তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,০৪,০৫

0
1115

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি Season_2,০৪,০৫
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (৪)

ঝরা পাতার নিক্কন শব্দে কান নড়ে উঠে ইশাদের। সঙ্গে সঙ্গে সামনে থেকে বাতাসের ঝাপটা! ইশাদের নরম দৃষ্টি সরে আসে আকাশ থেকে। তৎক্ষনাৎ চাঁদটি হারিয়ে যায় মেঘের আড়ালে। শিরশির অনুভূতি জেগে উঠে পুরো শরীরজুড়ে। বিড়বিড় করে আপনমনে,বৃষ্টি হবে নাকি? বাতাসের বেগে উড়ে আসে ঝরাপাতা। ইশাদের পায়ের সাথে বাড়ি খায়। ইশাদ সামান্য ছিটকে উঠে। এক কদম পিছিয়ে যায় ছাদের কার্নিশ ছেড়ে। নিজের পায়ের দিকে কিছুক্ষণ নিরব চাহনি এঁকে বা পাশে তাকায়। মুহূর্তেই চোখজোড়া উন্মাদ হয়ে উঠে।চিৎকার করে আম্মুকে ডাকতে চায়। উত্তেজনায় দু কদম এগিয়ে যায় উত্তর দিকে। তাদের ছাদের দেয়াল ছাপিয়ে বেড়ে উঠা পত্র ঝরা বৃক্ষটি পরিপূর্ণ। আগুন লাল কৃষ্ণচূড়া ফুলে! আনন্দে ইশাদের চোখ চিকচিক করছে। আজ কত বছর বাদে গাছটি ফুলে ফুলে সেজেছে। আম্মু কি দেখেছে? নিশ্চয় দেখেনি। দেখলে তো সবার আগে তার কাছেই দৌড়াতো। ইশাদ পেছন ঘুরে আম্মুকে ডাকার জন্য। এক পা ফেলতেই সামনে থেকে টনুর গলা,

“তিহি আপার জ্ঞান ফিরছে। ম্যাডাম আপনারে ডাকে।”

টনু তাদের বাসার কাজের ছেলে। দুই হাত দূরে দাড়িয়ে আছে। দাড়ানোর ভঙ্গি বলছে ইশাদকে নিয়ে তবেই নড়বে। তিহির জ্ঞান ফেরার খবরটায় তার খুশি হওয়া উচিত নাকি দুঃখ হওয়া উচিত বুঝতে পারছে না। এমন মাঝামাঝি অনুভূতিকে দূরে ঠেলে দিয়ে টনুকে ইশারায় ডাকলো। টনুর মুখটা হাস্যোজ্জ্বল। তার একটি অসাধারণ প্রতিভা হলো,যখন তখন হাসতে পারা। শুধু যে নিজে হাঁসে তা নয়,যতক্ষণনা অন্যকেউ তার হাসির সাথে যোগ মিলাচ্ছে ততক্ষণ হেঁসেই যাবে। ইশাদের এখন হাঁসতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেন জানি ঠোঁট দুটো তার ইচ্ছের সাথে সায় দিচ্ছে না। সে কি এখন টনুর সাহায্য নিবে?

“সিন চুন খোয়াইলা!”

টনুর হাসি হাসি মুখটা হারিয়ে গেল। সংশয় নিয়ে বলল,

“কী কন ছোটসাব? চুন খাইবেন?”

ইশাদের ইচ্ছে পূরণ হলো। ঠোঁট দুটো ইচ্ছের কাছে হেরে নড়ে উঠেছে। মৃদু হাসি নিয়ে বলল,

“এটার মানে হলো ফাল্গুনের শুভেচ্ছা। কাল পহেলা ফাল্গুন। আমরা যেমন ফাল্গুন মাসের প্রথম তারিখে বসন্ত বরণ করি? সে রকম চিনেরাও করে। তারা চন্দ্রপুঞ্জিকা অনুযায়ী বসন্ত বরণ করে। একে অপরকে বসন্তের শুভেচ্ছা জানায়। তাদের ভাষায় বলে ‘সিন চুন খোয়াইলা’ বুঝলি?”

