#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (২৩)
#রোকসানা_রাহমান
ইশাদ একে একে পায়ের নখে কালো মার্কারের কালি বসাতে থাকে নেইলপলিসের মতো। তিহি তখনো দম আটকে চুপটি করে দাড়িয়ে আছে। দশ আঙুলের নখ কালো রঙে ভরে যেতে ইশাদ থেমে গেল। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে পা জোড়ায়। ইশাদের ছোঁয়া থেকে মুক্তি পেতে তিহি নরম নিশ্বাস ছেড়ে বুক হালকা করে। দৌড়ে পালানোর জন্য এক পা নাড়াতেই আবার বন্দী হয়ে যায়। ইশাদ পর্দাসহিত তিহির কোমর জড়িয়ে ধরেছে। শক্ত বাধনে বাঁধতেই ইশাদের বুকের সাথে ল্যাপ্টে যায় তিহি। তার হৃদয় কাঁপছে! এ কেমন শব্দ কানে আসছে? কারো হৃদয়ের খুব কাছে আছে কি ? অনুভব করতে পারছে কি? তিহির বুকের বা পাশে লুকিয়ে থাকা হৃদয়টা যেন হঠাৎ করেই নাছোড়বান্দা হয়ে উঠল। সজোরে লাফাচ্ছে! কাছে,খুব কাছের আরেকজনের হৃদয়ের সাথে মিলিত হওয়ার প্রবল উত্তেজনায় ভুগছে। সচঞ্চল হৃদয়টাকে শান্ত করতে খুব ইচ্ছে হয় তিহির। কিন্তু পারছে না। এক অদ্ভুত ভয় মেশানো অস্বস্থি হচ্ছে তার। এক অদৃশ্য বাঁধাও অনুভব করছে। কী সেই বাঁধা? তিহি আনমনেই ইশাদের কাছ থেকে ছুটার চেষ্টা চালাতে শুরু করে। ইশাদের প্রশস্ত,বলিষ্ঠ বক্ষে হাতের পাতায় বল প্রয়োগ করে তিহি। তখনি ইশাদ চাপা স্বরে বলল,
“এত সহজে ছাড়া পাচ্ছো না। এত দিন অনিচ্ছায় তোমাকে ছুঁয়েছি। কিন্তু এবার? স্বইচ্ছায়। অনেক পালিয়েছো।আর নয়। নিজ থেকে ধরা দিলে হয়তো একটু দয়া-মায়া হতো। তা তো দেওনি। কত খাটিয়েছো বল তো? পারিশ্রমিকতো দিতেই হবে।”
তিহি ত্রস্তা হরিণীর মতো ছটফট করছে। না পারছে ছুটতে,না পারছে শপে দিতে। উপরন্তু জোরাজুরিতে আরো গাঢ়ভাবে হাতের বাঁধনে জড়িয়ে পড়ছে। ভেতরে অস্থিরতা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মুখ দিয়েও কথা বের হচ্ছে না। অন্য সময় তো কারণে-অকারণে অপদস্ত করে ছেড়েছে। এমনটা তো আগে হয়নি! তিহি নিশ্বাস নিতে চায়। ভেজাতে চায় দেহের অভ্যন্তরের স্নায়ুকোষগুলোকে। হঠাৎ করেই সব যেন শুকিয়ে গিয়েছে। প্রাণহীন,নির্জীব,নিস্তেজ! ইশাদের চোখের দৃষ্টি গভীর মায়া,প্রখরতা,মোহগ্রস্থ। যেন পর্দা ভেদ করে তিহির মুখটাকে দেখতে পারছে। সে ভারি নিশ্বাস ছেড়ে চতুর রসিকতা করে বলল,
“তুমি তো ভারি চালাক মেয়ে। যেই দেখলে তিতা কথায় কাজ হচ্ছে না অমনি অন্য পথ ধরলে? আবেগ ঢেলে,চোখের জল ফেলে,হৃদয়ে হৃদয় ছুঁয়ে কামড়ে দিলে? শরীরে বিষ ঢেলে গর্তে লুকিয়ে পড়লে? এ দিকে যে আমি ব্যথায় মরে যাচ্ছি একটাবার দেখার প্রয়োজন মনে করলে না? এত নিষ্ঠুর তুমি? আবার আমাকে বলে নির্দয়! ফের যদি বেআইনি অপবাদ দিয়েছো তো..”
