তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,০৮,০৯

0
892

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,০৮,০৯
রোকসানা রাহমান
পর্ব (৮)

রুকমিনি মুখার্জি খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেন। স্নান সেরে পুজো করেন। আজও ব্যতিক্রম হলো না। স্নান শেষে পুজো ঘরে যাওয়ার আগে তিহির রুমে আসলেন। বিছানা খালি দেখে ভারী নিশ্বাস ছাড়লেন। হাতে করে আনা লাল টকটকে শাড়ি, সোনার গয়না আর সিঁদুরের কৌটা খাটের উপর রেখে বারান্দায় এগুলেন।

বারান্দার রেলিংয়ে মাথা ঠেকিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে তিহি। চোখের চারপাশে কালচে ফোলাভাব। গাল বেয়ে ঝরে পড়া অশ্রুর ধূসর রঙের দাগ। রসাশ্যান্য ঠোঁটদুটো থেকে থেকে কাঁপছে! তিহির এমন মুমূর্ষু অবস্থায় রুকমিনির ভেতরটা কেঁদে উঠল। ঠোঁট চেপে নিজের দুর্বলতাটুকু আটকে তিহির মাথায় আলতো হাত রাখলেন। আদুরে গলায় ডাকলেন,
” তিহিমা? ”

তিহি হালকা কেঁপে উঠল। আলস্যতায় চোখের পাতা মেললে রুকমিনি মুখার্জি বললেন,
” স্নান সেরে আয়। আমি পুজো দেব। ”

তিহি বোধ হয় কিছু শুনল না। অবুঝ চোখে তাকিয়ে থাকলে রুকমিনি মুখার্জি হাত সরিয়ে নিলেন। কণ্ঠে কাঠিন্যভাব এনে বললেন,
” এ বাড়ির বউ তুই। রীতি-রেওয়াজ শিখতে হবে। আমার অবর্তমানে পুজোঘরের দায়িত্ব তোর হবে। সংসারের কল্যাণ-অকল্যাণ জানতে হবে। তাই বলছি, আমি থাকতে থাকতে সব শিখে নে। ”

তিহি চোখ তুলে শাশুড়ির কথা শুনল ঠিকই কিন্তু তনুমনে কোনো রকম প্রভাব পড়ল না। তিনি থেমে যেতেই তিহির চোখ বুঝে আসছিল তখনই বললেন,
” আমার বিশ্বাস তাজ বেঁচে আছে। একদিন ঠিক আমার বুকে ফিরবে। আর সেই বিশ্বাস জোর পাবে তোর কপালে সিঁদুর উঠলে। অনেক স্বাধীনতা পেয়েছিস আর নয়। ”

তিহি এবারও চোখ মেলে শাশুড়ির কথা শুনছে। তিনি বের হয়ে যাওয়ার আগে হুকুম দেওয়ার মতো বললেন,
” বউমা, খাটের উপর শাড়ি আর গয়না রাখা আছে। স্নান করে পরবে। সিঁদুর পরবে মোটা করে, কেমন? ”

রুকমিনি শেষে প্রশ্নবোধক চিহ্ন বসাতে তিহির ঠোঁট জোড়া কেঁপে উঠল। ভীষণ আহ্লাদে বলল,
” আমরা ঐ বাসায় কবে যাব, আম্মা? ”

রুকমিনি বুঝতে পেরেও না বুঝার ভান ধরে বললেন,
” কোন বাসায়? ”
” ইশাদের বাসায়। ”

তিহি ইশাদের নাম উচ্চারণ করতে রুকমিনি মুখার্জির চোখ জ্বলে উঠল। চোয়াল শক্ত করে কঠিনস্বরে বললেন,
” তোমাকে না বলেছি ঐ নাম আর মুখে নিবে না? ”

মুহূর্তে অগ্নিমুর্তির রূপ ধরা শাশুড়িকে দেখে একটুও ভয় পেল না তিহি। তার ধমক উপেক্ষা করে নরম স্বরে বলল,
” আমার ধ্যান-ধারণায়, চিন্তা-কল্পনাজুড়ে তো শুধুই সে। নিশ্বাসে নিশ্বাসে তার নাম না জপলে আমি তো মরেই যাব, আম্মা। ”

