তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,০৬,০৭

0
842

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,০৬,০৭
রোকসানা রাহমান
পর্ব (৬)

ইশাদ বাসায় ঢুকলে টনু দৌড়ে এলো। জানাল, তার মা ছাদে পা পিছলে পড়ে গেছে। কোমরে ব্যথা পাওয়ায় হাঁটতে পারছে না। চিলেকোঠায় বসে আছে অনেক্ষণযাবৎ। কথাটা শোনার পর ইশাদ উদ্বিগ্নচিত্তে সিঁড়ি কাটল। মায়ের কাছে পৌঁছে বিনাবাক্যে কোলে তুলে নিলে, শাহিনা শাইখা দ্রুত জিজ্ঞেস করলেন,
” আরে, কী করছিস? কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস? ”

ইশাদ জরুরি গলায় বলল,
” ডাক্তারের কাছে। ”

ডাক্তারের কথা শুনে শাহিনা শাইখা ইশাদের গলা ছেড়ে দিলেন। নামার জন্য ছটফট করতে করতে বললেন,
” কোথাও যেতে হবে না। নামা আমাকে। ইশাদ, নামা বলছি। ”

মায়ের এমন বাচ্চাদের মতো হাত-পায়ের ছুটাছুটি সামলাতে কষ্ট হচ্ছে ইশাদের। বাধ্য হয়ে তাকে তার রুমে নিয়ে গেল। সাবধানে খাটে রেখে বলল,
” এমন করে কেউ? যদি হাত ছুটে যেত? একদম গড়িয়ে নিচে পড়তে, আম্মু! ”

ইশাদের অসহায় মুখটা দেখে শাহিনা শাইখা মৃদু হাসলেন। হাতদুটো টেনে বললেন,
” এত সহজ? এগুলো আমার ছেলের হাত। মাকে রক্ষা করায় সর্বদা প্রস্তুত। ”

ইশাদ মায়ের পাশে বসল। তার প্রশংসায় আনন্দিত না হয়ে রাগ নিয়ে বলল,
” তুমি আমাকে মিথ্যে বলেছ কেন? ”
” কী মিথ্যা বলেছি? ”
” এই যে বাবা আছে। ”
” ছিল তো। তাকে নিচে দেখেই তো আমি উপরে গেলাম। ”

বাবার উপর বসে থাকা রাগটা আবার চড়ে উঠল। আচমকা মায়ের দিকে দুটি হাত মেলে সুধাল,
” তোমার কি এই দুটো হাতের উপর বিশ্বাস আছে, আম্মু? ”

শাহিনা শাইখা কপাল কুঁচকালেন। সরু চোখে ছেলের দিকে তাকালেন। ভেতরে কী চলছে বুঝার চেষ্টা করলেন। না পেরে বললেন,
” থাকবে না কেন? ”
” আম্মু, প্রশ্ন নয় উত্তর দেও। ”

শাহিনা শাইখা ছেলের হাত টেনে তালুতে চুমু খেয়ে বললেন,
” হ্যাঁ, আছে। ”

ইশাদ খুশি হলো। ভীষণ শান্ত কিন্তু দৃঢ়স্বরে বলল,
” আমি তোমার দায়িত্ব চাই, এখন, এই মুহূর্তে। ”

প্রথমে বুঝতে পারলেন না শাহিনা শাইখা। পর মুহূ্র্তে আৎকে উঠলেন। ডান হাত দিয়ে বুকের মাঝে গভীর চাপ রেখে বিস্ফারিত চোখে বললেন,
” কী বলছিস, ইশাদ। অসম্ভব! ”

ইশাদ তার সেই অসম্ভব শব্দটাকে পরোয়া করল না। মায়ের বালিশের নিচ থেকে আলমারির চাবি নিল। তালা খুলতে খুলতে বলল,
” যদিও তোমাকে এক কাপড়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা আমি রাখি। কিন্তু দাদা-দাদির দেওয়া জিনিসগুলো তোমার সাথে নিয়ে যাব। কারণ, এগুলো তোমার। আর এ বাসা থেকে একবার বেরিয়ে গেলে আর কোনোদিন আসতে দিব না। তাই পরে চাইলেও নিতে পারবে না। ”