টনু অবোধের মতো তাকিয়ে আছে ইশাদের দিকে। ডান হাতের আঙুল চুলে ডুবিয়ে হালকা মাথা নাড়ে। যার মানে এই সে বুঝতে পেরেছে। ইশাদ এবার শব্দ করে হেঁসে ফেলে। হাসতে হাসতে হাতঘড়ির দিকে তাকালো। বারোটা বেজে পাঁচ। তাহলে কি প্রথম শুভেচ্ছাটা টনুই পেল? ইশাদ একবার টনুর দিকে তাকায়। হঠাৎই কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। গটগট পা ফেলে দক্ষিণে। কয়েক গজ দূরেই চিলেকোঠা। খোলা দরজার সামনে লাইটের আলো পড়ে আছে। তাতে দুই তিনটে নারীর ছায়া। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়েও আলোর রশ্মি ঠিকরে বের হচ্ছে। জানালার সামনে আসতেই ইশাদ থমকে গেল। অসস্থি হচ্ছে তার। চোখের ভেতর জ্বালাপোড়া অনুভব করছে। কিন্তু কেন? কেন মনে হচ্ছে মেয়েটির সামনে গেলেই সে কেঁদে দিবে? এমন অদ্ভূত মনে হওয়া নিয়ে কি ভেতরে যাওয়া যায়? যায় না। একটা অপরিচিত মেয়ের সামনে সে কেন কাঁদবে? কেন? ইশাদ আর সামনে যাওয়ার সাহস পেল না। উল্টো ঘুরে সিড়ির দিকে পা বাড়াল। হাঁক তুলল টনুর উদ্দেশ্যে,

“ওখানে দাঁড়িয়ে আছিস যে? আমার সাথে আয়।”

ছাদ ছেড়ে সোজা মায়ের রুমের দিকে এগুলো ইশাদ। মায়ের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। মাথার ভেতর প্রশ্নরা কিলবিল করছে। মিহির ব্যাপারে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা আছে। তিহির ব্যাপারেও কি আছে? হয়তো! হঠাৎ ঐ ছোট্ট চিলেকোঠা ভাড়া দেওয়ার প্রয়োজন পড়লো কেন? এটা তো জানতে চায়তেই পারে। আর একটি খবর দেওয়ার আছে। আজ অনেক বছর পর তাদের বাসায় বসন্তের রঙ পড়েছে! তবে কী এবার মায়ের সাদা-কালো জীবনটা রঙিন হয়ে উঠবে?

ইশাদ ভেতরে ঢুকবে তার আগেই বাবার গলা পেল,

“সব তোমার দোষ। এসবের কী দরকার ছিল? একবার আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করলে না?”

সোবহান শাইখের কথার পিঠে কোনো কথা আসছে না। কিন্তু ইশাদের কান সজাগ। সে বোধ হয় কিছু শুনতে পারছে। মায়ের ফুঁপানির শব্দ। মা কি কাঁদছেন? ইশাদ আর অপেক্ষা করে না। ভেতরে ঢুকে পড়ে। সরাসরি তাকায় মায়ের দিকে। শাহিনা শাইখা মাথা নত করে আছেন। কিন্তু চোখ শুকনো! তাহলে কি সে ভুল শুনেছে? হয়তো। ইশাদ দ্রুত বাবার দিকেও তাকালো। তিনি রেগে আছেন। ছেলের এমন হঠাৎ চলে আসায় খানিকটা বিরক্তও হয়েছেন। বসা থেকে উঠে বললেন,

“মেয়েটার কী অবস্থা?”
“ভাল।”
“কিছু জানতে পারলে?”
“কোন ব্যাপারে?”

সোবহান শাইখ দ্বিগুন বিরক্ত নিয়ে বললেন,

“হঠাৎ সেন্সলেস হয়ে গেলো যে সেই ব্যাপারে।”

ইশাদের দায়সারা উত্তর গুলো এবার হারিয়ে গেল। সে তো তিহিকে দেখেইনি জানবে কিভাবে? সে কি দেখে এসে তারপর বলবে?

“কিছু বলছো না যে?”

ইশাদ নড়ে উঠে। বাবার দিকে তাকিয়ে দ্রুত বলল,

“আমি আসছি।”
“আসছি মানে?”

বাবার প্রশ্নটা ইশাদের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। সে সিড়ি কেটে চিলেকোঠায় পৌঁছালো। এবার জানালার সাথে দরজাটাও লাগানো। তবে ভেতরে লাইট জ্বলছে। কারো কথার আওয়াজও কানে আসছে। সম্ভবত রেখা ভূঁইয়া মেয়েকে শাসাচ্ছেন। কিন্তু কী নিয়ে? ইশাদ থম মেরে দাঁড়িয়ে না থেকে দরজায় আঘাত করে বলল,

“আসব?”