রুকমিনি মুখার্জি কঠিন ধমক দিতে গিয়েও পারলেন না। আবার চুপচাপ মেনেও নিতে পারলেন না। ছুটে গেলেন ভেতরে। শাড়ির উপর রাখা সিঁদুরের কৌটা থেকে এক চিমটি সিঁদুর এনে তিহির সিঁথিতে পরিয়ে বললেন,
” তুই আমার ছেলের বউ। এ বাড়ির বউ। আমার বউমা। তোর স্বামীর নাম তাজ। সাত জনমের বন্ধন তোদের। ”

কথাটা বলেই রুকমিনি মুখার্জি ছুটে গেলেন পুজোঘরে। নিশ্বাস আটকে পার্থনা করলেন ভগবানের কাছে, ছেলেকে ফিরিয়ে দিতে।

_______
তিহি সিঁদুর পরেই আবারও ঘুমিয়ে পড়ল। খাওয়া-দাওয়াই অবহেলায় শরীর এখন তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। হাঁটতে গেলে পা টলে! দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। বারান্দায় বসে বসে সময় কাটায়। চাহনি উদাস হয়ে আসতে ঘুমিয়ে পড়ে। সূর্যাস্ত, সূর্যোদয়ে খেয়াল নেই। মাঝে মাঝে চাঁদ দেখতে পায়। মেঘে হারিয়ে গেলে সেও হারিয়ে যায় কোথাও একটা।

তিহির ঘুম ভাঙল পরিচিত কণ্ঠস্বরে। শরীরের ক্লান্তভাব হঠাৎই ছুটে গেল। মেঝেতে হাঁটু ভর দিয়ে মাথা তুলে তাকাল গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে। তার চোখ জুড়িয়ে দেওয়ার জন্যই বুঝি ইশাদের মুখটা দেখা গেল বাড়ি ঢাকা সুউচ্চ দেয়ালের মাথায়। তিহি বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। ভালো করে তাকাতেই ইশাদের গলা পেল স্পষ্ট,
” দেয়াল টপকাব? দারোয়ান যদি চোর ভেবে পিটিয়ে দেয়? ”

উত্তরে ইমদাদ বলল,
” দিলে দিবে। ভালোবাসার জন্য এইটুকু মার সহ্য করতে পারবি না? ”

ইশাদ কিছু বলল না। দেয়ালের উচ্চতার মাপ পরীক্ষা করে বলল,
” আমরা আরেকটু অপেক্ষা করি। কেউ না কেউ তো বের হবেই। নাহলে গেইটে নক করব। ”

ইমদাদ ভারি বিরক্ত হলো বন্ধুর কথায়। ব্যঙ্গ করে বলল,
” তুমি ঢুকতে চাইলেই মালা দিয়ে বরণ করে নিবে তাই না? ”

ইশাদ কপাল কুঁচকে ফেললে ইমদাদ ওর কোমর চেপে ধরে উঁচু করল আচমকা। দেয়ালের মাথার দিকে ঠেলে দিয়ে বলল,
” ভুলে যেও না, তুমি এ বাড়ির বউকে চুরি করতে এসেছ। ”

ইশাদ দু-হাতে শক্ত করে দেয়াল চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল,
” আমরা কি সত্যি তিহিকে তুলে নিতে এসেছি? ”

ইমদাদ ইশাদকে ছেড়ে লাফিয়ে দেয়ালের অগ্রভাগ ছুঁলো দুই হাতে। প্রথমবারে শরীরের ভর ধরতে না পারলেও পরেরবার পারল। দেয়ালে উঠতে উঠতে বলল,
” জি, হ্যাঁ। ”

ইশাদ বিস্ময়ে ফেটে পড়ার আগেই তাকে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দিল ইমদাদ। নিজেও লাফিয়ে পড়ে বলল,
” ব্যথা পেয়েছিস? ”

ইশাদ উত্তর দিতে পারল না। তার আগেই তিহি চিৎকার করে উঠল,
” ইশাদ? ”

দুই বন্ধু ঘাড় বাঁকিয়ে উপরে তাকাল চকিতে। তিহি অস্থির হয়ে বলল,
” আমি জানতাম তুমি আসবে। আমাকে নিতে আসবে। দাঁড়াও আমি আসছি। এখনই আসছি। ”