শাহিনা শাইখা বিছানার চাদর খামচে ধরে একস্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন, অবিশ্বাস্য কিছু দেখছেন। ইশাদ কালো রঙের ব্যাগের চেইন লাগিয়ে বলল,
” আমি শুধু চাই না ঐ লোকটার কোনো জিনিস তুমি ব্যবহার করো। যার স্ত্রীর প্রতি নূন্যতম সম্মান, শ্রদ্ধা, সমাদর নেই তার নামের সকল বস্তু তুচ্ছ, মূল্যহীন। ”

ইশাদ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে চিৎকার করে টনুকে ডাকল। রিকশা ভাড়া করে মূল দরজার সামনে আনার হুকুম দিল। সে ছুটে বেরিয়ে যেতে যেতে সোবহান শাইখ উপস্থিত হলেন দোরগোড়ায়। স্ত্রী ও ছেলের দিকে একপলক চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
” তোমরা কোথাও যাচ্ছ? ”

শাহিনা শাইখা উত্তর দিতে চাইলেও সুযোগ পেলেন না। ইশাদ অবজ্ঞায় বললেন,
” আপনাকে বলার প্রয়োজন মনে করছি না। ”

ছেলের কাছ থেকে এমন উত্তর অপ্রত্যাশিত ছিল। তিনি রুমের ভেতর ঢুকে বললেন,
” এভাবে কথা বলছ কেন? ”

ইশাদ বাবার দিকে সরাসরি চেয়ে শক্ত গলায় বলল,
” আপনার সাথে এভাবেই কথা বলা উচিত। ”

সোবহান শাইখ রেগে যাচ্ছেন বুঝতে পেরে শাহিনা শাইখা দ্রুত বললেন,
” ওর কী জানি হয়েছে। বলছে, আমাকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে। ”

শাহিনা শাইখার কাতর কণ্ঠস্বরে খুব একটা বিচলিত হলেন না সোবহান শাইখ। ধীরস্বরে ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন,
” হঠাৎ এমন সিদ্ধান্তের কারণ জানতে পারি? ”

ইশাদ বাবার দিকে এক নজর চেয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল অন্যদিকে। বলল,
” হঠাৎ নয়, অনেক আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। কিন্তু মাকে বলার সাহস পাইনি। ”
” আজ সাহস পেয়েছ? ”
” হ্যাঁ। ”
” কিভাবে? ”

মুহূর্তে ইশাদের চোখে বাস স্ট্যান্ডের সেই দৃশ্য ভেসে উঠল। ঘৃণায় চোখ বুজে বলল,
” কয়েক ঘণ্টা আগে আপনার ঘটানো কাণ্ডে। ”

এই এতক্ষণে সোবহান শাইখের মুখমণ্ডলের ভাব পালটাতে লাগল। কণ্ঠস্বর দুর্বল হয়ে আসল,
” মানে? কী করেছি আমি? ”

ইশাদ আর অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে রাখতে পারল না। রাগে-ক্ষোভে মাথার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে যেন। চোয়াল কাঁপছে ক্রমাগত। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
” লজ্জা করছে না তোমার? নিজের কুকর্মের কথা ছেলের মুখ থেকে শুনতে চাচ্ছ? ছি! ”

ছেলের এমন বিকৃত বদনে সোবহান শাইখ আর ঠিক থাকতে পারলেন না। শরীরজুড়ে কাঁপুনি উঠে গেছে। রাগে কাঁপছে সেও। কিন্তু চেঁচালেন না। ইশাদের কাঁধ ধরে নিজের দিকে টেনে বললেন,
” কথা প্যাঁচাবি না একদম। সরাসরি বল, কী করেছি আমি? ”

ইশাদও আর কথা ঘুরাল না। সরাসরি বলল,
” আমার অসুস্থ মাকে ফেলে তুমি রুবিনা আন্টিকে নিয়ে বাইরে বেরিয়েছ। টিকেট কেটে দুজনে বাসে উঠেছ। অথচ তোমার দায়িত্ব ছিল আম্মুকে নিয়ে হসপিটালে যাওয়া। তার ভালো-খারাপ দেখাশোনা করা। আব্বু, আর কত? আমার আম্মুকে এবার রেহাই দেও! ”

ইশাদের দুটো কথা ভারী অসহায় শোনায়। কাতরতায় ডুবে আছে যেন! তার সেই অনুরোধ চাপা পড়ল সোবহান শাইখের গলা ফাটা চিৎকারে। টনুকে ডেকে যাচ্ছেন বিরতিহীন। সে ঘোড়ার মতো ছুটে আসতে গিয়ে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়। সে অবস্থায় জিজ্ঞেস করল,
” মালিক ডাকতাছেন? ”

