তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,২০,২১

0
1838

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি সিজন_৩,২০,২১
রোকসানা রাহমান
পর্ব (২০)

তিহি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পেটের দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। চোখে, মুখে উৎকণ্ঠা! ডানহাতটা পেট থেকে সরাতেই পারছে না। কোথায় গেল তার সেই ফুলো পেট? ফাঁটা ছাপ! সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিল না? নাকি আট মাস? তিহি মনে করতে পারছে না। চোখে নরম জল চিকচিক করছে। মুহূর্তে তিহির অন্তর কেঁপে উঠল। মমতাময়ী মায়া ছড়িয়ে পড়ল মুখজুড়ে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করল, ‘ আমার বাচ্চাটা কোথায়? এখানেই তো ছিল! দেখতে পাচ্ছি না কেন? নড়ছে না কেন? ‘ তিহির গলা ধরে এলো। নিশ্বাস আটকে এলো। পেট খামচে ধরে দরজার দিকে ছুটে চিৎকার করল,
” মা? বাবা? ”

চেঁচামেচি করে বাড়িসুদ্ধ কাঁপিয়ে তুলল। সকলে তার সামনে উপস্থিত হয়ে যখন একের পর এক প্রশ্ন শুরু করল তখন তিহি চুপ হয়ে গেল। মনে পড়ল এক্সিডেন্টের কথা। সে ধীরে ধীরে বারান্দার চেয়ারটাতে বসে প্রশ্ন করল,
” আমার কি বড় অপারেশন হয়েছে, মা? ”

তিহির মা সাথে সাথে উত্তর দিতে পারলেন না। স্বামীর দিকে তাকালেন। রশিদ মিয়া স্ত্রীকে ইশারায় চুপ থাকতে বলে মেয়ের কাছে এগিয়ে আসলেন। তিহি বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
” আমিই তো চেয়েছিলাম আমার মতো ও মুক্তি পাক। তাহলে এত কষ্ট কেন হচ্ছে, বাবা? ”

বলতে বলতে ঝরঝরে কেঁদে ফেলে তিহি। রশিদ মিয়া মেয়ের মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘ তোর মেয়ে বেঁচে আছে। এটা তো তুইও জানিস মা, তাহলে কেন কাঁদছিস? একটু মনে করার চেষ্টা কর। ‘

___________

বাসরঘরের বাসি ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে আছে ইশাদ। শুকিয়ে যাওয়া গাঁদা ফুলের একটা লতা টেনে গন্ধ টানল। চোখ বুঁজে বলল, ‘ আমার গভীর ছোঁয়াগুলো কী করে ভুলে গেলে, তিহিপাখি? ‘

” তুমি আমার বাবাই? ”

ইনার কণ্ঠস্বরে ইশাদ চোখ মেলল। লতা ছেড়ে তাকে কোলে করে খাটের কিনারে বসিয়ে বলল,
” আমাকে দেখে বাবাই মনে হয়? ”

ইনা বোকা চোখে তাকিয়ে থাকল। পেছন থেকে ইমদাদ বলল,
” বাবা কি মুখ দেখে হয়? ”

ইনা চটপটে বলল,
” এই আংকেলটা বলছে, তুমি আমার বাবাই। আর যেন আংকেল না বলি। ”

ইশাদ ইনার গালে চুমু খেল। হেসে বলল,
” তোমার আংকেল ডাকতে ভালো লাগলে তাই ডেকো। ”
” ঐ আংকেল যদি বকে? ”
” বকবে না। আমি মানা করে দেব। ”

ইনা খুশি হলো। ইশাদ ইমদাদের দিকে তাকিয়ে বলল,
” তোকে তো বলেছিলাম ঠিকানায় পৌঁছে আমাকে কল দিতে। দিসনি কেন? যাসনি? ”