সঙ্গে সঙ্গে ভেতর থেকে নিষেধাজ্ঞা,

“না। আসবেন না।”

এমন মুখের উপর না বলে দেওয়ায় ইশাদ অপমানবোধ করছে। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করল, অভদ্র মেয়ে!

তিহি ভেতর থেকে আবার চেঁচিয়ে উঠল। যথেষ্ঠ রুক্ষস্বরে বলল,

“এমন বুড়ো বয়সে একটা বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করছেন। লজ্জা করছে না? ভোরটা হতে দিন। সোজা থানায় যাব। এই যুগে বাল্যবিবাহ? আপনার নামে কেসটা এই তিহিই করবে। হুহ! নষ্ট বুড়োকে ফাঁসিতে ঝুলাব আমি।”
“বাল্যবিবাহ করলে যে ফাঁসি হয় এটাতো জানতাম না। সংবিধান কি নতুন করে আইন বানিয়েছে?”

ইশাদের কথা শেষ হতেই দরজা খুলে গেল। তিহির শরীরে হালকা কমলা রঙের শাল জড়ানো। লম্বা চুলের বেনির নিচে হলুদ রাবারব্যান্ড পেচানো। বুকের একপাশে পড়ে আছে। এই দুটোতে গাঢ় দৃষ্টি রেখেই ইশাদ হারিয়ে গেল। ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

“সিন চুন খোয়াইলা!”

তিহি নাক কুঁচকে বলল,

“এখনও খোয়ানো হয়নি। হবে। আপনার শরীরের গরম রক্ত খোয়ানো হবে। আমি স্পেশালি আলোচনা সাপেক্ষে বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে আসব। আপনার শরীরের হাড়-মাংস খোয়ানোর জন্য।”

তিহির তেতেপুড়া কথায় ইশাদের হুশ এল। দু’কদম পিছিয়ে বলল,

“মাথায় কী ছিট আছে? যখন-তখন,যেখানে-সেখানে উপুত হয়ে পড়ে যাচ্ছেন। জ্ঞান হারিয়ে ছেলেদের কোলে চড়ছেন। মাথা অপরিষ্কার জানতাম। এখন তো মনে হচ্ছে মনটাও অপরিষ্কার!”

ইশাদের কথায় তিহির নরম রাগ গরম হয়ে গেল। মাথায় চড়ে বসেছে। কড়া উত্তর দেবে তার আগেই রেখা ভূঁইয়া মাঝে চলে এলেন। ফিসফিসিয়ে বললেন,

“ভেতরে যা। আমি কথা বলছি।”

তিহি ইশাদের দিকে গরম দৃষ্টি ছুড়ে ভেতরে ঢুকে গেল। রেখা ভূঁইয়া বিনয়ীর সাথে বললেন,

“আপেল খাবে,বাবা? কেটে দেব?”

ইশাদ উনার হাতের দিকে তাকালেন। হাতে বড় প্লেট। লাল রঙের আপেলগুলোতে বিন্দু বিদু পানি জমে আছে। হয়তো এখনি ধুয়ে এনেছেন। পাশে একটি ছুরিও পড়ে আছে। ইশাদের মনে হলো আপেলটি সে আর ছুরিটি তিহি। তার সম্মতিতেই তাকে কেটে কয়েক টুকরো কেটে দিবে। কী ভয়ানক!

ইশাদ মৃদু হেঁসে নম্র গলায় বলল,

“আপনার মেয়েকে খাওয়ান। তার শরীর দুর্বল। খাওয়া-দাওয়াই বিশেষ যত্ন নিন। এভাবে বার বার অজ্ঞান হয়ে গেলে তো সমস্যা!”
“বার বার কখন হলো? একবারই তো হলো।”

ইশাদ চোখ বন্ধ করে ফেলে। নিজের জিভকে সামলে বলল,

“এখন একবার আবার হলে হবে বার বার! তাই আগে থেকেই সতর্ক করে দিলাম।”

ইশাদের কথায় খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না রেখা ভূঁইয়া। চোখে সন্দেহের খেলা। যেন অন্য কোনো উত্তর দিলে খুশি হতেন। ইশাদ দ্রুত কেটে পড়ার ফন্দিতে বলল,

“গুড নাইট আন্টি!”

