তোমায়_পাবো_বলে,পর্ব_১৭
নিশাত_জাহান_নিশি
“আপনার সাহস হয় কি করে? আমার হাত ধরে আমাকে এই শুনশান জায়গায় টেনে আনার?”
মিলি আপুর অতি রুক্ষ কন্ঠের ধ্বনি শ্রবণ করা মাএই আকস্মিক দৃষ্টিতে আমি এবং পরশ ভাই দুজন দুজনের মুখ দেখা দেখি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভ্রু যুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে পরশ ভাই সন্দিহান গলায় বললেন,,
“মিলির কন্ঠ মনে হলো না?”
আমি মাথা দুলিয়ে হ্যাঁ সূচক সম্মতি জানাতেই পরশ ভাই আমার ডান হাতটা চেঁপে ধরে আমায় নিয়ে সোজা বিপরীত পাশের প্যান্ডেলের দিকটায় কদম বাড়ালেন। অমনি আমাদের দৃষ্টিতে স্পষ্ট হলো মিলি আপু এবং পিয়াস ভাইয়ার অস্তিত্ব। মিলি আপু অত্যধিক রাগে ফুসফুস করছেন। হাব ভাব দেখে মনে হচ্ছে যেনো এক্ষনি পিয়াস ভাইকে কাঁচা চিবিয়ে খেয়ে নিতে পারবেন। কোনো রূপ তৈল, মসলা ছাড়াই গিলে একদম হজম করে নিবেন! পিয়াস ভাই মাথা নুঁইয়ে অপরাধী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি এবং পরশ ভাই উৎসুক ভঙ্গিতে আর ও এক কদম অগ্রে বাড়াতেই পিয়াস ভাইয়ার অতি নিম্ন গলার স্বর আমাদের কর্নকুহরে মিহি ভাবে ভেসে এলো। খর্বাকৃতির মুখমন্ডলে যেনো পিয়াস ভাই স্বাভাবিক গলায় আপুকে বললেন,,
“আমি ইচ্ছে করে তোমাকে এখানে টেনে আনি নি মিলি। তোমার পিঠের দিকটায় ভুলবশত লেহেঙ্গার একটা হুক খুলে গেছে। নজরে পড়তেই আমি তোমাকে এখানে টেনে নিয়ে এলাম। বাইরের ছেলেরা দেখলে আমার খারাপ লাগত, তোমার ও সম্মান হানি হতো!”
মিলি আপু থমকালেন। রাগটা যথেষ্ট আয়ত্তে এনে আপু লেহেঙ্গার ঠিক পিঠের দিকটায় হাত বাড়ালেন। হুক খোলার বিষয়টা আঁচ পাওয়া মাএই আপু মুখে কাঁচুমাচু ভাব ফুটিয়ে মাথা নুঁইয়ে রাখা পিয়াস ভাইকে শুধিয়ে বললেন,,
“কি হবে এবার পিয়াস? হুকটা কে লাগিয়ে দিবে?”
সহানুভূতি নিয়ে আমি তড়িঘড়ি করে পরশ ভাইয়ার হাতের বাঁধনটা ছাড়িয়ে মিলি আপুর উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই পরশ ভাই পুনরায় আমার ডান হাতটা চেঁপে ধরে দাঁতে দাঁত চেঁপে আমায় শাসিয়ে বললেন,,
“আর ইউ ক্রেজি টয়া? তুমি এখন মিলিকে হেল্প করতে যাবে? মাথায় ঘিলু নেই তোমার?”
ঘাড় ঘুড়িয়ে আমি নির্বোধ গলায় শুধালাম,,
“মানে?”
“পিয়াস আছে তো ওখানে নাকি? ব্যাপারটা পিয়াসকেই বুঝতে দাও। একটু সুযোগ দাও পিয়াসকে। মিলির সাথে প্রেমটা জমানোর।”
বিষয়টা মগজে সূক্ষ্মভাবে ঢুকতেই আমি মৃদ্যু হেসে বললাম,,
“তা ও অবশ্য ঠিক। একটু তো সুযোগ দেওয়াই উচিত!”
