তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,২৪,২৫

0
780

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,২৪,২৫
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২৪)

বিশাল আকাশে চাঁদ তার জোসনা ছড়াচ্ছে গৌরব ভরে! তাকে সঙ্গ দিতে অসংখ্য তারাদেরও জুড়ি নেই। যে যতটুকু পারছে নিজের অঙ্গের সবটুকু শূভ্র আলো তীব্রভাবে ফুটিয়ে তুলছে। যেন এতেই তার সুখ,আনন্দ,প্রশান্তি,আত্মতৃপ্তি! তাদের মতো আরেকজনও যে আত্মতৃপ্তি লুটে নিচ্ছে তা কি কেউ খেয়াল করছে? তিহির উদাস চেহারায় কাটায় কাটায় বসানো সব সৌন্দর্যকেই যেন চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে ইশাদ! হারিয়ে যাচ্ছে এক অন্য দুনিয়ায়। যেখানে লেখা হয় ভালোবাসার নতুন নতুন অধ্যায়। তিহিকে এতটা কাছ থেকে এতটা নিঁখুতভাবে এই প্রথম দেখছে। মনে মনে লিখছে হাজারও অনুভূতিময় কাব্য,কবিতা। রিকশার বেল বাজানোর শব্দে ইশাদের ভ্রম কাটে। ঠোঁটে ভেসে উঠে মৃদু হাসি। তিহি তখনো দু’চোখ মেলে রাস্তার বৈচিত্র দেখায় ব্যস্ত। পাশ থেকে যে একটা ছেলে তার অজান্তেই জাল বুনে নিজেই ফেঁসে যাচ্ছে সে খেয়াল তার নেই। ইশাদের সামান্য অভিমান হল। তবে তাকে মুক্ত করা বদলে পোষ মানিয়ে অন্তরে লুকিয়ে বলল,

“আমার উপর নজরদারি শুরু করেছো কবে থেকে?”

তিহি ঘাড় ঘুরিয়ে নিল ইশাদের দিকে। এক পলক দৃষ্টি রাখল ইশাদের মুখ পানে। সঙ্গে সঙ্গে সরিয়ে নিল। সামনে থেকে ছুটে আসা রিকশার দিকে তাকিয়ে আছে। রিকশাটি খুব দ্রুত তাদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তিহি চোখ বোজে ফেলে। সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে,রিকশায় একটি ছেলে ও মেয়ে বসে ছিল। ছেলেটি আলতো করে মেয়েটিকে জড়িয়ে রেখেছে। পুরো মুখজুড়ে ছিল কর্তব্যপরায়ণতা। যার আড়ালে লুকিয়ে আছে সীমাহীন ভালোবাসা। মুহূর্তেই তিহির সারা শরীরে ঈর্ষারা জ্বলে উঠল। এমন একটা হাত তার কেন নেই? এমন একটা মানুষ তার কেন নেই? সে ও তো রিকশায় বসে আছে। ভয় পাচ্ছে,যদি পড়ে যায়! কই, কেউতো তার ভয়কে তাড়িয়ে দিচ্ছে না। হালকা স্পর্শ মেখে বলছে না,ভয় পেয়ো না,তিহি। এই তো আমি আছি।

তিহির মন খারাপ হল। তার মনের উঠোনে মন খারাপের বৃষ্টি শুরু হয়েছে। শুকনো মাটি কাঁদাতে পরিণত হচ্ছে। সেই কাঁদায় হাঁটতে গেলেই সে হোচট খেয়ে পড়বে নিশ্চিত।

“নজরদারি কি শেষ? নাকি আরো দীর্ঘ ব্যাপী হবে? ফলাফল জানার জন্য হৃদয়টা উশখুশ করছে যে।”

তিহি পুনরায় দৃষ্টি রাখল ইশাদের দিকে। সে কী বলছে তার প্রতি বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তার মস্তিষ্কে তখন অন্য খেলা চলছে। ঈর্ষার খেলা। তিহি ইশাদের হাতের দিকে তাকাল। ঘন ও দীর্ঘ পশমে ঢাকা হাতদুটি একত্রে হাঁটুর উপর রাখা। তিহির ঠোঁট উল্টে কান্না আসছে। সে কান্না আটকাতে পারছে না। ছলছল নয়নে ইশাদের দিকে তাকাল। নাকের আগা লাল হয়ে আসতেই ইশাদের কাতর গলা,

“আরে, কী হলো? তিহি,কাঁদবে না। আমার কথায় কি আঘাত পেয়েছো? কোন কথায়? আচ্ছা,আমার কিছু লাগবে না।”

তিহির কান্না আটকানোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ইশাদ। কিন্তু বেশিক্ষণ কাজ হলো না। তার চোখের কিনার ভেঙে অশ্রুর ঢেউ আচড়ে পড়ল দুই গালে!

তিহির চোখের জল মুছে দেওয়ার জন্য হাত দুটো উঠে এলেও পথিমধ্যেই থমকে গেল। ভয় কাজ করছে। না ধরে, না ছুঁয়েই এই অবস্থা। ছুঁয়ে ফেললে কোন কান্ড ঘটবে কে জানে! ইশাদের প্রচন্ড রকমের অস্বস্থি হচ্ছে। দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে চুপচাপ চেয়ে আছে তিহির জলে ভাসা চোখ দুটিতে। তিহি অনেক্ষণ কাঁদল। তার চোখের শূভ্র অংশ এখন রক্তিম! হঠাৎ আসা কান্নাটা হঠাৎই হারিয়ে গেল। বোরকার এক অংশ দিয়ে মুখ মুছে বলল,

“বাসায় পৌঁছাতে আর কতক্ষণ লাগবে?”