সোবহান শাইখ চোখ রাঙানোতে জিজ্ঞেস করলেন,
” আমি যখন বাসা থেকে বের হয়েছি তখন ইশাদের মা কোথায় ছিল? ”

টনু তাৎক্ষণিক উত্তর দিল,
” ছাদে। ”
” সে যে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙেছে এ কথা আমাকে জানিয়েছে? ”

টনু দ্রুত মাথা দুপাশে নেড়ে বলল,
” না, উনি তো ছাদ থেকে নামতেই পারতাছিল না জানাইব ক্যামনে? আপনে যাওয়ার পর আমি ছাদে কাপড় মেলতে গিয়া দেখছি ম্যাডাম পইড়া আছে। ”
” তোর ম্যাডাম আমাকে ফোন করেছিল? ”
” না। ম্যাডামের কাছে ফোন আছিল না। ছোট স্যার যখন কল দিল তখন আমি ফোনের শব্দ শুইনা দিয়া আইছি। ”

সোবহান শাইখ জিজ্ঞাসাবাদ শেষ করে ইশাদের দিকে তাকাল। সে সন্তুষ্ট হলো না। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,
” আমার তো মনে হয় আপনাকে জানালেও ঘটনার কোনো পরিবর্তন ঘটত না। ছোটবেলা থেকে তো আপনাকে দেখে এসেছি। ”

সোবহান শাইখ কটমট চোখে তাকালেন। পর মুহূর্তে শান্ত চাহনি ঘুরিয়ে নিলেন স্ত্রীর দিকে। বললেন,
” তোমার ছেলের যদি মনে হয় তুমি এখান থেকে চলে গেলে ভালো থাকবে তাহলে যাও। আমি তোমাকে আটকাব না। কিন্তু ভুল বুঝে যাবে এটা মানব না। মিহির মাকে এ বাসায় তুমি এনেছিলে। সে যে এমনি এমনি আসার মেয়ে নয় আমি জানি, নিশ্চয় তুমি হাতে-পায়ে ধরেছিলে। রাজি না হওয়ায় ইশাদের সাথে মিহির বিয়ের কথা তুলেছিলে। আমি কি ঠিক বলছি? ”

শাহিনা শাইখা হতভম্ব চোখে মাথা উপরনিচ করলেন। সোবহান শাইখ আবার বললেন,
” তোমার এত কষ্ট বিফল হলো। মিহি বিয়ে করল ইমদাদকে। যেটা আমরা মেনে নিলেও রুবিনার পক্ষে মানা কতটা কষ্টের ছিল সেটা আমার থেকে তোমার ভালো জানার কথা। তবুও সে মুখ ফুটে একটা কথা বলেনি। সে চাইলে কিন্তু অনেক ঝামেলাই করতে পারত, করেনি। বরং বড় মনের পরিচয় দিয়ে চুপচাপ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছিল। ”

শাহিনা শাইখা মাঝখানে প্রশ্ন করে বসলেন,
” উনি চলে যাচ্ছিলেন? ”

সোবহান শাইখ মাথা ধীরে উপরনিচ করে বললেন,
” হ্যাঁ। ব্যাপারটা আমিও জানি না। অবশ্য জানার কথা না। কারণ, তার সাথে আমার আলাদা করে কখনই কথা হয়নি। দুপুরের খাবার পর আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম হাঁটতে। হঠাৎ রুবিনাকে বের হতে দেখি। হাতে ব্যাগ দেখে সন্দেহ হয়েছিল। পিছু নিতে দেখি সে সামনে যাকে পাচ্ছে তাকেই সিরাজগঞ্জ যাওয়ার উপায় জিজ্ঞেস করছে। আমার ভয় হলো, কোনো খারাপ লোকের খপ্পরে না পড়ে, সেই ভয়ে আমি তার সামনে যাই। রুবিনা রাজি না হওয়া সত্ত্বেও জোর করে তার সাথে চলি। ইচ্ছে হয়েছিল তাকে আটকাই। কিন্তু বলা হয়নি। কারণ, তাকে থেকে যাওয়ার মতো কোনো সম্পর্কই আমাদের মধ্যে ছিল না। একটা সম্পর্ক হতে গিয়েও হয়নি। আর কোনো সম্পর্ক হওয়ার পথও নেই। তাই চুপচাপ তাকে নিরাপদে বাসে উঠিয়ে দিয়ে এসেছি। ব্যস, এতটুকুই। এরমধ্যে তোমার ছেলে খারাপ কী দেখেছে আমি জানি না। তোমার যদি মনে হয় আমি ভুল করেছি তাহলে বলো। এখনই বলো। ”