পুনরায় পরশ ভাইয়ার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম আমি। পরশ ভাই আমার ডান হাতটা এখন ও শক্ত বাঁধনে চেঁপে ধরে আছেন। মনে হচ্ছে যেনো হাতের বাঁধনটা কিঞ্চিৎ ঢিলে করলেই আমি কোথাও একটা হারিয়ে যাবো। আর বুঝি আমায় খুঁজে পাওয়া যাবে না! এতোটা ও ভীতু বুঝি মানুষ হয়? পৃথিবীর সমস্ত প্রেমিক পুরুষরাই বুঝি তাদের প্রিয়তমাদের হারানোর ভয়ে এতোটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়? এতটুকু সাহস যদি নাই থাকে তবে কেনো তারা ভালোবাসার মতো অতি দুঃসাহসিক জালে পা বাড়ান?
পরশ ভাইয়ার উৎসুক দৃষ্টি যেমন পিয়াস ভাইয়া এবং মিলি আপুর দিকে। তেমনি আমার প্রেমকাতর দৃষ্টি পরশের দিকে! উফফফস পরশ ভাই হবে! আচ্ছা? এখন তো আমি লোকটাকে ভালোবাসি তাই না? তাহলে ভাই বলে কেনো ডাকব? প্রেমিককে আবার কেউ ভাই বলে সম্বোধন করে নাকি? সিদ্ধান্ত ফাইনাল। এবার থেকে আমি ও পরশকে পরশ বলেই সম্বোধন করব!
মৃদ্যু হেসে আমি পরশের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পিয়াস ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে এলাম। এমা! এতো দেখছি পিয়াস ভাই অতি যত্নের সহিত ঠোঁটের কোণে এক সম্মোহনী হাসি ঝুলিয়ে মিলি আপুর পিঠের উন্মুক্ত ঐ হুকটা লাগিয়ে দিচ্ছেন! অন্যদিকে মিলি আপু ও মাথা নুঁইয়ে বিষয়টাতে রীতিমত সায় জানাচ্ছেন। তবে কি পিয়াস ভাইয়ার প্রতি তৈরী ভালো লাগা থেকে মিলি আপু বিষয়টাকে অতি স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন নাকি আপাতত বিপদ থেকে পরিএান পাওয়ার জন্য পিয়াস ভাইকে বাধ্য হয়ে মেনে নিচ্ছেন?
হুকটা লাগানো শেষ হতেই মিলি আপু লেহেঙ্গার নিচের অংশটা দু হাত দিয়ে টেনে ধরে পিছু ঘুড়ে পিয়াস ভাইয়ার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কৃতজ্ঞতার স্বরে বললেন,,
“থ্যাংকস পিয়াস।”
পিয়াস ভাইকে প্রত্যত্তুর করার সামান্য সময় টুকু না দিয়েই আপু দৌঁড়ে আমাদের দিকটায় অগ্রসর হলেন। ইতোমধ্যেই পরশ ঝড়ের বেগে আমায় নিয়ে প্যান্ডেলের ঠিক অপর পাশটায় চলে এলেন। হাঁফিয়ে উঠা গলায় আমি অস্থির দৃষ্টিতে মিলি আপুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে বললাম,,
“ধ্যাত্তেরিকা। আপু তো পিয়াস ভাইকে পাত্তাই দিলেন না!”
পরশ ভাই কয়েক দফা রুদ্ধশ্বাস নির্গত করে আচমকা আমার বাঁ গালে দীর্ঘ এক চুমো এঁকে দাঁত কপাটি কেলিয়ে হাসতে হাসতে প্রস্থান নিলেন। বেকুব হয়ে আমি মুখটা হা করে আদর পাওয়া গালটাতে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম৷ ঘোর কাটিয়ে উঠতেই আমি খড়তড় দৃষ্টিতে অসভ্য লোকটার যাওয়ার পথে তাকিয়ে বললাম,,
“চূড়ান্ত অসভ্য এই লোক। সুযোগ পেলেই চলে! সদ্ব্যবহার করেই ছাড়বে!”
