তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (২৮)

0
949

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (২৮)
#ভালোবাসার_রাত

“বলব না। তোমাকে আমি কিছু বলব না। সেই অধিকারটা তুমি অনেক আগেই হারিয়েছো। আমি মিহিকেই বিয়ে করব। আমিও দেখতে চাই ভালোবাসার মানুষের জায়গায় অন্য কাউকে বসালে কতটা কষ্ট হয়। যন্ত্রণার পাথরের ওজনটা কী পরিমাণ ভার হয়। ঠিক কতটা ভার বয়ে মা,বাবা,স্ত্রী,পুত্রকে ফেলে অন্যত্র থাকতে হয়। সাথে তোমাকে এটাও দেখাতে চাই,হয়তো প্রথম ভালোবাসাকে ভুলা যায় না। কিন্তু চাইলেই নতুন ভালোবাসার জন্ম দেওয়া যায়। সৃষ্টিকর্তা সেই শক্তি আমাদের দিয়েছেন। ভালোবাসা কোনো মাপকাঠিতে মাপা যায় না৷ কোনো বেড়াজালে বন্দী করাও যায় না। তাহলে ভালোবাসা ফুরিয়ে যেত! সাথে অনুভূতিগুলোর অকালমৃত্যু ঘটত। পরিশেষে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যেত। ”

উত্তেজনায় অবিশ্রান্ত কথাগুলো শেষ করে ইশাদ। দপ করে ছাড়ল রুদ্রশ্বাস! বাবার দিকে তুচ্ছ চাহনি ফেলে ঘুরে দাড়ায়। ফিরে যেতে চায় নিচে। এক কদম,দু কদম এগিয়ে থমকে যায়। পেছন ঘুরে বাবার দিকে এক কদম ফিরে আসে। দৃঢ়কণ্ঠে পুনরায় বলল,

“ইংরেজিতে কেএন(Kn) এর শব্দগুলো নিশ্চয় তোমার জানা আছে? কে(K), এন(n) এর পাশে বসে দিব্যি নতুন অর্থযোগ্য শব্দ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে,অথচ উচ্চারণের সময় তাকে গ্রহণ করা হয় না। তার অবদান সম্পূর্ণরূপেই অবজ্ঞা, হেলায় ফেলে দেওয়া হয়। আমার আম্মুও তোমার জীবনে কে(K) এর সাদৃশ্যরূপ! তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান তার। যেটা তুমি ইচ্ছে কী অনিচ্ছায় অবজ্ঞা আর হেলায় ফেলে এসেছো প্রতিনিয়ত। কিন্তু আর পারবে না। আমি দেব না। কে(K) মানে আমার আম্মু ছাড়া তোমার জীবনের সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থটা তুমি অনুভব করবে। খুব শীঘ্রই!”

ইশাদের শেষ কথাটা সোবহান শাইখের ভেতরটাকে নাড়িয়ে দিল। সংশয় নিয়ে মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

“তোমার আম্মু ছাড়া বলতে কি বুঝাতে চেয়েছো?”

বাবার প্রশ্নে ইশাদের ঠোঁটের কোণ দীর্ঘ হলো। অল্পক্ষণ নীরব থাকে। চোখে ফুটিয়ে তুলে দাম্ভিকতা। ইশাদের দৃষ্টিকে উপেক্ষা করতে চাইলেন সোবহান শাইখ। পারলেন না। এক অজানা আকর্ষন অনুভব করছেন। যেন চোখের ভেতরে কেউ আছেন৷ যে তার যাদুবলে সোবহান শাইখের চোখকে বশ করে নিয়েছেন৷ সেকেন্ড কয়েক পেরোতেই সোবহান শাইখ শারীরিক দুর্বলতা অনুভব করেন। দেহের অস্থিবন্ধনী টনটন করে ওঠে। হৃদয় দৌর্বল্যতাকে সামলাতে রেলিংয়ে হাত রাখেন। শক্ত করে চেপে ধরে এক কদম পিছিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। ঠিক তখনি গাছের পাতাগুলো একাধারে নড়ে ওঠে। উড়িয়ে দেয় রাতের শীতল বাতাস! যা সোবহান শাইখের শরীরকে নয়,শক্ত হৃদয়টাকে ছুঁয়ে দিল।

