তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,০৪,০৫

0
900

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,০৪,০৫
রোকসানা রাহমান
পর্ব (৪)

তিহির অকস্মাৎ ওষ্ঠ চুম্বনে ইশাদের চিন্তা-ভাবনা এলোমেলো হয়ে গেল। ভালোবাসার এক নিষিদ্ধ অধিকার চেপে বসল অন্তরে। মস্তিষ্কের প্রাচীরগাত্রে একটাই নাম ঠাসাঠাসি হলো, সে হলো তিহি!

” তিহি? কোথায় গেলি, মা? ”

রুকমিনি মুখার্জির ডাকাডাকিতে সম্বিৎ ফিরল ইশাদের। তিহিকে চট করে সরিয়ে নিল নিজের কাছ থেকে। দরজার দিকে চোখ ফেলে বলল,
” তোমার আম্মা আসছে! ”

তিহি নির্ভাবনায় বলল,
” তো? ”

ইশাদ দরজা থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল তিহির মুখপানে। সন্দেহ চাহনি ফেলে বলল,
” তোমার ভয় করছে না? ”
” কিসের ভয়? ”
” আমাদের দুজনকে একসাথে দেখা ফেলার ভয়। ”
” এতে ভয় পাওয়ার কী আছে? ”
” ভয় পাওয়ার নেই? ”

তিহি ইশাদের দিকে একপা এগিয়ে আসল। তার বুকে লেগে থাকা সাবানের ফ্যানা হাত দিয়ে মুছতে মুছতে বলল,
” না। আমরা তো ভালোবাসছি। আম্মা আমাদের ভালোবাসার কথা জানেন। ”

কথাটা বলেই ইশাদের ভেজা বুকে মাথা রাখল তিহি। আহ্লাদি হাসতেই ইশাদ কাঁপা স্বরে বলল,
” জানে বলেই আমার কাছ থেকে দূরে নিয়ে যাচ্ছে! ”

তিহি মাথা তুলল। গভীরভাবে খেয়াল করল ইশাদের কণ্ঠনালী কাঁপছে! সেই কণ্ঠনালিতে আলতো চুমু খেয়ে বলল,
” আমি কোথাও যাব না। আমি আমার নষ্ট পুরুষের কাছে থাকব। ”

মুহূর্তে ইশাদের বুকটা গাঢ় ভালোবাসায় আচ্ছন্ন হলো। মাকড়শার মতো নতুন উদ্যমে জাল বুনতে ইচ্ছে হলো। তার নরম শরীরটুকু দু-হাতে আগলে নিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো, ‘ কোথাও যেতে দিব না। তিহিপাখি তুমি আমার কাছে থাকবে। আমার বুকের খাঁচায় বন্দী হয়ে। ‘ তা আর বলা হলো না। রুকমিনির গলার স্বর এদিকে জোরাল হয়ে বাজতে তিহিকে গোসলখানা থেকে বের করে দিল ইশাদ। সজোরে দরজা আটকে নিশ্বাসটুকু আটকে নিল।

______
রুকমিনি মুখার্জি সকলের থেকে বিদায় নিয়ে তিহির হাত চেপে ধরলেন। তিহির জেদ ধরতে ইচ্ছে হলো, পালিয়ে যেতে ইচ্ছ হলো, ছুটে গিয়ে ইশাদের বুকে পড়তে ইচ্ছে হলো। অথচ এতগুলো ইচ্ছে চাপা পড়ল নিবিড় অভিমানে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল দূরে দাঁড়িয়ে থাকা ইশাদের দিকে। ছলছল চোখে বিস্ময় ভর্তি চাহনি! যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না এই মানুষটা তাকে আটকাছে না। একবারের জন্য বলছে না, ‘ তিহি থেকে যাও। ‘ তিহি সদর দরজার আড়ালে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ইশাদের চোখে আকুলতা খুঁজছিল। তার জন্য একটু ব্যাকুলতা! কিন্তু পেল কি?

