলন্ত আগুনের উপর ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে কেউ। ধোঁয়া উঠছে কি? মেহেরুনা বেগম অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মোবাইলটির দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ধ্যান ভাঙালেন সুমি রহমান। কাঁধে হালকা ঝাকি দিয়ে ইশারায় কথা বলতে বলছেন। তিনি মেয়ের দিকে কিছু্ক্ষণ চেয়ে থেকে গম্ভীর গলায় বললেন,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

বয়সের ভারে কম্পিত কন্ঠটি যেন বিরতিহীন ঝাকিয়ে আরো কাঁপিয়ে তুলেছে কেউ তেমন শোনালো। পুরো রুম নীরব,নিস্তব্ধতায় ছেয়ে আছে। না ওপাশ থেকে কোনো কথা আসছে, না এপাশ থেকে। সকলেই যেন নিশ্বাস নেওয়া ভুলে গেছেন কিংবা নিশ্বাস ছাড়লেই মহা পাপ করে ফেলবেন! পিনপতন নীরবতা ভাঙলেন সোবহান শাইখ। বহুক্ষণ পর ছোট্ট করে বললেন,

“কেমন আছো,আম্মা?”

সঙ্গে সঙ্গে মেহেরুনা শাইখার চোখ ভরে গেল অভিমানের জলে। অভিমানের ঝড়টা সামলিয়ে ভালো আছি কী ভালো নেই কিছুই বলতে পারছেন না। সোবহান শাইখও বোধ হয় মায়ের অবস্থা বুঝতে পারলেন। দৃঢ় গলায় বললেন,

“বিয়ের তারিখ পাঁচ দিন পিছিয়ে দিচ্ছি। চলে আসো।”

এ পর্যায়ে মেহেরুনা শাইখা গলা কাঁপিয়ে উঁচু গলায় বললেন,

“তুই বললেই যেতে হবে? যামু না। তুই থাক তোর জিদ নিয়া।”

কথাটা শেষ করেই বড় দম ছাড়লেন মেহেরুনা শাইখা! সোবহান শাইখ বিপরীতে কোনো কথা বললেন না। আসতে করে কলটা কেটে দিলেন। তাঁর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ঝিলমিলিয়ে উঠছে।

“আম্মা,আসতে রাজি হয়েছেন?”

হঠাৎ শাহিনা শাইখার গলা পেয়ে মৃদু চমকালেন সোবহান শাইখ। পাশ ফিরলেন। শাহিনা শাইখার চোখে,মুখে চাপা উত্তেজনা আর অন্তহীন কৌতুহল! স্বামীর মুখ থেকে জবাব পাওয়ার বদলে বিরক্তির দৃষ্টি পেলেন। আশাহত হয়ে ওযু করতে চলে গেলেন।

নামাজ শেষে স্বামীর দিকে তাকালেন। ঘুমাচ্ছেন হয় তো। জায়নামাজ রেখে সাবধানে বিছানার এক কোণে শুয়ে পড়লেন। দরজার দিকে মুখ করে শুয়েছেন। সোবহান শাইখ চোখ মেলে স্ত্রীর দিকে তাকালেন। দুজনের মধ্যে দু হাত দূরত্ব! তিনি চাইলেই এই দুরত্ব কমিয়ে নিতে পারেন। একটু সরে আসলেই যথেষ্ট। কিন্তু এতো শরীরের! মনের বেহিসাবি দূরত্বটা কি কখনো কমিয়ে আনতে পারবেন? সময়,সুযোগ,ইচ্ছেরা কি তার হয়ে লড়বে?

তিনি গলা খাঁকারি দিয়ে সহসা বললেন,

“পড়ে গিয়ে মাজা ভাঙার ইচ্ছে জাগছে? নাকি ছেলেকে আমার বিপরীতে লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা চলছে?”

শেষ লাইনটা বলে নিজেই আহত হলেন। এটা তো সে বলতে চায়নি!

শাহিনা শাইখা উঠে বসলেন। এক পলক স্বামীর দিকে তাকিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিলে তিনি বললেন,

“আজ বিয়ে হবে না। ফাল্গুন মাসের ৩১ তারিখে হবে। সবাইকে নতুন তারিখ বলে দিও।”

________________________________
“মা,আমি শাড়ি পরে হাঁটতে পারি না। পা জড়িয়ে আসে।”

মেয়ের বেদনপূর্ণ বক্তব্যে কপট রাগ দেখালেন রুবিনা। চুলে চিরনির গভীর কাঁটা বসিয়ে বললেন,

“পড়তে পড়তে অভ্যাস হয়ে যাবে।”
“আহ! লাগছে তো। আজ তো আমার বিয়ে না। তাহলে এত সাজগোজ কেন করছি,মা?”

