#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি,১০,১১
#রোকসানা-রাহমান
পর্ব (১০)
মিহিকে নিয়ে বাসায় ঢুকতে গিয়ে দেখে সদরদরজা খোলা। আশেপাশে আম্মু আর আব্বু এমনকি ইনাকে না পেয়ে কিছুটা অবাকই হচ্ছে ইশাদ। মিহিকে ইশারায় ড্রয়িং রুমে বসিয়ে উপরে উঠার জন্য সিড়িতে পা ফেলছে। নিজের রুমের কাছে এগুতেই মা- বাবাকে দেখতে পাচ্ছে। দুজনেই দরজার আড়ালে দাড়িয়ে কিছু দেখছে আর চোখের পানি মুচছে। কি এমন দেখছে তারা?? ইনার কিছু হয়নি তো?? ইনার কথা ভাবতেই ইশাদের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠছে। দৌড়ে রুমের ভেতর ঢুকে গিয়ে থ হয়ে গেছে ইশাদ। অবিশ্বাস্যের চরমপর্যায়ে গিয়ে বললো,,
“” ভাইয়া,তুই?””
ইরফাদ অস্ট্রেলিয়া থেকে ফিরেছে দুঘন্টা আগে। কাউকে না জানিয়ে হুট করে চলে আসায় বাবা-মা বেশ চমকে গিয়েছিলো। চমকের পালা শেষ করে,নানা অভিমান,রাগ,ধমক,স্নেহ আর ভালোবাসার পার্ট শেষ হতেই ইনাকে কোলে তুলে নেয় ইরফাদ। সোজা হাটা ধরে ইশাদের রুমে। এই মেয়েটার সামনে কিভাবে দাড়াবে,কিভাবে নিজের পরিচয় দিবে এইসব ভেবেই সারারাত নির্ঘুমে কেটেছিলো ইরফাদের। যখন জানবে ও ইনার বাবা তখন মেয়েটার কি রিয়েক্ট হবে? যদি নানা প্রশ্ন করে বসে? এই যেমন,তুমি যদি আমার বাবা হও তাহলে এতোদিন কই ছিলা? আমাকে আদর করোনি কেন? মজা কিনে দাওনি কেন?? ঘুরতে নিয়ে যাওনি কেন?? আমার আম্মু কোথায়?? বলো,আমি উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত তোমার সাথে কথা বলবোনা,তোমাকে বাবাইও ডাকবোনা। তুমি তো পচা,নাহলে আমাকে ছেড়ে এতোদুর কি করে থাকলে??? এতোসব প্রশ্নের কি উত্তর দিবে এসব নানা চিন্তা-ভাবনা থেকে ভয়,সংকোচ,সংকট,দুর্বলতা ইত্যাদি একসাথে জড়ো করেই ফ্লাইট ধরেছিলো।
ইরফাদের কোলে উঠার পর ইনা শুধু মুখ ভার করে তাকিয়ে ছিলো,মুখ দিয়ে একটা শব্দও বের করেনি। হয়তো বুঝার চেষ্টা করছিলো এই অপরিচিত লোকটা কে??
ইরফাদ ইনাকে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নিয়েছে।নানা রকমের চকলেট দিতেই ইনার ভারী মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। একসাথে অনেকগুলো চকলেট মুখে পুরে ইরফাদের গালে চুমু খেয়ে নিলো। ইনার এমন স্বাভাবিক আচরনে যেন ইরফাদের বুকে আটকে থাকা নিশ্বাসটা বেড়িয়েছে। বেশ কিছুক্ষন মেয়ের হাসি হাসি মুখটা দেখে নিয়ে টুপ করে কপালে চুমু খেয়ে নিলো। এতো বছর পর প্রায় ৭ বছর পর মেয়েকে কাছে টেনে নিয়েছে,এই একটা চুমু খেয়ে কি মন ভরে? তাই পরপর কয়েকটা চুমু খেতে ইনা বিরক্ত মুখে বললো,,
“” উফ! তুমি দেখতে পারছোনা আমি চকলেট খাচ্ছি? তোমার এখনি এতো চুমু খেতে হবে? আমার খাওয়া শেষ হলে তারপর খেও!””
ইনার কথায় ইরফাদ শব্দ করে হেঁসে উঠতেই ইশাদের আগমন ঘটে। চোখে,মুখে অবিশ্বাস্য নিয়ে বলে,,
“” ভাইয়া,তুই?””
ইনার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই ইরফাদ জবাব দিলো,,
“” এমনভাবে বলছিস যেন,কোনো মরা লাশ হঠাৎ করে জিন্দা হয়ে উঠেছে।””
ইশাদ,পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে বললো,,
“” তার থেকেও বেশি কিছু!””
“” তুই কি বলতে চাচ্ছিস আমি মরা লাশ?””
“” না,তার থেকেও বেশি কিছু।””
ইরফাদ কিছু বলতে চেয়েও থেমে গিয়ে উঠে দাড়িয়েছে। ইশাদকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বললো,,
“” খুব মিস করছিলাম রে তোদের, খুব!””
“” তা এই অবিশ্বাস্যকান্ড ঘটানোর কারন কি শুধুই আমাদের মিস করা?””
“” নাহ, সব কান্ডের কান্ডারী একমাত্র তিহি!””
ভাইয়ের মুখে তিহির নামটা শুনে ইশাদের মুখের হাসি উধাও। মুখে বয়ে আসছে ব্যর্থতার ঝড়! হারানোর প্লাবন! কিন্তু এখন সে কোনো প্লাবনে ভাসতে চাইনা। ইশাদ ভাইয়াকে ছেড়ে ইনার কাছে বসেছে। মুখে চকলেট লেগে পুরোই চার/পাঁচ বছরের বাচ্ছা মনে হচ্ছে,অথচ কিছুদিন আগেই তো ও আট বছরে পা দিয়েছে। মুখের চকলেট মুছতে মুছতে বললো,,
“” সোনামা,তোমাকে চকলেট খেতে নিষেধ করেছিনা? একটু পরে যখন দাঁতে পোকারা খেলা করবে তখন কে কান্না করবে?””
ইনা আরেকটা চকলেট মুখে দিয়ে নাকি কন্ঠে বললো,,
“” আমাকে কেন বকছো বাবাই? আমি কি চকলেট খেতে চেয়েছি? ঐ আংকেলটাতো নিজে থেকেই আমাকে দিয়েছে। তুমি আংকেলকে বকো!””
