#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,পর্ব (৩)
#রোকসানা_রাহমান
“তোর মায়ের হাত তো দেখি আলাদীনের চেরাগ থেকেও শক্তিশালী! সকালে এক মেয়েকে বাসায় তুলতে না তুলতেই তার সাথে তোর বিয়ে ঠিক। একটু পরেই আংটি বদল হবে। আর বিকেলে আরেক মেয়েকে তুলতে না তুলতেই সোজা বাসর! যদিও সম্পূর্ণ হয়নি,হবে। দেখি তোর মাথাটা নামাতো,খুঁজি তোর চান্দীতে কয়টা তাঁরা!”
ইমদাদ কথা শেষ করতেই প্রচন্ড আঘাত খেল। নাকটা বুঝি ভেঙেই গেল! রক্ত পড়ছে কি? বারান্দায় লোহার জালের সাথে বাড়ি খেয়েছে মাথার পেছনটা। ঘটনার আকস্মিকতায় ভয়ার্ত ও আহত চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসে। সময় শেষে নাকে হাত রেখে ব্যথাতুর গলায় বলল,
“এখন কী করলাম?”
ইশাদের চোখ তখনো রক্তরাঙা। কন্ঠে ক্রোধ ঢেলে বলল,
“একসাথে চার চারটা মানুষকে অপমান করে এখন বলছিস কী করলাম? মানুষ হবি কবে?”
ইমদাদ বিস্ময়ে নাক থেকে হাত সরিয়ে ফেলে। সাবধানে দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে বলল,
“তোর যা আছে আমার তো তাই আছে। তুই মানুষ হলে আমি কেন হব না? আমার এক্সট্রা পার্ট আছে নাকি? আমি তো দেখতে পারছি না। তুই পারছিস? তাহলে আমাকেও দেখা। তারপর না হয় কোনো এক প্রাণীর দলে ফেলে দিস। আমি খুশি মনে মেনে নিব।”
ইমদাদের কথায় ইশাদ হেঁসে ফেলে। ইমদাদের দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,
“তুই আমার বন্ধু ভাবলেই শরীরটা ঘিনঘিন করে!”
ইশাদের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা আকড়ে ধরে ইমদাদ। সোজা হয়ে দাড়িয়ে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বলল,
“তাহলে ভাবিস না। কে বলেছে ভাবতে? আমি তো বলিনি। আর বলবও না। আমার মতো ভাবনাহীন মানব হবি! বুঝলি?
ইমদাদ হো হো করে হাঁসছে। ইশাদ ওর দিকে বাঁকা চোখে তাকিয়ে আছে। এখানে হাসির কী আছে সে বুঝতে পারছে না। কিছু সেকেন্ড বাদে বলল,
” তুই বলতে চাচ্ছিস আমরা বন্ধু না?”
“না।”
“তাহলে?”
“আমাদের পরিচয় হলো, তুই ইশাদ আর আমি ইমদাদ। আগে পড়ে কিছু নেই।”
“তাহলে আমি ডাকলে তুই ছুটে আসিস কেন?”
“তুই আসিস তাই!”
“আমি যাই দেখে তুই আসিস। আমি না গেলে আসবি না?”
ইমদাদ হাসি বন্ধ করেছে। হঠাৎ মুখটা ভাবুক হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বলল,
“অতদূর ভাবিনি। ভেবে বলব!”
“এই তুই ভাবনাহীন মানব?”
ইশাদের ভ্রূ উচানো মুখটার দিকে তাকিয়ে জিভ কাটে ইমদাদ। আমতা আমতা করে কিছু বলবে তার আগেই ইশাদ বলল,
“মেয়ে নিয়ে খেলতে খেলতে তুই পঁচে গিয়েছিস। শরীরের বাহির ও ভেতরের সব পঁচে গিয়েছে এমন কি তোর মুন্ডুটাও।
এটা আমার লাস্ট ওয়ার্নিং,আমার মা’কে নিয়ে কিছু বলার আগে হাজারবার ভাববি!”
