#তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে,পর্ব:৪,৫
#লেখা:মৌলী আখন্দ
#পর্ব:৪
এলিনা ভেবেছিল পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রেগে যাবে রাইয়ান। কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সে কিছুই বলল না।
বরং অপরাধী মুখ করে ঘুরতে লাগল।
“স্যরি এলি, এত্ত টায়ার্ড ছিলাম সাইট ভিজিট করে…“
মাথা চুলকাতে লাগল রাইয়ান। আচমকা এলিনার অন্যরকম ভালো লাগতে শুরু করল। রাইয়ানের পছন্দ অতিরিক্ত কড়া কফি।
সেই কফি এতদিন তেতো লাগত এলিনার কাছে। এখন সেই কফিও মিষ্টি লাগতে শুরু করল।
একই সাথে প্রবল ভয় তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। সে কি তাহলে রাইয়ানের ওপরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে?
খুব আহামরি কোনো নাস্তা না। জেলি ব্রেড সাথে কড়া কফি।
ওরা খাচ্ছিল মাটিতে ম্যাট্রেসের ওপরে বসে। এলিনা তাড়াতাড়ি বড় বড় চুমুকে কফি গিলে ব্রেড হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।
কৈফিয়তের সুরে বলল, “সময় নেই, দেরি হয়ে গেছে!”
মাথা ঝাঁকাল রাইয়ান। নিজেও উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো, তোমাকে পৌঁছে দিই!”
“না না, তুমি আরাম করে নাস্তা কর। তোমার তো সময় আছে!”
এলিনার শত প্রতিবাদের মুখেও মানল না রাইয়ান। অবিশ্বাস্য দ্রুত গতিতে তৈরি হতে শুরু করল।
রাইয়ান নামিয়ে দিলে ঠিক অফিসের সামনে কখনোই নামে না এলি। এক গলি আগেই নেমে গিয়ে পায়ে হেঁটে অফিসে ঢোকে।
আজকেও তাই করল। সময়ের আগেই চলে এসেছে সে।
এলিনা যে রুমটায় বসে, ছোট ছোট কিউবিকলে আরো তিনজন বসে সেই রুমে।
কেউই এখনো এসে পৌঁছায়নি। নিজের ডেস্কে বসে হাত বিছিয়ে দিয়ে হাতের ওপরে থুতনি ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে ভাবতে শুরু করল।
পারিবারিক বন্ধনের ব্যাপারে বরাবরই একটা ভীতি কাজ করত ওর মধ্যে। অনাথাশ্রমে বড় হলেও এলিনা আসলে অতীতহীন নয়।
এলিনার বাবা ছিল পরনারীতে আসক্ত। তাকে ফেরানোর চেষ্টা করে এক পর্যায়ে বোধ হয় হাঁপিয়ে উঠেছিল তার মাও।
এলিনাকে খুব ছোট রেখে বয়ফ্রেণ্ডের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল সে। সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল ওর ব্যাবসায়ী বাবার সঞ্চিত টাকাপয়সার প্রায় সবটাই।
শোকের ধকলটা সহ্য করতে পারেনি এলিনার বাবা। আত্মরক্ষার উদ্দেশ্যে সাথে রাখা লাইসেন্স করা পিস্তলটা কপালে ঠেকিয়ে নিজেই স্বাক্ষর করেছিল নিজের মৃত্যুর পরোয়ানায়।
আর তারপর, এলিনার আত্মীয় স্বজনেরা সংখ্যায় নিতান্ত কম না হলেও প্রায় কপর্দকশূন্য একজনের অনাথ বাচ্চার দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি কেউই। কেউ একজন দয়া করে অনাথাশ্রমে রেখে এসেছিল বলে রক্ষা।
এলিনা অনাথাশ্রমের সেই সব অল্প সংখ্যক বাচ্চাদের মধ্যে একজন যারা নিজেদের মায়ের নাম আর বাবার নাম জানে, জেনেও অনাথাশ্রমে থাকে। এইসবই এলিনা জানতে পেরেছিল অনেক পরে, বড় হয়ে।
একটা বয়স পর্যন্ত এলিনা বিশ্বাস করত মা তাকে নিতে আসবে। বয়ঃসন্ধিতে এসে এই ভুল ধারণা ভেঙে যায় তার।
আর তারপর থেকেই এলিনা ঠিক করে রেখেছিল এইসব ভালোবাসা, বিয়ে, সংসারের ফাঁদে পড়বে না। কিন্তু রাইয়ান…
হি ওয়াজ সামথিং ডিফরেন্ট। সে এলিনাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল।
এলিনার জানালা থেকে দেখা যাচ্ছে ধীরে ধীরে লোক ঢুকছে অফিস কম্পাউণ্ডে। আস্তে আস্তে বাড়ছে লোক সমাগম।
দরজা ফাঁক করে ভেতরে ঢুকল সিমি, এলিনার কলিগ। এই রুমেই বসে।
“গুড মর্নিং”, সম্ভাষণ করল সিমি।
“মর্নিং”, সংক্ষেপে প্রত্যুত্তর করল এলি। তারপর নিজেকে জোর করে টেনে নামিয়ে আনল ভাবনার ভুবন থেকে বাস্তবের জগতে।
রাইয়ানের সাথে খুব বেশি ইমোশনালি ইনভলভড হওয়া যাবে না। বাঁধ দিতে হবে নিজের মনকে।
চলবে
#তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে
।।৫।।
