#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (২৬)
#রোকসানা_রাহমান
রাতের ত্রিপ্রহর চলছে। ড্রিম লাইটের ঝাপসা নীল আলোতে তিহির অশান্ত মন ছটফট করছে তীব্রভাবে! কানের মধ্যে ঘড়ির টিক টিক শব্দটাও অসহ্য ঠেকছে। পাশেই রেখা ভূঁইয়া শুয়ে আছেন। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। নাকের সরু ছিদ্র দিয়ে ভারি নিশ্বাসের শব্দ বের হয়ে আসছে থেমে থেমে। তিহি বিরক্তমাখা চোখে তাকাল আম্মার দিকে। চেয়েই রইল কতক্ষণ। যেন অদৃশ্য,অস্পর্শণীয় বায়ুর অতিক্ষুদ্র কণাগুলোকে গুনে গুনে ধমকাচ্ছে! কেন একত্রে মিলিত হয়ে এমন অদ্ভুত শব্দ তুলে? অন্যকে জ্বালানোতে এত কঠিন নকশা আঁকার কী প্রয়োজন? তিহি বড্ড বিরক্তিতে অন্য পাশ হয়ে শুয়ে পড়ল! তার ঘুম আসছে না। আর আসবেও না। তার হঠাৎ করেই মন কেমন করে উঠছে। কান্না পাচ্ছে খারাপ ভাবে। বুকের মধ্যি কুঠরিতে শূন্যতা অনুভব করছে প্রবলভাবে। হাঁসফাঁসে ধুঁকছে! নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়া জোগাড়। তাহলে কি সে মরে যেতে চলেছে? এখনি আযরাইল আসবে? ছিড়ে নিবে তার রূহ? তিহি ভয়ে শিউরে উঠে। শরীরে লোমগুলো কন্টিকার ন্যায় শক্ত হয়ে দাড়িয়ে পড়ে। তিহি ফট করে উঠে বসে। শুকিয়ে যাওয়া গলাটা ভেজাতে পানির খোঁজ করছে। হাতের ডান দিকেই ছোট্ট টেবিলটা স্থির হয়ে বসা। তার উপর স্বচ্ছ কাঁচের গ্লাস ও জগ রাখা। তিহি গ্লাসে পানি ঢালার সময়টুকুও ধৈর্য্য ধরতে পারল না। জগের মুখ খুলে ঢকঢক করে পানি খেতে শুরু করল। একটানা পানি পানে মিহি শব্দ হচ্ছে। সেই শব্দের টানে হালকা নড়ে উঠল ইনা। ঘুম কন্ঠেই ডেকে উঠল,’মা!’
তিহির হাত কেঁপে উঠল। পানি মুখে না পড়ে গলায় পড়ছে। সে ঘাড় ফিরিয়ে কাতরকন্ঠীর সন্ধান করে।এ কেমন অনুভূতি? কঠিন বরফকেও হার মানাচ্ছে। শুকনো হৃদয় পুনরায় সতেজ হতে বুঝি এই একটা ডাকই যথেষ্ট! তিহির চেতন ফিরল পেটে ঠান্ডা স্পর্শে। কোনো রকমে হাত থেকে জগটা রেখে দাড়িয়ে যায়। পরনের কালো রঙের জামাটি ঘন ঘন নাড়ছে। শরীর থেকে আলগা করে আপনমনে বকছে। তার সামনের অংশ অনেকটাই ভিজে গিয়েছে। এভাবে কি ঘুমানো যাবে? এমনিই ঘুম মহোদয় তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তার মধ্যেই এই করুণ অবস্থা! তিহি বিছানা ছাড়ে। জামা পাল্টিয়ে পুনরায় বিছানায় উঠল। পরমুহূর্তেই বিছানা ত্যাগ করল। সে ওড়নাটা গলায় প্যাঁচিয়ে একবার আম্মার দিকে তাকাল। অতি সাবধানে পা টিপে টিপে রুম ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে।
____________________________________
দরজায় হালকা ধাক্কা পড়তে খুলে গেল। খানিকটা অবাক হল তিহি। ইশাদ যে দরজা খুলে ঘুমাবে সে ভাবেনি। তার ধারণা ছিল,ধপাধপ কড়াঘাত করে ইশাদকে বিরক্ত করবে। তেমনটা হল না। কিছুটা আশাহত হল। ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে পড়ে তিহি। কয়েক কদম দূরে ইশাদের বিছানা। বেশ উঁচু! সে চোখের অনুমানে নিজেদের বিছানার সাথে মেপে ফেলল। রুমের আধো আলোয় রুমটা ডুবে আছে। স্পষ্টও নয় আবার অস্পষ্টও নয়। চট করে কারো প্রতিচ্ছবি দেখা যাবে কিন্তু কার প্রতিচ্ছবি সেটা দৃশ্যমান করতে কঠোর কর্মঠ করতে হবে। তিহি বিছানার ধারে এসে দাড়ায়। মুহূর্তেই তার কপাল কুঁচকে গেল। একের জায়গায় দুই হল কী করে? লম্বালম্বিভাবে দুটো দেহ পড়ে আছে। এর মধ্যে ইশাদ কোনটা? নাকি দুটোই ইশাদ। একটা তার শরীর অন্যটা আত্মা! আচ্ছা আত্মাদেরও কী নাক,কান,মুখ,হাত পা থাকে? তিহি অবান্তর প্রশ্নে হারিয়ে গেল। আরো কয়েকগাছা প্রশ্ন জড়ো করার মধ্যেই অর্নভ চেঁচিয়ে উঠল,
“ভাইয়া,নারীপরি এসেছে!”
