–তোমায় ভালবেসে যাব —–
— পর্ব তিন —
–লেখা অধরা জেরিন —
,,-
,,
আজ প্রতিটি ক্ষণে হৃদয়ে যে পরম সত্য অনুভব করলাম- আমি শুধুই তোমার। তোমার বুকে শেষ ঠিকানা আমি পেলাম। কখনই তা মিথ্যা হতে দিওনা, কখনই ছেড়না আমার দুটি হাত। আজ আমি ভীষণ ভাবে সুখী ।। তোমার হাত দু’টো, আর দৃষ্টি ঘুরিও না। ঐ অদ্ভুত সুন্দর চোখজোড়ার। যেখানে অপলক তাকিয়ে বৃষ্টির সাথে আমিও আনন্দ হয়ে ঝরেছিলাম! তোমাকে ভালবাসি প্রচণ্ড- এরচেয়ে কোনও সত্য আপাতত আর জানিনা!! ভালবাসি তোমায়!
,,
আমি রাতুল কে নিজের থেকে ও বেশি ভালবেসে ফেলেছি । এক মূহুর্ত ওকে ছাড়া বাঁচতে পারিনা। আর আমি ও রাতুলের কাছে ওর প্রান। রাতুল আগের থেকে অনেক সুস্থ । আমি যা বলি ওই তাই শোনে। বিয়ের কিছু দিন পর রাতুল কে চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নেওয়ার পর ও অনেক সুস্থ । কিন্তু ডাক্তার বলেছে রাতুল যেদিন পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে সেদিন ওর এই অসুস্থ কয়েক বছর এর কথা ভুলে যাবে । মনে পড়বে আগের সব পুরোনো কথা । এমনকী আপনাকে ও না চিনতে পারে । কিন্তু আস্তে আস্তে করে সব মনে করিয়ে দিলে আবার সব সৃতি ফিরে পাবে।
,,
আমি সেদিন ডাক্তারের সব কথা শুনে চমকে উঠেছিলাম । বার বার শুধু একটা কথা কানে বেজে উঠলো,, আপনাকে ও ভুলে যেতে পারে!!! রাতুল যদি আমাকে চিনতে না পারে ? দুরে ঠেলে দেয় ? না না আমি আর এই সব ভাবতে চাইনা। আমি রাতুল কে নিয়ে সারা জীবন কাটাতে চাই। কিন্তু আমি যখন রাতের শেষে রাতুলের বাহুতে নিজেকে আবিষ্কার করি যখন ওর ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে থাকি তখন নিজের অজান্তে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরে । মনে হয় আমি ওকে ঠকিয়ে যাচ্ছি । আমি রিয়া সেজে অভিনয় করতে করতে হাঁপিয়ে উঠেছি। মাঝে মাঝে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে আমি আর পারছি না নিজেকে আড়াল করতে । আমি আমার পরিচয়ে তোমার ভালবাসা পেতে চাই ।
,,
,,
দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের ছয় মাস কেটে গেল।
বিকেলে ছাদে ফুল গাছে পানি দিতে দিতে এই সব কথা ভাবছিলাম । হঠাৎ করে রাতুলের চিৎকার কানে এলো। ও জোড়ে জোড়ে আমাকে রিয়া বলে ডাকতে লাগলো । ওহ আমি তো ভুলে গিয়েছিলাম যে আজ আমাদের বাইরে ঘুরতে যাওয়ার কথা ছিল । রাতুল আমাকে বলেছিল তুমি তৈরি থেক আমি এসে তোমাকে ঘুরতে নিয়ে যাব। কিন্তু আমি সব ভুলে বসে আছি । আমি পিছনে ফিরতে দেখি রাতুল ছাদে চলে এসেছে । আমি ওকে বললাম তুমি আবার ছাদে আসলে কেন ? ও হঠাৎ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললো তুমি যাননা আমি তোমাকে এক মূহুর্ত না দেখলে থাকতে পারি না । আমার অনেক কষ্ট হয় । মনে হয় তোমাকে হারিয়ে ফেলছি। আমি ওর কথা শুনে হেসে দিয়ে বললাম তুমি একটা পাগল । আমি কোথায় হারাবো। এভাবে তোমার কাছে সারাজীবন থাকবো। ও আমাকে আরো কাছে টেনে নিয়ে বললো আচ্ছা রিয়া যদি কখনও আমাদের মধ্যে ঝড় আসে তুমি আমাকে ভুল বুঝে দুরে ঠেলে দেবে নাতো ? এখন কার মতো ভালবাসা দিয়ে আগলে রাখবে তো ?
