তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,পর্ব (৩)

0
1114

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,পর্ব (৩)

তিহি বেহুঁশ হয়ে সোফা থেকে পড়ে যেতে নিলে ইশাদ বাহু আঁকড়ে ধরল। নিজের কাঁধের সাথে চেপে ধরলে পাশে এসে বসলেন রুকমিনি মুখার্জি। মাথা টেনে ধরে বার কয়েক বার ‘তিহি’ বলে ডাকলেন। কোনো উত্তর না পেয়ে হতাশ হলেন। পর মুহূর্তে অস্থির হয়ে বললেন,
” ডাক্তারকে কল দিতে হবে! আমার ফোনটা কোথায়? ”

তিহিকে ফেলে তাপান মুখার্জির নিকট ছুটলেন বিদ্যুৎগতিতে। উত্তেজিত হয়ে বললেন,
” এখনও দাঁড়িয়ে আছ যে? আমার মেয়েটার চিকিৎসা দরকার। ডাক্তারকে কল দাও। ”

তাপান মুখার্জির ভাবভঙ্গিতে চিন্তা দেখা গেল না। বরঞ্চ বিরক্তি জড়ো হলো ভ্রু জোড়ার মধ্যিখানে। তিনি ধীরপায়ে হেঁটে আসলেন তিহির দিকে। মেঝেতে পড়ে থাকা তাজের ছবিখানা তুলে কোর্টের একদিকে এমনভাবে ঘষলেন যেন কত বছরের ময়লা জমেছে! সেভাবেই বসার রুম ত্যাগ করলেন। স্বামীর এহেন আচরণে বিস্মিত হলেন রুকমিনি মুখার্জি। পরক্ষণে পূর্বের ন্যায় চপলতা দেখা দিল দেহ ও মনে। নিজের ফোন খুঁজতে শুরু করলে ইশাদ বলল,
” অস্থির হবেন না, আন্টি। আপনি ভুলে যাচ্ছেন এ বাসায় একজন ডাক্তার থাকে। ”

কথাটায় রুকমিনি মুখার্জি যতটা স্বস্তি পেলেন ততটাই চমকিত হলেন ইশাদের কোলে তিহিকে দেখে।

তিহিকে নিয়ে সোজা চিলেকোঠায় উঠে এলো ইশাদ। বিছানায় আলতো করে শুয়িয়ে দিয়ে ডাক্তারি পরীক্ষা শুরু করল। ততক্ষণে রুকমিনি মুখার্জি, শাহিনা শাইখা দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন। ইশাদ তাদের দিকে তাকালেও কথা বললেন রুকমিনির মুখার্জিকে উদ্দেশ্য করে,
” ভয় পাওয়ার মতো কিছু হয়নি। সকাল থেকে না খেয়ে আছে তার মধ্যে..”

কথাটা শেষ করতে পারল না ইশাদ। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে আবার বলল,
” হালকা খাবারের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হয়। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরবে। ”

ইশাদের কথাটা শেষ হতেই রুকমিনি মুখার্জি এমনভাবে ছুটলেন যেন এই ফরমায়েশটার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষায় ছিলেন। তার পিছু পিছু শাহিনা শাইখাও গেলে, অন্য একটি নারী ছায়া লক্ষ্য করে ইশাদ। ছায়ার দিকে দৃষ্টি রেখে তিহির পাশ থেকে উঠে আসে। দরজার কাছে গিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখে রুবিনা দাঁড়িয়ে আছেন। বিষণ্ণ মুখখানায় রাজ্যের জড়তা। শাড়ির আঁচল মুখের একপাশ দিয়ে টেনে মুখের ভেতর গুঁজে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
” আপনি? কিছু বলবেন? ”

ইশাদের কণ্ঠস্বরে বেশ চমকালেন রুবিনা। মৃদু কম্পনটা স্পষ্ট চোখে পড়ল ইশাদের। তার ভয় কাটাতে আন্তরিকতা বাড়িয়ে দিতে চাইল ইশাদ। ভীষণ নম্রস্বরে বলল,
” ভেতরে এসে বসুন, আন্টি। ”

রুবিনা জায়গা থেকে নড়ল না। শাড়ির আঁচলটা আরেকটু টেনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকল। ইশাদ এবার বাইরে এসে দাঁড়াল। রুবিনার দিকে খানিকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে মৃদু হেসে বলল,
” আমার মনে হচ্ছে, আমার সামনে মিহি দাঁড়িয়ে আছে! ”

মিহির প্রসঙ্গ উঠতে তাৎক্ষণিক প্রশ্ন করল রুবিনা,
” মিহি কোথায়? ”