ইমদাদ ইশাদের কাছে এসে বলল,
” মানুষটার সাথে তো আমার কথা বলার দরকার ছিল, তোর না। তাই দেইনি। ”
” কথা বলা শেষ? ”
” না, এখনও কিছু কথা বাকি আছে, তাই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। ”

ইশাদ অবাক হয়ে হাসল। ইমদাদের বুকে হালকা আঘাত করে বলল,
” এতদিনে সুবুদ্ধি হলো। ”

ইমদাদ কৃতজ্ঞতায় ইশাদকে জড়িয়ে ধরল। ছেড়ে বলল,
” মিহিকে এখানে রেখে যাচ্ছি। নতুন বাসা সাজিয়ে নিয়ে যাব। ”
” নতুন বাসা কেন? ঐটা কী হয়েছে? ”

ইমদাদ চোখ নামিয়ে বলল,
” আমি চাই মিহিকে পবিত্র ও পরিচ্ছন্ন স্থানে রাখতে। যেখানে আমার পাপের কোনো চিহ্ন থাকবে না। ”

ইশাদ বিস্ময় চোখে তাকাল। বন্ধুর এই আমূল পরিবর্তনে তার থেকে বেশি খুশি আর কে হতে পারে?

দুই বন্ধু রুম থেকে বের হবে তখন ইনা বলল,
” আমাকে নামাবে না, বাবাই? ”

দুজনে চমকে দাঁড়িয়ে পড়লেও ঘাড় ফিরে তাকাল শুধু ইমদাদ। উত্তেজনায় তার চোখ ছানাবড়। ইশাদকে ফেলে ইনাকে কোলে তুলে নিল। কোল থেকে কাঁধে নিয়ে বলল, ‘ আহ! মন জুড়িয়ে দিলি। ‘ ইমদাদের পাগলামির জন্য ইনা কোনো কথা বলার সুযোগই পাচ্ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর বুকে ধুকপুক নিয়ে বলল, ‘ আমি বাবাইয়ের কোলে যাব। ‘

ইমদাদ অনেকটা বলের মতো ঢিল মেরে ইশাদের কাছে দিল। একটু বেখেয়ালি হলেই হাত ফসকে পড়ে যেত। ইনা ইশাদের গলা জড়িয়ে ধরলে ইমদাদ কাঁধ ঝাকিয়ে বলল, ‘ কী রে, পৃথিবী ত্যাগ করলি নাকি? নড়ছিস-টড়ছিস না যে? ‘

ইনা সে অবস্থায় ইশাদের দুগাল চেপে ধরল। মুগ্ধ গলায় বলল,
” তুমি আমার সুন্দর বাবাই। আম্মু বলেছিল, তোমাকে বাবাই ডাকলে আমাকে অনেক আদর করবে। ”

ইশাদের জড়তা কাটল। ইনাকে পাগলের মতো কতগুলো চুমু খেয়ে জড়িয়ে নিলে সে বলল,
” বাবাই, আম্মু কখন আসবে? ”

____________
তৃপ্তির হাতের চিকন চুড়ি জোড়া দেখতে দেখতে তিহি বলল,
” তোর বিয়েও হয়ে গেছে? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। সেদিনই তো গায়ে ওড়না জড়ালি! ”

তৃপ্তি কী উত্তর দিবে বুঝতে পারছে না। বোকা চোখে তিহিকে দেখছে শুধু। চাচা-চাচির কাছে সব শুনে কান্না পেয়ে গেছিল। দেখা করতে চাইলে বলেছিল, সাবধানে কথা বলতে। তিহির মনে যেন সন্দেহ না জাগে। তাহলে নাকি মাথায় চাপ পড়বে।

” তুই অনেক বড় হয়ে গেছিস। বাব্বাহ, চুল তো কোমর ছাড়িয়েছে। চেহেরায় সেই বাচ্চা বাচ্চা ভাবটা নেই। ”

একটুখানি চুপ থেকে আবার বলল,
” তোদের বাসায় বরই গাছটা এখনও আছে না? চল বরই খেয়ে আসি। ”