তিহিদের গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার শব্দ পেতে শাহিনা শাইখা ইশাদের কাছে ছুটে এলেন। কিছু বলার আগেই ইশাদ বলল,
” ওর স্বামী নিখোঁজ হয়েছেন, আম্মু। মারা যাননি। ”

_________
প্রিয়াকে নিয়ে একটি কফিশপে এসেছে ইমদাদ। দ্রুত কফি অর্ডার করে ওয়েটারকে বিদায় দিল। চোখে-মুখে দুষ্টু ভাব নিয়ে প্রিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। হাতটা ধরতে প্রিয়া অভিমানের ভাব ধরে বলল,
” ছুঁবে না আমাকে। ”

ইমদাদ যেন আকাশ থেকে পড়ল এমন ভাবে বলল,
” কেন? ”
” কাল আমার ফোন ধরোনি তাই। ”

ইমদাদ মিথ্যে অভিনয় করে বলল,
” তুমি কল করেছিলে, আর আমি ধরিনি? এত বড় অন্যায় কী করে করলাম? আমার নামে তো কেস হওয়া উচিত। থানায় এখনই যাবে নাকি কফি খেয়ে? ”

প্রিয়া কিছু বলার আগেই ইমদাদ গালে চুমু খেয়ে বলল,
” কফি খেয়ে যাবে তাই তো? আমি জানি তো। দেখ, কী সুন্দর তোমার মনের কথা বুঝে গেলাম? উফ! আমি তোমাকে এত কেন ভালোবাসি! ”

ইমদাদ মুখটাকে এমন ভাব করল যেন বেশি ভালোবাসা লজ্জার ব্যাপার! প্রিয়া গলে গেল। অভিমান ভুলে আহ্লাদে ঢলে পড়ল ইমদাদের কাঁধে। আপ্লুত গলায় বলল,
” আমার বাবুটা একটুতে বেশি সিরিয়াস হয়ে যায়। কল না ধরলে কেস করতে হয় নাকি? ”

ইমদাদ বরফ আরও দ্রুত গলানোর জন্য উত্তপ্ত বাড়িয়ে বলল,
” অবশ্যই করতে হবে। তোমার কল না ধরা খুনের চেয়ে বড় অপরাধ। খুনের আসামীকে মুক্তি দিলেও আমাকে দেওয়া যাবে না৷ ”

প্রিয়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠলে ইমদাদ শান্তি পেল। মনে মনে বলল, ‘ আমি কেন ডাক্তার হলাম? আমার তো অভিনেতা হওয়া উচিত ছিল। ‘

ঠোঁটে কুটিল হাসি নিয়ে প্রিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিল ইমদাদ। ঠোঁটে চুমুটা এখনই খাবে নাকি কফি দিয়ে যাওয়ার পর এই চিন্তায় পড়ে গেল। মনে মনে সময়টুকু গণনা করায় ব্যস্ত হয়ে পড়তে ফোন বাজল। হিসাবনিকাশে ভীষণ ব্যস্ত থাকায় ফোনের রিংটোন টের পাচ্ছিল না। প্রিয়া বাধ্য হয়ে বলল,
” তোমার ফোন বাজছে। ”

ইমদাদ ভারি বিরক্ত হয়ে পকেট থেকে ফোন বের করল। ভেবেছিল কেটে দিবে, কিন্তু ইশাদের নাম দেখে কাটতে সাহস পেল না। রিসিভ করে বলল,
” হ্যাঁ, বল। ”
” কোথায় আছিস? ”
” হসপিটালে। ”
” আমিও তো হসপিটালেই। তোর চেম্বারে আছি। ”

ইমদাদ প্রিয়াকে ছেড়ে দিয়ে টেনে টেনে বলল,
” তুই হসপিটালে? ”
” হ্যাঁ। তুই কি পেশেন্টের কাছে? কোন ওয়ার্ডে? ”