“তো?”
তিহির কন্ঠে ছোট্ট শব্দটা ইশাদকে উন্মাদে পরিণত করল। ভারি পর্দাটাকে অসহ্য বোধ হল। দেখা পেয়েও দেখা হচ্ছে না! এ যন্ত্রণা কি মানা যায়?
ইশাদের দিক থেকে কোনো উত্তর না আসায় তিহি পুনরায় বলল,
“থেমে গেলেন কেন? বলুন তো কী করবেন? মারবেন? দেখি একটু মেরে দেখান। আমিও দেখতে চাই আপনার..”
তিহির কথার মাঝেই ওর কোমর ছেড়ে মাথার দুপাশ চেপে ধরে ইশাদ। ধীরে ধীরে কপাল ছেড়ে,গাল বেয়ে চিবুক স্পর্শ করে। কিছুটা নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
“এত উদ্ধত হওয়া ভাল নয়,তিহি। যদি সত্যিই কিছু করে ফেলি?”
ইশাদের ঠান্ডা স্বরের কথাটা তিহির মধ্যে মৃদু কাঁপুনি তৈরি করল। নিমিষেই ভয়ে গুটিয়ে যেতে চাইল। ব্যাপারটা বুঝি ইশাদও টের পেল। সে তখনি বলল,
“এবার আমার পারিশ্রমিক দেওয়ার পালা। বলো কী দিবে?”
তিহি কম্পিত স্বরে বলল,
“কিসের পারিশ্রমিক?”
“এই যে এত খাটালে তার। একটু আগেইতো বললাম। সাথে নিজের বিষ ছাড়াতেও হবে। আমি রাতে ঘুমাতে পারিনা,তিহি!”
ইশাদের শেষ কথাটা বড্ড অসহায় শোনায়। তিহির মায়া হয়। ইচ্ছে করে পৃথিবীর সবার ঘুম চুরি করে এই মানুষটার চোখে বসিয়ে দিতে। অন্যায় হবে বুঝি? হলে হোক। তবুও সে এই অন্যায়টা করতে পারে,নির্দ্বিধায়। বিনিময়ে তারও কি কিছু চায়?
“তিহি?”
“হুম?”
“কোনটা আগে করবে?”
“জানিনা।”
“জানিনা বললে তো হবে না। ছেড়ে দেওয়ার কোনো অপশন নেই। দুটো ভিন্ন ধর্মের কাজ। প্রথমটা ইতিবাচক দ্বিতীয়টা নেতিবাচক। আমার মনে হয় ইতিবাচকটাই আগে করা উচিত। কী বলো?”
“দুটো একসাথে করব।”
তিহির আচমকা উত্তরে ইশাদ খানিকটা অবাক হলো। এত জলদি রাজি হয়ে যাবে ভাবেনি। মনে সংশয়ও বাসা বাঁধছে। মনে মনে কোন কূটকৌশল চালাচ্ছে কে জানে! সে বিচক্ষণতাসহিত ধরে ফেললেও সেদিকে সাঁয় দিল না। বলল,
“আমার কোনো আপত্তি নেই।”
“তাহলে শুরু করব?”
“অবশ্যই। যত তাড়াতাড়ি করবে তত তাড়াতাড়ি মুক্ত হবে।”
“না ছাড়লে করব কিভাবে? আগে তো আমায় ছাড়ুন।”
ইশাদ তিহিকে ছেড়ে দিল। কিন্তু জায়গা থেকে নড়ল না। তিহি দীর্ঘ নিশ্বাস টেনে নিল। যতক্ষণ না বুক ফুলে উঠে। শেষে পর্দার আড়াল থেকে সাবধানে রুমে নজর রাখল। দরজাটা খোলা পড়েই আছে। সে মনে মনে চতুর পরিকল্পনা করে বলল,
“পর্দার আড়ালে থেকে পারছি না। নিশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আপনার রুমে একদমই আলো বাতাসের ব্যবস্থা নেই। জানালাটা কি বন্ধ?”