ইমদাদ কটাক্ষ করে বলল,
“বাকি দুজনকে নিয়ে বলতে কতবার ভাববো?”
মুহুর্তেই ইশাদের চোখ জ্বল জ্বল করে উঠল। কিছু বলতে গিয়েও পারছে না। প্রচন্ড বিরক্ত সে এই বন্ধুটাকে নিয়ে। তবুও এর মধ্যেই তার প্রশান্তি! সারাদিন ব্যস্ততা শেষে এই মানুষটির সাথেই দুটো কথা বলতে ইচ্ছে করে ইশাদের। ছোট্ট ছোট্ট সমস্যাগুলোও এর সামনেই উপস্থাপন করতে ইচ্ছ করে। যদিও এর বিপরীতে কখনোই ইমদাদ সমাধান খুঁজে দিতে পারে না। তাতে কী? ইশাদ তাও বার বার এই মানুষটির দারস্থ হয়! বারংবার মনকে সান্ত্বনা দেয়, হয়তো কোনো একদিন সমস্যার সমাধান হয়ে স্বয়ং ইশাদের সামনে দাড়াবে! এতো আশা জ্বলার কারণ কি শুধুই বন্ধুত্ব নাকি অন্যকিছু? হ্যাঁ আরেকটি বিশেষ কারণ আছে। মনে পড়তেই ইশাদের অক্ষিদ্বয়ে থৈ থৈ করে কৃতজ্ঞতার জল! ক্ষনিকের জন্য অতীতে ডুব দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলো ইশাদ তন্মধ্যেই প্রচন্ড কাঁপুনিতে বেজে উঠে ইমদাদের ফোন। এতে শুধু ইশাদের চোখে নয়, বিরক্তরা ইমদাদের চোখেও ধরা পড়ে! দুজনের চোখই আটকায় ইমদাদের ফোনের স্ক্রিনে। মিম নাম ভেসে আছে। ইশাদ কড়া ধমকে বলল,
“তোর এইসব কুকীর্তি বাইরে গিয়ে কর। আমার বাড়িতে না। যা এখনি বের হ।”
ইমদাদ কলটা কেটে দিল। সাইলেন্ট করে ফোন পকেটে ভরে ত্বরিতগতিতে বলল,
“সে কী! তোর আংটি বদল দেখব না? আমার হবু ভাবীকে দেখব না? এভাবে ডেকে এনে দুরছাই করছিস?”
ইশাদ জোরপূর্বক ইমদাদকে নিয়ে বারান্দা ছাড়ে। রুমে এসে ওর হাতে একটা মলম ধরিয়ে বলল,
“না। কখনো না। এই এখন থেকে আবারও আমার বাড়ি আসা নিষেধ। আমার অনুমতি ব্যতীত ভুলেও আমার বাড়িতে পা রাখবি না বলে দিলাম। আমি চাই না তোর কুদৃষ্টি আমার বাড়ির মেয়েদের উপর পড়ুক!”
ইমদাদ হা’করে তাকিয়ে আছে। হাতের মলমটা পড়বে পড়বে ভাব। যেন সে ইশাদনামক ব্যক্তিটাকে এই প্রথম দেখছে!