রুবিনা চিরনি চালানো বন্ধ করলেন। নিজের মেয়ের প্রশ্নে প্রায়ই বিচলিত হয়ে পড়েন। কপালে ফুটে উঠে চিন্তার ছাপ। বয়সের সাথে আচার-ব্যবহার কি খুব বেশি অসামঞ্জস্য? কতই বা বয়স? বিয়ের পর মানিয়ে নিতে পারবে তো? কাল ভিড়ের মধ্য থেকেও তার কানে কিছু কানাঘুঁষা এসেছে। আলোচনার মূল বিষয় ছিল মিহির বয়স। শুধু ইশাদের জন্য নয়,বিয়ের জন্যও অপরিণত! তিনি কন্ঠে উদ্বেগ রেখেই বললেন,

“শাড়ি পরলে তোকে খুব সুন্দর লাগে। বিশ বছরের পূর্ণ তরুনী মনে হয়।”
“কিন্তু মা, আমার বয়স তো ষোল।”

মেয়ের অহেতুক তর্কে প্রচন্ড বিরক্ত হচ্ছেন রুবিনা। তার কৌতুহলের ঝুড়ি যেন সবসময় ঢাকনা খোলা থাকে। তিনি মেয়ের ন্যায়শাস্ত্র উপেক্ষা করে মিহিকে দাড় করালেন। কোমরের দিকে শাড়ির অংশ টেনে অনেকখানি নিচে নামিয়ে দিলেন। কাঁধে ছড়িয়ে ফেলা আঁচলটা আরেকটা ভাঁজ তুলে ছোট করে দিলেন। জানালা দিয়ে ঝিরি বাতাস মিহির পেটের একপাশে স্পর্শ করে দিতেই সে শিউরে উঠল। আৎকে উঠে বলল,

“মা,পেট দেখা যাচ্ছে তো!”

তিনি কথাটা না শোনার ভান ধরে বললেন,

“আলতা পরবি?”

মিহি সরল গলায় বলল,

“কাল তো পরিয়ে দিয়েছিল।”

রুবিনা মিহির হাত দুটো সামলে ধরে বললেন,

“দেখ চলে গেছে।”

মিহি নিজের হাতের দিকে তাকাল। পায়েও। না কোথাও লাল রঙের ছোট্ট ফোঁটাও দেখা যাচ্ছে না। গোসল করার সময় সতর্ক থাকলে নিশ্চয় যেতো না। সে এত বোকা কেন? কিছু খেয়াল থাকে না। আলতা চলে যাওয়ায় যেমন হতাশ হলো তেমনি আনন্দিতও হলো। নতুন করে পরতে পারবে। সে উচ্ছ্বাসিত গলায় বলল,

“আবার পরব। তিহি আপুর সাথে।”

রুবিনা মেয়েকে সামলানোর পূর্বেই সে আলতা নিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইলে খপ করে হাত ধরে ফেললেন। কড়া চোখে বললেন,

“খবরদার ঐ মেয়ের কাছে যাবি না। সোজা ইশাদের কাছে যাবি। হাত ধরে বলবি,আলতা পরিয়ে দিতে।”

মিহি মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে কোমরের দু পাশে ধরে শাড়ি উপরে তুলার চেষ্টা করছে। ঠিক করতে গিয়ে শাড়ির কিছু অংশ খুলে গেল। সে দাড়িয়ে পড়ল। ঠোঁট কামড়ে গভীর মনোযোগে শাড়ি ঠিক করায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।

ইশাদ বসার রুমে মামার সাথে কথা বলছিল। আগের বার মামা একাই এসেছিলেন। এবার মামিকে নিয়ে এসেছেন। সাথে তাদের তিন বছরের ছোট্ট ছেলে অয়ন ও আছে। কাল গায়ে হলুদের ব্যস্ততায় তেমন কথা হয়নি। সুযোগ ছিল না তেমন নয়৷ ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গিয়েছিল। মামার সামনে পড়লেই তার শরীর দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হয়। তার উপর মামির উপস্থিতে প্রচন্ড অস্বস্থিতে ভোগছিল। কথপোকথনে সমাপ্ত ঘটাতে সে অয়নকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,

“আপনারা বসেন। আমি ওকে নিয়ে একটু ঘুরে আসি।”

কথার মাঝেই অয়নকে ঘাড়ে তুলে নিল সে। বেশ উৎফুল্ল হয়ে অয়নকে ঘাড়ের উপর নাচিয়ে সামনে পা ফেলতে চোখ কপালে। ইমদাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার দাঁড়ানোর ভঙ্গিটা খুব একটা পছন্দ হলো না ইশাদের। মাথাটা সামান্য নিচে ঝুঁকানো। চোখে এঁটে থাকা কালো সানগ্লাসটা নাকে টেনে এনে কিছু একটা দেখছে। কী দেখছে? ইশাদ ওর দৃষ্টি অনুসরণ করতেই একটি মেয়েকে দেখতে পেল। পড়ণে বেগুনি রঙের হাফ সিল্কের শাড়ি। পেটের দিক থেকে শাড়ি সরিয়ে কিছু একটা করছে। মুখ দেখা যাচ্ছে না। নিচের দিকে অনেকটা ঝুঁকে থাকায় খোলা চুলগুলো মুখের সামনে জড়ো হয়ে আছে। ইশাদ ভাল করে পরখ করে দেখবে যে সে ধৈর্য্যটাও হলো না। সে দ্রুতগামীতে ইমদাদের সামনে এসে দাড়াল। কড়া গলায় বলল,

“তুই এখানে কী করছিস? আমি তো ডাকিনি।”

ইশাদের কন্ঠ পেয়ে মিহি মাথা তুলল সামনে শুধু ইশাদ নয়,আরো একটি পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু ইশাদকে ভেদ করে তার মুখ দেখা যাচ্ছে না।

“তোর প্রশ্নের উত্তর পরে দিচ্ছি। সামনে থেকে সর। আমাকে দেখতে দে।”

ইশাদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসে। রাগে দাঁত কটমটিয়ে বলল,

“তুই চুড়ান্ত পর্যায়ের লুচ্চা হয়ে গিয়েছিস। আমার সামনে দাঁড়িয়ে অশ্লীলতা ছড়াচ্ছিস! তাও আমার বাড়িতে,আমার বাড়ির মেয়েদের সাথে অসভ্যতামি?”
“ধুর! আমি তো মুখ দেখতে চাচ্ছি। আমি নিশ্চিত এই সেই হাওয়ায় উরা মেয়ে। এর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে আমার জীবনটা পানসে হয়ে গেছে। সর তো।”

অয়ন না থাকলে এতক্ষণে ইমদাদের নাকে কতগুলো অগণিত ঘুষি পড়ত। তবে ইমদাদের কথায় সেও নিশ্চিত হলো এটা মিহি। ইমদাদ ধৈর্যচ্যুত হলো। সে ইশাদকে পাশ কাটিয়ে মিহির সামনে এগুতে ইশাদ নিজের বাম পাটা সামনে বাড়িয়ে দিল। ইমদাদ আকস্মিক বাঁধায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল! মিহি ভয়ে এক কদম পিছিয়ে গেল। বিস্ময়ে হতভম্ব! একবার ইশাদের দিকে তাকিয়ে আবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে ইমদাদের দিকে। ইমদাদের নাকটা বুঝি ভেঙেই গেল। খাঁড়া নাকের সুচালো অংশ গিয়ে ঠেকেছে মেঝেতে। সে ব্যথিত সুর ছাড়ে। আহত দৃষ্টি নিয়ে ঘাড় বাকাতে মিহি আরেক কান্ড করে বসল। আলতা বোতলের মুখ খুলে সব ঢেলে দিল ইমদাদের মুখে,পিঠে! সেই সময় দুই হাত দূর থেকে তিহির গলা আসে,

“ইশ! উনি পড়লেন কিভাবে?”

ইশাদ তাৎক্ষনিক পেছন ঘুরল। তিহি চট করে দু’হাতে মুখ চেপে ধরে। কী ভেবে তৎক্ষনাৎ দৌড়ে পালিয়ে গেল। মিহিও অপেক্ষা করে না। তিহির পিছ ধরে সেও পালিয়ে যাচ্ছে!

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২২)

“বাবাই,আমি পিঠে চড়ব?”

ইশাদের দৃষ্টি সিঁড়ির শেষ মাথায় আটকে ছিল। ইনার মিষ্টি কন্ঠে চোখ সরে আসে নিজের কাছে। ইনা তার শার্টের নিচের দিকটা টেনে ধরে আছে৷ হাতের রুপোর চুড়ির ঝুমঝুম শব্দ তোলে দ্রুত শার্ট টেনে আবার বলল,

“ও বাবাই, আমি পিঠে চড়ব?”

ইশাদ ইনার আবদার মাখানো চোখ জোড়ায় চেয়ে আছে৷ কী নিষ্পাপ! কী মায়া! জী আদুরী! ইশাদের ইচ্ছে হলো কাঁধ থেকে অয়নকে সরিয়ে ইনাকে বসিয়ে দিতে। কিন্তু ইচ্ছেটা উড়িয়ে দিয়ে সস্নেহে বলল,

“কার পিঠে চড়বে, সোনামা?”

ইনা বাম হাতের আঙুল তাক করে ইমদাদের উপর। অতিশয় উৎসাহ নিয়ে বলল,

“ঐ লাল পিঠে।”

ইশাদও ততক্ষণে দৃষ্টি রেখেছে ইমদাদের উপর। তার করুণ অবস্থায় হাসির বৃষ্টি ঝরাতে ইচ্ছে করছে। সে এখনো মেঝেতে পড়ে আছে কেন? সুইমিং পুল ভেবে সাঁতরাচ্ছে নাকি? ইশাদ ঠোঁট টিপে বলল,

“হ্যাঁ মা চড়ো না। কে মানা করেছে? আমি থাকতে তোমার ভয় কিসের?”

ইশাদের অনুমতি পেয়েই ইনা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। খুশিতে তার শুকনো ঠোঁট জোড়ায় গোলাপি হাসির প্রলেপ পড়েছে যেন। কোনোমতে পা দুটো পিঠের দুপাশে ফেলে ধপ করে বসে পড়ল। দাঁত বের করে ইশাদের দিকে বড় বড় করে তাকিয়ে নিজের উচ্ছ্বাসিত অনুভূতি প্রকাশ করল। তারপর গম্ভীর গলায় হাঁক দিল,

“উঠ ঘোড়া,উঠ। টগ টগ ছুট! আমার রাজপুত্রের কাছে যাবি কেমন?”

ইনা মিঠা সুরে হুকুম দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিঠের শার্ট টেনে দিচ্ছে৷ মাথার চুল টেনে দিচ্ছে। এতে কী ক্ষান্ত হলো? আয়েশি করে আদরও করে দিল। দুই একটা চুমুও তো পড়ল!