বাবার অন্য হাতটাও রেলিংয়ের উপর রাখল ইশাদ। তাকে ধাতস্থ হতে সময় দিয়ে তেজোদৃপ্ত ছাড়ল কণ্ঠে,

“তোমার অতীত এবং বর্তমান দুটোকে নিয়েই আমি এই বাড়ি ছাড়ব। তোমাকে ছুঁয়ে কথা দিচ্ছি আব্বু,শুধু হৃদয় কেন প্রাণ দিয়ে হলেও তাদের আগলে রাখব। সযত্নে অন্য একটি জগতে। যেখানে থাকবে শুধু ভালোবাসা,ভালোবাসা আর ভালোবাসা!”

ছেলের এমন দৃঢ়চিত্তের,দৃঢ়সংকল্পে সোবহান শাইখ বিস্ময়ে স্তব্ধ! ফ্যালফ্যাল দৃষ্টি ব্যতীত কিছুই করতে পারলেন না। বিপরীতে ইশাদ রোষদৃষ্টি রাখে। সেই দৃষ্টি অটল রেখেই সিঁড়ির দিকে পা বাড়ায়। বুকে তার আগুন জ্বলছে। প্রতিবাদী আগুন!

সশব্দের ভারী পা ফেলে সিঁড়ির ধাপ কাটছে ইশাদ। শরীর ঝাঁকিয়ে শেষ ধাপটি পার করল সে। সোজা নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরে। কয়েক পা এগিয়ে দৃষ্টি রাখে রুমের পানে। হঠাৎই থেমে যায়। তার মুখোমুখি ইমদাদ দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত সে ইশাদকে খুঁজতেই রুমে ঢুকেছিল। না পেয়ে বাইরে বের হয়েছে। ইশাদের মুখের দিকে তাকিয়ে শুকনো ঢোক গিলল ইমদাদ। এমন বিধ্বস্ত,বিদীর্ণ লম্বাটে মুখের ক্রুদ্ধ চোখজোড়া দেখে সে ভয় পেয়ে গেল। গোপনে হাতঘড়ির দিকে তাকাল। এক ঘন্টার জায়গায় দুই ঘন্টা পার হয়ে গিয়েছে। তাহলে কি এই রক্তিম আভার কারণ সে নিজে? ইমদাদ জোর করে ঠোঁটে হাসি আনার চেষ্টা করছে। সামনের দিকে পা ফেলার আগে অস্পষ্ট গলায় বলল,

“মনে হয় এখন আমার যাওয়া উচিত। আমি কাল আসব।”

ইমদাদ ভয়ে ভয়ে কথাটা শেষ করে। এক পা ছেড়ে আরেক পা বাড়াতে ইশাদ ওকে ঝাপটে ধরে। ভীষণ গাঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে চোখটা বুঁজে নেয়। কষ্ট হচ্ছে তার। ভীষণ অসহণীয় যন্ত্রণা! এমন একটা বলিষ্ঠ,প্রশস্ত বুক আর স্নেহমাখা হাতের স্পর্শের দাবিদার কি সে হতে পারে না? শেষ কবে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছিল মনে পড়ছে না। স্মৃতির পাতা ঝাপসা! কারো উপস্থিতেও তাকে অনুভব করতে না পারার যন্ত্রণাটাও বুঝি প্রকাশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার।

ইশাদের আকস্মিক কান্ডে ইমদাদ হতভম্ব! অনেকটা সময় লাগে বিস্ময় কাটাতে। উপস্থিত বুদ্ধির কার্যকলাপ স্বাভাবিক হয়ে আসতে আঁচ করতে পারে অনেক কিছু। এক হাতে ইশাদকে জড়িয়ে ধরে। হাতের তালু দিয়ে পিঠে মর্দন করতে করতে সহজ গলায় বলল,

“ভেতরে চল। যা যা উগলানোর আছে,উগলে ফেলবি। ভারি মন নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসানো যাবে না। শেষে আমার ভাবিটার উপর দিয়ে সব যাবে!”