তিহির আকস্মিক সহজ প্রশ্নটা ইশাদের মাথায় ঢুকল না। সে বিস্ময়ে চেয়ে আছে তিহির দিকে। কী অদ্ভুত!

তিহি ইশাদের দিকে তাকাল। চোখে,মুখে বিরক্তের ছটা নিয়ে জোরাল গলায় বলল,

“কোথায় হারালেন?”
“বুঝতে পারছি না।”
“কী বুঝতে পারছেন না?”
“তোমাকে।”

তিহির বিরক্তরা হারিয়ে গেল। নির্লিপ্তে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। চলছে নীরবতার মুহূর্ত! আচমকা ইশাদের হাত চেপে ধরে। কাঁধে মাথা ফেলে আহ্লাদী গলায় বলল,

“আমি এখন বাসায় যাব না। আরেকটু ঘুরব৷ প্লিজ!”
“এই রাতে? আমরা তো প্রায় চলে এসেছি। মোড় ঘুরলেই বাসা।”

তিহি চোখ বন্ধ করে নিল। প্রলম্বিত নিশ্বাস নিল। ইশাদের হাতটা আরো গভীরে জড়িয়ে ধরল। আরেকটু কাছে চেপে নরম সুরে বলল,

“আমি নামব না। এখন আপনার ইচ্ছে।”

ইশাদ তিহির কথা জবাব দেওয়ার পূর্বেই রিকশার উদ্দেশ্যে বলল,

“মামা,সোজা যান।”

রিকশাওয়ালা ততক্ষণে মোড়ের ডান দিকে চাকা ঘুরিয়ে ফেলেছিল। হঠাৎ নির্দেশ পাওয়ায় বেতাল হয়ে যায়। সেকেন্ড কয়েক সময় নিয়ে তাল ঠিক করে। সামনে পিচ ডালা পথ ধরে শোঁ শোঁ আওয়াজ তুলে। বাতাসের দাপটটাও যেন বেড়েছে। গায়ে লাগার মতো। ইশাদ তিহির দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে আপনমনে শ্বাস নেওয়ার কার্যকলাপ চালাচ্ছে। চোখের ঘন পাপড়ি মৃদু কাঁপছে। বাতাসে কি? ইশাদ এক পাশের ঠোঁট টেনে হাসে। ছড়িয়ে পড়া বোরকার নিচের অংশ ভেতরে টেনে আনছে। তিহির ঠোঁটজোড়া নড়ে উঠল। অস্পষ্ট গলায় বলল,

“আমি প্রতিদিন ঘুরব। আপনি কিন্তু না করতে পারবেন না। তাহলে কিন্তু আমি আপনার ক্লিনিকের সামনে অনশন পালন করব।”
“আজও বুঝি অনশন চলছিল?”

তিহি চোখ খুলল। মাথা তুলে হালকা রাগ নিয়ে বলল,

“আমার কত কষ্ট হয়েছে জানেন? একটু খেতেও দিলেন না। একা একা খেয়ে আসলেন। কোমর ব্যথা করছিল। আপনি খুব খারাপ।”

কথাটা শেষ করেই তিহি নিজের হাত গুটিয়ে নিল। ইশাদের থেকে একটু দূরত্ব তৈরি করে বসল। তিহির অভিমানি মুখের দিকে নীরব দৃষ্টি ইশাদের। মন চাইলেও সে অভিমান ভাঙল না। অন্য দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল। তখনি ফোনটা বেজে উঠে। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে রিসিভ করল,

“ইশাদ কোথায় তুই? জলদি বাসায় আয়।”

শাহিনা শাইখার কন্ঠে উদ্বিগ্ন। ইশাদ দ্রুত বলল,

“কেন,আম্মু? কী হয়েছে?”
“বাড়িতে পুলিশ এসেছে।”
“পুলিশ?”
“হ্যাঁ, তোর রেখা আন্টি নিয়ে এসেছে। আমি তো কিছুই বুঝছি না। এদিকে তোর বাবাও বাসায় নেই।”

শাহিনা শাইখার বিপরীতে কথা বলার সুযোগ পেল না,ইশাদ। কল কেটে দিয়েছে। কী থেকে কী হচ্ছে বুঝতে পারছে না। কপালে এক ঝাক দুশ্চিন্তা বসে পড়তে,ইশাদ তিহির দিকে তাকাল। সহসা বলল,

“তিহি,তুমি আন্টিকে বলে বেরোও নি?”

তিহির সরল উক্তি,

“না।”

ইশাদ চকিত হল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

“সত্যিই বলে আসো নি?”

তিহি বিরক্ত নিয়ে বলল,

“বললাম তো না। আপনার কী মনে হয় আম্মাকে বললে বের হতে দিবে? আপনার উপর নজর রাখতে দিবে?”
“এটা একদম ঠিক করোনি।”

কথাটা শেষ করেই ইশাদ ব্যস্ত গলায় রিকশাওয়ালাকে ফিরতি পথ ধরতে বলে। তারা অনেকটা দূর চলে এসেছে। ইশাদ আর ধৈর্য্য ধরতে পারছে না। দুশ্চিন্তায় ছটফট করছে। মা কিভাবে সামলাচ্ছে কে জানে! ইশাদ ছটফটানির মধ্যেই বার কয়েক তিহির দিকে তাকাল। তার মধ্যে কোনো চিন্তাধারা নেই। সে উদাসমনে গান ধরেছে। কী গান গাইছে? ইশাদ কি একটু শুনবে?