___________________________
প্রথম প্রেমের অনুভূতিটা অনেকটা পায়ের তলার সুড়সুড়ির মতো। দাঁত চেপে,চোখ খিঁচে,হাতের মুঠো বন্ধ করে কিংবা ঘুমিয়ে থাকলেও নড়েচড়ে উঠতে হয়। ব্যথিত হাসি হাসতে হয়। খুব কম মানুষই আছে যারা এই অনুভূতির সাথে পরিচিত নয়। ভালোবাসার অনুভূতিটাও কি তেমন নয়? ভালোবাসার সুড়সুড়িময় অনুভূতিটা হঠাৎ করে তীব্রতার রূপ ধারণ করেছে। অজানা যন্ত্রণায় ছটফট করছে। কারণহীন মুখ ভার। হৃদয়টা কেন কামড়ে কামড়ে মরছে! কিন্তু কেন? এমন ব্যথিত ভালো লাগা অনুভূতির উৎপত্তিটা কখন ঘটেছে? কার জন্য ঘটেছে? ইশাদ যত ভাবে তত মরে! ভালোবাসার সমুদ্রে লাফিয়ে পড়ে। অতল সাগরে হাতরিয়ে খুঁজতে থাকে কিছু একটা। কিন্তু কী সেই মরিয়া চাওয়া? আচমকায় ইশাদ নড়ে উঠে। তার ধ্যানে বিরতি ঘটায়। সে তার বিছানায় মাঝবর্তী অবস্থানে বসে ছিল। শিরদাঁড়া টান টান করে। গভীর ভাবনায় ডান হাত দিয়ে কপাল ম্যাসাজ করছিল। যেন গুরুতর দুশ্চিন্তায় ভুগছিল!

ইশাদ বিছানা থেকে নামে। দ্রুত দরজা খোলে বেরিয়ে যাচ্ছে।সে সময় দেখা হয় মায়ের সাথে,

“কোথায় যাচ্ছিস,ইশাদ?”

শাহিনা শাইখার প্রশ্নে বিচলিত হয়ে পড়ে। যেন চুরি করতে গিয়ে গৃহস্থের কাছে হাতে নাতে ধরা পড়েছে। লুকিয়ে পড়বে কী? শাহিনা শাইখা ছেলের দিক থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছেন। তার হাতে ফোন। নাম্বার ডায়াল করছেন। সম্ভবত তিনি কিছুটা ব্যস্ত। কপালে মৃদু দুশ্চিন্তার ছাপ। ইশাদের চোখে সবটাই স্পষ্ট ধরা পড়ল। সে উদ্বেগে জিজ্ঞেস করল,

“কী হয়েছে,আম্মু? তোমাকে চিন্তিত লাগছে।”

শাহিনা শাইখা ফোন নাড়াতে নাড়াতে বললেন,

“তোর বিয়ের ডেটটা পিছিয়ে পড়ায় একটু ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। জনে জনে কল দিয়ে জানাতে হচ্ছে পুরো ব্যাপারটা। প্রায় সবাইকে বলে দেওয়া হয়েছে কিন্তু..”
“কিন্তু?”
“তোর বাবার খুব কাছের একজনকে বলা হয়নি। উনার সন্ধ্যে বেলায় আসার কথা ছিল। আমি সকাল থেকে ফোন করছি। প্রতিবারই নাম্বার বন্ধ। এখন যদি চলে আসেন? কেমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে? অনেক দূর থেকে আসবেন। পঞ্চগড়!”

ইশাদ মায়ের চিন্তিত গালটিতে হাত রাখে। চোখের নরম চাহনি নিয়ে দীর্ঘ পাতা ফেলে। আশ্বস্ত করে বলল,

“নাম্বারটা আমাকে দেও। আমি দেখছি কী করা যায়। আমি থাকতে তোমার এত চিন্তা কিসের বুঝি না। একটু কি অবসর সময় কাটানো যায় না,আম্মু?”

ছেলের কথায় শাহিনা শাইখা আহ্লাদ হাসি দিলেন। ইশাদের হাতের উপর নিজের একটা হাত রাখলেন। গাঢ় ভাবে চেপে বললেন,

“আমরা নারি জাতিটাই এমন। শুধু নিজের আশেপাশের মানুষজন নয় অদূরে,অপরিচিত মানুষদের নিয়েও হায় হায় করে মরি।”

শাহিনা শাইখা আরেক ঝলক হাসলেন। ক্ষণস্থায়ী হাসিটি মিলিয়ে হাতের ফোনটা ছেলের হাতে তুলে দিলেন। ইশাদ ফোন নিয়ে সামনে অগ্রসর হতে শাহিনা শাইখা বললেন,

“ওদিকে কোথায় যাচ্ছিস?”

ইশাদ দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে নিল। বলল,

“রুমের ভেতর নেট সমস্যা করে, আম্মু। ছাদে গিয়ে কথা বলব।”

ইশাদ কথা শেষ করেই ছাদের সিঁড়িতে পা ফেলে। হঠাৎ ভয় চেপে বসছে লোম কূপে! কিসের ভয় এটা? তবে কি নিষিদ্ধ কিছুতে পা বাড়াচ্ছে?

সিঁড়ি কেটে ছাদের পাটাতনে প্রথম পদক্ষেপ পড়তেই সরাসরি দৃষ্টি রাখে তিহিদের রুমে। শেষ বিকেলের গাঢ় কমলা রঙের আলোর রশ্মি পড়ছে তিহিদের রুমের জানালার কাঁচে। চোখে ধারাল আঘাত করছে যেন। ইশাদ চাইতেও সেখানে তাকিয়ে থাকতে পারল না। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,’আয়নাকন্যার আগুন রূপ কি রুমের প্রতিটি কনায় কনায় গিয়ে পড়েছে?’