এই মুহূর্তে তিহির এই সাহায্যটুকু একদমই অপ্রত্যাশিত ছিল। ইমদাদ ভেবেছিল ঘুমের ঘোরে কাঁধে নিয়ে পালাবে। কিন্তু এখন তো তার পরিকল্পনা ঘেটে গেল। সাথে তার বুদ্ধিপূর্ণ মস্তিষ্ক জানিয়ে দিল, সর্বনাশ হয়ে গেছে! ধরা খাওয়ার আগে লুকাতে হবে।

ইমদাদ লুকানোর জন্য জায়গা খুঁজতে লাগল। আশেপাশে ফুলের বাগান আর একটি কালো গাড়ি ছাড়া কিছু দেখতে পারছে না। কোনদিকে যাবে? ইমদাদ সিদ্ধান্ত নিতে নিতে ইশাদকে তাড়া দিচ্ছিল। সে তখনও শূন্য বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে বিমোহিত হয়ে। ইমদাদ তার একহাত ধরে বাগানের দিকে টেনে এক কদম এগিয়েছে সবে তখনই দাড়োয়ান পথরোধ করল। সন্দেহ চোখে চেয়ে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল,
” আপনারা কে? ”

ততোক্ষণে ইশাদের সম্বিৎ ফিরেছে। ইমদাদ কিছু বলার আগেই সে জানাল,
” আমরা তাপান মুখার্জির পরিচিত। তিনি কি বাড়িতে আছেন? ”

দারোয়ানের সন্দেহভরা চোখদুটো একটু শীথিল হলো। কন্ঠস্বর ধীর করে বলল,
” আমার সাথে আসেন। ”

ইশাদ পিছু নিলে পেছন থেকে ইমদাদ হাত টান দিল। নিচুস্বরে বলল,
” কী করছিস? উনাদের সামনে পড়লে তিহিকে তুলব কী করে? ”

ইশাদ হাত ছাড়িয়ে নিল। ইমদাদকে উপেক্ষা করে সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। কলিংবেল চাপতে হলো না তার আগেই অকস্মাৎ দরজা খুলে দাঁড়াল তিহি। ছটফট মনটা শান্ত করতে ইশাদের বুকে পড়বে সেই সময় পেছন থেকে হুংকার আসল,
” বউমা, ভেতরে যাও। ”

তিহি চমকে পেছনে তাকাল। তার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানায় ভয় জমল। ভীত স্বরেই বলল,
” ইশাদ আমাকে নিতে এসেছে, আম্মা। ”

রুকমিনি মুখার্জি পুনরায় ধমকে উঠলেন,
” তোমাকে ভেতরে যেতে বলেছি। ”

তিহি কেঁপে উঠলেও জায়গা থেকে নড়ল না। ছলছল চোখে আরেকবার অস্পষ্ট কণ্ঠে উচ্চারণ করল,
” আম্মা! ”

পরের কথাটুকু বলতে পারল না। নিজে এগিয়ে তিহিকে টেনে সিঁড়ির মুখে রেখে আসলেন। চোখের ইশারায় উপরে যাওয়ার আদেশ দিতে সে চুপচাপ চলে গেল।

এই মুহূর্তে ইশাদকে রুকমিনি মুখার্জির অপছন্দ হলেও বাইরে থেকে বিদায় করলেন না। কোনো রকম ঝামেলাও করলেন না। সাদরে ভেতরে বসতে দিলেন। নাস্তাপানির ব্যবস্থা করলেন নিজে দায়িত্ব নিয়ে। বেশ কয়েকপদের শুকনো খাবার ও পানীয় সামনে দিয়ে বললেন,
” আমরা অতিথিকে নারায়ণ মনে করি। খালি মুখে বিদায় করা পাপ। কিছু একটা মুখে দেও। ”

ইশাদ রুকমিনি মুখার্জিকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও ইমদাদ নিতে পারছে না। সে আশ্চর্যান্বিত চাহনিতে তার আগাগোড়া পরখ করছে। ইশাদদের বাড়িতে যাওয়া-আসা থাকায় বেশ কয়েকবার এই মহিলাকে দেখেছে। সে সুবাদে এনাকে চেনার কথা। কিন্তু এই চেনার মাঝেও কেমন অচেনাভাব। তার মনে হচ্ছে এই প্রথম এই মহিলাকে দেখছে। কেন? এই কেন এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আবিষ্কার করল আগে যাকে দেখেছিল তার সাজগোজ ছিল সাদামাটা। আর এখন যাকে দেখছে তার সাজগোজে আমিরত্ব। গায়ের দামি শাড়ি, গয়না ছাপিয়ে সিঁদুরে চোখ পড়তে এক পুজোর মন্ডপের কথা মনে পড়ল। সে সময় এক হিন্দু মেয়ের সাথে প্রেম চলছিল। তাকে খুশি করতে পুজা দেখতে গিয়েছিল। সেই পুজা মণ্ডপের এক মূর্তির সাথে এই মহিলার বিশাল মিল!