ইমদাদ কী বলবে খুঁজে পেল না। মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়ে গলা কাঁপছে। ঠোঁট শুকিয়ে কাঠ! তাৎক্ষণিক কোনো উপায় না পেয়ে বলল,
” আমি তো বাসায়। ”

ওপাশ থেকে বিস্ময় ঝরে পড়ল,
” বাসায়! মাত্রই না বললি হসপিটালে? ”
” ছিলাম। একটু আগে চলে এসেছি। ”

ইশাদ আর কথা প্যাঁচাল না। সরাসরি বলল,
” ঠিক আছে। আমি বাসায় আসছি। ”

ইশাদ কল কেটে দিলে ইমদাদ টুপ করে বসে পড়ল। সেই সময় প্রিয়া বলল,
” তুমি ঘামছ কেন, বাবু? কী হয়েছে? এনিথিং রং? ”

প্রিয়ার কথার উত্তর দিতে পারল না ইমদাদ। তৎক্ষণাৎ মনে পড়ল মিহিকে রুমে রেখে বাইরে থেকে তালা মেরে এসেছে। ইমদাদ পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে প্রিয়ার হাতে দিয়ে বলল,
” সব রং, বেবি। তুমি বিল দিয়ে দিও। ”

ইমদাদ ছুটে বের হলে পেছন থেকে প্রিয়া চিৎকার করল,
” মানিব্যাগটা তো নিয়ে যাও। ”

ইমদাদ পেছন ঘুরল না। মানিব্যাগ নেওয়ার প্রয়োজনবোধও করল না। তার মাথায় একটা কথাই ঘুরছে, ‘ ইশাদের আগে বাড়ি পৌঁছাতে হবে। ‘

_______
রিকশা থেকে নেমে ভাড়া দিতে পারল না ইমদাদ। নিজের ভুলের জন্য কপাল চাপড়ে, বিনয়ের সাথে জানাল, ভেতর থেকে এনে দিচ্ছে। রিকশাওয়ালা অবাক হয়ে দেখল একটা মানুষ বানরের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে দোতলায় উঠে যাচ্ছে।

ইমদাদ জানত তার আগেই ইশাদ পৌঁছে যাবে। তবুও মনে মনে হাজার বার দোয়া করছিল যেন ইশাদ তার পেছনে থাকে। কোনো ঝামেলা না হয়। এবারের মতো বেঁচে যায়। তার সেই দোয়া কবুল হলো না। দরজায় তালা ভাঙা দেখে ইমদাদ পাথরের মতো জমে গেল। শরীরের বল হারিয়ে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে পড়ল। শুকনো গলায় ঢোক গিলতে গিলতে ভবিষ্যৎ কল্পনা করছে। ইশাদের হাতে মার খেয়েছে অসংখ্যবার কিন্তু এবার তার থেকে ভয়ংকর কিছু হবে না তো?

” ঐ তো উনি এসে গেছেন। ”

মিহির গলা পেয়ে ইমদাদ ভয়ে কুঁচকে গেল। ইচ্ছে হলো এখান থেকে পালিয়ে যেতে। কোন দিক দিয়ে পালাবে? ইমদাদ পালানোর সুযোগ পেল না তার আগেই ইশাদ রুম থেকে বেরিয়ে এলো। শক্ত হাতে ইমদাদের কাঁধ চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
” দরজায় তালা ছিল কেন? ”

ইমদাদের মনে হলো ইশাদের হাতের চাপে পিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে। বুকের হাড়গুলো এখন মড়মড় শব্দ করে ভেঙে ঝরে পড়বে। সে অসহায় চোখে তাকাতেই মিহি বলল,
” তোমাকে বললাম না আমি ঘুমিয়েছিলাম? তালা না দিলে তো চোর এসে সব নিয়ে যেত। তাই তালা দিয়েছিলেন। ”

ইমদাদ এতক্ষণে ঠোঁট নাড়ল,
” হ্যাঁ, তাই তো। মিহি বুঝে গেল আর তুই বুঝতে পারলি না? দেখলি আমাকে কত ভালোবাসে? না বলতেই সব বুঝে যায়! ”