অর্নভের কন্ঠে মাত্রাতিরিক্ত বিস্ময়,উত্তেজনা,অস্থিরতা! তিহির প্রশ্নজালে ছিদ্র তৈরী হয়। সে বিস্ফারিত চোখে তাকায় অপরিচিত পুরুষ কন্ঠের মানুষটির দিকে। ছেলেটি বসে আছে। উত্তেজনায় পাশের মানুষটির বুক হাতরাচ্ছে। তিহি হতভম্ব! ক্ষণকাল বাকশক্তি হারিয়ে মানবমূর্তি ধারন করল। সহসা টুপ করে বসে পড়ল। মাথা ঢুকিয়ে নিল খাটের নিচে।
ইশাদ বুকের উপর খোঁদল তৈরী হওয়ার পূর্বেই হুড়মুড়িয়ে উঠল। আতঙ্কিত কন্ঠে বলল,
“কী হয়েছে? বাড়িতে আগুন ধরেছে নাকি ডাকাত পড়েছে?”
“নারীপরি এসেছে।”
অর্নভের অতিশয় উৎসাহিত কন্ঠে ইশাদের ঘুম ছুটে গেল। আতঙ্কও। সে সময় নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করল। বলল,
“নারীপরি? এটা আবার কোন জীব? হয় নারী বল নাহয় পরি।”
“না। তার জন্য দুটোই প্রযোজ্য। তুমি একবার দেখেতো নেও।”
“কী দেখব?”
“আমার নারীপরিকে।”
“কোথায়?”
এ পর্যায়ে অর্নভ ঘাড় ঘুরায় বিপরীত দিকে। সামনে কেউ নেই। কোথায় গেল? তার উত্তেজনায় ভাঁটা পড়ল। হৃদয় ভেঙে হাজর টুকরো। হতাশায় মুখ ফিরিয়ে নিল। তাহলে কি সে স্বপ্ন দেখছিল?
“কী হলো? কোথায় তোর নারীপরি?”
অর্নভ মাথা নিচু করে ফেলে। দুর্বল কন্ঠে বলল,
“সরি। আমি স্বপ্ন দেখেছি।”
ইশাদের হাত দুটো শক্ত হয়ে এল। ভারি রাগটা ভেতরে ঠেলে দিয়ে বলল,
“শুয়ে পড়।”
অর্নভ শোয়ার আগে আরেকবার পুরো রুমে চোখ বুলাল। ক্ষীণ আশাটা জ্বলে উঠানোর প্রবল উদ্যম! না,জ্বলল না। বরঞ্চ হৃদয়ের ভাঙা টুকরোগুলো আরো সংখ্যায় দ্বিগুন হল। নিরাশায় বালিশে মাথা রেখে চোখ বুজল। ইশাদও ধপ করে শুয়ে পড়ে। কিন্তু একি! মাথাটা নরম বালিশে না পড়ে শক্ত কাঠে পড়ল কিভাবে? ইশাদ মৃদু ব্যথা নিয়ে মাথা তুলে। তার মাথার নিচে বালিশ নেই। অর্নভ নিল কি? সে বা’পাশে ঘুরল। না অর্নভতো তার নিজের বালিশেই শুয়েছে। তাহলে তার বালিশ কোথায়? ইশাদ ডান পাশে ঘুরে নিচে চোখ রাখে। সঙ্গে সঙ্গে চোখ ছানাবড়!
তিহি বালিশের উপর বসে আছে। চোখে আনন্দ,ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। ইশাদ চমকের মাত্রা কমিয়ে চাপা স্বরে বলল,
“তিহি,এখানে কী করছো?”