ইশাদ থম মেরে ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,,
“” দেখেছিস ভাইয়া,তোর মেয়ে কত পাকনি হয়েছে? আমি কাকে বকবো সেটাও আমাকে শিখাচ্ছে!””
ইনা চকলেট রেখে গোমড়া মুখে বললো,,
“” কয়টা চকলেট খেলাম বলে তুমি আমাকে আংকেলের মেয়ে বানিয়ে দিলে?? তুমি এতো পচা কেন বাবাই?””
ইশাদ আর ইরফাদ দুজনেই একসাথে হেঁসে উঠেছে। ইনা গোমড়া মুখ আরো গোমড়া করে বললো,,
“” উফ! তোমাদের সাথে আর কথা নাই। আংকেল এই নেও তোমার চকলেট!””
ইশাদ ইনার হাত চেপে ধরে বললো,,
“” সোনামা,উনি তোমার আংকেল হয়না।””
“” তাহলে?””
ইশাদ পিঠে কারো হাতের ছোয়া পেয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখে ভাইয়া। চোখের ইশারায় কিছু বলতে মানা করছে। ইশাদ ইশারাকে অগ্রাহ্য করেই বললো,,
“” উনি তোমার বাবাই হয়।””
“” আমার বাবাইতো তুমি!””
“” হুম,কিন্তু উনিও তেমার বাবাই।””
“” আমার দুটো বাবাই?””
“” হুম!””
ইনার গোমড়া মুখ নিমিষেই চকচক করে উঠছে। কিছু একটা ভেবে বললো,,
“” কিন্তু দুটো বাবা হলে কিভাবে হবে?? আমি যখন বাবাই বলে ডাকবো তখন কে আসবে আমার কাছে?””
ইনার কনফিউশনের কথা ইরফাদ বুঝতে পেরে বললো,,
“” তুমি আমাকে বড় বাবাই বলো, তাহলেই হবে।””
“” ওকে,তাহলে তুমি বড় বাবাই আর আমার বাবাই শুধু বাবাই।””
ইনাকে ইশাদ নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,,
“” নাহ! আমাকে ছোট বাবাই ডাকবে।””
“” তাহলে আমি শুধু বাবাই কাকে ডাকবো?””
ইনার অসহায়মাখা মুখ দেখে এবার সকলেই হেঁসে উঠেছে। মাঝখান থেকে ইনা আবার রাগ করে গোমড়া হয়ে রইলো। তার দুটো বাবাই অথচ শুধু বাবাই নাই,এটা কেমন কথা???
ইশাদ,ইনার দুগাল টেনে বললো,,
“” চলো,তোমার জন্য কেউ ওয়েট করছে।””
“” কে?””
“” গেলেই দেখতে পাবে।””
ইনাকে কোলে নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসে। সাথে বাকি সবাইও নিচেই নামছে।
মিহি, ইশাদের জন্য অপেক্ষা করতে করতে বোরিং ফিল করছিলো। এতো সময় ধরে উপরে কি করছে কে জানে? তার মধ্যে এতো বড় বাড়িতে আর কোনো মানুষজনকে না দেখেও কিছুটা অবাক। একঘেয়েমিটা কমাতে সোফা ছেড়ে উঠে দাড়িয়েছিলো। আশেপাশের চোখ বুলাতে গিয়েই দেখে ইশাদ একটা মেয়েকে কোলে নিয়ে নিচে নামছে। তার সাথে দুজন বয়স্ক মহিলা ও লোককে দেখা যাচ্ছে,হয়তো এনারাই ইশাদের মা-বাবা! মিহি নিজের মতো ভেবে নিয়ে ইশাদের পাশে একজন মাঝ বয়সি লোককেও দেখতে পেলো। ঠিক মাঝবয়সীও না,তবে তার সুন্দর ভাইয়ের থেকে পাঁচ/ছয় বছরের বড় হবে। মুখে তার কালো,ঘন চাপদাড়ি। মোছও আছে,তবে সেটা দাড়ির সাথে এডজাস্ট হওয়ায় তেমন একটা খারাপ লাগছেনা। বেশ ভালো লাগছে,অনেকটা তামিলদের নায়কদের মতো!
“” তুমি সিড়ির দিকে কি দেখছো, মিহিরানী?””
হঠাৎ ইশাদের কন্ঠে কিছুটা ছিটকে উঠে মিহি,সবাই তার দিকে চেয়ে আছে। আর সকলে তার সামনেই অবস্থান করছে,তাহলে সে এতক্ষন সিড়ির দিকে কি দেখছিলো?? মিহি আড়চোখে সিড়ির দিকে আরেকবার তাকিয়ে দেখে ওখানটা ফাঁকা!
ইনা, মিহিকে টেনে সোফায় বসিয়ে দিয়েছে। ওর কোলের উপর উঠে,গলা জড়িয়ে ধরে ইশাদের দিকে চেয়ে বললো,,
“” ছোট বাবাই,এই আপুটা আমার সাথে দেখা করতে এসেছে?””
“” হুম! কিন্তু সোনামা,তুমি ওকে আপু ডাকছো কেন?””
“” বারে,ও তো আমার মতো ছোট,তাহলে আপু ডাকবোনা?””
ইনার কথায় ইশাদ চোখ বড় করে বললো,,
“” ও তোমার মতো?””
“” হুম! তুমি দেখতে পারছোনা? তুমি তো দেখি কানা হয়ে যাচ্ছো!””
মিহি বাবা-মেয়ের কথার মাঝখানে কি বলবে বুঝতে পারছেনা। তাই চুপ করে থাকাটাই শ্রেয় মনে করলো। কিন্তু আর চুপ করে থাকতে পারেনি। ইশাদ ওর পাশে বসে ফিসফিস করে বললো,,
“”তোমার কি ভাগ্য গো মিহি,আজকেই তোমাকে বড়ভাবী বানাতে চাইলাম আর আজকেই ভাইয়া অস্ট্রেলিয়া থেকে বাংলাদেশে হাজির। উফ! কি টান! আমার মনে হয় এইবার তোমার বিয়েটা হলো বলে!!!””