_______________________________________

ইশাদ পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে সবটাই বর্ণনা করল ইমদাদের নিকট। খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছে যেন। গলাটাও শুকিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে,অনেকদিন বাদে সে একসাথে,এত সময় ধরে এত কথা খরচ করেছে। ইশাদ হাতের পাশে খালি গ্লাসে পানি ঢেলে নিল। ঠান্ডা পানিতে ঠোঁট ছুঁয়াতেই লক্ষ্য করল,ইমদাদ তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বৃদ্ধা আঙুলের নখ দাঁত দিয়ে খুটছে। চোখে অনুসন্ধানী দৃষ্টি। ঘন ভ্রূর চাপে চোখ দুটো সরু হয়ে আছে। সে অনেক্ষণ ইশাদের আপাদমস্তক দেখে বলল,

“তুই কি সত্যিই আমার বন্ধু ইশাদ? তার সাথে তোর তো কোনো মিল পাচ্ছি না। এই অমিলের কারণ কি সেই চুমুকন্যা? এক চুমুতে তুই ঘায়েল? বাপ রে! তুই তো আমার থেকে শত ধাপ এগিয়ে। বিয়ে করছিস একজনকে,প্রেম করছিস আরেকজনের সাথে। প্রেমিকার জন্য মরে যাচ্ছিস,আবার শপথ করে বসে আছিস অন্যকেই বিয়ে করবি! এই মরে যাচ্ছিস,এই বেঁচে উঠছিস। তোর থেকে তো হাঁপানি রোগীরাও অনেক সুখী।”

ইমদাদের হড়বড়ে বলা কথাগুলো তিতা হয়ে ঠেকল ইশাদের কাছে। পানির স্বাদ তিতকুটে রূপান্তর হয়ে যেন গলা দিয়ে নামছে। এমন বিস্বাদ পানি খাওয়া থেকে না খাওয়ায় শ্রেয়। সে পানির গ্লাস নামিয়ে রাখল। বিরক্তির চাহনি রাখল ইমদাদের দিকে। এই ছেলেটা কি কখনোই তার সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না? নাকি সারাটা জীবন আরো প্যাঁচিয়ে দিবে? ইশাদ মুখ ফিরিয়ে নিল। সেই সময় ইমদাদ সগর্বে বলল,

“আমি হলাম শুদ্ধ পুরুষ আর তুই নষ্ট পুরুষ!”

ইশাদ বাঁকা চোখে তাকায়। ইমদাদ খানিকটা মিইয়ে যায়। সগর্বে তোলা মাথা খানিকটা নত করে দুর্বল গলায় বলল,

“শুদ্ধ পুরুষ না হলেও নষ্ট পুরুষ নই। আমি কাউকে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দেইনি। জোর করে হামলেও পড়িনি। যা হয় ঐপক্ষের সম্মতিতেই।”

ইশাদ কড়া গলায় বলল,

“আমি কি তোর চারিত্রিক সনদ চেয়েছি?”

ইমদাদ আরেকটু নিভে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে দাঁড়িয়ে রইল। সহসা বলল,

“তোর সাথে যার বিয়ে হচ্ছে,সে কি এতে খুশি? কী যেন নামটা?”

ইমদাদ মনে করার চেষ্টা করছে। তারমধ্যেই ইশাদ বলল,

“মিহি।”
“মিহি – তিহির কি তোকে পছন্দ? তোদের কি আলাদাভাবে কথা হয়েছে? এমনও তো হতে পারে মিহিও তোর মতো মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করছে। সেক্ষেত্রে কিন্তু এটা অন্যায় হবে!”

ইমদাদ বিজ্ঞের মতো সুন্দর যুক্তিপূর্ণ কথা শেষ করে দাম্ভিক হাসি নিয়ে ইশাদের দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে তার হাসি ঘায়েব। ইশাদের লাল চোখের চাহনিতে সে দমে গেল। কী ভুল করেছে বুঝতে পেরে সংশোধন করতে বলল,

“ওটা মিহি হবে। অনলি মিহি!”