ইশাদ ব্যস্ত পা চালায় ফিরতি পথে। তার মন বলছে,পেছন ঘুরলে এখনও রেখা ভূঁইয়ার সন্দেহ দৃষ্টি দেখতে পারবে।

———————
চিলেকোঠা ছেড়ে দু’তলায় আসতেই ইশাদের নাকে শুঁটকির গন্ধ এল। সাথে সাথে বা’হাতে নাক চেপে ধরে। এই শেষরাতে শুঁটকির গন্ধ আসছে কোথা থেকে? রান্নাঘর থেকে কি? ইশাদ নাকে ধরেই রান্নাঘরের দিকে ছুটছে। সাধারণতঃ ইশাদ এবং শাহিনা শাইখা শুঁটকি খান না। তবুও এ বাড়িতে শুঁটকির গন্ধ উড়ে। সেটা হলো বাবা আসলে। বাবার কি শুঁটকি পছন্দ? কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি। হয়তো পছন্দ!

রান্নাঘরে ঢুকেই ইশাদের হাসি পেল। তার মা মুখে মাস্ক পড়ে আছেন। দু’হাত ব্যস্ত পাটায় শুঁটকি বাটায়। পাশে টনু পেঁয়াজ কাটছে। সাথে রসুনও আছে। মা বাটায় মন রেখেই বললেন,

“টনু,কঁচু পাতা আনতে বলেছিলাম যে এনেছিস?”
“হ, ম্যাডাম। ধুইয়া রাখছি। লবণ মিশামু?”
“তোর করতে হবে না। বাকীটা আমি করব। তুই এখন ঘুমাতে যা।”

টনু মাথা নেড়ে ময়লা উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ইশাদ দরজায় দাড়িয়েই বলল,

“একটু আগে বকা খেয়ে এসে তার জন্য শুঁটকির বোরা বানাচ্ছো? তোমার কি আত্মবোধ নেই আম্মু?”

শাহিনা শাইখা পেছন ঘুরলেন না। মিটিমিটি হাসলেন। ধীর গলায় বললেন,

“সে তো বিয়ের রাতেই তোর বাবার হাতে তুলে দিয়েছিলাম।”

ইশাদ দরজা ছেড়ে ভেতরে এল। মায়ের হাত থেকে শিলটা কেড়ে নিল। মাকে পাশে সরিয়ে পাটার উপর ঘর্ষণ শুরু করে বলল,

“বাবা কি কাল চলে যাবে?”
“না।”
“তাহলে?”
“মনে হয় আর যাবেন না।”

ইশাদ বাটাবাটি থামিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। বিস্ময় নিয়ে বলল,

“বাবা বলেছে?”
“না।”
“তাহলে?”
“আমার মন বলছে।”
“তোমার মন বেশিই বলছে। আমার তো মনে হচ্ছে কাল সকালেই চলে যাবে।”

শাহিনা শাইখা চুলায় আগুন ধরালেন। কড়াইতে তেল ঢেলে কঁচু পাতায় লবণ মাখতে মাখতে বলল,

“বাজি?”
“কিসের?”
“তোর মনের সাথে আমার মন। যার মন হারবে সে শুঁটকির বোরা খাবে।”

মায়ের এমন খেয়ালিপনায় ইশাদ হেঁসে ফেলল। হাসতে হাসতে চোখ গেল দরজায়। টনু বেরিয়ে যাচ্ছে। ইশাদ আচমকা ডেকে বলল,
“টনু,কোথায় যাস?”
“ঘুমাইতে।”
“আজ থেকে তুই আমার সাথে ঘুমাবি।”

টনু অবাক। সাথে শাহিনা শাইখাও। তিনি কঁচু পাতাতে মাখানো শুঁটকি ভরছিলেন। থেমে বললেন,

“তোর রুমে টনু ঘুমাবে?”
“হুম। এতো অবাক হচ্ছো কেন? আমার রুমে কি অন্য কেউ ঘুৃমাতে পারে না?”
“অবশ্যই পারে। কেন পারবে না? কিন্তু আজ অবধি দেখিনি তো তাই অবাক হচ্ছি। এক রাতে ইমদাদ ভুল করে ঘুমিয়ে পড়েছিল দেখে তুই কী কান্ডটাই না করলি!”