ইশাদ সন্দেহ চোখে তাকাল। পরক্ষণে দৃষ্টি নরম করে বলল,
” তোদের দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। ”

ইমদাদ জোর করে হাসল। নিজেকে ছাড়িয়ে মিহির একটা হাত ধরল। মিষ্টি করে বলল,
” ভেতরে চলো, বউ। ”

মিহি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে ভেতরে ঢুকল। পেছন পেছন ইশাদ আসলে বলল,
” ইশাদ ভাইয়া, তোমরা কথা বলো। আমি আসছি। ”

মিহি রান্নাঘরের দিকে চলে গেলে ইমদাদ বলল,
” হঠাৎ আমার হসপিটালে গেছিলি যে, কিছু হয়েছে? ”

ইশাদের হাসি হাসি মুখটা মুহূ্র্তে মলিন হয়ে গেল। একটা ব্যথা হৃদয়ে ঝিম ধরিয়ে দিল। ভার গলায় বলল,
” তোকে অনেক কিছু বলার আছে। ”
” বল। ”

ইশাদ বলার জন্য প্রস্তুত হতে ইমদাদের নজর গেল দরজার পেছনে। যেখানে কাগজ টানিয়ে লেখা হয়েছে, ‘ বাইরে থেকে তালা মেরে যাচ্ছি। একদম চুপচাপ থাকবে। বাইরে থেকে কেউ যেন তোমার গলার স্বর না পায়। ‘ এমন কঠিন সতর্ক দেওয়ার পরেও ইশাদ কী করে জানল মিহি ভেতরে আছে? এই প্রশ্নটা যেমন মাথায় আসল তেমন ভয়ও পেল এই ভেবে যে, ইশাদ না আবার দেখে ফেলে!

ইমদাদ ইশাদকে থামিয়ে বলল,
” চল, ছাদে যাই। খোলা হাওয়ায় মনোযোগ বেশি দিতে পারব। ”

ইশাদ আর দ্বিমত করল না। তিহির ব্যাপারে মিহি না জানলেই ভালো।

ছাদের রেলিং চেপে ধরে একটানা সবটা বলতে থাকে ইশাদ। তিহির অতীত শুনতে শুনতে ইমদাদের নজর গেল ছাদের অন্যপাশে। রুম্পি দাঁড়িয়ে আছে। সে এ বাড়ির মালিকের মেয়ে। ইমদাদ যখন নতুন উঠেছিল তখন থেকেই ভাব জমানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভাব তো দূর, প্রশ্ন করলে কখনও উত্তরই পায়নি। সেই মেয়ে আজ সকালে নিজ থেকে এসে বলল,
” তালা না দিয়ে চলে যাচ্ছেন যে? ”

ইমদাদ অবাক হয়েছিল, খুশিও। সেই খুশিতে ভুল করে রুমে তালা মেরেছিল। আসলে ভুল নয়, মেয়েটিকে খুশি করতে তালা মেরেছিল। সাথে এটাও ভেবেছিল, দরজা খোলা থাকলে রুম্পি জেনে যাবে মিহির কথা। যে মেয়ে ইমদাদ ব্যাচেলর জেনেও পাত্তা দেয়নি, সে মেয়ে ম্যারিড শুনলে তো দূর দূর করবে! সে চাচ্ছিল না দূর হতে। মেয়েটা যখন এতগুলো দিন পর নিজ থেকে কথা বলতে এসেছে সেহেতু একটা সুযোগ নেওয়াই যায়। সেই সুযোগ নিতে গিয়ে যে তার নাস্তানাবুদ হতে হলো এর দোষটা সম্পূর্ণ গিয়ে পড়ল রুম্পির উপর। বিরক্তে চোখ ফিরিয়ে নিবে তখনই কলার চেপে ধরল ইশাদ। তর্জন করে বলল,
” সালা, এখনও ঠিক হোসনি? তোর চোখদুটো আজ আমি উপরেই ফেলব। ”

