#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (১)
#রোকসানা_রাহমান
গোসলখানায় ঢুকে স্তব্ধ ইশাদ। সমুখে এক অপরিচিত নারী। সে গোসল করছে! পুরো গোসলখানা সুগন্ধী সাবানের তীব্র সুবাসে পরিপূর্ণ। সাবানের জায়গায় শ্যাম্পুও হতে পারে। কিংবা দুটোর মিশ্র সুবাস! কেননা মেয়েটার শুধু শরীর নয় মাথার চুলগুলোও ঘন সাদা বুদবুদের পুঞ্জে লুকায়িত।
ব্যক্তিগত গোসলখানায় এমন অভাবনীয় ঘটনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইশাদ। চোখের প্রখরদৃষ্টি মেয়েটির উপর। পলকহীন চাহনি। মেয়েটির মুখ দর্শন হয়নি এখনো। সে উল্টো ঘুরে আছে। সম্ভবত মুখে কিছু মাখছে। ইশাদ নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে বসলো,মুখ না দেখে বুঝলো কিভাবে এই মেয়েটি অপরিচিত? অনুমানশক্তির সাহায্যে? দাম্ভিকতায় ইশাদের ঠোঁটের কোণদ্বয় কিঞ্চিত প্রসারিত হল। সঙ্গে সঙ্গে কপালে চিন্তার ভাজ। চিবুকে গম্ভীরভাব ফুটে উঠেছে। মেয়েটিকে কড়া ধমক দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। ঠিক তখনই মেয়েটির হাত পড়েছে শাওয়ারের বাঁটে। ছাড়বে ছাড়বে ভাব থাকলেও ছাড়ল না। কিছু টের পেয়েছে বোধ হয়। সহসা ঘুরে দাঁড়ায়। দু’হাত দূরে একটি পুরুষ দাঁড়িয়ে। চেয়ে আছে তার দিকেই! মুহুর্তেই মেয়েটির চোখ দুটো অস্বাভাবিক পরিমাণে বড় হয়ে গেল। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে চিৎকার দেওয়া উচিত। কিন্তু না মেয়েটি চিৎকার তো দূর সামান্য ‘আহ’ শব্দটিও করল না। উপরন্তু তার চোখদুটো শীতল,শান্ত,অনুদ্ধত ও ধীর হয়ে আসছে।
অপ্রত্যাশিত ঘটনায় মেয়েটির অস্বাভাবিক আচরণে ইশাদের চোখ দুটোও নরম হয়ে আসলো। তবে কি সম্পূর্ণটাই ভ্রম? মনের কল্পণা? অথবা মিথ্যাজ্ঞান? নিজের ভাবনাকে পরখ করে দেখতে ইশাদের পা দুটো সচল হয়ে উঠল। ধীর কদমে মেয়েটির সামনে এসে দাঁড়ায়। তার চোখদুটো এখনো পূর্বের ন্যায় নিবৃত্ত। মণিদুটো এক স্থির ইশাদের আঁখিদ্বয়ে। একে অপরের মুখোমুখি! দূরত্ব নামমাত্র। চাইলেই একে অপরকে ছুঁয়ে দিতে পারে। ছুঁবে কি?
মেয়েটির এমন মূর্তি আচরণে ইশাদের ভ্রূজোড়া কুঁচকে গেলো। বিরক্তি ভাঁজ ঘন হয়ে আসছে। তখনি মনে পড়ে বন্ধু ইমদাদের কথা। কানে বাজে সগর্ব ও ব্যাঙ্গাত্মক কয়েকটি লাইন, ‘দোস্ত তুমিও খাইবা। তোমার ঠোঁটও লাফাইব নারীর ঠোঁটের লাইগা। করো না নিন্দা,ঘাড়ে পড়ব গাঁইথা! সেদিন আমিও তোমার মাথায় চড়ে বসব। নৃত্য করব। যাবে বলে তান্ডব নৃত্য। হা হা হা।’
বন্ধু ইমদাদের মনের বাসনা পূরণ করলে কেমন হয়? বাস্তবে তো সম্ভব নয়। তাহলে কল্পণায় হয়ে যাক? ইশাদের ঠোঁটে দুষ্টু হাসি। সময় ব্যয় বাদ দিয়ে আচমকা চুমু খেল মেয়েটির ঠোঁটে। সশব্দে দীর্ঘ চুমু! অনেকটা এমন-উম্ম্মাহ!