ইশাদ খানিকটা লজ্জা পেল। লজ্জা কাটাতে বলল,

“শুধু ঘুম নয়। আজ থেকে টনু আমার বডিগার্ড।”
“বডিগার্ড?”
“হুম বডিগার্ড। চব্বিশ ঘন্টা আমার সাথে থাকবে। তোমার রান্নাঘরের কাজের দরকার পড়লে অন্য কাউকে রেখ। আমি ব্যবস্থা করে দেব।”

ছেলের এমন কথায় শাহিনা শাইখার মুখে চিন্তার ছাপ পড়লো। ইশাদের কাছে এসে বলল,

“হঠাৎ বডিগার্ড কেন? সব ঠিক আছে তো বাবা?”

ইশাদ মায়ের চিন্তা দূর করতে মৃদু হাসলো। বললো,

“সব ঠিক আছে আম্মু। তুমি বোরা বানাও। বেশি রাত করো না। ঘুমিয়ে পড়ো।”

ইশাদ টনুকে নিয়ে রান্নাঘর ছাড়ল। হাঁটছে নিজের রুমের দিকে। রাত শেষ হতে চলল। এবার ঘুৃমানো দরকার। সিড়িতে পা ফেলেই টনু জিজ্ঞেস করল,

“ছোটসাব,আমি তো বন্দুক চালাইতে পারি না। আপনারে পাহারা দিমু ক্যামনে?”

ইশাদ সশব্দে হেঁসে ফেলল। টনুর কাঁধে হাত রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,

“আমার শত্রুও বন্দুক চালাতে পারে না। তাই তোরও চালাতে হবে না। তোর শুধু একটাই কাজ।”

টনু উৎসাহ নিয়ে বলল,

“কী কাজ?”

ইশাদ নিজের রুমে ঢুকার পূর্বে ছাদে উঠার সিড়ির দিকে তাকাল। সেদিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলল,

“এই বাসায় একজন আয়নাকন্যা আছে। তোর কাজ হলো সেই আয়নায় যেন আমার প্রতিবিম্ব না পড়ে তা খেয়াল রাখা।”
“আয়নাকন্যা? আমি ক্যামনে বুঝমু কে এই আয়নাকন্যা?”
“যার রূপ আয়নার মতো স্বচ্ছ,চকচকে,অতি নির্মল সেই আয়নাকন্যা। আমরা যেমন আয়নায় ভুল করে চোখ পড়ে গেলে চোখ সরাতে পারিনা। কিংবা সরিয়ে ফেললেও দ্বিতীয় বার ইচ্ছাকৃত চোখ রাখি নিজেকে দেখার জন্য? সে কন্যাটির রূপও তেমন। একবার চোখ পড়ে গেলে,দ্বিতীয় বার চোখ রাখতে বাধ্য করে। তবে আয়নার মতো সে করুণাময়ী নয়। সে নাশময়ী! বেশিক্ষণ তাকালেই রূপের আগুন দিয়ে ঝলসিয়ে দেয়।”

চলবে

#তোমার_সমাপ্তিতে_আমার_প্রাপ্তি
#Season_2
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৫)

ঘরময় অন্ধকার। কালো আঁধারে ডুবে আছে ছোট্ট রুমের সবকিছু। নিশ্চুপ নিরবতার মধ্যে শিউরে উঠা ঘড়ির টিক টিক শব্দ। রাত নাকি দিন ঠিক ঠাহর করতে পারছে না ইশাদ। কেন না রুমটা শক্ত,ভারী চারদেয়ালে জোড়া। বাতাস ঢুকার মতো জানালাতো দুর ছোট্ট ছিদ্রটাও নেই। গাঢ় অন্ধকার ও গভীর নিরবতার মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে ইশাদ। গা ছম ছম করা অনুভূতি! অন্ধকারের জন্য নয়,তার মনে হচ্ছে তার সামনে একটি মেয়ে দাড়িয়ে আছে। যার শারীরিক গড়ন নিকষ কালোতে মিশে আছে। তবে হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারবে। মেয়েটিকে কি সে চেনে? হয়তো চিনে নয় তো চিনে না। তবে নিশ্বাসটাকে চিনতে পারছে। খুব কাছ থেকে এই নিশ্বাসের ছোঁয়া পেয়েছিল সে। কিন্তু কবে? ইশাদ মনে করতে পারে না। প্রচন্ড চাপ পড়ে মস্তিষ্কে। যন্ত্রণা শুরু হয় অক্ষিকোটরে! হঠাৎই অন্ধকারের মাঝে আলো প্রস্ফুটিত হয়। ভেসে উঠে একটি মেয়ের মুখমন্ডল। প্রশস্ত কপাল,সরু চিবুকের পানপাতা মুখ! চোখজোড়ায় সহায়হীন ছাপ। পাতা জোড়া ভিজে ল্যাপ্টে আছে। চোখের নিচে কালচে দাগ! যেন সবসময় চোখে বৃষ্টি লেগেই থাকে। শুষ্ক ঠোঁটে লিপস্টিকের ছোঁয়া। শুকিয়ে ছড়িয়ে আছে চারপাশে। নাকের পাতা ক্রমশ কাঁপছে। মেয়েটির মুখটি পূর্ণরূপের ছায়া পড়তেই ইশাদ আঁতকে উঠে। চাপা স্বরে বলল,

“তিহি? তুমি এখানে কী করছো?”