পুরো ছাদ ফাঁকা। রশিতে কাপড় পর্যন্ত নেই। এক কোণে নতুন করে বসানো চুলায় আগুন জ্বলছে। ভুল করে কী? ইশাদ রান্নাঘরের দিকে পা বাড়িয়েও অন্যদিকে চলে আসে। একেবারে রেলিং ঘেষে দাঁড়ায়। ঠিক তিহিদের দরজা এবং জানালার মাঝখানে। দুটোই বন্ধ। কিন্তু খুললে প্রথমেই চোখ পড়বে ইশাদের দিকে। সে কিছুক্ষণ সেদিকে নীরব দৃষ্টি রেখে ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মায়ের তুলে রাখা নাম্বারটিতে কল দেয়। কল ঢুকেছে। ওপাশে রিং হচ্ছে। সেদিকে কোনো খেয়াল নেই ইশাদের। তার মনে চলছে বিরহময় অপেক্ষা! দীর্ঘ অপেক্ষা করাটা খুব বেশি কঠিন হয়ে পড়বে। কী করবে? ফোনের অপর পাশ থেকে রাশভারী পুরুষ গলা ভেসে আসতে ইশাদ তটস্থ হয়। হঠাৎ কী হয় কে জানে? অপ্রয়োজনে গলা উঁচিয়ে কথপোকথন চালাচ্ছে। ফাঁকে ফাঁকে দু কদম এগিয়েও আসছে তিহিদের রুমের কাছে। কিন্তু কোনো কাজ হলো বলে মনে হচ্ছে না। দরজা,জানালা কিছুই খুলছে না। তাহলে কি মহারানি তার গলা পায়নি? নাকি ইচ্ছে করেই লুকিয়ে থাকছে? এটা তো অন্যায়,ঘোর অন্যায়। এই অন্যায় সে কিছুতেই সহ্য করবে না। কিছুতেই না!

অপেক্ষা বরাবরই তিক্ত,কটু,বিরস হয়। আর তা যদি হয় প্রিয় কাউকে ঘিরে তাহলেতো রাগটা তরতর করে উর্ধ্বতে চড়ে বসে। ইশাদের সাথেও তেমনটাই হচ্ছে। চোখের সামনে নীল আর কমলা রঙের আকাশটা ঘন আঁধারে ঢেকে যাচ্ছে। এই একটু পর চাঁদ মামাও উঁকি দিবে। উপহাস করে বলবে,

“কী ভাগ্নে? শেষমেশ কিনা প্রেমরোগে ধুঁকছিস? দুনিয়াই কি আর কোনো রোগের খোঁজ পেলি না? নে এবার মর! ধুঁকে ধুঁকে মর! মরেও কি শান্তি আছে?”

ইশাদ রেলিংটা শক্ত করে চেপে ধরল। কড়া চাপড় মারতে পেছন থেকে ইমদাদের গলা এল,

“তোকে সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজে মরছি,আর তুই এখানে? ব্যাপার কি বন্ধু?”

ইশাদ পেছন ঘুরে। রাগটাকে যথা সম্ভব সংগোপন করে বলল,

“তুই এখনো এ বাসায়? যাসনি?”

ইমদাদ ইশাদের পাশে দাঁড়ায়। সামনে চোখ রেখে বলল,

“এইতো এখনি যাব। তোর কাছ থেকে বিদায় নিতে আসলাম।”

কথা শেষে ইমদাদ শূন্য থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ইশাদের পানে ফেলে। ইশাদের দৃষ্টিও ইমদাদের দিকেই। তবে মুখে নয় শরীরে। বুক,পিঠ,কাঁধ যেকোনো জায়গায় হতে পারে। ইমদাদ বিপদের পূর্বাভাস পেয়ে সতর্ক হতে দ্রুত বলল,

“রাত তো হয়ে এল। এখন আমি যাই। পরে আসব কেমন? তুই কি এখানে আরেকটু থাকবি?”
“এটা তো আমার শার্ট। তুই পরেছিস কেন? তোর কাছে এল কী করে?”

যে ভয়টা পেয়েছিল তাই যেন হল। বিপদের থাবা থেকে বাঁচতে ইমদাদ এক কদম দূরত্ব সৃষ্টি করে বলল,

“আন্টি দিয়েছে। এমনি এমনি তো দেয়নি। আমাকে তো বাইরে যেতে হবে,তাইনা? কী পরে যাব? ঐ হাওয়াই উড়া মেয়েটা তো আমার শার্টের বারোটা বানিয়ে দিয়েছে। সাথে সাথে আমার বিকেলের ইম্পর্ট্যান্ট মিটিংটাও!”

ইশাদ এক ভ্রূ সামান্য উপরে তুলে বলল,

“ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং”

ইমদাদ চোখ নামিয়ে ফেলে। চোখের তারায় অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। আমতা আমতা করে বলল,

“কেন? আমার কি মিটিং থাকতে পারে না? তুই কি ভুলে গেলি আমি একজন ডাক্তার? সম্মানে তুই আর আমি একি কাঠগড়ায়।”

ইমদাদের জড়ানো কথাগুলো গায়ে মাখল না ইশাদ। দুজনের দূরত্ব কমিয়ে নিল। কাঁধে হাত রেখে পূর্বের প্রশ্নটাই দ্বিতীয় বার করল,

“ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং?”