রাগে হনহনিয়ে আমি লেহেঙ্গা সামলে স্টেইজের দিকে পা বাড়ালাম। অমনি দেখলাম হলুদের অনুষ্ঠান অলরেডি শুরু হয়ে গেছে। বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠরা দল বেঁধে রুম্পা আপুকে হলুদ পড়াতে ব্যস্ত প্রায়। আম্মু, চাচীমনিরা এক এক করে আপুকে হলুদ মাখিয়ে আন্টি, পিয়ালী আপু এবং পায়েলকে স্টেইজে বসিয়ে দিলেন। হুট করেই আন্টি উনাদের মাঝে মিলি আপুকে ডেকে নিয়ে এলেন। মিলি আপু খুশিতে একদম গদগদ হয়ে আন্টির পাশ ঘেঁষে বসলেন। দৃষ্টি ঘুড়িয়ে আমার বাঁ পাশে তাকাতেই পরশ ভাই, হিমেশ ভাই, পিয়াস ভাই, জিহাদ ভাইকে দেখতে পেলাম। চারজন গোলাকৃতির হয়ে দাঁড়িয়ে কোনো একটা বিষয় নিয়ে খুব হাসাহাসি করছেন। পরশ ভাইয়ার হাসি যেনো থামছেই না। রাগে আমার গাঁ পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। মিলি আপুকে নিয়ে আন্টির মাতামাতি আমার মোটে ও পছন্দ হচ্ছে না। সেই রাগটা আমার পরশটার উপর ঝাঁড়তে বড্ড ইচ্ছে করছে! এর মধ্যেই আমার সব কাজিনরা আমার পাশে দাঁড়িয়ে ব্যতিব্যস্ত গলায় আমায় বলল,,
“রুম্পা আপুকে তাড়াতাড়ি হলুদটা পড়িয়েই আমরা কিন্তু নাচটা শুরু করে দিবো আপু। সবাই আমাদের নাচ দেখার জন্য সুপার এক্সাইটেড হয়ে আছে!”
“ওকে। তোরা মিউজিকটা বাজিয়ে দে। মিলি আপুদের পরে আমরা স্টেইজে উঠব!”
স্টেইজের দিকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়তেই মেজাজটা চরম বিগড়ে গেলো। হ্যাংলা লোকটাকে একটু আগেই দেখেছিলাম আমার বাঁ পাশে। এক্ষনি আবার দেখছি মিলি আপুর পাশে! কি সুন্দর হেসে হেসে হলুদ পড়াচ্ছেন মিলি আপুকে। বিয়ের কনে কে রেখে ইনি মিলি আপুকে হলুদ পড়াতে ব্যস্ত হয়ে আছেন! মানা যায় এসব? মিলি আপু তো পারছেন না খুশিতে আটখানা হয়ে একদম এই হ্যাংলা লোকটার কাঁধে চেঁপে বসতে। সামান্য সুযোগ পেলেই হয়তো কোলে উঠে বসবে! নিশ্চয়তা নেই কিন্তু! আন্টি তো টুকুর টুকুর এদের দুজনকে দেখছেন আর মিটিমিটি হাসছেন। সিনটা খুব মনে ধরেছে উনার! রাগে আমার গাঁ পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এক্ষনি স্টেইজে উঠে ঐ চরম হ্যাংলা লোকটাকে প্যান্ডেলের বাঁশ উঠিয়ে আপাদমস্তক বাঁশ পেটা করতে! একবার এসে দেখ না আমার কাছে! আজ তোর কি হাল করি আমি! মুখে মুখেই শুধু প্রেমিক হবার খৈ ফুটে। অন্যদিকে আবার পর নারীকে ও চাই তাই না?
রাগে অতি ক্রুদ্ধ হয়ে আমি বাড়ির সদর দরজার দিকে গন্তব্য পথ নির্ধারন করতেই হাতে হঠাৎ পুরুষালি হাতের টান অনুভব করলাম। পিছু ঘুড়ে তাকাতেই দেখলাম পরশ ক্রুর হেসে আমায় সম্মোহনী স্বরে বললেন,,
“তো চলুন! একটা যুগলবন্দী নাচ হয়ে যাক?”