_________________________________

বাসার ভেতরে ঢুকতেই তিহির গালে সজোরে চড় মারলেন রেখা ভূঁইয়া। ঘটনার আকস্মিকতায় ইশাদ স্তব্ধ! সে তিহির পেছন পেছন ভেতরে ঢুকেছিল। বাসার মুখ্য দরজা খোলাই ছিল। ইশাদ কিছু বলার পূর্বেই রেখা ভূঁইয়া রাগে ফেটে পড়লেন। চোখের মনি দুটো বের হওয়ার উপক্রম। তার চোয়াল কাঁপছে! তিহিকে কিছু বলতে না দিয়ে হাত চেপে ধরলেন শক্ত করে। টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে উপরে চলে যাচ্ছেন।

ইশাদ সেদিকে ক্ষণকাল চেয়ে রইল। কাঁধে নরম স্পর্শ পেয়ে সচেতন হয়। শাহিনা শাইখা মিহি সুরে বললেন,

“তোর দাদি এসেছেন।”

ইশাদ সামনে তাকায়। সোফার মধ্যে পা তুলে বসে আছেন মেহেরুনা শাইখা। হাতে তসবি। ঝিমুচ্ছেন! ইশাদ সেদিকে পা ফেলতে গিয়েও থেমে গেল। মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,

“তুমি যে বললে,পুলিশ এসেছে? কোথায়?”
“মাত্রইতো গেল। দেখিসনি?”

ইশাদ মাথা নাড়ে দুইদিকে। শাহিনা শাইখা ছেলের মাথায় শক্ত চাপড় মেরে বললেন,

“তোর মন কোথায় পড়ে আছে? চোখের সামনে দিয়ে জলজ্যান্ত মানুষ হেঁটে চলে যায় অথচ তুই দেখিসই না!”

ইশাদ মেহেরুনার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। কোলের উপর হাতের ভর ফেলে কোমল সুরে বলল,

“অবশেষে বুড়ির রাগ পড়ল!”

মেহেরুনা শাইখা চমকে উঠলেন। হাতের তসবি পড়ল ইশাদের মাথায়। চমকানো পর্ব শেষ করে তসবি তুলে নিলেন। ইশাদের মাথা দু হাতে চেপে ধরলেন। চুলের উপর দীর্ঘ ফুঁ দিলেন কয়েক বার। বললেন,

“এখনো পুরোপুরি পড়ে নি। একটুখানি বাকি আছে। তোর বউ দেখার লোভে ছুইটা আইছি।”
“তসবি হাতে নিয়ে মিথ্যে কথা?”

মেহেরুনা শাইখা তসবি পাশে রেখে দিলেন। আশেপাশে নজর বুলিয়ে বললেন,

“তোর সাথে কথা আছে। গোপন কথা। আমারে উপরে নিয়া চল।”

ইশাদ দাদির কোল থেকে মাথা আর হাত সরিয়ে নিল। উনাকে কোলে তুলে নিতে উদ্যত হতে,তিনি থামিয়ে দিলেন। চোখের ইশারায় দরজার দিকে তাকাতে বললেন। সোবহান শাইখ ভেতরে ঢুকছেন। কয়েক কদম এগিয়েই মেহেরুনাকে দেখতে পেলেন। চোখ পড়েও যেন পড়ল না। সোজা হাঁটা ধরতে মেহেরুনা শাইখা গলার স্বর উঁচুতে তুলে ইশাদের উদ্দেশ্যে বললেন,

“এক দিক দিয়া তোর বউ ঢুকব আরেক দিক দিয়া আমি বাইর হইয়া যামু। এখানে থাকলে আমি একদিনও বাঁচুম না। মনে হইতাছে,বাড়িতে না কবরে ঢুইকা বসে আছি।”

সোবহান শাইখ চলতিপথে থামলেন। কিন্তু মায়ের দিকে ঘুরে তাকালেন না৷ যেন হাঁটায় বিরতি রেখেছিলেন। বিরতি শেষে বড় বড় পা ফেলে উপরে উঠে গেলেন। ছেলের এহেন আচরণে মেহেরুনা শাইখা জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। তসবি তুলে শক্ত গলায় বললেন,

“চল।”

ইশাদ দাদিকে কোলে তুলে সিঁড়ি কাটছেন। কয়েক ধাপ এগুতে তার বহু আগের একটি বিষন্ন দিনের কথা মনে পড়ে। তখন ইশাদ ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে মাত্র। ক্লাস শুরু হয়নি। ঐদিনই প্রথম ক্লাস। সে বেশ উৎসাহসহিত নতুন ইউনিফর্ম পড়ে নিল। চোখে,মুখে আনন্দ আর উৎফুল্ল। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বাবার হাত ধরে বলল,

“আব্বু,আমি রেডি।”

সোবহান শাইখ ছেলের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলেন। ছেলের সামনে বসে,আদুরী গলায় বললেন,

“তোমার ইচ্ছে হয় না,আমার সাথে সবসময় থাকতে?”
“করে তো। খুব করে। কিন্তু তুমি তো চলে যাও,আব্বু।”

সোবহান শাইখ সামান্য হাসলেন। ছেলের হাত দুটো এক করে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বললেন,

“তুমিও আমার সাথে চল। তাহলেই আর যাব না। সবসময় তোমার সাথে থাকব। চব্বিশ ঘন্টা। আমার ওখানে সব থেকে ভাল স্কুলে তোমাকে ভর্তি করাব।”

ইশাদ কিছু বলার পূর্বেই মেহেরুনা শাইখা ছুটে এলেন। ইশাদকে নিজের দিকে টেনে নিয়ে খেঁকিয়ে উঠলেন,

“এগুলা কী বলস? তোর কি মাথা নষ্ট হয়ে গেছে? জানস না শাহিনা ওরে কত ভালবাসে? বউডার কলিজা কাইটা নিতে চাইতাছস?”