চোখ উপড়ে না নিলেও একটা ভারি ঘুষি পড়ল ইমদাদের নাকে। মাথাটা পেছনে বেঁকে গিয়ে দেয়ালে লাগল। আরেকটা ঘুষির প্রস্তুতি নিতে মিহি দৌড়ে এলো,
” ইশাদ ভাইয়া, তিহি আপু কল করেছে। ”

মিহিকে দেখে ইশাদ নিজেকে সংযত করে নেয়। তার হাতে ফোন তুলে দিয়ে ইমদাদের কাছে ছুটে যায় মিহি। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে,
” কী হয়েছে আপনার? এভাবে পড়ে আছেন কেন? ”

ইমদাদ তার উত্তর না দিয়ে ইশাদকে বলল,
” কী হলো চুপ করে আছিস কেন? তিহির সাথে কথা বল। ”

ইশাদ ইমদাদের দিকে তাকিয়ে ধীরে বলল,
” হ্যালো? ”

সাথে সাথে ওপাশ থেকে কান্নায় ভেঙে পড়ল তিহি। নাভিশ্বাস তুলতে তুলতে বলল,
” আমাকে নিয়ে যাও, ইশাদ। তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাব। ”

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (৫)

” আমাকে নিয়ে যাও, ইশাদ। তোমাকে ছাড়া আমি মরে যাব। ”

ইশাদ তাৎক্ষণিক উত্তর দিল না। দুর্বলতা গ্রাস করল তনু ও মনে। চোখের পাতা জোড়া বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে তিহির ফুঁপানি শুনছে আপনমনে।

তিহি অনেক্ষণ চুপ থেকেও ইশাদের গলা না পেয়ে অস্থির হয়ে পড়ল। অধৈর্য্য হয়ে আকুল গলায় বলল,
” ইশাদ, আমি সত্যিই মরে যাব! ”

তিহি কথাটা শেষ করতে ইশাদ চট করে চোখ মেলল। কঠিন স্বরে বলল,
” তাহলে মরে যাও। ”

মুখায়ব কাঠিন্য রেখেই কল কেটে ফোন পকেটে পুড়ল। ইমদাদ দৌড়ে এলো নিজের ব্যথা ভুলে। অবিশ্বাস্য স্বরে জিজ্ঞেস করল,
” কী বললি এটা! ইশাদ, তোর মাথা ঠিক আছে? ”

ইশাদ ক্রোধ চোখে তাকাল। ঘাড় শক্ত করে জবাব দিল,
” যার বেঁচে থাকা অন্য কারও উপর নির্ভর থাকে তার মরেই যাওয়া উচিত। ”

ইমদাদ দু-দিকে মাথা নেড়ে বলল,
” তুই ঠিক নেই। নিশ্চয় সকাল থেকে পেটে কিছু পড়েনি। ক্ষিধের চোটে ভুল-ভাল বলছিস। খাবি চল। ”

ইশাদের কাঁধ জড়িয়ে নিতে নিতে মিহির দিকে তাকাল ইমদাদ। বলল,
” রান্না হয়েছে? ”
“হ্যাঁ। ”
” যাও, খাবার বাড়ো। আমরা আসছি। ”

মিহি ছুটে চলে গেলে। ইশাদ নিজের কাঁধ ছাড়িয়ে নিল। অন্য দিকে ঘুরে বলল,
” আমি খাব না। ”
” কেন? ”
” ক্ষিধে নেই। ”

ইশাদ রেলিংয়ের কাছে দাঁড়ালে পেছন থেকে ইমদাদ উঁচু স্বরে বলল,
” তুই বললেই হলো ক্ষিধে নেই? তোর মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে সারা দিন না খাওয়া। আমার তো মনে হয় তিহি চলে যাওয়ার পর থেকে পেটে একটা দানাও পড়েনি। ”

এইটুকু বলে ইশাদের দিকে এগিয়ে গেল ইমদাদ। কাঁধে হাত রেখে নরম স্বরে বলল,
” তিহি পাগল, তাই পাগলামি করছে। কিন্তু তুই তো সুস্থ। তোকে কি…”