তৃপ্তিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উঠোনে ছুটে এলো তিহি। রাস্তায় পা দেওয়ার আগে তৃপ্তি মনে করাল,
” চাচিকে বলবে না আপু? চিন্তা করবে তো। চলো বলে আসি। ”

তিহি শুনল না। তৃপ্তিকে টেনে নিয়ে বাইরে চলে আসল।

তিহির মা রান্না করছিলেন। বারান্দায় আসতে দেখেন তিহি নেই। ছুটে যান ভেতরে। আতঙ্কে ফেটে পড়ে স্বামীকে বললেন,
” তিহিকে কোথাও দেখছি না! ”
” দেখছ না মানে? কোথায় গেছে? ”
” জানি না, মাত্রই তো তৃপ্তির সাথে কথা বলছিল! ”

রশিদ মিয়া আর দাঁড়িয়ে থাকলেন না। হনহনিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাসা থেকে।

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#সিজন_৩
পর্ব (২১)

রশিদ মিয়া বাড়ি থেকে বেরিয়ে আশপাশটা ভালো করে দেখলেন। মেয়ের ছায়াও না পেয়ে উৎকণ্ঠায় পাশের বাড়িগুলোতে খোঁজ নিতে শুরু করলেন। খোঁজ নিতে নিতে কল দিলেন ইশাদের নাম্বারে। অস্থির হয়ে বললেন,
” তিহিকে খুঁজে পাচ্ছি না! ”

ওপাশ থেকে উত্তর এলো,
” তিহি আমার সামনে আছে, বাবা। বরই খাচ্ছে। ”

রশিদ মিয়া থমকে গেলেন। সামনের লোকটির থেকে সরে এসে বললেন,
” তিহি তোমার কাছে? ”
” না, আমি তিহির কাছে। ”

রশিদ মিয়া প্রথমে বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
” তুমি শেরপুরে? ”
” হ্যাঁ। ”
” কখন এলে? বাসায় আসনি কেন? ”
” কিছুক্ষণ আগেই এসে পৌঁছালাম। আপনাদের বাড়ির মোড়টাতে আসতে দেখি তিহি একটা মেয়ের সাথে কোথাও যাচ্ছে। আমি তো ও কে-ই দেখতে এসেছিলাম তাই আর ভেতরে যাইনি। ওর পিছু পিছু অন্য বাসায় চলে আসছি। বাবা, মেয়েটা কি আপনাদের পরিচিত? ”
” হ্যাঁ, আমার ভাইয়ের মেয়ে। নাম তৃপ্তি। ওদের বাড়ি বাজারের দিকে। মেয়েটা এতদূর চলে গেল! তুমি থাকো, আমি আসছি। ”

রশিদ মিয়া ফোন কেটে রিকশা ধরলেন। দেরি করা ঠিক হবে না। এ গাঁয়ের অনেকেই জানে না তিহি ফেরত এসেছে। হঠাৎ দেখে কে কী বলে ফেলবে!

___________
ইশাদ লুকিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকেছিল। সুযোগ বুঝে বাঁশের ঝোপের আড়ালে চলে যায়। এই মুহূর্তে, এভাবে তিহির সামনে পড়তে চাচ্ছে না। তাকে দেখে কী ভেবে বসবে কে জানে!

তৃপ্তিদের বারান্দায় বসে লবণমরিচ দিয়ে বরই খাচ্ছে তিহি। চোখ, মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে দীর্ঘ সময় পর পরিচিত স্বাদ পাচ্ছে। ঠোঁটে ফুটছে সে তৃপ্ততার ছাপ! ইশাদ চট করে ফোন বের করে কয়েকটা ছবি তুলে নিল। ইনাকে দেখাতে হবে ছবিগুলো। তার জন্যই তো আসা। অসুখ হয়েছে শুনে মাকে দেখবে বলে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছিল। পরে যখন শুনেছে তাকে দেখলে মায়ের অসুখ বাড়বে তখন থেমেছে। অনুরোধ করে বলেছে, বাবাই যখন দেখতে যাবে তখন যেন ছবি তুলে আনে।