সোবহান শাইখ বসা থেকে উঠলেন। সহজ গলায় বললেন,

“ছেলেতো শুধু তোমার বউমার না। আমারও। সে যেমন ভালোবাসে। আমিও তেমন ভালোবাসি। তুমি এভাবে একপক্ষ হয়ে যাচ্ছো কেন? আমারও তো ইচ্ছে হয়,ছেলেকে নিয়ে সময় কাটাতে।”
“তো মানা করছে কে? চলে আয়। বউ,ছেলে নিয়ে সংসার কর।”

সোবহান শাইখ চাপা নিশ্বাস ছেড়ে বললেন,

“সম্ভব না।”
“তাহলে আমার সামনে থেকে দূর হ। ফের যদি আমার নাতি রে এসব কথা বলতে দেখি তাহলে দাউ দিয়া কুব দিমু। তোর বুকে হৃদয় না পাথর বসানো!”

ইশাদ চুপচাপ দাদি আর বাবার কথপোকথন শুনছিল। কিছু বলতে পারে নি। বাবাকে সে প্রচন্ড ভালবাস তো। মাকেও! কোনো একজনকে ফেলে কি আরেকজনের কাছে যাওয়া যায়? সেদিন দাদি তাকে অনেক কিছু বোঝায়। ইশাদ কি বুঝল না বুঝল জানে না। তবে এইটুকু ভাল করে মনে গেঁথে দিয়েছেন,তার বাবা তাকে মায়ের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যেতে চায়। সব কথা শেষে দাদি সতর্ক করে দিয়েছিলেন,এ কথা যেন ঘুনাক্ষরেও মায়ের কানে না যায়। ইশাদও বলেনি। কী করে বলবে? মায়ের একটু মন খারাপ দেখলেই যে তার হৃদয় পুড়ে উঠত। এরপর থেকেই সে বাবার থেকে দূরত্ব শুরু করে। সেই দূরত্ব এখনো বাড়ছেই!

দাদিকে বিছানায় নামিয়ে দিল ইশাদ। তাকে অপেক্ষা করতে বলে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। মুখে ঠান্ডা পানির ঝটকা দিতেই,কানে ভয়ংকর আর্তনাদের শব্দ পেল। ইশাদ হুড়মুড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হয়। মেহেরুনা শাইখা আতঙ্ক কন্ঠে বললেন,

“কী হইল? কে চিৎকার করছে?”

ইশাদ দাদির কথার উত্তর দিল না। ছুটে বাইরে চলে আসে। চিৎকারটা একবারই বেজেছে। মনে হচ্ছে মিহির গলা। মিহির কিছু হলো নাতো? সিঁড়ির কাছে আসতেই ইশাদ থমকে গেল। মিহি আর তিহি একসাথে সিঁড়ির মুখে দাড়িয়ে আছে। দুজনেই কাঁপছে। একজন রাগে আরেকজন ভয়ে। একটু দূরেই ইনা থেমে থেমে কাঁদছে। ইশাদ আরেক কদম এগুলে মিহি টানা টানা স্বরে বলল,

“তিহি আপু অয়নকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিছে!”

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২৫)

“তিহি আপু অয়নকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিছে!”

ইশাদ অতিশয় ব্যাকুলভঙ্গিতে সিঁড়ির মুখে ছুটে আসে। সিঁড়ির ভাগে ভাগে সাজানো ছয় নাম্বার স্তরে অয়নের ছোট্ট দেহটি পড়ে আছে। কপালের এক পাশে রক্ত উগলে পড়ছে। শরীরে জড়ানো হাফ স্লিভ শার্টটির নিচের অংশ কুঁচকে ধবধবে পেট বের হয়ে আছে। তাতে লালচে দাগ! এক হাত বাঁকা হয়ে পিঠের নিচে চাপা পড়েছে। পায়ে পা প্যাচানো। ইশাদ আতঙ্কে ফেটে পড়ছে। বুদ্ধি লোপ পেয়েছে। কোনো উদ্যোগ নেওয়ার পূর্বেই অয়নের মা,বাবা ছুটে এসেছেন। গলা ফাটিয়ে চিৎকার তুলছেন। সেই কান ফাঁটানো ভয়ংকর চিৎকারে ইশাদ চৈতন্য ফিরে পেল। শশব্যস্ততায় অয়নকে কোলে তুলে নিল। অয়নের বাবাও নিজের পোক্ত হাতে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। উৎকন্ঠায় চেঁচিয়ে বললেন,

“হসপিটালে নিয়ে চল। জলদি!”

পেছন থেকে অয়নের মা জলপূর্ণ কঠিন চাহনি ফেললেন সিঁড়ির বিপরীত মুখে থাকা সকলের উপর। হুংকার ছেড়ে বললেন,

“আমার ছেলে পড়েছে কিভাবে?”