মুহূর্তেই ইশাদের নজর জানালার দিকে চলে গেল। সেই সুযোগে তিহি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসে। দরজার দিকে দৌড় লাগাতে,ইশাদ ধরার জন্য হাত বাড়ায়। কিন্তু ব্যর্থ হলো সে। তিহি নাগালের বাইরে চলে গেছে। দরজার কাছে পৌঁছে জিভ বের করে বলল,
“আমার বয়েই গেছে আপনার বিষ ছাড়াতে! সাপকে দেখেছেন কখনও স্বইচ্ছায় নিজের বিষ টেনে নিতে?”
কথাটা শেষ করে সে আবার দৌড় লাগায়। পেছন থেকে পায়ের শব্দ কানে আসতে,বুঝতে পারে ইশাদ তার পিছু পিছু আসছে। অস্পষ্টভাবে কিছু বাক্যও কানে আসে,সাপিনী,দাড়াও বলছি!
শাহিনা শাইখা নিচতলায় যাওয়ার উদ্দেশ্য সিঁড়ির মুখে পৌঁছাতেই স্বামীর সাথে দেখা। সোবহান শাইখ নিচ থেকেই উপরে উঠে আসছেন। দুজনে এক বাসায় থাকলেও খাবার টেবিল আর রাতে বিছানা ছাড়া দেখা হয় না। কথাও হয় না। অথচ দিনের চব্বিশটা ঘন্টায় স্বামীর আশেপাশে ঘুরতে অযুহাত খুঁজতে ব্যস্ত থাকেন। কখনো পান কখনো পান না। পেলেও কী? মানুষটা কি খুব প্রয়োজন ছাড়া একটা শব্দও বের করে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে? এতটা চাপা স্বভাবের কিভাবে হয়? তার মধ্যে কী রসকস বলতে কিছু নেই? নাকি অন্যের থলিতে ঢেলে দেউলিয়া হয়ে গিয়েছে? ভাবতেই শাহিনা শাইখার হৃদয়ে আগুন জ্বলে উঠে। দাউদাউ করা সেই আগুনের পোড়ন কেউ দেখতে পায় না!
সোবহান শাইখের চোখে চোখ পড়লে,শাহিনা শাইখা চোখ ফিরিয়ে নিলেন। নিচে নামার জন্য এক পা তুলতেই কেউ যেন সজোরে ধাক্কা দিল। টাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়লেন স্বামীর উপর। এমন আকস্মিক ঝড়ে কিছুটা তাল ছাড়া হয়ে পড়েছিলেন সোবহান শাইখও। কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিলেন। এক হাতে স্ত্রীকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে সিঁড়ির রেলিং চেপে ধরলেন। তন্মধ্যেই পেছন থেকে তিহি চিৎকার করে বলছে,
“সরি আন্টি! দেখতে পাইনি। ভুল করে ধাক্কা লেগে গেছে। আপনি ঠিক আছেন তো?”
ততক্ষণে দুজনের ভর আয়ত্বে নিয়ে ফেলেন সোবহান শাইখ। কড়া চোখে তিহির দিকে তাকাতে,সে কান ধরে ফেলল। বিড়বিড়িয়ে কিছু একটা বলে দ্রুত পালিয়ে গেল।
তিহি চলে যেতে সোবহান শাইখ স্ত্রীকে ছেড়ে দিলেন। তিনি খানিকটা ঘাবড়ে গিয়েছেন। এক পাশে সরে গেলেন। সোবহান শাইখ রাশভারি চালে উপরে চলে গেলেন।
দূর থেকে সবটাই দেখছিল ইশাদ। সে তিহির পেছনেই ছিল। সামনে আম্মুকে দেখতে পেয়ে অনেক আগেই থেমে যায়। কিন্তু তিহি খেয়াল করেনি। ইশাদ দ্রুতগামীতে মায়ের কাছে এসে দাড়ায়। উদ্বিগ্ন কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“ব্যথা পাওনি তো, আম্মু?”
