#তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে,পর্ব:৬,৭
#লেখা:মৌলী আখন্দ
#পর্ব:৬
এলিনা আর রাইয়ানের সংসার চলছে অদ্ভুত লুকোচুরির মধ্য দিয়ে। এলিনার মনে হতে থাকে সবাই যেন সবার সাথে চোর পুলিশ খেলছে।
রাইয়ানের বাসায় জানে না এলিনার সাথে সংসার পাতার কথা, জানে না এলিনার অফিসেও। রাইয়ান জানে না এলিনা ডুবছে ভাসছে ভালোবাসার উথালপাথাল স্রোতে।
এরই মাঝে এগিয়ে আসছে ডেডলাইন, এলিনার অফিসে সবার মাথায় দুশ্চিন্তার ভার। অফিসের কিছুই রাইয়ানকে শেয়ার করে না এলিনা।
এক রাতের ভালোবাসাবাসির মুহূর্তে এলিনাকে অন্যমনস্ক দেখে ওকে ছেড়ে দিল রাইয়ান। তারপর উলটো দিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়ল চুপচাপ।
দুয়ের মুহূর্তে লেগে গেল এলিনার এটা বুঝতে যে, ভীষণ অভিমান হয়েছে রাইয়ানের। এলিনা চেষ্টা করল রাইয়ানকে নিজের দিকে ফেরাতে, কিন্তু শক্ত হয়ে রইল সে।
রুক্ষ স্বরে বলল, “রাত হয়েছে ঘুমাও। আবার তো সকালে উঠতে হবে।“
থমকে গেল এলিনা। এর আগে কখনো তার সাথে এমন রূঢ় ভঙ্গিতে কথা বলেনি রাইয়ান।
অন্য পাশে ফিরে ঘুমাতে চেষ্টা করল কিন্তু অবাধ্য চোখের জল বাধা মানছে না। টুপ টাপ ঝরে পড়তে শুরু করে দিয়েছে বালিশের ওপরে।
অল্প কিছু মুহূর্ত পরেই রাইয়ান জোর করে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল ওকে। রাইয়ানের স্পর্শেই শরীর শিথিল হয়ে যায় ওর, গায়ের জোরে পারল না এলিনা।
“নিজেই খারাপ ব্যবহার করে আবার নিজেই কান্নাকাটি করা হচ্ছে?”
“আমি কখন খারাপ ব্যবহার করলাম?”
“নয়তো কী? তুমি কিছু শেয়ার করবে না, আবার আশাও করবে আমি সব কিছু বুঝে নেব?”
হাল ছেড়ে দিল এলিনা। হতাশ কন্ঠে বলল, “আমি আর পারছি না!”
রাইয়ান ওর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “কী হয়েছে? আমাকে বল!”
“লিকুইড নাইটোজেন ছাড়া আর কোনো সলিউশন নেই! অথচ বাজেট এক্সিড করে যাচ্ছে!”
“লিকুইড নাইট্রোজেন দরকার তোমাদের? আমি আরিয়ান কেমিক্যালসে কথা বলে দিচ্ছি! মার্কেট প্রাইসের চেয়ে কম দেবে তোমাদেরকে!”
উত্তেজিত হয়ে উঠে বসল এলিনা। “সত্যি?”
হাসল রাইয়ান। “শুধু তুমিই আমায় দাম দিলে না, সখী!”
এত সহজে সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে, ভাবতেও পারছে না এলিনা। কাঁপা গলায় বলল, “তুমি কালকেই ওদের সাথে কথা বলে প্রাইস ফাইনাল কর। তারপর আমি বসদের জানাই।“
“জানাও। আর এখন এসব মাথা থেকে বের কর। এই অফিসের জ্বালায় একটু শান্তি পেলাম না!”