কথাটা শেষ করতে পারল না ইমদাদ। তার আগেই ইশাদ চরকিবেগে ঘুরে দাঁড়াল। চোখের পাকানি দেখে ইমদাদ সাবধান হয়ে গেল। নিজের ভুল শুধরে বলল,
” তিহি কেন পাগল হবে? আমি পাগল। পাগলের চিকিৎসা করতে করতে আমিও পাগল হয়ে গেছি। আমার তুই ছাড়া কেউ নেই। তাই এখনও বাইরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বলছি কি তুই একটু সময় পেলে আমাকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে…”

ইশাদ বিরক্তে কপাল কুঁচকে ফেলল। ইমদাদকে ফেলে ছাদ থেকে নেমে যাচ্ছে। ইমদাদ পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে বিড়বিড় করছে, ‘ নিজে মেরে ফেললে দোষ নেই আর আমি একটু পাগল বলাতেই দোষ! ‘ বিড়বিড়ানিতে মনোযোগ দিতে গিয়ে খেয়াল করেনি ইশাদ মাঝ সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। তার সাথে ধাক্কা লাগলে ইশাদ বলল,
” হয়েছে? ”

ইমদাদ নিজেকে সামলে বোকা কণ্ঠে বলল,
” কী? ”
” বিড়বিড় করা? ”
” তুই এটাও শুনেছিস? ”

ইশাদ উত্তরে সামান্য হাসল। ইমদাদকে একহাতে জড়িয়ে বলল,
” আমার রক্তের সম্পর্কে অনেকে থাকলেও আত্মার একজনই আছে। ”

ইশাদের কথার অর্থ ধরতে পেরে ইমদাদ কৃতজ্ঞতাপূর্ণ হাসল। বন্ধুর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে উচ্ছল স্বরে বলল,
” এবার চল পেটে কিছু চালান করি। ”

__________

দুপুরের খাবারে রুটি আর ডিম ভাজা দেখে তাজ্জব বনে গেল দুই বন্ধু। ইশাদ বিস্ময় আড়াল করতে পারলেও ইমদাদ পারল না। বলে ফেলল,
” মিহি, আমরা কি সকালের নাস্তা করছি? ”

মিহি সরলমনে বলল,
” না, দুপুরের খাবার খাচ্ছেন। ”

ইমদাদ ভাজা ডিম উঁচু করতে টপটপ করে তেল বেয়ে পড়ছে। সেদিকে তাকিয়ে বলল,
” আমি তো জানতাম, সকালের নাস্তায় রুটি আর ডিম থাকে। দুপুরের নাস্তায়ও যে থাকতে পারে বিয়ে না করলে জানতেই পারতাম না! ”

ইশাদকে কনুই দিয়ে গুতা দিয়ে বলল,
” তুই আগে থেকেই জানিস নাকি? না জানলে এখন জেনে রাখ। ”

ইশাদ কড়া চোখে তাকাল। ইমদাদের হাত থেকে ডিম নিজের প্লেটে নিয়ে বলল,
” আমার বোনের হাতে রান্না খাচ্ছিস তাই তোর ভাগ্য। শুকরিয়া কর। ”

ইমদাদ শুকরিয়া করতে পারল না। পেটের ভেতরে ক্ষুধার তীব্রতা টের পেল। গলার ভেতরটা তেতো হয়ে আসতে মজার ভাবটা কেটে গেল। ইশাদ না থাকলে হয়তো কয়েক প্রস্থ ধমকাধমকি করে ফেলত। ইশাদের ভয়ে নিজেকে সংযত রাখতে চেয়েও খুব একটা পারল না। বিরস গলায় জিজ্ঞেস করল,
” তুমি রাঁধতে পার না? ”

মুহূর্তে মিহির মুখের হাসি হারিয়ে গেল। মাথা নিচু করে বলল,
” একটু একটু পারি। ”