~~~
বসার রুমের কোথাও ইশাদকে খুঁজে পেল না মিহি। শুধু বসার ঘর? নিচ তলার পুরোটা অতিপতি করে খুঁজে বেরিয়েছে। সবশেষে দুতলায় সিড়ির দিকে এগুচ্ছে। মনে মনে একটাই ভাবনা,মা যখন বলেছে তখনতো তাকে চুলের বাড়ি দিতেই হবে! সেটাও এখনি।
মিহি দ্রুতপদে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে এল। নজর ইশাদের রুমের দিকে। দু পা এগুলেই ইশাদের রুম। সোজা ঢুকে যাবে? নাকি বাইরে থেকে অনুমতি নেবে? ভাবতে ভাবতে ইশাদের রুমের দরজার সামনে এসে দাড়ায় মিহি। ভেতরে ঢুকার আগে পূর্ব প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। মায়ের কাছ থেকে দেখেছে কিন্তু নিজের চেষ্টা করা হয়নি। শেষে যদি ঠিকঠাকমতো চুলের বাড়িটা না হয়? মিহি চটপট সিদ্ধান্ত নেয় কয়েকবার চর্চা করে তবেই ভেতরে ঢুকবে। সে হাত দিয়ে চুলগুলো সামনে আনে। কয়েকবার আঙুল দিয়ে আঁচড়িয়ে ঠিকঠাক করে অতঃপর ঝাপটা দিয়ে চুল পিঠে নিতেই প্রচন্ড জোরে হাঁচির শব্দ এল। মিহি চমকে উঠে। দ্রুত সামনে তাকায়। সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। অপরিচিত। নাকটা লাল টকটকে। পুরো মুখে সাদা সাদা দলাকারে তরলজাতীয় কিছু ছিটে আছে। ছেলেটির চোখ বন্ধ। দ্বিতীয় হাঁচির প্রস্তুতি চলছে। মিহি ভয় পেয়ে যায়। ছেলেটিকে পাশ কাটিয়ে রুমের ভেতর ঢুকে যায়। অপরিচিত ছেলের পেছনেই ইশাদ। তার পেছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়ে।
ইমদাদ পরপর তিনটে হাঁচি শেষ করে সামনে তাকাল। তাজ্জব হয়ে বন্ধুর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিল,
“কই গেল?”
“কী কই গেল?”
“আরে এখানে একটা মেয়ে ছিল তো। হাওয়ায় তার চুল উড়ে আমার নাকে লাগল। সেই জন্যইতো হাঁচি এল। হাওয়ার সাথে কি মেয়েটাও উড়ে গেল?”
সাথে সাথে ইশাদের পিঠে নখের আঁচড় পড়ল। তার বুঝতে বাকি রইল না মিহি তার আশ্রয় চাচ্ছে। শুধু নখ নয়,মিহির কপালটাও ইশাদের পিঠে লেগে আছে। হয়তো বুঝাতে চাচ্ছে তার কথা যেন বলে না দেয়। একদিনের পরিচয় পাওয়া মেয়েটির না বলা কথা বুঝে নিয়েছে ইশাদ। কিছুক্ষণ নিরব থেকে মৃদু কন্ঠে বলল,
“তোর ডাক্তারি ছেড়ে দেওয়া উচিত। পাগলের সাথে থাকতে থাকতে তুই নিজেও পাগল হয়ে যাচ্ছিস ইমদাদ।”
“তোর কি মনে হয় আমি মিথ্যে বলছি? আরে মেয়েটার শ্যাম্পুর ঘ্রাণটা এখনো নাকে লেগে আছে।”
কথার তালে তালে ইমদাদ পেছন ঘুরবে তখনি শক্ত হাতে আটকে দিল ইশাদ। গলায় জোড় এনে বলল,
“এখানে থাকার বাহানা বানাচ্ছিস তো? কোনো লাভ নেই। তুই যাবি। এখনি। চোখ সামনে,ঘাড়টাও পেছনে ঘুরাবি না।”
ইমদাদ কিছু বলতে চেয়েও পারল না। তার পূর্বেই ইশাদ ওকে সামনে ঠেলে দিচ্ছে। বন্ধুকে নিয়ে সামনে হাঁটা ধরতেই শার্টে টান খেল। মিহি এখনো তার শার্ট খামচে ধরে আছে। ইশাদ অনিচ্ছাতে ইমদাদকে ছেড়ে দিল। সামান্য হুকুমজারি করল,
“খবরদার এদিক ওদিক তাকাবি না। নজর মাটিতে রেখে বের হবি। বাইরে গিয়েই আমাকে কল দিবি।”
বন্ধুর এমন রোবটের মতো ব্যবহারে আশাহত হলো ইমদাদ। বাধ্য ছেলের মতো নিচে নেমে যাচ্ছে। ইমদাদকে বিদেয় করে পেছন ঘুরল ইশাদ। মিহি তখনো মাথা নিচু করে আছে। ভয়ে জড়সড়। খানিকটা কাঁপছেও কি?