এমন শ্রীহীন কান্ড ঘটার পরও মেয়েটি থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। ইশাদ এবার ধরেই নিল এটা তার ভ্রম। বন্ধুর ঢুকিয়ে দেওয়া প্রতিনিয়তের অত্যাচার থেকে এই কল্পণা চোখের সামনে ভাসছে। সে মেয়েটির গাল টেনে দিল। নাক টিপে দিল। অতঃপর খোশমেজাজে গোসলখানা ছাড়ল। কী মনে করে বাইরে থেকে সিটকিনিটাও লাগিয়ে দিল। এমন কল্পনা আর নয়৷ প্রথম কল্পনায় শুধু মেয়ে থাকলেও দ্বিতীয় কল্পনায় সাথে অন্য কেউ থাকবে। সে হলো ইমদাদ। ইশাদের বাল্য বন্ধু। নৃত্য করতে মাথায় চড়বে। তান্ডব নৃত্য!
ইশাদ চাপা হাসি নিয়ে নিজের রুম ছাড়ল। পকেটে ডান হাত ঢুকিয়েছে। ফোন বের করবে। কাউকে কল দেওয়া উচিত। কিছু কথা বা ঘটনা মনে চেপে রাখতে নেই। এতে আনন্দে ঘাটতি পড়ে। সে তার আনন্দ ঘাটতি রাখতে চায় না। কিন্তু কাকে কল দেওয়া যায়? ভাবনায় ভাবনায় ইশাদ সিঁড়ির মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। তার রুমটি দোতলায়। সিড়ির ডান পাশে। নিচ তলায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে সিড়ির এক ধাপ ভাঙতেই থমকে গেল। কারো পায়ের শব্দ। কেউ হনহন করে ছুটে আসছে। ইশাদ বামে তাকাল। ছাদে উঠার সিড়িটি বেয়ে আসছেন একজন মহিলা। বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি হবে। তিনি কাঁদছেন। হাউমাউ করে কাঁদছেন। পড়নে সুতি শাড়ী। তার আঁচল মুখে চাঁপা দেওয়া। চোখে,মুখে দিশেহারা ভাব। যেন পদ্মার স্রোতে সর্বস্ব হারিয়ে উনি সর্বহারা। কিন্তু ইনি কে? অতিথী? হতেও পারে। আজ এ বাসায় ‘আংটি বদল’ নামের এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। যাকে ইংলিশে বলে ‘Engagement’। অনুষ্ঠানটি এই বাড়ির একমাত্র ছেলেকে কেন্দ্র করেই অনুষ্ঠিত হবে। তার নাম ডঃ ইশাদ শাইখ। যে মেয়ের সাথে আংটি বদল হবে তার নাম মিহিম্মা মিহি। অনুষ্ঠানটির দিনক্ষণ ঠিক করা হয়েছে রাতে। ঠিক রাত আটটায়। সম্পূর্ণ ঘরোয়া আয়োজন। ইশাদ যতদূর জানে,ঘরোয়া আয়োজন ঘরের সদস্যদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে বিশেষ খাতির ও প্রয়োজনে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদেরও দেখা যায়। এখানেও যাবে। কিন্তু এই মহিলাকে তার আত্মীয়তো দূর কস্মিককালেও দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। তাহলে উনি এখানে কী করছেন? উপর থেকেই নামলেন কেন?
“এই ছেলে,তুমি আমার মেয়েকে দেখেছ? আমার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে। কীভাবে খুঁজি বলো তো! পুলিশের কাছে যাব? কেস করব কি? নাকি বিজ্ঞপ্তি দিব? তোমার কাছে নাম্বার হবে? বিজ্ঞপ্তিপত্রে কী লিখব বলো তো?”