ছবি তোলা শেষে ফোন পকেটে ভরে দেখে তিহি উঠোনে নেমে এসেছে। তৃপ্তি নামের মেয়েটি সাথে নেই। তিহি পেছনে না তাকিয়ে সোজা রাস্তায় চলে গেল। ইশাদ ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসে দ্রুত। তিহির পেছন নিতে নিতে রশিদ মিয়ার নাম্বারে কল দেয়। জানতে পারে তিনি রিকশায় আছেন। প্রায় চলে এসেছেন। এদিকে তিহি বাড়ির দিকের পথ না ধরে অন্য পথে হাঁটছে। ইশাদ ভারি দুশ্চিন্তায় পড়ল। লুকিয়ে পিছু নিবে নাকি ডেকে থামাবে দ্বিধায় পড়ে গেল। সেসময় অপরিচিত কেউ বলে উঠল,
” আপনাকে তো চিনতে পারলাম না। এ গাঁয়ে নতুন? কোন বাড়ির মেহমান? ”

ইশাদ উত্তর দিতে পারল না। তার আগেই তিহি বলে উঠল,
” আপনি এখানে? ”

ইশাদ চমকে তাকাল তিহির দিকে। ভয়ে থমকে গেল তার কণ্ঠস্বর। তিহি দূর থেকেই বলল,
” আমার পিছু নিয়েছেন? তাজের মতো? আমাকে জোর করে বিয়ে করবেন? তুলে নিয়ে যাবেন? অন্ধকারের ঘরে বন্দী করবেন? ”

ইশাদ পাথরের মতো থমকে যাওয়া শরীরটা নিয়ে স্পষ্ট দেখল তিহি ভয় পাচ্ছে। আতঙ্কে কন্ঠস্বর কাঁপছে। ঘন ঘন নিশ্বাস টানছে। জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা! দৌড়ে গিয়ে তিহিকে সামলাবে সে সুযোগও পেল না। তিহির চিৎকারে বলা কথাগুলোতে গাঁয়ের লোক একসাথে জড়ো হয়ে গেছে। তাকে ঘিরে ধরে নানা প্রশ্ন করছে। গণধোলাই শুরু হলে কেউ একজন বলল,
” মরে যাবে তো, ছেড়ে দেও। এবার পুলিশের হাতে তুলে দেই, বাকিটা উনারাই দেখবেন। ”

____________
রশিদ মিয়ার জরুরি তলবে ইমদাদ আর সোবহান শাইখ এসে পৌঁছায় থানায়। তার মুখ থেকে সবটা শোনার পর জামিনের জন্য উকিলের সাথে কথা বলার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েন সোবহান শাইখ। তাকে শান্ত করতে রশিদ মিয়া বলেন,
” অস্থির হবেন না, ভাইসাব। উনাদের সব বলেছি। তিহি আর ইশাদের বিয়ের প্রমাণপত্র দেখালেই ছেড়ে দেবে জানিয়েছে। ”
ইমদাদের দিকে ঘুরে বললেন,
” কাবিননামা এনেছ? ”

ইমদাদ তড়িঘড়িতে একটা কাগজ বের করে দিল। রশিদ মিয়া কাগজ হাতে ওসির সাথে কথা বলতে ভেতরে গেলেন। বেশ কিছুক্ষণ পর ইশাদকে নিয়ে বেরিয়ে আসে। সোবহান শাইখ ছেলের বেহাল দেখে দৌড়ে আসেন। কাঁধ চেপে ধরে বললেন,
” তুই ঠিক আছিস তো, বাবা? ”

