তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে #পর্ব-১

0
1266

#তোমায়_আমি_দেখেছিলেম_বলে
#পর্ব-১
#লেখা:মৌলী আখন্দ
(১৮+)

ফোনে ক্রমাগত ভাইব্রেশন হচ্ছে। সূক্ষ্ম হলেও কম্পনটা বিরক্ত করছে এলিনাকে।
মনঃ সংযোগে ব্যাঘাত ঘটছে। এলিনা সামনের স্ক্রিনের দিক থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই মোবাইল ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে এনে কলটা কেটে সুইচড অফ করে দিল ভাবলেশহীন মুখে।
দুই এক মুহূর্তের ব্যাপার, কিন্তু বস পাথরের মত মুখ করে বলে উঠলেন, “এনিওয়ান হু হ্যাজ এনি আদার প্রায়োরিটি এক্সেপ্ট দিস মিটিং ক্যান লীভ দিস রুম।“
প্রমাদ গুণল এলিনা। বস চটলে খবর আছে।
নিজের ডেস্কে বসেই সামনের দিকে ঝুঁকে এল এলিনা। কলম কামড়াচ্ছে নার্ভাস মুখে।
এখনকার মত ডোজ দেওয়া যথেষ্ট হয়েছে বুঝেই আবার প্রেজেন্টেশনের দিকে ঘুরলেন বস। বোঝাতে লাগলেন ডায়াগ্রামটা।
অন্য সবার মত এলিনাও চিন্তিত। নতুন যে শিপমেন্টটা তারা লঞ্চ করতে চাইছিল সামনের রোজার মাসে ইদ উপলক্ষ্যে, এটা তাদের কোম্পানির জন্য খুব ভালো এসেট হতে পারত।
অধুনা বিলুপ্ত প্রায় একটা ফাইবার তারা পুনর্জীবিত করেছে নারায়ণগঞ্জ থেকে, ওই বংশের এক মাত্র বেঁচে থাকা অশীতিপর এক বৃদ্ধের নির্দেশনা অনুযায়ী শুনে শুনে তাঁতির হাতে নিপুণভাবে বানানো হয়েছে এক্সক্লুসিভ এক মসলিন, যা সমসাময়িক অন্যান্যদের টেক্কা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে ভালোভাবেই। কানাডা থেকে ইম্পোর্ট করে আনা হয়েছে বিশেষ এক ফেব্রিক যা বসবে ওই মসলিনে।
এই ইদে একচেটিয়া ব্যবসা করবে কিবরিয়া গ্রুপ। কেউ তাদের টপকাতে পারবে না।
এরকমই এক লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছিল সবাই। কিন্তু আচমকা উদ্ভুত হলো এক অপ্রত্যাশিত সমস্যার।
ফাইবারে সেই ফেব্রিকটা কোনোভাবেই বসছে না। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় না গেলে ফাইবারটা রঙটা নিচ্ছে না।
হিমাংকের নিচে ওই তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে গেলে যে বিপুল খরচ হবে তা করতে গেলে কোনো প্রফিট অবশিষ্ট থাকবে না হাতে। বাজারের অন্যান্য মসলিনের চেয়ে দামটা অনেক বেশি পড়ে যাবে। এত দাম দিয়ে কোনো কাস্টমার কিনতে চাইবে না তাদের মসলিন।
আজকের ইমার্জেন্সি মিটিং সেই জন্যই কল করা হয়েছে। আর এই মিটিং এ এলিনা একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
এলিনা হক রাস্না, কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। এলিনা শব্দের অর্থ হলো শাইনিং লাইট। আর রাস্না একটা ফুলের নাম। ডাকনামটা অবশ্য অব্যবহারে বিলুপ্ত প্রায়।
মুশকিল হচ্ছে আজকে রাইয়ানের সাথে ডেট ফিক্সড করা ছিল। এলিনা যদিও ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকায়নি, প্রেজেন্টেশনের ওপরে চোখ নিবদ্ধ রেখেই কলটা কেটে দিয়েছে, তারপরও সে জানে কলটা রাইয়ানেরই ছিল।
রাইয়ানের দোষ নেই। সে তো জানে এলিনার অফিস পাঁচটা পর্যন্ত।
সাড়ে চারটায় যে বস সব এক্সিকিউটিভদের নিয়ে ইমার্জেন্সি মিটিং কল করবেন তা কে জানত? আসন্ন সংকট থেকে উত্তরণের কোনো একটা পথ বের করতেই হবে।
ইতোমধ্যেই এই প্রোজেক্টে যথেষ্ট ইনভেস্ট করা হয়ে গিয়েছে, এখন আর পিছিয়ে আসার কোনো পথ নেই। এখন দায় এসে পড়েছে এলিনাদের ঘাড়ে, কেন হোম ওয়ার্ক করে নেওয়া হয়নি যে, ওই বিশেষ ফাইবারে এই রঙটা বসবে না।
যদিও এলিনা একজন জুনিয়র এক্সিকিউটিভ, তারপরও যথেষ্ট এফিশিয়েন্ট এবং পটেনশিয়াল। বস তার মতামতকে গুরুত্ব দেন।
মিটিং এ মন দিল এলিনা। তার মন তন্ন তন্ন করে খুঁজছে একটা সমাধান।
একটা ম্যাজিক, একটা মিরাকল। আর বেশি দিন সময়ও বাকি নেই।