মহিলাটির কন্ঠে আতঙ্ক। পুরো শরীরজুড়ে অস্থিরতা! দরুন এক জায়গায় স্থির হয়ে দাড়াতে পারছেন না। ইশাদের অনুমান বলছে এই মহিলার মেয়ের বয়স কম করে হলেও আঠার কী উনিশ হবে। যার মানে সে তরুণী। আর একজন তরুণী কখনোই হারিয়ে যেতে পারে না। যদি না কেউ কিডন্যাপ করে। কিন্তু মহিলার বাক্য ব্যয়ে একবারও কিডন্যাপ বা অপহরণ শব্দটি আসেনি। তার মানে দাড়ায় মেয়েটি সত্যিই হারিয়ে গিয়েছে। তাহলে কি মেয়েটির বয়স পাঁচ কি ছয়? হিসেব নিকেশ যুৎসই হচ্ছে না দেখে ইশাদ অনুমান বাদ দিল। জিজ্ঞেস করল,
“কখন হারিয়েছে? কোথা থেকে হারাল?”
মহিলাটির দ্রুত উত্তর,
“এ বাসা থেকে। কিছুক্ষণ আগে।”
” এ বাসা থেকে?”
মহিলাটি মাথা নাড়ল। আঁচলের কোণ দিয়ে ঘন ঘন চোখ মুচছেন। ইশাদ আর কথা বাড়াল না। নিচের দিকে তাকাল। বসার রুমের এককোণে কয়েকটি বাচ্চা দেখা যাচ্ছে। সকলে মিলে কিছু একটা খেলছে হয়তো। সকলে হাত ধরে গোল করে বসে আছে। ছড়া কাঁটছে। ইশাদ সেদিকে আঙুল তুলে বললো,
“দেখুনতো ঐ বেগুনি জামা পড়া বাচ্চাটা আপনার মেয়ে নাকি।”
মহিলাটি সেদিকে তাকিয়েই ক্ষেপে গেলেন। মেঘের গর্জন তুলে বললেন,
“এই ছেলে,আমার সাথে মশকরা করছ? আমাকে দেখে কি পাগল মনে হয়? আমি পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে এসেছি? ইচ্ছে করছে চড়িয়ে দাঁত ফেলে দেই। বেয়াদব!”
ইশাদ তাজ্জব বনে গেল। বিস্ময় তার সাত আসমানে। উপকার করতে গিয়ে এমন দুরছাই? চোয়াল শক্ত হয়ে আসতেই চিকনসুর ভেসে এলো,
“কী হয়েছে,ইশাদ ভাইয়া?”
ইশাদ সামনে তাকাল। এক সিড়ি নিচে নেমে বলল,
“এই মহিলা কে? এখানে কী করছেন? উপকার করতে গিয়ে অপমানিত হলাম। মিহি,তুমি উনাকে চিন?”
মিহি একগাল হেসে বলল,
“উনি তো রেখা আন্টি। আপনাদের নতুন ভাড়াটে। আজ বিকেলেই উঠলেন।”
ইশাদ চোখ কপালে তুলে বলল,
“ভাড়াটে? কোত্থেকে এলো? আমার জানামতে,আমার বাবা তো ভাড়া দেওয়ার মতো অতিরিক্ত রুম বানায়নি!”
“আমি কী করে বলব? আপনার মা’ই তো বললেন,উনাকে চিলেকোঠার রুমটা দেখিয়ে দিতে।”
“মা?”
মিহি আর উত্তর দেওয়া সময় পেল না৷ তার পূর্বেই ভাড়াটে রেখা ভূঁইয়া মিহির উপর হামলে পড়লেন। গড়গড় করে কী সব বলে চলেছেন। সেদিকে ইশাদের ভ্রূক্ষেপ নেই। তবে সরেও গেল না। ওখানেই দাড়িয়ে আছে। কিছু সময় শেষেই মিহির কথাগুলো কানে বাজল। স্পষ্ট সুরে,
“তিহি আপু? উনিতো কিছুক্ষণ আগেই আমার কাছে আসলেন। বললেন গোসল করবেন। শরীরে নাকি ধুলোর গন্ধ! আমি তখন রান্নাঘরে ছিলাম। উনাকে বললাম আমার রুমে গিয়ে গোসল করে আসতে। আমার রুমে এ্যাটাচড বাথরুম আছেতো তাই!”