তিহি উত্তর দিল না। তার ডান হাত খাটের নিচে হারিয়ে যায়। সেকেন্ড কয়েকের মধ্যেই হাত বেরোল। হাতে প্লেট। ইশাদ চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করে,
“কী?”
এবার তিহির ঠোঁট নড়ল। স্বাভাবিক গলায় কিছু বলল,
“সেদিন আপনি…”
তিহির বাক্য পুরোপুরি ছুটার আগেই ইশাদ শক্ত হাতে ওর মুখ চেপে ধরে। দ্রুত চোখ ফিরিয়ে আনে অর্নভের দিকে। চোখে,মুখে সতর্ক ফুটিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আসতে বলো। অর্নভ শুনতে পাবে।”
তিহি ঘাড় নেড়ে সম্মতি প্রকাশ করে। এক পলক তাকায় ইশাদের পাশে শুয়ে থাকা মানুষটির দিকে। যাকে অর্নভ বলে সম্বোধন করছে ইশাদ। অতঃপর বলল,
“সেদিন আপনি আমার জন্য ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু খাওয়াননি। এখন খাওয়াবেন।”
ইশাদ হঠাৎ আগত সংকটে পড়ে বেমালুম ভুলে গেছে সব। সে সরাসরি বলল,
“কোন দিন?”
তিহির অভিমান হল। গাল ফুলিয়ে চলে যেতে ধরল। ইশাদ চট করে ওর ভাতের থালাটা টেনে ধরে। বলল,
“তুমি রাতে খাওনি?”
তিহি প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে না। তার চোখ টলমল। ইশাদ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে পুনরায় কিছু বলার জন্য উদ্যত হলো। তখনি অর্নভ বলল,
“ভাইয়া,তুমি কি ফোনে কথা বলছো? do you have any girlfriend? You can speak in front of me without hesitation. I don’t mind.”
ইশাদ আরেক দফায় খাটের সাথে বাড়ি খেল। এবার কপালের মাঝামাঝিতে খেয়েছো। খাটের কিনারায়। সে শক্ত গলায় বলল,
“চুপচাপ ঘুমা। নাহয় সংবিধান লঙ্ঘন অপরাধে সংসদীয় জেলে পাঠিয়ে দেব।”
অর্নভ ভয় পেল নাকি বুঝা গেল না। সে দিক থেকে আর কোনো সাড়া এল না। ইশাদ সতর্কতাসহিত ভাতে হাত ডুবিয়ে দিল। তরকারি দিয়ে মেখে তিহির মুখে তুলে দিতে,তিহি নাক কুঁচকিয়ে বলল,
“নোংরা কোথাকার। ময়লা হাতে খাওয়াচ্ছে। ছি!”
ইশাদের ভ্রূদ্বয় কিঞ্চিত কুঁচকে গেল। তিহির নাক সিটকানোর কারণ অনুধাবন করতে পারল। মুহূর্তেই লজ্জায় অস্বস্থিতে পড়ে গেল। হাত সরিয়ে নিতে চাইল। পারল না। তিহি সে হাত টেনে ধরে। মুখে ভাত পুরে নেয়। দাঁতে দাঁতে পিষতে থাকে। মুখে ফুটে উঠে পরম আনন্দ,আহ্লাদ! ইশাদ মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে সেই মুখপানে। অদ্ভুত ভালো লাগা ছুঁয়ে যায় তার অন্তরপাখিকে। যে ডানা ঝাপটাচ্ছে মুক্ত আকাশে উড়বে বলে। তার ইচ্ছে কি আদৌ পূরণ করতে পারবে ইশাদ?