লোকটার দিকে তাজ্জব দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই লোকটা ইশারা করে স্পিকারের দায়িত্বে থাকা জাহিদ ভাইকে বললেন,,
“মিউজিকটা ছাড়ুন!”
জিহাদ ভাই দাঁত কপাটি কেলিয়ে হেসে মিউজিক অন করতেই আমার সব কাজিনরা হাসি মুখে প্রস্তুত হয়ে গেলো নাচ করতে। সবাই সবার পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। মিলি আপু দৌঁড়ে এলেন স্টেইজ থেকে। পিয়ালী আপু এবং পায়েল ও ছুটে এসে পরশ ভাইয়ার ঠিক পেছনের দিকটায় দাঁড়ালেন। পিয়াস ভাই হুড়মুড়িয়ে এসে মিলি আপুর সামান্য পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন। হিমেশ ভাই আড়ষ্ট ভাব নিয়ে জিহাদ ভাইয়ার পাশাপাশি দাঁড়াতেই জিহাদ ভাই মৃদ্যু হেসে পরশ ভাই এবং বড় আপু সমেত আমার পাশে দাঁড়ালেন। সঙ্গে সঙ্গেই ভিডিও ম্যানরা, ক্যামেরা ম্যানরা আমাদের দিকে ফোকাস করতে আরম্ভ করলেন। স্টেইজে অবস্থানরত সব আত্নীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশিরা, বাচ্চা-কাচ্চারা কর তালির মাধ্যমে আমাদের অনুপ্রেরণা যোগাতে উৎসুক হয়ে উঠলেন। অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে এখনো আমি পরশের দিকে তাকিয়ে আছি। কিছুতেই যেনো বিশ্বাস হচ্ছে না পরশ নাচ করবেন! তাও সবাইকে নিয়ে। মুহূর্তের মধ্যেই পরশ আমার হাতটা ছেড়ে মিউজিকের তালে নেঁচে উঠলেন। মিউজিকটা হলো,,
“হু আভি গায়ি রাত
আনে ভুলো বাদিবাত
প্রেমেনিয়া মসাম ছে,,,
পরশ আমাকে কেন্দ্র করে স্টেপ বাই স্টেপ নেচে চলছেন। পরশের সাথে তাল মিলিয়ে বাকিরা ও নেচে উঠতে দু মিনিট ও বেগ নিলো না। নিজেকে আর সামলে রাখতে পারছিলাম না। মৃদ্যু হেসে আমি ও সবার সাথে নেচে উঠলাম। স্টেইজ পুরো জমজমাট হয়ে উঠল মুহূর্তের মধ্যেই। পরশ এতো নিঁখুতভাবে নাচের প্রতিটা স্টেপ তুলছিলেন মনে হচ্ছিলো যেনো সত্যিই কোনো ডান্সারের সাথে আমি বা আমরা নাচ করছি! লোকটা এতো সুন্দর নাচতে পারে আগে জানা ছিলো না সত্যি! সিনেমার হিরোদের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হচ্ছে না লোকটাকে। তবে বাস্তব জীবনে আমি ও হিরোর দেখা পেয়ে গেছি? স্বপ্ন কি তবে আমার ও সত্যি হয়েছে? কি জানি! হব হয়তো।