ইশাদ চোখ নামিয়ে নিল। বিছানায় বালিশ ফেলে বলল,

“রাতে খেয়েছিস? নাকি খেতে হবে?”

ইমদাদ খানিকটা আশাহত হলো। এত কষ্ট করে দুটো বিজ্ঞদের কথা রাখল। কোনো কাজই হলো না? কানে কি ঢুকলই না? নাকি লাইনগুলো বিজ্ঞদের মতো বলতে গিয়ে বোকাদের মতো বলে ফেলেছে? ইমদাদ সংশয় কাটাতে বন্ধুর দ্বারস্থ হতে ইশাদের দিকে তাকাল। কিন্তু ইশাদ আগের জায়গায় নেই। সে দরজার কাছাকাছি চলে গিয়েছে। ইমদাদ জিজ্ঞেস করল,

“কোথায় যাচ্ছিস?”

ইশাদ পেছন ঘুরল না। উত্তরও দিল না। বেরিয়ে গেল।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই মিহিদের রুমের সামনে হাজির হলো ইশাদ। ভেতরে ঢুকতে হলো না। মিহি বাইরেই আছে। দরজার কাছে। নজর দরজার দিকে। ইশাদ আরেক পা সামনে এগুলে টনুকে দেখতে পেল। কী আশ্চর্য! তার মাথায় লাল ওড়নার ঘোমটা। ইশাদ পুনরায় মিহির দিকে তাকাল। এবার খেয়াল করল মিহির মাথায় সাদা টুপি। দুজনের বিপরীতমুখী সাজে ইশাদ অবাক হলো। তাদের মধ্যে কী কথপোকথন হচ্ছে তা শোনার কৌতুহল তৈরী হচ্ছে। সে আরেকটু এগিয়ে কান খাড়া করল। মিহি বলছে,

“টনু ভাইয়া,এখন তুমি মিহি আর আমি ইশাদ ভাইয়া কেমন?”

টনু মাথা নাড়ল। সাথে ওড়নার এক অংশ মুখে ঢুকিয়ে লাজুক হাসি দিল। মাথা হালকা নাড়িয়ে মিহির কথার সম্মতি প্রকাশ করছে। মিহিও খুশি হলো। সে বলল,

“মিহি,তুমি খুব ভালো মেয়ে। অনেক সাহসী। সাহসী মেয়েরা তো ভয় পায় না। তুমি পাচ্ছো কেন?”

মিহির কথা শেষ হতে টনু চিকন স্বরে বলল,

“আমি শুনেছি,বিয়ে হলে স্বামীরা বউকে মারে। কথায় কথায় ধমকায়। কাপড় ধোয়ায়,রান্না করায়,ঘর মুছায় আরো কত কী! তাই ভয় পাচ্ছি। তুমিও কী আমাকে মারবে,ইশাদ?

টনুর কথা শেষ হলে মিহি শুরু করল। পিঠ টান টান করে মাথা খানিকটা উপরে তুলে মোটা গলায় বলছে,

“ছি! মারব কেন? আমি তো তোমায় খুব ভালোবাসি। বিয়ের পর আমি তোমকে…উফ! টনু ভাইয়া তুমি তো আবার ভুল করলে। আমি তো ইশাদ ভাইয়াকে আপনি করে বলি। তুমি ‘তুমি’ করে বললে কেন? আবার নাম ধরেও বলেছো। তুমি একটুও অভিনয় পার না। ধুর!”

মিহির চোখে,মুখে অপ্রসন্নতা। সে টনুর মাথা থেকে এক ঝটকায় ওড়না খোলে নিল। টনুকে বাইরে বের করে বলল,

“তুমি কিছু পার না। যাও। আমি কাল সকালে তিহি আপুর সাথে করব।”

কথা শেষ করেই মিহি দরজা লাগিয়ে দিল। টনু হতাশ হলো! আহতও হলো। সে বেজার মনে ঘুমাতে চলে গেল। ইশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল,

“কারো চাপে পড়ে নয়। মিহি স্বইচ্ছায়,খুশি মনেই বিয়েতে রাজি হয়েছে।”

________________________________________

ইশাদ বিছানায় শরীর এলিয়ে দিতে,ইমদাদ বলল,

“আমি ভাবলাম,আমার জন্য খাবার আনতে গিয়েছিস। কত আশা করে বসেছিলাম আন্টির হাতের রান্না খাব বলে। আর তুই? খালি হাতে ফিরলি?”