,,
আমি ওর কথা শুনে চমকে উঠলাম । রাতুল হঠাৎ এই কথা বলছে কেন ? আমি ওকে বললাম আর কখনও এমন কথা বলবে না। আমি তোমাকে নিজের থেকেও বেশি ভালবাসি। তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না। আমার কথা শুনে সেদিন রাতুল খুব খুশি হয়েছিল ।
,,
রাতুল আমাকে বললো আজ আমরা বাইরে ডিনার করবো। আমি আর রাতুল বাইরে গেলাম । কিন্তু আমার শরীর টা খুব খারাপ লাগছিল । আমি রাতুল বললাম বাসায় ফিরে চলো। ও আমাকে নিয়ে বাসায় চলে এলো। কিন্তু দিন দিন আমার শরীর খারাপ হতে লাগলো। ডাক্তার বাসায় ডাকা হলো। আমাকে দেখার পর ডাক্তার সাহেব বললো আমি মা হতে চলেছি। এ কথা শুনে সারা বাড়ি খুশিতে মেতে উঠলো। সবাই খুব খুশি । রাতুলের চোখে মুখে আনন্দ চিকচিক করছিল । ও আমাকে আগের থেকে আরো কেয়ার করতে লাগলো। আমাকে বিছানা থেকে নামতেই দেয়না। ওর এই সব পাগলামি দেখে আমার আনন্দে চোখে পানি চলে আসে । আমার কপালে এতো সুখ সইবে তো ???
,,
আমার শশুড় শাশুড়ি এরই মধ্যে নাতি নাতির কি নাম রাখবে সেইটা নিয়ে ঝগড়া করতে লাগলো। তাদের এই ছেলেমানুষি দেখে সবাই হাসাহাসি করতে লাগলো। অনেক দিন মা আর ছোট বোন টার জন্য খারাপ লাগছিল । খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল । আমি একদিন রাতুল কে বললাম আমাকে বাড়িতে নিয়ে চলো । সবাই কে অনেক দেখতে ইচ্ছে করছে । ও কিছু সময় মনটা খারাপ করে বললো তোমাকে যেতে দিতে পারি কিন্তু দুইদিনের বেশি থাকতে পারবে না । তোমাকে ছাড়া আমি থাকতে পারি না । আমি ওকে বললাম ঠিক আছে আমি মাত্র দুইদিন থেকে চলে আসবো। এবার একটু হাসো। ও হেসে দিয়ে বললো ঠিক আছে মনে থাকে যেন । তুমি আমাদের ড্রাইভার এর সাথে চলে যাও। আমার একটা খুব জরুরি মিটিং আছে । কাল আমাকে সিলেট যেতে হবে । আমি শশুড় শাশুড়ি থেকে অনুমতি নিয়ে মায়ের কাছে চলে এলাম। অনেক দিন পর আমাকে দেখে সবাই খুব খুশি । আমার নিজের কাছে ও ভাল লাগছে । আশেপাশের অনেকে আমাকে দেখতে এলো। এতো বড়ো বাড়ির বউ বলে কথা । আমার নিজের কাছে ও খুব হাসি পেত। যখন আশেপাশের কোনও বড়োলোক বাড়িতে বিয়ে হতো তখন অনেক সপ্ন এসে দু চোখে বাসা বাধতো।
,,
রাতে খাওয়া দাওয়া করে অনেক গল্পগুজব করলাম । এরই মধ্যে রাতুল অনেক বার ফোন করে আমার খোঁজ খবর নিয়েছে। বার বার ওর অনাগত সন্তান এর খেয়াল রাখতে বলেছে। আমি হেসে দিয়ে ওকে বলেছি আচ্ছা তুমি এতো পাগল কেন । আমার কিচ্ছু হবে না । আমি ঠিক সময় মতো চলে আসবো । তুমি নিজের খেয়াল রেখ। রাতে ঘুমিয়ে পড়লাম । রাতে খুব খারাপ একটা সপ্ন দেখলাম । দেখতে পেলাম কে যেন রাতুল কে আমার কাছ থেকে টেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে অনেক দুরে। আমি চিৎকার করে রাতুল কে ডাকতে লাগলাম । কিন্তু রাতুল আমার দিকে ফিরে ও তাকাচ্ছে না। ও চলে যাচ্ছে আমার কাছ থেকে দুরে অনেক দুরে !!!!!