নাচের মাঝখানে পরশ ভাই হঠাৎ স্টেইজ থেকে রুম্পা আপুকে হাত ধরাধরি করে উঠিয়ে নিয়ে এলেন। রুম্পা আপু ও কম যান না! ঠিক তাৎক্ষণিক নাচের স্টেপ তুলে নিলেন। প্রথম অবস্থায় বাড়ির মুরুব্বিরা একটু অমত পোষন করলে ও খানিক বাদে পরশের ইশারায় সবাই দমে গেলেন। রুম্পা আপুর নাচকে সায় জানালেন। নাচের মধ্যিখানে অবশ্য পিয়াস ভাই অনেক চেষ্টা করেছেন মিলি আপুর কাছাকাছি যাওয়ার। তবে মিলি আপু প্রতিবারই পিয়াস ভাইকে উপেক্ষা করে পরশের দিকে ধাবিত হয়েছেন। পরশ ও কম যান না! মিলি আপুকে ঠিক উপেক্ষা করে শেষ অবধি আমার কাছেই ধরা দিয়েছেন! প্রতিবার কোনো না কোনো ভাবে আমার চোখ পড়ছে হিমেশ ভাইয়ার দিকে! আপু এবং জিহাদ ভাইকে জুটি হিসেবে দেখে হিমেশ ভাই বরাবরই বিষন্ন মনে মাথা নুঁইয়ে নিয়েছেন। হাজার হলে ও তো প্রাক্তন তাই না? খারাপ তো একটু আধটু লাগবেই! এসবের মাঝে একটা জিনিস অবশ্য আমার দৃষ্টির বাইরে যায় নি! তা হলো, পায়েল! পায়েলকে অনেক্ষন যাবত খেয়াল করছি হিমেশ ভাইয়ার কাছাকাছি আসতে। আড়চোখে হিমেশ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে মৃদ্যু হাসতে। কখনো নাচের স্টেপের বাহানা ধরে হিমেশ ভাইয়ার বুকে লুটিয়ে পড়তে! তো কখনো হিমেশ ভাইয়ার হাতে হাত রাখতে। হিমেশ ভাই যদি ও বিষয়টাকে নিতান্ত স্বাভাবিক ভাবে ধরে নিয়েছিলেন, তবে আমার মন বলছে পায়েল বিষয়টাকে কোনো মতেই স্বাভাবিক ভাবে নিচ্ছে না! তবে কি পায়েলের মনে হিমেশ ভাইয়াকে নিয়ে সামথিং সামথিং চলছে?
নাচের প্রায় শেষ পর্যায়ে আসতেই পরশ ভাই কায়দা করে এক গাঁধা হলুদ এনে আমার মুখে লেপ্টে দিলেন। উপস্থিত সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। সবাই অদ্ভুত এক ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টিতে আমায় দেখছে। দেখতে নিশ্চয়ই হলুদ ভূত লাগছে আমায়। ক্ষুব্ধ হয়ে আমি ও হাত ভর্তি হলুদ এনে পরশ ভাইয়ার মুখ হতে শুরু করে পাঞ্জাবি অবধি মেখে দিলাম। যাও! এবার বুঝো ঠেলা। সং সেজে এবার তুমি ও ঘুড়তে থাকো। আমাদের বিনোদন দাও। ক্ষনিকের মধ্যেই লোকটা অতি ক্ষিপ্র হয়ে দৌঁড়ে আমার দিকে কদম বাড়াতেই আকস্মিক কোথা থেকে যেনো মিলি আপু এসে অট্ট হেসে পরশ ভাইয়ার মুখে হলুদ লেপ্টে দিলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য পরশ ও গম্ভীর মুখে বিনিময়ে আপুর গালে হালকা হলুদ মেখে দিলেন। আনন্দে আপ্লুত হয়ে আপু লজ্জায় লাল রঙ্গা হয়ে নাচ রেখেই দৌঁড়ে বাড়ির ভেতর ঢুকে গেলেন। পিয়াস ভাই হাতে হলুদ নিয়ে বিষন্ন মনে আপুর যাওয়ার পথে তাকিয়ে আছেন। বোধ হয় হাত ভর্তি হলুদটা এনেছিলেন, আপুকে লাগাবেন বলে! মনটা কেনো জানি না আমার ও বড্ড খারাপ হয়ে গেলো। আমার পিয়াস ভাই কোন দিক থেকে খারাপ? কেনো আপু পিয়াস ভাইয়াকে রিফিউজ করে অহেতুক পরশ এবং আমার মাঝখানে আসছেন? আন্টির সেল্টারেই কি আপু এতোটা বেড়ে গেছেন? এতোটা সাহস এবং জোর খাটাতে পারছেন?