শাহিনা শাইখা কিছু বললেন না। নির্বাক চোখে তাকিয়ে থাকলেন। ইশাদের রাগটাও পড়ে গেল। সাথে বুঝে গেল, মাকে আর নেওয়া যাবে না। দোষ থাকা সত্ত্বেও যার প্রতি ভালোবাসা বিন্দুমাত্র কমেনি, নির্দোষ অবস্থায় তাকে ফেলে চলে যাবে? এত ভাবনাতীত! ইশাদ কাঁধ থেকে ব্যাগ রেখে দিল। চেইন খুলে সবকিছু আগের জায়গায় গুছিয়ে রাখছে।

সোবহান শাইখ সগর্বে বের হতে গিয়েও থমকালেন। নাক উঁচু করে বললেন,
” তোমার আব্বুর ব্যবহার খারাপ হতে পারে, চরিত্র না। চরিত্র খারাপ হলে আজ আমাকে এখানে দেখতে পেতে না। আমাকে ধরে রাখার মতো কোনো মায়া, ক্ষমতা তোমার মায়ের নেই। রুবিনার সাথেও খারাপ সম্পর্ক তৈরি করার প্রয়োজন পড়ত না। তাকে বিয়ে করে নতুন সংসার করার মতো ক্ষমতা আমার ছিল। মিহির বাবার মরে যাওয়া পর্যন্তও অপেক্ষা করতে হতো না। এক ডাকে সব ফেলে চলে আসত। ”

কথাটা শেষ করে নাক উঁচু অবস্থায় চলে যেতে নিলে শাহিনা শাইখা নীরবতা ভাঙলেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে ইশাদের উদ্দেশ্যে বললেন,
” আমি পরনের কাপড়টাও নিয়ে যেতে চাই না, ইশাদ। কাছের একটা দোকান থেকে একটা শাড়ি নিয়ে আয়। তাড়াতাড়ি আসবি। এই আমি নিশ্বাস আটকে রাখলাম। এ বাড়ির একফোটা অক্সিজেনও আমার জন্য বিষ! ”

___________
ইমদাদ হাসপাতাল থেকে ফিরল সন্ধ্যার পর। অস্থির মনে পায়চারি করছে। চিন্তায় মাথা ধরে গেছে। কাল রাত থেকে ইশাদকে কল দিয়ে যাচ্ছে, ধরছে না। দুইবার তার চেম্বারে গিয়েছিল, পায়নি। বাসায় খোঁজ নিয়েছিল, সেখানেও নেই। মানুষটা হঠাৎ গায়েব হলো কী করে? এদিকে শেরপুরের এক পেশেন্টের আত্মীয় থেকে তিহির ঠিকানা পেয়েছে। তাপান মুখার্জি নাম শুনেই চিনে ফেলেছেন ভদ্রলোক। খুব টাকা নাকি লোকটার। ক্ষমতাশালী কোনো পদে না থাকলেও লোকজন সমীহ করেই চলে।

” আপনাকে চা দিব? ”

এই নিয়ে বেশ কয়েক বার ইমদাদের সামনে এসেছে মিহি। নানা রকম প্রশ্ন করেছে। ইমদাদ কানে তুলেনি। তার পুরোমন ফোনে। পরিচিত সকলকে কল দিয়ে যাচ্ছে। যদি কেউ ইশাদের খোঁজ দিতে পারে এ আশায়।

মিহি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার জিজ্ঞেস করল,
” অন্যকিছু খাবেন? আজ মিলা খালা নুডলস রান্না শিখিয়েছে। রান্না করব? ”

এ পর্যায়ে ইমদাদ ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। কণ্ঠ থেকে প্রচণ্ড বিরক্ত ঝরে পড়ার পূর্বেই ফোন বেজে উঠল। ইশাদের বাবার কল। সালাম দিয়ে কথা শুরু করল। কয়েক সেকেন্ড পর কেটে দিতে ইমদাদের চিন্তা আকাশের মাপ নিল। সে তাৎক্ষণিক ইশাদের নাম্বারে কল দিল। কী ভাগ্য! কল রিসিভ হলো। সে উত্তেজিত হয়ে বলল,
” আরে ভাই, কল ধরছিস না কেন? কাল থেকে কম করে হলেও লক্ষবার কল দিয়েছি। তোর বাবার কলও নাকি ধরছিস না? সমস্যা কী? ”
” বাবা, কল দিয়েছিল তুই জানলি কিভাবে? ”
” একটু আগে কল করে বললেন। ”