ইশাদ ম্লান হেসে মাথা নাড়ে। ইমদাদ পাথরের মতো শক্ত হয়ে দূরে দাঁড়িয়ে ছিল। বন্ধুর এই হাল তার কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকছে। ইশাদ কাছে আসলে রশিদ মিয়ার জায়গা দখল করে সে। বন্ধুকে কাছে পেয়ে ইশাদ জানতে চায় তিহির কথা। সে উত্তরে বলল,
” অচেতন হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়েছিল গ্রামের লোকেরা। জ্ঞান ফেরার পর বাসায় নেওয়া হয়েছে। ”

কথার মাঝে ঘড়ি দেখে বলল,
” এখন মনে হয় ঘুমাচ্ছে। ”

ইশাদ কিছু বলল না। কিছুক্ষণ থম মেরে থেকে হেসে ফেলল। ইমদাদ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
” পাগলের মতো হাসছিস কেন? ”

ইশাদ সহাস্যে বলল,
” পাগলের মতো না পাগলই। তা না হলে বউয়ের পিছ ধরে থানায় আসি? রামধোলাই খাই? ”

ইশাদ আবার হেসে ফেলল। হাসি থামিয়ে বলল,
” তিহির কয়েকটা ছবি তুলে নিয়ে আয় তো। ইনা দেখবে। দুপুরে যে ছবিগুলো তুলেছি, ওগুলোতে অসুস্থ মনে হচ্ছে না। ইনামা আমাকে ভুল বুঝবে। ”

________
নতুন বাসায় আসবাবপত্র গুছিয়ে মিহিকে এনেছে সন্ধ্যা নাগাদ। দু-কামরার ফ্ল্যাটটা ঘুরিয়ে দেখানো শেষে ইমদাদ বলল,
” পছন্দ হয়েছে? ”

মিহি মুখে জবাব দিল না। মুগ্ধ চোখে চারপাশে তাকিয়ে মাথা একপাশে কাত করল। ইমদাদ মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করল,
” একা থাকতে পারবে? ”

মিহি মুগ্ধ দৃষ্টি ফিরিয়ে আনল ইমদাদের দিকে। বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারল না। মাথা নিচু করে বলল,
” হ্যাঁ। ”

মিহির থুতনির নিচে আঙুল রাখল ইমদাদ। উপরে হালকা ধাক্কা দিতে মিহির মুখ সোজা হয়ে গেল। ইমদাদের চোখে চোখ পড়লে সে বলল,
” ভয় পাবে না তো? ভেবে বলো। সেরকম হলে রাধুনিকে পার্মামেন্ট রেখে দেব। ”

মিহি উত্তর দিল না। চোখের পলক ফেলল না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে মোহগ্রস্ত হয়ে বলল,
” আপনি এমন আদর করে কথা বলছেন কেন? ”

ইমদাদের হাসি চওড়া হলো। মিহির প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল,
” তোমার ভালো লাগছে না? ”
” হ্যাঁ। ”
” তাহলে এখন থেকে আদর করেই কথা বলব। ”
” কেন? ”

ইমদাদ মিহির থুতনির নিচ থেকে হাত সরিয়ে ফেলল। এককদম পিছিয়ে বলল,
” তোমার ভালো লাগছে তাই। ”

ইমদাদ রুম থেকে চলে যেতে গিয়ে থামল। ঘাড় ফিরিয়ে বলল,
” আমারও ভালো লাগছে তাই। ”

ইমদাদ রাতের খাবার আনল বাহির থেকে। দুজনে একসাথে খেয়ে উঠার পর মিহি বিছানা ঝাড় দিল। বালিশ নিয়ে শুয়ে বলল,
” আপনি ঘুমাবেন না? এভাবে বসে আছেন কেন?