প্রশ্নটা কানে যেতে ইশাদ বিদ্যুৎ বেগে পেছন ঘুরে। সরাসরি চোখের দৃষ্টি ফেলে মিহির উপর। চোখের ইশারায় সতর্ক করে দেয়। মাথাটা হালকা নাড়িয়ে বোঝায়,তিহিকে রুমে পৌঁছে দিতে।

অয়ন চিকিৎসাধীন আছে। মাথায় সাদা ব্যান্ডেজ মুড়ে দিচ্ছে ডাক্তার। ইশাদ কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। তার মাথায় চিন্তাশক্তি কাজ করছে না। ক্লান্ত লাগছে খুব। অবিশ্বাস্যের জোয়ার বয়ছে মস্তিষ্ক জুড়ে! এমন ভয়ংকর,বীভৎস কাজটা তিহি করল কিভাবে? এটাতো কল্পনার বাইরে। তিহি কি এতটাই হীনচেতা? ইনার সাথেও তো কম দুরাচার করছে না। তার আঁখি সাক্ষী সে নিজে। তাহলে কি তিহির মধ্যে কোনো পাপিষ্ঠের বাস? যে ফেরেশতা তুল্য বাচ্চাটাকেও ছাড়েনি! ইশাদ ক্লান্ত শরীরের ভার ছেড়ে দেয় শূন্য চেয়ারটিতে। পিঠ এলিয়ে পা দুটো টান টান করে মেঝেতে রাখে। জড়িয়ে পড়ে ক্ষতবিক্ষত ভাবনার জালে। চোখ দুটো বন্ধ করে নেয় অবসাদে।সেই সময় তার পায়ের সাথে অন্য কারো পা বাড়ি খায়। ইশাদ চট করে চোখ মেলে পা টেনে নিয়ে সামনে তাকায়। হসপিটালে কর্মরত নার্স মেঝেতে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন। বিরক্তে আর রাগে বিশাল পরিসরের হাসপাতাল কাঁপিয়ে তুলার আগেই ইশাদ ব্যস্ত গলায় বলল,

“সরি,সরি। আমি খুবই দুঃখিত। আমি বুঝতে পারিনি,আপনি এখনি এই পথে যাবেন।”

ইশাদের হাতজোড় করে নত হওয়াটা বুঝি কাজ করল না। মধ্যবয়সের নার্স ফুঁসে উঠলেন। নাক উঁচিয়ে অত্যধিক কর্কশ গলায় বললেন,

“এখানে চেয়ার দেওয়া হয়েছে বসার জন্য। হাত,পা ছড়িয়ে শোয়ার জন্য নয়। ভদ্র পোষাক পড়ে দোষ করে বেড়ান আপনারা,আর ভোগান্তি পোহাতে হয় আমাদের। আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে,আগে আপনাকে জানানো উচিত ছিল আমি এই রাস্তায় আসব, তাই না?”

ইশাদ লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। আশেপাশের সবার চোখ তার উপর। পরিস্থিতি আরো খারাপে চলে যেতে পারে। তাৎক্ষনিক কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু কী? ইশাদ আরেক বার চারপাশে চোখ বুলাল। অতি সাবধানে পকেট থেকে একটি নোট বের করল। নার্সের হাতে দিয়ে মৃদু গলায় বলল,

“আমি আসলেই দুঃখিত!”

ইশাদ নিঃশব্দে হাতপাতাল থেকে বেরিয়ে এল।

_________________________________

নিজ বাসার কলিং বেল চাপতে দরজা খোলে গেল। দরজার অপর পাশে ইশাদের ফুপি সুমি দাড়িয়ে আছেন। তাঁর কোলে ছোট মেয়ে নিপা। বয়স এগারো পার হয়েছে। পাতলা, গৌর বর্ণের মেয়েটির ওজন বিশের উপরে। তার শ্বাস টানার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছে, তিনি হাঁপিয়ে উঠেছেন! ইশাদ অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে বলল,

“ফুপি,নিপা এখনো হাঁটতে শিখেনি?”

ইশাদের প্রশ্ন শুনে তিনি আরো বেশি হাঁপিয়ে উঠলেন। কষ্টায়িত শ্বাস টানার চেয়ে বন্ধ করে দেওয়ায় শ্রেয়। ইশাদের দিকে নিপাকে ঠেলে দিয়ে বহু কষ্টে বললেন,

“আগে ও কে ধরো পরে বলছি।”

ইশাদ ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে নিপাকে কোলে নিতে বাধ্য হল। সুমি প্রগাঢ় নিশ্বাস টানলেন। কপালে উদ্বিগ্ন ফুটিয়ে বললেন,

“হাঁটতে তো অয়নও শিখেছে। দেখলি না ওর কি হাল হল? আমার মেয়েটা তো ওর মতো মোটা,তাজাও নয়। ল্যাতপ্যাতে! ভারি ফুঁ পড়লেই উড়ে যাবে!”

ফুপির কথা শুনে ইশাদের চোখ কপালে উঠে গেল। আড় চোখে নিপার দিকে তাকাল। ঠোঁটে চাপা শিস তুলে বিড়বিড় করল,কোথায় তিন বছর,কোথায় এগার বছর!

“তুই একা! অয়ন ঠিক আছে তো?”

মায়ের দুশ্চিতা দূর করতে ইশাদ বাসার ভেতরে ঢুকল। চোখের পাতায় আস্থা ঢেলে নরম গলায় বলল,

“ঠিক আছে,আম্মু। মামা,মামি ওর সাথে আছে। একটু পরেই এসে পড়বে। তুমি চিন্তা করো না।”

শাহিনা শাইখা ছেলের কথা বিশ্বাস করলেও দুশ্চিন্তামুক্ত হতে পারছেন না। বাচ্চাটার রক্তাক্ত মুখটা চোখে ভেসে উঠলেই শিউরে উঠছেন। না জানি কতটা কষ্ট পাচ্ছে!