সঙ্গে সঙ্গে ভারী শিকলের ঝনঝন শব্দ। বন্দী দুটো হাতের থাবা পড়ে ইশাদের উপর। চেপে ধরে গলা। ভয়ঙ্কর আর্তনাদ তুলে মেয়েটি,

“আমি বাঁচতে চাই। আমি মুক্তি চাই। মুক্তো হাওয়ায় নিশ্বাস নিতে চাই। চোখ ভরে আলো দেখতে চাই। ধূলো,মাটির গন্ধ নিতে চাই। দে আমায় মুক্তি দে! বাধন খুলে দে! দরজা খুলে দে!”

মেয়েটি এত জোরেই গলা চেপে আছে যে ইশাদের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গিয়েছে। চোখ লাল হয়ে অস্বাভাবিক পরিমানে বড় হয়ে আছে। গাল,নাক,ঠোঁট মিলেমিশে বিকৃতি রূপ ধারণ করেছে। ইশাদ নিজেকে বাঁচাতে মেয়েটির হাত ছাড়াতে চেষ্টা করে। কিন্তু পারছে না। তাহলে কি আজ তার মৃত্যু হবে? এই মেয়েটির হাতে? এভাবে মৃত্যুকে বরণ করতে পারবে না ইশাদ। তাই শরীরের সর্বস্ব শক্তি হাতে জড়ো করে। মেয়েটির কাঁধ ছুয়ে ধাক্কা দিতেই মেয়েটি হারিয়ে গেল। ঘন অন্ধকারে! অন্ধকার রুমটাও হারিয়ে গেল। সাথে ইশাদের ঘুম। ধরফরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। চোখ মেলে তাকায় চারপাশে। ভোরের স্নিগ্ধ আলো মেখে আছে পুরো রুম। জানালা দিয়ে ভেসে আসছে মৃদু বাতাস আর পাখির কিচিরমিচির শব্দ।

“আল্লাহ গো! আমার মাজাডা ভাইঙ্গা গেছে।”

ব্যথাতুর কন্ঠে জানালা ছেড়ে নিচের দিকে তাকায় ইশাদ। টনু দেয়ালের সাথে লেগে পড়ে আছে। এক হাত কোমরের পেছনে আরেক হাত মাথার পেছনে। ইশাদের কপাল কুঁচকে গেল। ভারী স্বরে বলল,

“টনু তুই ওখানে কী করিস?”

টনু শোয়া থেকে উঠতে চায়। পারে না। পড়ে গিয়ে বলে,

“ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া কন,আমি এইহানে কী করি?”

ইশাদ চোখ কপালে তুলে বলল,

“ধাক্কা! আমি কেন ধাক্কা দিতে যাব? তোকে তো আমার পাশে শুতে দিলাম।”

টনু ঠোঁট টিপে ব্যথা চেপে সোজা হয়ে বসল। প্যান্টটা টেনে বলল,

“আপনি ঘুমের ঘোরে কাতরাইতাছিলেন। হাঁসফাঁস করতাছিলেন। বিড়বিড় করতাছিলেন। আমি ভাবছিলাম আপনারে বোবায় ধরছে। আপনারে ডাকতে গেলাম আর লগে লগে ধাক্কা মারলেন। ছিটকা পড়লাম দেয়ালের কাছে। এহন আমার কী হইব? আপনারে পাহারা দিমু ক্যামনে? দাড়াইতেই তো পারতাছি না।”

টনুর সরল জবানবন্দীতে ইশাদ দমে গেল। খানিকটা লজ্জাও পেল। কিছু বলবে তার আগেই শাহিনা শাইখা হাজির। টনুর দিকে তাকিয়ে বললেন,

“কী ব্যাপার? কী হয়েছে?”