ইমদাদ চমকে কেঁপে উঠলে মিহি বলল,
” ভয় পেলেন নাকি? ”

ইমদাদ উত্তর দিল না। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকল মিহির মুখটায়। রাতে খাওয়া শেষ করা পর্যন্তও সে ঠিক ছিল। বিছানায় বসার পর থেকে কেমন জানি হয়ে গেল। মিহির পাশে শোয়ার সাহস পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে পাশাপাশি শুলেই কিছু একটা হয়ে যাবে অথচ কয়েকদিন আগেও এই মেয়েটাকে তার বাচ্চা মনে হয়েছে। বাচ্চা শরীরের গন্ধে তার কিছুই হবে না এমন গর্বে কত রাত পাশাপাশি শুয়েছে। কিন্তু আজ? ইমদাদ নিশ্বাস নেওয়া বন্ধ করে দিল। মিহির থেকে দূরে সরে বসে বলল,
” হ্যাঁ, তুমি ঘুমাও। আমি একটু পর ঘুমাব। ”

মিহি কথা বাড়াল না। বাধ্য মেয়ের মতো শুয়ে পড়ল। ইমদাদ আলো নিভিয়ে রুমের ভেতর পায়চারি করছে আর অস্থিরমনে বিড়বিড় করছে, ‘ এই মেয়েটা তো আমার। মেয়ে কেন বলছি? মিহি তো আমার বউ। তাহলে পাশে শুতে এত ভয় কেন পাচ্ছি? শুলেই কি ছুঁয়ে ফেলব? ছুঁয়ে ফেললেই কী হবে? বউই তো হয়। আইনেও বৈধ, ধর্মেও বৈধ। তবুও এত ভয় কেন পাচ্ছি? বয়স কম বলে? কত কম? খুব বেশি তো না। ‘ ইমদাদ আবছা আলোয় মিহির দিকে তাকাল। সাথে সাথে কান্নার মতো মুখ করে বলল, ‘ তুমি আমার বউ না, আমার পাপের শাস্তি। নাহলে আমার জিনিসকে আমারমতো করে ছুঁতে এত ভয় করি? যেখানে আমার জানা তুমি একটুও বাঁধা দিবে না। ‘

ইমদাদ আরও কিছুক্ষণ নীরব দর্শন করল মিহিকে। দীর্ঘ নিশ্বাস টানল কয়েকবার। মাঝরাতের দিকে আলগোছে মিহির পাশে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করে মিহির দিকে স্থির হয়ে শুয়ে পড়ল। চুপচাপ ওর ঘুমন্ত মুখটার দিকে চেয়ে থেকে মাথা তুলে আনল নিজের বুকে। আলতো জড়িয়ে বলল, ‘ তুমি শাস্তিরূপে কেন মৃত্যুরূপে আসলেও আমি গ্রহণ করে নিব। ‘

_________
সকালে ইমদাদ চোখ মেলে দেখল মিহি রুমে নেই। লাফিয়ে উঠে চিৎকার করল,
” মিহি? এই মিহি? ”

মিহি বারান্দায় কাপড় মেলছিল। ইমদাদের ডাকে দৌড়ে এসে বলল,
” কী হয়েছে? ”

ইমদাদ চোখ বড় বড় করে মিহির শরীরের শাড়ি দেখল। চুলে জড়ানো তোয়ালের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
” তুমি গোসল করেছ কেন? ”

মিহি উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেল না। ইমদাদ পাগলের মতো বলতে থাকল,
” ও মাই গড! আমি সত্যি সত্যি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি? কিভাবে হারালাম? নিশ্চয় ঘুমের মধ্যে। এজন্যই কিছু মনে পড়ছে না! ”

ইমদাদ মিহিকে টেনে বিছানায় বসাল। শরীরের এখানে-ওখানে দেখতে দেখতে আপনমনে বিড়বিড় করছে,
‘ কী করে পারলাম? ছোট্ট একটা মেয়ে! যদি বাচ্চা-কাচ্চা হয়ে যায়? কী করে সামলাবে? ও আল্লাহ! ‘ ইমদাদ মিহিকে ফেলে ওভাবেই বাইরে বেরিয়ে গেল। মিনিট কয়েকের মধ্যে ফিরে আসল ঝড়ের গতিতে। গ্লাসে পানি নিয়ে মিহির মুখে একটা ট্যাবলেট দিয়ে বলল,
” একদম গিলে ফেলবে। ”