“কিছু বলবে?”
মিহি চমকে উঠল। চোখের চাহনি বিক্ষিপ্ত। নিশ্বাসটাও বুঝি এলোমেলো! বহুক্ষণ ইতস্তত করে অস্ফুটে বলল,
“না। আমি যাই।”
মিহি দৌড়ে পালাবে তার আগেই ওর পথরোধ করল ইশাদ। ভীত মুখমন্ডলে গাঢ়দৃষ্টি ছুড়ল কিছুক্ষণ। সময় শেষে আচমকা মিহির ডান হাতটা চেপে ধরল। টেনে নিয়ে বসাল নিজের বিছানার একপাশে। ইশাদের এমন আচরনে মিহির বুক ধুরু ধুরু। সারা শরীর কাঁপছে। ভয়ে পুরো শরীর জমে যাওয়ার উপক্রম।
মিহিকে বসিয়ে রেখেই কিছু খুঁজছিলো ইশাদ। উচ্চ শব্দের হৃদয় কম্পন নিয়ে মিহি বিড়বিড় করছে,লাঠি খুঁজছে নাকি? ও মা গো! চুলের বাড়ি দিতে এসে এখন লাঠির বাড়ি খাবো?
“তুমি বসো আমি আসছি।”
মিহি মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিতে গিয়েও পারল না। সত্যি সত্যি বরফে পরিণত হলো নাকি!
ইশাদ দরজার কাছে পৌছে আবার সতর্ক করল,
“চুপচাপ এখানেই বসে থাকবে। নড়বে না কিন্তু।”
~~~
ইশাদ নিজের রুম ছেড়ে মায়ের রুমে ঢুকল। মা নেই। হয়তো নিচে আছে। মাকে ডাকবে ভেবেও ডাকল না। নিজেই হালচাষ শুরু করে দিল। তবে হালচাষটা শুধু ড্রেসিং টেবিলের উপরেই চলছে। ছোট ছোট কৌটো,ড্রয়ার,শরীরে মাখার নানা রকম প্রসাধনী এদিক সেদিক সরিয়েও সে হতাশ। যা খুঁজছে তা পাচ্ছে না। নিরাশ মনে মায়ের রুম ছাড়ার পূর্বে চিরনিটি তুলে নিল। বের হতে গিয়ে থমকে গেল। দরজার সামনে তিহি দাড়িয়ে। দু হাতের শক্ত বাধন বুকের উপর। দরজার মাঝামাঝিতে এমনভাবে দাড়িয়ে আছে যে সে চাইলেও পাশ কাটতে পারবে না৷ তিহিও কি কাটতে দিবে? শক্ত তোরজোর বেধে আসছে। অনেকটা মহিলা পুলিশের মতো। যেন ইশাদকে জেলে ঢুকাতে এসেছে। কিন্তু তার অপরাধটা কী?
তিহি দরজা ছেড়ে এক পা এগিয়ে বলল,
“আপনি ডাক্তার?”