তিনি ছেলের দিকে তাকালেন। জবাব দিলেন না। নিঃশব্দে নিচে নেমে গেলেন।
______________________________
ফাল্গুন মাসের আটাশ তারিখ। ঝকঝকে সকাল বেলা ইশাদ ক্লিনিকের জন্য তৈরি হয়ে বাসা থেকে বের হল। সদর দরজা পেরিয়ে কয়েক কদম এগুতে থেমে যায়। আচমকা পেছন ঘুরে। সরাসরি চোখ রাখে ছাদে। যা ভেবেছিল তাই। তিহি ছাদে দাঁড়িয়ে আছে। সোজা দৃষ্টি তার উপর। কিন্তু ইশাদকে ঘুরতে দেখে সে টুপ করে বসে পড়ে। হারিয়ে যায় ছাদের ঘেরাও করা পাঁচিলে! ইশাদ মৃদু হাসে। ক্ষণকাল চেয়ে থাকে তিহির দাঁড়িয়ে থাকা স্থানে। অপেক্ষা করে আরেক বার তার দেখা পাওয়ার। কিন্তু না। এই মেয়েটার সাথে সে কখনোই পেরে উঠে না। এবারও পারল না। মিনিট কয়েক পেরিয়ে যেতেও যখন তিহির দেখা পেল না তখন সে আশাহত হল। হাত ঘড়িটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। আরেকবার ছাদে চোখ ফেলে বড় বড় পা ফেলে গেটের উদ্দেশ্যে। অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে।
ইশাদের বিপরীতে চেয়ার দখল করে আছে এক অল্প বয়সের ছেলে। বয়স আঠারো কি উনিশ হবে। গায়ের রঙ ময়লা। চোখের নিচে কালসিটে ঘন ছাপ। মুখভর্তি চাপদাড়ি। দীর্ঘদিন যে নাপিতের ছোঁয়া পড়েনি বোঝা যাচ্ছে। উসকোখুসকো চুলে কপাল ঢেকে আছে। শরীরের শার্টটা ঢিলে হয়ে গলার কাছের হাড়টা বেরিয়ে আছে। ইশাদ তীক্ষ্ণ নজর ছেড়ে বলল,
“কী সমস্যা?”
ছেলেটি কথার কোনো জবাব দিল না। ইশাদ পুনরায় প্রশ্ন করতে চাইলে,পাশ থেকে একজন মহিলা বললেন,
“কিছু দেখতে পায় না,স্যার।”
ইশাদ ছেলেটির থেকে চোখ সরিয়ে মহিলার উপর রাখল। দুজনে পাশাপাশি বসে আছে অথচ এতক্ষণ মহিলাটিকে খেয়ালই করেনি ইশাদ। এবার করল। বলল,
“কী হয় আপনার?”
মহিলা বোরকার আড়াল থেকে হাত বের করে পাশের ছেলেটির শরীরে সস্নেহে হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“আমার ছেলে।”
“একদমই দেখতে পায় না?”
“জানিনা স্যার।”
মহিলাটির এমন উত্তরে কিঞ্চিৎ আশ্চর্য হলো ইশাদ। একজন মা হয়ে এমন উদাসীন উত্তর কী করে দেন? ইশাদ তার পেছনের কালো বোর্ডের কাছে চলে গেল। গুটি কয়েক অক্ষর তুলে ছেলেটির দিকে প্রশ্ন ছেড়ে দিল,
“বলুন তো এখানে কী লেখা আছে?”