ইমদাদ নিজেই মুখে পানি ঢেলে দিল। ট্যাবলেট খাওয়ার পর বলল,
” পুরো পানিটা খাও। ”

মিহি পানি খেলে তাকে বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে বলল,
” একদম বিছানা থেকে নামবে না। শুয়ে থাকো। ”

মিহি চুপচাপ শুয়ে থাকলে ইমদাদ এমনভাবে নিশ্বাস ছাড়ল যেন ভয়ঙ্কর কিছু থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করেছে। মন ও শরীর একটু শান্ত হলে গোসল করে আসল। পরার জন্য শার্ট নিতে নিতে বলল,
” কেমন একটা গন্ধ আসছে নাকে। তুমি চুলায় কিছু বসিয়েছ? ”

মিহি শোয়া থেকে উঠে বসে বলল,
” না। ”
” তাহলে গন্ধ কিসের? ”
” আপনার পারফিউমের। ”
” পারফিউম? ”
” হ্যাঁ, সকালে আমার হাত লেগে পড়ে গেছিল। ওটা সরাতে গিয়ে আমার হাতে লাগছে। আমি অনেক ধোয়ার পরও গন্ধ যাচ্ছিল না, তাই গোসল করেছি। নাহলে তো খাবারে লেগেও গন্ধ করত। দেখুন তো এখনও গন্ধ করছে নাকি। ”

মিহি হাতদুটো সামনে মেলে ধরে আছে। ইমদাদ শার্ট ফেলে বিস্ময় নিয়ে বলল,
” এই গন্ধের জন্য তুমি গোসল করেছ? ”
” হ্যাঁ। নাহলে এত সকালে গোসল করব কেন? পানি কী ঠাণ্ডা! ”

মিহি এমনভাব করল যেন ওর শরীরে কেউ ঠাণ্ডা পানি ঢেলে দিছে। ইমদাদ ওর নাকের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
” তারমানে আমাদের মধ্যে কিছু হয়নি? ”
” কী হয়নি? ”

ইমদাদ বোকার মতো চেয়ে আছে মিহির দিকে। ঠিক তখনই মনে পড়ল, রাতে শোয়ার সময় যে পাতলা গেঞ্জি পরেছিল সকালে সেটা গায়েই ছিল। তাহলে এমন সন্দেহ মনে জাগল কিভাবে? ইমদাদ খানিকটা শক্ত স্বরে বলল,
” যদি কিছু না হয়েই থাকে তাহলে ট্যাবলেট খেলে কেন? ”

মিহি সরল গলায় উত্তর দিল,
” আপনি খায়িয়ে দিলেন তাই। ”
” তুমি জানো ওটা কিসের ট্যাবলেট ছিল? ”
” কিসের? ”

ইমদাদ বলতে পারল না। নিজের বোকামির জন্য হেসে ফেলল। হাসতে হাসতে মিহির মাথা চেপে ধরল বুকের মধ্যে। সে অবস্থায় বলল,
” আমি চেয়েছিলাম আমার সংসারে এমন কেউ থাকুক যে ভালোবেসে আমার খেয়াল রাখবে, যত্ন নিবে, আগলে রাখবে। কিন্তু এখন বুঝতে পারলাম আমি ভুল ছিলাম। আমি আসলে চেয়েছিলাম আমার সংসারে এমন কেউ থাকুক যাকে ভালোবেসে আমি খেয়াল রাখব, যত্ন নেব, আগলে রাখব। আর সেই মানুষটা আমি পেয়ে গেছি। ”

ইমদাদ মিহির চুলে চুমু খেয়ে মাথাটা সরাতে চাইল। মিহি সরল না। ইমদাদকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মোহিত কণ্ঠে বলল,
” আপনার শরীরের গন্ধটা ভালো লাগছে। ”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here