” কেন এসেছ? ”

রুকমিনি মুখার্জির হঠাৎ প্রশ্নে ইমদাদের ঘোর কাটল। একটু নড়েচড়ে বসতে রুকমিনি মুখার্জি আবার বললেন,
” তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি অন্যায় পথে পা বাড়াচ্ছ? ইশাদ, তোমার তো সব জানা। কিছুই লুকাইনি। ”

ইশাদ মাথা নিচু করে ফেলল। রুকমিনি মুখার্জি খানিকটা ব্যাকুল স্বরেই বললেন,
” তিহি আমার ছেলের বউ। ইনার মা। সব জেনেশুনেও…”
” আপনার কাছে প্রমাণ আছে? ”

ইশাদের আমচকা প্রশ্নে রুকমিনি মুখার্জি থমকে গেলেন। দ্বিধান্বিত স্বরে বললেন,
” কিসের প্রমাণ? ”
” আপনি যা যা বলেছেন সব সত্য, এটা কি প্রমাণ করতে পারবেন? আচ্ছা, আপনি তো তাজ আর তিহির বিয়েতে উপস্থিত ছিলেন না তাহলে কিভাবে জানলেন ওদের বিয়ে হয়েছে? তিহি বলেছে? এটা তো সম্ভব নয়। ম্যারেজ সার্টিফিকেট আছে আপনার কাছে? ”

ইশাদের একের পর এক প্রশ্নে থতমত খেলেন রুকমিনি মুখার্জি। ইশাদ মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। ঘাড় শক্ত করে শাণিত দৃষ্টি রেখে বললেন,
” কিসের উপর ভিত্তি করে দাবি করছেন তিহি আপনার ছেলের বউ? সিঁদুর দানে তো সম্ভব নয় কারণ, তিহি মুসলিম ঘরের সন্তান। তাহলে? ”

মুহূর্তে রুকমিনির আমিরত্ব সৌন্দর্যে অসহায়ত্ব ধরা পড়ল। চালচলনে অস্থিরতা ভাব। অনেক কিছু বলতে চেয়েও পারছেন না। যেন ঠোঁটের আগায় এসে হারিয়ে যাচ্ছে। ইশাদ গোপনে খুশি হলো। চোখে-মুখে সাহসিকতা দৃষ্টান্ত! রুকমিনি মুখার্জিকে আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করল না। সোফা ছেড়ে সোজা চলে গেল সিঁড়ির ধারে। দৌড়ে উপরে উঠছে। সিঁড়ির সাথে লাগোয়া বারান্দার ডানদিকে পা রাখতে পেছন থেকে তিহি বলল,
” আমি এখানে। ”

ইশাদ থমকে গেল। পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতে হৃদয়টা লাফিয়ে উঠল। মুগ্ধ চোখে দেখল তার তিহি লাল টকটকে শাড়ি পরে দাঁড়িয়েছে। সদ্য গোসল করে বের হওয়াই এতদিনের ক্লান্ত, অবসন্ন, দুর্বলতা বদনটা স্নিগ্ধ ও পবিত্র মনে হচ্ছে। সে ঘোরলাগা দৃষ্টি নিয়েই তিহির কাছ ঘেষে দাঁড়াল। এক গোছা ভেজা চুল কান থেকে সরিয়ে ফিসফিস করে সুধাল,
” তুমি এখনও বেঁচে আছ? আমি তো ভেবেছিলাম প্রাণ হারিয়ে ভূত-পেত্নী কিছু একটা হয়ে গেছ। ”

ইশাদের এমন মশকরায় তিহির রাগ হলো। ইশাদের মুখোমুখি হতে একটু ঘুরে দাঁড়াতে সোনার দুলটা তার ঠোঁটে বাড়ি খেল। ইশাদ চোখ বন্ধ করে নিলে তিহি রেগে বলল,
” আমি মরে গেলে তুমি খুশি? ”