মুহূর্তে রেগে গেল ইশাদ। রাগ নিয়ে বলল,
” এখনই তার নাম্বার ব্লকলিস্টে ফেলবি। ”

ইশাদকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ইমদাদ বলল,
” আচ্ছা। কথা শেষ করেই ফেলব। জরুরি কথা আছে। ”

ইশাদ মানল না। আগের রাগ নিয়েই বলল,
” না। আমি কেটে দিচ্ছি, ব্লকলিস্টে ফেলে আমাকে কল দে। ”

আদেশ করে ইশাদ কল কেটে দিল। সেই সময় মিহি বলল,
” ইশাদ ভাইয়া? তাকে বলুন আমি নুডলস রান্না করেছি। এসে যেন খেয়ে যায়। ”

কথাটা শেষ করতে পারল না ইমদাদ তার দিকে অগ্নিরূপে ঘুরল। মিহির হাতের গরম নুডলসের বাটিটা উল্টে দিয়ে বলল,
” একটু চুপ থাকতে পার না? দেখছ না, আমি চিন্তায় মরে যাচ্ছি? ”

ইমদাদের কথাটা মিহির কানে পৌঁছাল কি? তার আগেই চোখ চেপে ধরে বসে পড়ল। কাটা চামচের ঘাটা বুঝি চোখের ভেতরেই লেগেছে!

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (৭)

কাটাচামচ মিহির চোখের ভেতর না ঢুকলেও নিচের নরম স্থানে ঘা লেগেছে। দূরত্ব প্রায় এক সেন্টিমিটার। রক্ত জমে ফুলে ঢোল! নিচের দিকে তাকালে সাদা ব্যান্ডেজের প্রতিচ্ছায়া দেখা যায় শুধু। ইশাদ মিহিকে রেখে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলে ইমদাদ পথরোধ করে বলল,
” বিশ্বাস কর, আমি ইচ্ছে করে দিইনি। ওটা একটা এক্সিডেন্ট ছিল! ”

ইমদাদের অসহায় মুখমণ্ডল ও কণ্ঠস্বর কোনোটাই ইশাদের শক্ত চোয়াল নরম করতে পারল না। উল্টো চোখে আগুন জ্বলে উঠল। শক্ত মুঠে কলার চেপে ধরে চাপা স্বরে শাসাল,
” তুই আবার আমার সামনে এসেছিস? আমি কিন্তু ভুলে যাব এটা হসপিটাল। ”

ইমদাদ ভয়ে জমে গেল। গলা শুকিয়ে খড়ায় পরিণত হলো। বুকের পাটা সংকুচিত করে বলল,
” আর এমন ভুল হবে না। মাফ করে দে। ”

ইশাদ কলার ছেড়ে ছিল। বিনাবাক্যে গরম চাহনি ফেলে হাঁটা ধরল নিজের চেম্বারের দিকে। ইমদাদ শুকিয়ে আসা কলিজা নিয়ে ইশাদের পিছু নিল। বিনা অনুমতিতে চেম্বারের ভেতর ঢুকে অনুরোধের গলায় বলল,
” বলছি তো আর ভুল হবে না। আমার চোখ, কান নষ্ট করে হলেও তোর বোনকে রক্ষা করব। ”
” তুই সত্যিই মিহিকে ভালোবাসিস? ”

ইশাদের হঠাৎ এমন প্রশ্নে ইমদাদ ঘাবড়ে গেল। ভয়ে জড়োসড়ো শরীরটা মেলে দাঁড়াল। চোখদুটো ইশাদের চোখে পড়তে নতুন ভয়ের জন্ম হলো। মিথ্যা ধরা পড়ার ভয়!