রাইয়ানের সাথে এলিনার পরিচয়ের ঘটনাটাও ভীষণ অদ্ভুত। সেই রাতে উইক এণ্ডের আগের রাতের গেট টুগেদার পার্টি শেষ করে বাসায় ফিরছিল এলিনা।
বেশ খানিকটা রাতই হয়ে গিয়েছিল ফিরতে ফিরতে। হাতির ঝিলের এই কোণাটায় যেখানে স্ট্রিট ল্যাম্পটা নষ্ট ছিল, সেখানে আসতেই কানে চাপা ধস্তাধস্তি আর মৃদু আর্তনাদের শব্দ।
এলিনার মধ্যে ভয় ডর কম বরাবরই। আর আত্মরক্ষার প্রাথমিক কৌশলগুলো জানা থাকায় বাইক থামিয়ে ছুটে গিয়েছিল সে কোনো রকম দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছাড়াই।
গিয়ে দেখেছিল ভয়ে আতঙ্কে কিংবা অনেকক্ষণ মুখে হাত চাপা দিয়ে রাখার জন্য, যে কারণেই হোক, অজ্ঞান হয়ে গেছে মেয়েটি। আর আততায়ীও তিনজন।
এলিনার সাহস যতই থাকুক, একা তিনজনের সাথে পাল্লা দিয়ে এঁটে ওঠা ওর কর্ম ছিল না। কিন্তু এত রাতে এই নির্জন রাস্তায় কেউ আসবেও না।
মেয়েটাও আর জ্ঞান হারানোর সময় পেল না, এমনটাই ভাবছিল এলিনা। অন্তত ওর হুঁশ থাকলে হাত ধরে খিঁচে একটা দৌড় দেওয়া যেত।
এখন না পারছে ওকে ফেলে রেখে যেতে, আর না পারছে এদের সাথে পাল্লা দিতে। মনের মধ্যে ভয় এসে উঁকিঝুঁকি দিতে চাইলেও সেটাকে পাত্তা দিতে চাইছিল না এলিনা।
ভয় এসে গ্রাস করে বসলেই ও শেষ হয়ে যাবে, ভালো করেই বুঝতে পারছিল সে।
ঠিক এমনই সময়ে কোথা থেকে যেন উদয় হয়েছিল রাইয়ান। কোনো রকম সতর্ক হওয়ার সুযোগ না দিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শয়তানগুলোর ওপরে।
বেগতিক দেখে রাইয়ানের গায়ে ছুরি বসিয়ে দিয়ে ছুটে পালিয়েছিল ওরা। আর বহু কষ্টে মুখে মাথায় অসুস্থ মেয়েটার জ্ঞান ফিরিয়ে এনে ওকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল ওরা।
প্রেম বড় বিচিত্র জিনিস, কখন কোথায় কার হৃদয়ে তীর বসিয়ে দেয় আগে থেকে কখনো বলা যায় না। রাইয়ানের ক্ষত মেজর কিছু ছিল না, সামান্য ড্রেসিং এই সেরে যেত।
কিন্তু হাসপাতালের লাউঞ্জে বসেই সেদিন শেষ রাতে রাইয়ানের ব্যাণ্ডেজের ওপরে গভীর মমতায় স্পর্শ করেছিল এলিনা। ভেসে গিয়েছিল তার কখনো প্রেমে না পড়ার প্রতিজ্ঞা।
অবশ্য এত সহজেও হয়নি সবকিছু। বহুদিন ধরে এলিনার মন গলাতে অনেক কিছু করতে হয়েছে রাইয়ানকে।
এলিনাও নিজের মনের সঙ্গে মিথ্যা বলে গেছে ক্রমাগত। নিজেই অস্বীকার করে গেছে প্রেমে পড়ার বিষয়টা।
তবু সকালে ঘুম ভাঙতেই রাইয়ানের মুখটা ভেসে উঠত চোখের সামনে। কথা বলতে বলতে নিচের ঠোঁট কামড়াত রাইয়ান।
সামনের চুলগুলো একটু বড় রাখে রাইয়ান, অফিসে যাওয়ার সময়ে জেল দিয়ে ব্যাক ব্রাশ করে যায়, এমনিতে অগোছালো থাকলে মাঝে মাঝে কপালে চলে আসে। রাইয়ানের সামনে এসে পড়া চুলের গোছা, অন্যমনস্কভাবে নিচের ঠোঁট কামড়ানো, ওর হাতের কালো ব্রেসলেট, বাইকে উঠে হাতে গ্লাভস পরে নেওয়ার দৃশ্যটা…
ধীরে ধীরে খুন হতে শুরু করে এলিনা। তারপর একদিন আর বাধা দিতে পারে না।
চুমু খাওয়ার সময় রাইয়ানের সামনে এসে পড়া চুলগুলো খুব বিরক্ত করে এলিনাকে। হাত দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে, “চুল আটকে আসতে পারো না?”
রাইয়ান হাসে, খুব জানে চুমু খাওয়ার সময় এই চুলের সুড়সুড়ি এলিনার কত পছন্দ। এলিনাকে খুব বোঝে সে, এটাও বুঝত সে ধরে বেঁধে বিয়ে না করলে এলিনা জীবনেও বিয়ের কথা বলবে না, রাজিও হবে না।
রাইয়ানের হাতে কালো ব্রেসলেটটা দেখলে এখনো শিহরণ জাগে এলিনার। ওর ওপরে আবেগীয় নির্ভরশীল না হওয়ার শপথ উড়ে যেতে চায়।
মন চায় বলে, “আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি! খুব খুব খুব বেশি! সারা জীবন এভাবে আমাকে আগলে রাখবে তো?”
কিন্তু এলিনা ভয় পায় বিশ্বাসভঙ্গের, ভয় পায় সম্পর্কের বদলে যাবার। তাই সে কিছুই বলে না।
উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে না। ভালোবাসার দারুণ উত্তপ্ত লাভা পেলেপুষে গোপনে লুকিয়ে রাখে বুকের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির গহীনে।
চলবে