ইশাদ নিপাকে সোফায় রেখে মিহিদের রুমের দিকে এগোয়। তিহির দ্বারা ঘটিত অত্যন্ত কদাকার,ঘৃন্য,ভয়ঙ্কর ঘটনার সাক্ষি ছিল মিহি। সেই সময়ে কী এমন ঘটেছিল যে তিহি এই নির্মম কাজটি করল? কিছু একটা তো হয়েছে। এমনি এমনি একটা বাচ্চাকে ধাক্কা দিবে কেন? দুর্ঘটনাও তো হতে পারে। হয় তো মিহি ব্যাপারটা আঁচ করতে পারেনি। ভেবেছে তিহি ইচ্ছে করে ধাক্কা দিয়েছে। ইশাদ মনের সংশয় দূর করতে মিহিদের দুয়ারে এসে দাঁড়াল। দরজায় হালকা আঘাত করে ডাকল,

“মিহি? ভেতরে আছো?”

ভেতর থেকে সাথে সাথে জবাব আসেনি। কয়েক সেকেন্ড পর উত্তর আসল,

“হুম। কেন?”
“আমার রুমে আসো। তোমার সাথে কথা আছে।”
“আমি তো এখন ঘুমাব। কাল কথা বলব।”

মিহির কন্ঠে ভয়ের ছোঁয়া। তাহলে কি সে ইশাদের সামনে আসতে ভয় পাচ্ছে? নাকি অয়নের ব্যাপারটি নিয়ে এখন ভীত? ইশাদ চলে যেতে নিলে,মিহি দ্রুত বলল,

“আচ্ছা আসছি।”

কথাটা শেষ করেই মিহি মায়ের দিকে তাকাল। দুজনে পাশাপাশি শুয়ে ছিল। মায়ের কাছ থেকে সরে গেল সামান্য। রুবিনা মেয়ের শরীর থেকে কাঁথা সরিয়ে নিলেন। হাত দিয়ে খোলা চুলে রাবার প্যাঁচিয়ে বললেন,

“রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। আর তো একটা দিন। তারপর ঐ রুমেই তোকে থাকতে হবে। অভ্যাস কর। ভালোবাসা দুয়ারে খটখট করছে আর তুই ফিরিয়ে দিবি? জলদি যা। তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”

মায়ের জোরাজুরিতে মিহি ইশাদের রুমে আসতে বাধ্য হল। ইশাদ ইশারায় বিছানায় বসতে বলে। মিহি আড়ষ্টভঙ্গিতে বসে। চোখের দৃষ্টি মাটিতে!

ইশাদ সামনে এসে দাঁড়ায়। নরমস্বরে বলল,

“ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”

মিহি মাথা নেড়ে জবাব দিল। যার মানে এই-ঘুমায়নি। ইশাদ মিহির পাশে বসে। মিহি চমকে যায়। থরথর করে কাঁপছে! যেন বিশাল কোনো ভুল করে ফেলেছে। এখনি শূলে চড়াবে। ইশাদ মিহির ভয়ার্ত মুখে দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইল। যার জন্যে ডেকে আনা তা করা হবে না হয়তো। তাকে দেখে মনে হচ্ছে,তিহি নয় সে নিজেই অয়নকে ফেলে দিছে! ইশাদ মিহির ভয় তাড়াতে মাথায় হাত দিল। আলতো আদর মেখে বলল,

“মিহি সাহসী নাকি ভীতু?”

মিহি চোখ তুলে তাকায়। হাত দিয়ে খামচে ধরা বিছানার চাদর ছেড়ে দেয়। ইশাদ আবার বলল,

“আমি তো ভেবেছিলাম খুব সাহসী। সুন্দরবনের বাঘের পিছনেও ছুটতে পারবে।”

মিহির চোখ চকচক করে উঠে,

“সুন্দরবন? আমাকে নিয়ে যাবেন?”
“সে রকম পরিকল্পনাতো ছিল। কিন্তু এখন বাদ দিতে হবে মনে হচ্ছে। তুই তো ভয়ে কাঁপছিস!”

মিহির প্রদীপ্ত মুখটি নিভে গেল। মৃদু সুরে বলল,

“আমি ভয় পেয়েছি খুব। তিহি আপু হঠাৎ করে অয়নকে ধাক্কা মেরে দিল!”

মিহি নিজেই কথা টেনে আনায় ইশাদের সুবিধা হল। সে সুযোগ বুঝে জিজ্ঞেস করল,

“কেন ধাক্কা দিয়েছে?”
“ইনার জন্য।”
“ইনা?”
“হুম। আমি ইনা আর অয়নকে নিয়ে ছাদে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দুটো ঝগড়া লেগে গেল। অয়ন বলছে,আমার ভাইয়াকে তুই বাবাই ডাকবি না। ইনা বলছে,আমার বাবাইকে তুই ভাইয়া ডাকবি না। এই নিয়ে গালাগাল থেকে মারামারিতে চলে যায়। ইনা অয়নের চুল টেনে ধরল। অয়ন ইনার গালে খামচি টেনে দিল। আমি একটাকে ছাড়াইতো আরেকটা চেপে ধরে। কী অবস্থা! শেষে কী হলো কে জানে? ইনা কাঁদতে কাঁদতে ছাদে চলে গেল। ফিরে এল তিহি আপুকে নিয়ে। আমি কিছু বলার আগেই অয়নকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।”
“ইনার সাথে তিহি এসেছিল?”
“হ্যাঁ।”

মিহির বর্ণনানুযায়ী ব্যাপারটাকে একে একে সাজিয়ে নিচ্ছে ইশাদ। ইনা ছাদে গিয়ে কী করেছে? তিহির কাছে নালিশ করেছে কি? এ ছাড়া অন্য কিছু মাথায় আসছে না। তাহলে কি ইনার ছোট্ট নালিশই অয়নের উপর ভারি হয়ে পড়ল? তাই বলে এতটা? কিন্তু তিহি তো ইনাকে পছন্দ করে না। রীতিমতো চোখের কাঁটা বেধার মতো ব্যবহার করে। তাহলে?