ইমদাদ জেরা শুরু করে দিল,
” কী কী পার শুনি? ”

মিহি একবার চোখ তুলে দেখল ইমদাদকে। তারপরেই নতজানু হয়ে বলল,
” রুটি, ভাত, ডাল, ভর্তা। ”
” কী কী ভর্তা? ”
” শুধু আলু ভর্তা। ”
” আর কিছু পার না? ”
” না। ”

ইমদাদ তপ্ত শ্বাস ফেলল। রাগটাকে ভেতরে রেখে বলল,
” তাহলে ভাত, ডাল, ভর্তাই করতে। রুটি করতে গেলে কেন? ”

ইমদাদের একের পর এক প্রশ্নে মিহি কুণ্ঠিত হচ্ছিল। দুর্বল স্বরে বলল,
” মা বলত, আমি রুটি ভালো বানাতে পারি তাই। ”
” ভালো বানাতে পার বলে দুপুরে রুটি খাওয়াবে? সময় জ্ঞান নেই নাকি? ”

মিহি হালকা কেঁপে উঠল। অসহায় চোখে তাকালে ইমদাদ বলল,
” তোমার মা তোমাকে রান্না শেখাইনি? মায়ের আঁচলের নিচে থেকে করেছটা কী? ”

ইমদাদের এমন কথায় মিহির কান্না পেয়ে গেল। ছলছল চোখে বলল,
” মা আমাকে কখনও রান্না শেখায়নি। এগুলো আমি দেখে দেখে শিখেছি। বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের বাসায় এসবই রান্না হত। অন্যকিছু হলে সেগুলোও শিখতে পারতাম।

মিহির কথায় ইমদাদের উপর কোনো প্রভাব না পড়লেও ইশাদের খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। সে এতক্ষণ চুপচাপ দুজনের কথপোকথন শুনে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক বুঝার চেষ্টা করছিল। মিহিকে ভেতরে রেখে বাইরে তালা দেওয়ার যুক্তিটা তার পছন্দ হয়নি। সন্দেহ দূর হওয়ার বদলে বেড়ে গিয়েছিল।

ইশাদ কিছু বলার জন্য উদ্যত হতে ইমদাদ তাড়াতাড়ি বলল,
” এখন থেকে আমাদের বাসায় অন্য কিছু রান্না হবে। তুমি সেগুলো দেখবে আর শিখবে, ঠিক আছে বউ? ”

মিহি ভেজা চোখে চকিতে তাকাল। ইমদাদ চোরা চোখে ইশাদকে দেখে বলল,
” প্রেম করার সময় দুজন দিন-রাত কথার পাহাড় বানালাম অথচ রান্না নিয়ে কিছু বললাম না। এটা কিছু হলো? কোনোভাবে যদি আঁচ করতে পারতাম তুমি রান্না পার না তাহলে বিয়ের আগেই রান্নার লোক রাখতাম। তাহলে এই ভর দুপুরে কষ্ট করে রুটি বানাতে হত না! ”

এতক্ষণে ইশাদ কথা বলল,
” বানিয়ে যখন ফেলেছেই ভালোবেসে খেয়ে ফেল। ”

ইমদাদ কৃত্রিম হাসল। ভেতরে বিরক্ত নিয়ে রুটি ছিঁড়ে মুখে ঢুকাল।

খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে ধুতে হঠাৎ ইমদাদ বলল,
” তিহির ঠিকানাটা দে তো। বের হওয়ার আগে একটু খোঁজ নিয়ে দেখি কোন পথে গেলে তাড়াতাড়ি যাওয়া যাবে। ”

ইশাদ প্রথমে অবাক হলেও পরমুহূর্তে স্বাভাবিক হয়ে বলল,
” নেই। ”
” নেই মানে? রাখিসনি? ”
” না। ”
” কেন? ”

ইশাদ বসা থেকে উঠল। এক কদম হেঁটে বলল,
” তখন আমি ঠিকানা রাখা প্রয়োজন মনে করিনি। ”
” এখন তো প্রয়োজন হচ্ছে। ”