,
,
মধ্যরাত ২ টো বাজছে ঘড়িতে। ফ্রেশ হয়ে মাএ ড্রইং রুমে এলাম সবাই। লম্বা শাওয়ার নেওয়ার পরে ও হলদেটে দাগ যেনো এখনো আমার মুখ থেকে ধূলিসাৎ হচ্ছেই না। ডাইনিং টেবিল জুড়ে বাড়ির সমস্ত অতিথিদের বসানো হয়েছে। সবাই পেট পূজোয় ব্যস্ত প্রায়। একটা চেয়ার ও ফাঁকা নেই যে আমরা বাড়ির সদ্যসরা কেউ বসব। সোফায় যে যার মতো খাবারের প্লেইট হাতে নিয়ে খেয়ে চলছে আমার কাজিনরা। সবাই বেশ ক্ষুধার্ত দেখেই বুঝা যাচ্ছে। চরম ক্ষুধা মন্দা নিয়ে আমি ও রান্না ঘরে প্রবেশ করে প্লেইট ভর্তি বিরিয়ানী নিয়ে যেই না রান্নাঘর থেকে বের হবো অমনি আকস্মিকভাবে কোথা থেকে যেনো পরশ আমার সম্মুখীন হলেন। বাঁকা হেসে লোকটা ক্ষনিকের মধ্যে আমার হাত থেকে প্লেইটটা কেঁড়ে নিয়ে দৌঁড়ে সোজা সিঁড়ি বেয়ে ছাদের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বেশ তিরিক্ষি মেজাজে পরশকে অনুসরন করে সিঁড়ি বেয়ে দু তলায় উঠতেই পেছন থেকে মনে হলো আন্টি নাম ধরে আমায় ডাকছেন! উদগ্রীব চিত্তে আমি পিছু ফিরে তাকাতেই আন্টির রাগী মুখটা আমার দৃষ্টিলোকন হলো। চোয়াল শক্ত করে আন্টি আমায় শুধিয়ে বললেন,,
“কোথায় যাচ্ছ তুমি?”
মাথা নুঁইয়ে আমি কম্পিত গলায় বললাম,,
“ছাছাছাদে!”
“ছাদে কি?”
“পরশ আমার খাবার প্লেইটটা নিয়ে গেছেন!”
“কি বললে তুমি? পরশ?”
“পপপরশ ভাই!”
“আচ্ছা? তুমি কি বুঝতে পারছ না? পরশের সাথে তোমার মেলামেশাটা আমার পছন্দ নয়?”
মাথা উঁচিয়ে আমি জড়তা ভুলে দৃঢ় কন্ঠে বললাম,,
“পরশ ভাই আমাকে ভালোবাসেন আন্টি! চাইলে ও আপনি পরশ ভাই থেকে আমাকে আলাদা করতে পারবেন না!”
“ইউ জাস্ট শাট আপ। আমি যা বলব, পরশ ঠিক তাই শুনবে। পরশ মিলিকেই বিয়ে করবে!”
“কিন্তু পরশ তো মিলি আপুকে ভালোবাসেন না আন্টি! ভালোবাসা ছাড়া কাউকে বিয়ে করা যায় নাকি?”
“বিয়ের পর ভালোবাসা তৈরি হয়ে যাবে। আমি তোমাকে ওয়ার্ন করছি টয়া। পরশের ধারে কাছে ও একদম ঘেঁষবে না। পরশের ভালোবাসাকে ও প্রশ্রয় দিবে না!”