তারপর আর কোনো কথা নেই। রেখা ভূঁইয়ার সশব্দের নিশ্বাস ছাড়ার শব্দ এল। তারপরই দুজন হন্তদন্ত হয়ে নিচে নেমে গেলেন। ইশাদও নামার জন্য পা বাড়াতে গেল। তবে মধ্যিখানেই আটকে আছে। হঠাৎ বুকের ভেতরটায় অস্থিরতার ঝড় শুরু হলো। উষ্ণ ধোয়া বের হচ্ছে লোমকূপ থেকে। মন বলছে, মিহি যে মেয়েটাকে তিহি আপু বলে সম্বোধন করেছে সে মিহির রুমে নয় তার রুমে আছে। গোসলখানায় বন্দী! না চাইতেও ইশাদ উল্টো সিড়ি বায়ছে। হাওয়া বেগে পৌঁছুল নিজের রুমে। চঞ্চল পা দুটো সোজা আটকেছে গোসলখানার দরজার সামনে। যার দরজা এখনো বাইরে থেকে আটকানো। ইশাদ নিশ্বাস আটকে দাড়িয়ে আছে। সম্পূর্ণ মনোযোগ কানে। ভেতর থেকে কোনো শব্দ বা আওয়াজ আসছে না। সাধারণতঃ কেউ ভুল করে বা কারো দ্বারা বন্দী হয়ে গেলে সে চিৎকার করে। বাঁচাও বাঁচাও বলে মরিয়া চিৎকার! সাথে লাগাতার কড়াঘাত পড়ে দরজায়। কিন্তু এখানেতো কিছু হচ্ছে না। তাহলে কী সেই ঠিক ছিল? আসলেই সম্পূর্ণ তার মনের কল্পনা? হঠাৎ কল্পনায় পাওয়া মেয়েকেই চুমু খেয়েছে? আর যদি তা না হয়?
ইশাদ আর ভাবতে পারছে না। চপলতায় ভুগছে তার মন। হাত ঘড়ির দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলে কেমন হয়? সেকেন্ডের কাঁটা এক ঘর সরতেই দরজা খুলে ফেলল ইশাদ। সরাসরি ভেতরে তাকানোর সাহস পেল না। মনে মনে প্রার্থনা ছুড়ে দিল সৃষ্টিকর্তার প্রতি। তারপর পিটপিট করে চোখ মেলতেই আঁতকে উঠলো!
মেয়েটির নরম শরীর পড়ে আছে ভেজা মেঝেতে। ঝরণার পানি ঝড়ে পড়ছে তার এঁকেবেঁকে পড়ে থাকা শরীরের একাংশে! ইশাদ বুদ্ধীশূন্য হয়ে পড়ল। কী করবে বুঝে উঠার আগেই পায়ের শব্দ। কানে বাজছে মিশ্র নারী শব্দ। শুধু রেখা আন্টি আর মিহি নয়। সাথে ইশাদের মা শাহিনা শাইখাও আছেন। সকলে এদিকেই আসছেন। ইশাদ থম মেরে কয়েক সেকেন্ড খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে রইল। হঠাৎ কী মনে হলো ছুটে যায় দরজার দিকে। চট করে আটকে দিল ভেতর থেকে। লম্বা নিশ্বাস টেনে গোসলখানার দিকে এক পা বাড়াতেই দরজায় বাড়ি পড়ল। পরপর দুটো বাড়ি পড়তে ইশাদ মিছেরাগ নিয়ে বলল,
“কী হয়েছে আম্মু? ঘুমুচ্ছি। বিরক্ত করো নাতো।”
ইশাদের মা শঙ্কিত কন্ঠে বললেন,
“সেকি রে। তুই কখন এলি? এসেই রুমে তালা দিয়ে আছিস? মায়ের সাথে দেখাটাও করলি না? এই ভর সন্ধ্যাবেলায় কিসের ঘুম? শরীর ঠিক আছে তো বাপ?”