ইশাদের সন্দেহভরা চাহনিতে চেয়ে থাকতে পারল না ইমদাদ। মনিদুটো চঞ্চল হয়ে ঘুরতে লাগল পুরো চেম্বারজুড়ে।

ইশাদ এগিয়ে এসে অটল চাহনি ফেলে জিজ্ঞেস করল,
” মিহিকে ভালোবাসিস? উত্তর দে। ”

ইশাদের চোখে চোখ রাখার সাহস হলো না ইমদাদের। অন্যদিকে ঘুরে আমতা আমতা করে বলল,
” বাসি তো। না বাসলে বিয়ে করব কেন? তুই তো আমাকে চিনিসই, হুট-হাট বিয়ে করার ছেলে আমি নই। ”
” তাহলে ওর কষ্টে তোর চোখে ব্যথা নেই কেন? এখানে নিয়ে আসার পর থেকে আমার পিছ পিছ ঘুরছিস অথচ একবারও জিজ্ঞেস করলি না ও কেমন আছে। তাছাড়া যাকে ভালোবাসিস তাকে আঘাত করিস কিভাবে? ”
” যেভাবে তুই তোর ভালোবাসার মৃত্যু কামনা করিস। ”

ইশাদের অটল দৃষ্টি টলে গেল। ভ্রূজোড়া কুঁচকে যেতে ইমদাদ গোপনে শ্বাস ছাড়ল। কথা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে দ্রুত বলল,
” তুই যেমন রাগ থেকে তিহির মৃত্যু কামনা করেছিলি আমিও তেমন রাগ থেকেই করেছি। ইচ্ছাকৃত ছিল না। ”

ইশাদ কিছু একটা বলার জন্য প্রস্তুত হতে ইমদাদ প্রশ্ন করে বসল,
” কল করেছিলি? ”
” কাকে? ”
” কাকে আবার? তিহিকে। সে বাঁচবে না বলার পর তো দুটোদিন পার হয়ে গেল! যেতে পারিসনি বলে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করবি না? ”
” না। ”
” কেন? ”

ইশাদের দিক থেকে উত্তর শোনার ধৈর্য্য হলো না ইমদাদের। দারুন উৎসাহ নিয়ে বলল,
” থাক, ফোনে দেওয়া লাগবে না। একেবারে সামনে গিয়েই দিবি। ”
” মানে? ”

ইমদাদ পকেট থেকে নতুন দুটো টিকিট বের করে বলল,
” সব ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে। সাড়ে এগারোটায় বাস আসবে। ”

ইমদাদ কথার মধ্যেই ঘড়ি দেখে নিয়ে বলল,
” বেশি সময় নেই। চল বেরোই। ”

ইশাদ তাৎক্ষণিক কিছু বলল না। সন্দিহানে চেয়ে আছে ইমদাদের মুখে। সেকেন্ড কয়েক পর বলল,
” মিহিকে এ অবস্থায় একা রেখে যেতে তোর বিবেকে বাধছে না? এই, তুই আমার সাথে গেম খেলছিস না তো? সত্যি করে বল। ”

ঘুরেফিরে ইশাদ আবার সন্দেহ সাগরে পতিত হওয়ায় ইমদাদ হতাশ হলো। রেগেও গেল খুব। বিবেকবুদ্ধি হারিয়ে মিহিকে দোষারোপ করতে থাকল। মনে মনে গালি-গালাজ করতে করতে বেফাঁসে বলে ফেলল, ‘ কাটাচামচটা চোখে না লেগে গলায় ঢুকে দম কেন আটকাল না? তাহলেই তো সব ঝামেলা মিটে যেত! ‘
” চুপ করে ভালবাসেনা আছিস কেন? ইমদাদ, সত্যি বল। ”

ইমদাদ বুদ্ধিশূন্য চোখে তাকাল ইশাদের দিকে। কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। সত্যি বললেও সমস্যা মিথ্যা বললেও! সে সময় ইশাদের ফোন বেজে উঠল। স্ক্রিনে শাহিনা শাইখার নাম্বার ভেসে উঠতে তার বুদ্ধির বাতি জ্বলে উঠল। চটজলদি বলল,
” আরে, একা রেখে যাব কেন? আন্টি আছে না? তার কাছে রেখে যাব। ওর তো এখন খেয়ালের প্রয়োজন। আমি কি এত কিছু বুঝি? আন্টির কাছে ভালো থাকবে। তাছাড়া, আমরা তো সারাজীবনের জন্য যাচ্ছি না। যাব, তিহিকে নিয়ে চলে আসব। ”

ইমদাদের কথার প্রত্যুত্তর করল না ইশাদ। ফোন কানে চেপে তার দিকে সরু চোখে চেয়ে মায়ের সাথে কথা বলছে। কথা বলতে বলতেই মিহির কাছে গেল। তার কানে ফোন দিয়ে উল্টো ঘুরতে গিয়ে ইমদাদের সাথে ধাক্কা খেল। বিরক্ত নিয়ে বলল,
” কী সমস্যা? ”