টনু কিছু বলবে তার আগেই ইশাদ দৌড়ে মায়ের কাছে চলে আসে। পরিস্থিতি সামলাতে বলল,

“কিছু হয়নি তো। কী হবে? নাস্তা রেডি হয়েছে? আমি একটু বের হব।”

শাহিনা শাইখা মাথা উপর নিচ করলেন। যার মানে নাস্তা রেডি। তবে সন্দেহের চোখ তখনো টনুর দিকে।

——————–
ইশাদ ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। অপেক্ষা করছে গরম রুটির জন্য। নাকে লাগছে কষানো মাংসের ঘ্রাণ। ঘ্রাণ গভীরভাবে নিশ্বাসের সাথে টেনে নিতে চোখ বন্ধ করে ফেলে। তখনি বন্ধ চোখে ভেসে উঠে নিষ্প্রাণ মুখটি। সাথে কানে বাজে করুণ বীনের সুর। আমি মুক্তি পেতে চাই! ইশাদ চোখ মেলে ফেলল। দ্রুত চোখ বুলালো চারপাশে। খুঁজছে কাউকে। কাকে? তিহিকে? হ্যাঁ তিহিকেই। এই মেয়েটাকে নিয়ে এমন লোমহর্ষক স্বপ্ন কেন দেখল? কেন?

মুহূর্তেই অস্থির হয়ে পড়ে ইশাদ। ডাইনিং ছেড়ে উঠে দাড়াবে তখনি বাবার গলা,

“কোথায় যাচ্ছো?”

বাবার গম্ভীর গলায় ইশাদ নিরব। মনের চঞ্চলতা নিভে গেল। সত্যিইতো কোথায় যাচ্ছে সে?

সোবহান শাইখ ইশাদের সামনা সামনি চেয়ার টেনে বসলেন। টেবিলের উপর ডানহাত রেখে বললেন,

“দাঁড়িয়ে আছো যে? বস। খাবার শেষ করে তারপর যাবে।”

ইশাদ বসে পড়ে। চোখ মেলে তাকায় বাবার দিকে। এই মানুষটাকে নিয়ে ভাবনার অন্ত নেই ইশাদের। না হাসে,না কাঁদে,না রাগে,না ভালোবাসে! আসলেই কী ভালোবাসে না? হয়তো বাসেন৷ কিন্তু প্রকাশ করেন না। একদল মানুষ আছে,যারা ভালোবাসাকে প্রকাশ করতে জানে না। ভালোবাসা নামক শব্দটাকে এড়িয়ে চলে সবসময়। অথচ তাদের ভেতরটা থাকে ভালেবাসায় ভরপুর! বাবাকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কানে আসে আধোবুলি। অস্ফুটস্বরে কেউ ধমকাচ্ছে কাউকে। ইশাদ ঘাড় ফেরায়। দূরে রান্নাঘরের সামনে রুবিনা দাড়িয়ে আছেন। শাড়ির আঁচলের কোণটা দাঁত দিয়ে কামড়ে রেখেছেন। যেন মুখটা আড়াল করতে চাচ্ছে। সেভাবেই নিচুস্বরে ধমকাচ্ছেন মিহিকে। তার চোখ টলমল। যেন এখনি কেঁদে দিবে। দুজনের মধ্যে কী চলছে বুঝতে পারছে না। বুঝার চেষ্টা করতে গাঢ় মনোযোগী হলো। হঠাৎই মনে পড়ে তিহির কথা। সত্যিই তো মিহি তার তুলনায় বড্ড বেশি ছোট। প্রায় দশ/বারো বছরের ছোট হবে! এই মেয়েটি তার বউ হবে? খুব অশোভন লাগবে। মায়ের কথা রাখতে গিয়ে ভুল করে ফেলছে নাতো? তাঁর খুশির জন্য আরেকজনের জীবন ধ্বংসে তুলে দিচ্ছে নাতো? ইশাদ ছোট্ট কল্পনায় ডুবে। সে বেঘোরে ঘুমুচ্ছিলো। হঠাৎ মায়ের কড়া ডাকে চোখ মেলতেই একটি মেয়েকে দেখিয়ে গদগদ হয়ে বললেন,

“দেখতো তোর বউ পছন্দ হয়েছে নাকি?”