ইশাদের ভাবনাচ্ছেদ ঘটে তিহির হেঁচকিতে। সে শব্দ করে হেঁচকি তুলছে। গলায় ভাতের দানা আটকাল নাকি? ইশাদ পানির খোঁজ করে। পানি নেই। কী হবে এখন? ইশাদ আবারও মহাসঙ্কায় পড়ল। অর্নভ যদি জেগে যায়? এই মেয়েটা ভাত নিয়ে হাজির হল অথচ পানি আনেনি। উফ! ইশাদ শোয়া থেকে উঠে বসে। অর্নভ নড়ে উঠতে ইশাদ তিহির হাতে ধরে সোজা দরজার দিকে ছুটে চলল।
___________________________________
রাতের নিস্তব্ধ,কোলাহলশূন্যকে সাক্ষী রেখে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়ছেন মেহেরুনা শাইখা। আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়লেন বার বার। দীর্ঘক্ষণ নিভৃতে চোখের পানি ফেললেন। অতঃপর জায়নামাজ ভাঁজ করতে করতে সোজা হলেন। সাথে সাথে মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। আজ কাল দাড়িয়ে নামাজ পড়তে বড্ড কষ্ট হয় মেহেরুনা শাইখার। কোমরে তীব্র ব্যথা উঠে। পায়ের রগ ছিড়ে যেতে চায়। ঝিম ধরে থাকে উরুর অংশে। তিনি এক পা বিছানার দিকে ফেলতে সব কিছু আঁধারে ছেয়ে আসে। শরীর ভারশূন্য হয়ে পড়ে যেতে নিলে শক্ত দুটো হাত এগিয়ে আসে। সাথে ভেসে আসে সচেতনী কন্ঠ,
“সাবধানে,আম্মা। নামাজটাতো বিছানায়ও পড়তে পারতে।”
মেহেরুনা ঝাপসা চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। পরম স্নেহে উচ্চারণ করলেন,
“সোবহান?”
মা,ছেলের দীর্ঘ নীরবতার মুহূর্ত কাটল। তার মধ্যে দু এক বাক্যও যোগ হল। মান-অভিমানের পর্ব হালকা হয়ে আসে। সহসা মেহেরুনা শাইখা ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন,
“বিয়েটা ভেঙে দে।”
সোবহান শাইখ চমকে গেলেন। চকিত কন্ঠে বললেন,
“কেন?”
“আমি চাই না এ বাড়িতে একি ঘটনা দুইবার ঘটুক।”
সোবহান শাইখ আবার চমকালেন। পূর্বের চেয়েও দ্বিগুন! বললেন,
“কোন ঘটনা?”
মেহেরুনা শাইখা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন না। কিছুক্ষণ থম মেরে রইলেন। যেন মনে মনে হিসেব-নিকেষ কষছেন। মুহূর্তকাল শেষে বললেন,
“তোর মতো তোর পোলাও অন্য কাউরে ভালোবাসে। তার মনও অন্য কোথাও পড়ে থাকে। মন ছাড়া শুধু শরীরের লগে যদি বিয়া দিতে চাস তাহলে দে। তোর বাপের লগেও জোরাজুরি করি নাই। তোর লগেও করমু না। কিন্তু তোর বাপ তোর ব্যথাটা বুঝে নাই। তুই কি বুঝবি না?”
সোবহান শাইখ এক স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। মায়ের কথার বিপরীতে কী বলবেন খুঁজে পাচ্ছেন না। সব কিছু এলোমেলো হয়ে গিয়েছে।
“বালিশটা ঠিক কইরা দে। ঘুমামু।”
এক রকম বিধ্বস্ত রূপে মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে আসছেন সোবহান শাইখ। মিহিদের ঠিক পাশের রুমটিই মেহেরুনা শাইখার। এতদিন রুমটা তালাবদ্ধ অবস্থায় পড়ে ছিল। বহু বছর পর সেই ঘর পরিষ্কার করে থাকার যোগ্য বানানো হয়েছে। তিনি পায়ে পায়ে দোতলায় উঠার সিঁড়ির কাছে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ থমকে গেলেন। আবছা ছায়া দেখলেন কি? কে চলে গেল সামনে দিয়ে? সোবহান শাইখ সতর্ক চোখে আঁধারে ঢাকা নিচতলার পুরোটায় চোখ বুলালেন। কিছু না পেয়ে সিঁড়িতে এক পা ফেললেন। তখনি কিছু নড়ে উঠল। সোবহান শাইখ তটস্থ হলেন। কারো কন্ঠও পেলেন বুঝি! তাৎক্ষনিক সুইচ বোর্ডের দিকে ছুটলেন। দ্রুত কয়েকটি সুইচ টিপে দিলেন। পুরো নিচ তলা সাদা আলোয় ভেসে উঠল। এক দৃষ্টিতে বসার রুম,রান্নাঘর,ডাইনিং সবকিছু দেখে নিলেন। তারপর নিশ্চিন্তে চোখের পাতা ফেললেন। ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে লাইটগুলো নিভিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন।
“এখনি ধরা খাচ্ছিলাম। মাথামোটা একটা!”
ইশাদের কথায় তিহি হেসে ফেলল। একটু নড়তে,মাথায় বাড়ি খেল। তারা খাবার টেবিলের নিচে লুকিয়ে ছিল। ব্যথার মৃদু আহতবাণী হাসির শব্দে চাপা পড়েছে। মাথায় হাত রেখে বলল,
“আমরা কি চুপি চুপি প্রেম করছি?”