এবার ছেলেটি নড়েচড়ে বসল। ইশাদের কথামতো বোর্ডের দিকে অনেক্ষণ তাকিয়ে রইল। পরিশেষে একফালি হাসি নিয়ে বলল,
“সানজিদা!”
ইশাদের ভ্রূজোড়া কুঁচকে গেল। সে কি লিখতে ভুল করল? নিজের সংশয় কাটাতে নিজেই নিজের লেখা পরখ করে। না,সেতো সানজিদা লেখেনি। নাম তো দূর কোনো শব্দও লেখেনি। স্বরবর্ণ লিখেছে। ইশাদ হাত দিয়ে স্বরবর্ণ মুছে এ,বি,সি,ডি লিখল। তারপর গম্ভীর স্বরে বলল,
“এবার বলুন কী লেখা?”
ছেলেটি আবারও বোর্ডের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটে পূর্বের হাসিটি এখনো লেগে আছে। হাসি দীর্ঘ করে আবারও বলল,
“সানজিদা।”
ইশাদ কিছু বলার আগেই মহিলাটি কেঁদে দিল। ভেজা কন্ঠে বলল,
“এইডাই সমস্যা। আমার পোলাডা সানজিদা রে ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। ভাত খাইতে দিলে কয়,’মা,তুমি আমার সানজিদা রে খাইতে দিছো ক্যান?’ আচ্ছা আপনিই কন,আমি মানুষ হইয়া কি মানুষ রে রান্ধা করুম?”
মহিলাটির কথায় ইশাদ বিস্ময়ের চূড়ায় অবস্থান করল।
বিস্মিত গলায় বলল,
“এই সানজিদা কে?”
সানজিদার প্রসঙ্গ উঠতে মহিলার চোখের পানি শুকিয়ে যায়। রাগে ফুঁসে উঠে অনর্গল নানা কাহিনী তুলে ধরে। যার মূল কথা হলো, সানজিদা এই ছেলের এককালের প্রেমিকা ছিল। কিন্তু এখন সে অন্যের স্ত্রী! ইশাদ পুরো ঘটনা শেষে ড্রয়ার থেকে একটা কার্ড বের করে মহিলার হাতে ধরিয়ে দিল। বলল,
“আপনি ড.ইমদাদ হোসেনের সাথে দেখা করুন। এখান থেকে বের হয়ে রিকশায় উঠলে পনেরো মিনিট লাগবে। বলবেন আমি পাঠিয়েছি।”
মহিলাটি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ছেলেটিকে নিয়ে বের হয়ে গেল। ইশাদ অনেক্ষণ খালি চেয়ারটিতে তাকিয়ে রইল। সহসা মুখ ফুটে বেরিয়ে এল,’আমারও কি ড.ইমদাদের সাথে দেখা করা উচিত? ইশাদ ভয়ে ভয়ে জায়গায় বসে থেকে পেছনের বোর্ডের দিকে তাকাল। অবাক কান্ড,সাদা রঙের চকের গুড়ায় তিহি নামটি চিকচিক করছে!