ইশাদ চোখ মেলল। উত্তর দিল না। মুচকি হাসছে। তিহির এই হাসিটুকু পছন্দ হলো না। রাগ বেড়ে গেল। অভিমানে বলল,
” ঠিক আছে, মরেই দেখাচ্ছি। ”

তিহি সত্যি মরে যাবে এমনভাব ধরে হাঁটা ধরলে ইশাদ ওর হাত টেনে ধরল। ডান হাতের অনামিকা আঙুলে একটি আংটি পরিয়ে বলল,
” এখন একটু বেঁচে থাকো। আমি চলে যাওয়ার পর নাহয় মরে যেও। ”

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (৯)

” এখন একটু বেঁচে থাকো। আমি চলে যাওয়ার পর নাহয় মরে যেও। ”

তিহি লজ্জায় লাল হলো। চোখ নামিয়ে লাজুক হেসে বলল,
” আমার তো এখনও মরে যেতে ইচ্ছে করছে! ”

ইশাদ তিহির হাতের পিঠে ছোট্ট চুমু খেল। বুকের মাঝে ছুঁয়িয়ে বলল,
” এমনি মরতে পারবে নাকি আমাকে কিছু করতে হবে? ”

তিহি চোখ তুলে এক পলক ইশাদের মুখখানা দেখল। তারপরেই চোখ নামিয়ে হাত টেনে নিয়ে বলল,
” করার কি বাকি আছে? ”
” নেই? ”

তিহি প্রশ্ন পিঠে প্রশ্ন শুনে থতমত খেল, স্তব্ধ হলো। বিস্ময়মাখা চোখদুটো স্থির করল ইশাদের পায়ে। মনের শীতল হাওয়া শরীরে ছড়িয়ে পড়লে কেঁপে উঠল সর্বাঙ্গ! অস্থির হয়ে পড়া অনুভূতিটুকু স্থির করতে একহাতে শাড়ির আঁচল খামচে ধরল। অন্য হাতে ভেজা চুলের নিম্নভাগ আঙুলে প্যাঁচিয়ে নিল।

তিহির এই নতুন রূপে ইশাদের চোখের চাহনি নেশায় ডুবল। নিশ্বাসে আলস্য ছড়িয়ে পড়ল। মুগ্ধ হয়ে চক্ষুদ্বয়ের তৃষ্ণা মেটাতে চেয়েও পারল না। ব্যাঘাত ঘটাল এক শিশু কণ্ঠ,

” আম্মু, তুমি শাড়ি পরেছ? ”

ইশাদ ও তিহি চকিতে তাকাল শিশু কণ্ঠের দিকে। রুকমিনি মুখার্জির হাতের বাঁধন থেকে ছুটে এলো ইনা। তিহির আপাদমস্তক দেখল ভীষণ মনোযোগে। চোখদুটো চকচকে হয়ে আসতে মহাউৎসাহে বলল,
” আমিও শাড়ি পরব, আম্মু। ”

তিহি উত্তর দিল না। লজ্জায় রাঙা মুখটায় বিরক্ত জমছে ধীরে ধীরে। ইনা তিহির হাত নাড়িয়ে চুড়ির রিনিঝিনি ছন্দ তুলে বলল,
” কী সুন্দর চুড়ি! আম্মু, আমাকে কয়েকটা দিবে? ”

তিহি আর চুপ থাকতে পারল না৷ চোখের ভেতরটা টকটকে লাল হয়ে আসল। চোখমুখ ফুলিয়ে থাপ্পড় মারার জন্য হাত তুলতে ইশাদ ইনাকে কোলে তুলে নিল। এক কদম পেছনে সরে উল্টো ঘুরে দাঁড়াল। ইনার শিশুসুলভ মুখটায় চেয়ে আদুরে গলায় সুধাল,
” তোমারও শাড়ি, চুড়ি চাই? ”

ইনা সাথে সাথে উত্তর দিল না। ইশাদের কানের পাশ দিয়ে তিহির গলার দিকে তাকাল। তারপরেই আহ্লাদে ভেসে বলল,
” চাই-ই তো। আম্মুর গলার হলুদ রঙের ঐ সুন্দর মালাটাও চাই। ”

ইশাদ চট করে তিহির গলার দিকে তাকাল। মৃদু হেসে বলল,
” ঠিক আছে, মামনি। তুমি এখন দাদির কোলে যাও, আমি তোমার জন্য শাড়ি, চুড়ি আর হলুদ রঙের মালা কিনে আনছি। ”