তিহির প্রশ্নে থতমত খেল ইশাদ। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তিহির দিকে। সে মিটিমিটি হাসছে। সহসা তার মনে প্রশ্ন জাগে,এই দুষ্টুমিষ্টি মেয়েটাই কি অয়নকে ফেলে দিয়েছিল? মুহূর্তেই গম্ভীরভাব ফুটে উঠে তার মধ্যে। এত বড় অন্যায় করার পরও এর সাথে সে কী করছে? অন্তত একটা কঠিন ধমক তো প্রাপ্য। ইশাদ শক্ত ধমক দেওয়ার প্রস্তুত নিল। দেওয়ার সুযোগ পেল না। তার আগেই তিহি টেবিলের নিচ থেকে বেরিয়ে এল। ইশাদকে কিছু না বলেই ছুটে চলে গেল।
____________________________
ফাল্গুন মাসের উনত্রিশ দিবস শুরু। কাক ডাকা ভোরে ইশাদকে ডেকে তুললেন শাহিনা শাইখা। হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দিয়ে হারিয়ে গেলেন। মায়ের বাধ্য ছেলে হওয়ায় অগত্যা বাইরে বেরিয়ে যেতে হল। ফিরল হাতভর্তি দুইয়ে দুইয়ে চার বস্তা বাজার নিয়ে। বাসার ভেতরে পা ফেলেই বুঝে গেল বিয়ে বাড়ির রমরমা আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছে। বাসার ভেতরে,বাহিরে পরিচিত-অপরিচিতরা গিজ গিজ করছে। কানে আসছে বাচ্চাদের শোরগোল। যাকে দেখছে সেই ব্যস্ত। এদিকে তার হাতদুটো এখনি ছিড়ে পড়বে মাটিতে। বাবুর্চি কি সেই হাতকেও তেলে ডুবিয়ে দিবেন? ইশাদ ভেতরে ঢুকছে আর মাকে খুঁজছে। লিস্ট ধরিয়ে এভাবে লাপাত্তা? চোখের দৃষ্টি চারপাশে ঘুরতেই নজরে পড়ল অর্নভকে। সে দোতলার সিঁড়ির রেলিং ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে। মাথাটা সামনে দিকে থাকলেও নজর অন্য দিকে। ইশাদ তার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে আৎকে উঠল। এই ছেলেতো তিহিকে নজরবন্দী করেছে! ইশাদ তাৎক্ষনিক হাতের জিনিস নিচে ফেলে দিল। অর্নভের গালে কষে দুটো চড় মারতেই হবে। সংবিধান যে বানিয়েছে শাস্তি তো সেই দিবে। অর্নভের কাছাকাছি পৌঁছানোর আগে ইনার মুখোমুখি হল। সে বসে বসে সাজছে। তার সামনে রঙ বেরঙের চুড়ি আর নেইলপলিস। ইশাদের চিন্তারা দ্রুত কাজ করতে শুরু করল। চোখের দৃষ্টি ত্রিভুজ আকারে ছুটছে। একবার তিহি,তারপর ইনা,সবশেষে অর্নভ। চোখের দৃষ্টিতে কয়েকবার ত্রিভুজ তৈরী করে ক্ষান্ত হল। ইনার পেছনে চলে যায়। লুকিয়ে একটা নেইলপলিস তুলে নিল। মুখ খুলে ইনার মাথায় ঢেলে দিল। সে চিৎকার তুলতে,ইশাদ দুই লাফে অর্নভের কাছে ছুটে যায়। হাতে নেইলপলিসটা ধরিয়ে দিয়ে আলগোছে নিজ রুমের দিকে ছুটে গেল। দরজার আড়ালে থেকে বিড়বিড় করছে,সরি সোনামা। তোমাকে কষ্ট দিয়ে ‘এক ঢিলে দুই পাখি’মারতে চাওয়ায় আমি অত্যন্ত লজ্জি! ততক্ষণে ইনার গগন কাঁপানো চিৎকার পড়ছে একের পর এক।
অর্নভের কান ঝালা পালা হওয়ার উপক্রম। তার বিশেষ মুহূর্তটিতে কাঁটা হয়ে পড়েছে ইনার চিৎকার। সে ইনার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে তিহিও হাজির। ইনা চোখ বন্ধ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“তিহি আপু,আমার সাজ নষ্ট করে দিয়েছে।”
কথাটা শেষ হতেই সশব্দের চড় পড়ল অর্নভের গালে!
চলবে