“” ধুর! আমি এখনি চলে যাবো। আপনি আমাকে নিয়ে কখন থেকে মজা করে যাচ্ছেন।””
ইশাদের কথা কেউ না শুনলেও মিহির কথা সবাই শুনতে পেরেছে। সবাই ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে। ইরফাদ এগিয়ে এসে বললো,,
“” তুই ওর কানে কি ফিসফিস করছিস?? আর কিসের মজার কথা বলছে?? এতো সুন্দর বাচ্চা মেয়েটাকে জ্বালাচ্ছিস কেন?””
মিহি আড়চোখে ইরফাদের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইশ! কি সুন্দর কন্ঠ।
~~
সারাদিনে তাজ আর একবারের জন্যও রুম থেকে বের হয়নি। কেন হয়নি কে জানে?? তিহিও রুমে আসেনি। লোকটা আশেপাশে থাকলেও ভয়েরা কেঁপে উঠে। তাই ফুপিমার রুমেই গল্পগুজবে নিজেকে বিজি রেখেছে। কিন্তু রাতের খাবারটাও যখন খেতে আসলোনা তখন তিহি আর চুপ করে থাকতে পারছেনা। টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়িয়েছে।
তাজ শুয়ে আছে,রুমের লাইট বন্ধ,মুখের উপর বালিশ চেপে শুয়ে আছে। তিহি লাইটটা অন করে ধীর পায়ে এগুতে গিয়েও থেমে গিয়েছে। একটু দুর থেকেই বললো,,,
“” খাবার বেরেছি,খেতে আসুন। ফুপিমা ডাকছে।””
নিজের কথার বিপরীতে তাজের কোনো সাড়া না পেয়ে আরেকটু এগিয়ে এসেছে। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি??
তিহি তাজের মুখ থেকে বালিশ সরাতেই তাজ ধপ করে চোখ মেলে ফেলেছে। চোখদুটো লাল টকটক হয়ে আছে। তিহি ভয়ে সিউরে উঠে,এক কদম পিছিয়ে যেতেই তাজ ওর হাত টেনে ধরে। জোরপুর্বক বিছানায় ফেলে নিয়ে ওর দুইবাহু চেপে ধরে বললো,,
“” তোর এতো বড় সাহস,তুই আমাকে মাতাল বলিস? আমার ছোয়াকে হিংস্রের আচরের সাথে তুলনা করিস?? ইচ্ছে করছে তোকে কামড়ে বুঝিয়ে দিতে হিংস্রতা কাকে বলে।””
তিহি চোখ বন্ধ করেই বললো,,,
“” আপনি আবার নেশা করেছেন? ছাড়ুন আমাকে। মদের গন্ধে আমার বমি আসছে।””
“” হ্যা,করেছি তাতে তোর কি? আমার যা খুশি আমি তাই করবো। তুই বলার কেউনা। বুঝেছিস তুই?””
“” আমি আপনার বউ। কোনো পতিতা নই যে আমার সাথে এমন আচরন করবেন।নিজের পুরুষত্ব ফলাতে তো পতিতালয়ে গেলেই হয় আমাকে কেন বিয়ে করেছেন?? আপনার কি আমাকে পতিতা মনে হয়?””
তিহির কথায় তাজ রাগে ফেটে পড়ছে। বাহু দুটো আরো শক্ত করে চেপে ধরে অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বেশ কিছু সেকেন্ড পার হতেই ওকে ছেড়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পড়ে।
~~
মাঝরাতে তিহিকে নিয়ে সাজানো স্বপ্নগুলোর স্মৃতিচারন করতেই হয়তো ইশাদের ঘুম ভেঙে যায়। আজও তাই হয়েছে। শোয়া থেকে উঠে পাশ ফিরে চেয়ে আছে। ইরফাদ আর ইশাদের মাঝখানে শুয়ে আছে ইনা। ইরফাদ আর ইনা দুজনেই গভীর ঘুমে। ইনা আঙুল চুষে যাচ্ছে আর ইরফাদ এতোদিনবাদে মেয়েকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুমের দেশে বিরাজ করছে। আজ কেন জানিনা ইরফাদের জন্যও ইশাদের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। তার মতো সেও যে ভালোবাসার মানুষটিকে হারিয়েছে।
ইশাদ বিছানা ছেড়ে বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে। আজ আকাশটা মেঘে ঢাকা নয়,তারার মেলা বসেছে। সাথে চাঁদটাও জ্বলজ্বল করছে। আজ কি পুর্নিমা??
“” এতোরাতে আকাশ দেখছিস? ঘুম নেই?””
ভাইয়ার কন্ঠ পেয়ে নীরবেই চোখের ধারে জমে থাকা পানিগুলো হাত দিয়ে মুছে বললো,,
“” ঘুম আসছিলোনা তাই ভাবলাম একটু হাওয়া খাই।””
ইরফাদ, ইশাদের পাশে এসে সেও আকাশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বললো,,
“” আমার কাছে চোখের পানি লুকোচ্ছিস? এই সময়টা আমিও পার করে এসেছি। তবে তফাৎ কি জানিস? আমার মানুষটি আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলো,কিন্তু তুই নিজের ইচ্ছায় তাকে ছেড়ে দিয়েছিস!””
“” ভাইয়া সকালে আমার আর্লি উঠতে হবে।””
“” পালাচ্ছিস?? আর কতজনের কাছ থেকে পালাবি?? সবশেষে নিজের থেকে পালাতে পারবি তো?””
ইশাদ থমকে গেলে ইরফাদ আবার বললো,,
“” ভেতরে আর কত চেপে রাখবি? তোকে যে এটা খেয়ে ফেলছে? অন্তত আমাকে তো বল,কি এমন হয়েছিলো তোদের মধ্যে যার জন্য নিজের প্রাণটা হাতে নিতেও তুই দ্বিধাবোধ করিসনি?””
ইশাদ অপরাধীর সুরে বললো,,
“” আমি বলতে পারবোনা।””
ইশাদ আর এক মুহুর্তোও ওখানে দাড়ালোনা। রুমে এসে শুয়ে পড়তেই ইরফাদ আবার বললো,,
“” তোর কি কোনো বিশেষ রোগ দেখা দিয়েছে?””
“” নাতো, কেন?””
ইরফাদও বিছানায় শুয়া অবস্থায় ইনাকে ডিঙিয়ে ইশাদের কাছে এসে ফিসফিস ভঙ্গিমায় বললো,,
“” তাহলে তোর পুরুষত্বে কোনো দোষ আছে??””