ইশাদ দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল। উদ্দেশ্যহীন দৃষ্টি ঘুরছে পুরো রুমে। সেভাবেই জবাব দিল,
“জ্বি।”
তিহি ত্বরিতগতিতে ইশাদের কাছে ছুটে এল। ইশাদ দ্রুত এক কদম পিছিয়ে গেল। তিহি তোষিত কন্ঠে বলল,
“এইজন্যই তো আমি বটগাছ হয়ে গিয়েছিলাম। আপনি আমার উপর সম্মোহন বিদ্যা ঢেলেছিলেন। ইংলিশে যাকে বলে Hypnotize!” সোজা কথায় বশ করেছিলেন। মাইন্ড ওয়াশ করে আমাকে বটগাছ বানিয়ে চুমু খেয়েছেন। গাল টেনেছেন। নাক টিপেছেন।”
তিহির কথায় ইশাদ হতভম্ব। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। এই মেয়ে তো তার থেকেও কয়েক ধাপ এগিয়ে। এখন তার কী বলা উচিত? কিছু তো একটা বলতে হবে। এই মেয়েকে পরাস্ত করতেই হবে।
ইশাদ খানিক সময় নিরব কাটিয়ে মাথাটা সামনে ঝুঁকায়। বাঁকা হেঁসে বলল,
“আমি সম্মেোহন বিশেষজ্ঞ নই,চক্ষু বিশেষজ্ঞ।”
ইশাদের কথায় তিহির ঔদ্ধত্য চেহারাটা নিভে গেল। মলিন মুখে নিরবে দাড়িয়ে আছে। ইশাদ দাম্ভিক ভাব নিয়ে তিহিকে পার হবে তখনি তিহির কন্ঠ বেজে উঠে,
“চক্ষু বিশেষজ্ঞ দেখেইতো চোখ দিয়ে বশ করেছেন। এই যে এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে।”
ইশাদ ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল। তিহির কাজলরাঙা চোখদুটোতে ভেসে আছে মায়া পুকুর। আর কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকলেই ইশাদ ডুবে যাবে। তারপর কী হবে? মরে যাবে? আচ্ছা এই মরণকে কী নামে উপাধি দেওয়া যায়? ডেড সার্টিফিকেটে কিছু তো একটা লিখতে হবে। কিন্তু কী লিখবে?
“এগুলো করার জন্যইতো ডাক্তারি পড়েছেন তাই না? চোখে চোখে বশ করে চুমু খাওয়া হচ্ছে? আপনার লাইসেন্স বাদ করা উচিত। আপনি হলেন নষ্ট বিশেষজ্ঞ! নষ্ট বিদ্যা শিখে অন্যদের নষ্ট করে দিচ্ছেন। ছি! নষ্ট পুরুষ।”
তিহির কথায় ইশাদের ভ্রূজোড়া কুঁচকে গেল। তবে মুখে কোনো শব্দের মালা গাঁথলো না। তিহি আবার শুরু করল,
“শুনলাম আজ নাকি আপনার এনগেজমেন্ট? মিহির সাথে? তার মানে আপনি মিহির হবু? মিহি কি জানে? আপনি তার শুধু হবু না। নষ্ট হবু!”
তিহির মুখে মিহি নামটা শুনতে ইশাদ সংবিৎ ফিরে পেল। সে তিহিকে উপেক্ষা করে চলে যাওয়ার জন্য পা চালায়। দরজায় গিয়েই থমকে গেল। দুর থেকে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আপনার কাছে বাঁধুনি হবে?”
“সেটা আবার কী?”
“চুলের আগায় যেটা প্যাচায়।”
তিহি ইশাদের দিকে এগিয়ে আসলে ইশাদ পিছিয়ে গেল। মনে মনে উচ্চারণ করছে,এ মেয়েটা কী চুম্বক দিয়ে তৈরী? অদৃশ্য টান অনুভব হয় কেন? কেন মনে হয় সে কাছে আসলে আমি আরো কাছে চলে যাব?
“রাবারব্যান্ড? কী করবেন?”
“সেটা আপনার না জানলেও চলবে।”
“আমার জিনিস দেব। না জেনে দেব কেন?”
ইশাদ কথা বাড়াল না। উল্টো ঘুরে গেল। এমন একটা ভাব- না দিলে নাই!