ফাইবার এবং ফেব্রিকের কেমিক্যাল স্ট্রাকচার এবং প্রোপার্টি নিয়ে মতবিনিময় চলছে। আলোচনার মাধ্যমে যদি কিছু বেরিয়ে আসে।
মিটিং চলল টানা সাড়ে তিন ঘন্টা। সাড়ে সাতটায় যখন বসের বাক্য বাণে বিধ্বস্ত হয়ে বেরিয়ে এল সবাই তখন এলিনার মনে পড়ল ফোনটা চালু করার কথা।
অন্য সবার সাথে কনফারেন্স রুমের সামনের লিফটে উঠল না সে। সিনিয়রদের আগে যেতে দিল।
তারপর ছুটে গেল বিল্ডিং এর অন্য প্রান্তে। ছুটতে ছুটতেই অন করল ফোনটা।
অন করতেই টুং টাং মেসেজ। এপাশের লিফটে উঠে ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখল এলিনা।
তারপর ফিক করে হেসে ফেলল। রাইয়ান লিখেছে,
“এলি এলি,
তুই কই গেলি?”
এরপর আরেকটা,
“রাস্না ও রাস্না
ছেড়ে তুই যাস না!”
আপনমনেই মাথা নাড়তে নাড়তে হাসতে হাসতে বলল এলিনা, “ওঃ নো! ইম্পসিবল ম্যান!”
লিফট নিচে নেমেছে। এপাশের লিফট যেখানে এসে থামে সেটা অফিসের পেছন দিক।
ইচ্ছে করেই এই লিফটে নেমেছে এলিনা। সামনে দিয়ে এখন সব বসরা বের হবেন।
কী প্রয়োজন তাদের সামনে দিয়ে বয়ফ্রেণ্ডের সাথে দেখা করবার, তাও আবার কোম্পানির এই বিপর্যয়ের সময়ে? তার ওপরে রাইয়ান কী রঙ ঢং শুরু করে দেয় তার নেই ঠিক।
পকেট থেকে বাইকের চাবি বের করে গ্যারেজের দিকে এগিয়ে গেল এলিনা। কানে ফোন।
ফোনে রিং বাজছে, তুলছে না রাইয়ান। রাগ হয়েছে নাকি বাবুর?
গ্যারেজের সামনে ফুল বাগানের সামনে একটা টুলে বসে ঢুলছে রাইয়ান। মাথাটা হেলান দিয়ে থামের সাথে লাগানো।
দেখে এলিনার এত মায়া হলো যে বলার নয়। কাছে গিয়ে আলতো করে কপালের চুলগুলো আঙুল দিয়ে আঁচড়ে দিল সে।
ধড়মড় করে জেগে উঠল রাইয়ান। উঠে সদ্য ঘুম ভাঙা লাল চোখে এলিনার দিকে তাকিয়ে বলল, “এতক্ষণে আসার সময় হলো রাজকুমারীর?”
কানে ধরল এলিনা, “স্যরি স্যরি জান! আর্জেন্ট মিটিং পড়ে গেল!”
“হু! শুধু শুকনো স্যরিতে কাজ হবে না! এর পানিশমেন্ট কী হবে বল তো?”
পানিশমেন্ট কী, সেটা এলিনা ভালোমতই জানে। শাস্তি স্বরূপ আজ রাতে রাইয়ানের ফ্ল্যাটে থাকতে হবে এলিনাকে।
যদিও রাইয়ানের সঙ্গ এলিনা উপভোগই করে, সেই হিসেবে কোনোভাবেই এটাকে শাস্তি বলা যায় না, কিন্তু এলিনা ইচ্ছে করেই যন্ত্রণার একটা শব্দ করল। সে জানে একবার যদি রাইয়ান বুঝে ফেলে যে তার সাথে রাত্রি যাপনের জন্য এলিনাও সাগ্রহে অপেক্ষা করে তাহলে আর কোনোভাবেই বাধা মানবে না। পাকাপাকিভাবে রাইয়ানের ফ্ল্যাটে উঠে যাবার জন্য জোর করবে তখন।
দীর্ঘদিনের প্রেম থাকলেও এলিনা ঠিক লিভ টুগেদার করতে চাইছে না। এর পেছনের কারণ বিয়ে নিয়ে কোনো সংস্কার নয়।
এলিনা ক্যারিয়ারটাকে একটু এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আগে রাইয়ানের সাথে এক বাড়িতে একত্রবাস করতে আগ্রহী নয়। প্রতিদিনই অফিস থেকে ফিরে তার নিজস্ব কিছু কাজ থাকে।
প্রায় দিনই সে রান্না করে না, স্যুপ নুডলস কিছু একটা দিয়ে কাজ চালিয়ে নেয়। রাইয়ানের সাথে এক বাড়িতে থাকলে সেটা সম্ভব হবে না।
তার চেয়ে এই ভালো, প্রেম প্রেম খেলা। সময় তো আর পালিয়ে যাচ্ছে না।
সিনিয়র এক্সিকিউটিভ হলেই বিয়েটা সেরে নেওয়ার কথা ভাবা যাবে। এলিনা গ্যারেজ থেকে নিজের বাইকটা বের করতে যাচ্ছিল, রাইয়ান বাধা দিল।
ইঙ্গিত করল নিজের বাইকে ওঠার। উঠে বসল এলিনা।
রাতের বাতাস কেটে তারা যখন বেরিয়ে যাচ্ছিল সাক্ষী রইল শুধু অফিসের দারোয়ান। সে হাসিমুখেই বিদায় দিল ওদেরকে।
মাসে দু তিনদিন এরকম হয়। রাইয়ান নিজের বাইক নিতে দেয় না এলিনাকে।
সেরকম রাতগুলোর পরদিন সকালে রাইয়ানের ফ্ল্যাট থেকে অফিসে আসে এলিনা। চোখে মুখে জড়িয়ে থাকে রাতের উত্তেজনার ক্লান্তি আর প্রিয় পুরুষের আদরের লালিমা, নতুন বউদের মুখে যেমনটা দেখা যায়।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here