“” ভাইয়া,তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে গেছে?? কি সব আজগুবি কথাবার্তা বকছিস??””
“” চিল্লাচ্ছিস কেন? মনের সংকোচ দুর করার জন্য জিজ্ঞেস করলাম।””
“” তুই কি এসেই আমার উপর গবেষনা চালানো শুরু করে দিয়েছিস?””
ইরফাদ নিজের জায়গায় যেতে যতে বলল,,
“” তো আর কি করবো? যার যাদু মন্ত্রনায় আমার মেয়ের কাছে ছুটে এলাম,অথচ তাকে দেখতেই পেলাম না। আচ্ছা ওর শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে দেখা করে আসলে কেমন হয়? এটলিস্ট একটা ধন্যবাদ তো দেওয়া দরকার!””
“” আমি ঘুমাবো।””
“” তোকে ঘুমুতে কে নিষেধ করেছে? ঠিকানাটা দিয়ে ঘুমিয়ে যা।””
“” কিসের?””
“” তিহির শ্বশুড়বাড়ির!””
“” নেই।””
“” নেই মানে?””
“” নেই মানে নেই!””
“” তাহলে ওর বরের ফোন নাম্বারটা বল।””
“” জানিনা।””
“”জানিনা মানে?””
“” জানিনা মানে জানিনা!””
“” প্রাক্তন প্রেমিকার হাসবেন্ডের নাম্বার জানিসনা,শ্বশুড়বাড়ির ঠিকানা জানিসনা তাহলে তুই কেমন প্রেমিক, ইশাদ??””
“” নষ্ট প্রেমিক!””
~~
তাজ আর বাসায় আসেনি। তিহি বালিশ ভেজাতে ভেজাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। যাকে বলে ক্লান্ত ঘুম। মানুষ যখন খুব বেশি কান্না করে চোখের পানি ফেলে তখন চোখগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়ে,আর একসময় চোখের পাতা দুটো লেগে গিয়ে ক্লান্ত ঘুমে ঢলে পড়ে।
“” তিহিপাখি,তুমি কাঁদছো? তোমার কান্নার পেছনে যে আমি আছি,এটা জেনেও কাঁদছো? তোমার চোখের পানিগুলো যে আমাকে খুব যন্ত্রণা দেয়!””
তিহি চোখের পানি মুছে নিয়ে বললো,,
“” সরি,ইশ! আমি আর কাঁদবোনা। আমি কি এই নরক যন্ত্রণা থেকে কোনোদিন বের হতে পারবোনা? ঐ পশুচারী তাজের হিংস্র থাবা থেকে বাঁচতে পারবোনা?””
ইশাদ ইষৎ হেঁসে তিহির বা’গালে নিজের ডানহাতটা রেখে নরম সুরে বললো,,
“” তিহি পাখি,মানুষের দুটো রুপ থাকে।এক,বাহ্যিক রুপ আর দুই,আন্তিক রুপ। তুমি বাহ্যিক রুপ দেখেই জাজ করে ফেললে?? একটা মানুষের উপর মন্তব্য করতে হলে তার দুটো রুপকেই সঠিকভাবে পর্যালোচনা করা উচিত। তুমি আমার তিহিপাখি হয়েও এমন ভুল কি করে করছো?? তাজের ভেতরে যে সত্তাটার বসবাস তা ঘুমিয়ে পড়েছে। তাকে জাগিয়ে তুলো। তবেইনা তুমি সঠিক মন্তব্যটা দিতে পারবে!””
“” আমি পারবোনা,ইশাদ। আমাকে তোমার কথার জাল থেকে মুক্তি দাও। আমি তোমাকে নিয়ে ভাবতে চাই আর কাউকেনা!””
তিহি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে।কিন্তু ইশাদকে না পেয়ে আবার অঝরধারায় কেঁদে উঠে। দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে ও। কিন্তু হঠাৎই কারো মাথার স্পর্শ পায় নিজের কোলে। তিহি কান্না থামিয়ে তাকিয়ে দেখে তাজ!
“” নেশাবউ! তোমার গন্ধ না পেলে আমার ঘুম আসেনা।””
চলবে
#তোমার সমাপ্তিতে-আমার প্রাপ্তি
#রোকসানা-রাহমান
পর্ব (১১)
তিহি ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে চারপাশে চোখ বুলাচ্ছে।কিন্তু ইশাদকে না পেয়ে আবার অঝরধারায় কেঁদে উঠে। দুহাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে ও। কিন্তু হঠাৎই কারো মাথার স্পর্শ পায় নিজের কোলে। তিহি কান্না থামিয়ে তাকিয়ে দেখে তাজ!
“” নেশাবউ! তোমার গন্ধ না পেলে আমার ঘুম আসেনা।””
তিহি অন্ধকারের মধ্যেও যেন তাজকে দেখতে পাচ্ছে,কিন্তু তাজের মুখের সৌন্দর্যকে না,তার ভেতরে জমে থাকা কষ্টকে। কি এমন কষ্ট আছে উনার?? তিহির যে খুব জানতে ইচ্ছে করছে,খুব!
“” আপনার লুকোনো কথাগুলো আমাকে বলবেন কি? আমি যে আর এসব সহ্য করতে পারছিনা। মুক্তি দিবেন আমায়? একটু খোলা আকাশে উড়বো। আকাশে উড়ার স্বপ্নটা যে দেখিয়েছিলো, সে যে আমায় বলেছে এখন তার হাত ধরে নয়-আপনার হাত ধরে উড়তে। আপনার পাখায় ভর করে নীল আকাশ দেখতে। আমি যে তার কথা ফেলতে পারবোনা। এতোটা দুঃসাহসী নই আমি!””
তিহির কথার উত্তরে তাজ শুধু একটুখানি নড়ে উঠেছে। তিহির পেটের দিকে চেপে এসেছে। বা’হাতে তিহির পিঠের দিক ঘুড়িয়ে গভীরভাবে জড়িয়ে বললো,,
“” আমাকে তোমার পেটের গন্ধ নিতে দিবে,নেশাবউ?? একটা ছোট্ট চুমুও খেতে ইচ্ছে করছে। ব্যথা দিবোনা প্রমিস!””