সামনে এক পা ফেলতে তিহি বলল,
“দাড়ান, দিচ্ছি।”
তিহি ছুটে চলে যায় নিজের রুমে। ইশাদ তার অপেক্ষাতে দাড়িয়ে আছে। হঠাৎই নজর পড়ে নিচের দিকে। তার বাবা সিড়িতে পা রাখছেন। পেছনে মা। দুজনের মধ্যে দুরত্ব দেখে মনে হচ্ছে মালিকের পেছনে ভৃত্য! ইশাদ মায়ের রুম ছেড়ে একটু আড়ালে গিয়ে দাড়ায়। রুমে বাবা ঢুকলেন। মাও! ইশাদ নিজের রুমে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে তিহির কথা মনে পড়ে। সে তাকে অপেক্ষা করতে বলেছে। এসে যদি না পায়? কিন্তু মেয়েটা এখনো আসছে না কেন? ইশাদ কি বাবার সাথে দেখা করে নিবে? আসার পর এখনো বাবা- ছেলের সাক্ষাত হয়নি। করতেই পারে। করা উচিতও।
মায়ের রুমে ঢুকতে গিয়েই ইশাদ থমকে গেল। মায়ের কন্ঠ পাচ্ছে সে,
“কেমন আছেন?”
শাহিনা শাইখার প্রশ্নের উত্তরে দায়সারা উত্তর দেন সোবহান শাইখ,
“ভালো।”
“আপনি কি গোসল করবেন? গরম পানি করে দেব?”
“না।”
হঠাৎ কথোপকথন থেমে গেল। ইশাদ তখনো চুপ করে কান খাড়া করে আছে। এভাবে আড়াল থেকে বাবা-মায়ের ব্যক্তিগত কথা শোনা কি উচিত হচ্ছে? হয়তো না। কিন্তু তার শুনতে ইচ্ছে হয় কেন? মায়ের নিরুদ্যম নিশ্বাসটা শুনার জন্য? আর কত? মায়ের প্রতি বাবার এই অবহেলা আর কত দেখবে? এই অবহেলার কারণটা কী?
“আপনি আমাকে দেখলে পালাল কেন?”
তিহির আকস্মিক প্রশ্নে ঘাবড়ে যায় ইশাদ। দ্রুত চোখ রাখে মায়ের রুমে। কেউ দেখে নিলো কি!
ইশাদের হকচকিয়ে যাওয়াটা তিহির চোখ এড়ায়নি। আবার প্রশ্ন ছুড়বে তার আগেই নিচু কন্ঠ ছাড়লো ইশাদ,
“বাঁধুনি এনেছেন?”
তিহি রাবার ব্যান্ডটা ইশাদের দিকে বাড়িয়ে বলল,
“আপনি আমার প্রশ্নের উত্তর দেন না কেন? ভয় পান? যদি ফেল করেন!”
ইশাদ মৃদু হাঁসল। তিহির মায়া সাগরে চোখ রেখে বলল,
“ঠিক ধরেছেন।”
ইশাদ আর এক দন্ডও দাড়াল না। সোজা হেঁটে চলে নিজের রুমে। মুগ্ধ দৃষ্টি সাদা রঙের রাবার ব্যান্ডটির উপর। হঠাৎ ভালো লাগার দোলনা দুলছে বুকের ভেতর। কিন্তু দোলনায় বসে থাকা মায়াবিনীটি কে?
~~~
ইশাদ রুমে ঢুকেই আদেশ বাক্য ছাড়লো মিহির উপর।
“এদিকে আয়।”
মিহি ঘাড় ফেরায়। ইশাদ খাটের উপর বসে আছে। পা দুটো ভাজ করে। মুখের ভাব স্বাভাবিক। কিছুটা আদুরী ভাব। ইশাদ এবার শক্ত গলায় বলল,
“কি হলো? এদিকে আসতে বললাম না? আমার সামনে এসে বস।”
মিহির সব ভয় উবে গেল। চটজলদি ইশাদের কাছে গিয়ে বসল। ইশাদ ওকে পেছনে ঘুরে বসার জন্য ইশারা করে। মিহিও তার কথামতো বসেছে। মিহির চুলে চিরনি লাগিয়ে বলল,
“বেনি কিভাবে পাকায় রে?”