লজ্জা পেয়ে গেল এলিনা। বিব্রত এলিকে বুকের ওপরে টেনে এনে আদরে ভরিয়ে দিল রাইয়ান।
চুমুর ফাঁকে ফাঁকে মৃদু স্বরে বলতে লাগল,
“তোমায় আমি দেখেছিলাম বলে
তুমি আমার পদ্মপাতা হলে;
শিশির কণার মতন শূন্যে ঘুরে
শুনেছিলাম পদ্মপত্র আছে অনেক দূরে
খুঁজে খুঁজে পেলাম তাকে শেষে।
নদী সাগর কোথায় চলে ব’য়ে
পদ্মপাতায় জলের বিন্দু হ’য়ে
জানি না কিছু-দেখি না কিছু আর
এতদিনে মিল হয়েছে তোমার আমার
পদ্মপাতার বুকের ভিতর এসে।
তোমায় ভালোবেসেছি আমি, তাই
শিশির হয়ে থাকতে যে ভয় পাই,
তোমার কোলে জলের বিন্দু পেতে
চাই যে তোমার মধ্যে মিশে যেতে
শরীর যেমন মনের সঙ্গে মেশে।
জানি আমি তুমি রবে-আমার হবে ক্ষয়
পদ্মপাতা একটি শুধু জলের বিন্দু নয়।
এই আছে, নেই-এই আছে নেই-জীবন চঞ্চল;
তা তাকাতেই ফুরিয়ে যায় রে পদ্মপাতার জল
বুঝেছি আমি তোমায় ভালোবেসে।
(কবিতা ঋণ জীবনানন্দ দাশ)
চলবে
#তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে
।।৭।।
গভীর রাত পর্যন্ত ল্যাপটপে কাজ করছিল এলিনা। আজকাল প্রায়ই রাত হয়ে যায় কাজ করতে করতে।
অফিস থেকে আগেই ফেরে রাইয়ান, দুজনের কাছেই দুটো চাবি আছে। দুজনেই বাইরে থেকে তালা খুলে বাসায় ঢুকতে পারে।
এলিনা আজকে বাসায় ঢুকে দেখেছে রাইয়ান বিছানায় উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। তার ঘুম না ভাঙিয়েই রাতের খাবার রেডি করে রেখে কাজ করতে বসে গিয়েছিল ও।
আচমকা মাথায় স্পর্শ পেয়ে চমকে উঠল এলিনা। রাইয়ান সদ্য ঘুম ভাঙা জড়ানো কন্ঠে বলল, “কখন এসেছ, আমাকে ডাকোনি কেন?”
এলিনার মুখ থমথমে। সে রাইয়ানের দিকে সরাসরি তাকাল না।
“কী হলো, কথা বলছ না যে?”
ঘুরে বসল এলিনা। কঠিন গলায় বলল, “তুমি আমার ল্যাপটপে হাত দিয়েছিলে?”
“মানে?”
“তুমি জানো না আমার ল্যাপটপে প্রোটেকশন দেওয়া? পেন ড্রাইভ ঢোকালে, ঘাঁটাঘাঁটি করলে আমি টের পাই?”
এলিনা নিজের ল্যাপটপ নিয়ে যায় না অফিসে। ল্যাপটপ বাসাতেই থাকে।
অফিসের ডেস্কটপ আর ট্যাব দিয়ে বাইরের কাজ সারে। ল্যাপটপের পাসওয়ার্ড জানাই ছিল রাইয়ানের, পাসওয়ার্ড বদলানোর কোনো প্রয়োজন বোধ করেনি এলিনা।
কিন্তু আজকে তার ল্যাপটপ খোলা হয়েছিল, একটা পেন ড্রাইভ ঢোকানো হয়েছিল। রাইয়ান ছাড়া আর কারো কাজটা করার সুযোগ নেই।
রাইয়ান আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য কিছু বলতে যাচ্ছিল। এলিনা দুহাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, “লিসেন। আমার এখানে কিছু ক্লাসিফায়েড ইনফরমেশন থাকে। সেগুলো রেস্ট্রিক্ট করা। আমার অফিসের সিক্রেট। জনসাধারণের জানার জন্য না।“
রাইয়ান আহত গলায় বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস কর না?”
“তুমি বলতে চাচ্ছ তুমি খোলোনি আমার ল্যাপটপ? ঢোকাওনি কোনো পেন ড্রাইভ?”
“আমি একটা মুভি দেখতে চেয়েছিলাম শুধু, আর তাতে এত ঝামেলা হবে জানলে নিশ্চয়ই ধরতাম না তোমার ওই ক্লাসিফায়েড ল্যাপটপ!”
“তুমি মিথ্যা বলছ!”
বরফ শীতল কণ্ঠে বলল এলিনা।
“তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি আমার প্রত্যেকটা ড্রাইভ ঘেঁটেছ। কী খুঁজছিলে তুমি, রাইয়ান?”
রাগ দেখিয়ে চলে গেল রাইয়ান। এলিনা কিছুক্ষণ বসে রইল থমথমে মুখে।
রাইয়ান সে রাতে রাগ করে কিছু খেল না। না খেয়েই শুয়ে পড়ল বিছানায়।
অনেক বার হাত ধরে টানাটানি করল এলিনা। বার বারই হাত ছুঁড়ে ফেলে দিল রাইয়ান।
খিদে সহ্য করতে পারে না এলিনা, সে খেয়ে নিল একা একাই। রাইয়ানের কথা সে বিশ্বাস করেছে।
তবুও ল্যাপটপে পাসওয়ার্ড বদলে দিল সে। হয়ত এতদিন ধরে বদলে না দেওয়াটাই ভুল ছিল তার।
বহুদিন পর দুজন জেগে রইল অনেক রাত পর্যন্ত, সেই প্রেমের দিনগুলোর মত, যখন দুজন রাত জেগে চ্যাট করত। অথচ দুজনের মধ্যে একটিও বাক্য বিনিময় হলো না।
চুপচাপ দুদিকে ফিরে গভীর ঘুমের ভান করে নিশ্চুপ পড়ে রইল দুজনে।
চলবে