“আন্টি প্লিজ আমার কথা টা বুঝার চেষ্টা করুন। আমি ঐদিন যা বলেছিলাম সব ভুল বলেছিলাম। অবিবেচকের মতো একটা মানুষকে ভালো ভাবে না জেনে না বুঝেই তার সম্পর্কে কটুক্তি করেছিলাম। তার জন্য আমি ভীষন অনুতপ্ত। প্রতিনিয়ত আমি ভেতরে ভেতরে গুমড়ে মরছি। প্লিজ আন্টি আমায় ক্ষমা করে দিন। যা হয়েছে ভুলে যান প্লিজ। আমি পরশের বউ হতে রাজি। আপনার ঐদিনের কথা রাখতে রাজি।”
“মিলির বাবা-মায়ের সাথে আমি আগামী পরশুই পরশের বিয়ে সম্পর্কে কথা বলব। তোমার হাজার কাকুতি মিনতিতে ও আমার মত বদলাবে না! কেনো বলো তো? তোমাদের মতো মেয়ে মানুষদের আমার খুব ভালো মতে চেনা আছে। তোমরা সেকেন্ডে সেকেন্ডে রূপ বদলাতে পারে! দেখা গেলো বিয়ের পর আবার বললে,,
“আমি ডিভোর্স চাই! এই ছেলেকে আমার পছন্দ না। না জেনে না বুঝেই ছেলেটাকে আমি বিয়ে করেছি। এখন তার সাথে আমার বনাবনি হচ্ছে না। নতুন কাউকে চাই আমার! পরিশেষে যাই হোক, হাতে ধরে আমি আমার ছেলের সাজানো জীবনটা নষ্ট করতে পারব না!”
শো শো বেগে আন্টি প্রস্থান নিলেন। পেছন থেকে আমি কান্নাজড়িত গলায় আন্টিকে অনেক বার ডেকে বললাম,,
“আন্টি প্লিজ আর একটা সুযোগ দিন আমায়! অন্তত একটা বার আমার মনে কথাটা বুঝার চেষ্টা করুন। প্লিজ আন্টি থেমে যান। একটা বার আমার কথাটা শুনুন!”
হাজার বার ডাকার পরে ও আন্টিকে মানাতে পারলাম না। আন্টি সম্পূর্ণ নারাজ আমার কথা শুনতে। পিছু ফিরে একটি বার ও আমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধ করলেন না। আত্নসম্মান বিসর্জন দিয়ে আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম আন্টির রাগ ভাঙ্গাতে। একবার ও ভেবে দেখলাম না আন্টি আমার চরিএ সম্পর্কে ঠিক কতোটা কটুক্তি করে গেছেন! কতোটা আঘাত করেছেন আমায়! কাঙ্ক্ষিত ভয় এবং বিশেষ কিছু হারানোর যন্ত্রনায় আমার আঁখি পল্লবে বৃষ্টির আনাগোনা শুরু হতেই পেছন থেকে পরশ আমার কোমড় জড়িয়ে ধরলেন। ঘোর লাগা স্বরে লোকটা আমার ঘাড়ে মুখ ডুবিয়ে ভালোবাসি কথাটা বলতেই ফট করে আমার রাগটা যেনো মাথায় উঠে বসল। জোর পূর্বক পরশের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে আমি পরশের সম্মুখস্থ হলাম। অশ্রুবিসর্জন করে আমি পরশের বাঁ গালটা বরাবর সজোরে এক চড় বসিয়ে বললাম,,
“সময় অসময় বুঝেন না আপনি? এই আপনার ভালোবাসা?”
ঘটনার আকস্মিকতায় পরশ তব্দা লেগে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অতঃপর টলমল দৃষ্টিতে আমার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললেন,,
“টাইম মেন্টেইন করে আমি ভালোবাসতে পারব না। ভালোবাসার প্রতিটা সময়ই আমার জন্য সমান!”
“আই হেইট ইউ পরশ। আই রিয়েলি হেইট ইউ!”
ঢুকড়ে কেঁদে আমি দুতলার সিঁড়ি থেকে প্রস্থান নিয়ে প্রথম তলার সিঁড়ির দিকে অগ্রসর হতেই পরশ পেছন থেকে আহত গলায় বললেন,,
“সত্যিই ঘৃনা করো আমায়?”
“হুম ঘৃনা করি। প্রচনননন্ড ঘৃনা করি। আপনার মুখটা ও দেখতে চাই না আমি!”
চলবে….?