ইশাদ রুকমিনি মুখার্জির নিকট এগিয়ে গেল। ইনাকে তার দিকে বাড়িয়ে দিলে ইনা ইশাদের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
” আমি আম্মুর কোলে যাব। ”

ইশাদ থেমে গেল। রুকমিনি মুখার্জির দিকে এক ঝলক চেয়ে তিহির দিকে ঘুরে দাঁড়াল। এগুতে এগুতে ভাবছে, কিছুক্ষণ আগের না ঘটা ঘটনাটির কথা। তিহি কি একটুও বদলায়নি? ইনাকে এখনও মেনে নেয়নি? রুকমিনি মুখার্জির মুখ থেকে সবটা শোনার পরও তার আচরণে একটুও পরিবর্তন আসেনি। কেন?

ভাবতে ভাবতে তিহির একদম কাছে এসে দাঁড়াল ইশাদ। নিজের ঠোঁটদুটো তার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিসে বলল,
” যদি আমাকে ভালোবেসে থাকো তাহলে এই বাচ্চা মেয়েটিকে আর কখনও আঘাত করবে না। ভাববে, ইনা হাসছে মানে আমি হাসছি, কাঁদছে মানে আমি কাঁদছি। ”

রুকমিনি মুখার্জি দূর থেকে অবাক হয়ে দেখলেন, তিহি সানন্দে ইনাকে কোলে তুলে নিচ্ছে।

ইনাকে তিহির কোলে দিয়ে দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসল ইশাদ। ইমদাদ তার নিকট এসে দাঁড়াল উশখুশ নিয়ে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করার আগেই ইশাদ ফিরে তাকাল রুকমিনি মুখার্জির দিকে। তিনি সিঁড়িপথের মাঝে দাঁড়িয়ে আছেন। সেদিকে চেয়েই ইশাদ বলল,
” যদি ভেবে থাকেন ইনাকে প্রমাণ বানাবেন তাহলে বলব, রিপোর্ট বদলে দিতে আমার এক পয়সাও খরচ করতে হবে না। ”

ইমদাদকে নিয়ে বের হওয়ার আগে সতর্ক করে গেল,
” এবার একা ফিরে যাচ্ছি, পরেরবার তিহিকে নিয়ে যাব। ”

____________

ইমদাদকে নিয়ে ইশাদ প্রায় বেরিয়ে এসেছে। গেইট পার হবে, সেই সময় তার চিন্তা-চেতনায় অদৃশ্য কিছু আঘাত করে গেল। নদীর স্রোতের মতো তার চিন্তার প্রবাহ প্রতিকূলে ছুটল। অকস্মাৎ থমকে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করছে কিছু একটা। ইমদাদ জিজ্ঞেস করল,
” দাঁড়িয়ে পড়লি যে? ”

ইশাদ উত্তর না দিয়ে পেছন পথে ছুটল। বাগান পেরিয়ে সদর দরজার সামনে এসে খটখট করল তুমুল শব্দে। এবার দরজা খুললেন রুকমিনি মুখার্জি। তার মুখ চোখের সামনে প্রত্যক্ষ হতে ইশাদ হাতদুটি টেনে নিল। কপালে ছুঁয়ে অনুতাপের গলায় বলল,
” আমি ভুল করেছি। আপনার সাথে অন্যায় আচরণ করেছি। আমাকে মাফ করে দিন। ”

রুকমিনি মুখার্জি অপ্রস্তুত হলেন। হতবুদ্ধিতে তাকিয়ে থাকলে ইশাদ আগের কণ্ঠেই বলল,
” আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি আপনার বলা প্রত্যেকটা কথা সত্য। তবুও অবিশ্বাসের অভিনয় করেছিলাম। শুধু তিহিকে পাওয়ার জন্য। অথচ আপনি তাকে দ্বিতীয় জীবন দান করেছেন। মেয়ের মতো আগলে রেখেছেন এতগুলো বছর। কোনো শাশুড়ি এমন পারে না। হয়তো আমার মাও পারবে না। ”