ইমদাদ ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। খানিকটা উঁচু গলায় বলল,

“ইম্পর্ট্যান্ট ডেটিং। রিপার সাথে দেখা করার কথা ছিল। সত্যটা বের করেই ছাড়লি? এবার শান্তি?”

ইশাদ মাথা দুদিকে নাড়ে। যার মানে এই-সে শান্তি পায়নি। আরো কিছু হবে তারপর শান্তি পাবে। এবার ইমদাদের ভ্রু জোড়া সংকুচিত হয়ে আসে। কিছু আন্দাজ করে গলার কাছ দিকের শার্টটা খামচে ধরে চাপা চিৎকার তুলে,

“ইশাদ না। এটা কিন্তু ঠিক হবে না। আমাকে আজ রিপার সাথে দেখা করতেই হবে। অনেক কষ্ট হয়েছে মানাতে। একটু বোঝার চেষ্টা কর বন্ধু!”

ইমদাদের কথার মাঝেই দু’হাতে শার্টের বোতাম খামচে ধরে ইশাদ। জোরপূর্বক খুলতে খুলতে বলল,

“অশ্লীল ছেলে,তোর অশ্লামী করতে শার্টের কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু শুধু কেন পরবি? এত রাতে ডেটিং? বিশ্বাসযোগ্য নহে। তুই যে রেস্টুরেন্ট ছেড়ে ফ্ল্যাটে যাওয়া-আসা করছিস এটা আমার অজানা নয়। যা খুশি কর! কিন্তু আমার শার্ট খুলে যা।”

দুজনের দস্তাদস্তির মধ্যেই ইশাদের নজর আটকাল তিহিদের জানালাতে। তিহি চোখ দুটো বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দুটোর মধ্যবর্তী বিশাল ফাঁক। ইশাদ ধীরগতিতে তাকায় ইমদাদের দিকে। শার্ট প্রায় খোলা শেষ। হাতায় আটকে আছে। সে যে জোর করে খুলছে এটা প্রথম দেখায় স্পষ্ট বুঝা যাবে। তিহি কী বুঝল? সাংঘাতিক কিছু কি? ইশাদ পুনরায় তিহির দিকে তাকাতে,সে মুখের হাঁ বন্ধ করে নেয়। নাক,মুখ কুঁচকিয়ে ফেলে। পরিশেষে ঠোঁট দুটো মিলিয়ে কিছু একটা বলল। কী বলল? নষ্ট পুরুষ?

________________________________
ঠান্ডা ভাতে সামান্য পানি ছিটিয়ে দিলেন শাহিনা শাইখা। চুলার আঁচ যথা সম্ভব কমিয়ে নিজের রুমে ছুটে গেলেন। আলমারীর গোপন সিন্দুকে চাবি ঢুকিয়ে তালা খুললেন। একটি সাদা রঙের শপিং ব্যাগ দেখা যাচ্ছে। বের করার পূর্বে একবার রুমে চোখ বুলালেন। দরজাতেও। না কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছে না। সোবহান শাইখ রাতের খাবার শেষ করে বাইরে হাঁটতে যান। প্রায় ত্রিশ কি চল্লিশ মিনিট হাঁটেন। শাহিনা শাইখা জানা সত্ত্বেও বার বার ভীত চাহনি ফেলছেন আশেপাশে। সাবধানে ব্যাগটি নিজের আঁচলের তোলায় লুকিয়ে দ্রুতগামীতে রান্নাঘরে ছুটে গেলেন। ভাত গরম হয়ে গেছে। ঢাকনা তুলতে গরম ধোঁয়া বাষ্পকারে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটি কাঁচের প্লেটে ভাত বেড়ে তাতে চিংড়ি দিয়ে ভাজা করলা ভাজি, আর ইলিশ দিয়ে রান্না টমেটো,আলুর তরকারিটা নিলেন। অন্য একটি প্লেট দিয়ে ঢেকে সোজা হেঁটে চললেন মিহিদের রুমের উদ্দেশ্যে। আজ রুবিনা রাতের খাবার খাননি। তিনি সবসময় নিজের রুমে খান। খুব একটা বাইরে আসেন না। জোর করার উপায় নেই। এ বাসায় আসার পূর্বেই শর্ত দিয়েছিলেন,তার মর্জির বিরুদ্ধে কিছু করতে বললে মিহিকে নিয়ে ফেরত চলে যাবেন। যেটা শাহিনা শাইখা চান না। তাই তার কথামতো রুমে খাবার পাঠানো হয়। মিহির মাধ্যমে। মিহি সবার সাথে ডাইনিংয়ে বসেই খায়। খাওয়া শেষে মায়ের জন্য খাবার নিয়ে যায়। এটাও কি রুবিনার ইচ্ছে? না। নিয়মটা নিজ থেকেই তৈরী হয়ে গিয়েছে। আজ খাবার নিতে মানা করে দেয় মিহি। তার মা নাকি বলেছে,আজ তিনি খাবেন না। শাহিনা শাইখা জানতে চেয়েছিলেন অসুস্থ নাকি। মিহি সরল মনেই উত্তর দিয়েছিল ‘না’।

মিহিদের দরজার কাছে আসতেই শাহিনা শাইখার বুকের মধ্যিখানে ক্ষণে ক্ষণে তীক্ষ্ণ ঢেউ আঁচড়ে পড়তে থাকে। ব্যথাটা সহ্য করতে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তখনি মিহির কন্ঠ,

“আন্টি? বাইরে দাড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো না!”