ইশাদের মৃদু হাসিটুকু মিলিয়ে গেল। এই এতক্ষণ পর মনে হলো মিহির বিয়ে সম্পর্কে আসল মানুষকেই জানানো হয়নি। মুহূর্তে অনুতাপের অদৃশ্য রঙ ছড়িয়ে পড়ল মুখজুড়ে। সেই রঙ মেটাতে রুবিনাকে জোর করে ভেতর রুমে আনল ইশাদ। খাটের কিনারে বসিয়ে ইমদাদ আর মিহির বিয়ের ঘটনা খুলে বলল। সবটা শোনার পর ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকলেন কতক্ষণ। বিনাবাক্যে বসা থেকে উঠে চলে যাচ্ছিলেন। কী ভেবে দরজার মুখের কাছে গিয়ে থামলেন। ঘাড় ঘুরে তাকালেন ইশাদের দিকে। কিছু একটা বলার পুরো ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও না বলে দরজা পার হলেন। সিঁড়ি মুখের কাছে পৌঁছাতে পেছন থেকে শুনতে পেলেন,
” মিহির সাথে কথা বলবেন? কল দেই? ”

___________
ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে গিয়ে বেশ বিড়ম্বনায় পড়ল ইমদাদ। মিহিকে খাটে শুতে বলবে নাকি নিজে শুবে ভেবে পাচ্ছে না। এদিকে একার সংসার দেখে দু-কামড়ার ফ্ল্যাট নিবে ভেবেও নেওয়া হয়নি। নিজের বেখেয়ালিপনায় নিজেকেই ভুগতে হচ্ছে! সে ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিহির দিকে তাকাল। মেয়েটা খাটের এক কোণে বসে ঝিমুচ্ছে। যেকোনো সময় খাট থেকে পড়ে যেতে পারে। শেষে না মাথা ফাটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। ইমদাদ বাড়তি ঝামেলা থেকে মুক্ত পেতে ধমকের সুরে বলল,
” বসে ঘুমাচ্ছ কেন? শুতে পারছ না? ”

মিহি অনুমতি পেয়ে খাটের অর্ধেক দখল করে শুলো। চোখ বন্ধ করে আবার মেলল। ভার গলায় জিজ্ঞেস করল,
” আমি কি ঐ বাসায় আর যাব না? ”

ইমদাদ উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করল না। রুমের আলো নিভিয়ে সুইচবোর্ডের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকল। বেশ কিছুক্ষণ চিন্তায় মগ্ন থেকে আচমকা বিড়বিড় করল, ‘ নিচে শুতে হবে কেন? ঐটুকু মেয়ের পাশে শুয়ে কী আর হবে? আমার রুচি কি এত খারাপ হয়ে গেছে যে বাচ্চার শরীরের গন্ধে বেতাল হয়ে যাব? আমার প্রিয়া আছে। আজ হয় হয়নি তো কাল হবে। ”

ইমদাদ দমকা নিশ্বাস ফেলে খাটের কাছে এগিয়ে গেল। মিহির থেকে বেশ দূরত্ব রেখে একদিকে কাত হয়ে শুয়ে পড়ে। চোখ বন্ধ করে নিতেই হঠাৎ ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। ইমদাদ চমকে খাট থেকে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। নিজেকে দ্রুত সামলে ফোন ধরল। কল রিসিভ করে কিছু বলার আগেই ইশাদ বলল,
” মিহিকে দে। ”

ইমদাদ ফোন কানে নিয়েই মিহির দিকে তাকাল। চোখ বন্ধ করে ভারী নিশ্বাস ফেলছে। চোখ ফিরিয়ে বলল,
” মিহি ঘুমাচ্ছে। ”

ঠিক তখনই চিৎকার করে উঠল মিহি,
” আমি জেগে আছি। ”

ইমদাদ আরও একবার চমকাল। অবাক চোখে তাকাল মিহির দিকে। যন্ত্রের মতো ফোনটা তার দিকে বাড়িয়ে বলল,
” ইশাদ কথা বলবে। ”

মিহি চট করে উঠে বসল। ফোন কানে ধরে বলল,
” ইশাদ ভাইয়া, কী কথা বলবে? ”
” আমি তোর মা বলছি। ”

মায়ের কণ্ঠ পেয়ে মিহির উচ্ছ্বসিত ভাব-সাব হারিয়ে গেল। মন খারাপের সুরে ডাকল,
” মা!”

তারপর আর কোনো কথা বলতে হয়নি মিহির। চুপচাপ মনোযোগ দিয়ে শুধু মায়ের কথা শুনে গেল। মাঝেমধ্যে ‘আচ্ছা’ শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে অনুভব করল তার বিয়ে-সংসার-দায়িত্ব সম্পর্কে শুনতে ভালো লাগছে। অথচ কয়েক ঘণ্টা পূর্বে বউ সাজার সময় এই কথাগুলোই তার ভালো লাগেনি। বার বার স্বামীর জায়গায় ইশাদের মুখটা কল্পনা করতে বললেই তার রাগ হয়েছে। মায়ের ভয়ে প্রকাশ করতে পারেনি। মুখ ফুটে বলতে পারেনি, আমি বিয়ে করতে চাই না মা। ইশাদ ভাইয়াকে আমার ভাইয়া ডাকতে ভালো লাগে। তুমি কেন ভাইয়া ডাকতে মানা করছ?