এতটুকু বলে ইশাদ থামল। সময় নিয়ে নিজেকে সামলাল। ঘনঘন ঢোক গিলে, ভারী নিশ্বাস টেনে হঠাৎ বলল,
” আপনি কি তিহির হাতের ঐ গভীর দাগটা দেখেছেন? পায়ের তলার পুড়ে যাওয়া চিহ্নগুলোও? ”

মুহূর্তে রুকমিনির মুখার্জির মুখের ভাব পালটে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
” দাগ! কিসের দাগ? ”

ইশাদ অসহিষ্ণু গলায় বলল,
” আড়াল করার চেষ্টা করবেন না, আন্টি। আমি দেখেছি মানে আপনিও দেখেছেন। ”

রুকমিনি মুখার্জি এমনভাবে এক কদম পেছনে সরে গেলেন যেন তাকে কেউ ধাক্কা মেরেছে। চোখের চাহনি লুকিয়ে ক্ষীণ স্বরে বলল,
” হয়তো এক্সিডেন্টের সময় আঘাত পেয়েছে। ”

ইশাদ প্রতিবাদ করে উঠল,
” না, ওগুলো এক্সিডেন্টের আঘাত নয়। আপনি আমাকে ভুল বুঝাতে চাচ্ছেন। ”

উত্তেজনায় ইশাদের গলার স্বর খানিকটা জোরাল হওয়ায় রুকমিনি মুখার্জি চমকে উঠেন। ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করেন,
” তাহলে? ”

ইশাদ খানিকটা নিভল। শান্ত ও গভীর চোখে চেয়ে বলল,
” একজন মা-ই বলতে পারবে তার সন্তান কেমন। কারণ, তার চোখের সামনেই সন্তান ভালো-মন্দ স্বভাবে বড় হয়ে ওঠে। ”

রুকমিনি মুখার্জি বিস্ফারিত চোখে তাকালেন। রাগে ফুঁসে উঠে বললেন,
” আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও। এখনই। নাহলে কিন্তু…”

রুকমিনি মুখার্জি নিজের কথা শেষ করলেন না। সশব্দে দরজা আটকে দিলেন। ইশাদ বন্ধ দরজার বাইরে থেকে বলল,
” তিহিকে আমি জোর করে বিয়ে করব না। ছেড়েও দিব না। আপনার সম্মতিতেই আমাদের বিয়ে হবে। কারণ, একমাত্র আপনিই জানের তিহির কাকে প্রয়োজন। ”

__________
বাড়িতে পৌঁছে রাতের খাবার খাচ্ছিল ইশাদরা। পরিবেশন করছে মিহি। শাহিনা শাইখা ভাত মাখতে মাখতে মিহিকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। ইমদাদের প্লেটে মাছের আস্ত টুকরো থাকতেও যখন আরেকটা টুকরো তুলে দিল তখন তিনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে ইমদাদের ঠাণ্ডা বকাটাও কর্ণগোচর করলেন। বকুনি খেয়েও ঠোঁটে হাসি ধরে রাখা মিহির ভোলা চেহারাটাও উপভোগ করলেন।

খাবার শেষে ইমদাদ বিদায় নিতে আসলে শাহিনা শাইখা জিজ্ঞেস করে বসলেন,
” একাই যাচ্ছ? মিহিকে নিবে না? ”

ইমদাদ হালকা হেসে ভদ্র সাজে বলল,
” না, আন্টি। এখানে কয়েকদিন থাকার আবদার করেছে। না রেখে পারি বলুন? ”

ইমদাদের মন ভোলানো কথা শাহিনা শাইখাকে ভুলাতে ব্যর্থ হলো। প্রশ্ন করলেন,
” মিহি আবদার করেছে? ”
” হ্যাঁ। ”
” কিন্তু আমার কাছে যে বলল, তোমার সাথে চলে যাবে।”

ইমদাদের চোখ বড় হয়ে গেল। এদিকওদিক মিহিকে খুঁজতে খুঁজতে জিজ্ঞেস করল,
” মিহি বলেছে? ”
” হ্যাঁ, মিহিই বলেছে। ”

রুমের কোথাও মিহিকে না পেয়ে ইমদাদের দৃষ্টি ফিরে এলো শাহিনা শাইখার দিকে। সন্দিহানে জিজ্ঞেস করল,
” মিহি নিজের মুখে এ কথা বলেছে? ”

শাহিনা শাইখা মিটিমিটি হাসলেন। দরজার দিকে তাকিয়ে ইশারায় মিহিকে ডাকলেন। সে এতক্ষণ পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ইমদাদকে দেখছিল।