ইমদাদের কথায় ইশাদের হেলদোল হলো না। সে আগের ন্যায় শক্ত হয়ে শুয়ে আছে। ইমদাদ ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল। ধীরস্বরে বলল,

“বন্ধু,ক্ষুধা লাগছে। আমি খেয়ে আসি।”

সঙ্গে সঙ্গে ইশাদের চোখ খুলে গেল। রক্তচক্ষুতে তাকাল ইমদাদের দিকে। যার মানে এই-তোর আমাদের বাড়িতে ঘুরাঘুরি নিষেধ। এক কথা কতো বার বলব? চুপচাপ শুয়ে থাক।

ইমদাদ অসহায় গলায় বলল,

“তাহলে তুই এনে দে। এভাবে সেধে এনে না খায়িয়ে মারবি?”

ইশাদ অন্য পাশ ঘুরে বলল,

“পারব না।”

ইমদাদ করুণ গলায় বলল,

“আমি মাটির দিকে তাকিয়ে হাঁটব। কারো দিকে তাকাব না। এত রাতে কেউ কি জেগে আছে,বল? যাই?”

ইশাদ নড়ল না। কথাও বলল না। ইমদাদ শোয়া থেকে উঠে বসে। একবার ইশাদের দিকে তাকিয়ে দরজার দিকে তাকাল। ডান হাতে পেট টিপে দেখছে। হঠাৎ ছুট লাগায় দরজার দিকে। খালি পেটে কি ঘুম আসবে?

ইমদাদের পায়ের শব্দ পেয়ে ইশাদ উঠে বসে। কিন্তু পেছন পেছন ছুটল না। ক্লান্ত লাগছে। বিষাদে ছেয়ে আছে রক্তকণিকা! হাড়ে হাড়ে ছুটছে তীব্র যন্ত্রণা। পশমে পশমে উড়ছে তিহির কল্পনা। কী হবে কাল সকালে?

“ইশাদ?”

মায়ের ডাকে ইশাদের চৈতন্য ফিরে। ঘড়ির দিকে চোখ রাখে। ঘন্টার কাঁটা একটায়। মা এখনো ঘুমায়নি? ইশাদ মনের প্রশ্নটা প্রকাশ করল,

“আম্মু,এত রাতে জেগে আছো। কিছু বলবে?”

শাহিনা শাইখা সামান্য হাসলেন। ছেলের পাশে বসলেন। গাল ছুঁয়ে দিলেন। কাঁধ ছুয়ে দিলেন। বুকের দিকেও হাত ঘুরিয়ে নিয়ে এসে বললেন,

“তুইও তো জেগে আছিস।”

ইশাদ মায়ের মনোযোগ অন্য দিকে ঘুরাতে দ্রুত বলল,

“ইমদাদ থাকলে কি ঘুমানোর জো আছে? এই এত রাতে বলছে ক্ষুধা লাগছে! আমার ঘুম ভাঙিয়ে খেতে চলে গেল।”

শাহিনা শাইখা মৃদু হাসলেন। কিয়ৎকাল ছেলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অতঃপর বাম হাতের শপিং ব্যাগটা ছেলের হাতে দিলেন। সংকোচ নিয়ে বললেন,

“এটা মিহির মাকে দিয়ে আসবি?”

ইশাদ ব্যাগটা হাতে নিল। দ্রুত ভেতরে কী আছে পরখ করছে। লাল আর সোনালী রঙের শাড়িটি হাতিয়ে দেখতে,শাহিনা শাইখা বললেন,

“ওটা আমার শাড়ি নয়। উনার জন্য আলাদাভাবে কিনেছিলাম। মেয়ের বিয়েতেও অমন সাদা,মরা রঙের শাড়ি পরবেন? খারাপ দেখাবে। এটা দিয়ে আয়। ভালো করে বলে আসবি,কাল যেন এটাই পরে।”

ইশাদ মায়ের দিকে তাকাল। তার ঠোঁটে একটা প্রশ্ন এসেও আটকে আছে। শাহিনা শাইখা বুঝি প্রশ্নটা পড়ে ফেললেন। অন্য দিকে চোখ রেখে বললেন,

“আমি বললে,নাও পরতে পারেন৷ তুই বললে,অবশ্যই পরবেন।”
“তুমি এত নিশ্চিত হচ্ছো কী করে?”