ইশাদ বিরক্ত নিয়ে সামনের মেয়েটির দিকে তাকাল। তার মাথায় ঘোমটা দেওয়া। ঘোমটা পড়ে যাবে দেখে শাহিনা শাইখা দুই হাতে ধরে আছেন। উচ্ছাসিত গলায় বললেন,

“আমার কিন্তু খুব পছন্দ। আমি তো বিয়ের ডেটও ঠিক করে ফেলেছি। আজ রাতেই এনগেজমেন্ট হবে। দাড়া তোর মামাকে কল দিয়ে আসতে বলি।”

ইশাদকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই শাহিনা শাইখা মামাকে কল দিয়ে বসলেন। শুধু কী মামা? আরো কাকে কাকে কল দিলেন কে জানে! ইশাদ শোয়া থেকে আলসেমিভঙ্গিতে বসলো। সামনের মেয়েটির ঘোমটা পড়ে গেছে। সে দাঁড়িয়ে আছে নতজানু অবস্থায়। ইশাদ ওর থেকে চোখ সরিয়ে বলল,

“আম্মু সকাল সকাল কী শুরু করলে?”

শাহিনা শাইখা ফোন ফেলে ছেলের পাশে বসলেন। ওর হাতদুটো চেপে ধরলেন বুকে। ছলছল চোখে ঠান্ডা গলায় বললেন,

“এটা আমার শেষ চাওয়া!”

মায়ের এমন কথায় ইশাদ হতভম্ব! ক্ষনিকের জন্য পৃথিবীর দুয়ার ত্যাগ করল যেন। ভাষা হারিয়ে,বুদ্ধীশূন্য হয়ে ফ্যালফ্যাল করে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর?

“ইশাদ ভাইয়া?”

মিহির কন্ঠে ইশাদের কল্পনায় ছেদ পড়ে। কিছুক্ষণ মিহির নিষ্পাপ মুখটাতে চেয়ে থেকে বলল,

“কিছু বলবে?”
“রুটি কয়টা দেব?”

ইশাদ পাতে তাকাল। এরমধ্যে প্লেটে চারটে রুটি দেওয়া শেষ। মেয়ে আরো দিতে চাচ্ছে। তাকে দেখে কী মহিষ মনে হয়? ঝোলা বাধা মহিষ? ইশাদ মনে মনে বিড়বিড় করে মিহিকে টেনে পাশে বসিয়ে দিল। সামনে প্লেট সোজা করে রুটি দিল। মাংসের বাটিটা টেনে বলল,

“তোমার কারো কথা শুনতে হবে না। কোনো কাজ করতে হবে না। মন যা বলবে তাই করবে। ঘুরবে,নাচবে,খাবে আর আমার আম্মুর সাথে গল্প করবে। কেমন?”

মিহি মুক্তোঝরা হাসি নিয়ে বলল,

“মা সত্যিই বলে আমি আসলেই ভাগ্যবতী!”
“এখানে ভাগ্যের কী হলো?”

ইশাদের কথার জবাব দিতে পারল না মিহি। তার আগেই প্রচন্ড জোরে প্লেট পড়ার শব্দ। কয়েক টুকরো হয়ে দূরে পড়ে আছে। এখনো ঝনঝন শব্দ বাজছে। পাশেই শুঁটকির বোরাও পড়ে আছে। অনাদরে। ইশাদের চোখ রক্তলাল। কড়া চোখে বাবার দিকে তাকাতে উনি চেঁচিয়ে উঠলেন,

“আমার চোখের সামনে থেকে সাদা রঙ সরাও। এখনি। নাহলে সব ভেঙে ফেলব। আগুন জ্বালিয়ে দেব!”

শাহিনা শাইখা কেঁপে উঠলেন। সাদা রঙের টেবিল ক্লথটা সরাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। ইশাদ তখনো রেগে আগুন। মানুষটা বাবা নাহলে হাতটা বুঝি কেটেই ফেলতো। মায়ের রাত জাগা পরিশ্রমের এই মূল্য? কিন্তু তার বাবাকে তো এমন রাগতে দেখেনি কখনো। হ্যাঁ মায়ের সাথে দুর্ব্যবহার করে এটা জানে। তবে কখনো চেঁচিয়ে কথা বলে না। ঠান্ডা কন্ঠের তিক্ত কথা শোনায়। যার সাক্ষী সে নিজে। তাহলে আজ কী হলো? সামান্য সাদা রঙের টেবিল ক্লথ দেখে এমন কঠিন হুংকার? নাকি অন্যকিছু? ইশাদ মনে প্রশ্ন ফেলতেই পেছনের কেউ বাতাস বেগে পালিয়ে গেল। রুবিনা আন্টি? পালালো কেন? ভয় পেয়েছেন কি?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here