তিহি ফ্যালফ্যাল নয়নে চেয়ে থাকা ছাড়া আর কিছু বলতে পারছেনা৷ আমি কি বলছি আর সে কি বলছে?? উনি কি আমার কথা শুনতে পারছেনা? নাকি ইচ্ছে করেই এড়িয়ে যাচ্ছে?? কন্ঠটা এতো শীতল কেন? স্পর্শটাও শীতল। তবে কি আজ উনি মদ্যপান করেননি??
“” তুমি থ্রি-পিস কেন পড়ো? থ্রি-পিস পড়লে তোমাকে সদ্য ফুটে উঠা পদ্মকুমারি লাগে,মনেই হয়না তোমার বিয়ে হয়েছে। তখন তো আমার নিজেকে বুড়া বুড়া লাগে। আর আমি তোমার পেটটাও দেখতে পারিনা। সবসময় আড়াল হয়ে থাকে। এখন থেকে শাড়ী পড়বে,বলো না পড়বে তো!””
তাজ কথার ছলেই নিজের ঠোট ছুয়িয়ে দিলো তিহির পেটে।
“” নেশাবউ,আজ আমি এভাবেই ঘুমোবো। তোমার কোলে,তেমার কি কষ্ট হবে?””
তাজ আরেকটা চুমু খেতেই তিহি নিজের কোল থেকে তাজকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। চাপা কন্ঠে চিৎকার করে বললো,,
“” না,আমি পারবোনা,পারবোনা আপনার ছোয়া নিতে। আমার অসহ্য লাগে আপনার ছোয়া। আমি শুধু আমার ইশের ছোয়া চাই,আর কারো নয়,কারোর ছোয়া নয়!””
তিহির চিৎকারে তাজের কিছু যায় আসেনি,তাকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার পরও তার চোখ খুলেনি। বিছানায় বাকা হয়ে পড়ে আছে। তিহি ওর মুখের কাছে গিয়ে শুকনো নিশ্বাস নিতেই বুঝলো,তাজ নেশাগ্রস্থ!এতে যেনো বুকের কষ্টটা আরো দ্বিগুন হারে উর্ধ্বগতিতে উঠতে শুরু করছে। রাগে পায়ের তলা চুলকোনি উঠেছে। ইচ্ছে করছে পা’টা কেটে ফেলে দিতে সাথে তাজের মাথাটা। অসভ্য একটা নেশা করে এসে,আমার সাথে প্রেমালাপ করা হচ্ছে?? তোর প্রেমালাপের খেতায় আগুন! তুই এভাবেই পড়ে থাক। তোর মাথার নিচে বালিশ দেওয়ার জন্য তোর নেশায় জেগে উঠা, নেশাবউকে ডেকে নিয়ে আয়। আমি পারবোনা কিছু করতে,পারবোনা!
~~
“” ফুপিমা,তোমার ছেলেমেয়ে কয়টা গো? এ বাড়িতে আসার পর তুমি আর তোমার ভাইয়ের ছেলে ছাড়া আর কাউকে দেখিনি।””
তিহির কথায় শিরিন বেগম মাংসে মশলা দিতে গিয়ে থেমে গেলেন। তিহির মুখের দিকে চেয়ে আছেন। তিহি শাড়ী পড়েছে,বেগুনি কালারের সুতির শাড়ী! শাড়ী সামলিয়ে পোলাওয়ের চালটা ধুতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। চালের বোলটা বারে বারে রেখে আঁচল উঠাচ্ছে। খুব মন দিয়ে কাজের ব্যস্ততায় যে একটা প্রশ্ন করছে সেদিকে তার কোনো নজর নেই। তিহির থেকে চোখ সরিয়ে মাংসে মরিচের গুড়ো দিতে দিতে বললেন,,
“” একটা ছেলে আরেকটা মেয়ে। এই বাসায়ই তো আছে,তুই দেখতে পাচ্ছিসনা?””
তিহি অবাক হয়ে বোলটাতে পানি ছেড়ে তাকিয়ে বললো,,
“” কই? কোনরুমে? তোমাদের বাসায় তো তিনটা রুম,একটাতে তুমি থাকো,একটাই তোমার ভাইয়ের ছেলে,আরেকটা তো লক করা। আরো রুম আছে? আর ওরা কি অলয়েজ রুমেই থাকে বের হয়না?””
শিরিন বেগম মশলাটা কষিয়ে মাংস ঢেলে দিলেন। একটু দম নিয়ে তিহির কাছে এসে ওর হাত থেকে চালের বোলটা নিয়ে বললেন,,
“” এই যে আমার পাশে শাড়ী সামলানো নিয়ে ব্যস্ত যে মেয়েটি,ওই তো আমার মেয়ে আর তোর রুমে যে ঘুমিয়ে আছে,সে হলো আমার ছেলে। নিজেকে নিজে দেখিসনি মানলাম তাই বলে আমার ছেলেটাকেও তোর চোখে পড়েনা??””
তিহি শাড়ীর আচলটা টেনে বললো,,
“” ধুর! আমি তোমার নিজের ছেলেমেয়ের কথা বলছি।””
“” নেই।””
“” নেই মানে?””
“” মা হওয়ার সৌভাগ্য হয়নি আমার! সেজন্য স্বামীর সোহাগটাও অন্য কাউকে দিয়ে দিতে হয়েছে। এটা আমার স্বামীর বাড়ি। তাকে অন্যকারো অধীনে দিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে আমাকে দান করেছেন।””
তিহি এক পলক চেয়ে থেকে পেছন থেকে ঝাপটে ধরে বললো,,
“” সরি,ফুপিমা।””
“” আরে কি করছিস? ছাড় আমাকে। মাংসটা পুড়ে যাচ্ছে।””
তিহি, শিরিন বেগমকে ছেড়ে মাংস নাড়তে গেলে ওকে থামিয়ে বললো,,
“” পুড়ে মরতে চাস?””
“” কেন?””
“” শাড়ী পড়ে তো দুটো মিনিটও স্থির থাকতে পারছিসনা।মনে তো হচ্ছে আগুন লাগিয়ে ছাড়বি। যা চেন্জ করে আয়!””
শিরিন বেগমের কথায় তিহি ঠাই দাড়িয়ে রয়েছে। মাথাটা নিচের দিকে।
“” তাজ বলেছে?””
“” কি?””
“” শাড়ী পড়তে?””