শাহিনা শাইখা হাসলেন। রহস্যময়ী হাসি! প্রশ্নটা এড়িয়ে বললেন,

“আমি এখানে আছি কতক্ষণ। তুই দিয়ে আয়। তারপর যাব।”

ইশাদ আর কথা বাড়াল না। শাড়িটা নিয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে এল। মিহিদের রুমের দিকে পা বাড়ানো অবস্থায় একবার ডাইনিং টেবিলটার দিকে তাকাল। সাথে সাথে চোখের পাতায় সেদিনের দৃশ্যটি ভেসে ওঠে। ঠোঁট টেনে হেসে বিড়বিড় করে বলল, আব্বু সাদা রঙ নয়,বলো সাদা শাড়ি তোমার পছন্দ নয়। না,ভুল বললাম। ভালোবাসার মানুষটির শরীরে মৃত স্বমীর স্মরণে পরিহিত শাড়ি তোমার পছন্দ নয়!

ইশাদ মিহিদের বিছানায় বসে আছে। তার পেছনেই মিহি ঘুমাচ্ছে। সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে রুবিনার দিকে আনে। তিনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন। মাথা ঝুকে আছে। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। হাত দুটো অস্থির। মাঝে মাঝেই অযথা শাড়ির আঁচল টানছেন। ইশাদ মনে মনে বাবার কথাটিকে সমর্থন করল। তিনি আসলেই অনেক লাজুক স্বভাবের! নাহলে এই মধ্যবয়সে এসে পুত্রের বয়সী ইশাদকে দেখে এত কুণ্ঠিত ও আড়ষ্টভাব ফুটে উঠতো না। তাও অপরিচিত নয়। রাত শেষ হলেই মেয়ের জামাই হবে। ইশাদ বিছানা ছাড়ল। ধীর পায়ে রুবিনার দিকে এগিয়ে আসে। মায়ের দেওয়া শাড়িটি উনার দিকে বাড়িয়ে বললেন,

“কাল এটা পরবেন। আমার আম্মুর ইচ্ছে।”

রুবিনা অবাক চোখে তাকায়। চোখ ফিরিয়ে নিলেন। দৃঢ় গলায় বললেন,

“না। আমি এটা পরব না।”

উনার দৃঢ়কণ্ঠে ইশাদের মনে কৌতুহলী হয়ে ওঠে। হঠাৎ করেই এই মহিলার ভেতরকার জমানো কথাগুলোও জানতে ইচ্ছে করে। সেদিন বাবা বিয়ের আসর ছেড়ে আসার পর উনার প্রতিক্রিয়া কী ছিল? বাবাকে ক্ষমা করেছিলেন কী? নাকি এখনও নারাজ। যার অভিশাপই হয়তোবা বাবার উপর থেকে কাটছে না!

ইশাদ নিজের কৌতুহল চাপা দিয়ে বলল,

“আমি চাই আপনার আর আমার আম্মুর মধ্যে একটা সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠুক। সেই সম্পর্কের আনাচে-কানাচে যেন আমার আব্বুর চিহ্ন টুকুও না থাকে। এমন সম্পর্ক কি হতে পারে না?”