ইশাদ ইমদাদের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাল। শুকনো গলায় বলল,
” না, এখনও প্রয়োজন হচ্ছে না। কারণ, আমরা কোথাও যাচ্ছি না। ”

ইমদাদ অস্থির হয়ে গেল। অসহিষ্ণু স্বরে বলল,
” তুই কি চাচ্ছিস মেয়েটা সত্যি মরে যাক? ”

ইশাদ সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়াল। অন্যরকম গলায় বলল,
” ব্যাপারটা এত সহজ না ইমদাদ। তিহি নিজের বাড়িতে নয়, শ্বশুরবাড়িতে আছে। তাছাড়া ওদের লাভ ম্যারেজ ছিল। ”

ইমদাদ তার কথায় গলে না গিয়ে প্রতিবাদ করল,
” কী ছিল না ছিল আমি বুঝি না। আমি শুধু বুঝি তিহি তোকে ভালোবাসে, তুই ওকে। আর আমি চাই এই ভালোবাসা পূর্ণতা পাক। তার জন্য আমার যা করতে হয় তাই করব। প্রয়োজন হলে তিহিকে তুলে…”

ইমদাদকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ইশাদ বলল,
” আমি তাড়াহুড়ায় কোনো সিদ্ধান্ত নিতে চাই না। আমাকে ভাবতে দে। ”

ইমদাদ ইশাদকে ভাবার সময় দিল না। হেঁচকা টানে রুম থেকে বের করে বলল,
” গাড়িতে বসে বসে ভাবিস। এখন চুপচাপ আমাকে অনুসরণ কর। ”

__________

ইমদাদ একপ্রকার জোর করেই ইশাদকে নিয়ে বাস কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই তারা শেরপুর টাউনের উদ্দেশ্যে টিকিট কিনল। বাস সামনে এসে দাঁড়ালে ইশাদকে ঠেলে তুলল। পাশাপাশি বসে বলল,
” আমরা কবে কখন ফিরব বুঝতে পারছি না। আন্টিকে আগে থেকে বলে রাখলে ভালো হয়। তুই কল দিবি নাকি আমি? ”

ইশাদ ইমদাদকে উত্তর দেওয়ার বদলে ফোন বের করল। মায়ের নাম্বারে ডায়াল করে বাইরে তাকাল জানালা দিয়ে। একটু দূরে দৃষ্টি পড়তে আচমকা স্থির হয়ে গেল চোখের পাতা। গলা থেকে বেরিয়ে আসল একটি শব্দ, ‘ বাবা! ‘

সেই সময় ফোনের ওপাশ থেকে শাহিনা শাইখা বললেন,
” হ্যাঁ, বাবা বল। ”

ইশাদ জানালা দিয়ে গলা বের করে বাবাকে ভালো করে দেখে জিজ্ঞেস করল,
” আম্মু, আব্বু কোথায়? ”
” কোথায় আবার? বাসায়ই তো। ”
” বাসায় নেই, আম্মু। ”
” কী বলছিস? দুপুরে খেতে তো…”

মায়ের পুরো কথা শোনার ধৈর্য হলো না ইশাদের। দ্রুত প্রশ্ন করল,
” আব্বুর কি কোথাও যাওয়ার কথা ছিল? দূরে কোথাও? ”
” সেরকম কিছু তো আমাকে বলেনি। ”

ইশাদ আরও কিছু বলতে চাইল তার আগেই কথা হারিয়ে ফেলল। ফোন কানে বিস্ময় চোখে দেখল তার বাবা রুবিনাকে নিয়ে একটি বাসে উঠছেন।

দুজনে বাসের ভেতরে হারিয়ে গেলে ইশাদের বিস্ময় কাটল। সে তাৎক্ষণিক বাস থেকে নামার তোরজোর শুরু করল। ইমদাদের বাধা শুনল না। বাস থেকে নেমে বাসার দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছে, আজ একটা বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here