তিহি লজ্জা আড়াল করে বললো,,
“” কই নাতো। এমনি অভ্যাস করছিলাম। আচ্ছা,দাড়াও আমি পাল্টে আসছি।””
তিহি চটপট চলে যেতে চাইলে শিরিন বেগম ডেকে উঠলেন। ওর হাত ধরে হাটা ধরতেই তিহি বলে উঠলো,,
“” কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?””
“” চুপ!””
তিহিকে নিজের রুমে নিয়ে এসে ওকে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। সবুজ কালারের স্টিলের বিশাল বড় এক আলমারীর লকে চাবি ঢুকাচ্ছেন। আলমারীটার দিকে তিহি বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে আছে,আম্মুর,এমন একটা আলমারীর শখ ছিলো। ছোটবেলা থেকেই শুনে এসেছে,পরের মাসের বেতন থেকে কিছু টাকা জমিয়ে কিস্তিতে এমন একটা আলমারী কিনবে। কিন্তু তাদের পরের মাস আসলেও আলমারী কেনার জন্য আর পরের মাস আসেনি!
তিহির হাত টেনে নিতেই তিহি ভাবনা থেকে ফিরে এসেছে। কিছু বুঝার আগেই শিরিন বেগম,চিকন সোনার দুটো চুড়ি পড়িয়ে দিয়ে বললো,,
“” বউ মানুষের হাত খালি হলে কি বউ বউ লাগবে? তোর কানটাও তো খালি!””
শিরিন বেগম নিজের কানের দুলদুটো খুলতে খুলতে বললেন,,
“” শুধু শাড়ী পড়লেই কি বউ সাজা যায়? আরো কত কি লাগে!””
“” তোমারটা আমাকে কেন দিচ্ছো? তোমার কানও তো খালি দেখাবে ফুপিমা!””
“” আমার কান ভরা থাকলেই কি আর খালি থাকলেই কি? স্বামীর সোহাগ তো সেই কবেই আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।””
~~
তিহি রুমে ঢুকে আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে দেখছে আর বিড়বিড় করে বলছে, শুধু সাজলেই কি বউ হওয়া যায় গো,ফুপিমা?? বুকের ভেতরে ভালোবাসাটাও যে লাগে। যেটা তোমার ছেলের জন্য আমার বুকে,আর আমার জন্য তার বুকে বিদ্যমান নয়। তবুও আমি তার বউ সাজবো। আমাকে যে বউ সাজতেই হবে!
জুম্মা নামাজের জন্য আহ্বানের আযানে তিহির ভাবনা রেশ কাটে। পাশ কাটিয়ে চাইতে দেখতে পেলো তাজ তখনো গভীরঘুমে। পাতলা ছোট ছোট ফুলের সাদা চাদরটা কুচকে নিয়ে ঘুমিয়ে আছে। শীত লাগছে নাকি??
তিহি ওয়াশরুমে ঢুকে বালতিটা পানি দিয়ে অর্ধেক ভরে নিয়েছে। মনে মনে কতগুলো সুরা পাঠ করে চোখ বন্ধ করলো। একটু ছোট কন্ঠে বিসমিল্লাহ্ বলে পুরো বালতির পানি ঢেলে দিয়েছে তাজের শরীরে।
তাজ ধাপ করে উঠে বসে হা হয়ে তাকিয়ে আছে তিহির দিকে। শাড়ীর আচলটা কোমড়ে গুজা,চুলগুলো হাতখোপা করে থাকায় কানের দুলগুলো চিকচিক করছে। চোখগুলো বন্ধ করে একটা বালতি নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
তিহি ভেবেছিলো এই বুঝি ঝাঝালো কন্ঠে তাজ চেচিয়ে উঠবে,কিন্তু ঝাঝ তো দুরে থাক,তার কানে অন্য কোনো শব্দও আসছেনা। ধীরে ধীরে চোখ মেলে সামনে তাকিয়ে দেখতে পেলো তাজ তার দিকে চেয়ে আছে। তবে চোখগুলো তার মুখের দিকে না অন্যদিকে! তিহি বালতিটা ফেলে দিয়ে কোমড় থেকে আচলটা খুলে নিয়ে বললো,,,
“” সারারাত কি ছাইপাঁশ খেয়ে আসেন যে দিনভর ঘুমাতে হয়?? জুম্মারদিনেও ঘুমানো হচ্ছে? নামাজে যাবেননা? আপনার জন্য ফুপির কত চিন্তা!””
সবসময়ের মতো তাজ এবারও তিহির কথায় কোনো উত্তর না দেওয়ায় তিহি চটে গিয়ে বললো,,
“” এখনি গোসল সেরে নামাজে যাবেন নাহলে আপনাকে এখানেই গোসল করাবো।””
~~
বড়ভাই হিসেবে ইশাদকে নিয়ে খুব বেশিই চিন্তিত ইরফাদ। যে পরিস্থিতিতে নিজে কাটিয়ে এসেছে সেখানটাই ইশাদকে থাকতে দিতে চায়না। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে একাকিত্ব থাকা মানে জীবনটাকে ধ্বংস করে দেওয়া। যে ধ্বংসের নমুনা সে এই সাতটা বছরে পেয়েছে। সবার থেকে দুরে থেকে নিজের জীবন থেকে সাতটা বছর হারিয়ে ফেলেছে। ইশাদও তার মতো হারিয়ে যাক তা চায়না ইরফাদ। মনে মনে অনেক চিন্তা-ভাবনা করেই মিহির স্কুলের সামনে দাড়িয়ে আছে। মাধ্যমিকের আজকে ওর লাস্ট পরীক্ষা। সব কয়টা পরীক্ষাতে ইশাদ ওকে নিতে আসলেও আজ ইরফাদ এসেছে। এর পেছনে একটা কারনও আছে।
ইশাদ,তিহির ব্যাপারে যতটা উৎসুক হয়ে ইরফাদের সাথে কথা বলতো তার কিছুটা উৎসুক মিহিকে নিয়েও দেখতে পেরেছে। আর সেই উৎসুকের পেছনে কি আছে,আদৌ কিছু আছে নাকি ইরফাদ জানেনা। কিন্তু সে চায় কিছু থাকুক বা না থাকুক, এবার যেন কিছু গড়ে উঠে। তার জন্য মিহির মতামতটা জানা খুব বেশি প্রয়োজন।
মিহি পরীক্ষা শেষে ইশাদকে খুজতে গিয়ে দেখে ইরফাদ দাড়িয়ে আছে,সাথে ইনাও আছে। সবসময়ের মতো ইশাদকে দেখতে না পেয়ে মনটা একটু খারাপ হলেও পরক্ষণেই ইরফাদকে দেখতে পেয়ে একটু ভালো লাগার বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
“” সুন্দর ভাইয়া আসেনি?””