ইমদাদ ইশাদকে খুশি করতে বলল,
” বউ সমস্যা। ড. সাহেব আমি কি কিছুক্ষণের জন্য বউয়ের সাথে সময় কাটাতে পারি? ”

ইমদাদের বলার ধরনে ইশাদ হেসে ফেলল। বুকে আদুরে ঘুষি দিয়ে বলল,
” জ্বি পারেন। তবে সাবধান, আবার যেন কোনো এক্সিডেন্ট না ঘটে তাহলে কিন্তু…”
” হবে না। যা, এখন। ”

ইশাদ চলে যেতে মিহি কল কেটে দিল। ইশাদের ফোনটা নিচে নামিয়ে রেখে অপরাধী সুরে বলল,
” আমি বুঝতে পারিনি আপনি রেগে যাবেন, সরি। ”

মিহির ব্যথায় ফুলে যাওয়া মুখটা দেখেও একটু মায়া হলো না ইমদাদের। সুযোগ নিয়ে বলল,
” এক শর্তে সরি গ্রহণ করব। ”

মিহির চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। শুকনো ঠোঁট টেনে আগ্রহ নিয়ে সুধাল,
” কী শর্ত? ”
” তুমি ইশাদকে বলবে, কয়েকদিন আন্টির সাথে থাকবে। ”

মিহি এক নিশ্বাসে রাজি হয়ে গেল। ইমদাদের একটা হাত ধরে বলল,
” আপনি যা বলবেন আমি তাই করব। শুধু আপনি রাগ করবেন না, প্লিজ! ”

ইমদাদ ধীরে হাত সরিয়ে বলল,
” তাহলে আমি ইশাদকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ”

_________
হাসপাতালের কাছেই একটি বিল্ডিংয়ে মাকে নিয়ে ভাড়া বাসায় উঠেছে ইশাদ। মিহির আবদারে তাকে নিয়ে আসল সেই বাসায়। রাতে খাওয়া শেষে মিহি আর ইশাদের মা শুলো এক রুমে। অন্য রুমে ইশাদ আর ইমদাদ। ইশাদ চোখ বুজা অবস্থায় ডান কাত হতে ইমদাদ বলল,
” সাড়ে এগারোটা বাজতে এখনও দশ মিনিট বাকি বুঝলি? বাসের তো নির্দিষ্ট সময় নেই। বলে এক সময় ছাড়ে আরেক সময়। ”

ইমদাদের কথায় কোনো সাড়া দিল না ইশাদ। চুপচাপ নিশ্বাস নিচ্ছে আর ছাড়ছে। ইমদাদ ঘাড় উঁচু করে ইশাদের দিকে তাকাল। একটু এগিয়ে বলল,
” আমরা যদি এখন বের হই তাহলেও….”

ইমদাদের কথার মাঝেই ইশাদ আচমকা ঘুরল। একটা কঠিন ধমক দিতে গিয়েও থেমে গেল। ভারী নিশ্বাস টেনে বলল,
” আজ সকালে নিউরোলজিস্টের সাথে কথা বলেছি। ”

ইমদাদ অবাক হয়ে বলল,
” নিউরোলজিস্ট? ”
” হ্যাঁ, তিহির জন্য। ওর অতিত জানার পর থেকেই আমার ভেতরের সব এলোমেলো হয়ে গেছে। ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না। তাই নিউরোলজিস্ট এর শরণাপন্ন হই। ”
” কী বললেন উনি? ”

ইশাদ ইমদাদের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। অন্ধকারময় রুমে উদাস চোখে চেয়ে বলল,
” ওর শর্ট টাইম মেরোরি লস চলছে। যে কোনো সময় অতীতের সবকিছু মনে পড়ে যেতে পারে। এর মানে বুঝতে পারছিস? ”

ইমদাদ একজন ডাক্তার হওয়ার সুবাদে ভবিষ্যৎ বিপদ অনুধাবন করে শিউরে উঠল। আতঙ্কে ভেতরটা অস্থির হয়ে পড়ল। উৎসাহ হারিয়ে ফেলতে গিয়েও লাগাম টেনে ধরে বলল,
” তোকে ভুলে যাবে এইতো? এতে ভয়ের কী আছে? আবার মনে করিয়ে দিবি। ”

ইশাদ উদাস থেকে ফিরল। চোখ বুঝে উল্টো ঘুরতে ঘুরতে বলল,
” অযৌক্তিক কথা বলিস না তো। ”