,,
আমার ঘুম ভেঙে গেল । সমস্ত শরীর ভিজে গেছে । আমি এক গ্লাস পানি খেলাম। ফোন টা হাতে নিয়ে বসে আছি। এখনই ইচ্ছে করছে ওর সাথে কথা বলতে । কিন্তু আবার ভাবছি ঘুমিয়ে আছে কাল কথা বলবো । আবার মন খারাপ লাগছে খুব । ফোন টা দিয়ে বসলাম । কিন্তু ফোন ঢুকছে না । একি ওর ফোন বন্ধ কেন ?? ও তো কখনও ফোন বন্ধ করে রাখে না। ওর কোনও বিপদ হলো নাতো ?? আমার অস্থিরতা বেড়ে যেতে লাগলো । আমি বার বার ফোন করতে লাগলাম । আমার সপ্ন আবার সত্যি হতে চলছে নাতো। যদি রাতুল আগের সব সৃতি ফিরে পায়। আমাকে যদি মেনে না নেয়। আমার সন্তান কে যদি পিতৃত্বের পরিচয় দিতে অস্বীকার করে ????
,,
আমার দুচোখ বেয়ে জলের ধারা গড়াচ্ছে, কিছুতেই থামাতে পারছিনা আমি। আমার খুব ইচ্ছে করছে এখান থেকে ছুটে পালিয়ে যাবার। আমি সহ্য করতে পারছি না কিছুতেই। একেবারেই সহ্য করতে পারছিনা এই পরিস্থিতি।
আমি খুব অস্থির হয়ে গেলাম । এতো রাতে কাকেই বা ফোন দেব। আমি ঠিক করলাম সকালে ফিরে যাবো । কারণ এই সপ্ন আমাকে বার বার মনে করিয়ে দিচ্ছে যে রাতুলের কোনও বিপদ হলো নাতো ? আমি সকালে ড্রাইভার কে খবর পাঠালাম । বাড়িতে চলে এলাম। আমাকে দেখে সবাই খুব অবাক । বললো কেন এতো সকালে চলে এলাম ? আমি আমার শাশুড়ি কে বললাম রাতুল কোথায় ? তিনি বললেন কাল রাতে রাতুল সিলেটে চলে গেছে । আর বলেছে রিয়া শুনলে চিন্তা করবে তাই ওকে পৌছে জানাবো । আমি বললাম কাল রাত থেকেই ওর ফোন বন্ধ পাচ্ছি। আমার অনেক চিন্তা হচ্ছে । শশুড় বললো তুমি কোনও চিন্তা করো না। পৌছে ঠিক তোমাকে ফোন করবে ।
,,
এই ভাবে আমার সারাদিন কেটে গেল । ওর কোনও খোঁজ নেই। এবার বাসার সবাই চিন্তায় পড়ে গেল । আমার শশুড় আর দেরি না করে সিলেট লোক পাঠিয়ে দিলেন । আমরা খবর পেলাম রাতুল এক্সসিডেনট করে সিলেটে হাসপাতালে ভর্তি । আমি খবর পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে পড়লাম । যখন জ্ঞান ফিরলো দেখি আমার সামনে ডাক্তার বসে আছে । আমি আমার শশুড় কে বললাম আজই আমি সিলেট যাব। তিনি বললেন ঠিক আছে তুমি আগে সুস্থ হও তারপর অবশ্যই আমরা সিলেট যাব। কিন্তু আমার জেদাজেদিতে পরে তিনি ঠিক করলেন আজই আমরা সিলেট যাব। আমরা সিলেট গিয়ে সোজা হাসপাতালে চলে গেলাম ।রাতুল মাথায় আঘাত পেয়েছে । ওকে অপারেশন থিয়েটার এ নেওয়া হয়েছে । আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি । যতো সময় যাচ্ছে আমি কষ্টের সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছি । এমন সময় দেখতে পেলাম খুব সুন্দরী একটা মেয়ে আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালো । তাকে দেখে আমার শশুড় শাশুড়ি ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো । আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। এমন সময় দেখতে পেলাম আমার শাশুড়ি মেয়েটাকে দেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো। আর বললো কোথায় ছিলি এতো দিন রিয়া ?
চলবে?