________________________________
দুপুরে লাঞ্চ সেরে নিজ চেম্বারে অগ্রসর হচ্ছিল ইশাদ। হঠাৎ অপেক্ষা কক্ষে এক বোরকা পরিহিতার দিকে চোখ যায়। মুহুর্তেই চাপ পড়ে মস্তিষ্কে! আবছা আবছা মনে পড়লেও সে নিশ্চিত হলো এই বোরকা পরিহিতা সকাল থেকেই এখানে বসে আছেন। কার জন্য? ক্লিনিকে তেমন ভীড় নেই। তেমন কোনো বিশেষ রোগীও ভর্তি নেই তাহলে ইনি বসে আছেন কেন? তার বসার ভঙ্গি বলছে,তিনি ইশাদের চেম্বারের দিকেই নজর রেখে বসে আছেন। তাহলে কি তার অপেক্ষায় আছে? ইশাদের ভাবনার মধ্যেই পাশ দিয়ে একজন নার্স যাচ্ছিল। ইশাদ তাকে থামিয়ে ইশারায় বলল,উনাকে তার চেম্বারে পাঠিয়ে দিতে। ইশাদ ভেতরে ঢুকতে পেছন থেকে নার্স জানাল,
“উনি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। পরে আসবেন বললেন।”
ইশাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে আবার ভাবনায় ঢুকে গেল। তাহলে কি সকাল থেকেই কারো জন্য অপেক্ষা করছেন? এভাবে এক বসায় এতটা সময় কাটিয়ে দিচ্ছেন? অসুবিধা হচ্ছে না? যার জন্য এত অপেক্ষা সেই বা আসছে না কেন? ইশাদের রাগ হল। অন্যের জন্য মিছে রাগ করে কী লাভ? সে ব্যাপারটা এখানেই মুছে ফেলল।
ঘন্টার কাঁটা সাতটায় পৌঁছুতে ইশাদ ক্লিনিক থেকে বের হওয়ার তোরজোর শুরু করে। কেবিন থেকে বের হতে সেই বোরকা পরিহিতা নজরে পড়ল। এখনোও বসে আছে! একি ভাবে। সামান্যতমও নড়েনি যেন। ইশাদ আর থেমে থাকল না। সে নিজ থেকেই তার সামনে গেল। আন্তরিকতাসহিত বলল,
“পেশেন্ট কি আপনি? একা দেখাতে ভয় পাচ্ছেন? ভয়ের কিছু নেই। আপনি চাইলে..”
ইশাদ কথা শেষ করার আগেই সে মুখ ঘুরিয়ে নিল। যেন,বিরক্তে তার বমি পাচ্ছে। ইশাদ অপমানিত বোধ করল। আর একটা শব্দও ব্যয় না করে গটগটে ক্লিনিক ছেড়ে বেরিয়ে এল। হাতের ইশারায় খালি রিকশা ডাকল। তখনি অনুভব করল তার পাশ ঘেষে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ইশাদ ঘাড় ফেরায়। অবাক হয়। বিরক্তও হয়। তবুও ভদ্রতা বজায় রেখে বলল,
“ভয় কমেছে? চিকিৎসা নিবেন? যদিও আমার ডিউটি শেষ। তবুও আপনি দেখাতে চাইলে আবার ফিরব।”
বিপক্ষ থেকে কোনো উত্তর এল না। তার দিকে তাকানোর প্রয়োজনবোধও করল না। ইশাদ প্রচন্ড ক্ষেপে যায়। সে দূরত্ব বজায় রেখে অন্য পাশে সরে আসে। ততক্ষণে রিকশা চলে এসেছে। ইশাদ রিকশায় প্রায় উঠে পড়েছিল। সহসা সে পেছন তাকায়। রিকশা থেকে নেমে পড়ে। ধীর পায়ে হেঁটে যায় বোরকা পরিহিতার কাছে। তার পাশ ঘেষে দাঁড়ায়। কাঁধে কাঁধের ছোঁয়া লাগতে মেয়েটি সরে যেতে চাইল। ইশাদ তার পূর্বেই হাত চেপে ধরে বলল,
“রিকশায় উঠো,তিহি।”
তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। কালো বোরকার মধ্যে চোখের শূভ্র অংশ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠে। ইশাদ এক গাল হেসে বলল,
“তোমার কী মনে হয়,সর্বাঙ্গ ঢেকে আসলেই আমি চিনতে পারব না? তোমাকে চেনার জন্য এই চোখ দুটোই যথেষ্ট। তবে আমি নিশ্চিত চোখ দেখারও প্রয়োজন নেই। শুধু একটি গাঢ় নিশ্বাস টানলেই চিনতে পারব!”
তিহি চোখ দুটো সরু করে ফেলে। মুখ ঘুরিয়ে নেয়। ইশাদ আরেকটু কাছে সরে আসে। দ্রুত চারপাশে চোখ বুলায়। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলল,
“নষ্ট পুরুষের নষ্টামি দেখতে না চাইলে রিকশায় উঠে বসো। জলদি!”
চলবে