“” উহু! আমি আসলে হবেনা? তাকেই লাগবে?””
ইরফাদের এমন প্রশ্নে মিহি ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। ওকে চুপ করে থাকতে দেখে ইরফাদ হেঁসে উঠে বললো,,
“” গাড়ীতে বসো। ইশাদ একটু কাজে আটকে গেছে তাই আমি তোমাকে নিতে আসলাম।””
“” হুম!””
ইনা মিহির হাত ধরে টেনে দুজনেই গাড়ীতে উঠে বসেছে। ইরফাদ সামনে ড্রাইভিং সিটে আর ইনা,মিহি পেছন সিটে। পেছনে যথেষ্ট জায়গা থাকা সত্তেও ইনা ওর কোলের উপরেই বসে আছে। মুখে তার লেগে আছে মিস্টি হাসি।
মিহিকে অমন চুপচাপ দেখতে পেয়ে ইরফাদ নিজে থেকেই বললো,,
“” আমার সাথে যেতে ভয় লাগছে?””
“” না।””
“” তাহলে এমন তব্ধা লেগে আছো কেন? ইশাদের কাছে তো শুনছি তুমি অনেক পকরপকর করো।””
“” পকরপকর!”
মিহির কথায় ইরফাদ শব্দ করে আবারও হেঁসে উঠে। সামনে তাকিয়ে হাসছে দেখে মিহির বেশ খারাপ লাগছে। একটু এদিকে ঘুরে হাসি দিলে কি হয়? আমার তো উনার হাঁসি দেখতে ইচ্ছে করছে।
মাঝ রাস্তায় গাড়ী থামিয়ে একটা রেষ্টুরেন্টের ঢুকেছে ইরফাদ। কথা বলার জন্য কিছুটা নিরব স্পেস থাকা প্রয়োজন। তার উপর মিহিরও নিশ্চয় অনেক ক্ষুধা লেগে আছে৷ দুপুরে ভাত খাওয়াটাই বেটার মনে হলেও এখানে ভাত না থাকায়,বিরিয়ানি অর্ডার করা হয়েছে।
মিহি সবেই একদলা মুখে পুরেছে তখনি ইরফাদ বললো,,
“” তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে?””
সাথে সাথে ছোটখাটো ভিষম উঠে গেলো মিহির। ইরফাদ পানি এগিয়ে দিলো।
একটু পানি খেয়ে গ্লাসটা নিচে রাখতে ইরফাদ আবার বললো,,
“” বললেনা বয়ফ্রেন্ড আছে নাকি?””
মিহি আড়চোখে ইরফাদের দিকে তাকিয়ে বললো,,
“” না।””
ইনা এতক্ষন চুপচাপ বাবার কাছে খেয়ে যাচ্ছিলো। এখন আর চুপ করে থাকতে পারেনি,
“” আমার তো অনেকগুলো বয়ফ্রেন্ড আছে,বড়বাবাই। আপুর কেন নাই?””
“” তুমি যে অনেক কিউট তাই!””
ইনার মুখ মুছে নিয়ে মিহির উদ্দশ্যে আবার বললো,,
“” ধরো,হুট করে তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেলো তাহলে কি করবে?””
ইরফাদের দ্বিতীয় প্রশ্নে মিহির কাশির সাথে যথারীতি হেচকিও উঠে গিয়েছে। ইরফাদ হঠাৎ এমন আজগুবি প্রশ্ন কেন করছে?? উনার মনে কি চলছে? আর কিইবা বুঝাতে চাচ্ছে??
মিহি কাশি আর হেচকি একসাথে সামলাতে গিয়ে বমি করে দিয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখে ইরফাদের আর কিছু বলা হলোনা। ইশাদের কথা তুলাও হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব ওকে বাড়ি পৌছে দিয়ে এসেছে।
~~
“” তোদের বিয়ের তিনমাস পার করে সবে চারমাসে পা দিয়েছিস,এর মধ্যে ডিভোর্স কেন?””
“” তুই কি পেপারটা রেডি করেছিস? দিলে দে নাহলে আমি অন্য লয়ার দেখবো!””
তাজের ঠান্ডা ধমকানিতে আরো বেশি হতাশ হলো এ্যাডভোকেট মিরাজ। লয়ার হিসেবে বাদ দিয়ে ফ্রেন্ড হিসেবেও এতো করে বুঝিয়েও কোনো লাভ হয়নি। সবশেষে ডিভোর্স পেপারটা তাজের দিকে বাড়িয়ে ধরেছে। তাজ ছো মেরে পেপারটা নিয়ে বেড়িয়ে যেতে নিলে মিরাজ বলে উঠলো,,
“” বিবাহের এতো অল্প সময়ে ডিভোর্স হয়না,আাইনগত হোক আর ইসলামগত হোক, এটা কিন্তু অবৈধ হচ্ছে তাজ।””
“” আমার আইনে হলেই হবে। একটা অবৈধ সম্পর্কে দ্বারা যে আগুন ধপ করে জ্বলে উঠেছিলো আজ নাহয় সেই অবৈধভাবেই আগুন নিভিয়ে ফেলবো।””
“” আর যদি তিহি প্রেগন্যান্ট হয়?? নিয়মানুসারে নোটিশ পাঠানোর পরও তিনমাস অপেক্ষা করতে হয়,এইটা দেখার জন্য যে,সে প্রেগন্যান্ট কিনা। তুইতো কোনো নোটিশও পাঠাসনি!””
তাজ ম্লান হেঁসে মিরাজের দিকে ঘুরে দাড়িয়ে বললো,,
“” ইমপসিবল,লাস্ট আড়াইমাস ধরে ওকে আমি ছুইনি পর্যন্ত তার মধ্যে আজ পনেরোদিন পর বাসায় যাচ্ছি!””
“” তার আাগে ছুসনি? একবার কি ভেবেছিস,এরপরে মেয়েটার কি হবে?””