মায়ের সাথে কথা শেষ করে ফোন ফিরিয়ে দিতে গিয়ে দেখে ইমদাদ গভীর ঘুমে ডুবে আছে। মিহি বুঝতে পেরেও হালকা স্বরে ডাকল,
” এই যে, শুনছেন? ”

ইমদাদ কোনো উত্তর দিল না। শুধু কপাল থেকে হাতটা শরীয়ে বুকের উপর রাখল। মিহি সেই হাতের উপর নখের আঁচড় টেনে লিখল, ‘ আমার স্বামীর নাম ইমদাদ। ‘

___________

ইশাদের সামনে রুবিনার কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল বুঝতে পারে ইশাদ। তাই তাকে ব্যক্তিগত সময় দিয়ে তিহির পাশে এসে বসে। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতে থাকতে চুলে আঙুল ডুবায়। অজান্তেই ঠোঁটদুটো ছুটে যায় তিহির কপালে। তারপর কানের কাছে নিয়ে মৃদুস্বরে বলল,
” এত ভয় পেলে চলবে তিহিপাখি? এবার যে ভয়কে জয় করতে হবে। অসুস্থতাকে হারিয়ে সুস্থ হতে হবে। ”

ইশাদের কণ্ঠস্বর মস্তিষ্কে পৌঁছাতে সাড়া দিল তিহি। আধো চোখে তাকাল ইশাদের দিকে। তারপরেই চোখ বন্ধ করে মাথা ঠেলে দিল ইশাদের উরুতে। শেরওয়ানির এক অংশ খামচে ধরে আহ্লাদী স্বরে বলল,
” তোমাকে পাশে পেলে আমি সব পারব। ”

ইশাদ মুচকি হাসল। কোমল স্বরে কিছু একটা বলতে গিয়ে সামনে তাকায়। দরজার সামনে রুকমিনি মুখার্জিকে দেখতেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। লজ্জা,ভয়, অস্বস্থিতে বিশাল দেহখানা সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে যেন! এক প্রকার জোর করেই তিহিকে সরিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। টেনে টেনে বলল,
” প্লেটটা আমার কাছে দিন। আমি খায়ি…”
” তুমি এখন যেতে পার। বাকিটা আমি সামলে নিব। ”

ইশাদের নরম দৃষ্টি শক্ত হয়ে আটকায় রুকমিনির মুখে। তারপরে তিহির দিকে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নীরবে বের হয়ে আসে।

_________
ঘুম থেকে উঠে সোজা গোসলখানায় ঢুকেছিল ইশাদ। শরীর ভিজিয়ে সাবান লাগাতে কড়াঘাত পড়ে বন্ধ দরজায়। বার বার ‘কে’ জিজ্ঞেস করার পরও বাইরের মানুষটির থেকে কোনো উত্তর পায়নি। তন্মধ্যে দরজায় আঘাত করতে করতে ভেঙেই ফেলবে এমন অবস্থা! সে বাধ্য হয়ে দরজা একটু ফাঁক করে বাইরে উঁকি দিতে চাইল। তার আর সুযোগ হলো না। তিহি জোরপূর্বক গোসলখানার ভেতরে ঢুকে গেল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” আমি কোথাও যাব না। আম্মাকে বলে এসো আমি তোমার সাথে থাকব। ”

ইশাদ প্রথমে বুঝতে না পারলেও পরক্ষণেই অনুমান করে ফেলল তিহিরা আজ চলে যাচ্ছে। তার মন খারাপ হলো, বুকে ব্যথা উঠল, সেই ব্যথাকে উপেক্ষা করে একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তিহির অশ্রুতে ভেজা মুখটায়। আপনমনে বিড়বিড় করছে, ‘ তুমি অন্য কাউকে ভালোবেসেছ তিহি, তার জন্য পরিবার ছেড়েছ, সকলকে ফাঁকি দিয়ে সংসার করেছ, ইনার মা হয়েছ। এই সব কিছু জেনেবুঝে কী করে তোমাকে আটকাব? কোন অধিকারে বলব, তিহি আমার কাছে থাকবে? ‘

ইশাদের মন যখন নানা ভাবনায় ব্যস্ত তখন তিহির চিন্তা-ভাবনা পিছিয়ে গেল সেই দিনটিতে। যেদিন তিহিরা এ বাসায় উঠেছিল। এই গোসলখানায় গোসল করছিল। ইশাদের মতো এমন সাবান মাখা শরীরে ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়েছিল। মুহূর্তেই ইশাদের করা সেই প্রথম চু্ম্বন চোখের তারায় স্পষ্ট হয়ে ধরা দিল। শরীরজুড়ে শীতল শিহরণ ছুটে চলতে তিহি নিজেকে ভুলে গেল, পরিস্থিতি ভুলে গেল, সম্পর্ক ভুলে গেল। সবকিছু ভুলে গিয়ে অমস্মাৎ গভীর চুমু খেল ইশাদের ঠোঁটে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here