শাহিনা শাইখা দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। সহজ গলায় বললেন,

“তোমার আম্মু?”

মিহি বিছানায় শুয়ে ছিল। উঠে বসল। হাত দিয়ে রুমের এক কোণে ইশারা করে বলল,

“ঐ তো আম্মু।”

শাহিনা শাইখা ডান পাশে তাকায়। রুবিনা টুলের উপর বসে আছে। চুল ছাড়া। কালো চুলের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ সাদা চুলের উঁকিঝুকি। এখনো কী ঘন! অর্ধেক চুল সামনে ফেলা। কোমর ছুঁইছুঁই। তাঁর হাতে ছোট, কালো চিরুনি। এই ধরনের চিরুনি দিয়ে উঁকুন আনা হয়। উনি কি তাই করছিলেন? শাহিনা শাইখার উপস্থিতে খানিকটা অস্বস্থি রুবিনার মধ্যেও যেন ভর করল। চোখের দৃষ্টি কোথায় রাখবেন বুঝতে পারছেন না। উঠে দাড়াবেন? কথা বলবেন? নাকি বসেই থাকবেন সে ভাবনার উথাল-পাতাল হচ্ছে। সব ফেলে সে উঠেই আসল। সামনে অগ্রসর হতে হতে চুল গুছিয়ে খোঁপা বাঁধতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। শাহিনা শাইখার কাছে আসতেই মুগ্ধ নয়নে চেয়ে রইলেন রুবিনার দিকে। যৌবনকালের জল যেন এখনো ছিটকে ছিটকে পড়ছে। এই চোখের মায়ায় তো সে একজন নারী হয়েও আটকে পড়ছে,তাহলে তার স্বামী কিভাবে বেরোবে?

শাহিনা শাইখা এই নিয়ে দুবার রুবিনার মুখোমুখি হলেন। সাধারণত,প্রথম আলাপের অনুভূতির তুলনায় দ্বিতীয় আলাপে অনেক কিছুই সহজ হয়ে আসে। বেশ পরিবর্তন হয়। কিন্তু শাহিনা শাইখার মনে হলো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। না ব্যথার আঘাত,না ব্যর্থতার আঘাত আর না মুগ্ধতার! সেই প্রথম দিনেও তিনি এমনি ভাবে চোখ মেলে তাঁকে দেখেছিল।

“কিছু বলবেন?”

রুবিনার প্রশ্নে শাহিনা শাইখার হুঁশ ফিরে। বেশ লজ্জিতবোধ হয়। পালাতে ইচ্ছে হয়। সে তাড়াহুড়ায় হাতের প্লেটটা রুবিনার হাতে ধরিয়ে দিলেন। কন্ঠ টেনে বললেন,

“রাতে না খেয়ে থাকতে হয় না।”

কথাটা শেষ করেই ঝড়ের গতিতে সেখান থেকে চলে আসলেন। নিজের রুমের সামনে আসতে মনে পড়ল,যার জন্য এত কিছু তাই করা হল না। শপিং ব্যাগটা এখনো তার আঁচলের নিচে পড়ে আছে!

_________________________

ফাল্গুন মাসের ছাব্বিশতম দিন চলছে। সকাল থেকেই মিহির মন উচাটন। হঠাৎ করেই একঘেয়েমিতে ভুগছে। কিছু একটা খেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কী খেলবে? কার সাথে খেলবে? সঙ্গী খুঁজে পাচ্ছে না। খেলার মতো পরিস্থিতিও নেই। বসার রুম সর্বদা অন্যদের দখলে। এই মানুষগুলোকে সে চেনে না। শুধু চোখের দেখা হচ্ছে কাল থেকে। তেমন আলাপ হয়নি। এই নিয়ে ছয় বার বসার রুমের উঁকি দিল। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে রুমে ঢুকে যায় আবার। টিভিটাও দেখার সুযোগ নেই!

মুহুর্তকাল মুখভার করে বসে থাকে সে। মায়ের জিজ্ঞাসাবাদে অংশগ্রহণ করে না। সহসা খাটের নিচে ঢুকে পড়ে। তাদের নিজস্ব ব্যাগ থেকে চারকোণো কাগজের প্যাকেট বের করে। দৌড়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। সোজা আসে তিহিদের রুমে। তিহি মাত্রই গোসলের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। তার কাঁধে জামাকাপড়। তোয়ালে খুঁজছে। মিহি রুমে ঢুকে উত্তেজনাবশে জোরালো গলায় বলল,

“তিহি আপু খেলবে?”

তিহি তাৎক্ষনিক মিহির কাছে ছুটে আসে। সাবধানিভঙ্গিতে বলল,

“আম্মা ঘুমাচ্ছে। মাথা ব্যথা। আস্তে কথা বল।”

মিহি একবার চোখ ফেলে রেখা ভূঁইয়ার দিকে। তিনি কপালে হাত রেখে শুয়ে আছেন। পাশেই ইনা ঘুমাচ্ছে। সে চাপা স্বরে বলল,

“চলো না খেলি। আমার খুব মন খারাপ লাগছে।”

তিহি চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে, “কী খেলবে?”