মিহি ভীরু পায়ে শাহিনা শাইখার পাশে এসে দাঁড়ালে তিনি একহাতে পাশ থেকে জড়িয়ে নিয়ে বললেন,
” মুখে বলেনি, চালচলনে বলেছে। ”

ইমদাদ কথাটা ধরতে পারল না। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকলে শাহিনা শাইখা বললেন,
” তোমার বউ কাল রাতে আমাকে একটুও ঘুমাতে দেয়নি। সারারাত স্বামীকে নিয়ে গল্প করেছে, আমি গল্প শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে গেলে ছটফট করেছে। সকালে তোমাকে দেখতে না পেয়ে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিল। আরেকটু হলে তো আমাকে দিয়ে কেসও করিয়ে ছাড়ত। ভাগ্যিস ইশাদ ফোন করে জানিয়েছিল তোমরা তিহিদের বাসায়! ”

ইমদাদ কঠিন চোখে তাকালে মিহি মাথা নিচু করে ফেলল। আন্টির কাছ থেকে সরে যেতে চাইল। শাহিনা শাইখা ছেড়ে দিয়ে বললেন,
” যা, তৈরি হয়ে নে। ইশাদকে পাঠাচ্ছি, রিকশা ডেকে দিবে। ”

ইমদাদ কিছু একটা বলতে চেয়েও পারল না। নীরবে রাগটুকু আড়াল করে মিহির তৈরি হয়ে আসার অপেক্ষা করছে। ইশাদ রিকশা ডাকতে নিচে চলে গেলে শাহিনা শাইখা ইমদাদের কাঁধে হাত রাখল। আদুরে মর্দন করে বলল,
” তোমার মধ্যে ইশাদের বাবার ছায়া দেখছি। তার মতো পাষাণ হয়ো না। মিহি আমার মতো সরল হলেও বয়সে খুব ছোট। সামলাতে পারবে না। ”

মিহির উপর চটে থাকায় শাহিনা শাইখার কথাটার মর্মার্থ ধরতে পারল না ইমদাদ। হয়তো ঠিকমতো শুনেওনি।

___________
রিকশা ইশাদকে ছেড়ে একটু দূরে ছুটে আসতেই ইমদাদ এক প্রস্থ ঝেড়ে দিল মিহিকে। মিহি রাগ করল না। অভিমানও না। সে চুপচাপ নীরব মনে বলল, ‘ আপনার সাথে থাকতে আমার ভালো লাগে। খুব ভালো। ‘ সেই সময় কোমর জড়িয়ে ধরল ইমদাদ। মিহি আশ্চর্য হয়ে ইমদাদের দিকে তাকালে সে কড়া গলায় বলল,
” ঠিক করে বসতে পার না? এখনই তো পড়ে যাচ্ছিলে। ভাইকে দিয়ে মার খাওয়ানোর ধান্দা না? ”

মিহি উত্তর দিল না। মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকলে ইমদাদ আবার বলল,
” বোকার মতো চেয়ে থাকলেই বোকা হয়ে যাবে না। তুমি অত্যন্ত চালাক একটা মেয়ে। ইচ্ছে করেই আমাকে বিয়ে করেছ, যাতে আমাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পার, তাই না? এত সহজ নয়। ফের ঝামেলা করার চেষ্টা করে দেখ না, একদম তুলে আছাড় মারব। ”

ইমদাদের হুমকিতেও মিহির মুগ্ধতা কাটল না। কোমল মনে প্রেম প্রেম গন্ধে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল তার সকল জাগতিক চিন্তা-ভাবনা।

__________
পরের দিন হসপিটালে পৌঁছে নিজের চেম্বারের দিকে হাঁটতে ইশাদ ছোটখাট বিষম খেল। অপেক্ষারত কক্ষে তার জন্মদাতা ঝিমুচ্ছে। একজন নার্স পাশ কাটার সময় সালাম দিল ইশাদকে। উত্তর দিতেই সোবহান শাইখ চোখ মেলে চাইলেন। দুজনের চোখাচোখি হলো। ইশাদ বাবাকে উপেক্ষা করে চেম্বারে ঢুকতে ঢুকতে ওয়ার্ডবয়কে জানিয়ে দিল,
” আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কেউ যেন ভেতরে প্রবেশ করতে না পারে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here