“আপনি আমাকে বেনি করে দিবেন?”
“তো কী করব? এভাবে পেত্নির মতো চুল ছেড়ে আছিস কেন? আবার চুল গিয়ে পড়ছে অন্যের নাকের উপর!”
“আমার কী দোষ মাইতো..”
মিহি কথা ছাড়তে গিয়ে মাঝপথে আটকে গেল। ইশাদ চুলে চিরনি ঠেকিয়ে বলল,
“মা কী?”
“কিছু না। চলুন আমি আপনাকে বেনি করা শিখিয়ে দেই।”
“ওকে। তুই বলে বলে দে,আমি শুনে শুনে ঠিক পারব।”
মিহির কথামতো ইশাদ বেনি তুলছে। তারমধ্যেই বলল,
“তোর পড়াশোনা কদ্দূর?”
“এস এস সি দিয়েছিলাম।”
“দিয়েছিলাম মানে? এখন আর পড়িস না?”
মিহি মন খারাপ করে বলল,
“না। আপনার আম্মু তো আমাদেরকে নিয়ে চলে এলেন।একটু আগে মা বলেছে আর পড়তে হবে না।”
“কেন?”
“আপনার সাথে বিয়ে হবে যে তাই।”
মিহির মুখে ‘বিয়ে’ শব্দটা শুনতেই ইশাদের হাত দুটো অবশ হয়ে এল। হাত থেকে চিরনি পড়ে গিয়েছে। দ্রুত মিহির কাছ থেকে সরে গেল। বিছানা থেকে নেমে গেল। মিহি চিন্তিত কন্ঠে বলল,
“কি হয়েছে ইশাদ ভাইয়া?”
ইশাদের অসহায় দৃষ্টি মিহির উপর। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,
“তুমি এখন যাও। আমরা পরে কথা বলব।”
মিহি বিনাবাক্যে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায়। ইশাদ ধপ করে বিছানায় বসে পড়তে মিহি আবার আসে। বলে,
“আন্টি বলছে,তাড়াতাড়ি নিচে আসতে। এই যে এই পান্জাবী পড়ে নিতে বলল। আংকেল দিয়েছে।”
“তোমার সাথে বাবার কথা হয়েছে?”
“হুম। কেন?”
“কিছু না। তুমি যাও আমি আসছি।”
~~~
ইশাদ নিচে আসতেই সোবহান শাইখ মৃদু হাঁসলেন। ছেলেকে নিজের দিকে ডাকলেন। বসার রুমটা এখন পরিপূর্ণ। শুধু তিহি নেই। কী করে জানলো তিহি নেই? তবে কি ইশাদের চোখ জোড়া তিহিকে খুঁজছে? অবশ্যই খুঁজছে। কেননা খোঁজ শব্দটির সাথে কারো সত্তা ওতপ্রোতভাবে জড়িত! চোখে খোঁজ খোঁজ ভাব নিয়েই মিহির হাতে আংটি পড়ালো ইশাদ। হঠাৎই ভেতরে প্রবল মোচড় অনুভব করছে সে। অসস্থিতে বুক ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে। আচমকা চোখ পড়ে সামনে। ঠিক তিহির উপর। মাটির মূর্তি ন্যায় শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। বড় বড় টানা চোখদুটোতে ভয় স্পষ্ট! কী এমন দেখছে সে? ইশাদই বা কী দেখছে? তার চোখের পাতা পড়ছে না কেন? কিসের অপেক্ষায় আছে পাতাগুলো? এমন একটা ভাব যেন- এখন কিছু ঘটবে। সেই সম্ভাব্য ঘটনার জন্যই অপেক্ষা করছে সে।
ইশাদের অপেক্ষা শেষ করতেই যেন তিহির শরীর নরম হয়ে এল। জ্ঞান হারিয়ে নিচে পড়ে গেল!
চলবে