ইশাদের কিছু বলার প্রয়োজন হলো না। তন্মধ্যেই খেঁকিয়ে উঠলেন রেখা ভূঁইয়া,
“আপনাদের বাসা থেকে আমার মেয়ে হারিয়ে গিয়েছে আর আপনি ছেলেকে নিয়ে পড়ে আছেন? আমার মেয়ের থেকে আপনার ছেলের ঘুম বড় হয়ে গেলো? এই নিয়ে বাড়ীওয়ালা সেজেছেন? এমন বাড়ীওয়ালার কাপড়ে থুতু ছেটায়। আমার মেয়েকে বের করে দিন। আমি আজই বাড়ি ছাড়ব।”
শাহিনা বেগম আশ্চর্য হয়ে বললেন,
“আপনার মেয়ে,মেয়ে। আমার ছেলে,ছেলে নয়?”
“না। আপনার ছেলে,মেয়ে।”
“কী! আমার ছেলেকে মেয়ে বলা? তাহলে আপনার মেয়েও মেয়ে নয়,ছেলে। দাড়ি মোচ ছাড়া ছেলে!”
দুজনের অহেতুক তর্কে মিহির নিরব উপস্থিতি। বয়োজ্যেষ্ঠ দুজন মহিলার মাঝে সে কী বলবে? শেষে না দুজনের রাগ তার উপর এসে পড়ে। তবুও মিহি ভয়ে ভয়ে বলল,
“তিহি আপু মনে হয় বাগানে গিয়েছে। চলুন সেখানে দেখে আসি।”
একাধিক পা গুলো ভিন্ন পথে চলে যাওয়ার শব্দে ইশাদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। দ্রুত চলে গেল জ্ঞান হারা মেয়েটির কাছে। নিথর শরীরটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করল,বেঁচে আছে তো?
মেয়েটির মুখে জল ছেটানো হল। তবে জ্ঞান ফিরল না। ফেরার কোনো লক্ষণও দেখছে না। ইশাদ রুম ছেড়ে গিয়েছিল বড়জোর পাঁচ মিনিট হবে। এতো অল্প সময়ে মেয়েটা জ্ঞান হারাল কী করে তাও বুঝতে পারছে না। এভাবে আর কতক্ষণ? ঠান্ডায় শেষে অন্যকিছু না বাধিয়ে বসে। উপায়ন্তর না পেয়ে কোলে তুলে নিল ইশাদ। নিজ বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে উপরে চাদর টেনে দিল। অনিচ্ছাতে চোখ আটকাল ঠোঁটজোড়ায়। নরম ঠোঁটজোড়া শুষ্ক,কালো রঙ ধারণ করেছে। মুখ রক্তশূন্য। ইশাদ চোখ ফিরিয়ে নেয়। শুরু করে ডাক্তারি পরীক্ষা। মেয়েটির ডান হাতের কব্জী চেপে ধরে পালস বিট পরখ করছে। মিনিট শেষে হাত ছাড়তে গিয়ে আবার শক্ত করে চেপে ধরে। অজান্তেই কন্ঠ ছেড়ে বেরিয়ে আসে,এগুলো কিসের দাগ?
ইশাদ তাৎক্ষনিক মেয়েটার বাম হাত চাদরের নিচ থেকে বের করে। দু’হাত এক করে ধারালো দৃষ্টি রাখে কব্জী পাশে। কব্জীর কাছ ঘেষে কালো,গাঢ় দুই সেন্টিমিটার পুরু দাগ। যা গোল হয়ে হাতের এপিঠওপিঠ ঘুরে এসেছে। ইশাদের স্বল্প ডাক্তারী পেশার অভিজ্ঞ চোখ দুটো বলছে এই নরম দুটো হাত ভারী শিকলে বন্দী ছিল। দীর্ঘ সময়। কম করে হলেও এক বছর!
ইশাদ কখনো সিগারেট খায়নি। ছুঁয়েও দেখেনি। তবে আজ ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে। খেতেও ইচ্ছে করছে। তার হঠাৎ উপলব্ধি হল সে সিগারেট খোর। ভয়ঙ্কর সিগারেট নেশায় ভুগছে। এই মুহুর্তে একটা সিগারেট না হলে সে মরে যাবে। ধোয়ার তৃষ্ণায় মরবে! ইশাদ তড়িঘড়িতে ফোন লাগায় ইমদাদকে।
“কোথায় তুই?”