মিহি আগ্রহ নিয়ে বলল,

“ধনী হবার মজার খেলা।”

তিহির মুখেও সামান্য আগ্রহ ফুটে উঠল। এই খেলার সাথে সে পরিচিত নয়। মিহিকে টেনে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসল। বলল,

“এটা আবার কী খেলা? আমি তো আগে খেলিনি।”

মিহি বেশ মজা পেল। উৎসাহ নিয়ে বলল,

“অনেক মজার খেলা। খেলবে?”
“এখন?”

মিহি মুখ ছোট করে অনুরোধের সুর ধরল,

“প্লিজ,আপু। আসো না খেলি।”

তিহি সামান্য ভাবল। বলল,

“আচ্ছা খেলব। আগে গোসল করে আসি? নাহলে আম্মা বকবে।”

মিহি খুশি হল। আনন্দিত গলায় বলল,

“তাহলে আমি সব সাজিয়ে নেই? তুমি গোসল করে আসো।”
“কোথায় আসব?”

এবার মিহি চিন্তায় পড়ে গেল। ছাদে খেলা যাবে না,পুরো ছাদ জুড়ে তপ্ত রোদের আলো ছড়িয়ে আছে। বসার রুমেও খেলা যাবে না। নিজের রুমেও না। মা যে তিহিকে খুব একটা পছন্দ করছে না সেটা বুঝে ফেলেছে। তিহিদের রুমেও না। তাহলে? মিহি বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা শেষে সহসা বলল,

“ইশাদ ভাইয়ার রুমে।”

তিহি চমকে উঠে। ভীত চাহনি ফেলার পূর্বেই মিহি ছুটে চলে গেল।

তিহি গোসল শেষে ধীর পায়ে ইশাদের রুমে হাজির হয়েছে। ভেতরে ঢুকার পূর্বে একবার উঁকি দিল। না ইশাদ নেই। কিন্তু মিহিও তো নেই। তাহলে কি অন্য কোথাও খেলার তোরজোর করছে? তিহি চলে যাবে ভাবতেই,চোখ পড়ে বিছানায়। সে ভেতরে ঢুকে পড়ে। বিছানার কাছে আসতে দেখতে পায়,একটি শক্ত কাগজের কোর্ট তার চারপাশে ছক কাটা। প্রত্যেকটা ছকে ছবিসহ জায়গার নাম। কোর্টের উপর দুটো ছক্কা ও চারটা গুটি। এগুলো দিয়ে সে লুডু খেলেছে। কিন্তু এখানে কোথাও লুডুর কোর্ট নেই। কোর্টের পাশে চোখ পড়তে সে আশ্চর্য হয়ে গেল। অনেকগুলো টাকা সাজানো। এক হাজার থেকে শুরু করে এক টাকা পর্যন্ত। এগুলো কি আসল টাকা? তিহি ছুঁয়ে দেখতে নিলে,পায়ের শব্দ পায়। তার মস্তিষ্ক সাবধানি বার্তা ছুঁড়ে। কে আসছে মিহি নাকি ইশাদ? প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বাদ দিয়ে সে লুকিয়ে পড়ার উপায় খুঁজে। গোসলখানায় ঢুকতে গিয়ে কিছু মনে পড়ে। সেখান থেকে ছুটে আসে জানালার কাছে। দীর্ঘ প্রস্তরের রঙিন পর্দার আড়ালে লুকিয়ে পড়ল।

ইশাদ রুমে ঢুকেই কপাল কুঁচকিয়ে ফেলে। তার বিছানায় এসব কী পড়ে আছে? ক্লিনিকে তেমন ভীড় না থাকায় বাসায় চলে আসার কথা ভাবছিল। শরীরটাও সুবিধের ঠেকছিল না। তার মধ্যে আম্মুর কলও গিয়েছিল। তাই চলে আসাটাই যুক্তিযুক্ত মনে হলো। ফ্যানের সুইচটা চেপে দিতেই যেন রুমে ঘুর্ণিঝড় শুরু হলো। টাকার ঘুর্ণিঝড়! চারপাশে টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে। বিস্ময়ে ইশাদের মুখ থ হয়ে আছে। এদিক সেদিকে ফেলা চোখ জোড়া আটকাল ফর্সা,নরম পায়ে। ক্ষণকাল পা দুটোতে তাকিয়ে কাটিয়ে দিল। মুহূর্তেই মাথায় কিছু খেলে গেল। সে টেবিলের কাছে ছুটে যায়। কালো মার্কার নিয়ে সাবধানে এগিয়ে আসে জানালার কাছে। আচমকা পায়ের গোড়ালিতে চেপে ধরে ইশাদ। ভয়ে তিহির ভেতরটা চিৎকার করে উঠে। কিন্তু গলা ছেড়ে বেরিয়ে আসে না। ইশাদ একে একে পায়ের নখে কালো মার্কারের কালি বসাতে থাকে নেইলপলিস মতো। তিহি তখনো দম আটকে চুপটি করে দাড়িয়ে আছে। দশ আঙুলের নখ কালো রঙে ভরে যেতে ইশাদ থেমে গেল। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে পা জোড়ায়। ইশাদের ছোঁয়া থেকে মুক্তি পেতে তিহি নরম নিশ্বাস ছেড়ে বুক হালকা করে। দৌড়ে পালানোর জন্য এক পা নাড়াতেই আবার বন্দী হয়ে যায়। ইশাদ পর্দাসহিত তিহির কোমর জড়িয়ে ধরেছে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here