ইমদাদ ইশাদের উপর হেলে আসল। জোর দিয়ে বলল,
” মোটেও অযৌক্তিক নয়। যাকে ভালোবেসে মরে যেতে চায় তাকে এত সহজে ভুলে যাবে? আমরা দিলে তো? ”
” তোরা কী করবি? স্মৃতিশক্তি টেনে ধরে থাকবি? ”

এই মুহূর্তে ইশাদের এমন ব্যঙ্গটুকু হজম করতে কষ্ট হলো ইমদাদের। কষ্টুটুকু উপেক্ষা করে বলল,
” তিহি ভুলে যেতে পারে তুই তো আর ভুলছিস না। আবার প্রেমে ফেলবি। এবার তো একাই একাই করেছিলি। পরের বার আমরা সবাই মিলে করব। ”

ইশাদ ইমদাদের কথার পাত্তা দিল না। ইমদাদ দুইহাত দিয়ে ইশাদের মুখের দুদিকে চেপে ধরে উঁচু করে কঠিন গলায় বলল,
” তোর ভালোবাসায় বিশ্বাস নেই? জোর নেই? পাগল মেয়েটাকে আরেকবার পাগল করতে পারবি না? ”

ইশাদ অন্ধকারেও ইমদাদের অন্যরকম কণ্ঠস্বরে চমকে গেল। নির্বোধের মতো তাকিয়ে থাকলে ইমদাদ আবার বলল,
” তিহিকে ছাড়া তুই বাঁচতে পারবি? ”

ইশাদ সাথে সাথে উত্তর দিল না। অনেক্ষণ পর নিজেকে ছাড়িয়ে বালিশে মাথা রেখে বলল,
” তুই ভুলে যাচ্ছিস আমি ওর প্রথম ভালোবাসা নই। ওর হৃদয়জুড়ে আরেকজন মানুষের বসবাস। তার অবর্তমানে ভুলবশত আমি ঢুকে পড়েছি। সময় হলে আমাকে ঠিক বের করে দিবে। আর সে কাজটা তিহি করবে। ইমদাদ, ও যখন বলবে ‘ আমি তাজকে ভালোবাসি। ‘ তখন আমি সহ্য করব কীভাবে? ”
” আর যদি কখনও না বলে? ”
” মানে? ”
” এমনও তো হতে পারে তিহির কিছু মনে পড়লই না! হতে পারে না বল? ”

ইশাদ থমকে গেল। এক মুহূর্তের জন্য বিশ্বাস করতে চাইল তিহির কিছু মনে পড়বে না। পর মুহূর্তে ইনার মুখটা ভেসে উঠল। রুদ্ধশ্বাসে বলল,
” আমরা শুধু আমাদের কথাই ভাবছি। ইনার কথা ভাবছি না। ও এতদিন জানত তিহি আপু হয়। এখন জানে মা হয়। এতদিনে হয়ত বাবার সাথেও পরিচয় হয়ে গেছে। তারমধ্যে যদি….”
” আমি এত কিছু ভাবতে পারব না। আমি শুধু তোর খুশিটুকু ভাবতে চাই। ”

ইমদাদের এমন ত্যাড়া বক্তব্যে ইশাদ রেগে গেল। তাকে জোর করে রুম থেকে বের করে দরজা আটকে শুয়ে পড়ল। ইমদাদ দরজায় ঠকঠক করতে করতে বলল,
” আমাকে দাম দিচ্ছিস না তো পরে পস্তাবি। তাজ শালা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে নাহলে অমন সুন্দরী বউ রেখে দূরে থাকে? আর তিহি? সেই বা কত দিন একা একা থাকবে? আজ তোকে চায়ছে, কাল ঠিকই অন্য কাউকে….”

ইমদাদ কথার মাঝেই ভারী ঘুষি টের পেল বুকে। পড়তে গিয়ে নিজেকে আটকাল। তন্মধ্যেই সেন্ডো গেঞ্জি টেনে ধরে ইশাদ বলল,
” তুই আমার হাতেই মরবি দেখিস। ”

ইমদাদ বুকে ঢলতে ঢলতে কুটিল হাসল। সদর দরজা পার হতে হতে বলল,
” অশ্লীল কাজ সবসময় খারাপ হয় না। ভালোও হয় তাই না, বন্ধু? ”

ইশাদ উত্তরে শাসাল,
” যদি বাস না পাই তোর কাঁধে চড়ে যাব। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here