“চেম্বারে। কেন?”
“বাসায় আয়। এখনি।”
ইমদাদ খানিকটা চিন্তিত গলায় বললো,
“পাগলের ডাক্তার আমি আর ভুলভাল আচরণ করিস তুই। ব্যাপার কী বলতো। সকালে ফোন দিয়ে বললি আজ থেকে তোর বাসায় যাওয়া বন্ধ আর এখন ফোন দিয়ে বলছিস বাসায় যেতে। সমস্যা কী? মাথায় ব্যামো হয়ছে,মামা? কত সাইজের ইনজেকশন আনব?”
“তোর সাইজের লোহার ইট নিয়ে আসিস। তোর মাথায় ভাঙব।”
“পাগলের চিকিৎসক আমি নাকি তুই? ইট তো আমার ভাঙার কথা,তোর মাথায়।”
“আগেতো আয় তারপর দেখি কে কার মাথায় ভাঙে।”
ইমদাদ হো হো হো হাসি ঢেলে ফোন রাখবে তারমধ্যেই ইশাদ জলদিতে বলল,
“এক প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসিস তো।”
“সিগারেট? কী করবি?”
“দরকার আছে।”
~~
আধা ঘন্টা হতে চলল অথচ মেয়েটির এখনো জ্ঞান ফেরেনি। ইশাদের মুখে অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে। এভাবে আর কতক্ষণ দুয়ার টেনে বসে থাকবে? ঘড়ির কাঁটা দৌড়াচ্ছে ঘোড়ার গতিতে। একটু পরেই আটটায় পৌঁছে টিক টিক টিক শুরু করে দিবে। আর মা? সে তো পারলে দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকবে। তখন কী হবে? এ কোন ঝামেলায় ফেসে গেল ইশাদ? নিজের গালে নিজেই চড়াতে ইচ্ছে করছে। একে রেখে যে বের হয়ে যাবে সে সাহসও নেই। জ্ঞান ফেরার পর কী কান্ড বাধাবে কে জানে? আগে থেকেই তো সব সামাল দিতে হবে! আজ সকাল থেকেই তার মন্দভাগ্য শুরু হয়েছে। ভাল ভাগ্য কখন দেখা দেবে? ইশাদ মেয়েটির সামনে গিয়ে দাড়াল। প্রাণহীন মুখটাতে তাকাতেই বুকের ভেতর উথালপাতাল শুরু হয়ে গিয়েছে। নিশ্বাস আটকে অসহায় গলায় বললো, আমার সাথেই কেন! আমার গোসলখানায় কেন!
ইশাদের মুখ পাংশুটে। বেড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে নিল। পানি খাওয়ার জন্য ঠোঁটে তুলতেই ঝরঝরা নারী কন্ঠ,
“আপনি চুমু খেয়েছেন। হ্যাঁ আপনিইতো আমাকে চুমু খেলেন।এখানে,এইতো এখানে,আমার ঠোঁটে। আপনার বড় বড় চোখ দুটো দিয়ে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলেন। তারপর টুপ করে চুমু খেয়ে নিলেন! এখন কথা হচ্ছে চুমুটা কি স্বপ্নে খেলেন নাকি বাস্তবে? I am so confuse!”
চলবে
[সিজন এক অসম্পূর্ণ বা সম্পূর্ণ হলেও সেখানে তিহির একটি ব্যক্তিত্ব ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল। সেটা নষ্ট করতে মন সায় দিল না। তাই ভিন্নভাবে ইশাদ তিহিকে নিয়ে হাজির হয়েছি। গল্পটিও ভিন্ন তবে ছোট ছোট চমক পাবেন। যেগুলো শুধু তারাই উপভোগ করতে পারবেন যারা সিজন ১ মন দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন? প্রথম পর্ব থেকেই চমক শুরু হয়ে গিয়েছে। কেউ ধরতে পারলে অবশ্যই জানিও❤️]