রুবিনার ফিরিয়ে নেওয়া চোখদুটো আবারও ইশাদের দিকেই আটকাল। জড়তাভাব অনেকটাই কেটে গিয়েছে বোধ হয়। ইশাদ অনেক্ষণ উত্তরের অপেক্ষা করল। কিন্তু উত্তর না আসায় সে চলে যাওয়ার উদযোগ নিল। হঠাৎ করে প্রশ্ন তৈরী হলেও উত্তর হয় না। উনাকে সময় দেওয়া উচিত। ইশাদ ছোট্ট করে বলল,

“আসি।”

কথাটা শেষ করে নড়তে পারল না। ওর হাতদুটো খামচে ধরেছেন রুবিনা। হাত দুটো কপালে ছুঁয়িয়ে নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে চোখ থেকে উষ্ণ পানি গড়িয়ে পড়ল। ইশাদ শিউরে উঠল। কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। উনি সেকেন্ড কয়েক অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বললেন,

“আমার মেয়ের কপালটাও আমার মতো পুড়বে নাতো? আমার নাহয় বাবা ছিল। তিনি সামলিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু মিহি? তাকে কে সামলাবে? ও কি সৌভাগ্যবতী যে তোমার মতো স্বামী পাবে। নাকি মন্দকপালী যে আমার মতো বাবাকে পাবে না।”

রুবিনার মতো ইশাদও কোনো উত্তর দিতে পারল না। নিরুত্তরে মিহিদের রুম ত্যাগ করল। সময় গড়িয়ে যাচ্ছে পায়ের তালে। নিজ কক্ষের সামনে এসে পুনরায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো,আমার জীবনটা মিহির নামে উৎসর্গ করলাম। সে যা চাইবে, তাই হবে।

____________________________________

তিহি শেরওয়ানির সাথে পাথর বসানো পাগড়ি পরিয়ে দিল ইশাদের মাথায়। গলাতে প্রিন্স জ্যাকেটটা পরিয়ে দিয়ে চটি জোড়া পায়ের সামনে রাখে। হাতে ঝলমলে সিলভার রঙের দামী ঘড়ি পরিয়ে দিয়ে ইশাদের দিকে তাকাল। ইশাদের উদাস মনের রোষপূর্ণ দৃষ্টি অন্য দিকে। তিহি ইশাদের শেরওয়ানির বোতাম নখ দিয়ে চেপে ধরল। বুকে কপাল ঠেকিয়ে বলল,

“এখনও রাগ করে আছো? রুম থেকে বের হলেই তো আমি তোমার অতীত হয়ে যাব। শেষ সময়ের শেষ জেদ ভেবে ক্ষমা করে দেও,নষ্ট পুরুষ।”

শেষ কথাটা ইশাদের হৃদয়ে ছুঁচের ন্যায় বিঁধল। একটা নয়,অসংখ্য। অগণিত! রক্ত ঝরছে কী? টপ টপ শব্দ করে? ইশাদ দৃষ্টি অন্য দিকে রাখতে পারে না। তীক্ষ্ণ হয়ে পড়ে তিহির চোখজোড়ায়। টানা টানা চোখ দুটো প্রথম বর্ষায় ভরা যৌবনের পুকুরটির মতো টলমল! ইশাদের চোখে চোখ পড়তেই বাঁধ ভেঙে অশ্রুর বন্যা শুরু হয়ে গেল। তিহি ডুকরে কেঁটে উঠে বলল,

“বিশ্বাস করুন,আমি আপনাকে পাইনি বলে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। কিন্তু আপনি অন্য কারো দলিল হবেন এটা মানতেই পারছি না! কষ্ট হচ্ছে খুব। এতটা অসহায় কখনও লাগেনি। মনে হচ্ছে,আমার জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা হারিয়ে ফেলছি!”

ইশাদ তিহির গাল দুটো পরম স্নেহে দুহাতে চেপে ধরল। ভেজা দুটি চোখে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে বলল,

“তিহিপাখি,এভাবে বলো না। যাকে কেন্দ্র করে চোখের জল ফেলছো তা তো প্রকাশই পাইনি। আমাদের মধ্যে দূরত্বটা কিন্তু অনেক। যতটা কাছে এসেছিলাম তা তো পুরোটাই ভুল ছিল। সেটাকে ধরে রেখে এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে? ভেতরের অনুভূতি ভেতরেই চাপা থাক। আজ আমি শুরু করছি,কাল তুমি করবে। জীবনের প্রতি পদে পদে,নতুন সূচনায় পা রাখতে হয়।”
“ভালোবাসি!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here