মিরাজের কথায় তাজ ঈষৎ হেঁসে বললো,,
“” তলর কি মনে হয়,যে ছেলেটা উইথআউট এনি কন্টাক্টে তিহির জীবন ঘড়ির কাটা ঘুরিয়ে যাচ্ছে-সে ছেলেটা এমনি এমনি তিহিকে রাস্তায় ফেলে রাখবে?””
“” হার স্বীকার করছিস?””
মিরাজের কথায় তাজের মুখের ম্লান হাসিটুকুও উবে গিয়েছে। কথা না বাড়িয়ে বের হয়ে আসে।
হ্যা ছুয়েছি খুব খারাপভাবে ছুয়েছি। যার নাম দিয়েছে হিঁস্র আচর! আমার ছোয়া মাতালের ছোয়া,নেশাগ্রস্থ ছোয়া। তিহি আমার কাছে স্বামীর ছোয়া চেয়েছিলো,কিন্তু ও কি বউ হয়ে সে ছোয়া নিতে পারবে? না পারবেনা। কি করে পারবে? ওর বুকভরা ভালোবাসা অন্যকারোর জন্য,তবুও কেন ছলনাময়ী হয়ে আমার সামনে আসে? মিথ্যে বউ সেজে আমার সামনে কেন আসে? ওর ভালোবাসার মানুষটির প্রতি ভালোবাসা দেখে আমার প্রতিহিংসা পুরে ছারখার হয়ে গেছে। ওকে দেখলে যে আমার ভয় হয়,বারবার মনে হয় আমি আবার কোনো ছলনাময়ীর ফাঁদে পা দিয়ে ফেলছি। এক অপরাধ দুবার করার মতো বোকা আমি নয় তিহি। তোমাকে আমি মুক্ত করে দিবো। তোমার মুক্ত আকাশে উড়ার ডানাটা নাহয় আমিই তৈরী করে দিবো! তোমাকে আর মিথ্যে বউ সেজে আমার মন জয় করতে হবেনা,সংসার সংসার খেলতে হবেনা। আমার প্রতিহিংসা আগুনে আমি তোমাকে পুড়তে দিবোনা। তোমার চোখের পানির কাছে আমি হেরে গেছি। তোমাদের ভালোবাসার অটুট বন্ধনে আমি হেরে গেছি। অন্যের ভালোবাসা দিয়ে ফুটানো ফুলের গন্ধ আমি নিতে পারবোনা। এই ফুলের সুবাস শুধু তারই পাওনা।
~~
“” তাজ বোধহয় আজও আসবেনারে মা,চল আমার সাথে ঘুমাবি।””
শিরিন বেগমের কন্ঠে তিহি একটু নড়ে উঠলেও ঘুরে দাড়ায়নি। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েই বললো,,
“” তোমার ছেলেটা কি চায়,ফুপিমা? এভাবে মাঝখানে এনে আটকে রেখেছে কেন? হয় নিজে জ্বালিয়ে শেষ করে দিক,নাহয় আমি নিজেই জ্বলে শেষ হয়ে যায়। আমার জীবনটা কি এভাবেই থমকে থাকবে? কোন অপরাধে আমাকে এতো কঠিন শাস্তি দিচ্ছে?””
শিরিন বেগম নিশ্চুপ থেকে তিহির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,,,
“” আমার তাজটা এমন না রে মা,ও তো ছোটবেলা থেকেই,শান্তশিষ্ট, নম্র-ভদ্র আর পড়ালেখা নিয়ে বিজি ছিলো। হঠাৎ কি এমন ধমকা ঝড় বইলো কে জানে? তারপর থেকে তাজকে আমি বুঝতে পারিনা। জানিস তো,ও ছেটবেলা থেকেই ওর আব্বু-আম্মুর সাথে থাকলেও বছরে দুবার আমার কাছে আসতো। আমাকে নিয়ে এখানে ঘুরবে,ওখানে ঘুরবে,এটা বানাবে,ওটা বানাবে,,,নানা হৈ-হুল্লোড় করতো। কিন্তু হঠাৎ করেই ও আমার কাছে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো। পুরো দুবছর পর হুট করে এসে হাজির! তারপর থেকে কি যে হলো যত বাজে নেশা আছে সবকিছুতে আসক্ত হয়ে পড়লো। আমার কাছে থেকেও বাসায় আসেনা। ফোন করলে পাইনা। একমাস-দুৃমাস বাদে আসে আবার হুট করে নাই।আমি কতভাবে ওকে এই নেশা থেকে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছি কিন্তু পারিনি। ওর শুধু এক কথা ওর হৃদপিন্ড না পেলে ও এসব ছাড়বেনা। কে এই হৃপিন্ড? জানার অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু ও কিছুতেই বলেনি,শুধু বলতো যেদিন নিয়ে আসবো সেদিন দেখবে!
তার বেশ কয়েকবছর পর তোকে নিয়ে হাজির। আমি তো ভেবেছিলাম তাহলে তুই ই ওর সেই হৃপিন্ড। কিন্তু তুই আমাকে বুঝিয়ে দিলি আমার ধারনা ভুল!
ভেবেছিলাম বিয়ে করে যখন বউ এনেছে তাও নিজের পছন্দের তাহলে মনে হয় এবার সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার এই ভাবনাটাকেও ভুল করে দিয়েছে তাজ। ও তো দিনে দিনে আরো বেশি হিংস্র হয়ে যাচ্ছে। তোর মতো এমন মিস্টি মেয়েকে রেখে ও কিভাবে বাইরে থাকতে…..””
শিরিন বেগমের কথার মাঝখানেই তিহি মাথা ঘুরে পড়ে যায়। যদিও উনি ধরেছিলেন,কিন্তু শক্তিতে কুলোতে না পারায় মেঝেতে শুয়িয়ে দিয়েছেন। টেনশনে কি করবে বুঝতে না পেরে তাজকে কল দিয়ে বসে।
অন্যসময় তাজ কল রিসিভ না করলেও আজ প্রথম রিংয়েই রিসিভ করেছে। নিজে হ্যালো বলার সময়টুকুও পায়নি তার আগেই ওপাশ থেকে শিরিন বেগম বললেন,,,
“” তিহি জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়েছে। ভয়ে আমার প্রেসার লো হয়ে গেছে। আমি নড়তে পারছিনা তাজ। তুই কিছু কর! তাড়াতাড়ি বাসায় আয়!””
চলবে