ইশাদ ভাবনায় ডুব দেওয়ার পূর্বে মিহিকে বলল,

“আচ্ছা,তুমি এখন যাও। রাতের খাওয়া হয়েছে?”
“হুম।”
“যাও,শুয়ে পড়ো।”

মিহি নীরবে উঠে পড়ে। দরজার কাছে গিয়ে পেছন ঘুরে বলল,

“মিহি কিন্তু অনেক সাহসী। সুন্দরবন নিয়ে যাবেন না?”

ইশাদ হালকা হাসল। মাথা এক পাশে কাত করে বলল,

“যাব।”

মিহি ঠোঁটেও মিষ্টি হাসি ফুটল। হাসি হাসি মুখে ইশাদের রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। তার ঠিক পাঁচ মিনিট বাদে শাহিনা শাইখা ভেতরে প্রবেশ করলেন। আমোদিত গলায় বললেন,

“তোদের দুটিকে একসাথে দেখলে আমার চোখ জুরিয়ে যায়। ”
ইশাদ ভ্রূ কুটিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কার কথা বলছ,আম্মু?”

শাহিনা শাইখা ছেলের পাশে বসলেন। বললেন,

“কার কথা আবার? তুই আর মিহি। আমি তো ভেবেছিলাম হুট করে বিয়ে ঘোষণা করে দেওয়ায় তোদের না আবার অসুবিধা হয়। এখন মনে হচ্ছে কোনো অসুবিধা হবে না। আমার চিন্তা দূর হল। দুজনে লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেম করছিস!”

ইশাদ চোখ বড় বড় করে বলল,

“মিহির সাথে প্রেম?”
“তো কার সাথে হবে শুনি? এমন করে বলছিস যেন ভুল কিছু বলেছি? কয়টা বাজে দেখেছিস? এত রাতে হবু বউ, বরের রুম থেকে বের হল। এটা প্রেম ছাড়া আর কী হতে পারে? আমি তো স্পষ্ট দেখলাম,মিহি লাজুক হাসি নিয়ে বের হয়ে গেল।”

ইশাদ মায়ের কাছ থেকে উঠে পড়ল। কান দিয়ে গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। মুখের ভেতর তেতো ভাব ঠেকছে। মিহির সাথে প্রেম? ছি!

শাহিনা শাইখা আগ্রহ নিয়ে বললেন,

“এবার তাহলে আমার সব চিন্তা দূর হল। আমার তো ঠিক মতো ঘুমও হচ্ছিলো না রে ইশাদ! রাতদিন এক চিন্তায় মাথায় ঘুরতো। জোর করে ছেলের মাথায় নিজের ইচ্ছে চেপে দিলাম। মেনে নিতে পারবে তো?”
“তোমার ইচ্ছে নয়। বলো বাবার ইচ্ছে।”

শাহিনা শাইখা ঘাবড়ে গেলেন। বিচলিত হয়ে বললেন,

“কী বলছিস এসব? এখানে তোর বাবা আসল কোথা থেকে?”

ইশাদ মায়ের দিকে তাকাল। দৃঢ় গলায় বলল,

“বাবাতো শুরুতেই ছিল,আম্মু। পরে তুমি এসেছো।”

ছেলের তেজোদীপ্ত চাহনি আর অটল কন্ঠে শাহিনা শাইখা মিইয়ে গেলেন। চোখের দৃষ্টি শূন্যে ফেলে উদাসস্বরে বললেন,

“সেদিন কলটা তোর বাবাই করেছিল। আমি আনন্দে আত্মহারা! তিনি তো কখনো আমাকে কল করেন না। এই প্রথম করলেন। আমি ফোনটা ধরতেও পারছিলাম না। অতিশয় আনন্দে চোখ ভিজে উঠছিল,হাত কাঁপছিল। কাঁপা হাতে কল রিসিভ করলাম। সাথে সাথে উনি বললেন, তোমার কাছে আমি কখনো কিছু চাইনি। ভাবিওনি চাইতে হবে। কিন্তু আজ বাধ্য হয়ে চাইছি। তুমি কি দিবে?”

উনার এমন কথায় আমার হাত,পা ঠান্ডা হয়ে গেল। কোনো রকমে অবশ কন্ঠে বললাম,’কী?’ উনি সঙ্গে সঙ্গে বললেন,মিহিকে বাড়িতে নিয়ে এসো। আমি ওর বাবা হতে চাই। সারা জীবন চোখের সামনে দেখতে চাই।”

এইটুকু বলেই নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন শাহিনা শাইখা। ইশাদ আলতো করে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন। মজারছলে বলল,

“তোমার সুখের জন্য একটা কেন দশটাও করতে পারি। তোমার কঠোর স্বামীকে বলো,লিস্ট করতে!”

শাহিনা শাইখা হেসে ফেললেন। ইশাদের কান মলে বললেন,

“আগে একটাকে সামলে দেখা।”

_______________________________
তিহি আয়নার সামনে দাড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। চুলের অর্ধেক অংশ সামনে এনে যত্নসহকারে চিরুনির কাঁটা বসাচ্ছে। তার সাথে আরেকজনও চুল আঁচড়ানোতে ব্যস্ত! তিনি হলেন ইনা। কিন্তু তার মুখ বেজার। তিহির সাথে সে তাল মেলাতে পারছে না। তার মধ্যে চুলের মাপটাও ঠিক নেই। তিহির চুল পেট ছেড়ে কোমরে ছুঁয়েছে। কিন্তু ইনা? তার চুল তো বুক অবধি। সে মুখভার করে তিহির চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ কী বুদ্ধী খেল! দৌড়ে তিহির কালো ওড়না নিয়ে আসল। মাথায় বেঁধে নিয়ে চুলের মাপ বড় করল। সামনে এনে খুশি মনে তিহির মতো চিরুনির কাঁটা বসাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ততক্ষণে তিহির চুল আঁচড়ানো শেষ। নিজের ওড়না ইনার মাথায় দেখে রেগে গেল। চোখ গরম করে খুলে নিল। ইনার মন খারাপ হল। গাল ফুলিয়ে জানালার দিকে তাকালে ইশাদকে দেখতে পায়। ইশাদ হাতের ইশারায় ডাকে। সে নুপুরের ঝুনঝুন শব্দ তোলে ছুটে যায়। ইশাদের সামনে আসতে দু’মুঠো চুড়ি মুখের সামনে ধরে বলল,

“সোনামা,দেখতো রঙ ঠিক আছে নাকি?”

ইনা চট করে চুড়িগুলো নিয়ে পড়তে শুরু করে। দুই হাতে রিনিঝিনি শব্দ তুলে খুশিতে ফেটে পড়ে। ইশাদ গাটু ভাঁজ করে বসে। চাপাস্বরে জিজ্ঞেস করে,

“ছোট্ট ইনার কি আরো চায়?”

ইনা দ্রুত মাথা নাড়ে। আনন্দিত গলায় বলল,

“চায় তো। অনেক অনেক অনেকগুলো চায়। তিহি আপুর যতগুলো আছে।”
“তিহি আপুর কতগুলো আছে?”

ইনা দুই হাত দু দিকে মেলে বলল,

“এত্তগুলো।”
“ওকে। তুমি আমাকে রঙগুলো বলে দিও। কেমন?”

ইনা ইশাদের গলা জড়িয়ে ধরল। ইশাদ ওর চুলে হাত রেখে বলল,

“ইনা সব থেকে বেশি কাকে ভালবাসে?”

ইনার চটপটে উত্তর,

“তিহি আপুকে।”
“ইনার তিহি আপুও কি ইনাকে ভালোবাসে?”

ইনা ইশাদের গলা ছেড়ে দিল। হৃষ্টচিত্তে বলল,

“হুম। সব থেকে বেশি ভালোবাসে।”

ইশাদের ভ্রূজোড়া কুঁচকে যায়। মাত্রই তিহির ইনার প্রতি রূঢ় ব্যবহার দেখেছে। তারপরও এই মেয়ের ভালোবাসার লেনদেনের দুই পাশেই তিহি। এই পরিবারের সকলেই অদ্ভুত!

ইশাদ রুমে ঢুকে সামান্য অবাক হল। তার বিছানার সিংহভাগ দখল করে আছে অর্নভ। অর্নভ তার ফুপাতো ভাই। ফোনে ফোনে আলাপ,পরিচয়,স্নেহ,ভালবাসা প্রদান হয়েছে এত দিন। এই প্রথম সামনাসামনি দেখা। আন্তরিকতা কতটা প্রযোজ্য হবে কে জানে! ইশাদের উপস্থিতে অর্নভ উঠে বসল। কোনো রকম অস্বস্থির জায়গা না দিয়ে সহজভাবে বলল,

“ভাইয়া,আমি প্রেমে পড়েছি। যাকে বলে,প্রথম দেখায় প্রেম!”

প্রথম আলাপে এই ধরনের কথায় ইশাদ খানিকটা বিব্রত হলো। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

“মানে?”
“এত দূর থেকে মানে বোঝানো যায় নাকি? এদিকে এসো।”

অর্নভ,ইশাদকে টেনে বসাল। আবেগে আপ্লুত গলায় বলল,

“তাকে দেখলাম আর প্রেমে পড়ে গেলাম। সে নারী নাকি পরি আমি জানিনা। কিন্তু তাকে আমি দু’চোখ ভরে দেখেছি। এখন আমার তাকে চাই।”

অর্নভ শুরুতেই সহজ আচরণ করলেও ইশাদ পারল না। বলল,

“কোথায় দেখেছো?”
“ছাদে।”

ইশাদের বুকে ছ্যাত করে উঠল। হৃদয় পোড়া গন্ধ ছড়ানোর আগেই দ্রুত বলল,

“তোর বয়স কত?”
“বিশ।”

ইশাদ বিছানায় বালিশ ফেলে শুয়ে পড়ল। অত্যন্ত চৌকসে বলল,

“বাংলাদেশের সংবিধানে বিশ বয়সে প্রেম করা নিষেধ।”

অর্নভ আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,

“সে কী! সংবিধানে কি এখন প্রেমও চলে এসেছে? কবে করল? আমি তো জানি না।”

ইশাদ চোখ বন্ধ করে এক পাশ হয়ে বলল,

“তুই তো বাংলাদেশে থাকিস না। জানবি কী করে? আমি থাকি,আমি জানি। সংবিধানে আরো অনেক কিছু বদলিয়েছে। কাল সকালে বলব। এখন ঘুমা।”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here